লা নুই বেঙ্গলী – ৩

আজ আমি অনেকক্ষণ ধরে ডায়েরির পাতা ওল্টালাম। আমার আসামে থাকার দিনগুলোয় যা লিখেছিলাম আবার পড়লাম। দৈনন্দিন জীবন-যাপনের সংক্ষিপ্ত বিবরণগুলোকে পরম্পরা অনুযায়ী সাজিয়ে নিয়ে পরবর্তীকালে আমার পরিবর্তিত জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এটা জরুরী ছিল।

কাজে যোগ দিয়েছিলাম অত্যন্ত উৎসাহ আর কৌতূহলী মন নিয়ে। আমি ছিলাম বাস্তবিকই বোধহয় প্রথম পথপ্রদর্শক। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রেলপথ-নির্মাণের কাজ, আমার মনে হচ্ছিল, ভারতবষ সম্পর্কে একটা বই লেখার চেয়ে অনেক জরুরী আর প্রয়োজনীয়। কিন্তু এটাও ঠিক, ওই অতি প্রাচীন, প্রায় সভ্যতার প্রথম যুগের অঞ্চলের সঙ্গে আমাদের আধুনিক যন্ত্রপাতির সংঘাত-মিলনের ঘটনা যে- কোনো ঔপন্যাসিকের বিষয়বস্তু হতে পারতো অনায়াসে। আমার কাজের মধ্যে দিয়ে আমি যে ভারতবর্ষকে চিনছিলাম, তার সঙ্গে তখনও অবধি আমার পড়া ভারতবর্ষের ওপর লেখা উপন্যাস বা খবরের কাগজের রিপোর্টের কোনো মিল ছিল না। বিষাক্ত গাছপালা, অবিশ্রান্ত বৃষ্টি, মাথার যন্ত্রণার উদ্রেককারী তাপপ্রবাহ ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে আমি বাস করতাম যে আদিবাসীদের সঙ্গে, তারা অনায়াসেই নৃতত্ত্ববিদদের আকর্ষণীয় বিষয়বস্তু হতে পারতো। ঐ ফার্ন লতাগুল্ম-আচ্ছন্ন জায়গায় যারা থাকতো তারা ছিল একাধারে সরল এবং নিষ্ঠুর। চেষ্টা করতে কসুর করিনি ওদের মধ্যে সভ্যতার প্রাণ সঞ্চার করতে।

ওদের নীতিবোধ, শিল্পবোধ বোঝার চেষ্টা করলাম। সংগ্রহ করতে শুরু করলাম ওদের লোকগাথা, বংশ-পরিচয়ের ইতিহাস। ছবিও তুললাম অসংখ্য। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, যতই আমি ওই প্রায়-অসভ্য মানুষদের ভেতরে প্রবেশ করছিলাম ততই আমার মর্যাদাবোধ, অহঙ্কার প্রখর হচ্ছিল। এতদিন এগুলো কোথায় ছিল? এমনকি আমার মনে এরকম কিছু থাকতে পারে বলেও আমার ধারণা ছিল না। কিন্তু ওই জঙ্গলে সত্যি সত্যিই আমি ছিলাম সৎ আর আমার রিপু দমন করার ব্যাপারে অনেক বেশি সক্ষম।

কিন্তু বৃষ্টি! রাতের পর রাত অনিদ্রার শিকার হয়ে আমি শুনতাম ছাদের ওপর বৃষ্টির অবিরাম ছন্দ। অবিস্মরণীয় সেই শব্দ। মুষলধারে সেই বৃষ্টি দিনের পর দিন চলতো। ছেদ পড়তো হয়ত মাত্ৰ কয়েক ঘন্টার জন্য। কিন্তু তখনও একটা কুয়াশার মতো পরিবেশে ঝিরঝির করে তার রেশ চলতো। সেই সূক্ষ্ম বৃষ্টির কণাগুলো ছিল বরফের মতো ঠাণ্ডা কনকনে, তার মধ্য দিয়ে যখন আমি হেঁটে যেতাম, অদ্ভুত এক তীব্র বুনো সুবাস মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন করে দিতো।

বিকেলে হয় আমার বাংলার বারান্দায় পায়চারি করতাম, নয়তো নিরালা, নির্জন শোবার ঘরে বসে স্যাঁতসেঁতে তামাক পাইপে পুরে ধূমপানের চেষ্টা করতাম।

মাঝে মাঝে এই জীবন অসহ্য মনে হতো। এক তীব্র অস্থিরতা শরীর মন জুড়ে বিদ্রোহ জানাতো। ছট্‌ফট্ করতাম, ঘুষি পাকিয়ে বারান্দার থামে আঘাত করতাম। চিৎকার করে উঠতাম; বৃষ্টির মধ্যেই নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে পড়তাম কোনো এক অজানা দেশের সন্ধানে, যেখানে আকাশ অনন্তকাল ধরে মুষলধারে বৃষ্টিপাত করে না, বা ভিজে স্যাঁতসেঁতে উঁচু ঘাসের জঙ্গল নেই। ভীষণ মনে পড়তো তমলুকের কথা। সেই সমতল ভূমি, লবণাক্ত বাতাসের ঝাপটা, মরুভূমির মতো শুষ্ক বাতাস। এখানকার পরিবেশ, জঞ্জাল, পচা গন্ধ আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল।

