লা নুই বেঙ্গলী – ১৪

১৪

কয়েক মাস হিমালয়ের কোলে, রাণীক্ষেত আর আলেমোড়ার মাঝামাঝি এক বাংলোয় কাটালাম। হতাশা, উৎসাহহীনতা আর বুক-চাপা স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে কেটে গেল সময়।

দীর্ঘদিন দিল্লী, সিমলা, নৈনিতাল ঘুরে চারপাশে কেবল লোকজনের, বিশেষ করে সাদা মানুষের ভিড়ে ক্লান্ত, বিপর্যস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত এখানে এসে ছিলাম। আমার আজকাল লোক-সমাগমকে বড় ভয় করে। ওদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, ওরা অভিবাদন জানালে প্রত্যুত্তর দিতে প্রবৃত্তি হয় না, বাজে কথায় সময় নষ্ট করতে একদম ভালো লাগে না। আমার এখন চাই বিশ্রাম, কেবল বিশ্রাম। ওরা আমার সেই বিশ্রামের বাধা-বিশেষ। নির্জনতাই এখন আমার একমাত্র সান্ত্বনা, আমার বাঁচবার একমাত্র উপায়।

আমার মনে হয়, একাকীত্বের কী জ্বালা, তা কত হতাশাব্যঞ্জক এবং তিক্ত হতে পারে, তা খুব কম লোকই আমার মতো করে উপলব্ধি করতে পেরেছে। মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচমাস আমি কেবলমাত্র একটি লোকেরই মুখ দেখেছি, সে হলো এই বাংলোর পরিচালক। আর কেউ আমার ঘরে আসতো না। এর সঙ্গেও আমি খুব কমই কথা বলতাম, তাও কেবলমাত্র যখন ও আমার খাবার নিয়ে আসতো বা জল ভরে রেখে যেতো। আমি আমার সমস্ত সময় অরণ্যে কাটাতাম। হিমালয়ের আলমোড়া অঞ্চলে পাইনের এক বিখ্যাত বন আছে। আমি সেই বনে ঘুরে বেড়াতাম। এমাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত আমার ভালোবাসার জনকে নিয়ে নানা কল্পনায় মশগুল থাকতাম। সে সব কত অলীক স্বপ্ন, কল্পনা—মৈত্রেয়ী আর আমি, যেন কত সুখে, কত আনন্দে এই বনের নির্জনতাকে সাক্ষী রেখে একাত্ম হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কখনো বা ফতেপুর সিক্রির মৃতপুরীতে, কখনো বা জঙ্গলের এক পরিত্যক্ত কুটিরে, শুধু সে আর আমি।

সারাদিন, সারারাত, দিনের পর দিন আমি আমাদের দুজনকে ঘিরে কত স্বপ্ন, কত ছায়াময় চিত্রকল্প—সারা পৃথিবী থেকে দূরে, একান্ত একান্তে একাত্ম হয়ে থাকার কল্পনায় বিভোর হয়ে থাকতাম। বিগত দিনের কত ভুলে যাওয়া স্মৃতি, কত ছোট ছোট তুচ্ছ অথচ মধুময় ঘটনা আবার জীবন্ত হয়ে উঠতো আমার অন্তরে। কত গভীর, কত নিবিড়, কত ললিত গীতিময় সে সব ব্যথার গাথা। যে-সব তুচ্ছ জিনিসকে আগে কখনো কখনো কোনো মূল্যই দিইনি, সেগুলো এখন আমার অন্তদৃষ্টিতে জ্বলজ্বলে ভাস্বর হয়ে উঠছিল। আমি যেন মৈত্রেয়ীকে ভেঙে ভেঙে গড়ছিলাম, সেই পাইন, চেস্টনাটের ছায়ায় ছায়ায়, পাহাড়ে, জঙ্গলের পথে পথে। আমি আমার সেই অপূর্ব ভাবনার অন্তরঙ্গতায় এমন আপ্লুত ও আবিষ্ট হয়ে থাকতাম যে, মাঝে মাঝে আমার ভয় হতো। এই স্বপ্ন যদি ভেঙে যায়, আমি আমার এই যন্ত্রণাময় শারীরসত্তা নিয়ে বাঁচবো কী করে। আমি জানতাম, এবং নিশ্চিন্তই ছিলাম যে, মৈত্রেয়ীও তার ভবানীপুরের ছোট্ট ঘরে বসে বসে আমারই মতো গভীর চিন্তায় মগ্ন, আমাদের চাওয়া-পাওয়া, আমাদের মিলন, কিংবা আমাদের বিচ্ছেদ অথবা মৃত্যু।

কোনো কোনো শুক্লপক্ষের সন্ধ্যায় চাঁদের আলোয় আমি বনের পথে বেরিয়ে পড়তাম, হয়ত একটা টিলার ওপর উঠে দূরে কোনো অঝোরে—নেমে আসা ঝর্ণার শুভ্র নির্ঝর দেখে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠতাম—মৈত্রেয়ী মৈত্রেয়ী’ যতক্ষণ না আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি—আমি আমারই শব্দের প্রতিধ্বনি পাহাড়ে পাহাড়ে ধ্বনিত হতে শুনতে পেতাম। যেন এক স্বপ্নের পথ ধরে, অবর্ণনীয় সুখ আর প্রশান্তি বুকে নিয়ে বাংলায় ফিরে আসতাম; মনে হতো, মৈত্রেয়ী নিশ্চয়ই আমার ডাক শুনতে পেয়েছে, ঐ আকাশের মধ্য দিয়ে বাতাস ও ঝর্ণার ধারায় ভেসে আমার প্রাণের আর্তি নিশ্চয়ই তার কানে গিয়ে পৌঁছেছে।

আমি জানি না, মানুষের মনের কোন্ পর্যায়কে তার সঠিক আত্মসত্তা বলা যায়; এই দীঘ কয়েকমাস ধরে সম্পূর্ণ নির্জনতার সমুদ্রে অবগাহন করতে করতে আত্মসত্তা বলতে, বোধ হয়, আমার একটা অন্যতর ধারণা জন্মাচ্ছে। বেশ কিছু দিন হলো যেন মৃত্যু আর আমি পরম বন্ধুতে পরিণত হয়েছি—যে প্রচণ্ড আশাবাদী দুই বন্ধু হাত ধরাধরি করে চলেছি—সে তো আমার কাছেই রয়েছে, বন্ধুর ইচ্ছেই আমারও চরম ইচ্ছে—তাড়াহুড়োর কিছু নেই, বেশ ইওরোপীয়ান টেকনিকের প্রেম, ভালোবাসার পায়োনিয়ারিজম্—যেন মৃত্যুই আমাকে উদ্ধার করার জন্য বুক চিতিয়ে বীরদর্পে হাজির হয়ে রয়েছে আমার পাশে, যেমন করে ইওরোপীয়ানরা ভারতবর্ষের মাটিতে পা রেখেই মনে করেছে, এই পোড়া দেশের জন্যে ওরাই সভ্যতাকে মাথায় করে নিয়ে এলো। আমার এখন সব কিছুই বৃথা, নিরর্থক বলে মনে হয়—সবই অলীক, সবই মায়ার ভ্রম মাত্র। সব কিছুই। কেবল আমার সেই কয়েকমাস ভরা নিরন্তর প্রেম, তার সুখস্মৃতি আর আজকের আমার এই যন্ত্রণার ও দুর্দশার অনুভূতিটা ছাড়া। আমার এই যে আত্ম-অনুশোচনার অনুভূতি, এটা শুধু মৈত্রেয়ীকে হারানোর জন্যই নয়, আমি আমার আশ্রয়দাতা গুরুর প্রতি যে অন্যায় ও পাপ করেছি, আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদা অতুলনীয়া মায়ের প্রতি, ছোট্ট ছবুর জীবনের প্রতি, সেই মেয়েটা- মৈত্রেয়ী- যাকে আমি চরম বিপদের মধ্যে ফেলে এসেছিলাম, সে সবের জন্যেও আমার এই মানসিক যন্ত্রণা। এই সমস্ত দুশ্চিন্তা আমার বুকের ভেতর চেপে বসে যেন আমার শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে। এখন নিজেকে ঘুম পাড়ানোর জন্য আমার বোধ হয় ঘুম-পাড়ানী মাদকের দরকার, যাতে না-স্বপ্ন, না-কোনো জ্ঞান, না-মৃত্যু, না-পাপ, না-বিচ্ছেদ—কিছুই উপলব্ধি করতে পারি।

আমার ডায়েরির পাতা নিত্য বেড়েই চলেছে, কিন্তু ২৩শে অক্টোবর তারিখটায় পৌঁছতে আমার বড় ভয়, বড় অস্বস্থি। সত্যি কথা বলতে কি, ঐ তারিখটা আমার জীবন থেকে যেন মুছে গেছে। একটা বড় খামে আমি কিছু জিনিস সীল করে রেখেছিলাম- মৈত্রেয়ীর কয়েকটা চিঠি, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের চিঠি, একটা শুকনো গোলাপফুল, একটা চুলের কাঁটা মৈত্রেয়ীর কিছু হিজিবিজি কাটা কাগজ, বেশির ভাগই ফ্রেঞ্চ গ্রামারের নোট লেখা, এক কথায়, আমার প্রিয়তমার সঙ্গে নিবিড়তম অধ্যায়ের কিছু চিহ্ন। আমি আজকাল মাঝে মাঝেই খামটা খুলে সেগুলো দেখি আর সেই জীবনকাহিনীর শেষ অধ্যায়টা লক্ষ্য করি। এই মধুময় স্মৃতিটুকুর কথা কি আমি লিখে বোঝাতে পারবো?

আমার ডায়েরিতে আমি লিখে রেখেছি, আমার অকপট সরলতা, পক্ষপাত শূন্যতা এবং সেন্টিমেন্টাল অহমিকার জন্য আমি কী ভাবে, কত পর্যায়ে দীর্ঘ দিন ধরে ঠকে আসছি। বাংলোয় থাকাকালে আমি কোনো চিঠি পেতাম না, ফলে কাউকে চিঠি দেবার দায়ও ছিল না। বাংলোর পরিচারক মাসে একবার, বড়জোর দুবার নৈনিতাল শহরে যেত জিনিসপত্র সওদা করতে এবং এই বনবাদাড়ে একেবারেই মেলে না এমন বস্তু কিনে আনত। তখন আমি মাঝে মাঝে দু এক লাইনের চিঠি দিতাম ব্যাঙ্কের উদ্দেশ্যে, বা কখনো হ্যারল্ডকে টেলিগ্রাম করে জানাতাম যে আমি এখনো বেঁচে আছি।

খ্রীস্টমাস নাগাদ আমার কাছে হঠাৎ একটা ‘স্যারপ্রাইজ’ এলো, তাতে আমি বুঝতে পারলাম এখনো কীভাবে আমার খোঁজ-খবর চলছে, এবং আমার পক্ষে এখনো কলকাতায় ফেরা কতখানি বিপজ্জনক আমার ব্যাঙ্কে খোঁজখবর করে খোকা ইতিমধ্যে জেনে গেছে পাহাড় অঞ্চলে আছি। সে নৈনিতালের পোস্ট মাস্টার মশাইয়ের প্রযত্নে একটা চিঠি দিয়েছে। বাংলোর পরিচারক যখন আমার নাম লেখা খামটা আমার হাতে এনে দিলো তখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সত্যিই চিঠিটা আমাকে লেখা। ও ভেবেছিল অ্যালেন দীর্ঘদিন হলো আর এখানে নেই, নিশ্চয়ই সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে দূরে কোথাও চলে গেছে। আমি আমার ঘরের দরজায় খিল এঁটে দিয়ে চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। আমি প্রচণ্ড উত্তেজনায় কাঁপছি, যেন আমি মিঃ সেন বা মৈত্রেয়ী বা মিসেস সেনের হাতে ধরা পড়ে গেছি। খোকা লিখেছে, ওঁরা পরিবারবর্গ মিলে কিছুদিন মেদিনীপুরে কাটিয়েছে। সেখান থেকে মৈত্রেয়ী নিজেই আমাকে তাড়াহুড়ো করে কয়েক লাইন বিচ্ছিন্নভাবে লিখে পাঠিয়েছে। ও ঐ খামের মধ্যে কয়েকটা বুনো ফুলও পাঠিয়েছে, হয়তো গ্রামের পথে ঘুরতে ঘুরতে কোথাও থেকে তুলেছিল। আমি বুঝেছি, ও আমার এই নেহাতই বস্তুবাদী, ইন্দ্রিয়াসক্ত, পার্থিব মানুষের আসল চেহারাটা দেখে দুঃখ পেয়েছে। ও নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনায় আর একজন অ্যালেনকে সৃষ্টি করেছে আর তার সঙ্গে এ পৃথিবীতে বাস্তবে অসম্ভব যাবতীয় স্বর্গীয় কল্পনা দিয়ে অপরূপ রূপকথা গড়ে তুলেছে, যা এ বস্তু জগত থেকে বহু-উর্ধ্বে, বহুদূরে এক অপার্থিব স্বপ্নময় সত্তা।

ও আমায় লিখেছে—আমি তোমায় হারিয়ে কী করে বাঁচবো! তুমি যে আমার সূর্য, তোমার কিরণধারাই যে আমার প্রাণসত্তা! আর একটা টুকরো কাগজে লেখা—তুমি বাতাস, তুমি ফুল—ও আরও লিখেছে—এই ফুলের গুচ্ছগুলোকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে আমি তোমার একান্ত নিবিড় আলিঙ্গন অনুভব করি—আর এক জায়গায় লেখা—প্রতি রাতেই তুমি আমার কাছে আসো, যেমন করে তোমাকে আমাদের ভবানীপুরের বাড়িতে পেতাম আর আমি তোমার কাছে কনে-বউ সেজে যেতাম। তুমি আমাকে নারীত্বে উত্তীর্ণ করে দিয়েছিলে। আর তুমি, তুমি আসো অজস্র মণিমুক্তা সজ্জিত সুবর্ণ দেবতার মতো,অসীম অপার সুষমায় আমি তোমার সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণতা হই, আর তুমি আমাকে বুকে তুলে নাও। তুমি আমার কাছে শুধু প্রেমিক নও, তুমি আমার দেবতা, আমার সূর্য, আমার জীবনসর্বস্ব….

আমিও যে এক অদ্ভুত পৌরাণিক কালের স্বপ্নে আবিষ্ট হয়ে পড়ছি। একটা ব্যাপার ভেবে আমি ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছি এবং সঙ্কুচিত বোধ করছি যে আমার মতো সামান্য রক্ত-মাংসের মানুষকে, মানুষ দেবতা বানায় কি গুণে? আমি ভাবতে লাগলাম কোন্ নিরন্তর আদর্শের মহিম অনুভূতি মানুষকে দেবত্বে উত্তীর্ণ করে, কোন্ মহীয়সী প্রেম মানুষকে সূর্যের মহিমা দান করে। আমি নিজেকে যেন এক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর রূপে আবিষ্কার করলাম। আমিও তো কল্পনায় সব সময়ই ভবানীপুরে মৈত্রেয়ীর সঙ্গেই আছি, কত নিবিড় ভাবে আমার সমস্ত পৌরুষ দিয়ে ওকে দুহাতে জড়িয়ে রেখেছি। যতই অলীক হোক, আমার মধুর স্বপ্ন নিয়তই আমাকে ঘিরে রইল। সমস্ত আকুলতা, সমস্ত আন্তরিক আতি দিয়ে যেন আমরা এক অনন্ত সম্পূর্ণতায় একে অন্যকে ঘিরে রয়েছি নিরন্তর। মৈত্রেয়ীর পুরাণ-কল্পনা আমাকে দেবপ্রতিম করে তুলেছে, একটা অবাস্তব আদর্শ মাত্রে পর্যবসিত করেছে। অথচ আমি আমার মধ্যে তার কল্পনার সেই সূর্যকে বা তার স্বপ্নের ‘ফুলকে’ খুঁজে পাচ্ছি না যাতে আমি তার যোগ্য হয়ে থাকতে পারি; আমি তো নেহাৎই রক্ত-মাংসের মানুষ, সব দোষ-ত্রুটি, আবেগ-উচ্ছলতা নিয়েই।

আমার বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠেছে। কেন মৈত্রেয়ী আমার থেকে এত দূরে চলে গেল? যদি ভবিষ্যতে আবার যোগাযোগ করার জন্য পাগলই হবে, তাহলে ওকে ভুলে যাবার জন্যে আমার অনুরোধ করেছিল কেন? ও আজ আমাকে যেমন করে ভাবছে, কে ওর মাথায় এই রকম আমাকে দেবতা বলে ভাবার অনুপ্রেরণা দিল? আমি তো দেবতার দূরত্ব চাই না, আমি তো বাস্তবে, এখনি তাকে একান্ত করে কাছে পেতে চাই। সব থেকে বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠলো সেই পরম মধুর একান্ত করে পাওয়ার সুখ স্মৃতিগুলো। ওর রক্তমাংসের অস্তিত্বটাকে নিয়ে আমি কত ভাবে, কত আশ্লেষে আদর করেছি, খেলা করেছি। সে যেন আমার সমস্ত চাওয়ার, সমস্ত ইচ্ছার জীবন্ত প্রতিমূর্তি। তার দেহ, তার মন, তার সব কিছু, যার মধ্যে আমি নিজেকে বারবার আবিষ্কার করি আমার স্মৃতিতে যেন সব কিছু চলচ্চিত্রের মত দৃশ্যমান। আমি পৃথিবীর কোনো সম্পদের বিনিময়েই এই স্বপ্নকে ভুলতে রাজি নই। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ট সম্পদ, আমার আদর্শ, আমার অপার্থিব সত্তা। কিন্তু আমি কেবল স্বর্গীয়, অপার্থিব আদর্শের প্রতিরূপ হয়ে থাকতেও রাজি নই।

খোকা আমাকে আরও কিছু নতুন খবর পাঠিয়েছে। অপারেশনটা সাক্সেস্ফুল হয়নি, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে আবার নতুন করে দু-মাসের ছুটি নিতে হয়েছে। মিসেস সেনের চেহারা একেবারে ভেঙে গেছে। তাঁর মুখের ভাব হয়েছে প্রশান্ত সন্ন্যাসিনীর মতো। মৈত্রেয়ী ভয়ে শঙ্কায় খুব শুকিয়ে গেছে। সে কিন্তু সমস্ত রকম বিয়ের প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। কলকাতায় ফিরে আসার পর থেকে ও নাকি ক্রমাগতই আমার রয়েড স্ট্রীটের বাসায় ফোন করার চেষ্টা করেছে। ওর ধারণা আমি এ শহরেই রয়েছি কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই ওর সঙ্গে দেখা করছি না। খোকা নাকি একদিন আমার পুরনা বাসায় গিয়েছিল। মাদাম রিবেইরো ওর কাছে আমার সম্পর্কে অনেক অভিযোগ করে বলেছেন যে উনি আর আমাকে তাঁর ওখানে থাকতে দিতে রাজি নন। আমি দুতিন সপ্তাহ বাইরে থাকবো বলে এসেছিলাম, কিন্তু তারপর থেকে চার মাসের ওপর হয়ে গেল, আমি বেঁচে আছি কিনা সে খবর পর্যন্ত কেউ জানে না। আমি কেবল হ্যারল্ডকেই কটা ঠিকানাবিহীন টেলিগ্রাম করেছিলাম। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মন্টুকে প্রচণ্ড ধমক দিয়েছেন, সে মিসেস সেনের অবাধ্য হয়েছিল বলে। বেচারা ছেলেটার বড় দুঃসময় চলেছে। বিয়ের সময়ের চুক্তি অনুযায়ী ওকে এখন অনেকগুলো টাকার ঋণ পরিশোধ করতে হবে, ততদিন পর্যন্ত লীলু আলাদা থাকবে। লীলু এখন তার মা-বাবার কাছে, আরও আছে একটা অল্পভাড়ার ছাত্রাবাসে। দিনের পর দিন শুধু চায়ে পাঁউরুটি ভিজিয়ে খেয়ে পয়সা জমাচ্ছে, ঋণ পরিশোধ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লীলুকে নিয়ে আসবে বলে।

খোকা চিঠিটা শেষ করেছে, কবে নাগাদ ফিরবো ঠিক করেছি সে কথা জিজ্ঞেস করে। সে ঝেড়ে জ্ঞান দিয়েছে, আমি যেন নিজের কেরিয়ার নষ্ট না করি, অথবা তুচ্ছ একটু ভালোবাসাবাসি খেলা নিয়ে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট না করি। সব মানুষেরই জীবনে এরকম একটু আধটু হয়, তাই বলে কেউ সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে হিমালয়ে গিয়ে বসে থাকে না; শক্ত হাতে এ সব মোকাবিলা করতে হয়। এটা কোনো সমাধানই নয়। শেষে সে আবার যোগ করেছে, কবে ফিরছ?

আমারও ভেতরে অনেকদিন ধরেই এই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে, কবে ফিরছি, কিন্তু আমার কলকাতার জীবনের কথা আমি কিছুতেই ভাবতে বা মেনে নিতে পারছি না। তা ছাড়া কলকাতা ফিরে হবেই বা কী! আমার তো সেখানে কোনো কাজকর্ম নেই। আমাকে আমার আগের অফিস থেকে কোনো কাজের সার্টিফিকেট দেয়নি। কাজেই নিষ্কর্মা বেকার হয়ে ওখানে গিয়ে কোনোই লাভ নেই। আমার পকেট বরং নির্জন পাহাড়ে কম খরচে এখনো বছর খানেক থাকার অনুমতি স্বচ্ছন্দে দিতে পারে। কিন্তু তারপর? আমি তো ফতুর হয়ে যাবো। তখন আমার অনেক দূরে, যেমন জাভা বা অন্য কোথাও চলে যেতে হবে এবং সেখানে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে হবে…। অবশ্য এ ভাবা নেহাৎই ভাবার জন্যে ভাবা। সত্যি সত্যিই আমি ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা মন থেকে মেনে নিতে পারছি না, নেহাৎই যদি বিদেশে একটা চাকরি-বাকরি না জুটে যায়। আমার সমস্ত কর্মক্ষমতা, সমস্ত উচ্চাশা, জীবনের সমস্ত উদ্দেশ্যই যেন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, হারিয়ে গেছে। এখন সে সবের স্বপ্নও বরং আমাকে দুঃখ এনে দেয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলায়। বাংলোর বারান্দায় বসে বসে আমি কেবল পাইনের বন, পাহাড় দেখি, অবাস্তব কল্পনা করি, আর ধ্যান মগ্ন হয়ে থাকি….. এই সুন্দর অমলিন বনটার চাইতে মনোরম সুন্দর আর কিই বা আছে? অথচ কেউ তাদের প্রশ্ন করে না, কেন তারা বাড়ে, কেউ তাদের অতুলনীয় সৌন্দর্যকে দুচোখ ভরে দেখে না, কেন? কেন? আমি গাছ হতে চাই, গাছ হয়ে মহাসুখে, শান্তভাবে হাওয়ার ভরে হেলতে দুলতে চাই, গঙ্গার পাড়ে, জলের ধারে…..। আমার আর কোনো ভাবনা নেই, কোনো অনুভূতি কাজ করছে না, কোনো স্মৃতি আর ভারাক্রান্ত বা বিব্রত করছে না…..। জীবনের কোনো সাড়াই আর জাগছে না, যা আমাকে আবার জনসমাজে ফিরে যেতে প্রলুব্ধ করতে পারে। আমি যেন পাথর হয়ে গেছি, উজ্জ্বল স্ফটিক! তবু স্ফটিকের আলো আছে, উজ্জ্বলতা আছে, কিন্তু প্রাণহীন পাথরের? নিষ্প্রাণ পাথরের?

আমি আসার সময় একখানা বইও নিয়ে আসিনি। আমার মাথার মধ্যে কেবল কতকগুলো ভাবনা কাজ করছিল,যাতে আমি নির্জন একাকীত্বের জীবনে কিছুটা স্বস্তি ও শান্তি পেতে পারি। আমার এই দীর্ঘ নির্জনবাসে কেবল সামান্য কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হয়েছি, যারা আমার সমান, ব্যথার ব্যথী, বরং আমার চেয়েও গভীর অথচ প্রাণবন্ত, স্বাধীনচেতা। চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী থাকার চেয়ে আমি মুক্ত প্রকৃতির বুকে মুক্ত মন নিয়ে ঘুরে বেড়াতেই বেশি ভালোবাসি। কিন্ত আসলে আমি নিজের কাছে সব দিক দিয়ে বন্দী…. আমার ভাবনার জগতে কয়েকটা দিক নিষিদ্ধ প্রদেশ, যেমন, ২৩ শে অক্টোবরের স্মৃতি……।

মার্চের শুরুতে, একদিন বেশ একটু বেশি রাতেই, হঠাৎ বাংলোয় এক অজানা অতিথি এসে উঠলো। ডাকাডাকিতে জেগে উঠে বাংলোর পরিচারক তাকে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিলো। কিন্তু তার খিচুড়ি ভাষা এতই দুর্বোধ্য যে সমূহ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে আমার ডাক পড়লো। হিমালয়ান ফারের বিশাল কোটটা গায়ে চাপিয়ে বেরুলাম, আমাকে প্রায় এক মঙ্গোলিয়ান মাউন্টেনিয়ার বলে মনে হচ্ছিল। বারান্দায় একটা লম্বা-ইজি চেয়ারে এক ভদ্র মহিলা আধ-শোয়া অবস্থায় বসে আছেন, দেখেই বোঝা যায় বেশ ক্লান্ত। ট্রেঞ্চ কোটে ঢাকা চেহারায় খেয়ালই করিনি তার চুলগুলো বাদামী- লালচে এবং হাত দুটো বেশ বড়সড়। মাত্র কয়েকটা হিন্দুস্থানী শব্দ তাঁর সম্বল। আমাকে দেখেই তাঁর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো স্বস্তিতে। তখনো তিনি হাঁপাচ্ছেন।

তিনি জানালেন যে তিনি রাণীক্ষেত থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসেছেন, পথ হারিয়ে ফেলে নানা দিক দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে, একটা বেশ বড় ঝর্ণা পেরিয়ে শেষে এই বাংলোটা খুঁঝে পেয়েছেন। তিনি আমার তাঁর এই একা দুঃসাহসিক অভিযানের কথা বিশদভাবেই বললেন। শুনে বুঝলাম কাজটা তাঁর উচিত হয়নি। তাঁর নাম জেনি আইজাক, আসছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন থেকে এবং বেশ কয়েকমাস ধরে ভারতবর্ষে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি হিমালয়ের বুকে একটা এমন ধর্মস্থান খুঁজে বেড়াচ্ছেন যেখানে তিনি ঈশ্বরের সন্ধান পেতে পারেন। প্রথমে কথাতেই বুঝলাম, তিনি এ জগৎ সম্পর্কে খুবই নিস্পৃহ, শান্ত ও স্থির, ঐ একটি উদ্দেশ্য ছাড়া তাঁর আর জগতের কোনো কিছুর প্রতিই আকর্ষণ নেই। বাংলোর পরিচারক বারান্দার বড় আলোটা জ্বালতে আমি তাঁকে আরো ভালো করে দেখতে পেলাম। তিনি নিতান্তই তরুণী, নীল চোখ, সুন্দর গোল মুখ, কিন্তু একেবারেই ভাবলেশহীন, বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, গলার স্বর যেন ছোট্ট মেয়ের মতো, হাত দুটো লম্বা, বিশাল বুক—রীতিমত স্বাস্থ্যবতী। পরনে ইওরোপীয় ঔপনিবেশিকের বিচিত্র পোশাক, পুরো মাউন্টেনিয়ারের চেহারা। ভদ্রমহিলা ঠাণ্ডায় প্রায় জমে গিয়েছিলেন। পরিচারক বেশি করে চা এনেছিল, তিনি সবটাই খেয়ে ফেললেন, আর মাঝে মাঝে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন। তিনি প্রায় একটানা দুদিন ধরে হেঁটেছেন। তিনি হেঁটে রবীন্দ্রনাথের মন্দিরে যাবার জন্য বেরিয়েছেন, প্রায় তিরিশ দিন এদিক ওদিক ঘুরে মাইখালি পৌঁছান। পথের দিশার কথা শুনে আমি চমকে গেলাম। ও পথটা তো এখন পুরো বরফে ঢাকা! ঘন কুয়াশার মধ্যে জমাট ঠাণ্ডায় হাঁটতে গিয়ে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন। ওঁকে এখন হরিদ্বার হয়ে যেতে হবে বলে জানালাম। মোটামুটি আমার যতটা জানা আছে, সেটাকে মূলধন করেই বললাম, ওকে প্রথম কোট দ্বারায় যেতে হবে, সেখান থেকে ট্রেনে হরিদ্বার যাওয়া যাবে। তিনি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, আমি ঐ সব জায়গায় যাচ্ছি, না এখন বেশ কিছুদিন এই বাংলোতেই থাকবো।

বড় সমস্যাজনক প্রশ্ন! আমি শুকনো অনাগ্রহী গলায় জবাব দিলাম, আমি এখনো কিছু ঠিক করিনি, তবে মনে হচ্ছে কিছুদিন থেকে বিশ্রাম নেবো, তাছাড়া, এই নির্জন পাহাড়ে সুন্দর পাইনের বন, আমার ভীষণ ভালো লেগে গেছে। এখানে বড় একটা কেউ আসে না।

পরের দিন আমি প্রতিদিনের নিয়ম মতো সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। পাহাড়ে, বনে এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ঘুরে, কেক রুটি যা ছিল খেয়ে, ঝর্ণার জল যেটুকু সম্ভব মুখে দিয়ে, বেশ রাত করেই বাংলোয় ফিরলাম। ঢুকতেই পরিচারক জানাল, ‘মেসাব’ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এবং আমি ফিরলেই দেখা করতে বলেছেন। বেচারা জেনি আইজাক্! তাঁর দুচারটে হিন্দুস্থানী শব্দের বিদ্যে নিয়ে নিশ্চয়ই খুব ফাঁপরে পড়েছিলেন। আমি ওঁর দরজায় টোকা দিলাম। জ্বরের ঘোরে বসে যাওয়া গলায় ভেতরে যাওয়ার ডাক এলো। বুঝলাম, তিনি রীতিমতই অসুস্থ, আর শঙ্কিত হলাম যে পাহাড়ী জ্বরের প্রকোপ এখন বেশি। বড় পাজি রোগ। জ্বরে কাঁপছেন, কিন্তু ভয় পান নি। তিনি আমাকে প্রয়োজনীয় হিন্দুস্থানী কথাবার্তায় একটা তালিকা তৈরি করে দিতে অনুরোধ জানালেন, এক কাপ কোকো খেতে চাইলেন। পরিচারক ভাষা না বোঝার ফলে কিছুই আনতে পারেনি……।

আশ্চর্য, এই নির্জন পাহাড়ের বুকে একেবারে একা, এখানকার ভাষা জানা নেই, পথের হদিশ জানা নেই, কোনো দিক থেকে সাহায্য পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই, তবু কত নিশ্চিন্ত, নির্ভীক– এই অসুখের মধ্যেও। তিনি আমায় জানালেন, গত দু তিন সপ্তাহ ধরেই তাঁর এই রকম ঘুরে ফিরে জ্বর আসছে। তিনি অসুস্থ হয়ে আলমোড়ায় এক ভুটানীর কুঁড়ে ঘরে বিশ্রাম নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মনে ভয়ের লেশমাত্র নেই। আমি তাঁকে বললাম, এ ভাবে কিছু না জেনে শুনে অপ্রস্তুত ভাবে ভারতবর্ষের বনে-পাহাড়ে ঘুরতে আসা তাঁর উচিত হয়নি। তিনি বোধহয় লজ্জায় একটু লাল হলেন, কিন্তু ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিলেন—আমি অনন্ত ব্রহ্মকে খুঁজতে বেরিয়েছি।

আমি এক বিরাট হাসিতে ফেটে পড়লাম। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই হাস্যকর, মজাদার মনে হচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই আমায় নিজের থেমে যেতে হলো। ভদ্রমহিলার কোনো উত্তেজনার বালাই নেই। এমন আত্মমগ্ন ঠাণ্ডা, অনুত্তেজিত, জগতের প্রতি সম্পূর্ণ বিরাগী মহিলা আমি কখনো দেখিনি। তারপর তাঁর গলায় ব্রহ্ম’ কথাটা শুনে মনে হলো সারা পৃথিবীতে ভারতবর্ষের এই মিস্টিক নাটকীয় কথাটা বেশ ভালই ছড়িয়েছে,আর তার সঙ্গে এই অঞ্চলের গল্প- অথচ আমি তো দীর্ঘদিন এখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছি…..।

আমি এ প্রসঙ্গ এড়াতে চেষ্টা করলাম। আমি তাঁকে মহাত্মা গান্ধী আর ভারতবর্ষের স্বাধীনতা—আন্দোলনের ওপর প্রশ্ন করলাম। অবাত্তার, প্রশ্ন, আমায় কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি নিজেই বাতিল করতাম। তিনি বললেন, এটা ইংরেজদের ব্যাপার, তাঁর কিছুই মন্তব্য করার নেই, তিনি ফিনল্যাণ্ডের এক ইহুদী বংশের মেয়ে; তবে তাঁর মতে, তিনি সাদা- চামড়ার লোকদের ভণ্ডামী একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, এবং সেজন্যেই -এ সব থেকে দূরে থাকার জন্যেই তিনি ঠিক করেছেন কোনো এক আশ্রমে গিয়ে সত্যের, জীবনের, অমৃত্যের সন্ধানে রত হবেন। তাঁর কথার মধ্যে দিয়ে আমি অ্যাংলো-স্যাক্সেন জাতটা কিভাবে ভারতবর্ষের মহান সংস্কৃতিক নেহাৎই ফকিরি, মিস্টিক, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যাপার বলে অপপ্রচার করে আসছে, রামচরকের বইয়ে যে সমস্ত অবান্তর ধর্মীয় সত্যের এবং ক্রিয়া-কর্ম ভাবনার কথা বলা হয়েছে, তার প্রভাব অনুভব করলাম। এটা বোঝা যাচ্ছে যে, ভদ্রমহিলা দীর্ঘদিন ধরে একা; তিনি আমার সব কথাকেই সরাসরি নাকচ করছেন, তবু কথা বলছেন, কারণ অন্তত একজন মানুষ পেয়েছেন যে তাঁর কথা শুনছে, বুঝুক বা না বুঝুক। কথায় কথায় জানতে পারলাম তাঁরা পাঁচ বোন। তিনি কেপটাউনের মিউনিসিপ্যাল অর্কেস্ট্রায় বেহালা বাজাতেন; জোহান্স্বার্গের কনসার্টেও বাজিয়েছেন। মাসে চল্লিশ পাউন্ড স্টার্লিং আয় ছিল তাঁর। কিন্তু তাঁর পরিবারবর্গের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারেননি—তারা বুর্জোয়া মনোবৃত্তিসম্পন্ন, মেয়েরা বিয়ে ছাড়া আরও যে কিছু করতে পারে তা তারা ভাবতেই পারে না। তিনি এই শ্বাসরোধ করা পরিবেশকে মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁর কাজ ছিল রোজ রাতে তাঁর নিজের পয়সায় কেনা ছোট মোটর গাড়িতে চড়ে কনসার্টে বাজাতে যাওয়া, আর…..।

তিনি হয়তো পরম উৎসাহে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন, কিন্তু রাত হয়ে গেছে, এই অজুহাতে আমিই চলে এলাম। আমি তাঁকে বলে এলাম, যে-কোনো রকমের প্রয়োজন হলেই যেন আমাকে ডেকে পাঠান, তারপর খুব সন্তর্পণে তাঁর সঙ্গে মৃদু হ্যাণ্ডসেক করে বিদায় নিলাম।

সে রাতে অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে লাগলাম, অনন্ত ব্রহ্ম ব্যাপারটার মূল চরিত্রটা কী, যার আশায় ভদ্রমহিলা তাঁর সব কাজকর্ম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। তাঁর জন্যে আমার খুবই করুণা হলো, বেচারা শুধু রামচরক ছদ্মনামে ইংরেজ এক গল্পকারে অনন্ত ব্রহ্ম সম্পর্কে গল্প শুনেই একটা মোটামুটি সভ্য দেশের কর্ম, স্বাধীনতা ইত্যাদি ছেড়ে দিয়ে ব্রহ্মের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন! অনেকক্ষণ ধরে তিনি আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে তাঁর সব আবিষ্কার, যার মধ্যে দিয়ে তিনি “এক নতুন ইন্দ্রিয়াতীত জগতেরঃ সন্ধান পেয়েছেন, সে সব এক অপার্থিব, রহস্যময় ব্যাপার। একদিন নাকি রাত্রে স্বপ্নের মধ্যে একটা লাইব্রেরির নাম পেয়েছেন, যার সম্বন্ধে তিনি কিছুই জানতেন না। পরের দিন সকালে কোথায় যেন যাবার পথে তাঁর গাড়িটা মাঝ পথে দুর্ঘটনায় পড়ে, হঠাৎ দেখেন সামনেই সেই স্বপ্নে দেখা লাইব্রেরিটা। অথচ তিনি কেপটাউনের এই পথটা ধরে কতশতবার যাতায়াত করেছেন, কিন্তু এর আগে কোনোদিন তাঁর এটা চোখেই পড়েনি। তিনি তার ভেতরে ঢুকে প্রচুর, আধ্যাত্মিক ও যোগ সম্পর্কে বই দেখতে পেলেন। তিনি রামচরকের প্রচুর বই পড়েছেন। সেগুলো ভারতাত্মা সম্পকে “গভীর জ্ঞানসঞ্চারী”।

দিন কয়েক ধরে আমার অনন্ত ঘোরাঘুরি বন্ধ করতে হয়েছে। আর সেই অভ্যাসমত স্বপ্নাল কল্পনা আর তার ধ্যানে মেতে থাকতে পারছি না….। জেনি এখনো বেশ অসুস্থ, আমার তার কাছে থাকাটাই বেশি প্রয়োজন। একদিনেই সে আমার ওপর এত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যে তার এত দিনের একাকীত্ব ও মানবসঙ্গ ছেড়ে আসার কথা ভুলে সে সবসময় ছুতো-নাতা করে পরিচারককে দিয়ে আমায় ডেকে পাঠাচ্ছে। অন্তরঙ্গতার সূত্র ধরে সে এখন দীর্ঘ সময় ধরে আমাকে তার জীবনকাহিনী শোনাতে ব্যস্ত, অনেক কিছু তার একান্ত ঘটনাও নাকি সে আমার কাছে স্বীকার না করে শান্তি পাচ্ছে না। সে বলছে, তার সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার আগে তার জীবনের সব কথা আমাকে বলা দরকার এবং সে তার গোপন প্রেম ভালোবাসার কথাও অকপটে ব্যক্ত করেছে। সে বিশ্বাস করে যে নেহাৎই একঘেয়ে চলতি চরিত্রগুলোর থেকে সে একেবারেই আলাদা জাতের এবং সে নাকি মাদাম বোভারির মতো এক সময় তার জীবনে ক্রমাগত পুরুষ সঙ্গ করে এসেছে একের পর এক। তখন তার মনে হয়েছে সেটাই সব থেকে মহৎ এক আদর্শ বিশেষ, এক চরম সত্য। কিন্তু এখন নানা অভিজ্ঞতায় জেনির এই জগতের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে, এই সমাজ, পরিবার, প্রেম-ভালোবাসা, সবকিছু তার কাছে এক বিরাট ভুয়ো প্রবঞ্চনা বলে মনে হয়। সে যে কত কষ্টে এই সব পার্থিব বাঁধন থেকে মুক্তি ছিনিয়ে নিয়েছে, সব কিছু ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছে, সে সব অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলতে তার ভাবলেশহীন মুখে ব্যথার রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে তার সঙ্গীত ও শিল্পজগৎ থেকে বিদায় নেওয়া সত্যিই খুব বেদনার। সত্যিকারের ভালোবাসার অভিজ্ঞতা তার জীবনে সামান্যই…. সে বলেই ফেললো, যারা তার কাছে এসেছে তারা কেউই তাকে হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতে আসেনি। যাকেই সে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরেছে, পরে দেখেছে তারা প্রত্যেকেই অন্য কারো ঘনিষ্ঠ প্রেমিক। সে বুঝেছে, তার মন-প্রাণ দেওয়া প্রেম কারো কাছে কোনো মানসিক আকর্ষণ সৃষ্টি করেনি, তাই সে ইচ্ছে করেই দৈহিক প্রেমের চরম সুখ কোথায়। এই নিয়ে যেন গবেষণা করে এসেছে তার নিজের দেহ দিয়েই, তারপর এই পার্থিব বস্তু-জগতের মায়া ত্যাগ করে সে অনন্ত ব্রহ্মের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। এই তো, আফ্রিকা ছেড়ে বেরিয়ে আসার মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আগেই সে এক জার্মান ছেলের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছে, নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়েছে তার হাতে। ছেলেটি একজন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী। সে জেনির প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিল, সত্যি বলতে কি বোধ হয় ভালোবেসেই ফেলেছিল। সে বিশ্বাসই করতে চায়নি জেনির ভালোবাসার ছলনা আদপেই হৃদয়ের ভালবাসা নয়, তার এক নিষ্ঠুর খেলা মাত্র, দৈহিক মিলন-সুখের ছেলেখেলা। আসলে ভালোবাসার পাত্রদের সে মন থেকে ঘেন্না করে। সে তার বিশ্বাসের এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে পৌঁছলে মনে হওয়া সম্ভব, সমস্ত পুরুষ মানুষই এক একটা কামুক পশু মাত্র, এক একটা ক্ষীণজীবী, জড়ভরত, শুয়োর। সত্যিকারের প্রশংসনীয় পুরুষ হচ্ছে সে, যার ভেতরে বিচার বিবেচনা, বিবেক ও অন্যের প্রতি সহানুভূতি, মমত্ববোধ আছে, এবং যে আদর্শের জন্যে “পার্থিব সুখ” কে হেলায় ত্যাগ করতে পারে। যেমন, সন্ন্যাসী, দার্শনিক বা কোনো অধ্যাত্ম-রহস্যসন্ধানী। জেনির মাথায় এখন নানা রকমের অসংলগ্ন ভাবনা-চিন্তা ভীড় করে আছে। ওর নিজের জীবনের মানসিক বঞ্চনার ইতিহাস এবং বর্তমানে নানা নারীসুলভ কুসংস্কার- পুরুষ সম্পর্কে “মহানুভব পুরুষ”, “দেবসুলভ চরিত্র”, “নির্জন জীবন”, “সর্বত্যাগ”, ইত্যাদি ভাবনা ওর সব গুলিয়ে দিয়েছে….।

আমি এ-সমস্ত শুনে প্রায় ক্ষেপে উঠেছিলাম। আমি যেদিন থেকে জনসমাজ ত্যাগ করে এই নির্জন পাহাড়ে বাস করছি, সেদিন থেকে আমার মনে একটাই চিন্তা রয়েছে, আমাকে একটা আদর্শকে রূপ দিতে হবে, যেকোনো মূল্যেই হোক। আর এই মেয়েটা অনন্ত ব্রহ্মকে খুঁজতে গিয়ে সব কিছু এমনি গুলিয়ে ফেলেছে যে কেবল অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে এবং নিজেই নিজেকে কষ্ট দিয়ে মারছে। ওর মাথার ভেতর হাজারো রকমের বিভ্রান্তিকর ধারণা কিলবিল করছে।

প্রতি রাত্রে আমি যখন ঘরে ফিরে আসি, আমি আমার ডায়েরিতে আমার নিত্যদিনের চিন্তা, ধারণা, অভিজ্ঞতা লিখে রাখি। আমার মনে হচ্ছে, জেনির এখানে আসাটা আমার পক্ষে নিতান্তই একটা সাধারণ ঘটনা নয়। ওর উপস্থিতি বোধ হয় আমার সঙ্গে আবার নতুন করে আমার স্বেচ্ছায় ছেড়ে-আসা বস্তু জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেবে।

সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই জেনি সুস্থ হয়ে উঠেছে এবং শারীরিক বল ফিরে পেয়েছে। কিন্তু এখনো তার চলে যাবার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে আমার প্রতি তার মনোভাবও আমুল বদলে গেছে। প্রথম দিকে ওর কথাবার্তা আমাকে বেশ বিরক্ত ও উত্যক্ত করতো। কিন্তু ও আমার প্রতি বেশ আকর্ষণের ভাব দেখাচ্ছে, আমার কথার মূল্য দিচ্ছে, এবং কতকগুলো বিষয়ে তার প্রতি আমার প্রশংসাকে সাগ্রহে গ্রহণ করছে, এক কথায় ওর ভেতর দিয়ে আমি আবার আমার ইওয়রোপীয় মূল্যবোধকে যাচাই করে নিচ্ছি; কারণ আমিও তাদের ফেলেই দূরে এসেছি, হয়তো আবার তাদের মধ্যে ফিরে যেতে হবে কিছুদিনের মধ্যে বা অনেকদিন পরে। কিন্তু আমার এবং আমার নতুন তরুণী বান্ধবীর স্বার্থেই এই যাচাই হয়ে যাওয়াটা জরুরি ছিল।

একদিন ওর ঘরে ঢুকতে গিয়ে আমি রীতিমত শঙ্কিত হয়ে থ মেরে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। ঘরের মধ্যে জেনি তখন প্রায় নগ্ন অবস্থায়। আমি অস্বীকার করবো না, সেদিন আমি উত্তেজনা এড়াতে পারিনি, হাঁ করে তাকিয়েছিলাম সেই মোহময়ী রূপের দিকে।

সে রাতে নানা ভাবনা আমার মাথায় ভিড় করে রইলো। আমি নিজেকে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, মৈত্রেয়ীর ওপর আমার এই যে লাগামছাড়া ভালোবাসা, বাস্তবে তা কেবল আমার জীবনে প্রবল আঘাত, বিচ্ছেদ, আমার সব কিছ ছেড়ে এভাবে নির্জনে অজ্ঞাতবাস, নিজেকে প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত, বিপর্যস্ত করে ফেলা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি। এই প্রেমের নেশা আমাকে একটা জরদগব সেন্টিমেন্টাল, ভীতু ক্লীবে পরিণত করেছে মাত্র। আমার সমস্ত পৌরুষ নিয়ে কর্মজগতের মুখোমুখি দাঁড়ানোর, নিজের ব্যক্তিত্বকে ও কর্মক্ষমতাকে সকলের সামনে প্রতিষ্ঠা করার বদলে আমি জড়, অক্ষম, ব্যর্থতার জীবন বেছে নিলাম কেন! এক তুচ্ছ নারীর ভালোবাসাকে মর্যাদা দিতে গিয়ে আমি এই যে সর্বত্যাগী জীবনকে বেছে নিয়ে নিজেকে নিরস্তর বঞ্চনা করে চলেছি, এর শেষ কোথায়? এখনো কি সেই নারীর, সেই প্রেমের মৃতপ্রায় স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে আগামী দিনের বাস্তব সম্ভাবনাগুলোকে বিসর্জন দেবার কোনো যুক্তি আছে? নিদারুণ অন্তর্দ্বন্দ্বে সে রাতটা আমার প্রচণ্ডভাবে ছটফট করে কাটলো। আমার মনে হতে লাগলো একটা ভূয়ো আদর্শকে আকঁড়ে ধরে থাকতে গিয়ে আমি আমার সমস্ত জীবনটাকেই বিপথে নিয়ে চলেছি, যেটা একমাত্র মূর্খের মতো নিজেকে ধ্বংস করে দেবার পথ ছাড়া আর কিছুই নয় অবশ্য এটাও ঠিক, আমার মনের এখন যে অবস্থা, তাতে নতুন করে আবার নারীসঙ্গ, আবার সেই সংগ্রামের, কামনার, ব্যর্থ আকর্ষণের বাস্তব জগতের প্রতি আর আমার কোন মোহ রাখতে ইচ্ছে করছে না। আমার এখন এই জীবনের বিনিময়ে একটা জিনিস দেখারই প্রচণ্ড আগ্রহ যে, এই পৃথিবী ও তার নারী জাতি নিজেরা আমার দ্বারা কখনো আকর্ষিত হয় কিনা আমার এই পলায়নী মনোবৃত্তি আর জগতের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা অনীহাই কি আমার এই অবস্থার জন্যে দায়ী নয়? আমি নিজে ছাড়া আর কেউ কি জোর করে আমাকে এই পথে ঠেলে দিয়েছে? আমার কি এখনো নতুন করে ভাবার, নতুন পথ গেছে নেওয়ার সুযোগ আছে?

আমি জেনিকে যেন নতুন চোখ দিয়ে দেখতে চাইলাম। এবার আর আমার কোনো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব বা কষ্ট হলো না, কোনো অযথা সেন্টিমেন্ট কাজ করলো না, প্রথম প্রেমের বিহবল অনুভূতি হলো না। আমার স্বাধীনতায় আর কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

কেপটাউন ছেড়ে আসার সময়ে জেনির ভেতরে বস্তুজগতের প্রতি যে অনীহা তার নারীত্বের স্বাভাবিক ধর্ম ও অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, তাকে রুক্ষ কর্কশ করে ফেলেছিল, আমার সান্নিধ্য নিঃসন্দেহে তাকে তার সেই অবস্থার ফাঁদ থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে আরও স্নিগ্ধ কোমল রমণী করে তুলেছে। ও বোধহয় আমাকে ওর নারীত্বের মোহজালে বন্দী করতে পেরেছে …আমি যদি তাকে গ্রহণ করি, তার মধ্যে দিয়ে আবার নিজের কাছে প্রমাণ করে দিতে পারি যে আমার ভেতরের চিরকালের সেই পুরুষটা এখনো মরেনি, আমার সমস্ত দোষ, ত্রুটি, ক্ষুদ্রতা, উচ্ছল অনুভূতি নিয়েই আমি একটা মানুষ.. আবার যদি পৃথিবীর মুখোমুখি গিয়েই দাঁড়াই, আমাকে তো বাধা দেবার কেউ নেই। আমি এতাবৎ যা করে এলাম,তার বিপরীতটা করারও সম্পূর্ণ অধিকার আমার আছে।

আমার স্বীকার করতেই হবে যে জেনি ক্রমশ আমার কাছে আরও কোমল আরও স্নিগ্ধ আরও বেশি করে নারী হয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে ধর্ম প্রসঙ্গ নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ রেখেছে, “তিব্বতের রহস্য সম্পর্কে জানতে প্রচণ্ড আগ্রহী, কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছি, ওটা ওর একটা ছল মাত্র তার চোখ দুটো আরও ভাসা ভাসা, অর্ধনিমীলিত হয়ে উঠেছে যেন কী এক আরামে মদির নেশায়, তার গলার স্বরে এক উষ্ণ আবিল সুর, যেন অনেক বেশি রহস্যময়ী হয়ে উঠেছে ও। মাঝেই ও সামান্য কথায় উচ্চকিত হয়ে হেসে খুন হচ্ছে,কারণে অকারণে আমার মুখের সামনে পরম যত্নে চকোটের কাপ তুলে ধরছে, সবচেয়ে বড় কথা, যখন সে প্রথম এলো,তখন তার মুখে মেয়েলী প্রসাধনের চিহ্নমাত্র ছিল না: এখন সে মুখে পাউডার মাখছে, সুন্দর ভাবে মেক -আপ করছে, সাজছে। সে অনবরত আমার কাছে জানতে চাইছে আমি এই নির্জন জগতে একা একা পড়ে আছি কেন, আমার হাতে এই কালচে পাথর বসানো আংটিটা কে দিয়েছে, ইত্যাদি।

সবচেয়ে মজার কথা হলো, জেনিকে দেখে এবং ওর সঙ্গে কথা বলার মধ্যে আমি মৈত্রেয়ীর আভাস পাচ্ছি আমার অন্তরে এখনো নিরন্তর প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাসে মৈত্রেয়ীর অধিষ্ঠান। যখনই আমি কল্পনা করতে চাইছি, যে আমি কোনো নারীসঙ্গ উপভোগ করছি, যেমন হাতের কাছে জেনিই তো রয়েছে,–তখনই আমি ভেতর থেকে টের পাচ্ছি যে সেটা আমার পক্ষেএকেবারেই অসম্ভব ভালোবাসার প্রতিটি অভিব্যক্তির মধ্যেই একটা দুরুদুরু শিহরণের ভাব থাকে, কিন্তু আমার পক্ষে আর সেই ভাব ফিরে পাওয়া অসম্ভব। মৈত্রেয়ী আমার প্রাণ, মন সমস্ত সত্তাকে এমন ভাবে ঘিরে আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে, তার স্মৃতি আমাকে আর কোনো কিছুর দিকে তাকাতে পর্যন্ত দিচ্ছে না। সর্বত্র সে এসে দাঁড়াচ্ছে মূর্তিময়ী হয়ে, আমার যে-কোনো ভুলত্রুটির সম্ভাবনাকেই শাসন করছে আমার পৌরুষের সম্মান যাতে ধুলোয় লুটিয়ে না পড়ে। তাহলে আমি কী করবো? তাহলে আমি কি আর এলোইজ বা আবেলারের মতো দুর্মদ, দুর্দমনীয় হতে পারবো না এ জীবনে? আমার যে আবার স্বাধীন ভাবে সবকিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে, আবার একবার পরখ করে দেখতে ইচ্ছে করছে মৈত্রেয়ীর পরও আর একবার কাউকে নির্দ্বিধায় ভালোবাসতে পারি কিনা, নতুন প্রেমের জোয়ারে আর একবার ভেসে যেতে পারি কিনা। কিন্তু আমার পক্ষে আমার পুরনো সংস্কার ভেঙে নতুন করে চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমারই কতকগুলো বিভ্রান্তিকর মনোভাব আমি যেন কিছুতেই নতুন অভিজ্ঞতার ঝুঁকি নিতে সাহস পাচ্ছি না বাধার শেকল ছিঁড়তে পারছি না। আমি কি সত্যিই নিজেকে বুঝতে ভুল করছি …..

জেনি আগামী সোমবার চলে যাবে বলে ঠিক করেছে। ও রাণীক্ষেত থেকে একটা কুলি পাঠাতে লিখে দিয়েছে। শেষের এই কটা দিন ও যেন বডড বাড়াবাড়ি শুরু করেছে। নানা ছল-ছুতোয় কেবল আমার কাছে কাছে ঘুরছে, অকারণে ঘুরছে, অকারণে হাসছে, আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, যে পরিব্রাজক জীবন সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই, যাতে শুধু একাকীত্বের যন্ত্রণাই সার, সেরকম জীবনের দিকে এগোবার দরকার কী? আমাকে বার বার বোঝাচ্ছে ওর আর আমার মতো নির্জন জীবন-যন্ত্রণার স্পৃহা নেই, কারণ সেখানে কারও পথ চেয়ে থাকার সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ওর এই হঠাৎ নারীত্বের জাগরণের বেশ মজাই পাচ্ছি। শনিবার সন্ধ্যায় খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছিল, ঘন কুয়াশা ভেদ করে আকুল করা ছায়া মেঘ জ্যোৎস্না। আমার ভেতরটা যে ঠিক কিরকম করছিল তা বোঝাতে পারবো না: কেন আমি আমার ভেতরটাকে চেপে রেখেছি, আমি এত সতর্কভাবে নিজের কাছে কী গোপন করতে চাইছি? আমি ঠিক করে ফেললাম আজ এই বারান্দায় বসে ওকে মৈত্রেয়ীর সমস্ত কাহিনী শোনাবো।

কাহিনী বলতে বলতে মাঝ রাত পেরিয়ে গেল, সেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জেনি আর আমি তখনও বসে আছি বারান্দায়। একটু চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নেবার জন্যে আমরা দুজনে ওর ঘরে ঢুকলাম। আমি ইতিমধ্যে মৈত্রেয়ী প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ শেষ করে এখন খোকার চিঠির কথা বলছি, এবং জেনিকে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি যে আমি মৈত্রেয়ীকে ভুলেই যাবো ঠিক করেছি—আর এই অযথা যন্ত্রণার স্মৃতি মনের মধ্যে পুষে রাখবো না। যা গেছে তা যাক্। সেদিন ভাবের আবেগে কী যে বলেছি আর কী না বলেছি, তা নিজেই ভেবে পাই না সেদিন যেন হঠাৎ খুশির মততায়, বোকার মতো নিজেকে বিশেষ ভাবে প্রকাশ করতে রীতিমত বাচালতা এবং ভাড়ামিই করে ফেলেছি। আমি একটা সামান্য মানুষ, কেন যে অসামান্য একনিষ্ঠা দেখাতে গিয়েছিলাম, এই কথা ভেবে নিজেই হেসে খুন হয়েছি। জেনি শুকনো মুখে স্থির, স্তব্ধ হয়ে সব ইতিহাস শুনেছে, ওর দু চোখে জলের ধারা নেমেছে। আমিতাকে জিজ্ঞেস করলাম ও কাঁদছে কেন। ও কোনো উত্তর দিলো না। আমি ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত দুটো আমার হাতের মধ্যে নিলাম, তার দুবাহু দুহাতে চেপে ধরলাম যেন নতুন সঞ্চরিত আবেগে। সে আমার খুব কাছে এসে মাথা নিচু করে রইলো। আমাদের দুজনের উষ্ণ নিঃশ্বাস, দুজনকে স্পর্শ করতে লাগলো আমি ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ধরা গলায় চরম উৎকণ্ঠায় বললাম—কাঁদছো কেন? বলো বলো! এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও চোখ বুজলো, তারপর

হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চুম্বন করতে লাগলো।

প্রচণ্ড আনন্দ আর উত্তেজনায় আত্মহারা হয়ে আমি ঘরের দরজার খিলটা লাগিয়ে দিলাম…..।

ডায়েরির পরবর্তী পাতাগুলোয় মনে হচ্ছে আর মৈত্রেয়ীর ইতিহাসে ভরে রাখতে পারবো না। এই সব স্মৃতির বোঝা টেনে বয়ে বেড়ানোর আর কোনো প্রয়োজনই দেখছি না। এই দীর্ঘদেহী, সবল ফিনল্যাণ্ডবাসিনীর শ্বেত শুভ্র দেহ দুহাতে আকড়ে ধরে আমি আর মৈত্রেয়ীর কথা ভাবতে চাইছি না। জেনিকে প্রতিটি চুম্বন করার মধ্যে যে মৈত্রেয়ীর কথা মনে আসছে, সে মৈত্রেয়ী আমার বঞ্চনার ইতিহাস, তাকে আমি মন থেকে দূর করে দিতে চাই সম্পূর্ণভাবে। দীর্ঘদিন যে বরতনুকে ঘিরে আমার সেদিনের প্রেমের স্বপ্নসৌধ গড়ে উঠেছিল সে প্রেমের আজ সমাধি হয়েছে। আমি এখন কথা প্রসঙ্গে যে মৈত্রেয়ীর কথা টেনে আনছি, সেটাও বিতৃষ্ণা ও ঘৃণা নিয়েই।

আমি কি মৈত্রেয়ীকে সত্যিই ভুলতে চাই, না কি আমি নিজের কাছে জোর করে প্রমাণ করতে চাই, আমার ভেতরে প্রেমের নিষ্ঠা বা একনিষ্ঠা বলে কিছুই নেই আবার নতুন করে প্রেম করতে আমার এতটুকুও কষ্ট, এতটুকা দ্বিধা হবে না? আমি নিজের মনের ভেতরটা যথেষ্ট হাতড়েও কোনো সুদুত্তর পাচ্ছি না; নাকি এটা আমার প্রথম অভিজ্ঞতাহীন জীবনে একটি ভুলের বোঝা মাত্র? যার ফলে এই কাদায় পড়া অবস্থা। আমি কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারছি না যে সেই সব আপাতমধুর স্মৃতিগুলো হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে কী করে? আবার—আমি নিজেকে সেই সব হতভাগ্যদের সঙ্গে একাসনেও বসাতে পারছি না, যারা ভালবাসে, আবার ভুলে যায়, এবং এই করতে করতেই জীবন কাটিয়ে দেয়, প্রেম যে চিরন্তন, নির্দিষ্ট একনিষ্ঠতার প্রসাদ, তা মনে না রেখেই। কয়েক সপ্তাহ আগেও আমি এটা ভাবতে পারতাম না। কিন্তু জীবন এক অদ্ভুত অস্তিত্ব, আমারই দাঁতের বিষে আমি জর্জরিত, দোষ দেবো কাকে?

এ-সব জিজ্ঞাসা আমার মনে ঝড় তুলছে, তার কারণ মৈত্রেয়ীর আর আমার ভালোবাসা যে কতটা শক্তিশালী তা আমি জানি। একথা ঠিক যে জেনির সোহাগে, আলিঙ্গনে আগুন আছে, কিন্তু সে আগুনে আমি গা ঘিন ঘিন করতে করতে নিজেকে আহুতি দিয়েছি। যা করেছি, কিন্তু কথা ঠিক যে, এর পর আর একটি নারীসঙ্গের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে আমার অনেক-অনেক দিন লেগে যাবে। আর দুটো ক্ষেত্রের অস্তিত্বই আলাদা আমি যাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসি, সে হলো মৈত্রেয়ী, একমাত্র মৈত্রেয়ী। জেনি যখন নানাভাবে তার নিজস্ব ভঙ্গী এবং রুচিতে আমাদের আদর সোহাগ করে চলেছে, তখন আমি দাঁতে দাঁত চেপে থেকেছি। বেচারা জেনি, নেহাৎই মেয়েমানুষ। সে আমার দেহের পাশবিক সাড়া জাগিয়ে আমায় ক্ষেপিয়ে তুলতে পেরেছে, কিন্তু আমার মন থেকে, হৃদয় থেকে মৈত্রেয়ীকে মুছে দিতে পারেনি। অন্তরে যে নারীর স্মৃতিসত্তা চির জাগরূক হয়ে আছে, সে হলো মৈত্রেয়, একমাত্র মৈত্রেয়ীই। আর কেউ নয়।

মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম—তুমি সব সময় আমার বুকের ওপর পড়ে থাকতে চাইছো কেন? সে তার ভাবলেশহীন দুটো নীল চোখ বড় বড় করে মেলে, ছোট বাচ্চা মেয়ের মতো বলে উঠলো, তুমি মৈত্রেয়ীকে যেমন করে ভালোবাসো, আমাকেও তেমনি করে ভালোবাসবে বলে।

আমি চুপ করে গেলাম। এ রকম আকাঙ্ক্ষা কি সম্ভব? এই রকম ভালোবাসা পাবার আকাঙ্ক্ষা?

-যখন তুমি গল্প করো, মৈত্রেয়ীকে তুমি কতো ভালোবাসো, যখন আমার নিজেকে বড় একা, বড় দুঃখী মনে হয়। আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে.. কান্না পায়।

আমার মনে হয় ও বুঝে ফেলেছে যে, আমি যে আদর সোহাগ উপভোগ করেছি সেটা নেহাৎই দৈহিক ইন্দ্ৰয়ানুগ, আমিও তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি না। পরদিন ভোরে ওর ঘর থেকে আমি যেন মুক্তিস্নান করে রেরিয়ে এলাম। ও তখনও বিছানায় লেপটে শুয়ে আছে দোমড়ানো মোচড়ানো বাসি ফুলের মতো, আমার মৈত্রেয়ীকে ভুলবার পাগল-পরা চেষ্টার চিহ্ন স্বরূপ সমস্ত বিছানাটা এলোমেলো, নয় ছয় হয়ে আছে।

আমি সোমবার তাকে পাইন বন পেরিয়ে দূরে সেই ঝর্ণা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এলাম। হায় ঈশ্বর! আমাকে কেন এ–পথে নিয়ে যাচ্ছো? জেনি আইজাক! তোমাকে কি আমি কোনোদিন স্বপ্নেও কাছে পাবো?

আমার এই নির্জনে পড়ে থাকা এই একাকীত্ব এবার আমার নিজের কাছে কী রকম বিরক্তিকর, বোকামি বলে মনে হতে লাগলো। মৈত্রেয়ীকে নিয়ে আমার সাধের স্বপ্ন বার বার ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। আমি লক্ষ করছি যে, আজকাল সব স্মৃতি যেন অলীক কল্পনা বলে মনে হচ্ছে।আমার দিনে ক্লান্ত, রাতে অনিদ্র…..।

এর পর থেকে সব কিছু যেন বদলে যেতে লাগলো। একদিন সকালে

আমি উপলব্ধি করলাম, এবার ফিরাও মোরে। আশ্চর্য, প্রভাত-সূর্যের দিকে সরাসরি তাকিয়ে দেখলাম, সোনালী কিরণ, আর সবুজের মেলা। আমি বেঁচে গেছি। আমি মৃত্যুর কালো শীতলতা থেকে উদ্বেল আবেগ নিয়ে মুক্তি পেয়েছি। আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছে, ছুটে বেড়াতে ইচ্ছে করছে। আমি বুঝতে পারছি না কী করে এ সম্ভব হলো? কোন অপার্থিব শক্তি আমাতে ভর করে আমাকে আবার বদলে দিয়েছে, সম্পূর্ণ পৃথক সত্তায় পরিণত করেছে!

আমি নির্জন পাহাড়কে বিদায় জানিয়ে ফিরে চললাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *