লা নুই বেঙ্গলী – ২

তখন আমি তমলুকে বাঁধ-নির্মাণ ক্ষেত্রে তাঁবুতে থাকতাম।

দিন দুয়েক আগে জরিপের কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে। ফলত অ্যংলো-ইণ্ডিয়ান মহলে যা হয় সারা রাত ধরে হৈ হল্লা চলেছে। নাচ, গান তার সঙ্গে অফুরন্ত মদ। মেয়েরাও ছিল। রাতের শেষে অন্ধকার থাকতে থাকতেই লেকে বেড়াতে যাওয়া। গত মার্চ মাসের ঘটনাটা মনে পড়লো। এডি হিগারিং-এর সঙ্গে আমার তর্ক বেধেছিল। তর্ক থেকে তা ঘুষোঘুষি অবধি গড়িয়েছিল। নরিনের সঙ্গে প্রেমপর্বও সে সময়কারই ঘটনা। উঠতি যৌবনের প্রেমের উচ্ছ্বাস যে রকম হয় আর কী! যখন ইচ্ছে জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া, এ অবধিই।

নদীর ধারে, এক হাতে পাইপ, অপর হাতে ছড়ি নিয়ে ধীর পায়ে বেড়াচ্ছিলাম। সূর্য তখনও আকাশে আগুন ছড়ায়নি। বাতাসে ধুনো আর দারচিনির মিষ্টি গন্ধ; বড় বড় কাঠগোলাপ গাছের তলায় পাখিদের কিচির-মিচির। বিস্তীর্ণ তটভূমিতে কেউ কোথাও নেই। আমি একা। এই একাকীত্বই কি শাশ্বত! একাই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। সে চিন্তা কিন্তু আমার মনে বিষাদ এনে দেয়নি। সেই সমতলভূমিরই মতো আমার মন ছিল শান্ত, তৃপ্ত। সে সময় আমায় কেউ যদি বলতো যে আমার আয়ু আর মাত্র এক ঘন্টা, তবু আমি তখনই ঘাসের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়তাম মাথার তলায় হাত দুটো রেখে। মাথার ওপরে অনন্ত আকাশের নীল-সমুদ্রের দিকে অপলকে চেয়ে থাকতাম উপভোগ করতাম প্রত্যেকটা মুহূর্ত।

জানিনা কোন্ বোধ আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল। মনে হচ্ছিল আমি যেন সব কিছুই করতে পারি। আমি সর্বশক্তিমান, অথচ আমি সব কামনা থেকেই বিযুক্ত একটা অস্তিত্ব। সেই বিস্ময়কর জগতে আমার একাকীত্বের তীব্রতা আমাকে একেবারে অন্যমনস্ক করে দিচ্ছিল। ভাবছিলাম হ্যারল্ড, নরিন, এই সব মানুষের কথা। কী করে এরা আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লো! ওদের মতো গতানুগতিক আর প্রাণহীন জীবন তো আমার নয়!

একদিকে একাকীত্ব, অন্যদিকে শান্তির তৃষ্ণা—এই নিয়ে নিজের ডেরায় ফিরে এলাম। ভাবতে ভালো লাগছিল যে আরও এক সপ্তাহ এই তাঁবুতেই থাকতে পারব; ইলেকট্রিক বাল্ব দেখতে হবে না, পত্রপত্রিকার খবর আমার শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাতে এসে হাজির হবে না। এমন সময়, আমার বেয়ারা এসে ঢুকলো, তার হাতে কলকাতা থেকে আসা একটা টেলিগ্রাম। অফিসের কাজকর্ম সম্পর্কে কিছু নির্দেশ আন্দাজ করেই ওটা সঙ্গে সঙ্গে খোলার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিছুক্ষণ বাদে অবসর পেয়ে যখন ওটা খুললাম এবং পড়লাম, তখন কিছুক্ষণের জন্যে আমার মাথা যেন ফাঁকা হয়ে গেল। নরেন্দ্র সেনও টেলিগ্রাম পাওয়ামাত্র আমায় কলকাতা ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন।

বাধ্য হয়ে সেই দিনই বিকেলের গাড়িতে রওনা হতে হলো। জানালা দিয়ে সরে যেতে লাগল দৃশ্যাবলী—আমার প্রিয় দৃশ্যাবলী—কুয়াশাচ্ছান্ন সমতল ভূমিতে তখন পড়েছে শ্রেণীবদ্ধ গাছের নিভৃত স্বল্প ছায়াঃ মন ভারী হয়ে উঠছিল। সকালের কথা মনে পড়ছিল বার-বার। এই প্রকৃতি, যে আমাকে আজই সাদর উষ্ণ আমন্ত্রণ জানিয়েছিল উদ্দেশ্যহীনভাবে তার গহীন নির্জনতায় ঘুরে বেড়াতে! ভীষণ ইচ্ছে করছিল আবার ফিরে যাই কেরোসিনের আলোয় আলোকিত আমার সেই তাঁবুতে। আরো ইচ্ছে করছিল কান পেতে লক্ষ লক্ষ ঝিঁঝিঁ পোকা আর লক্ষ লক্ষ পঙ্গপালের ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তে।

দেখা হওয়ার পর মিঃ সেন বললেন—অ্যালেন, তোমার জন্য একটা ভালো খবর আছে। লামডিং—সদিয়ায় রেল লাইন বসানোর কাজ চলছে। পাহাড়ী জমি; কালভার্ট তৈরি, সঠিক বেনডিং এসব ব্যাপার তত্ত্বাবধানের জন্য একজন দক্ষ লোকের প্রয়োজন। আমার ব্যক্তিগত দায়িত্বে আমি কাউন্সিলের কাছে তোমার নাম সুপারিশ করেছিলাম এবং সুখবর হচ্ছে এই যে, তা গৃহীত হয়েছে। তোমার এখন কাজ হচ্ছে, পরবর্তী লোককে তোমার কাজ-কর্ম বুঝিয়ে দেওয়া। তোমার জিনিস-পত্র গোছগাছ করার জন্য তুমি হাতে মাত্র তিন দিন সময় পাচ্ছ।

মিঃ সেনের মুখ স্নেহে উজ্জ্বল। কিন্তু আমি মহা অস্বস্তিতে পড়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম, যে কোম্পানির কাজে আমাকে যেতে হচ্ছিল তারা ছিল স্বরাজ্য পার্টির সমর্থক। তারা চেয়েছিল, কোনো ভারতীয়ই ওই পদের দায়িত্বে থাকুক। শ্বেতকায় হিসেবে আমায় সমর্থন করায় মিঃ সেনকে নাকি কাউন্সিলে জোর লড়াই-এর মুখোমুখি হতে হয়েছিল।

আমার নতুন পদটা ছিল আমার আগের পদের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং মাইনেও ছিল অনেক বেশি। ২৫০ টাকার বদলে এখন আমার মাইনে হল ৪০০ টাকা, যা Noel & Noel কোম্পানির একজন প্রতিনিধির মাইনের চেয়েও বেশি। যদিও আমায় কাজ করতে হবে আসামের অস্বাস্থ্যকর অনুন্নত এলাকায় তবু আমার প্রকৃতি-প্রেমই শেষ পর্যন্ত জয়ী হলো। ভারতে এসেছিলাম যে-প্রকৃতির টানে তা বোধ হয় পূর্ণ হতে চলেছে, এই ভেবে আমি মিঃ সেনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালাম। মিঃ সেন আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন—অ্যালেন, আমি ও আমার স্ত্রী, আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমার কথা প্রায়ই আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়। তুমি বাংলা জানলে দারুণ ভাল হতো।

সে সময় তাঁর এই অযাচিত স্নেহপ্রীতির বিষয়ে খুব একটা ভেবে দেখিনি। তবে নিজের কাছে একটা প্রশ্ন ছিলই, মিঃ সেন তাঁর অসংখ্য পরিচিত ভারতীয়দের ছেড়ে আমার প্রতি এতটা পক্ষপাতিত কেন করছেন? মনে মনে একটা উত্তরও খাড়া করে নিয়েছিলাম যে, হয়ত আমার গঠনমূলক মেজাজ, কর্মশক্তি, উদ্যম এবং সর্বোপরি একজন বিদেশী হিসাবে ভারতবর্ষের উন্নতিতে আমার শ্রম এবং সময় নিয়োগের ব্যাপারগুলোই ওঁকে আমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।

যাইহোক, যথাসময়ে হ্যারল্ড খবরটা পেলো এবং সঙ্গে সঙ্গেই আমার পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি উপলক্ষে চায়না টাউনে একটা পার্টির দাবি জানালো। স্বাভাবিকভাবেই কিছু অ্যাংলো যুবতীকেও দলে নিতে হলো। দুটো গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। হৈচৈ আর হাসি-ঠাট্টা করতে করতে আমাদের দল সশব্দে নিজেদের অস্তিত্ব খুব বেশি করে জানান দিতে দিতে ক্রমশ পার্ক স্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গী রোডে এসে পড়ল। চৌরঙ্গী রোডে এসেই গাড়ি দুটো দৌড়-প্রতিযোগিতায় নেমে পড়লো। অবশ্য দোষ আমাদেরই। উভয় গাড়ির যাত্রীরাই নিজেদের ড্রাইভারদের উত্তেজিত করছিল। আমি যে গাড়িটায় ছিলাম তার ড্রাইভার আবার ফরাসী ভাষা জানে। যুদ্ধের সময় সে কিছু দিন ফ্রান্সে ছিল। আমার কোলের ওপর বসে ছিল গারতি। গাড়ির উন্মত্ত গতিতে ভয় পেয়ে গারতি আমায় জড়িয়ে ধরে বার বার বলছিল যে পড়ে যাবো, পড়ে যাবো। আমি পড়ে যাবো। তোমার কিছু যায় আসে না আমি পড়ে গেলে?

ধর্মতলার মোড়ে এসে আমাদের গাড়ি থামতে বাধ্য হলো কারণ একটি ট্রাম তখন রাস্তা জুড়ে চলেছে। অপর গাড়িটা ট্রামটার আগেই বেরিয়ে গেছে। আর ঠিক সেই সময়েই অঘটনটি ঘটলো। মিঃ সেনের গাড়ি একেবারে আমাদের পাশ ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। নরেন্দ্র সেন, তাঁর স্ত্রী এবং মৈত্রেয়ী সেই গাড়িতে। খানিকটা ভয়, লজ্জা আর অস্বস্তিতে আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। আমি কোনো রকমে তাঁকে নমস্কার জানালাম। মিঃ সেন প্রত্যুত্তরে একটু ব্যঙ্গের ভঙ্গীতে মৃদু হাসলেন। মিসেস সেন যদিও আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, কিন্তু তাঁর চোখে-মুখে তখন আতঙ্ক আর বিস্ময় যথেষ্ট প্রতীয়মান ছিল। একমাত্র মৈত্রেয়ীই মাথায় হাত ঠেকিয়ে আমায় নমস্কার জানালো। মনে হলো ও বেশ উপভোগ করছে ব্যাপারটা, আমার চার পাশের সঙ্গী সাথী আর কোলের ওপর বসা মেয়েটিকে দেখে। ওকে ভারতীয় কায়দায় প্রত্যাভিবাদন জানাবার ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু আমার হাস্যকর অবস্থার কথা বিবেচনা করে বিরত হলাম। যতক্ষণ না আমাদের গাড়ি পুনরায় যাত্রা শুরু করলো, ততক্ষণ যে আমার কি অস্বস্তিতে কাটলো কি বলবো! ঘাড় উঁচু করে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম মৈত্রেয়ীর হালকা চা- পাতা-রঙের শাল বাতাসে উড়ছে।

একজন ‘কালা আদমীম্বকে আমি শ্রদ্ধা জানালাম দেখে আমার ওপর অন্যদের টিটকিরির বন্যা বয়ে গেল। একটা দুষ্টুমির খোঁচা মেরে গারতি বললো, কাল থেকে হয়তো দেখবো অ্যালেন ভোর বেলা উঠে গঙ্গা-স্নান করছে। হ্যারল্ড জানতে চাইলো কি করে আমি একটা ‘নিগার’-পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলছি!

কিন্তু আমাদের ড্রাইভারটা গোড়া থেকে পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল! এই ঘটনায় তার প্রচণ্ড আনন্দ হয়েছিল। হোটেলের সামনে যখন তার ভাড়া মেটাচ্ছিলাম, সে ফরাসীতে আমায় বললো, ভীষণ ভালো লাগলো সাহেব। বাঙালী মেয়েটা আপনারই হবে। বহুৎ আচ্ছা।

পরদিন সকালে নরেন্দ্র সেনের সঙ্গে দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমায় খুবই স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন—কাল সঙ্গে কারা ছিল?

-আমার কয়েকজন বন্ধু স্যার!

-আর সুন্দরী মহিলাটি? তুমি কি ওকে ভালবাসো?

—মিঃ সেন, ওই মেয়েরা ভালবাসার পক্ষে খুব সস্তা। আমার চাকরি হওয়ার উপলক্ষে আমি বন্ধুদের একটা পার্টি দেবো বলেছিলাম। আমরা অনেকজন ছিলাম, তিনটে গাড়ি-ভাড়া করতে অনেক খরচা বেড়ে যেত, তাই দুটো গাড়িতেই আমরা ঠাসাঠাসি করে…। স্যার, কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে… বা…।

কথাবার্তায় আমার অতিরিক্ত সাবধানতা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তিনি আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন—অ্যালেন, তোমার সামনে কিন্তু অন্য রাস্তা খোলা আছে। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মেসে থাকার ফলে তোমার রুচি এবং কৌলীন্য দুই-ই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এই জীবন খুব মর্যাদার নয়। আর একটা কথা, এই ভাবে, এদের সঙ্গে জীবন কাটালে তুমি কিন্তু কোনো দিনই ভারতকে ভালবাসাতে পারবে না।

আমার ব্যক্তিগত জীবন-যাপন-পদ্ধতি সম্পর্কে মিঃ সেনের আগ্রহ দেখে আমি আশ্চর্য হলাম। তিনি যে এসব নিয়েও ভাবেন তা আমি কখনও ভাবিনি। এ যাবৎ তিনি আমার কাছে যা জানতে চেয়েছেন, অর্থাৎ ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেছেন, তা, আমি এখানকার খাদ্যে অভ্যস্ত হতে পারছি কি না, ভালো চাকর পেয়েছি কি না, এখানকার এত গরম বা শব্দে আমার কষ্ট হচ্ছে কি না, অথবা আমি টেনিস কেমন খেলতে পারি, ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

যাইহোক, আবার কাজের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলো। এক গাদা কাগজ-পত্রে সই করা বাকী ছিল। যাবার আগে মিঃ সেন আমাকে রোটারী ক্লাবে লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করলেন। আমি নানা অজুহাতে নিমন্ত্রণ এড়ানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি কোনো কথা শুনলেন না। নির্ধারিত দিনে, ক্লাবের একটা বিশেষ ঘরে আরও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে মিঃ সেন আমার পরিচয় দিতে গিয়ে যে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিলেন, তাতে আমার যথেষ্ট আনন্দ আর গর্ব হচ্ছিল।

সেই রাত্রেই আমি শিলং যাত্রা করলাম। স্টেশনে একমাত্র হ্যারল্ডই এসেছিল আমাকে বিদায় জানাতে। সে আমাকে শেষ বারের মত সাপ, কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া আর পেটের অসুখের হাত থেকে বাঁচার উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের মতামত পুনরাবৃত্তি করল, “জল খাবি না, শুধু সোডা দিয়ে ব্র্যাণ্ডি বা হুইস্কি খাবি।’ হ্যারল্ড শুভযাত্রা কামনা করলো। আমি কলকাতা ছেড়ে চললাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *