৬
একদিন নরেন্দ্র সেন আমার দরজায় টোকা দিলেন। দরজা খুলে দেখি তিনি তাঁর মেয়ের সঙ্গে কোথাও বেরোচ্ছেন। মৈত্রেয়ীর পরণে ছিল তার প্রিয় কফি সবুজ রঙের একটা শাড়ি, গায়ে মেরুণ রঙের শাল, আর সোনালী জরির কাজ করা তুর্কি চটি ছিল পায়ে। মিঃ সেন বললেন, মৈত্রেয়ী সৌন্দর্যের মূল সূত্রের ওপর বক্তৃতা দিতে যাচ্ছে।
ভালোই তো—আমি প্রশংসার ভঙ্গিতে হাসলাম। মৈত্রেয়ী উদাসীনভাবে তার শাল নিয়ে পাকাচ্ছিল। ওর হাতে কাগজে পাকানো ওর বক্তৃতার পাণ্ডলিপি। ও খুব সুন্দর করে চুল বেঁধে ছিল। কেওড়া আতরের প্রচণ্ড উগ্র সুগন্ধ ব্যবহার করেছিল। সেই গন্ধে আমার সারা ঘর ভরে গেল। আমি ওকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানালাম, বললাম, ও যেন একদম ঘাবড়িয়ে না যায়। নরেন্দ্র সেন একটু গর্ব করেই বললেন—ও এই প্রথম বক্তৃতা দিতে যাচ্ছে না। দুঃখের বিষয় তুমি ভালো বাংলা জানো না, নইলে তুমিও আমাদের সঙ্গে যেতে পারতে….।
আমি একটু চুপসে গিয়ে ঘরে ফিরে এলাম। অনেক তোড়জোড় করে একটু পড়া শুরু করলাম। কি রকম একটা অস্থিরতা আমায় গ্রাস করছিল। মৈত্রেয়ীর রূপই আমাকে আবিষ্ট করে তুলছিল। কোনোদিন ভাবতেও পারিনি ওই বাচ্চা মেয়েটা আমাকে এই রকম অস্থিরতার মধ্যে ফেলতে পারে। বার বার বিড়বিড় করছিলাম নিজের মনে ‘সৌন্দর্যের মূল সূত্র’, ‘মূল উপাদান’। তারপরে নিজের মনেই ভাবলাম, ব্যাপারটা নিয়ে আমি কি খুবই বাড়াবাড়ি করছি না?
ঘন্টা দুয়েক কেটে যাবার পর বাইরে তাদের গাড়ি থামবার আওয়াজ পাওয়া গেলে মৈত্রেয়ীকে অভিনন্দন জানাবো বলে আমি এগিয়ে গিয়ে বারান্দায় চলে এলাম। মৈত্রেয়ীকে কেমন যেন একটা বিষণ্ন মনে হলো।
-কেমন হলো বক্তৃতা?
-সবাই ঠিক বুঝতে পারেনি। আসলে ব্যাপারটা নিয়ে ও এত গভীর ভাবে ভেবেছে যে….। সৃষ্টির অনুভূতি, সৌন্দর্যের গভীরে প্রবেশ, এসব তত্ত্বকথা সাধারণ মানের শ্রোতারা বোধহয় ঠিক বুঝতে পারেনি।
আমার মনে হচ্ছিল, মৈত্রেয়ী বোধহয় একটু দাঁড়াতে চায়। আমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়। কিন্তু দেখা গেল সে কোনো কথা না বলে সোজা দোতলায় উঠে গেল। ওর শোবার ঘরের জানালা বন্ধ করার শব্দ শুনতে পেলাম। আমি আর আমার ঘরে থাকতে পারলাম না। পার্ক থেকে একটু ঘুরে আসবো ভেবে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। হঠাৎই দোতলার বারান্দা থেকে আমাকে উদ্দেশ করা তার ডাক শুনলাম—কোথায় যাচ্ছেন?
মৈত্রেয়ী বারান্দায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। পরণে বাড়িতে পরার ধবধবে পরিষ্কার সাদা শাড়ি, কাঁধের ওপর খোলা চুল, নগ্ন বাহুলতা। উত্তর দিলাম, একটু বেরোচ্ছি, তামাক কিনে ফিরবো।
-কেন? কোনো চাকরকে দিয়ে আনিয়ে নিন না?
–আর আমি? আমি কি করবো?
-আপনি যদি চান তো ওপরে চলে আসুন। আমরা দুজনে গল্প করবো, আমার ঘরে বসে।
এই অতর্কিত আহ্বান আমাকে উদ্বেলিত করলো। আমি স্বচ্ছন্দে সব ঘরেই যাতায়াত করতাম, কিন্তু কখনো মৈত্রেয়ীর শোবার ঘরে ঢুকিনি। এক নিমেষে আমি ওর ঘরে পৌছে গেলাম। ও দরজায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। ওর মুখ ছিল ক্লান্ত, দৃষ্টি অনুনয় মাখানো, আর ঠোঁট দুটো ছিল অসম্ভব লাল। পরে জেনেছিলাম, বাঙালী মেয়েরা তাদের সৌন্দর্য চর্চার রীতি হিসেবেই, কোথাও বাইরে যাবার আগে পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে নেয়।
—দয়া করে জুতো খুলে ঢুকুন।
ঘরের সংলগ্ন বারান্দার কাছে নিচু মোড়ার ওপর সে আমায় বসতে বললো। ঘরটা আয়তনে আমার ঘরের মতই বড়। সংলগ্ন ঘেরা বারান্দায় একটা লেখার টেবিল। ঘরে একটা খাট, একটা চেয়ার আর দুটো মোড়া ছিল। দেওয়ালে কোনো ছবি নেই, কোনো আলমারী বা আয়নাও ছিল না ঘরে।
–এই খাটে ছবু শোয়।
-আর তুমি?
–ঐ মাদুরে।
খাটের তলায় গুটানো একটা পাতলা মাদুর ও আমায় দেখালো। আমি অবাক হয়ে গেলাম। সেই মুহূর্তে ওকে আমার মানুষ নয়, দেবী মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন কোনো সন্ন্যাসিনীর সামনে বসে রয়েছি। হাসতে হাসতে ও বললো—প্রায়ই ওই বারান্দায় গিয়ে শুই। দারুণ হাওয়া দেয় আর নিচের রাস্তার আওয়াজ শোনা যায়।
বাড়ির সামনের রাস্তাটা এমনই যে, ওখান দিয়ে রাত আটটার পর লোক চলাচল করে না। সেটাকে ঠিক রাস্তাও বলা চলে না, বরং পার্কের একটা কোণের দিক বললে ঠিক বলা হয়।
-ওই রাস্তার আওয়াজ শুনতে আমার খুব ভাল লাগে। কোথায় গেছে ওই রাস্তাটা কে জানে।
আমি মজা করে বললাম—ক্লাইভ স্ট্রীটে।
–আর ক্লাইভ স্ট্রীট থেকে?
-গঙ্গায়। -তারপর?
—তারপর সমুদ্রে।
ও যেন একটু শিউরে উঠলো। আমার কাছে এগিয়ে এসে বললো—আমি যখন ছোট ছিলাম, ছবুর চাইতেও ছোট, তখন আমরা প্রত্যেক গ্রীষ্মকালে পুরী যেতাম। ওখানে আমার ঠাকুরদার একটা হোটেল ছিল। পুরীর সমুদ্রের মতো বড় বড় ঢেউ আর কোথাও নেই। এই বাড়ির মত উঁচু উঁচু ঢেউ।
আমি কল্পনা করছিলাম দৈত্যের মতো সেই বিশাল বিশাল ঢেউয়ের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে মৈত্রেয়ী যেন সৌন্দর্যের মূল সূত্র সম্পর্কে ভাষণ দিচ্ছে। আমি হাসি চাপতে পারলাম না।
-হাসছেন কেন?
-বাড়ির মত বড় ঢেউ? একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না?
–এই জন্য? আমার ঠাকুরদা হলে আরও বাড়িয়ে বলতেন। জানেন, ওঁর এগারটা সন্তান ছিল! আমার দিক থেকে ও মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ওকে কোনোভাবে কোনো আঘাত দিয়ে ফেলেছি নাকি? এটা ভেবে নিয়ে আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইলাম।
—প্রয়োজন নেই। প্রথমবারেই আপনি এত ঘটা করে ক্ষমা চেয়ে রেখেছেন যে, নতুন করে আর ওর প্রয়োজন নেই। নিজের ওপর ভরসা নেই নাকি? আচ্ছা, আপনার সুইনবার্নকে কেমন লাগে?
আমি তার অনর্গল কথা বলার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। উত্তরে বললাম, সুইনবার্ন পড়তে আমার ভালো লাগতো এক কালে।
টেবিলের ওপর থেকে একটা পুরনো বই নিয়ে এলো ও। পেনসিলে দাগ দেওয়া Anactoria র একটি অংশ দেখালো আমায়। আমি জোরে জোরে সেই অংশটা পাঠ করলাম। কবিতাটির কয়েক লাইন পড়ার পর আমার হাত থেকে বইটা ও কেড়ে নিলো।
—সম্ভবত সুইনবার্নকে বাদ দিয়ে অন্য কবিদের ভালো লাগবে আপনার।
লজ্জিত হয়ে স্বীকার করলাম এবং আমার পছন্দে গুরুত্ব দেবার জন্য বললাম, সমস্ত Neo- romantic কবিতা পল ভ্যালেরির যে-কোনো একটা সাধারণ কবিতার কাছে তুচ্ছ।
ও খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনছিল, আর এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু যেই দেখলো আমি দার্শনিক কবিতার সমালোচনা করছি, আর যে-সমস্ত কবিতা আলোচনার বিষয়বস্তু হতে চলেছে, সেগুলো দুটো পৃথক ভাষারও বটে, তখন ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো—আপনি চা খাবেন?
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই করিডর দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে নিচে রান্না ঘরে কিছু নির্দেশ পাঠালো।
-আশা করি আমার প্যান্টের ওপর চা ওল্টাবে না। যে দশা করে ছিলে গত বছর লুসিয়্যাঁর।
আমার মনে হয়েছিল, কথাটা শুনে ও হেসে উঠবে এখুনি। কিন্তু তা না করে ও বাংলায় বিস্ময়সূচক কোনো শব্দ উচ্চারণ করে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওর পায়ের শব্দ থেকে বুঝতে পারছিলাম ও তার বাবার অফিস ঘরে গেছে। কয়েকমুহূর্ত পরে আবার তেমনি করে ছুটতে ছুটতে ও ফিরে এলো। হাতে দুখানা বই।
—এ দুটো আজ সকালেই ফ্রান্স থেকে এসেছে। সারা দিন আমার বক্তৃতা নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম যে ভুলেই গিয়েছিলাম।
বই দুটো ছিল লুসিয়্যাঁর ‘L’ Inde avec les Anglais-এর দুটো কপি। কাকে পাঠিয়েছে কিছুই লেখা ছিল না।
—একটা বই আপনার। —মৈত্রেয়ী আমায় বললো।
আমি বললাম, এখন আমরা দুজন কী করবো আন্দাজ করতে পারছো? আমার বইটা আমি তোমাকে উপহার দেবো আর তোমারটা তুমি আমায় দেবে।
মৈত্রেয়ী আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো। সে ধৈর্য রাখতে পারছিল না। দৌড়ে কালি কলম আনতে ছুটলো। আমি কী লিখছি দেখার আগ্রহ তার চোখে-মুখে উজ্জ্বল হয়ে ছিল। আমি লিখলাম ‘আমার বান্ধবী মৈত্রেয়ী দেবীকে, একজন ছাত্র ও শিক্ষক’। আমার লেখা দেখে সে আদৌ সন্তুষ্ট হচ্ছে না। তার হাতের বইটাতে সে লিখলো, ‘আমার বন্ধুকে।
-যদি এই বইটা কেউ চুরি করে নেয় তখন?
-কী আসে যায়? সেই চোর হয়ত পরে আমার বন্ধুও হতে পারে।
হাঁটুর ওপর চিবুক রেখে সে বসলো মাদুরে। বসে বসে আমার চা খাওয়া দেখতে থাকলো।
ক্রমশ রাত হয়ে এলো। রাস্তার গ্যাসের আলোয় তালগাছের নীল-নীল ছায়া ঘরের মধ্যে পড়েছিল। মনে মনে ভাবছিলাম বাড়ির অন্য বাসিন্দারা সব গেল কোথায়? কারো কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। এটা কি ষড়যন্ত্র? মৈত্রেয়ীর শোবার ঘরে আমাদের একদম একলা ছেড়ে দেওয়া? ঘরে আলো বলতে রাস্তার আলো যেটুকু এসে পড়েছে।
—আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম—খুব মিষ্টি গলায় বললো ও।
—আজ থেকে কেন? আমরা তো অনেক দিন আগে থেকেই বন্ধু হয়েছি। সে বললো, যদি আমরা বন্ধু হয়ে থাকি, নিশ্চয় ও আমাকে ওর দুঃখের কথা জানাতে পারবে। আমি ওর সব কিছুই আমাকে বলতে বললাম। কিন্তু মৈত্রেয়ী চুপ করে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আমিও নীরবে ওকে দেখতে লাগলাম।
—আজকের কনফারেন্সে রবীন্দ্রনাথ আসেননি।
কথাটা শুনে একটু খারাপ লাগলো। বোধ হয় আমার পৌরুষেও আঘাত লাগলো। ইচ্ছে করছিল ওর একটু বিরক্তি উৎপাদন করে ওকে রাগিয়ে দিতে। বলতে ইচ্ছে করছিল আমাকে …..বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা ওর উচিত হয়নি।
রাগাবার জন্যই বললাম—তুমি রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসো?
হঠাৎই মৈত্রেয়ী কী রকম যেন পাল্টে গেল। আমার দিকে ফিরে তিক্ত কন্ঠে বললো, আপনি তো অন্ধকারে যুবতী মেয়েদের সঙ্গে একলা বসে থাকতে ভালবাসেন, তাই না?
-এ রকম একলা বসে থাকার ঘটনা এই প্রথম ঘটলো, কিছু না ভেবেই আমি উত্তর দিলাম। হঠাৎই সে খুব ক্লান্তির ভঙ্গিতে পা ছড়িয়ে বসলো। বললো, আমার এ সব ভালো লাগছে না। আমি এখন একটু একলা থাকতে চাই।
কোনো কথা না বলে আমি নীরবেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে জুতো পরলাম। নিঃশব্দে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিতৃষ্ণায় মনটা ভরে গেল।
নিচের সমস্ত আলোগুলো জ্বালা হয়ে গিয়েছে তখন। সেই সময়কার ডায়েরির কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি–
“ওকে যে আমার প্রত্যেক দিনই সুন্দর লাগে তা নয়। ওর সৌন্দর্য ক্ল্যাসিকাল সঙ্গীতের মত। ওর মুখ দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় যে-কোনো মুহূর্তে ও বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে। ভাষার যাদুতে ও মুগ্ধ হয় সবচেয়ে বেশি। মনে পড়ে কতদিন সারারাত্রি ওর কথা ভেবেছি। একটা ছায়াচিত্রের মতো নীল রেশমের শাড়িতে মোড়া ওর শরীর। ওর মাথায় একরাশ চুল। পারস্যবাসীরা সাহিত্যে মেয়েদের মাথার চুলের সঙ্গে সাপের তুলনা করে কেন?
আমি জানি না কি ঘটতে যাচ্ছে। আমি কি ভুলে যাবো আমার অস্তিত্ব। হে ভগবান কবে শান্তি পাবো?
ছবু একটা গল্প লিখেছে। মৈত্রেয়ী ছাদে বসে সেটা অনুবাদ করে আমায় শোনালো। গল্প বলতে বলতে ও খুব হাসছিল। গল্পটা এই রকম : এক রাজার একটা ছেলে ছিল। তার নাম ছিল ফুল। একদিন ফুল ঘোড়ায় চেপে অরণ্যে প্রবেশ করলো। যেই সে বনে এলো, অমনি সেখানকার সব কিছ ফুলে পরিণত হলো। শুধু রাজপুত্র আর তার ঘোড়া যেমন ছিল তেমনই রইলো। প্রাসাদে ফিরে সে তার বাবাকে এই আশ্চর্য ঘটনা বর্ণনা করলো। রাজা এই ঘটনা বিশ্বাস করলেন না। রাজপুত্রকে মিথ্যা কথা বলার জন্য প্রচণ্ড বকলেন। তিনি রাজপণ্ডিতদের বললেন শাস্ত্রে মিথ্যা কথা বললে কী হয় সে কথা পড়ে শোনাতে আর মিথ্যা কথা বললে কী শাস্তি হয় সে সবের কিংবদন্তী শোনাতে। রাজপুত্র দৃঢ়তার সঙ্গে বললো যে সে সত্যি কথাই বলছে। রাজা সৈন্যসামন্ত নিয়ে রাজপুত্রের কথা যাচাই করার জন্য সেই অরণ্যে গেলেন। সেখানে যাওয়া মাত্র সকলেই ফুল হয়ে গেল। একটা দিন কেটে গেল। তারপর রাজপুত্র সমস্ত শাস্ত্রের বই এনে তার পাতা ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো করে উড়িয়ে দিতে লাগলো। সেই টুকরো পাতার স্পর্শে রাজা এবং তাঁর সৈন্যদল আবার বেঁচে উঠলো
নরেন্দ্র সেনের চরিত্রের খারাপ দিকগুলো হলো তিনি অকারণ গর্বে অহঙ্কারী। নিজেকে উনি প্রতিভাবান বলে মনে করেন। সে দিন রাত্রে ছাদে গিয়ে এক পাশে আমায় ডেকে নিয়ে প্যারিসের বারবণিতাদের সম্পর্কে খুঁটিনাটি জানতে চাইলেন। শুনলাম তিনি রক্তচাপ আর চোখের চিকিৎসার জন্য ফ্রান্সে যাচ্ছেন কয়েক মাসের জন্য।
মিঃ সেনের মামাতো ভাই মন্টু দিল্লী থেকে এখানে এসেছে। ওখানে সে ছিল একটা সেকেণ্ডারি স্কুলের শিক্ষক। এখানে গভর্নমেন্ট কমার্শিয়াল স্কুলে লেকচারারের একটা চাকরি পেয়েছে। ছোটোখাটো রোগা ছেলেটির বয়স আন্দাজ তিরিশ হবে। সে থাকে আমার পাশের ঘরটায়। দেখতে দেখতে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। সে বললো ইচ্ছে করেই সে কলকাতায় চাকরি নিয়েছে বিয়ে করার জন্য। তার নিজের বিয়ের ইচ্ছে নেই, কিন্তু মিঃ সেন নাছোড়বান্দা। মন্টুর খুব ভয়ও করছে বিয়ের ব্যাপারে। চোখ বন্ধ করে সে ইংরেজী বলে আর খুব হাসতে পারে।
চারদিন ধরে মন্টুর বিয়ের উৎসব আজ শেষ হলো। কনের নাম লীলু। (কালো কালো, সাধারণ দেখতে একটা মেয়ে, কিন্তু মনে হয় খুব সহানুভূতিশীলা হবে)। কনের বাড়িতে আর এখানে বিরাট ভোজ হলো। বাস্তবিকই, যাবতীয় আয়োজন মিঃ সেনই করলেন। আমার কাছে তিনি আবার অভিযোগও করলেন যে মন্টু বড়ো অস্থিরমতি, যে-কোনো সিদ্ধান্ত তাড়াহুড়ো করে নেয় ইত্যাদি। মন্টু তাঁকে এতো ভক্তি করে যে সে তার নববিবাহিত বধূর কৌমার্যও দান করতে প্রস্তুত। শুনে অবাক হলাম। ভারতে নাকি এরকম প্রথা এখনও কোথাও কোথাও প্রচলিত আছে যে শিষ্য তার বিয়ের প্রথম রাতটা গুরুকে নিবেদন করে। মন্টু আমাকে বহুবার বলেছে যে মিঃ সেন তার শুধু মামাতো পিসুতো দাদাই নন, তিন ওর শুরুও।
আমি দু’জায়গাতেই গিয়েছিলাম। দু-জায়গাতেই প্রথম সারিতে আমায় জায়গা করে দেওয়া হয়েছিল। রেশমের ভারতীয় পোশাক পরেছিলাম। আমায় চমৎকার দেখাচ্ছিল একথা বলতেই হবে। অনুষ্ঠানে নিজে থেকে আমার উদ্যোগ, পরিশ্রম আর সবার সঙ্গে বাংলায় কথা বলার চেষ্টার জন্যে আমি সবারই প্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, এখানকার সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান আমাকে মোহিত করেছে। কোনো কিছুতেই ভারতীয়দের বন্ধুত্বের প্রতিদান দেওয়া সম্ভব নয়। মিসেস সেনের স্নেহ, মায়া, মমতা এত প্রগাঢ় আর এত পবিত্র যে তার তুলনা হয় না। সবাই ওঁকে মা সম্বোধন করে কথা বলছিল। আমি নিঃসন্দেহ যে, ভারতবর্ষ ছাড়া মাতৃহৃদয়ের এই তীব্র আবেগ আর কোথাও নেই।
মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে এই রকম একটি কল্পনা আমায় ভীষণ আনন্দ দিতো। যতদিন উৎসব চলছিল, আমি সর্বদা ওর চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকতাম। বাগ্দত্তা….. প্রেমিকা। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও কখনো আমি মোহে অভিভূত হইনি বা আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়নি। নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করতাম, ওকে যতটা সুন্দরী ভাবছি আসলে ও অতটা সুন্দরী নয়। ওর কোমর শরীরের তুলনায় বেশি ভারী ইত্যাদি খুঁত ধরে নিজেকে ওর চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এইভাবে যে আরও বেশি করে ওর চিন্তায় ডুবে যাচ্ছি, সে কথা সবসময় স্মরণে থাকতো না।
ও-বাড়িতে আমাকে নিয়ে যে-সমস্ত বক্রোক্তি করতো তা আমার কানে আসছিল, সেগুলো ঠাট্টা না সত্যি বুঝতে পারছিলাম না; একটা প্রায় অসম্ভব এবং গুরুত্বপূর্ণ বিবাহের প্রস্তাব। প্রস্তাবটা মিঃ সেনেরই এবং একদিন খাবার টেবিলে শুনলাম মিসেস সেনও সমর্থন করেছেন। এটাকে ষড়যন্ত্র বলা যাবে কি? বিয়েকে এঁরা পবিত্র, সামাজিক, ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করেন। আমাকেও এঁরা আন্তরিকভাবে গভীর স্নেহ করেন, ভালোবাসেন। মৈত্রেয়ীও এখন উচ্চ বাঙালী সমাজে যথেষ্ট পরিচিত। অনায়াসে আমার চাইতে অনেক ভালো স্বামী সে পেতে পারে।
মৈত্রেয়ীকে বিয়ে করলে আমার কি হবে? এটা কি সম্ভব যে আমি আমার বিবেচনাবোধ, স্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তি সব হারাবো এবং ফাঁদে পড়ে সম্মতি জানাবো? সন্দেহ নেই এযাবৎ যে কজন যুবতীকে আমি দেখেছি তাদের মধ্যে মৈত্রেয়ী সব দিক থেকেই আকর্ষণীয়া কিন্তু এটাও স্থির নিশ্চিত যে আমি ওকে বিয়ে করতে পারি না।
তাহলে কী করবো আমি? বিয়ে করে এক পরাধীন জীবনযাপন করবো এরপর? জীবন স্থির হয়ে যাবে এক বৃত্তের মধ্যে। আমার যথেচ্ছ দেশভ্রমণ…বাকি আর সব!
এই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখী আর কেউ নেই। এক স্বপ্নের রাজ্যে কিছুক্ষণ বিচরণ করছি। গতরাত্রে বাসর ঘরে যুবতী মেয়েরা গান গাইছিল। ফুলে ফুলে ঢাকা সেই ঘর। মৈত্রেয়ী এই উৎসব উপলক্ষে বিশষভাবে রচিত তার কবিতা পাঠ করলো।
এখানে যে কথা বলবো, অর্থাৎ যে মানসিক অবস্থার কথা বলবো, সেই অবস্থা আমাকে মারাত্মকভাবে বিব্রত করছিল। যদি কোনোভাবে বুঝতে পারতাম বা সন্দেহ করতাম যে লোকে আমার সম্ভাব্য বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছে, সঙ্গে সঙ্গেই এক পাশবিক আবেগে আমি মথিত হতাম। ইন্দ্রিয়গুলো শরীর মন উভয়ের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতো। কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভয় করছে। বিপদও কি আমাকে উদ্বিগ্ন করছে? আমি বিয়ে করবো না এটা স্পষ্ট করে বলতে আমার সাহস হচ্ছে না; আবার এ জায়গা ছেড়ে চলেও যেতে পারছি না, সেটা অশালীনতা হবে বলে।
একটা নৈতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করছি, যদিও আমার রিপু আমায় উত্তেজিত করছে।
আজ মন্টু মেয়ে-মহলে আমার কথা ফাঁস করে দিয়েছে। আমি ওকে বিশ্বাস করে বলেছিলাম যে আমি বিয়ে করতে চাই না, আর কোনোদিন বিয়ে করবোও না। মনে হলো একথা শুনে মৈত্রেয়ী রেগে গেছে, আর এক অদ্ভুত ক্ষোভের দৃষ্টি নিয়ে আমায় দেখছে। আমার কাছে আর পড়তে আসছে না। কাজ থেকে আমি ফিরে আসার পর রোজ যেমন আমার সঙ্গে গল্প করতো তাও বন্ধ করে দিয়েছে। মিসেস সেনও কেমন যেন হয়ে গেছেন! আমার প্রতি যে উষ্ণ স্নেহ ওঁর ছিল তাতে যেন ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ওদের এই হঠাৎ পরিবর্তন আমাকে অস্থির করে তুলছে।
আজ বিকেলে যখন ঘরে বসে লিখছি, তখন মৈত্রেয়ীর প্রচণ্ড হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। খোকার কোনো ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে বোধ হয় সে হাসছে। আমার প্রচণ্ড ঈর্ষা হলো। খোকা মৈত্রেয়ীদের একজন গরীব আত্মীয়। এই যুবকটি মন্টুর বিয়ে উপলক্ষে ভবানীপুরের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। এখানে তার ভূমিকা ছিল প্রায় বাড়ির জঞ্জালের মতো। বারান্দার সামনের দিকে একটা ঘরে সে থাকতো। ওর সঙ্গে হাসাহাসির শব্দে ঈর্ষায়, রাগে আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। সঙ্গে সঙ্গে আমার লজ্জাও হলো নিজের অবস্থা উপলব্ধি করে।
মৈত্রেয়ী আমার মধ্যে কোনো স্পৃহা জাগিয়ে তুলতে পারেনি একথা সত্য। অন্য দিকে তার বাড়ির লোকজনদের স্নেহ-ভালোবাসাও আমি উপলব্ধি করেছিলাম। ভয় আমার হয়েছিল যখন বিয়ের ফাঁদ পাতার পূর্বাভাস পেয়েছিলাম, আর আজ যখন আমি ঘোষণা করে দিলাম যে আমি বিয়ে করবো না অবিবাহিত থাকবো, তখন অবস্থাটা আর আগের মতো রইলো না। কিন্তু এবার মৈত্রেয়ীর নিস্পৃহতা আর অবহেলা আমার মধ্যে ভালোবাসা জাগিয়ে তুললো। আজ আমি ঈর্ষাপরায়ণ আবার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও সন্ত্রস্ত, ভীত। আমার একাকীত্ব আমায় কষ্ট দিচ্ছে।
কী অদ্ভুত পরিবর্তন! এখন আমি খেতে বসি মন্টু আর মিঃ সেনের সঙ্গে। মেয়েরা পরে খায়। মৈত্রেয়ীর অভাবে খাবার টেবিল থেকে সব আনন্দই চলে গেছে। অফিসের কাজ পরিদর্শনের জন্য দক্ষিণ বঙ্গে চলে যেতে চাইলাম। ফেরার পর বাড়ি পাল্টাবার একটা অজুহাত খাড়া করবো। এখানে যা অভিজ্ঞতা হলো আমার, তার এখন চূড়ান্ত পর্যায় চলেছে। অভিজ্ঞতার পর্বটা অত্যন্ত দীর্ঘ।
দুদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে অবিশ্রান্ত। আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। চারদিক জলে ভেসে গেছে। জলে-ডোবা রাস্তাগুলো দেখার জন্য আমি বারান্দায় গেলাম। হঠাৎ মৈত্রেয়ীকে দেখতে লাগলাম। দারুণ জমকালো পোশাক-চেরি রঙের ভেলভেট, কালো রঙের ব্রাউজ, সিল্কের। ও একই দৃশ্য দেখছিল। জানতাম ও বৃষ্টি নিয়েও কবিতা লেখে। হয়ত আজ ও আমার শোবার ঘরের ওপরে ওর শোবার ঘরে বসে একটা কবিতা লিখেই বাইরে এসেছে। খুবই নিস্পৃহ আর ঠাণ্ডা ছিল ওর চাউনি। অল্প দু একটা কথাও হলো।
এ-বাড়িতে নিজেকে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। অথচ এইখানেই আমি পেয়েছিলাম সবচেয়ে বেশি স্নেহ, মায়া, মমতা! পেয়েছিলাম আন্তরিকতা, যা ভারতীয় ঐতিহ্যের অনুসারী। মনে হচ্ছিল এক জমাট শীতলতা আমাকে ঘিরে ধরছে চারপাশ থেকে। আমার সব স্বতঃস্ফূর্ত ভাব চলে গেছে। খাবার টেবিলে আমি নীরব; শোবার ঘরে নিজেকে মনে হতো অসুস্থ। মাঝে মধ্যে নিজেই এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করতাম। এক অদ্ভুত উপলব্ধিতে পৌঁছতাম যা এ যাবৎ আমি অনুভব করিনি।
গতকাল থেকে সম্পর্কটা আবার একটু ভালোর পথে। অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়িতে আমি নরেন্দ্র সেনের কাছে মন্টুর মন্তব্যের সমালোচনা করেছিলাম। আমি ঠিক জায়গাটাতেই ঘা দিয়েছিলাম। মন্টু আমার কথা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিল যে, আমি বিবাহ নামক প্রথাটাকেই ঘৃণা করি। তাই আমার চারপাশের লোকেরা, যাঁরা এটাকে পবিত্র এবং আবশ্যকীয় সামাজিক কর্ম বলে মনে করেন, তাঁরা এর প্রতিবাদ বা এটাকে অসমর্থন না জানিয়ে থাকতে পারেননি। আমি বোঝাতে পেরেছিলাম যে মন্টু ঠিক বলেনি। যাই হোক, আমার কথাবার্তার পরে বেশ বুঝতে পারছিলাম, যে শীতলতার সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকখানিই কেটে গেল।
গতকাল আমি মৈত্রেয়ীর সঙ্গে কথা বললাম স্বাভাবিকভাবে। অনেক দিন বাদে আমরা হাসলাম। লাইব্রেরিতে আজ অনেকক্ষণ গল্প করলাম দুজনে। কার্পেটে বসে ‘শকুন্তলা’ পড়া হলো। ওর গৃহশিক্ষক এসেছিলেন, আর আমি আগে থেকেই পড়ার সময় উপস্থিত থাকার অনুমতি চেয়ে রেখেছিলাম।
রাত্রে ছাদে দাঁড়িয়ে ও একটা কবিতা আবৃত্তি করলো। তারপর নিঃশব্দে সেখান থেকে চলে গেল। যাবার আগে বিষণ্ন সুরে বলে গেল, কবিতাই হচ্ছে তার জীবনের শেষ কথা।
আমি কি মৈত্রেয়ীকে ভালবাসি?
পরবর্তী মাসগুলোর ডায়েরির সংক্ষিপ্তসার :
আমরা দুজনে পৌরুষ নিয়ে আলোচনা করছিলাম।
আলোচ্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন ওয়াল্ট হুইটম্যান, পাণিণি এবং অন্যান্যরা। মৈত্রেয়ীর পড়াশোনা বিশেষ ছিল না, কিন্তু ওর আগ্রহ এবং মনোযোগ সে অভাব পূরণ করে দিচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম আমাকে ওর ভাল লাগে। একথা ও স্বীকারও করে ছিল। ও বললো ও আত্মসমর্পণ করতে চায় কবি রবীন্দ্রনাথের কল্পনায় আঁকা কোনো নায়িকার মতো সমুদ্র সৈকতে, প্রচণ্ড ঝড়ের প্রারম্ভে। …সাহিত্য!
মৈত্রেয়ীর প্রতি আমার আসক্তি গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। গ্রাম্য কবিতার মতো সরলতা, সহযোগীর আন্তরিকতা এবং এও স্বীকার্য যে এক শারীরিক টানেরও সংমিশ্রণ ছিল সেটা। কার্পেটে বসে পড়াশোনা করার সময় কখনো কখনো ওর আলতো স্পর্শই আমাকে ভীষণ বিচলিত করতো। অনুভব করতে পারতাম ওর মধ্যেও এক চঞ্চলতা ছড়িয়ে পড়ছে। সাহিত্য আলোচনার মাধ্যমে আমরা পরস্পরকে অনেক কথাই বলতে পারতাম। সাহিত্য সাহায্য করছিল আমাদের মনের ভাবপ্রকাশে, সরাসরি কোনো কথা না বলেই। কখনো কখনো মনে হতো আমরা দুজনেই পরস্পরকে চাই!
পরবর্তী সময়ে যুক্ত টিকা :
আমার ধারণা ঠিক নয়। মনে হচ্ছে মৈত্রেয়ীর প্রেমের গভীরতা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। খেলার ছলে, মেলামেশার অবাধ স্বাধীনতায় ও মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। দেহজ প্রেম সম্পর্কে ওর কোনো ধারণাই ছিল না।
ডায়েরির পরবর্তী অধ্যায় :
সেদিনটা ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। সন্ধ্যা থেকে রাত্রি এগারোটা অবধি আমি মৈত্রেয়ীর শোবার ঘরে। আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ থেকে কিছু অনুবাদ করছিলাম এবং কাব্য আলোচনা করছিলাম। রাত্রিতে মিঃ সেন একটা ডিনার পার্টি থেকে ফিরে হঠাৎই আমাদের এ ঘরে এলেন। আমি শান্ত ভাবেই কথা বলতে থাকলাম কিন্তু মৈত্রেয়ীর মুখ চোখ পাল্টে গেল। সে আমার হাত থেকে বইটা তাড়াতাড়ি কেড়ে নিয়ে মুখের সামনে খুলে ধরলো।
—আমরা বাংলা পড়ছি …
আমি অবাক হলাম।
এই ভাবেই কি ওর মিথ্যা বলা শুরু হয়েছিল?
পরবর্তীকালে যুক্ত টীকা :
না। আমি বোধ হয় ওকে ভুল বুঝেছি। ও মিথ্যা বলেনি। বলাকা অনুবাদের জন্য আমি ওর ঘরে রয়ে গেছি একথা সে অন্য কেউ হলে হয়ত অনায়াসেই বলতে পারতো কিন্তু হঠাৎ বাবাকে দেখে কী করবে, কী বলবে বুঝতে না পেরে আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে নিয়েছিল।
ডায়েরির পরবর্তী অধ্যায় :
আজ আমি ওর জন্য পদ্মফুল এনে ছিলাম। তোড়াটা বিরাট ছিল। তোড়াটা হাতে নিতে ওর মুখ ফুলে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। আমার হাত ধরে ও আমায় অকুন্ঠ ধন্যবাদ জানালো। আমার স্থির বিশ্বাস হলো যে ও আমায় ভালোবাসে। সারাদিন ধরে ও আমার জন্য কবিতা লেখে। আমায় আবৃত্তি করে তা শোনায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি ওকে ভালোবাসি না। খানিকটা বিস্ময়মিশ্রিত আনন্দ হয় মাত্র। ওর দেহ-মন আমাকে বিচলিত করে সত্য। ওর চরিত্রের এক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কৃত হলো : আমি লীলুর সঙ্গে ওর বিষয়ে কথা বলছিলাম। লীলুকে সাবধান করে দিলাম, যে সমস্ত কথা আমায় বললো, সেগুলো যেন মন্টুকে আবার না বলে বসে।
—ও আমার কী করবে? —লীলু ঝাঁঝিয়ে উঠলো।
—আমি ওসব জানি না। পারিবারিক ঝগড়া সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই।
মন্টু ওকে শাস্তি দেবেই, যে ভাবেই হোক, মৈত্রেয়ী জানালো, ‘যে ভাবেই হোক’ শব্দগুলোর ওপর বিশেষ জোর দিয়ে। ও ওদের সম্পর্কে আরও অনেক কথা বললো।
তাহলে ও জানে ওদের দাম্পত্য-জীবনের গোপন কথা। পরে ও বলেছিল যে ভালোবাসা আর আবেগপ্রবণ কবিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ও নিজে যেন কোনো পাগলামি না করে বসে। আমাকে ও অনেক অবিশ্বাস্য গোপন কথা বলেছিল। সে সব কথা বন্ধুত্বের প্রাথমিক স্তরেই কী করে বলা সম্ভব বুঝতে পারছিলাম না।
পরবর্তীকালে সংযুক্ত টীকা :
মৈত্রেয়ী বাস্তবিকই খেলা করছে। লীলু ওকে দাম্পত্য প্রেম কাকে বলে বোঝাচ্ছিল। কতটুকু ও বুঝতে পারছিল জানি না তবে সফল দাম্পত্য প্রেমের সূত্রগুলো বলতে খুব মজা পেতো।
ডায়েরির পরবর্তী অধ্যায় :
লীলু, মন্টু, মৈত্রেয়ী আর আমি পাড়ার একটা সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। হিমাংশু রায়ের একটা ভারতীয় ছবি দেখানো হচ্ছিল। মৈত্রেয়ী আর আমি পাশাপাশি বসে ছিলাম। কথা বলছিলাম আর হাসছিলাম আমরা। কিন্তু ছবির পরেই ও হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেল। অন্ধকার, বদ্ধ ঘর, ছবির বিষয়, না আমার সান্নিধ্য, কোনটা যে দায়ী তা বুঝতে পারলাম না। আমি জানি যে, ও সম্পূর্ণ শুদ্ধ হলেও ভীষণ রকমের ইন্দ্রিয়পরায়ণা। আমার ভারতীয় বন্ধুরা, ভারতীয় নারীদের এই বিস্ময়কর দিক সম্পর্কে জানিয়ে ছিল। একজন অসূর্যস্পর্শা যুবতীয় কুমারী মেয়ে তার ফুলশয্যার রাত্রেই নিজেকে এক নিখুঁত দক্ষ প্রেমিকা এবং নিপুণ দেহশিল্পীরূপে প্রকাশ করতে পারে।
মৈত্রেয়ী ওর প্রথম প্রেমের কথা আমার কাছে প্রকাশ করলো। একটি বাঙালী যুবক, এখন সে ইংল্যাণ্ডে পড়াশোনা করছে। এ থেকে কি এটাই বুঝবো, ও খুবই সাধারণ মাপের ভাবপ্রবণ ব্যক্তিত্ব?
পরবর্তীকালে সংযুক্ত টিকা :
ওই স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে ও এটাই ব্যক্ত করতে চাইছিল যে, ওই ঘটনা ছিল আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগের ঘটনা, যা ও ভুলে যেতে চায়।
ডায়েরির পরবর্তী অধ্যায় :
আবার ওর জন্য ফুল এনেছিলাম। ও খুব রেগে গেছে আমার ওপর। কারণ ফুল শুধু ওর জন্যই আনি না, মিসেস সেন এবং অন্যান্যদেরও দিই। মনে হচ্ছে মন্টু কিছু সন্দেহ করছে। যখনই আমরা নিরিবিলি দুজনে কথা বলি, অমনি মন্টু আমাদের মধ্যে এসে দাঁড়ায়। আমাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে’ বলা সত্ত্বেও মন্টু ওখানে থাকার জন্য জেদ করতে থাকে।
মিঃ সেন আর আমি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি দুঃখের সঙ্গে জানালেন যে ওঁর ফ্রান্স যাওয়া পিছিয়ে গেছে। ভাবছিলাম এটা কি আমার ভুল, না উনি সত্যিই মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ভাবছেন? ফেরবার পথে যখন গাড়িতে বসে আমি আদৌ মৈত্রেয়ীকে ভালোবাসি কি না ভাবছি, তখনও আমাদের ফুলশয্যার কল্পনা আমার সব চিন্তা-ভাবনাকে এলোমেলো করে দিচ্ছিল। ফলে বিরক্তি আসছিল নিজের ওপরেই।
একটা কৌশল অবলম্বন করলাম। ওর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ এড়িয়ে চললাম। যেন আমার ভয় করছে, কী হবে; যেন আমি ওর প্রেমে পাগল এবং ভীত। আজ সকালে ও আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রায় জোর করে আমার ঘরে এসেছিল। একজন ভারতীয় যুবতীর এ-হেন আচরণ বোধ হয় এই প্রথম। জানি না কোথায় এর শেষ হবে! ও আমাকে বিচলিত করে, মোহগ্রস্ত করে, কিন্তু তবু ওকে আমি ভালোবাসতে পারছি না। শুধুই খেলা করে যাচ্ছি।
অদ্ভূত ওলোটপালট-করা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। বেশি দূর যাওয়া আমার ভুল হয়েছে। সরলতার ভান করা আরও বেশি করে ভুল। ভেবেছিলাম ভারতীয় নারীর হৃদয় জয় করার সঠিক রাস্তাটাই ধরেছি। কিন্তু ও কেবলমাত্র এক ভারতীয় নারীই নয়, ওর মধ্যে রয়েছে এক সহজাত বোধ আর সেটা কাজে পর্যবসিত করার ব্যাপারে ওর ছিল অসাধারণ ইচ্ছাশক্তি। পুরুষ নারীর পুজো করবে এটা ও একেবারেই পছন্দ করতো না। এটাকে সে অমার্জিত এবং কুরুচির পরিচায়ক বলে মনে করতো। ভীষণ বিদ্রূপ করতো ও এ ধরনের ঘটনার কথা শুনলে। ও স্বপ্ন দেখতো একজন পুরুষের, যে নিম্নস্তরের ভাবপ্রবণতা দমন করতে সমর্থ। আমার ব্যবহার কি ওকে হতাশ করছিল…!
বাঃ বেশ ভালো। তাই যদি হয় তো আমিও আমার কৌশল পাল্টাবো। আমাদের আগের কথাবার্তাতেই এ কথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে আমি খোলাখুলিই সব কথা বলতে পারি। ও কখন আসবে, আবার কখন আমার ঘরে বসে দুজনে গল্প করতে পারবো। এই সব ভেবে পাগলের মত অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম। আমার ব্যবহারে ওর প্রতিক্রিয়াগুলো আমি নজর করবো। কিন্তু আমি প্রথমেই জানাবো যে ওর ভালোবাসা পাবার কোনো আগ্রহই আমার নেই। আমি জানি ও আমাকে ভালোবাসা। ও ওটা লুকোতে পারে না। আমি জানি ও ক্রমশ আমার কাছে বাঁধা পড়ে যাচ্ছে! চব্বিশ ঘন্টা যদি আমরা একলা থাকতে পারি, আমি নিঃসন্দেহ যে ও আমার কাছে আত্মসমর্পণ করবে।
কিন্তু হায় ভগবান, ও কেন আমায় অপমান করে! কেন ও বলে যে গতানুগতিক প্রেমকে ও ঘৃণা করে?
অন্য কোনো নারী আমাকে এতখানি বিচলিত কোনো দিন করতে পারেনি। এই গরমের মাসগুলোতে কাজের চাপের পর আমার ইন্দ্রিয়দমন আমায় পীড়া দেয়। আবার মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমার বিয়ের কথাবার্তা আমায় ভীষণ ভয়ও পাইয়ে দেয়। এই বিয়ে হতে চলেছে, এটা আমি জানি। প্রতিদিন এর নতুন নতুন প্রমাণ আমার কাছে এসে হাজির হয়। মিসেস সেন নিজের ছেলের মতো আমায় স্নেহ-মমতা দিয়ে আগলে রাখেন। মিঃ সেন আমার পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন ‘আমার ছেলে।’
গতকাল রাত্রিতে খাবার টেবিলে মিসেস সেন আমায় বকলেন—তাঁকে এখনও ‘মাদাম’ বলে সম্বোধন করার জন্য। এখনও ভারতীয় রীতি অনুযায়ী তাঁকে ‘মা’ বলে ডাকতে পারছি না কেন জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁর সন্ন্যাসিনীর মতো প্রশান্তভাব আমাকে প্রভাবিত করে। তাঁর সরলতা আমায় মুগ্ধ করে। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি।
ঠাট্টা দিয়ে আমায় আক্রমণ করা হলো। মন্টু চায় আমি ওকে ‘মামা’ আর লীলুকে ‘মামী’ বলে ডাকি, যদিও লীলুর বয়স এখন সতেরোও হয়নি। খুব মজা পেলাম।
মৈত্রেয়ীকে নিয়ে সমস্যাঃ সামান্য কারণেই আমরা রেগে যাই। এই জাতীয় ঝগড়া দিনে অন্তত দুবার হবেই। ও আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে যে সমস্ত উপায়ে, সেগুলোর সঙ্গে সহানুভূতি, মমতা ছাড়া শারীরিক ছোঁয়াও থাকে! বাকি সময় আমার কাটে কাজ নিয়ে বিরক্তিতে। মনে ভাবি একদিন আমাদের এই আবেগসর্বস্ব গোপন বন্ধুত্ব নিশ্চয়ই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয় না। রাগ ভেঙে যায়, বন্ধুত্ব জোড়া দেবার জন্য আমি আবার ওকে খুঁজি। আবার কখনো-কখনো ও-ই আগে থেকে আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। আমাদের প্রেম-প্রেম খেলা আবার শুরু হয়। মনে হচ্ছে নিজেকে বেশি দিন আর শাসনে রাখতে পারবো না।
আজ ওকে প্রায় জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমার শোবার ঘরে আমরা একাই ছিলাম। ওকে একবার জড়িয়ে ধরার প্রচন্ড হচ্ছে হচ্ছিল। উভয়েই আমরা প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। অনেক কষ্টে ইচ্ছে দমন করে ওর হাতে শুধু একটা আলতো করে কামড় দিলাম। আমি নিজের কাছে নিজেই একটা ভয়ের বস্তু হয়ে উঠছি।
পরবর্তী কালে সংযুক্ত টিকা :
আমি ভুল করেছিলাম। মৈত্রেয়ী এতটুকুও উত্তেজিত হয়নি। ও আমার মনোভাব বুঝেই বিচলিত হয়ে পড়েছিল। ও শুধুই মজা করতে চেয়েছিল তার বেশি কিছু নয়। আমিই উল্টোপাল্টা ভেবে নিয়েছিলাম।
ডায়েরির পরবর্তী অধ্যায় :
মৈত্রেয়ীর মতো এই রকম অসাধারণ মেয়ে খুব কমই হয়। বিয়ের পর কি ও আর পাঁচজনের মতো সাধারণ হয়ে পড়বে না?
একদিন বিকেলে মৈত্রেয়ী আমার ঘরে এলো। ওর গায়ে ছিল রাজপুতানার একটা পোশাক সেই পোশাকে ওকে প্রায় নগ্ন দেখাচ্ছিল। স্বচ্ছ কাপড়ের নিচে ওর বাদামী রঙের বুকের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছিল। ওর গায়ের রঙের চেয়ে ওই অংশ ঈষৎ ফর্সা। আমি ভয়ঙ্কর উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল নিশ্চয় মিঃ সেন বাইরে গেছেন, আর ও এই সুযোগে ইচ্ছে করেই এইরকম উত্তেজক পোশাক পরে আমার ঘরে এসেছে। মিঃ সেন থাকলে ওই রকম পোশাক পরতে ওর সাহস হতো না।
কারণে অকারণে আমার ঘরে ও হাজির হয়। অকারণে ঝগড়া প্ররোচনা দেয়। আবেগে ও দীপ্তিময়ী হয়ে উঠছে দিন দিন। ওর দেহ ভীষণ প্রলোভন জাগায়।
নিজের রিপু দমন করার জন্য আমি ওকে কুৎসিত, মোটা, দুর্গন্ধে ভরা মহিলা রূপে ভাবার চেষ্টা করছি। একটা অন্য ছবি ভেবে নিয়ে তার ধ্যান করতে শুরু করলাম, কিন্তু বৃথাই চেষ্টা। মিছিমিছি স্নায়ু উত্তেজিত করা। কিছুই বুঝতে পারছি না ও আমায় কোথায় নিয়ে যাবে!
আজ সকালে ওর সঙ্গে আমার ঝগড়া হলো। আমার কতকগুলো বোকামির জন্য ও রেগে গেল এবং আমাকে ভয় দেখালো যে এক সপ্তাহ আমার সঙ্গে কথা বলবে না। আমি জানিয়ে দিলাম ও যা খুশি করতে পারে আমার তাতে কিছুই যায়-আসে না। এই কথাগুলো বলতে পেরে আমার বেশ হালকা লাগছিল। এখন ভালোভাবে নিজের কাজে মন দিতে পেরেছি। লীলু দূত হয়ে এসে আমায় জানালো যে মহিলা-কবি একেবারে চুপসে গেছে। উত্তরে আমি জানালাম যে আমি একটুও রাগ করিনি, তবে মৈত্রেয়ী যা চাইছে তা চালিয়ে যেতে পারে।
তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে সব মেয়েরাই এক! সর্বত্র একই সুর, ইওরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, বুদ্ধিমতী, বোকা, সৎ, নষ্ট চরিত্র যা কিছু হোক। খাবার টেবিলে মৈত্রেয়ী আমার পাশে এসে বসলো। প্রায় একশো বছরের পুরনো একটা দারুণ জমকালো সাড়ি পরে এসেছিল ও। মৈত্রেয়ী কাঁদছিল। কোনো কথা বললো না, সামান্য কিছু খেলো। ‘মা’ সবই বুঝতে পারলেন! খাওয়ার পর আমাদের মধ্যে একটু বোঝাপড়া হলো। মৈত্রেয়ী আমাকে ভর্ৎসনা করলো ওকে বিনা দোষে অভিযুক্ত করার জন্য, বিনা দোষে ওকে ভুল বোঝার জন্য। ও বললো—ও যে প্রেম, সমবেদনা ইত্যাদি বিশ্বাস করে না, একথা সত্যি নয়।