লা নুই বেঙ্গলী – ১১

১১

বাড়ি ফিরে এসে দেখি টেবিলের ওপর একটা চিরকুট। তাতে লেখা লাইব্রেরিতে এসো। মৈত্রেয়ী আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বেশ ভয়-মাখানো কণ্ঠস্বরে বললো,-খোকা বোধ হয় সব জেনে গেছে।

আমি মাথা ঠাণ্ডা রেখে ওকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতে লাগলাম। ওর হাতের মধ্যে আমার দুটো হাত চেপে ধরে ও এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমার ওই শান্তভাবের মাধ্য ও যেন খুঁজছিল একান্ত নির্ভরতা।

–বাবাকে কিছু জানানোর আগে আমাদের দুজনের কাছে দুজনের একাত্ম হওয়াটা জরুরী। বাবা অসুস্থ। এসব কথা জানালে উনি আর অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

-হ্যাঁ ঠিকই। কিন্তু কী জানো, আমাদের দুজনের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস আর নির্ভরতা -জোরদার না করলে যদি কিছু নিন্দা হয়, তার মুখোমুখি আমরা দাঁড়াতে পারবো না। আমাদের ছন্দপতন হবে।

ও ভয়ার্ত চোখে চারপাশ দেখছিল। মৈত্রেয়ীর ইচ্ছা, আসক্তি এবং কৌলীন্যের সংঘাতকে উপলব্ধি করছিলাম। আর কত ঈশ্বরকে ডাকবো, আমাদের ভাগ্য সুনিশ্চিত করার জন্য। মৈত্রেয়ী বললো—তোমার আংটির পাথরটা আমি নিজে পছন্দ করেছি। মৈত্রেয়ী শাড়ির আঁচলের কোণে বাঁধা গিট খুলে একটা লম্বাটে বস্তু দেখালো সেটা ছিল গাড় সবুজ আর লাল রঙ দিয়ে তৈরি একটা প্যাটার্ন। এটা ও আমাকে বোঝালো। হিন্দু বিবাহরীতি অনুযায়ী ওটা সোনা আর লোহা দিয়ে তৈরি। দুটো সাপ যেন পরস্পরকে জড়িয়ে রয়েছে। একটা লোহার রঙের, অপরটি সোনালী। প্রথমটা পৌরুষের, আর দ্বিতীয়টা নারীত্বের প্রতীক। মিসেস সেনের সিন্দুকের মধ্যে পারিবারিক গয়নার বাক্সে একগাদা গয়নার মধ্যে থেকে ও এটা বেছে নিয়েছে মায়ের অজান্তে ও এটা নিয়ে এসেছিল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিল কেন! পরে অবশ্য উত্তরটা পেয়ে গিয়েছিলাম। ও ভয় পাচ্ছিল, খ্রীস্টীয় অনুশাসন অর্থাৎ নৈতিকতার মাপকাঠিতে যেটা পাপ, সেই পাপের মধ্যে আমরা নিমজ্জিত হচ্ছি না তো? সেজন্যেই ওর মতে, একটা বন্ধন দরকার। ঐ দিয়ে যে আংটি গড়া হবে, সেই আংটি সেই বন্ধনের প্রতীক হতে পারে। যদিও, আমি জানি পারস্পরিক বন্ধন বা চুক্তি কিছুই এর ওপর নির্ভর করে না। তবে সামাজিকতা অন্য জিনিস। সেদিক থেকে বিচার করে বিবাহিত মেয়েদের হাতে পরিয়ে দেওয়া হয় একটা সোনা আর লোহায় জড়ানো বালা। যেহেতু কুমারী অবস্থায় মৈত্রেয়ীর তা পরার সাহস ছিল না। তাই আমার হাতেই..

ও অনেক ধর্মীয় অন্য ধরনের কথা বলছিল সেই সন্ধ্যায়। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। কিন্তু ওর ওই অদ্ভূত রহস্যপূর্ণ এবং আনুষ্ঠানিক আড়ম্বর একদিকে, আর অন্যদিকে আমার মানুষের সঙ্গে মানুষের মধ্যে সহজ সরল সম্পর্কের যে ধারণা এ দুয়ের মধ্যে দেখা দিলো বিরোধ। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের ভালোবাসাকে একটা নিয়মাবদ্ধ প্রতীকের কাছে সমর্পণ করায় আমার মন সায় দিচ্ছিল না।

স্বর্ণকার যেদিন আংটিটা তৈরি করে নিয়ে এলো, আমি তা পারার আগে উল্টে পাল্টে দেখলাম ছেলেমানুষের মতো। বাড়ির কেউ ওয়াকিবহাল ছিল না, শুধু লীলু ও ঋতু আমার বিয়ে নিয়ে এ ব্যাপারে একজন ভারতীয়র সঙ্গে কথা বলেছিল। কিন্তু সবটাই ঘটেছিল সাধারণ হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে। ইঞ্জিনিয়ার তখনও অসুস্থ ছিলেন। উনি ছুটি বাড়িয়ে নিয়েছিলন এবং মিসেস সেনের ওঁকে শুশ্রুষা করা ছাড়া অন্য কোনও কাজ ছিল না।

পরের দিন মৈত্রেয়ী খুব ক্লান্তির ভান করছিল। ঘন্টাখানেকের জন্য লেকের ধারে ঘুরে আসবার জন্য ও একটা গাড়ি চাইলো। গাড়ির কথা শুনে ছবু আমাদের সঙ্গে যেতে চাইলো। কিছুদিন ধরেই ছবুর শরীর মন ভালো যাচ্ছিল না, সারাক্ষণই চুপচাপ থাকতো। খুব কম কথা বলতো, আর একদৃষ্টিতে শূন্যে তাকিয়ে থাকতো, অথবা সঙ্গতিহীন গান গাইতো। মিসেস সেন ওকে ছাড়লেন না। –আমাদের সঙ্গে দিলেন খোকার এক বোনকে। মেয়েটি বিধবা, খুব শান্ত প্রকৃতির। কাজ করতো ক্রীতদাসীর মতো। কোনোদিন গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াবার সৌভাগ্য যে হবে তা বোধহয় সে ভাবতেই পারতো না। বেরোবার সময় আমি ড্রাইভারের পাশে বসলাম আর ওরা দুই তরুণী বসলো পিছনের সিটে লেকে পৌঁছে বিধবা মেয়েটি গাড়িতেই বসে রইল। গাড়িটা রইলো রাস্তায় কাছে, একটা বিরাট ইউক্যালিপটাস গাছের তলায়। ড্রাইভার গেল লেমনেড খুজতে, আমি আর মৈত্রেয়ী গেলাম জলের ধারে।

কলকাতা বেড়াবার জায়গার আমার সব চেয়ে ভালো লাগতো লেকের ধারটা। কারণ শহরটা ক্রমশ হয়ে উঠছিল একটা মানুষের জঙ্গল। শান্ত, বিশাল জলাশয়ের ওপর উড়ে আসতো ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি। আমি জানতাম ওই লেকের ওপারেই আছে রেললাইন, অপর প্রান্তে রয়েছে শহরতলী। তবু আমার সদ্য গজিয়ে ওঠা গাছপালা দেখে মনে হতো,নিজের নিজের অস্তিত্ব আর স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য ওরা বুঝি পাল্লা দিতে চাইছে পুরনো বড় গাছের সঙ্গে। দু-একটা আলোর ব্যবস্থা তখন সবে মাত্র হয়েছে, তাই রাত্রি এখানে ছিল অনেক নিবিড়। মহরের কোলাহল থেকে দূরে এই অঞ্চলটা আমায় ফিরিয়ে দিতো আমার প্রথম কর্মজীবনের স্মৃতির স্নিগ্ধতা।

আমরা একটা ঘন গাছের কাছে এসে থামলাম। মৈত্রেয়ী আমার আঙুল থেকে আংটিটা খুলে নিয়ে নিজের দুই হাতের মধ্যে চেপে ধরে রইলো, বললো, অ্যালেন, আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবার এটাই উপযুক্ত মুহূর্ত।

মৈত্রেয়ীর দৃষ্টি ছিল দূরে, জলের দিকে। প্রেক্ষাপট ছিল এমন যেন মধ্য যুগীয় কোনো প্রেমের দৃশ্য উম্মোচিত হচ্ছে।। মৈত্রেয়ী যেন জল তারা-ভরা আকাশ, অরণ্য আর মাটিকে উদ্দেশ্য করে কথা বলছিল। ঘাসের ওপর ভর দিয়ে ও বসে ছিল। হাতে ধরা ছিল আংটিটা। সেই অবস্থায় মৈত্রেয়ী প্রতিজ্ঞার বাণীউচ্চারণ করলোঃ

মা বসুমতী, আমি তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি অ্যালেনের হবো। আমি ওকে নির্ভর করেই বর্ধিত হবো, যেমন ঘাস তোমার ওপর নির্ভর করে বর্ধিত হয়। যেমন তুমি বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকো, তেমনি আমি ওর আসার অপেক্ষায় থাকবো। ওর দেহ সত্তা থাকবে আমার জন্য, যেমন তোমার জন্য থাকে সূর্যের আলো। আমি তোমার সামনে প্রতিজ্ঞা করছি যে আমাদের এই মিলন সমৃদ্ধ হবে, কারণ আমি নিজেই স্বাধীন ভাবে ওকে পছন্দ করি। যদি কোনো দুর্ভাগ্য আসে তবে তা যেন ওর ওপর বর্ষিত না হয়ে আমার ওপর বর্ষিত হয়। মা বসুমতী, তুমি শোনো, আমি যেন কোনো মিথ্যার ভাগী না হই। যদি তুমি আমায় ঘনিষ্ঠভাবে ভালোবাসো, যেমন আমি তোমায় বাসি তাহলে এই মুহূর্তে, আমায় এমন শক্তি দাও যেন আমি সব সময় ওকে ভালোবাসতে পারি। আমি ওকে এমন আনন্দ দিতে পারি যা অন্যরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। যেন দিতে পারি একটি সফল জীবন। আমাদের জীবন যেন ঘাসের মতন মসৃণ প্রাণবন্ত ও আনন্দদায়ক হয়, যেমন করে তোমার স্নেহে ঘাসের গুচ্ছ বর্ধিত হয়। আমাদের চুম্বন যেন হয় প্রথম দিনের বর্ষার মতো স্নিগ্ধ। আমার হৃদয় যেন কখনও অ্যালেনের প্রতি ভালোবাসায় ক্লান্ত না হয়, যেমন তুমি কখনও ক্লান্ত হও না। অ্যালেনকে ঈশ্বর জন্ম দিয়েছেন কতদূরে, কিন্তু আমার আদরিণী মা তুমি, আমাকে নিয়ে এসেছো ওর কত কাছে..

আমি ওর কথা শুনছিলাম যতক্ষণ পর্যন্ত বোধগম্য হচ্ছিল। ও যেন ছোট্ট মেয়ের মতো আধো আধো বাংলা বলছিল। ও যে কী বলতে চায়, আমি সঠিক অনুধাবন করতে পারছিলাম না। যখনও চুপ করলো,আমার ভয় হচ্ছিল ওকে স্পর্শ করতে, ও এতখানিই তন্ময় হয়ে বসে ছিল। আমি ওর কাছে হাঁটু গেড়ে বসলাম, একটা হাত মাটির ওপর রেখে। ও -ই প্রথম কথা বললো, আমাদের এখন আর কেউ আলাদা করতে পারবে না, অ্যালেন। এখন আমি তোমার, সম্পূর্ণ তোমার।

ওর প্রতি অনুরাগে আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম, মনে মনে খুঁছিলাম এমন কথা, যা কোনো দিন বলা হয়নি। কিন্তু কিছুই নতুন খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমন কোনো শব্দই খুঁজে পাইনি, যা আমার অন্তরের উত্তেজনা প্রশমন করতে পারে। ওর আচরণে এমন একটা অদ্ভূত নিশ্চয়তা ছিল, যা আমার আজও মনে আছে।

একদিন তুমি আমাকে তোমার স্ত্রীরূপে বরণ করবে, এবং তুমি আমাকে সেই মুক্তির জগৎ দেখাবে, তাই না?

ওই ইংরেজীতে এই রকম কিছু কথা বলেছিল। আরো কিছু স্থুল জাতীয় কথা বলার জন্য ওকে খুব লজ্জিত দেখাচ্ছিল।

—আমি একদম বাজে ইংরেজী বলি, না অ্যালেন! কী জানি কী বাজে কথা ভাবছো আমার সম্বন্ধে। আমি বলতে চাই,এই জগৎ এই পৃথিবীকে আমি তোমার সঙ্গে দেখতে চাই, দেখতে চাই এমন ভাবে, ঠিক যে -ভাবে তুমি এই জগৎকে দেখো। পৃথিবীটা কত বড়, আর কত সুন্দর, তাই না? কেন আমাদের চারদিকে লোকেরা এত যুদ্ধ করে? এত দাঙ্গাহাঙ্গামা করে? আমি চাই অনুভব করতে। আমি চাই, সবাই আনন্দে থাকুক।.. কিন্তু না, আমি বোধ হয় অর্থহীন কথা বলছি। আমি জগৎটাকে যেমন ভাবি, সেটা কি তেমনই! যেমন করে ভাবি!..

বলে ও হাসতে লাগলো। গত শীতে মৈত্রেয়ীকে যেমন দেখেছিলাম, এখনও সেই রকমই দেখলাম। নিষ্পাপ, চমকপ্রদ। অনর্গল কথা বলছে। আপাতবিরোধী,কিন্তু সত্য-বিরোধী নয়। এমন সব কথায় ও অপার আনন্দ লাভ করছে। সেই সব অভিজ্ঞতার চিহ্ন, যা ওকে অযথা বিভ্রান্ত করেছে মনে হচ্ছিল সে সব যেন মুছে গেছে!

বুঝতে পারছিলাম যে, আমাদের ভালোবাসার বন্ধনই ওকে শান্ত ও তৃপ্ত করেছে, অবাধ সুখানুভূতি দিয়েছে। যখন আমাদের মিলনবন্ধন ওর মনে স্বীকৃত এবং গৃহীত হলো তখন যেন ওর সব ভয় চলে গেল।

রাত্রি হয়ে আসছিল, তাই আমরা তাড়াতাড়ি গাড়িতে ফিরে এলাম। এইবার, এই প্রথমবার আমি মৈত্রেয়ীকে আলিঙ্গন বা চুম্বন কিছুই করিনি। অসামান্য এক পবিত্র অনুভূতি আমায় আচ্ছন্ন করেছিল। শালটাকে মাথা পর্যন্ত মুড়ি দিয়ে গাড়িতে বসে আমাদের সঙ্গিনী ঝিমোচ্ছিল। সে আমাদের দিকে দেখলো যেন আমাদের দুষ্কর্মে সহযোগিতার আনন্দ নিয়ে আমরা এগোচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। আমি মৈত্রেয়ীর থেকে কিছু বড়। ও কিছু ছোট, কিন্তু অসামান্য সুন্দরী। ওর মুখশ্রী সৌজন্যপূর্ণ এবং স্বাধীনতা ও জয়ের আনন্দের দৃপ্ত ছাপ ওর প্রত্যেকটা ভঙ্গিতে!

অনেক পরে আমি মৈত্রেয়ীর কাছ থেকে জেনেছিলাম, খোকার এই বোনই প্রথম যাকে জানানো হয়েছিল আমাদের প্রেমের কথা এবং সে যতটা সম্ভব তা গোপন রাখার চেষ্টা করেছিল। এই মেয়েটি একটি অপদার্থ বক্তিকে বিয়ে করে দারুণ কষ্ট পেয়েছে। বিয়ে করেছিল দশবছর বয়সে এমন এক ব্যক্তিকে যাকে সে আগে কোনোদিন দেখেনি, তাকে সে দারুণ ভয় করতো। ঐ ব্যক্তিটি তাকে নৃশংসভাবে বলাৎকার করেছিল, এবং প্রতি রাত্রে তার কামোচ্ছ্বাসের আগে ও পরে মেয়েটিকে মারধোর করতো। এই মেয়েটি সব সময় মৈত্রেয়ীকে উপদেশ দিয়েছে জাত-ধর্মের নিয়মের প্রতি ভয় না পেতে এবং সব রকম প্রতিরোধের বিরুদ্ধে ও আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে। সে ছিল আমার পরম মিত্র এবং মৈত্রেয়ীর সব চাইতে বিশ্বস্ত ও ভালো বন্ধু। তবু ওকে আমি খুব কমই দেখেছি এবং দৈবাৎ ওর সঙ্গে কথা বলেছি। আমি জানিনা ওর নাম কী। আমি আমার ডায়েরী অনেকবার পড়েছি, ওর নামটা আবিষ্কার করার জন্য। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে পাইনি।

সেই রাত্রেই হবু খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লো। মিসেস সেন ওকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে ঘুম পাড়ালেন। কেউ বুঝতে পারছিলনা তার কি হচ্ছিল। লক্ষণগুলো ছিল অদ্ভূত; ও সব সময় চাইছিল জানলা বা বারান্দায় ঝুঁকে থাকতে। ওর বিশ্বাস ছিল ও নিচে কাউকে দেখতে পাবেই. রাস্তার ওপর, যে ওকে ঈশারা করে ডাকছে।

সারা দিনের এই সব ঘটনার পর কিছুটা ক্লান্ত হয়েই আমি শুয়ে পড়েছিলাম। আমার নানান অদ্ভূত স্বপ্ন দেখার কথা—জলের ধারে ঘুরে বেড়ানো, রাজহাঁস, জোনাকি.. কারণ আমার মন ছিল খুব বিহুল। ঠিক সেই সময় আমার দরজায় করাঘাত শুনে আমি ধড়মড় করে জেগে উঠলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কে? কেউ উত্তর দিলো না। স্বীকার করছি, আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম এবং আলোও জেলেছিলাম। দরজা খুলে বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম দরজায় মৈত্রেয়ী। ও দাঁড়িয়ে ও কাঁপছিল। পা খালি, যাতে আওয়াজ না হয় এবং পরনে হালকা সবুজ রংয়ের শাড়ি। আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করবে।

—আলোটা নিভিয়ে দাও, আমার ঘরে ঢুকে খুব নিচু গলায় বললো। তারপর আমার আরাম কেদারার পিছনে গিয়ে লুকোলো, মনে ভয়, যদি ওকে কেউ বাইরে থেকে দেখে ফেলে থাকে।

আমি আলো নিভিয়ে দিয়ে ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে বোকার মত জিজ্ঞাসা করলাম—কী হয়েছে মৈত্রেয়ী? এত রাত্রে?

ও কোনো উত্তর দিলো না। চোখ বন্ধ করে, ঠোঁট চেপে ধরে, ও খুব কষ্ট করে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। আমার সামনেই মৈত্রেয়ী নিবারণ হলো। অল্প আলোর দীপ্তিতে স্নান করে আমার ঘর আলোকিত করছিল ওর শরীর। ঘটনাটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। প্রায়ই আমি আমাদের প্রথম প্রেমের রাত্রির স্বপ্ন দেখতাম, দেখবো বলে বিশ্বাস করতাম সেই শয্যা, যেখানে আমি ওকে সম্পূর্ণ ভাবে দেখবো, জানবো, কিন্তু কোনোদিনই মৈত্রেয়ীর যৌবনপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাকৃত নগ্ন দেহের কল্পনা করিনি। আমার সামনে সেই রাত্রি উপস্থিত। অন্য কোনো পরিবেশে হয়ত আমাদের মিলন হবে, এরকম‍ই মনে হতো। কিন্তু ওর ঐ স্বতঃপ্রবৃত্ত কর্ম আমার সব দুরাশাকে অতিক্রম করে গিয়েছিল। ওর চোখে আকুল আহ্বান। আমি খুব আলতো ভাবে ওকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলাম। ওর ঊর্ধ্বাংশ ছিল নগ্ন। ওর সারা শরীর ছুঁয়ে আমার হাত ওর নিজস্ব স্পর্শ করলো। কোমরে ওর শাড়িটা খসে পড়লো পায়ের কাছে। পবিত্রকে অপবিত্র করার জন্য প্রবল প্রক্ষোভে আমি কাঁপছিলাম। ওর সামনে আমি নতজানু হয়ে বসলাম। ওর মূর্তি আমার কাছে এক অকল্পনীয় সৌন্দর্য নিয়ে আসেছিল। ও দু হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। এক দিকে অজানাকে জানার অনির্বচনীয় আনন্দ, অপর দিকে সংস্কারাবদ্ধ মনের শুচিতাবোধ ও ভয়, এই দুই-এর দ্বন্দ্ব তখন ওর চোখে মুখে। অবশেষে ও ভয় ও অসহায়তাকে জয় করতে সক্ষম হলো। ওর সমস্ত শরীরে তখন এক নতুন ছন্দ। আমার বিছানায় শোবার জন্যে ওকে আমি সাহায্য করতে গেলাম। ও প্রত্যাখ্যান করে নিজেই আমার বালিশে চুমু খেতে এগিয়ে গেল। পরমূহূর্তেই ওকে আমার সাদা সুজনীর ওপর ছড়িয়ে পড়তে দেখলাম একটা প্রাণবন্ত ব্রোঞ্জের মূর্তির মতন। ও কাঁপছিল, রুদ্ধশ্বাসে বার বার আমার নাম ধরে ডাকছিল। আমি জানলার খড়খড়িগুলো নামিয়ে দিলাম। রাত্রি নেমে এলো আমাদের ঘরে। …… পরে আমার আর কিছুই মনে নেই। ভোরের দিকে ও উঠে পড়লো। বুকের ধুকপুকুনি নিয়ে দরজাটা অতি সন্তর্পণে খুলে দিলাম। ও সরলভাবে বললো-আমাদের এই মিলন ঈশ্বর-নির্দেশিত। তুমি দেখছো না, আজকে হুবু আমার সঙ্গে শোয়নি?

যে সিঁড়িটা ওর ঘরের দিকে গেছে, সেখানে আমি ওর পায়ের আওয়াজ শুনতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুই শুনতে পেলাম না।

সকালবেলা মৈত্রেয়ীই আমাকে চায়ের জন্য খুঁজতে এলো। ও বাগানের ফুল নিয়ে এসেছিল। ফুলগুলো ফুলদানিতে যখন ও সাজিয়ে দিচ্ছিল, ওর মুখের বিবর্ণতা আমাকে আঘাত করছিল। চুলগুলো অগোছালো হয়ে ওর ঘাড় ঢেকেছিল। পরে ও বলেছিল, আমি ওর চুলগুলো এমন বিশৃঙ্খল করে দিয়েছিলাম যে ও আর গুছোতে পারেনি। ওর ঠোঁটে ছিল কামড়ানোর গাঢ় লাল দাগ। আমি চূড়ান্ত স্বর্গসুখ নিয়ে আমাদের প্রথম রাত্রির মিলন চিহ্নগুলো পর্যবেক্ষণ করছিলাম। মৈত্রেয়ী ছিল উজ্জ্বল সুন্দরী। ও বলেছিল, ওর সমস্ত শরীর সেদিন পুরোপুরি জেগে উঠেছিল। বলেছিল যে ছবুর জন্য ও ভীষণই উদ্বিগ্ন ছিল, সেজন্য সারা রাত্রি ঘুমোতে পারেনি। একদিকে আবার অসুখ, তার ওপর আবার ছবুর এই অবস্থা ওকে প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতার মধ্যে ফেলেছিল।

দিনটা যে কী ভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। নরেন্দ্র সেনের বদলী যিনি কাজ করছিলেন, তাঁর সঙ্গে সারা দিন ব্যস্ত রইলাম। ফিরে এসে দেখতে পেলাম মৈত্রেয়ী বারান্দার তলায় ডাকবাক্সের কাছে দাঁড়িয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। আমাকে চুল আঁটবার বাঁকানো পিন দিয়ে তৈরি এবং পাথরের মতন বোতাম দেওয়া একটা আংটি দেখালো যা ওর আঙুলে পরা ছিল।

—রাত্রে তোমার দরজা বন্ধ রেখো না। এ কথা বলেই মৈত্রেয়ী চলে গেল। প্রায় মধ্য রাত্রে ও এলো। কিন্তু এবার আর ও ভয় পাচ্ছিল না। ও আমাকে জড়িয়ে ধরে হাসছিল। আমি আনন্দ পাচ্ছিলাম এই দেখে যে ভুল যা হয়েছে তার জন্য ও বিষণ্ণ বা অনুতপ্ত ছিল না। আন্তরিক ছিল ওর আঁকড়ে ধরা, আকুলতা ছিল ওর আহ্বানে এবং চমৎকার ছিল ওর সোহাগ। প্রথম থেকেই ওর মিলনের সহজ জ্ঞান দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল যে কিছুই আর ওকে সঙ্কুচিত করছিল না, যদিও ও সব রকম অশালীনতা থেকে বিরত ছিল। এই অল্পবয়সী মেয়েটি ভালোবাসা সম্পর্কে কিছুই জানতো না আবার তাকে ভয়ও পেতো না। কোনও আশ্লেষ সোহাগই তাকে ক্লান্ত করছিল না, আমার পুরুষালী কোনো আচরণই ওকে নিরুৎসাহ করছিল না। বরং মিলনে ওর সবরকম সাহস ও সমর্পণ ছিল। প্রত্যেকটি উদ্যমের মধ্যেই ও পূর্ণ আনন্দ পেত এবং না জানাতো বিরক্তি, শ্রান্তি। কাঁদতো দুঃখে ও মিলন মুহূর্তের চরম আনন্দে। গান গাইতো পরে, ঘর জুড়ে নাচতো ওর ঈশ্বরীয় হাল্কা ও নমনীয় পা দিয়ে! ও এমন ভালোবাসার প্রকাশ উদ্ঘাটন করতো যে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম। ওর আঁকড়ে ধরার সুনির্দিষ্টতা, ওর দেহে মরালীর মত ঘনঘন পরিবর্তনের ছন্দ আমাকে বিহ্বল করতো। ওকে প্রত্যেক মুহূর্তে দেখাতো আরও দুঃসাহসী। ওর আদরে আদরে আমি বিপর্যন্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। ও এমন নিখুঁতভাবে আমার শরীরের ইচ্ছাগুলোকে উপলব্ধি করতো, যা প্রথমদিকে আমাকে অস্থির করতো। ও জানতো, ঠিক কোন্ সময়ে আমি ওর কাছে থাকতে চাইবো। আমি একটা ছোট্ট বেড ল্যাম্প যোগাড় করেছিলাম। ওটাকে আরামকেদারার পেছনে রেখে মৈত্রেয়ীর শাল দিয়ে ঢেকে রাখতাম। ঐ অবনমিত আলোয় ব্রোঞ্জের দেহটা একটা বর্ণালী নকশার রূপ নিতো। ও বেশিক্ষণ অন্ধকার সহ্য করতে পাতো না।

আমি অবাক হয়ে ভাবতাম ও কখন ভালো করে ঘুমোতো। রোজ ভোর হলেই চলে যেতো। দু- তিন ঘন্টা ধরে ধ্যান করতো। পরের দিন আমার অফিসে বসে পড়ার জন্য লিখতো কবিতা ও চিঠি আর তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতো আমাদের অকুণ্ঠ প্রণয়। সকালে চা ওই করতো। সকালবেলা আমার দরজায় ধাক্কা দিয়ে জাগাতো। যদি বাথরুমে আমার দেরি হতো, ও আমার উপর গজগজ করতো একটা বাচ্চার মতন। ভান করতো বয়স্কা মায়ের মতন। একটা পরম আত্মীয়সুলভ কণ্ঠস্বর যা প্রথম প্রথম আমার বিরক্তি উৎপাদন করতো। আমি চাইতাম ও প্রণয়পূর্ণ হোক প্ৰিয়া হোক। কিন্ত পরেও আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমি ওর ভালোবাসার গভীরতা ও তার বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ আবিষ্কার করেছিলাম, যা আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না। এই ভালোবাসার সুখানুভূতি না জেনেই আমি সেই ভালোবাসাকে কত না অবহেলা ও অশ্রদ্ধা করেছি!

প্রত্যেকদিন দুপুরের পর আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। আমার নতুন উপরওয়ালা আমাকে যখন তখন অপমান করতো। আর অশালীন ভাবে হুকুম দিতো। ভদ্রলোক একজন সদ্য আমেরিকা-ফেরত ইঞ্জিনিয়ার-ভারতীয় ট্র্যাডিশনের এক বড় নিন্দুক ও শত্রু। বাঙালী অথচ ইওরোপীয়ান পোশাক পরা। এক অদ্ভুত ধরনের মানুষ। খোকা নিঃসন্দেহে আমার পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল। ও আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল,—তোমাকে এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন? কেন তুমি জানলার খড়খড়িগুলো বন্ধ করে ঘুমোও?

খোকার এই প্রশ্ন আমাকে কতকগুলো জিনিস বুঝিয়ে দিয়েছিল। প্রথমত, খোকা অত্যন্ত বিদ্বেষ ও হিংসা নিয়ে আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতো। মনে হচ্ছিল মৈত্রেয়ী যে প্রায় রাত্রে আমার ঘরে আসে, সে ব্যাপারটা খোকা সন্দেহ ও লক্ষ্য করে। আমি ক্রমশ ভীত হয়ে পড়েছিলাম, সে যদি আমাদের বিরুদ্ধে সব জানিয়ে দেয়! তাই সিগারেট কিনে দিয়ে বা বই পড়তে দিয়ে ওর প্রতি আমি দারুণ সহানুভূতি দেখাতাম। ও ছিল বুদ্ধিমান ও উচ্চাকাঙক্ষী ছেলে। ও ভারতীয় সিনেমা কোম্পানিদের জন্য চিত্রনাট্য লিখতো, অবশ্য তা নিত্যই প্রত্যাখ্যাত হতো।

ছবুর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। প্রথমে ভারতীয় ডাক্তাররা ও পরে নামী ইংরেজ ডাক্তাররাও কিছুই বলতে পারছিলেন না। কেউ কেউ ভাবছিলেন ও বোধ হয় উম্মাদ হয়ে যাচ্ছে। অন্যেরা ভাবছিলো ওর হিস্টিরিয়া হয়েছে। মিসেস সেনের পাশের একটা ছোট্ট ঘরে হুবু থাকতো। খুব কম কথা বলতো আর যেটুকু বলতো তা শুধু রবি ঠাকুর-সম্পর্কে, অথবা সেই রাস্তা সম্পর্কে যেটা মৈত্রেয়ীর ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যেতো। ওকে যদি একা থাকতে দেওয়া হতো তাহলে ও বারান্দায় চলে যেতো রাস্তা দেখতে। তখন ও গান গাইতো। অথবা হাত দিয়ে অঙ্গভঙ্গি করতো বা কাঁদতো। লী এবং খোকার বোন ওকে সব সময় পাহারা দিতো। খুব আশ্চর্য যে ও শুধু মৈত্রেয়ীকে এবং আমাকে চিনতে পারতো, আর কখনো কখনো নিজের মাকে। আমি ভাবতাম কী করে মিসেস সেন চুপচাপ আর হাসিমুখে থাকতেন!- ওঁর স্বামী চোখ নিয়ে কষ্ট পাচ্ছেন, মেয়েটা পাগল হয়ে যাচ্ছিল অথচ কী করে উনি এই বড় বাড়িতে সব লক্ষ্য রাখতেন, আমাদের প্রত্যেকের সুবিধা অসুবিধার দিকে নজর দিতেন, আমাদের চা থেকে শুরু করে দুবেলা খাবারের বন্দোবস্ত করতেন নির্দিষ্ট সময়েই! এই রকম একটা সময়েই মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমার রাত কাটানোর জন্য আমি নিজেকে দোষারোপ করতাম।আমি যেন অধৈর্যভাবে সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, যেদিন মিসেস সেন আমাদের এই পাগলামীর কথা জানতে পারবেন এবং আমাদের ক্ষমাও করবেন। একটা কারণে আমার পুরী যাওয়াটা পিছিয়ে গিয়েছিল।আমার উপরওয়ালা ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলা। তাছাড়া মৈত্রেয়ী আমার যাওয়া বিরুদ্ধে ছিল আর সব থেকে বড় কথা মিসেস সেন, আমার জন্য ভয় পেতেন রাজনৈতিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে রক্ত ঝরাচ্ছিল দক্ষিণ বঙ্গে।

ছবু একদিন আমার আংটিটা দেখতে চেয়ে ওটা চেয়ে বসলো। আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমি মৈত্রেয়ীর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে কখনই ওটা হাত থেকে খুলবো না। কাজেই এ ব্যাপারে মৈত্রেয়ী সম্মতির প্রয়োজন ছিল, আবার ওদিকে ছবুও আংটিটার জন্যে কাঁদছিল, একটানা বায়না করছিল ওটার জন্য। যখন আংটি ও পেল তখন সেটা একটা রুমাল দিয়ে বেঁধে গলায় জড়িয়ে রাখলো। আমি জানি না ওকে কী আকর্ষণ করেছিল। ও ওটাকে একভাবে আঙুলের মধ্যে ঘোরাচ্ছিল, উল্টে দেখবার চেষ্টা করছিল।

ডাক্তারী চিকিৎসায় ওর কিছুমাত্র পাগলামী সারলো না। তুকতাক জানে এমন এক লোককে একদিন ডাকা হলো। এক অল্পবয়সী মেয়ের এক বুড়ো কাকাকে ডাকা হলো। তিনি সারাদিন ধরে বিষ্ণুস্তোত্র পাঠ করে গেলেন এক অদ্ভূত সুরে যা শুনলে মনে হয় আমাদের সব উৎসাহ যেন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, মন ভরে যাচ্ছে বিষণ্নতায়। বাড়ির সবাই এসেছিল শুনতে। নরেন্দ্র সেন একটা লম্বা চেয়ারের ওপর পা ছড়িয়ে শুয়ে ছিলেন, মাথার তলায় একটা কুশন, চোখে কালো চশমা। মন্টু, খোকা আর আমি ছিলাম, মাটিতে বসে মেয়েদের সঙ্গে আমি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। মানসিক আবেগ আমাদের সবাইকেই পেয়ে বসেছিল, এমন কী ইঞ্জিনিয়ার নিজেও কাঁদছিলেন সেই বেদনায়। মৈত্রেয়ী ওর শালের মধ্যে মুখ লুকিয়ে চোখের জল ফেলছিল যে সমবেত আবেগমনকে অভিভূত করে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ আমি কিছুক্ষণ পরে ঐ জায়গা ছেড়ে চলে গেলাম। একাই ঘরে রইলাম, কিন্তু কোনো কাজই করতে পারলাম না। কীর্তনের করুণ সুর সমস্ত বাড়ি পেরিয়ে এসে আমার কানে বাজছিল একটানা সেই সুর তখনও আমার একাকিত্বের বেদনা যেন বাড়িয়ে দিচ্ছিলো।

সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক অন্য আর এক ভাবেও ছবির মনকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। প্রচলিত এক টোটকা ওষুধ উনি সঙ্গে করে এনে ছিলেন। সেটা কোনো একজাতের লতা পাতা আর মধু দিয়ে তৈরি একধরনের লেই। ওটাকে মাথার একদম ওপরে চামড়ার ওপর লাগিয়ে দিতে হবে আমার মনে হলো এরকম এক বিপর্যয়ের মুহূর্তে আমার এগিয়ে এসে সাহায্য করা উচিত।কারোরই সাহস হয়নি ছবুর চুল কেটে দেবার। আমার ওপরেই সেই দায়িত্ব এলো। হবু এসব কিছুই বুঝতে পারছিল না। আমি ওর সামনের দিকে গিয়ে সোজা ওর দিকে তাকিয়ে চুলগুলো কাঁচি দিয়ে এলোপাথাড়ি কাটতে লাগলাম। অনর্গল ওর সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম, যাতে কাঁচির আওয়াজ ও না শুনতে পায়। বিছানার মাথার কাছে পিছন দিকে মৈত্রেয়ী চুলের গুচ্ছগুলো হাতে ধরছিল। আর সেগুলো পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখছিল। মিনিট পনেরোর মধ্যেই মাথার তালুটা পরিষ্কার করে দিলাম, আর মিসেস সেন সেইখানে সেই গরম লেই ঢেলে দিলেন। হুবু আমাদের দেখলো। মাথার তালুটা অনুভব করার চেষ্টা করলো, তারপরে সেই আংটি বাঁধা রুমালটা গলা থেকে খুলে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো চোখের জল অঝোরে গড়িয়ে পড়তে লাগলো ওর সুন্দর শ্যামবর্ণ মুখের ওপর দিয়ে। ও দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল না বা ফুঁপিয়ে কাঁদছিলনা যদিও ও বুঝতে পেরেছিল যে ও অর্ধেক ন্যাড়া হয়ে গিয়েছে ওর হঠাৎ হঠাৎ এই ধরনের মানসিক আক্রমণ হতো বিশেষ করে যখন ও চাইতো উঠে গিয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে, আর তাতে কেউ বাধা দিলে।

যাই হোক, দিনগুলো অত্যন্ত উত্তেজনার মধ্যে কাটছিল। অফিস থেকে ফিরে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেতাম মিঃ সেন আর ছবুর খবর নেবার জন্যে। তারপরে স্নান করে, খেয়ে আবার ওপরে আসতাম ছোট্ট মেয়েটার বিছানার পাশে বসে থাকবার জন্য। ও প্রায়ই বিকারগ্রস্ত অবস্থায় আমায় ডাকতো আর আমি কাছে এলেই কিছুটা শান্ত হতো।

এর মধ্যে সব রাত্রি আমি মৈত্রেয়ীর সঙ্গে কাটাতাম। সে নিজেকে পাগলের মতো আমার কাছে সঁপে দিয়েছিল। বাড়ির এই সব ঘটনায় ও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। আমার কাছে এসে ও যেন কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি পেতো। সকাল বেলা যখন ঘুম থেকে উঠতাম, তখন শরীর শ্রান্ত ও মনে বর্ণনাতীত ভয় নরেন্দ্র সেন দিন দিন চোখ অপারেশনের তারিখ পিছিয়ে দিচ্ছিলেন আর ডাক্তাররা ওঁকে সম্পূর্ণ বিশ্রামের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু যে দুঃখ ও ভীতির ঝড় বাড়ির ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল, তা তাঁর অবস্থার উন্নতির পক্ষে সহায়ক ছিল না। আমিও ভয় পাচ্ছিলাম সামান্য একটু অসতর্কতায় আমাদের সব ফাঁস হয়ে যেতে পারে যে—কোনো মুহূর্তে। মৈত্রেয়ীও উদ্বিগ্ন হতো। ও রাতে যখন আমার ঘরে আসতো, সবাই তখনও ঘুমিয়ে পড়তো না ছবুর ঘরের মধ্যেই ও আমার হাত জড়িয়ে ধরতো, আমার ঘাড়ে ওর দেহের সমস্ত ভার দিয়ে ভর দিতো হাতে চুম্বন করতো। একটু খেয়াল করলে যে, কেউই সব বুঝতে পারতো।

খোকার নজর আমরা এড়াতে পারিনি। লীলু এবং মন্টু অবশ্য সন্দেহ করতো যে আমাদের একটা যোগাযোগ আছে, কিন্তু কখনই ভাবতে পারেনি, আমরা প্রেমিক প্রেমিকা এবং এতখানি এগিয়ে গেছি।

মৈত্রেয়ী মাঝে মাঝে এমন একটা আচরণ করে ফেলতো যা আমাকে আতঙ্কজনক অবস্থায় ফেলতো। মৈত্রেয়ীর আগে বেরিবেরি হয়েছিল। তাই সন্ধের দিকে ওর পা ফুলতো, আর সেজন্য ডাক্তাররা ওকে মাঝে মাঝে ম্যাসাজ নেবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সকালবেলায় লীলু অথবা খোকার বোনেরা ওকে বিবস্ত্র করে, ওর সারা শরীরে একরকম দুর্গন্ধযুক্ত তেল মালিশ করতো। এই গন্ধ অনেক ধোওয়ার পরেও গা থেকে ওঠানো কঠিন হতো। মৈত্রেয়ী মাঝে মাঝে হঠাৎ যন্ত্রণা বোধ করতো। আর তখনই সঙ্গে সঙ্গে মালিশের প্রয়োজন হতো। তখন অবশ্য পায়ে মালিশ করলেই চলতো আর সে কাজটা খোকাই করতো। মৈত্রেয়ী ওকে ডেকে নিয়ে যেতো নিজের ঘরে। ওটা আমি লক্ষ্য করতাম কিন্তু সহ্য করতে পারতাম না।

এই ব্যাপারে মৈত্রেয়ীকে একদিন আমি যা-তা বলেছিলাম। ও আমার দিকে হতবাক্ হয়ে তাকিয়েছিল, তারপর বলেছিল, আমার দ্বারা এই কাজ হবার নয়। নিঃসন্দেহে খোকা একজন পেশাদার অঙ্গ সংবাহক ছিল না। ওর বয়স আর ওর অকারণ হাসিতে আমি রাগে কাঁপতাম এই ভেবে যে ওর ঐ কালো, লোভী বড় বড় হাতগুলো মৈত্রেয়ী গা স্পর্শ করছে।

একবার এক সন্ধেবেলা ও খোকাকে ডেকেছিল ভেতরের বারান্দার ওপর থেকে। ও হঠাৎ একটা ছুরির খোঁচায় খুব ব্যথা পেয়েছিল। খোকা উপস্থিত ছিল না তাই ড্রাইভারকে ডেকেছিল। আমি প্ৰায় কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছিলাম ওর এই ত্রুটির জন্য ওকে চাবুক মারবো বলে। কিন্তু আমার নিজের চিন্তায় নিজেই লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলাম—কিছুক্ষণ পরে অবশ্য বাগানের মধ্যে লুকিয়ে থেকে গোয়েন্দাগিরি করতে আমার লজ্জা হয়নি। মৈত্রেয়ী তখনও আলো জ্বালায়নি। আমি তিক্ততার সঙ্গে কল্পনা করছিলাম। সেইসব উপন্যাসের মনোরম প্রসঙ্গে, যেখানে গাড়ির ড্রাইভাররা তাদের মহিলা- মালিকদের প্রচ্ছন্ন প্রেমিক। চিন্তা করতে লাগলাম মেয়েদের অবিশ্বাসী চরিত্র আর অসততার কথা হাজার রকমের হীন চিন্তা যা এতদিন উপেক্ষা করে এসেছি,তা আমার মনকে আক্রমণ করলো একদিন মৈত্রেয়ীর ঘরে মন্টু ঢুকে চাবি দিয়ে ঘর বন্ধ করে দিলো। তারপর নিচ থেকে আমি ঝগড়া শুনতে পেলাম, সেই সঙ্গে ভয়ঙ্কর চিৎকার যেন শরীরে শরীরে লড়াই যখন ওরা বেরিয়ে এলো, তখন মন্টুর মুখ লাল, বন্যতায় ভরা আর মৈত্রেয়ী মলিন। ওর চুলগুলো অগোছালো হয়ে পাক খেয়ে পিঠের ওপর পড়ে। এটা অবশ্য সত্যি এ অল্প আগেই মৈত্রেয়ী আমায় জানিয়েছিল যে মন্টু একটা ইতর। ও খুব অন্তরঙ্গভাবে মৈত্রেয়ীকে কাছে পেতে চেয়েছিল, আর সেজন্য মৈত্রেয়ী ওকে একটা চড় কষিয়েছিল এবং বাবার কাছে নালিশ করেছিল। কিন্তু নরেন্দ্র সেন তখন অসুস্থ ছিলেন। তাই মন্টু ছিল তখন অপরিহার্য, তাই ওকে বার করে দেওয়া অসম্ভব ছিল।

মনে আছে মৈত্রেয়ী একদিন ওর অন্য আর এক কাকার কথা বলেছিল। সে চেষ্টা করেছিল মৈত্রেয়ীকে বুকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করতে। কিন্তু সেইবার হঠাৎ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এসে পড়েছিলেন। কাকাকে ওর হঠকারিতার জন্য ক্ষমা চাইতে হয়েছিল এবং চাকরিও খোয়াতে হয়েছিল।

মৈত্রেয়ী প্রায়ই আমার কাছে সেই ইন্দ্রিয়গত উত্তেজনাকে দোষারোপ করতো যা অন্যদের হৃদয়ে ও জাগিয়েছিল। এমনকি যাদের সঙ্গে ওর রক্তের সম্পর্ক আছে তাদেরও। ও চাইছিল ওর চারপাশে অন্য অনুভূতিকে সক্রিয় করতে যা ইন্দ্রিয়গত ইচ্ছার প্রকোপ বৃদ্ধি থেকে অনেক ভালো, পবিত্র।

আমি অন্য আর একটা দৃশ্যও দেখেছিলাম এক সন্ধেবেলা খোকা অনেকক্ষণ মৈত্রেয়ীকে আটকে রেখেছিল বারান্দার তলায়। মৈত্রেয়ী মানসিক বিপর্যয়ের সঙ্গে টেবিলে একা। খোকার সাহস হয়নি টেবিলে আসার। এই সব যা দেখতাম বা শুনতাম, তা আমাকে ভীষণ মানসিক যন্ত্রণা দিতো। আমার মনে হয়েছিল সবাই মৈত্রেয়ীর দেহকে চায়। আর সেও সবাইকেই প্রশ্রয় দেয়। এই নিয়ে আমি নানা অসম্ভব ব্যাপারের কল্পনা করছিলাম এবং নিদারুণ কষ্ট ভোগ করছিলাম। আমার হিংসা আমাকে একটুও স্বস্তি দিচ্ছিল না। আমি নিজেকে কিছুতেই এই অসুস্থ ভাবনা থেকে মুক্ত করতে পারছিলাম না যে মৈত্রেয়ী আরেকজনের বাহুর মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে।

সেদিন মৃত্যুবৎ হতাশার মধ্যে বাগান থেকে ফিরে এলাম। রাতের খাবারের সময় চেয়ারের তলায় আমার পা দুটোকে একপাশে সরিয়ে রেখেছিলাম। শোবার সময় একটা বড় কাঠের হুড়কো দিয়ে দরজা আটকে রেখেছিলাম, ঠিক করে রেখেছিলাম, মৈত্রেয়ীকে কিছুতেই আসতেই দেবো না। ও দরজায় টোকা দিতেই আমি জেগে উঠলাম, কিন্তু এমন ভাব দেখালাম যেন ঘুমিয়েই আছি, এবং কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। ও আরও জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো, আমাকে আরও একটু জোরে ডাকতে লাগলো আমার ভয় করছিল পাছে কেউ শুনতে পায়,তাই খুলে দিলাম।

-কেন তুমি আমায় ঢুকতে বাধা দিচ্ছো? তুমি আর আমাকে চাও না?—কথাটা বলতে বলতে মৈত্রেয়ীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল, চোখে জল নিয়ে ও কাঁপছিল। ও ঢুকলে আমি আবার দরজা বন্ধ করে দিলাম এবং দুজনে বিছানায় এসে বসলাম। ওকে জড়িয়ে ধরলাম না, বরং আমার অন্তর্বেদনার কথা ওর কাছে খুলে বললাম। দুহাত দিয়ে ও আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমাকে আকুল চুম্বনে ও ঢেকে দিলো, নখ ফুটিয়ে দিলো আমার বুকে, তবু আমি কথা বলেই চলেছিলাম। সেদিন আমি আমার নিদারুণ কষ্টের কথা, যন্ত্রণার কথা চেপে রাখতে পারিনি। আমার সব সন্দেহের কথা আমি বিষের মতো উগরে দিয়েছিলাম।

উঃ আমার দুঃখ হচ্ছে যে কেন ও আমাকে বলাৎকার করেনি! সেটাই ভালো ছিলো। —এই বলে সহসা মৈত্রেয়ী কাঁদতে লাগলো।

—তোমার সম্পর্কে, তোমাকে যতখানি জানি—ইন্দ্রিয়গত ও বেপরোয়া —তোমার ড্রাইভারের কাছে ব্যাপারটা খুবই সোজা ছিল। —ঘৃণার চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আমি উত্তর দিলাম।

—তুমি কি সব সময় এই সব অসম্ভব ব্যাপার কল্পনা করে আনন্দ পাও তোমার অতি সাধারণ আর অদ্ভুত নোংরা মন নিয়ে? এই বিকৃতভাব কি অনেক দিন ধরে তোমার মস্তিষ্ক পূর্ণ করে রেখেছে?

আমি উত্তরে উঠে দাঁড়ালাম, অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পায়চারি করতে লাগলাম। ওকে নিষ্ঠুর অপমানে বিদ্ধ করলাম। আমি ওকে দারুণভাবে ঘৃণা করছিলাম, এই কারণে নয় যে ও আমাকে প্রতারণা করেছে। কারণ হলো ও আমাকে ওর ভালোবাসার প্রতি, ওর পবিত্রতার প্রতি অন্ধভাবে বিশ্বাস করিয়েছে এবং সব কিছু ওকে দিয়ে, ওর কাছে আত্মসমর্পণ করিয়ে, ওর সব ইচ্ছা আমাতে পরিণত করিয়ে, ফিরিয়ে দিয়েছে ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপ। আমি এই ভেবে পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম যে নিজেকে সমর্পণ করেছি এমন একজনের কাছে যে আমাকে প্রতারণা করেছে প্রথম থেকেই। সত্যি বলতে কি, আমি বিশ্বাস করছিলাম না যে ও আমার সঙ্গে সত্যি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। আমি মৈত্রেয়ীর ভাবগতিক যেন একটা সাধারণ প্রহসন হিসাবেই বিচার করছিলাম। আমাদের বাড়ির মেয়েদের পরিবর্তনশীলতা ও খেয়াল সম্পর্কে ভালোই জানতাম। কিন্তু এও জানতাম যে আত্মসম্মান বোধ ও পরিমিতিবোধ তাদেরকে যে কোনো কারোর কাছে নিজেদের সমর্পণ করতে বাধা দিয়েছে। মৈত্রেয়ীর ব্যবহার আমার কাছে হেঁয়ালিপূর্ণ ছিল, এবং আমি আগে থেকে ওর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না। আমার মনে হয়েছিল ও যেমন আদিম এবং বেপরোয়া, তাতে ও অন্য যে কোনো কারোর কাছেই নিজেকে উৎসর্গ করতে পারতো দায়িত্বহীনতার সঙ্গে। আমার হিংসা ক্রমে ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল এবং গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা আমি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলাম। ভূলে গিয়েছিলাম মৈত্রেয়ীর স্নিগ্ধতা, এবং পবিত্রতা। সব কিছু একটি বিরাট প্রতারণার থেকে বেশি আর কিছুই মনে হচ্ছিল না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম মানুষের অনুভূতির ভঙুরতা। খুব নিশ্চিত বিশ্বাসও হয়তো সাধারণ একটা কাজের জন্য ভেঙে যেতে পারে। কিন্তু অধিকার, যা ঠিক ঠিক আন্তরিকতার সঙ্গে পাওয়া গেছে, তা ভঙ্গুর হয় না। কিছুই আমার অসৎ চিন্তাকে ঠেকাতে পারছিল না, এত সুখ, নিশ্চয়তা, নির্ভরতা, যা জমা হয়েছিল ভালোবাসা চলাকালীন, দুজনের একত্রে রাত্রিযাপনের সময়, সব যেন হারিয়ে যাচ্ছিল জাদুর মতন। আমার মধ্যে শুধু অতি-উত্তেজিত পুরুষোচিত অহংকার বড় হয়ে উঠেছিল আর একটা ভয়ঙ্কর ক্রোধ জেগে উঠেছিল আমার নিজেরই বিরুদ্ধে

মৈত্রেয়ী আমার কথা শুনছিল এবং দেখাচ্ছিল সে খুব কষ্ট পাচ্ছে, সেটা আমাকে আর উত্যক্ত করছিল। ও ঠোঁট কামড়ে রক্ত বার করে ফেলেছিল। বড় বড় সজল চোখ নিয়ে আমার দিকে দেখছিল যেন ও বুঝতে পারছিল না যে এমন দৃশ্য সত্যই ঘটছে।

পরে ও ফেটে পড়লো—তুমি আমাকে বলাৎকারের কথা বলছো? তুমি আমাকে কেন বুঝতে চাইছো না? তুমি আমার জন্য একদম চিন্তা করো না। তুমি আমাকে একদিন বলেছিলে যে যদি আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় লুণ্ঠিত হবার জন্য, তাহলেও তুমি আমাকে ভালোবাসবে। আমি নিজেকেও বলতাম যে এই রকম কিছু হলে ভালোই হবে। তাহলে আমাদের মিলনে আর কোনও বাধা থাকবে না। অ্যালেন, আমাকে বোঝো, আমরা মিলিত হতেও পারছি না আবার নিজেদের ভুলেই নিজেরা মরতে চলেছি। এমনকি তুমি যদি নিজেকে ধর্মান্তরিত করো, তাহলেও ওরা বিশ্বাস করবেন না যে তুমি আমাকে বিয়ে করছো। ওঁরা যে তোমার থেকে অন্য জিনিসের প্রতীক্ষায় আছেন তা তুমি বুঝতে পারো না? বরং যদি কেউ আমার শ্লীলতাহানি করে, তাহলে ওঁরা আমাকেই রাস্তায় ফেলে দিতে বাধ্য হবেন, নয়তো সেই পাপ গোটা বাড়ির ওপরেই পড়বে।আর ওঁদের থেকে বিতাড়িত হলে আমি তোমার স্ত্রী হতে পারবো, আমি খ্রীস্টান হয়ে যাবো একটা খ্রীস্টানের পক্ষে লুণ্ঠিত হওয়া পাপ নয় এবং তুমি আমাকে তখনও ভালোবাসবে। তাই না? তুমি আমায় সব সময়ের জন্য ভালোবাসবে। অ্যালেন, আমাকে অন্তত এটা বলো, তুমি আমাকে ভুলে যাবে না। তুমি জানো, আমার জন্য কী অপেক্ষা করবে আজ যদি তুমি আমায় ভুলে যাও।

আমি স্বীকার করছি যে আমি আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। মনে হলো যেন বিরাট দুঃস্বপ থেকে জেগে উঠলাম। আমার রাগ দূর হয়ে গেল এবং যা বলেছি তার জন্য খুবই অনুতপ্ত হলাম। আমি মৈত্রেয়ীর কাছে হয়তো ক্ষমা চাইতাম, কিন্তু কী ভাষায়,কী ভঙ্গিতে চাইলে তা ঠিক এই সময় যথাযথ হবে তা ভেবে পাচ্ছিলাম না যে সবগুলো মনে আসছিল, তার প্রত্যেকটা আমার মনে হচ্ছিল ভুল, হাস্যকর এবং কুৎসিত।

জানতাম না কী করতে হবে চোখে অনুশোচনা এবং ভালোবাসার ভাব দেখানোর চেষ্টা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও খুব কাঁদতে লাগলো আমার ত্রুটি উপলব্ধি করে ও খুব বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। আমার হাঁটু জড়িয়ে ধরে পায়ের কাছে আছড়ে পড়লো। অনুরোধ করতে লাগলো আমাদের প্রেম যেন অক্ষয় থাকে, যেন আমাদের ভুল আমাকে ভয় না পাইয়ে দেয়। আজ আমার মনে হয় ওর সব কথাগুলো ছিল অন্তরের আকুতি। কিন্তু সেই মুহূর্তে ওগুলো আমাকে আগুনের মত জ্বালচ্ছিল ও যন্ত্রণা দিচ্ছিল। আমি মৈত্রেয়ীকে দু বাহুর মধ্যে টেনে নিলাম এবং চুপ করে জড়িয়ে থেকে স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে বোঝাতে চাইলাম, যে আমি যা উচ্চারণ করেছি তার পিছনে ছিল আন্তরিক ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নয়। যা বলেছি তা দুরন্ত অভিমান থেকেই বলেছি। ও আন্দাজ করতে পেরেছিল আমি কতটা কষ্ট পাচ্ছিলাম। আমার নিজের মানসিক দুর্বলতায় আমরা দুজনেই নতুন করে আমাদের বিয়ের কথা এড়িয়ে গেলাম। ব্যাপারগুলো আমার কাছে অত সোজা মনে হচ্ছিলনা যতটা প্ৰথমে হয়েছিল চরম বিচ্ছেদের ধারণা করার চেয়ে বরং বেশি পছন্দ করছিলাম আমাদের মিলনের স্বপ্ন থেকে নিজেকে বিরত রাখা। জানলার পাশে যেন কার পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম মনে হলো। আলো নিভিয়ে দিয়ে চুপ করে রইলাম। তারপর পায়ের শব্দ বারান্দার দিকে চলে গেল এবং কে একজন যেন করিডরের দরজায় ধাক্কা দিলো। ভয়ে আমাদের হিম করে দিলো। আওয়াজ কিছুক্ষণের জন্য থেমে গিয়ে আবার ফিরে এলো। এবার আমার জানলার খড়খড়ির কাছে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এটা খোকা ছাড়া আর কেউ নয় নিঃসন্দেহে খোকা সিনেমা দেখে ফিরেছে। দরজাটার খিল খুলতে আমি দেরির ভান করলাম যাতে মৈত্রেয়ী নিজের ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় পায়।

—তুমি কার সঙ্গে কথা বলছো? –ও জিজ্ঞাসা করলো

-কারুর সঙ্গেই না! রূঢ় ভাবে বললাম এবং দরজাটা দড়াম করে ওর মুখের ওপর বন্ধ করে দিলাম।

তখনই ওপর থেকে মিসেস সেনের কন্ঠস্বর শুনলাম মৈত্রেয়ীর ঘরের সামনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *