১০
সেদিন থেকে এক নতুন জীবন শুরু হলো। তার স্মৃতি আমার কাছে আজও সজীব। প্রতিটি দিন নিয়েই এত কথা আমি লিখতে পারতাম যে হয়তো একটা গোটা খাতাই ভরে যেতো। আগস্ট মাসের প্রথম দিকটা ছিল যেন অবকাশ যাপনের সময়। জামা কাপড় পাল্টানো, ডায়েরি লেখা আর ঘুমানোর জন্য ছাড়া আমি আমার ঘরেই ঢুকতাম না। মৈত্রেয়ী বি. এ. পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি ওকে সাহায্য করতাম। যদিও সংস্কৃত আমি একটুকু বুঝতে পারতাম না, তবু যখন ওর বৃদ্ধ সংস্কৃত শিক্ষক আসতেন, আমি শকুন্তলা নাটকের ব্যাখ্যা শোনার জন্য ওর পাশে কার্পেটে বসে পড়তাম। বৃদ্ধ পণ্ডিত চোখে কম দেখতেন, আর সেই সুযোগে আমি মৈত্রয়ীকে লুকিয়ে চুরিয়ে আদর করতাম, জ্বালাতন করতাম।
মৈত্রেয়ী আমাকে কালিদাসের রচনা বুঝিয়ে দিতো। কালিদাসের কাব্যে বিশেষ করে প্রেমের অংশগুলো ও ব্যাখ্যা করতো। যেন পরোক্ষভাবে নিজের কথা বলে যেতো ও। সঙ্গীত, সাহিত্য বিশেষ করে বাংলা কবিতা যা যা ও ভালোবাসতো, ক্রমশ আমিও তা ভালোবাসতে শুরু করলাম। বৈষ্ণব কবিতার মানে বোঝার চেষ্টা করতাম। সবচেয়ে মোহিত হতাম শকুন্তলা নাটকের অনুবাদ পড়ে। তাক ভর্তি পদার্থবিজ্ঞান, গণিতের বইয়ের ওপর আকর্ষণ আমার ক্রমশ চলে যাচ্ছিল।
কয়েকদিন পরে ও আমাকে বললো, ওর আরও কিছু স্বীকারোক্তি নাকি বাকি আছে। আমার প্রতি ওর ভালোবাসায় আমার কোনোই সন্দেহ ছিল না। যে-কোনো সময়ই, ওর উপস্থিতি ছিল আমার কাছে দারুণ কিছু প্রাপ্তির মতো। তাই ও কিছু বলার আগেই ওকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করলাম।
–না, আগে আমার কথা শুনতেই হবে। তোমার সমস্ত কথা জানা দরকার। আচ্ছা, তুমি কি আগে কখনও এরকম করে ভালোবেসেছো?
–না, কোনো দিনও না।
তাড়াতাড়ি উত্তর দিলাম আমি। সত্য, মিথ্যা বিচার না করেই। অথবা হয়তো এরকমই ভেবেছিলাম, কী মূল্য আছে আমার কৈশোরের সেই ইন্দ্রিয়গত ক্ষণিকের ভালোলাগার। অন্তত এই সব-ভোলানো পাগল-করা ভালোবাসার কাছে! ও বললো, আমিও তাই ভাবি। কিন্তু একটা অন্যরকম ভালোবাসার কথা কি তোমায় বলবো?
—তোমার ইচ্ছে।
–আমি একটা গাছকে ভালোবাসতাম। আমাদের দেশে এই গাছের নাম সপ্তপর্ণী।
—ওটাকে ভালোবাসা বলে না।
—না, ওটা ভালোবাসাই। ছবুও ওর গাছকে ভালোবাসে। আমার গাছটা ছিল বড় গাছ। সেই সময় আমরা বালীগঞ্জে থাকতাম। ওখানে খুব বড় বড় গাছ ছিল। আমি প্রেমে পড়লাম বিশাল এক সপ্তপর্ণী গাছের সঙ্গে। আমি গাছটাকে রোজ না দেখে থাকতে পারতাম না। আমি রোজ ওকে আলিঙ্গন করতাম, কথা বলতাম ওর সঙ্গে। গাছটার গায়ে আমি চুম্বন করতাম, ওর কাছে গিয়ে আমি কাঁদতাম। মনে মনে কবিতা রচনা করে আমি ওকে আবৃত্তি করে শোনাতাম। ও ওর পাতা দিয়ে আমার গায়ে মাথায়, মুখে ঠাণ্ডা স্পর্শ দিতো। আমি একা ঘুমোতে পারতাম না। গাছটার কথা ভাবতে ভাবতে আমার অসুখ করে গেলো। আমার বুকের অসুখের সূত্রপাতও সেই সময় থেকে। আমায় অনেক দিন বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। বিছানায় রোজ আমাকে ওই গাছের টাটকা ডাল-পাতা এনে দিতে হতো।
আমার মনে হচ্ছিল যেন কোনো রূপকথার গল্প শুনছি। সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করতে পারছিলাম, ও যেন অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। এক জটিল মানসিক গঠন ছিল ওর। বুঝতে পারছিলাম একমাত্র শিক্ষিত সভ্য মানুষরাই স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন হতে পারে। যে ভারতীয়দের আমি এত ভালোবাসি, ওদেরই একজন হয়ে উঠতে চাই, তাদেরই মন এত জটিল, দুর্ভেদ্য যে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারতাম না।
মৈত্রেয়ীর স্বীকারোক্তি আমায় কষ্ট দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ও একই সঙ্গে অনেক কিছুকেই ভালোবাসতে পারে। আমি হৃদয়ের অংশীদারী কারবারে বিশ্বাস করতাম না, চাইতাম ওর সমগ্ৰ হৃদয় জুড়ে শুধু একজনেরই অস্তিত্ব থাকবে, আর সেটা হবো আমিই। তাই ওর কথাগুলো যে আমায় কতখানি কষ্ট দিচ্ছিল তা সহজেই অনুমেয়। আমি ওর কথাগুলো যে আমায় কতখানি কষ্ট দিচ্ছিল তা সহজেই অনুমেয়। আমি ওর স্মৃতি থেকে কিছুই মুছে দিতে পারবো না। কী করে এক কিশোরী তার শরীর-মন নিবেদন করতে পারে একটা গাছকে, কী করে একটা গাছের সঙ্গে একজন মানুষের মানসিক আদান-প্রদান ঘটতে পারে, কিন্তু আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। ও আমাকে সেই গাছের পাতা আর ডাল এনে দেখালো। সেগুলো শুকিয়ে গিয়েছিল কিন্তু এক মৃদু সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। আমি আমার ক্রোধ সম্বরণ করতে পারলাম না। ডাল, পাতা সব দুহাতে ছিন্ন ভিন্ন করে গুঁড়িয়ে ধুলো করে দিলাম। আমি ভাবতে পারছিলাম না, ভালোবাসায় একটা গাছ আমার চেয়ে এগিয়ে আছে। কোথায় গেল আমার বিশ্বাস, যে ও আমাকেই শুধু ভালোবাসে, ওর জগৎ জুড়ে শুধু আমারই অস্তিত্ব!
ও আমার হাতে চুমু খেতে লাগলো। যেন নিশ্চিত করতে চাইলো যে ও নিজেও এই চেয়েছিল। ও সব ভুলে গেছে। ওর গরু, ওর গাছ ওর এখনকার ভালোবাসার সঙ্গে ওইসব ভালোবাসার কোনো মিল ছিল না। আমি চুপ করে ছিলাম। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছিল। মৈত্রেয়ী কাঁদতে কাঁদতে বললো, তোমাকেই যদি একমাত্র ভালো না বাসতাম, আমি কখনই এসব কথা স্বীকার করতে পারতাম না। তোমাকেও বলতে হবে সেই সব মেয়েদের কথা যাদের সঙ্গে তুমি আগে মিশেছো, ভালোবেসেছো।
—আমি কোনো দিনই কাউকে ভালোবাসিনি।
ও আশ্চর্য হয়ে গেল।
—তুমি এত দিন প্রেম ছাড়া বেঁচে আছো?
আমি ইতস্তত করছিলাম। মৈত্রেয়ী আমার মন পড়তে পারলো।
–না, আমি সেই সব মেয়েদের কথা জানতে চাই না যাদের সঙ্গে তোমার শারীরিক সম্পক ছিল। গুগুলো কলঙ্ক, পাপ, ভালোবাসা নয়।
ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। সেই সময় ওদের বাড়ির ড্রাইভার বারান্দা ধরে এগিয়ে আসছিল, হঠাৎ কান্নার আওয়াজ শুনে অবাক্ হয়ে ও মৈত্রেয়ীকে দেখলো আর ভয় পেয়ে সেখান থেকে দ্রুত চলে গেল। পরে জেনেছিলাম ড্রাইভারটা আমাদের ওপর নজর রাখতো। মৈত্রেয়ী মুখের ওপর শাল চাপা দিয়ে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎই বলে উঠলো, আমায় কষ্ট দিয়ে তোমার কী লাভ হচ্ছে? তোমার কি মনে হচ্ছে যে. আমি দেহে এবং মনে শুদ্ধ নই?
আমি বজ্রদের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। ওর কথাগুলোই আমার বুক ভেঙে দিচ্ছিল, আর উল্টে ওই বলছে যে আমি ওকে কষ্ট দিচ্ছি? আমি কোনো উত্তর দিলাম না। আমি ওকে পাগলের মতো ভালোবাসতাম আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছিলাম আমার মন থেকে ওর অতীতকে মুছে ফেলতে। অপরপক্ষে ও ক্রমাগতই সেগুলোকে আমার সামনে মেলে ধরছিল।
সেই দিনই বিকেলে ও আর একটা ঘটনার কথা বললো। ওর তখন বারো-তেরো বছর বয়স। ওর মা ওকে নিয়ে পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে গিয়েছিলেন। মন্দিরের অন্ধকার গলিপথগুলো দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ কে একজন ওর গলায় একটা মালা পরিয়ে দেয়। ও পরিষ্কার বুঝতে পারেনি মানুষটাকে। আলোয় এসে মিসেস সেন মালাটি দেখলেন। দেখে ওর গলা থেকে সেটা খুলে নিয়ে নিজের হাতে রাখলেন। মন্দিরের অভ্যন্তরে যখন ওরা বিগ্রহ প্রদক্ষিণ করছিল তখন প্রত্যেকবার প্রদক্ষিণের মধ্যেই কেউ ওকে একটা করে মালা পরিয়ে দিচ্ছিল। প্রদক্ষিণ শেষে দেখা গেল মিসেস সেনের হাতে ছখানা মালা জমা হয়েছে। উনি প্রচণ্ড রেগে চেঁচামেচি করে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। কারণ ওই মাল্য-প্রদানের অর্থ ছিল প্রায় বিবাহের সমান। ওঁর চেঁচামেচি শুনে একজন যুবক অন্ধকার থেকে সামনে এগিয়ে এলো। অসম্ভব রূপবান ছিল সেই যুবক। যুবকটি নিচু হয়ে মিসেস সিনের পায়ে হাত দিয়ে বললো, মা’। এইটুকু বলেই যুবক ভিড়ে আর অন্ধকারে মিশে গেল। যুবকটির রূপের বর্ণনা আমি শুনতে পারছিলাম না। আমার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল।
বহু বছর ধরে মৈত্রেয়ী সেই যুবকের স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসার পরও। এই কথা শুনে আমার মনে হলো রবীন্দ্রনাথকে মৈত্রেয়ী বোধ হয় এখনও ভুলতে পারেনি। তাহলে…ভবিষ্যতে এমনও কি হতে পারে যে আরও একজন কেউ এলো এবং মৈত্রেয়ী তাকেও একই সঙ্গে ভালোবেসে চললো আমায় তুচ্ছ করে? ওই ঘটনাটা ও রবীন্দ্রনাথকে বলেছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ওই যুবকটি ছিল ভালোবাসার দূত। আর মালাটা ছিল ভালোবাসার প্রতীক। এইসব কথা শোনবার পর মৈত্রয়ীর মনের জগৎ সম্পর্কে আমার সমস্ত ধারণা বদলে নতুন করে ভাবতে শুরু করলাম। এই দেশের গভীর জঙ্গল, ধর্মীয়, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, প্রতীক, এসব কিছুর মতই দুর্বোধ্য এদেশে মানসিক জগৎ। এই দুর্বোধ্যতার মিছিলের মধ্যে আমার জায়গাটা কোথায়? এই কিশোরী মেয়েটি, যে আমায় ভালোবাসে, তার মনের কোন জায়গায় আমার অবস্থান? আমায় জড়িয়ে ধরে মৈত্রেয়ী বললো, এখন আমি শুধু তোমার। সত্যিকারের, বাস্তব ভালোবাসা আমি তোমার কাছেই পেয়েছি। কী ভাবে ভালোবাসতে হয় তুমিই আমাকে শিখিয়েছো। আমি তোমার কাছেই আত্মসমৰ্পণ করেছি। তুমি যখন রাগ করো, আমার মনে হয় এক বিশাল ঝড় বইছে তুমি আমাকে পা দিয়ে ঠেলে ফেললেও আমার আনন্দ হবে। তোমার কিসের ভয়?
বাস্তবিকই চিন্তিত হবার মতো কোনো কারণ ছিল না। খাবার পর মৈত্রেয়ী আমার ঘরে এলো। সবাই তখন ওপরে ফ্যানের তলায় ঘুমুচ্ছে। বিরাট আরাম কেদারায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বসলো। আমি ওকে চুম্বন করতে শুরু করলাম। সেই দিন আমি ওকে ভালো করে দেখলাম। ভারতের মন্দিরগাত্রে যেসব অপ্সরা মূর্তি আমি দেখেছিলাম, প্রায় তাদের মতো ও নিখুঁত। আনন্দ-মিশ্রিত নিদারুণ ভয়ে মৈত্রেয়ী চোখ বুজলো।
আরাম কেদারার একটা হাতল ও চেপে ধরে রেখেছিল, অন্য হাতে আমার চুলে হাত বুলিয়ে আদর করছিল।
এটা কি পাপ নয়?—ও হঠাৎ ফিফিসিয়ে বললো।
ওর চোখের কোণে অশ্রু। কয়েক গুচ্ছ চুল ওর ঠোঁটের কোণে এবং চিবুকে আটকে ছিল। আমি উত্তর দিলাম, যখন আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে, তখন আমাদের ভালোবাসার কোনো সীমানা থাকবে না।
—কিন্তু এখন? এখন এটুকুই কি পাপ নয়?
—না, এখন তো আমি তোমাকে সেভাবে আদর করছি না।
–তবু বলো আমি কি পাপ করছি না?
ওর তীব্র পাপবোধ ওকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল। ও চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
ও কী বলতে চেয়েছিল তা বুঝতেই আমার বেশ কয়েক দিন কেটে গেল। প্রাচ্য নৈতিকতার বোধে ও পীড়িত হচ্ছিল। আলিঙ্গন, চুম্বন অবধি ওর বোধে ছিল ভালোবাসার বন্ধনের প্রতীক। তার সামান্য অতিরিক্তই হচ্ছে নির্দিষ্ট গণ্ডি অতিক্রম করা। সংস্কার, কর্মফলের ভয়, ঈশ্বরের ভয় ইত্যাদি ব্যাপারগুলোই এদেশের ভালোবাসার ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়কে অবদমিত করে রেখেছে। সেদিন রাত্রে নিজেকে বহু প্রশ্ন করেছিলাম, কাকে বলে শুচিতা? শরীর ও মনের শুচিতা? এর অর্থ কী-এর ব্যাখ্যা কী, প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের ধারণায়? প্রথম চুম্বনের পর মৈত্রেয়ীর বিবেকের প্রতিরূপই বা কী?
অনেক ভেবে আমি ওর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলাম। মিসেস সেনকে আমি সত্যিই ভীষণ ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম ওঁর স্বামীকে, তাই ঠিক করলাম সুযোগ মতো আমি নিজেই মৈত্রেয়ীকে বিবাহ করবার প্রস্তাব তুলবো।
তখনকার মতো সান্ত্বনা খুঁজে নিতে হলো আমাদের সঙ্গে বাইরে বেড়ানোর মধ্যেই। মোটরে করে আমরা ঘুরে বেড়াতাম ব্যারাকপুর, হুগলী, চন্দননগর, প্রায় মধ্যরাত্রি পর্যন্ত।
গাড়িতে নরেন্দ্র সেনের পরিবারের কেউ-না-কেউ থাকতেনই, কিন্তু আমাদের দৃষ্টি শুধুমাত্র পরস্পরের প্রতিই নিবন্ধ থাকতো, তাই আমাদের অন্তরঙ্গতার মধ্যে অন্য কারো উপস্থিতি অনুভব করতাম না। গাড়িতে করে কত গ্রামের ভেতরই না চলে গেছি। তার, সুপারি, নারকেল গাছের নিচে কত ছোট ছোট বাড়ি দেখতে পেতাম। ছোট ছোট জঙ্গল দেখে মনে হতো কী সুন্দর লুকোনোর জায়গা গ্রামের লোকেরা আমাদের শুভেচ্ছা জানাতো। বড় বড় গাছের ছায়ায় আচ্ছন্ন রাস্তাগুলোর ওপর আমরা কত স্মৃতির স্বাক্ষর রেখে এসেছিলাম। বড় বড় পুকুর, যার পাশে কখনো কখনো আমরা হাত ধরাধরি করে বসে থাকতাম। চন্দননগরের রাস্তা তখন ছিল নিস্তব্ধ, দু’পাশে বড় বড় গাছ, অন্ধকারে মুঠোমুঠো জোনাকির আলো, এসব কথা কি ভুলে যাবার
একটি বিশেষ রাত্রির কখা বেশ মনে পড়ে। রাস্তার মাঝে গাড়িটা গেল খারাপ হয়ে। ড্রাইবার আর মন্টু যন্ত্রপাতি আর মিস্ত্রীর সন্ধানে বেরোলো। নরেন্দ্র সেন গাড়ির সিটে প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায়, আধ- শোওয়া। ছবু, মৈত্রেয়ী আর আমি তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম। আকাশে চাঁদ ছিল না, এতো অগণ্য তারা আমি একসঙ্গে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। জোনাকির দল নির্ভয়ে আমাদের মুখে, কাঁধে, হাতে এসে বসছিল। মনে হচ্ছিল ওরা যেন রূপকথার জীবন্ত মণিমুক্তো। আমরা কেউই কোনো কথা বলছিলাম না। যদিও ছবুর উপস্থিতির ভয় ছিল, তা সত্ত্বেও অন্ধকার ও নিস্তদ্ধতার সুযোগে মৈত্রেয়ী আর আমি প্রায়ই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছিলাম। জানি না কোন্ এক মনোজগতে আমি বিচরণ করছিলাম। মনে হচ্ছিল এই অবস্থার যেন কোনো আদি নেই, অন্তও নেই। একটা প্রাচীন ইউক্যালিপ্টাস্ গাছ যেন উঠে গেছে আকাশ স্পর্শ করতে। আমরা তিনজনে একটা নিস্তরঙ্গ পুকুরের ধারে বসলাম। নিকষ কালো জলে তারাদের প্রতিবিম্ব যেন সূক্ষ্ম জরির কাজের মতো লাগছিল। এক অদ্ভুত ভাবাবেগ আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। আমার আত্মা প্রবেশ করছিল এক অলৌকিক প্রশান্তির মধ্যে
আর একবার ধানখেতের সীমানায় ঘন ঝোপঝাড়ের মধ্যে আমি একটা জীর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি আবিষ্কার করেছিলাম। ধানখেতে হাঁটার সময় আমার প্যান্ট হাঁটু অবধি ভিজে গিয়েছিল। প্যান্ট শুকোবার জন্য আমি সেই বাড়ির প্রাচীরে বসেছিলাম। বন্য গাছপালায় বাড়িটা প্রায় ঢেকে গিয়েছিল। তখনও সন্ধ্যা হয়নি, আকাশে হয়নি তারাদের আবির্ভাব। পড়ন্ত বিকেলের উষ্ণ হাওয়া ইউক্যালিপ্টাসের সুগন্ধ ছড়াচ্ছিল। সমস্ত পরিবেশটাই যেন আমাদের প্ররোচনা দিচ্ছিল, জানাচ্ছিল আমন্ত্রণ। মৈত্রেয়ী আর আমি পরস্পরের দিকে গভীর দৃষ্টি নিয়ে নিঃশব্দে তাকিয়েছিলাম—ঠিক লাইব্রেরিতে যে ভাবে আমরা পরস্পরকে দেখতাম, তেমনি ভাবে। হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে আমি ওর মাথার চুলে চুম্বন করলাম।
সেই সব বেড়ানোর দিনগুলো আমার স্মৃতিতে আজও জীবন্ত হয়ে আছে। সেইসব দিনগুলোর মাধুর্য আজও আমায় বিচলিত করে। দৈহিক স্মৃতি চলে যায়, সমপূর্ণ দৈহিক অন্তরঙ্গতার স্মৃতিও ম্লান হয়ে যায়, যেমন যায় আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণার স্মৃতি। সেই সময় নির্বাক্ সম্মোহিত দৃষ্টি বিনিময়ের রহস্য আমি অনুধাবন করার চেষ্টা করতাম। একটা সময় গাড়ি এসে শহরে ঢুকতো। সেখানে পর্যাপ্ত আলোর মধ্যেও আমাদের চোখ পরস্পরকে খুঁজে বেড়াতো। দৃষ্টিতেই আমরা পরস্পরের কাছে আত্মসমৰ্পণ করতাম। ভাবতে অবাক লাগে, আমাদের ভ্রমণসঙ্গীরা কী করে সমস্ত ব্যাপারটার প্রতি উদাসীন থাকতো।
একদিন রাত্রিতে আমরা চন্দননগরের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম। বৃক্ষশ্রেণী-শোভিত প্রশস্ত পথ উজ্জ্বল ভাবে আলোকিত। কিন্তু আমার মনে ছিল ক্লান্তি আর অবসাদ। রাস্তার দুপাশে দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম প্রাসাদ, অট্টালিকার ভগ্নস্তূপ, পৃথিবীর আর এক প্রান্তে হারিয়ে যাওয়া লুপ্তপ্রায় ফরাসী ঔপনিবেশিকদের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিচিহ্ন। ফেরার পথে আমি ভারতবর্ষকে বোঝার চেষ্টা করছিলাম এই দেশ কোন্ আত্মশক্তির জোরে কিভাবে কষ্ট সহ্য করে, আত্মস্থ করে, সেই সব যাযাবর জাতিদের যারা জোর করে তাকে দখল করে, শাসন করে, শোষণ করে। বিংশ শতাব্দীর একটি আধুনিক মোটর গাড়িতে ভ্রমণ করতে করতে আমি অনুভব করছিলাম, উপনিষদের ব্যাখ্যা মতো প্রায়-অপ্রবেশ্য ও প্রায়-দুর্বোধ্য এক নিঃসঙ্গ আত্মার উপস্থিতি, যা একই সঙ্গ অবাস্তব ও পবিত্র। আমি পার্থিব জগতে ফিরে আসার জন্য আমার ভালোবাসার একান্ত সম্পদ সেই কিশোরীটির বাহু স্পর্শ করলাম।
মনে আছে, প্রায়ই আমরা বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দের আশ্রমে যেতাম, বিশেষ করে উৎসবের দিনগুলোতে। মঠের সিঁড়িগুলো গঙ্গার জলধারা পর্যন্ত নেমে গেছে। সৌরভে আচ্ছন্ন মন্দির। অপরূপ প্রাকৃতিক দৃশ্য। নিঃশব্দে আমরা সেখানে বেড়াতাম। প্রেম-ভালোবাসার আকার-ইঙ্গিত সব ভুলে যেতাম। মনে হতো আমি সেখানে এমন এক শান্তি পাই, যা আমার আত্মা আগে কোনোদিনও অনুভব করেনি।
একটা তীব্র আবেগ, একটা বন্ধমূল দৃঢ় বিশ্বাস ক্রমশ আমায় ঠেলে দিচ্ছিল ধর্মান্তরিত হতে, হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে আমাদের বিবাহের সমস্ত বাধা দূর করতে।
বেলুড় মঠেই মৈত্রেয়ীর কাছে আমি প্রকাশ করেছিলাম আমার ধর্মান্তরিত হবার ইচ্ছা। ও ভীষণ অবাক্ হয়ে গেল, গভীর উল্লাসে ও জানালো, তাহলে কেউই আমাদের আর বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। সেদিন বিকেলেই ভবানীপুরের বাড়িতে এসে সে খবরটা তার মাকে জানালো। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিচে নেমে আমার ঘরে এসে জানালো মিসেস সেন এবং উপস্থিত সব মহিলারাই খুব খুশি হয়েছেন এই প্রস্তাবে। আমরা ভারমুক্ত হয়ে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলাম।
কিন্তু আমার ধর্মান্তরিত হবার অভিপ্রায় আমার কাছে শোনামাত্র নরেন্দ্র সেন বেশ খেপে গেলেন। শুধুমাত্র নতুনত্ব এবং কৌতূহলপূর্ণ উৎসবাদির আকর্ষণ ছেড়ে ধর্ম ও নীতির মূল ব্যাপারটা গভীরভাবে অনুবাধন করা আমার প্রাথমিক কর্ম কিনা এ প্রশ্ন করলেন আমাকে। তিনি নিজে হিন্দুধর্মের প্রতি বিশ্বস্ত এবং তিনি জানেন ধর্ম ত্যাগ করলে তাঁকে সামাজিক মর্যাদা হারাতে হবে এবং তাঁর মতে, আমারও সেই রকম চিন্তা করা উচিত।
এরকম সোজাসুজি জোরালো বিরোধিতায় মৈত্রেয়ী আর আমি দুজনেই খুব ভেঙে পড়লাম। ঠিক করলাম যে অক্টোবর মাসটা পুরীতে কাটাবো। সেখান থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে এলে আর কোনো বিতর্কের অবকাশ থাকবে না।
নরেন্দ্র সেন অনেক দিন ধরেই রক্তচাপে ভুগছিলেন, এবার হঠাৎই তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাড়িশুদ্ধু লোক বিপদের আশঙ্কায় অস্থির হয়ে উঠলো। গাড়িতে বেড়ানো আর বিশেষ একটা হতো না। আমার বেশির ভাগ সময়ই কাটতো রোগীর ঘরে। উপন্যাস, দর্শন এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই পড়ে শোনাতাম তাঁকে। শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় তিনি ভীষণই আত্মা, পরলোক আর তাঁর রোগ নিয়ে চিন্তা করতেন, ওই সম্পর্কে পড়াশোনা করতে চাইতেন। আমি, মন্টু ও মৈত্রেয়ী পালা করে তাঁর দেখাশোনা করতাম। শারীরিক কষ্ট তাঁর বিশেষ ছিল না, তবে দিনের বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে চোখে কালো চশমা পরে শুয়ে থাকতে হতো।
আশেপাশে তখন অসংখ্য ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল। প্রায় পঞ্চাশ হাজার জাতীয়তাবাদীকে জেলে পোরা হয়েছিল। যখন তখন অশ্বারোহী পুলিশদের লাঠিচার্জ, ভবানীপুরে শিখদের ওপর ব্রিটিশরাজের অত্যাচার, লুঠতরাজ। চোখের সামনে দেখেছি শিশুদের পর্যন্ত ধরে পেটাতে, স্ত্রীলোকদের আহত করতে। পুনরায় গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিচ্ছিল। আমার মনেও বিদ্রোহ দেখা দিলো যুক্তি তর্কের উর্ধ্বে উঠে আমার মধ্যে ব্রিটিশদের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে শুরু করলো। প্রত্যহ নতুন নতুন বর্বরতা খবরের কাগজ মারফতে জেনে আমি রাগে ফেটে পড়তাম। রাস্তায় যে-কোন শ্বেতাঙ্গকেই দেখলে আমি ঘৃণার চোখে তাকাতাম। ইংল্যাণ্ড থেকে আমদানি করা প্রত্যেকটি জিনিসই আমি বয়কট করলাম, এমনকি আমার প্রিয় তামাক পর্যন্ত। অবশ্য ভবানীপুরের বাড়িতে নিজের জন্য আমাকে সামান্য জিনিসই কেনাকাটা করতে হতো।
শিখপল্লী জালিয়ানওয়ালাবাগ আক্রমণের কয়েকদিন পরে হ্যারল্ড একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো আমার টাকাকড়ি থাকতো চাটার্ড ব্যাঙ্কে। আমি ওকে একটা চেক লিখে দিলাম। এটুক পরোপকার করতে পেরে আমার ভালোই লাগছিল। হতভাগ্য লোকটির তিনমাসের বোডিং-এর ভাড়া বাকি পড়ে গিয়েছিল এবং সামনের মাসে মাইনে পাওয়ার আগে খাবার কেনার টাকা পর্যন্ত ওর হাতে ছিল না। আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল ভারতের একজন শত্রুকে সাহায্য করার জন্য। কারণ ততোদিনে আমি একজন প্রায় গোঁড়া দেশভক্ত বনে গিয়েছিল।
মৈত্রেয়ী আমাদের চা দিতে এসেছিল। আমি গান্ধী, বিপ্লব ইত্যাদি নিয়ে একটা বিতর্ক শুরু করার চেষ্টা করছিলাম। সমস্ত অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানদের মতো হ্যারল্ডও ঐ বিষয়ে রূঢ়, নির্দয় মনোভাব পোষণ করতো পুলিশ, সেনাবাহিনীর সন্ত্রাস, অত্যাচার ইত্যাদিতে সে ক্ষুব্ধ ছিল না, ছিল মুগ্ধ। কিন্তু সদ্য সে এক শ’ টাকা ধার করেছে—তাই এখুনি আমার বিপরীত মনোভাব সে ব্যক্ত করতে পারছে না অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম তার কাপুরুষতা।
হ্যারল্ড- এর টাকা ধার করা ছাড়া আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল। সেটা ছিল, আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করা। আমার বাড়িটা চিনে রাখা, আমি কিরকম কালা আদমীদের সঙ্গে জীবন যাপন করছি এবং কতটা স্বাচ্ছন্দ্য আর আরামে আছি, এটা জানা। মৈত্রেয়ীকে দেখাটাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। সে যখন মৈত্রেয়ীকে আমাদের চা পরিবেশন করতে দেখলো এবং আমার দিকে গোপন দৃষ্টি দিতে ও হাসতে দেখলো তখন পুরো ব্যাপারটাই সে বুঝে ফেললো।
—অ্যালেন তোকে আমরা হারালাম। তোর আর কোনো আশা নেই। আমি ওর দিকে সোজা চোখে রেখে গিয়ে বললাম, এই সমাজে ঢুকতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। এ জগৎ জীবন্ত, এখানে এখনো কিছুটা অন্তত নীতিজ্ঞান আছে। এদের মেয়েরা পবিত্র, আমাদের মেয়েদের মতো প্রায়—বারবধূ নয়। আমি একটা শ্বেতাঙ্গ মেয়েকে বিয়ে করবো ভেবেছিস! যারা কৌমার্য কী, তাই জানে না! ত্যাগ বলতে কী বোঝায় তার কোনো ধারণা যাদের নেই? আমাদের জগৎ, শ্বেতাঙ্গদের জগৎ, একটা মৃত ক্লেদাক্ত জগৎ। আমার ওখান থেকে কিচ্ছু নেবার নেই। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, এই সমাজে, এই জীবনে প্রবিষ্ট হয়ে আমি যেন আমার পুরোনো অন্ধ স্বার্থ এবং অবাস্তব জীবনের ঊর্ধ্বে উঠতে পারি। গড়তে পারি একটা নিখুঁত, পরিপূর্ণ;অর্থপূর্ণ ভালোবাসার জীবন—আর এই শিক্ষা আমি পেয়েছি এদেরই সমাজে, এই বাড়িতে।
যদিও তখন যে-ধারণা আমি উদ্দীপনা ও সততার সঙ্গে প্রকাশ করেছিলাম তা আমার পরিষ্কার চেতনার নাগালে ছিল না। হ্যারল্ড কিন্তু ভীষণ অবাক হয়ে গেল। নিদারুণ অস্বস্তি নিয়ে কী উত্তর দেবে সে ভেবে পাচ্ছিল না! শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতির মৃত্যু, যা আমাকে বহুদিন বিচলিত করেছে, সে সম্বন্ধে তার কোনো ধারণাই ছিল না। ওর বোধ হয় ইচ্ছে হচ্ছিল একগ্লাস হুইস্কি খেয়ে আমার বাড়ি থেকে প্রস্থান করা। কিছু না ভেবেই সে বললো—জী তোর ধর্ম?
-যা তোর ধর্ম তাইই। কিন্তু ধর্মকে আমি নতুন করে জেনেছি এখানে, এই ভারতে এই মাটিতে যে মাটির সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। যেখানকার মানুষ ক্ষুধার্ত, কিন্তু ভালোবাসার জন্য, স্বাধীনতার জন্য, জ্ঞানের জন্য, সত্তার মুক্তির জন্য সতত নিরত। এদের এই সান্নিধ্য ছাড়া খ্রীস্টানধর্মকেও আমি বুঝতে পারতাম না।
এ যাবৎ হ্যারল্ড আমার কাছে কেবল শুনেছে প্রযুক্তিবিদ্যা, গণিতবিদ্যা ইত্যাদি আমার পড়াশোনার কথা, আজ হিন্দুধর্ম, খ্রীস্টধর্ম সম্পর্কে আমার কথা শুনে সে অবাক্ হয়ে গেল। আমি অন্তরে অনুভব করতে পারছিলাম, আমার এই যাবতীয় উদ্দীপনা ও স্বতঃস্ফূর্ততার প্রাণশক্তি ছিল আমার প্রেম, আমার ভালোবাসা।
পরবর্তী কালে নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমার সমস্ত কাজ, ভাবনা সবই কি আমার ভাবপ্রবণতার কাছে নিছক দাসত্বের দ্বারাই নির্ধারিত হয়েছিল? এই অনুভূতি হয়েছিল অনেক পরে,যখন আমি সত্য জানবার জন্য ঈশ্বরকে খুঁজেছিলাম ..হ্যাঁ!
… সত্য! হ্যারল্ড বললো-আমি তোর সব কথা বুঝতে পারলাম না। ঈশ্বর তোকে বাঁচিয়ে রাখুন, আর অমঙ্গলের হাত থেকে রক্ষা করুন।
হ্যারল্ড চলে যাবার পর আমি খানিকটা বিচলিত হয়েই ঘরে পায়চারি করতে লাগলাম। ভাবছিলাম যা চিন্তা করি তাই কি প্রকাশ করতে পারলাম?এমন সময়ে মৈত্রেয়ী ঘরে ঢুকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বললো,-যাক, তোমার বন্ধু শেষ পর্যন্ত গেছে। উঃ! তোমাকে এখন ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল।
ওকে আমার দুবাহুর মধ্যে জড়িয়ে ধরেও এই প্রথমবার আমার ভয় হলো যে ওর ভালোবাসা ও হয়তো একদিন আমাকে ক্লান্ত করতে পারে। হ্যারল্ড চলে যাবার পর, অন্তত একঘন্টা আমিএকা থাকতে চেয়েছিলাম ওর উপস্থিতি আমায় বিচলিত করেছিল। চাইছিলাম আমার বোধশক্তি, নীতিজ্ঞান ইত্যাদি এক পারম্পর্যে স্থাপন করতে।
কিন্তু বুঝতে পারলাম ও এতক্ষণ নজর রাখছিল কখন আমার বন্ধু চলে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে এসে আমার বাহুতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। মনে হচ্ছিল আমার নিজস্ব সত্তার একটা অংশ আমি যেন বিকিয়ে দিয়েছি। একথা ঠিক, মৈত্রেয়ীর কাছে নিজেকে আমি সম্পূর্ণভারে সমর্পণ করেছিলাম, তার থেকে কখনই দূরে থাকিনি। ওর স্মৃতি আমাকে অনুসরণ করেছে আমার নিদ্রার প্রান্ত অবধি। কিন্তু আমার একটা নিজস্ব নির্জনতারও প্রয়োজন আছে, যা ও কখনোই অনুভব করতে পারতো না। কেন একপ্রেমিক তার প্রেমাস্পদের মানসিক অবস্থা কল্পনা করতে অক্ষম হবে?
ওকে জড়িয়ে ধরে ওর সুগন্ধি চুলে আমি ধীরে ধীরে আমার ঠোঁট দুটি স্পর্শ করলাম। এমন সময় হঠাৎই খোকা এসে ঘরে ঢুকলো আর আমাদের ঐ অবস্থায় দেখে সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আর যাবার সময় বলে গেল—মাপ করবেন!