বাংলোয় আমি ছাড়া আর থাকতো আমার তিনজন চাকর আর বাংলোর মালিক। কদাচিৎ কোনো বিদেশী আসতো; পাটচাষের পর্যবেক্ষক, মহকুমার কোনো ইংরেজ সরকারী কর্মচারী অথবা চীনযাত্রী কোনো চা-ব্যবসায়ী। সে সময় আমরা এক সঙ্গে বসে হুইস্কি খেতাম। অন্যান্য দিন কাজ থেকে ফিরে এসে স্নানের পর আমি একাই মদ্যপান করতাম। মদ খেতে খেতে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছতাম যখন নিজের অস্তিত্বের কোনো অনুভূতি আর আমার থাকতো না। তখন আমার গায়ে আঁচড় কাটলেও আমি কোনো কষ্ট অনুভব করতাম না। শ্বাস-প্রশ্বাসে একটা জ্বালা অনুভব করতাম। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেই মাথা ঘুরে যেত। আমার ইচ্ছাশক্তি লুপ্ত হতো। শূন্যে যে কতক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকতাম তা কে জানে। সময়ের জ্ঞান হারিয়ে যেতো। লম্বা চেয়ারে গা এলিয়ে, নাইট-গাউন পরে বসে থাকতাম। নেশার ঘোরে আমার চিবুক এসে ঠেকতো বুকে। এইভাবে একটা সময় আমার মনে হতো, ভিজে স্যাঁতসেঁতে ভাব কেটে গিয়ে আমার শরীরের পরিচিত উত্তাপ ফিরে এসেছে। এক একদিন এর পর লাফিয়ে উঠে পোশাক পরে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়তাম। ধুলোর মতো জলকণা মিশ্রিত বাতাসে শ্বাস নিতে নিতে বিষণ্ণ চিত্তে আমি স্বপ্ন দেখতাম একটা সুখী, সাধারণ জীবনের। শহর বা শহরের উপকন্ঠে একটা সাধারণ ছোট বাড়ি, শহরে দিনে অন্তত একবারও যাওয়া যায় এরকম একটা জায়গা হলেই চলবে। বৃষ্টির মধ্যে ভবঘুরের মতো ঘুরতে ঘুরতে এই সব ভাবতাম আমি। ঘুরে বেড়াতাম যতক্ষণ না অন্য কাজে প্রবৃত্তি আসত, অথবা ঘুম পেতো।

আসামে থাকাকালীন আমার ঘুম ছিল খুব গভীর। বিশেষ করে সেই তিন সপ্তাহ, যখন আমি সদিয়ার চল্লিশ মাইল দূরে জঙ্গলে কাজ করতাম। ওখান থেকে মাঝে মাঝে প্রায় মধ্যরাত্রে মোটরে বাংলোয় ফিরে আসতাম। পাহাড়ী রাস্তার খাদ এড়িয়ে অনেক ঘুর পথে ঘরে ফিরে এসে তখন আর জামা কাপড় ছাড়ার ইচ্ছে থাকতো না। প্রচুর রাম দিয়ে এক কাপ চা আর সঙ্গে কুইনাইন খেয়ে পোশাক পরেই শুয়ে পড়তাম। পরের দিন সকাল নটার মধ্যেই আবার ফিরে যেতে হতো কর্মক্ষেত্রে।

ক্রমশ আমার পোশাক-পরিচ্ছদে অবহেলা এলো। আর প্রয়োজনই বা কি ছিল! কয়েক শো মাইলের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকই শ্বেতকায় ছিল। তারা মৌসুমী আবহাওয়ার সময় পাহাড়ে থাকতোই না। আর ছিল কিছু অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান পরিবার। এদের বাড়িতে আমি কয়েকবার থেকেছি, যখন আমার মানসিক অবসাদ আর সহ্য করতে পারছিলাম না। ওই সব পরিবারে ইংরেজীতে কথাবার্তা আমাকে যেন কিছুটা স্বস্তির পরিবেশে ফিরিয়ে আনতো। সকলে মিলে সন্ধ্যা থেকেই আমরা মদ খেতে শুরু করতাম।

রবিবার আমার চাকরেরা শিলং চলে যেত সারা সপ্তাহের রসদ আনতে। সেদিন আমি দুপুর অবধি ঘুমোতাম। জেগে উঠে দেখতাম মাথা ভারী হয়ে আছে আর মুখ ফুলে কিম্ভুত-দর্শন হয়েছে। বিছানাতে শুয়ে শুয়েই ডায়েরি লিখতাম। খুঁটি-নাটি অনেক কিছু টুকে রাখতাম পরবর্তীকালে আসামে শ্বেতকায়দের জীবনযাত্রা নিয়ে যদি কখনও একটা বই লিখি এই ভেবে। এর জন্য আমার নিজেকে বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন হতো। আমার কর্মচাঞ্চল্যহীন স্নায়বিক অবসাদের দিনগুলো, আবার পাশাপাশি রেললাইন-পাতার প্রথম পথপ্রদর্শক রূপে আমার ভূমিকা, যেখানে আমার মন গর্ব আর শক্তিতে ভরপুর, এসবই তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করতাম।

সারা জুলাই মাসে আমি একবার মাত্র শিলং গিয়েছিলাম। অনেক অনেক দিন বাদে সূর্যের কিরণ গায়ে মাখলাম। সিনেমা দেখলাম আর আমার গ্রামোফোনটা সারিয়ে নিলাম। কয়েকটা ডিটেকটিভ উপন্যাস কিনলাম। আসামে যাওয়ার পর থেকে এ ছাড়া অন্য কিছু পড়ার মত মানসিক অবস্থা ও আমার ছিল না।

আমি জানতে পেরেছিলাম হেড অফিসে আমার কাজের খুব প্রশংসা হচ্ছে। সেটা জেনেছিলাম আমি সরাসরি নরেন্দ্র সেনের কাছ থেকেই, আমাদের শিলং-এর প্রতিনিধি মারফৎ নয়। এই প্রতিনিধি লোকটাকে আমি একদম সহ্য করতে পারতাম না। প্রচণ্ড অহঙ্কারী এই আইরিশ লোকটার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমাকে একবার শিলং-এ যেতে হয়েছিল। শুধু তার দেখা পাবার জন্য আমাকে সে অকারণে অপেক্ষা করিয়ে রেখে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। অথচ সে সময় তার এতটুকুও ব্যস্ততা ছিল না।

প্রায় প্রতি সপ্তাহেই মিঃ সেনের একটা করে ইংরাজীতে টাইপ করা কয়েক লাইনের চিঠি আসতো। কাজ স্বাভাবিক গতিতেই এগোচ্ছিল। সদিয়ার কাছে কঠিন গিরিপথগুলোর সংস্কারে কাজ আর পুরো রাস্তাটা পরিদর্শনের কাজ শেষ করে যদি রিপোর্টটা তৈরি করে ফেলতে পারি, তাহলে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি কলকাতায় যেতে পারবো, এরকম একটা সম্ভাবনাও দেখা দিলো। কিন্তু প্রচণ্ড অবসাদের সময় যে ভয়টা আমার কেবলই হতো, ঠিক তাই হলো। আগস্ট মাসের গোড়ার দিকে আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। আমার স্নায়ুর ওপর অত্যন্ত চাপ থাকার ফলে প্রচণ্ড ম্যালেরিয়ার আক্রমণ আরও জটিল আকার ধারণ করলো।

একদিন বিকেলের আগেই বাংলোয় ফিরে এলাম। শরীর ভাল লাগছিল না। ঘরে এসে চা খেতে গিয়ে মনে হলো কোনো স্বাদ পাচ্ছি না। কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এল। হ্যারন্ডের পরামর্শ মনে পড়লো। তিন গ্লাস ব্র্যাণ্ডি খেয়ে আমি শুতে গেলাম। পরদিন আর ওঠার ক্ষমতা রইল না। ভুল বকতে শুরু করলাম। ফ্র্যাঙ্ক নামে এক অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান ডাক্তার এলেন আমায় দেখতে। সব দেখেশুনে তিনি আমাকে সেদিনই সদিয়া পাঠিয়ে দিলেন। তখন পড়ন্ত বিকেল, কিন্তু সূর্য বিস্ময়করভাবে উজ্জ্বল ছিল। ফুল, পাখি, প্রকৃতি দেখতে দেখতে আমি চললাম সদিয়ার পথে। স্টেশনে এক শ্বেতাঙ্গিনীকে দেখে বিস্মিত হলাম। গত চারমাসে আমি কোনো বিদেশী মহিলা দেখিনি।

তারপর কি হয়েছিল আমার স্পষ্ট কিছু মনে নেই। শুধু বুঝতে পারছিলাম আমায় শিলং-এ আনা হয়েছে এবং আমাকে ইউরোপীয়ানদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কলকাতায় টেলিগ্রাম পাঠানো হয়েছিল। আমার জায়গায় বদলী লোক আসার আগেই নরেন্দ্র সেন আমায় দেখতে এলেন। এর পাঁচ দিন পর ট্রেনের একটা প্রথম শ্রেণীর কামরায় আমাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সঙ্গে রইলো দুজন নার্স এবং হ্যারল্ড। কলকাতায় পৌঁছে আমাকে সোজা তোলা হলো ট্রপিকাল হাসপাতালে।

একদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম আমার ঘরের দেওয়ালগুলো সাদা রঙের। ঘরে ক্যারামেল এবং অ্যামোনিয়কের গন্ধ। জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে এক ভদ্রমহিলা কিছু একটা পড়ছেন। মাথার ওপর চলমান পাখার একটানা শোঁ-শোঁ শব্দ। মনে হচ্ছিল আমার আধো ঘুম-জাগরণের মধ্যে কেউ যেন জোসেফ কাডের বই ‘লর্ড জিম’-সম্পৰ্কে কিছ বলছিল। বিছানায় সোজা হয়ে বসে আমার বলতে ইচ্ছে করছিল যে উপন্যাসটা নেহাৎই মাঝারি ধরনের। এর চেয়ে অনেক ভালো উপন্যাস কাডের যৌবনে লেখা ‘আলমেয়ারাস্ ফলি’।

আমি ভদ্রমহিলার উদ্দেশে বললাম, ‘আমেয়ারাস্ ফলি’ না পড়লে কাডের প্রতিভা সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়।

ভদ্রমহিলা আমার বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললেন—যাক্, ভগবানকে ধন্যবাদ, আপনি তাহলে কালা হয়ে যান নি

তারপর প্রশ্ন করলেন—আপনার কিছু লাগবে?

আমার ঠাণ্ডা, রুগ্ন খোঁচা-খোঁচা গালে হাত বুলোতে বুলোতে বললাম, আমি দাড়ি কামাতে চাই।

আরো বললাম, এই রকম অভদ্র চেহারায় আপনার মুখোমুখি হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইছি আমি।

ভদ্রমহিলা হাসিতে ফেটে পড়লেন। তারপর বললেন—যাক, আপনার জ্ঞান ফিরে এসেছে তাহলে। আমরা তো বলতে গেলে ক্রমশ হতাশই হয়ে পড়ছিলাম। এখন মিঃ হ্যারল্ড কার-কে টেলিফোন করতে হবে। উনি রোজ আপনার খবর নিতে আসেন।

হ্যারল্ডের যে আমার প্রতি এতখানি টান, সেটা জানতে পেরে আবেগে আমার চোখে জল এসে গেল। এই অপরিচিত, বান্ধবহীন অবস্থায় নিজেকে ভীষণ একা আর অসহায় মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কত দূরে আমার দেশ প্রায় পাঁচ সপ্তাহের পথ, আর আমি এখানে একা মৃত্যুপথযাত্রী।

ভদ্রমহিলা স্নিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন করলেন—কি হলো আপনার?

বললাম—কিছু না। আপনি যদি একটু আমার দাড়িটা কামাবার ব্যবস্থা করে দেন ….

আমার চোখের জল বাঁধ মানছিল না। মৃদু স্বরে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম—আপনার কি মনে হয় আমি ভালো হয়ে উঠবো? আমি আবার সুস্থ হয়ে উঠতে পারবো? আবার দেখতে পাবো নিউইয়র্ক, প্যারিস?

তাঁর উত্তরটা আমার মনে পড়ছে না। কিন্তু সেই দিনটা আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। এর পরই আমায় দেখতে এলেন কয়েকজন ইউরোপীয়ান ডাক্তার। তাঁরা চলে যাবার কয়েক মিনিট পরেই হ্যারল্ড এসে আমার করমর্দন করলো। তারপর অনর্গল বকে যেতে লাগলো, কলকাতার নানারকম খবরাখবর দিয়েঃ পারতির এখন প্রেমের খেলা চলছে মিডল ব্যাঙ্কের এক ম্যানেজারের সঙ্গে। গারতি এখন সিনেমা যায় সাড়ে তিন টাকার টিকেটে। বিয়ের পর নরিনকে দেখতে কুৎসিত হয়ে গেছে। আমার শোবার ঘরে এখন একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবার বাস করছে। আর, হ্যারল্ড নিজে কিন্তু যুবকই আছে। এখনো বিকেলের দিকে স্কুলের মেয়েদের ধরে নিজের ঘরে নিয়ে আসে, আর আসন্ন প্রসবা স্ত্রীর সামনেই নোংরামি করে। স্ত্রীর চিৎকার চেঁচামেচি সে কানেই তোলে না… ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমরা যখন এই ধরনের বাজে কথাবার্তায় মগ্ন ছিলাম তখন মিঃ সেন ঘরে ঢুকলেন। তিনি পরম আন্তরিকতায় আমার হাত দুটো চেপে ধরলেন এবং আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি ওঁকে হ্যারল্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। হ্যারল্ড যে ভাষায় মিঃ সেনকে সম্ভাষণ করলো, তা খুব ভদ্র ও মার্জিত ছিল না। বুঝতে পারছিলাম মিঃ সেন হ্যারল্ডের উপস্থিতিতে বিব্রত বোধ করছিলেন। মিঃ সেন বললেন, অ্যালেন, তুমি অত্যন্ত পরিশ্রমের ফলেই অসুস্থ হয়ে পড়েছো। চিন্তা করো না, ভালো হয়ে যাবে। অন্যান্য সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।

পরের দিন অফিস ছুটির পর তিনি আবার আসবেন এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে মিঃ সেন বিদায় নিলেন।

মিঃ সেন বিদায় নেবার সঙ্গে সঙ্গে হ্যারল্ড আমাকে বললো, এই জাতীয় লোক সম্পর্কে খুব সাবধান থাকবি, অ্যালেন। উনি তোর ওপর এতো সহানুভূতি দেখাতে শুরু করলেন কেন? তোর সঙ্গে ওঁর মেয়ের বিয়ে দেবেন না কি?

লজ্জায় লাল হয়ে কপট রাগ দেখিয়ে আমি বললাম—উল্টো-পাল্টা অযৌক্তিক কথা বলিস না তো!

অনেক দিন পর, মৈত্রেয়ীর মুখটা আবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কিন্তু এ এক অন্য মৈত্রেয়ী! মিসেস সেনের মুখের সঙ্গে যেন এ মুখের সাদৃশ্য অনেক বেশি। পানের রসে লাল টুকটুকে ঠোঁট, ঘাড়ের ওপর কালো চুলের খোঁপা, মুখে মৃদু হাসিতে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ নিয়ে আরও সজীব। বেশ কিছুক্ষণ ওর রূপের ধ্যান করলাম আমি। মৈত্রেয়ীকে অনেক দিন না দেখতে পাওয়ার বেদনা, শীঘ্রই আবার তাকে দেখতে পাওয়ার আশা ও আনন্দ, আবার কথা বলার সময় যে অস্বস্তি হবে, এ সবের মিশ্র প্রতিক্রিয়া আমার মন ছুঁয়ে গেল। এই সময়ে হ্যারন্ডের উপস্থিতি আমার শুধু বিরক্তিকর নয়, অসহ্য মনে হচ্ছিল। জানি না কী করে সেই আশ্চর্য অনুভূতির ব্যাখ্যা করবো। মৈত্রেয়ীর প্রতি আমার কোনো বিশেষ শ্রদ্ধার ভাব বা ভালবাসা, কিছুই ছিল না। আমি তাকে দেখেছিলাম খুবই সাধারণ একজন অহঙ্কারী বাঙালী মেয়ে হিসেবেই। সে ছিল এমন অদ্ভূত প্রকৃতির এক নারী যে একাধারে শ্বেতকায়দের ঘৃণা করতো আবার তাদের প্রতি আকৃষ্টও হতো।

হ্যারল্ড আমাকে যা বলে গিয়েছিল, সে সব শুনে আমার আনন্দ হবার মতো কিছু ছিলো না। সে চলে যাক এটাই আমি চাইছিলাম। এক দিনে পর পর অনেক কিছুই ঘটে গেল। অনেক কিছুই জানলাম আর অনুভব করলাম। একটু সুস্থ হওয়া আমার শরীর এবং মনে মৈত্রেয়ীর আবির্ভাব সেই মুহূর্তে আমায় যেন কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলছিল। বুঝতে পারছিলাম তার বাস্তব শারীরিক উপস্থিতি নতুন কোনো সমস্যার সৃষ্টি করলেও করতে পারে।

ভারতবর্ষে আসার পর আমি কখনো অসুস্থ হইনি, আর এত দীর্ঘকালীন অসুস্থতার স্মৃতিও আমার নেই। ইচ্ছে করতো বিছানা থেকে নেমে, জামাকাপড় পরে কলকাতার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। শহরের আলো আমার স্মৃতি আর বেদনা নতুন করে জাগিয়ে তুলছিল। ইচ্ছে করতো চায়না টাউনে গিয়ে ‘চাউ’ খাই, ‘চাও’-এর পেঁয়াজ, নুডলস, ডিমের কুসুম, বাগদা চিংড়ির গন্ধ ও স্বাদ—সব যেন আমি অনুভব করতে পারছিলাম। ইচ্ছে করছিল ফেরার পথে ‘ফিরপো’-এ নেমে জাজ্ শুনতে শুনতে একটা ককটেল খাই। হাসপাতালের বিস্বাদ খাবার আমাকে পাগল করে দিচ্ছিল। ধূমপান করাও নিষেধ ছিল।

পরদিন আমাকে দেখতে এলো আমার দুই বান্ধবী, গারতি আর ক্লারা। ওরা আমার জন্য প্রচুর চকোলেট, সিগারেট আর ফল নিয়ে এসেছিল। আমি কেবল ওদের বলছিলাম এখান থেকে পালাতে চাই, স্বাধীনতা চাই। এমন সময় হ্যারল্ড এসে পড়লো। সে আমার যেদিন ছুটি হবে সে রাত্রে পার্টি দেবার পরিকল্পনা শুরু করে দিলো। শুধু পার্টিই হবে না, সঙ্গে থাকবে লেকভ্রমণ। অনুষ্ঠানে যাতে কোনো খুঁত না থাকে তার জন্য গারতি তখনই কাগজ পেনসিল জোগাড় করে নিমন্ত্রিতদের তালিকা তৈরি করতে লেগে গেল। তালিকা থেকে দুই সিম্পসন বাদ যাবে এটাও ওরা ঠিক করে ফেলল। কারণ নরিনের বাগদান অনুষ্ঠানের সময় গারতি দেখতে পেয়ে গিয়েছিল যে ইশাক ঘরের কোণে লুকিয়ে লুকিয়ে ‘র’ হুইস্কি খায় আর জেরাল্ড সিগারেট চুরি করে—ক্যাথারিনকে অবশ্য নিমন্ত্রণ করতেই হবে, কারণ সে নাকি আমার অসুখের কথা শুনে দারুণ দুঃখ প্রকাশ করেছে আর মাঝে মাঝে আমার খবর নিয়েছে। হুবার ভাইরা আর সুন্দরী আইভির ব্যাপারে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এরকমই ঠিক করা হলো। বাদ বাকী নিমন্ত্রিতদের ব্যাপারে সবাই একমত হলো।

গারতিই বেশি কথা বলছিল এবং আমার হয়েই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল। তার কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার মন এখানে ছিল না। গারতির মুখ থেকে আমার দৃষ্টি সরে গিয়ে প্রায়ই শূন্যে নিরুদ্দেশ্য হয়ে যাচ্ছিল।

এমন সময় নার্স এসে খবর দিলো মিঃ সেন আসছেন। আমি পড়লাম মহা ঝন্‌ঝাটে। যখন কোনো সম্মানীয় ভারতীয়কে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যুবক-যুবতীদের সামনে আমায় দেখা করতে হতো, তখন একটা অস্বস্তি আমি অনুভব করতামই। গারতি আর ক্লারা কৌতূহলী চোখ নিয়ে দরজার দিকে তাকালো। প্রথমে ঘরে প্রবেশ করলেন নরেন্দ্র সেন মুখে স্মিত হাসি নিয়ে। তা পরেই এলো মৈত্রেয়ী। লঘু এবং ক্ষিপ্র ছিল পদক্ষেপ। আমার মনে হলো, আমার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। মনে পড়লো যে আজ আমি দাড়ি কামাইনি, যে নাইট গাউনটা পরে আছি তার আমার নয় এবং ওটা আমাকে একেবারেই মানাচ্ছে না। নিজেকে হাস্যকর একটা জীব বলে মনে হচ্ছিল। মিঃ সেনের সঙ্গে করমর্দন করলাম একটু কষ্টের ভান করে, যাতে নিজের অপ্রতিভভাবটা একটু ঢাকতে পারি। তারপর আমি মৈত্রেয়ীকে নমস্কার জানাবার জন্য কপালে হাত ঠেকালাম। এই কপট গাম্ভীর্য আনতে গিয়ে আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কী ভালো লেগেছিল যখন মৈত্রেয়ীকে আমার বন্ধুদের সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেবার পর সে অত্যস্ত স্বাভাবিক সপ্রতিভতার সঙ্গে তাদের করমর্দন করলো, আর জিজ্ঞাসা করলো, “How do you do?” মিঃ সেন হাসতে হাসতে বললেন, আমার মেয়ে দুটো পাশ্চাত্য রীতিতে ভব্যতা প্রকাশ করার ধারাটা ভালই রপ্ত করেছে।

তিনি সর্বক্ষণ গারতিকে লক্ষ্য করছিলেন এবং বিশেষ করে খেয়াল করেছিলেন তাঁর সূক্ষ্ম মতামতের সময় গারতির প্রতিক্রিয়া।

আমি যেন এক আগ্নেয়গিরির ওপরে বসেছিলাম। একদিকে আমার দুই বান্ধবী আর হ্যারল্ড নিজেদের মধ্যে বকবক করে চলেছিল, আর অন্য দিকে ঘরে উপস্থিত মিঃ সেন তাঁর মেয়েকে বাংলায় কিছু বলছিলেন। মৈত্রেয়ী আগ্রহভরে চারদিকে দেখছিল, কিন্তু তার দৃষ্টিতে তাচ্ছিল্য আর ব্যঙ্গ। যতবারই মৈত্রেয়ী কোনো আলোচনায় যোগ দিচ্ছিল, ততবারই তার ঠোঁটে ছিল একটা মৃদু হাসি যাতে ব্যঙ্গ আর সূক্ষ্ম পরিহাস মিশে ছিল। আমি মৈত্রেয়ীর মতো কোনো সরল মেয়ের মুখে এ জিনিস আশা করিনি। আমার অপরিচ্ছন্ন চেহারার জন্য নিজের ওপর আমার রাগ হচ্ছিল। একসঙ্গে গারতি, ক্লারা, হ্যারল্ড আর মিঃ সেনদের উপস্থিতি আমার কাছে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মনে মনে ভাবছিলাম মৈত্রেয়ীর মধ্যে মুগ্ধ হবার মতো কিছু নেই। ওকে ভালবাসতে পারা তো দূরে থাক, বড়জোর মাঝে মাঝে হয়তো দু-একবার দেখা করার ইচ্ছা জাগতে পারে। কিন্তু তবু তার সম্বন্ধে আমার একধরনের ঔৎসুক্য আমি অনুভব করছিলাম।

মৈত্রেয়ী বললো—মসিয়ে অ্যালেন, আমাদের বাড়ি কবে যাচ্ছেন?

মৈত্রেয়ীর কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভূত সুর ছিল যার ফলে আমার তিন বন্ধুই একসঙ্গে ঘুরে ওর দিকে তাকালো।

আমি বললাম—যেদিনই ভাল হবো সেই দিনই যাবো।

কথা বলতে আমি ইতস্তত করছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না কী বলে ওকে সম্বোধন করবো। ‘মিস’ শব্দটা ঠিক মানায় না, আবার ওকে ‘দেবী’ বলে সম্বোধন করতেও আমার সাহস হচ্ছিল না আমার এই হতবুদ্ধিভাব লজ্জায় আমাকে লাল করে তুলেছিল, তাই ক্ষমা চাইতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

বললাম—কিছু মনে করবেন না। ঘরটা গুছোনো নেই, দাড়ি কামাতে পারিনি আজকে, সারাদিন খুব ক্লান্ত লাগছে।

আমি তীব্র ক্লান্তির ভাণ করতে থাকলাম, আর মনে মনে কামনা করতে লাগলাম, সবাই যেন চলে যায়। কারণ একসঙ্গে সকলের এই উপস্থিতিতে আমার দারুণ অস্বস্তি হচ্ছিল।

নরেন্দ্র সেন বললেন—অ্যালেন, তুমি কি জানো যে আমরা ঠিক করেছি এর পর থেকে তুমি আমাদের বাড়িতে থাকবে! এটা আমার স্ত্রীর প্রস্তাব আর আমরা সবাই এটাতে একমত হয়েছি। তুমি এখানকার রান্না করা খাবারে অভ্যস্ত নও এবং এর পর যদি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ো তখন তার ফল মারাত্মক হতে পারে। এছাড়া আর একটা দিকও আছে, আমাদের ওখানে থাকতে তোমার টাকা- পয়সার খরচও কম হবার সম্ভবনা রয়েছে। ফলে সেই জমানো টাকা নিয়ে তুমি বছরে একবার হলেও দেশে যেতে পারবে, নিজের লোকজন আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারবে। আর আমার বিশ্বাস তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারো যে তোমার উপস্থিতি আমরা……

নরেন্দ্র সেন তাঁর বাক্য সম্পূর্ণ করলেন না, শুধু মৃদু হাসিতে তা শেষ করলেন। মৈত্রেয়ী সোজা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সে আমায় কিছু বললো না, শুধু আমার উত্তরের অপেক্ষায় রইল। তাঁরা চলে যাবার পরই কেন ডায়েরিতে লিখে রাখিনি ঠিক সেই মুহূর্তে মানসিক অবস্থা কী রকম ছিল, সেই কথা ভেবে আজ আমার বড় অনুশোচনা হয়। একথা বলছি এই কারণে নয় যে ঘটনাগুলো বহু পুরোনো। আসলে পরবর্তীকালে যে মারাত্মক ভাবাবেগ এবং বিদ্রোহী মনোভাব আমার মধ্যে এসেছিল তা আমাকে সম্পূর্ণভাবে উদাসীন করে দিয়েছিল এবং ফলত আমার সই সময়কার অনুভূতিগুলো নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও আজও স্পষ্ট মনে পড়ে আমার চিন্তা তখন দ্বিধা- বিভক্ত।

একদিকে একটা এমন জীবন যাপনের হাতছানি যা আগে কখনো কোনো শ্বেতাঙ্গের কপালে জোটেনি এবং যে জীবন লুসিয়্যাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু। একদিকে মৈত্রেয়ীর প্রতি আমার আকর্ষণ, যার প্রতিক্রিয়াকে পরবর্তীকালে মৈত্রেয়ীর তরফ থেকে এক রহস্যময় ঐতিহাসিক খামখেয়ালিপনা বলেও আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। অন্য দিকে আমার স্বাধীনতা প্রিয় মনের বিদ্রোহ। মনে হচ্ছিল ওখানে থাকলে আমার সমস্ত স্বাধীনতা খর্ব হবে, আমার ঊর্ধ্বতনের প্রচ্ছন্ন অদৃশ্য শাসনে আমার যৌবনের সমস্ত সাধ আহলাদ, এমন কি মদ্যপানও বোধ হয় বন্ধ হয়ে যাবে। আর সিনেমা দেখার ব্যাপারেও বোধ হয় তা সপ্তাহে একটাতে নেমে আসবে। এই দুটো বোধই আমাকে এত তীব্যভাবে আক্রমণ করেছিল যে, কোনটাকে প্রাধন্য দেবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিন্তু উত্তর তো একটা সময় দিতে হবেই, তাই আমি বলে ফেললাম—মিঃ সেন, আপনার কাছে আমার ঋণের শেষ নই। আমার ভয় হচ্ছে আমি না আপনাকে অসুবিধায় ফেলি।

বলতে গিয়ে কথাগুলো আমার মুখে একটু জড়িয়ে যাচ্ছিল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম ঐ দুটি মেয়ে—গারতি আর মৈত্রেয়ীর মুখের দিকে। বুঝতে পারছিলাম যে তারা দুজনে আমাকে নরেন্দ সেনের খাঁচায় পোরা ব্যবস্থার প্রস্তাবটায় বেশ মজা পাচ্ছিলেন। মিঃ সেন আর মৈত্রেয়ী আমার বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অন্যরা ছিল জানালার কাছে। নরেন্দ্র সেন হেসে বললেন—বোকার মতো কথা বলো না। আমার বাড়ির একতলায় লাইব্রেরীর পাশেই কয়েকটা ঘর খালি পড়ে রয়েছে। অসুবিধে আবার কি হবে! তাছাড়া তুমি থাকলে, আমার পরিবারের মধ্যে কিছুটা ইউরোপীয়ন সভ্যতাও তো ঢুকবে।

আমি মনে মনে ভাবছিলাম শেষ কথাগুলো কি মিঃ সেন ঠাট্টা করে বললেন? কিন্তু গারতি আমার চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে দিল। আগেই আমরা বন্ধুরা নিজেরা কথা বলে ঠিক করে নিয়েছিলাম যে মিঃ সেন বা তার সুন্দরী মেয়েরা যদি এই ধরনের কোনো বিপদে ফেলেন, তখন গারতি আমায় জিজ্ঞাসা করবে, অ্যালেন, তোমার প্রেমিকার খবর কি? নরিন ইসাবেল বা লিলিয়ান যারই নাম প্রথমে মাথায় আসবে তারই নাম জিজ্ঞাসা করলেই হবে। মিঃ সেনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গারতির সঙ্গে আমার চুক্তির কথা ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু গারতির মনে পড়লো এবং ঠিক সময়েই সে সেই প্রশ্নটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিল।

মিঃ সেন প্রশ্নটা শুনেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। মৈত্রেয়ী প্রশ্নকর্ত্রীকে দেখার জন্য মাথা ঘোরালো। উত্তরের অপেক্ষা না করে গারতি বলেই চললো—যাও যাও, অত সাধু সাজার কি আছে? বাড়ি ছাড়ার আগে তোমাকে ওর মতামত নিতে হবে তো? কি মিঃ সেন, ঠিক বলিনি?

মিঃ সেন গম্ভীর মুখে বললেন—হ্যাঁ, তা তো বটেই।

মৈত্রেয়ী দারুণ অবাক হয়ে গারতিকে দেখছিল। তারপর সে সোজা তার বাবার চোখে চোখে রাখলো। ব্যাপারটা চাপা দেবার জন্য মিঃ সেন তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন অ্যালেন, তোমার পড়ার জন্য বই এনেছি। আমার মেয়ে পছন্দ করেছে Out of the East। বইটা ওর ইচ্ছে ছিল তোমাকে শোনাবে। কিন্তু আজ তো অনেক দেরি হয়ে গেল…..।

মৈত্রেয়ী বললো–বাবা, আমি তো ভালো ইংরাজী পড়তে পারি না এদিকে গারতি তার প্রথম প্রচেষ্টা বিফলে গেছে দেখে বলে উঠলো—কিন্তু অ্যালনে তোমার প্রেমিকার ব্যাপারে কিছু বললে না তো?

তাকে থামাবার জন্য আমি চিৎকার করে বললাম—আমার কোনো প্ৰেমিকা নেই।

শুনে গারতি নিচু গলায় মিঃ সেনের কানে কানে বলে চললো—ও মিথ্যে কথা বলছে। আসলে ও একটা পাক্কা লম্পট।

সে একটা চমকপ্রদ দৃশ্যের সৃষ্টি হলো বটে। হতভম্ব, লজ্জিত মিঃ সেন মৈত্রেয়ীর দিকে তাকালেন। হ্যারল্ডদের হাব-ভাব দেখে মনে হল তারা ভাবছে তারা জিতে গেছে। জানালার পাশ থেকে সে তাই আমায় বিজয় সংকেত করছিল। ঐ রকম একটা পরিস্থিতিতে আমার অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। আর আমি তখন মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম, একটা অলৌকিক কিছু ঘটুক যাতে সব কিছু মিটমাট হয়ে যায়। নিজেকে আড়াল করার জন্য যন্ত্রণার ভান করে দু’হাত দিয়ে কপাল ঘষতে থাকলাম। মিঃ সেন বললেন—আমরা চলি। অ্যালেন তোমার এখন বিশ্রাম নেওয়া উচিৎ।

মিঃ সেন আমার করমর্দন করলেন, আমিও চললাম বলে হ্যারল্ড মিঃ সেন ও তার কন্যার কাছ থেকে বিদায় নিলো। কোনো সৌজন্য প্রকাশ না করেই।

হ্যারল্ড এবং মিঃ সেনেরা রেরিয়ে যাওয়া মাত্রই গারতি আর ক্লারা হাসিতে ফেটে পড়লো। গারতি বললো—অ্যালেন, দেখলে কেমন হারিয়ে দিলাম!

ক্লারা মন্তব্য করলো—কিন্তু দেখতে খারাপ নয়। শুধু নিগারদের মতো, এই যা। ও মাথার চুলে ওগুলো কি পরেছে অ্যালেন?

পুনরায় আমার পুরনো মানসিকতা চাড়া দিয়ে উঠল। বিশ্বাস না থাকলেও মন্তব্যগুলো আনন্দ সহকারেই শুনতে লাগলাম। এমন কি মিঃ সেনদের বিরুদ্ধে মন্তব্যে আমিও যোগ দিলাম। গারতি পুরনো কথায় ফিলে গেল। বললো—নাও, তালিকাটা শেষ বারের মতো দেখে নেওয়া যাক। আমার মনে হয় হুবার ভাইদেরও নিমন্ত্রণ করলে ভালো হয়। বড় ভাই ডেভিডের গাড়িটা তাহলে পাওয়া যেতে পারে। আর অ্যালেন, আমার উপস্থিত বুদ্ধির একটু প্রশংসা করো—কিরকম বাঁচিয়ে দিলাম তোমাকে, বলো?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *