লা নুই বেঙ্গলী – ১৩

১৩

হ্যারল্ড বাড়ি ছিল না। কিন্তু ওর বাড়ির মালিকানী ওর শোবার ঘরের দরজা খুলে দিলেন। পাখাটা সম্পূর্ণ জোরে চালিয়ে দিয়ে, আমি ওর বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। মাথাটা ঠান্ডা করার দরকার ছিল। মালিকানী মিসেস রিবেইরো খুবই বিচলিত বোধ করছিলেন, আমাকে কী প্রশ্ন করবেন তাও বুঝতে পারছিলেন না।

ওঁকে নিশ্চিন্ত করার জন্য বললাম, আমার কোনো বিপদ হয়নি, উদ্বিগ্ন হবেন না। মিঃ সেনের আজ অপারেশন হবে, তার জন্যই চিন্তিত আছি।

নিজের সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। হ্যারল্ড বা এই মহিলা কাউকেই আমার কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না। পরবর্তীকালে হ্যারল্ডের এই নিয়ে কচকচানি আমার অসহ্য লাগবে। ও ওর সমস্ত ইয়ার বন্ধুদের কাছে আমার কাহিনী রসিয়ে রসিয়ে বলার জন্য ছুটবে। মেয়েরা আমাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য ছুটে আসবে, ওদের সঙ্গে মদ খেতে আর রাত কাটাতে অনুরোধ করবে। আমি কারো কাছ থেকে কোনো সান্ত্বনা সহ্য করতে পারবো না। এই সমস্ত লোকেদের কাছে মৈত্রেয়ীর নাম উচ্চারণ করতেই আমার ইচ্ছে করছিল না। আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। আমি সম্পূর্ণভাবেই আমার মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম। কোনো কিছুই স্পষ্টভাবে চিন্তা করতে পারছিলাম না। শুধু পুরনো বোধবুদ্ধি দিয়ে এইটুকু বুঝতে পারছিলাম যে আমি আর মৈত্রেয়ী আজ বিচ্ছিন্ন। অসম্ভব! অসম্ভব! যখনই তার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতো মৈত্রেয়ীর দেহ বারান্দায় শায়িত, আমি আতঙ্কে কেঁপে উঠতাম অন্য চিন্তায় মনকে নিযুক্ত করার চেষ্টা করতাম, অন্য স্মৃতি আনার চেষ্টা করতাম—জুঁই ফুলের মালা, লাইব্রেরি, চন্দননগর… মনটা একটু শান্ত হতেই সিনেমার ছবির মত ভেসে উঠলো, শেষ দৃশ্য : খাবার টেবিলে মিসেস সেনের বিদ্বেষ ভরা দৃষ্টি, মিঃ সেনের কথা—যদি কিছু ভালো করে থাকি তোমার, তার জন্য যদি আমায় সামান্য কৃতজ্ঞতাও জানাতে চাও…!

ঘন্টা খানেক বাদে মিসেস রিবেইরো এসে জিজ্ঞাসা করলেন আমি কী খেতে চাই চা, হুইস্কি, বিয়ার…। আমি সব কিছু প্রত্যাখ্যান করলাম এমন এক ভঙ্গীতে অথবা হয়ত আমার কন্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যাতে বৃদ্ধা মহিলা গুরুতর চিন্তিতভাবে আমার বিছানার দিকে এগিয়ে এলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন—অ্যালেন তুমি কি অসুস্থ?

জানি না কী উত্তর দিয়েছিলাম। বোধ হয় বলেছিলাম, গত কয়েক মাস খুব কাজের চাপের মধ্যে ছিলাম…এই গ্রীষ্মে কোথাও বেড়াতে যাইনি…মিঃ সেনের জন্য আমি খুবই বিচলিত, এই রকম কিছ উত্তর হয়ত দিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করেছিলাম কোনো ঘর খালি আছে কি না। আমি কিছু দিন বাইরে ঘুরে এসে ভাড়া নেবো। খালি ঘরের কথা শুনে ভদ্রমহিলা খুব খুশি হলেন এবং তক্ষুণি আমায় পাশের ঘরটা দেখালেন। আমায় জিজ্ঞাসা করলেন আমি কেন ভবানীপুরের বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছি। ওঁর কৌতূহল আমায় ক্লান্ত করছে দেখে উনি প্রসঙ্গ পাল্টে আমার জ্বর সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন এবং আমায় পাহাড়ে কোথাও বেড়াতে যাবার পরামর্শ দিলেন—দার্জিলিং, শিলং অথবা সমুদ্রের ধার—পুরী বা গোপালপুর, যেখানে গিয়ে ফাদার জুসতুস সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরে ছিলেন। ওঁর সব কথা শুনলাম এবং সব কিছুতেই সায় দিলাম যাতে কথা না বাড়ে। তিনি বারান্দা থেকে স্টেট্সম্যান কাগজ নিয়ে এসে হোটেলের ঠিকানা দেখতে শুরু করলেন আর আমায় জানাতে থাকলেন। হ্যারন্ডের বিছানায় শায়িত আমার দেহ, যে সিগারেটগুলো আমি খাচ্ছিলাম সেগুলো থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠে যাওয়া ধোয়া, এই অনর্গল বকে যাওয়া ভদ্রমহিলা, সবই অবাস্তব মনে হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি স্বপ্ন দেখছি। মৃত্যুই আমার একমাত্র আশ্রয়। আমাকে মরতেই হবে।

মনে হচ্ছিল এই রকম পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে আমি কয়েক দিন থাকলেই পাগল হয়ে যাবো। আমাকে পালাতে হবে। আমাকে পালাতে হবে এক প্রগাঢ় নির্জনতার মধ্যে। সব ভুলতে হবে, সব চেয়ে বড়ো প্রয়োজন নিজেকে ভোলার। ঠিক করলাম পরের দিনই আমি চলে যাবো।

মিসেস রিবেইরোকে বললাম-অনুগ্রহ করে একবার মিঃ সেনকে ফোন করবেন-south 1147, বলুন উনি যেন এখানে আমার জিনিসপত্র পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।

অন্য সময় হলে হয়ত রিবেইরো একজন ‘কালা আদমি’কে ফোন করতে চাইতেন না কিন্তু যেহেতু ওঁর বাড়িতে ভাড়া থাকবো, তাই উনি তাড়াতাড়ি ছুটলেন ফোন করতে। সম্ভবত মন্টুই ফোন ধরেছিল।

– আমি আপনার ঘরটা পরিষ্কার করে দিই-বলে চলে গেলেন রিবেইরো। ওঁকে যেতে দেখে আমি বাস্তাবিকই খুশি হলাম। আমি আর কান্না চেপে রাখতে পারছিলাম না। হঠাৎ মনে হলো আমি বুড়ো হয়ে গেছি। আমার চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে। একটা আর্শির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি নিজেকে চিনতে পারছিলাম না। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে আমার চেহারায় আশ্চর্য পরিবর্তন এসেছিল। বোধ হয় সেই দিন থেকেই আমি বুঝেছিলাম মানুষের বাহ্যিক রূপের কোনোই মূল্য নেই। মানুষের মুখে তার চরিত্রের কিছুই লেখা থাকে না। হয়ত শুধু চোখ দুটোই একমাত্র বিশ্বাসঘাতকতা করলেও করতে পারে।

তারপর অসীম ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ে আমি আমার ঘরে—আমার বিছানায় আশ্রয় নিলাম। শুয়ে শুয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ছাদের দিকে শূন্যে দৃষ্টি মেলে রইলাম। এমন সময় দারুণ আনন্দে হৈ হৈ করতে করতে হ্যারল্ড এসে ঢুকলো। ঘর ঢুকেই সমস্ত ঘটনা জানতে চাইলো। আমি প্রচন্ড মাথা ধরেছে বলে ওকে সামান্য দু-একটা কথায় ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা করলাম। ও সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা পানীয়ের ব্যবস্থা করলো এবং দৃঢ়ভাবে জানালো হুইস্কি খেলে সব যন্ত্রণারই উপশম হয়। ও নিজের ঘরে থেকে হুইস্কির বোতল নিয়ে এলো। আমি একবার খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচন্ড দুঃখ বোধে পুনরায় আক্রান্ত হলাম। ঠিক এই সময় খোকা এসে ঘরে ঢুকলো। প্রচন্ড আবেগে আমি ওকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলাম। ওকে আমার প্রেমের দূত বলে মনে হচ্ছিল। খোকার ধুতি ছিল ময়লা, খালি পা। আমার ঘরের অন্যান্যরা ওর দিকে বিতৃষ্ণার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিল। ও কিন্তু সহজভাবেই কুলিদের পরিচালনা করছিল। আমি অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন শেষ হবে ওর কাজ, আর আমি জানতে পারবো মৈত্রেয়ীর অবস্থা,—ওখানে কী ঘটেছে। আমি কুলির পয়সা মিটিয়ে ওকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গেলাম। যাবার আগে মিসেস রিবেইরোকে আমাদের দুজনের জন্য চা পাঠাতে বলে দিলাম। হ্যারল্ড রাগে ফেটে পড়ছিল। ও চাইছিল একা আমার সঙ্গে তখন কথা বলবে। ও বুঝতেই পারছিল ভবানীপুর থেকে আমার চলে আসার ব্যাপারটা অত সোজা ছিল না। ও অবশ্য আমাদের বিরক্ত করতে আসেনি।

খোকা আমার জন্য এক কপি ‘উদ্ধিতা’ নিয়ে এসেছিল। বইটায় মৈত্রেয়ীর শেষ কথা “আমার ভালবাসাকে, আমার ভালোবাসাকে—মৈত্রেয়ী”, লেখা ছিল। আমি বিষণ্ণ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-শুধু এই? খোকা আমাকে বই এর শেষ পাতাটা দেখতে বললো। লেখা ছিল ‘চির বিদায় প্রিয়তম। আমি এমন কিছু বলিনি যাতে তুমি দোষী হও। শুধু এইটুকুই বলেছি যে তুমি আমার কপালে চুমু খেয়েছিলে। এটুকু আমার স্বীকার করতেই হয়েছিল কারণ উনি আমার মা। অ্যালেন, আমার বন্ধু, আমার প্রেম, বিদায়—মৈত্রেয়ী’।

দুঃখে যন্ত্রণায় আমি বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। হাতের লেখাটাই বার বার দেখছিলাম। খোকা চুপচাপ সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎই সে বলতে শুরু করলো—সবই জানাজানি হয়ে গেল। অবস্থা চরমে উঠলো। সত্যি কথা বলতে কি আপনারা ভীষণই অসাবধানী ছিলেন। ড্রাইভারও আপনাদের একাধিকবার দেখেছে, আপনার ঘরেই। ও মন্টু আর লীলুকেই বলেছিল। কেউই সাহস পায়নি আপনাদের সাবধান করে দিতে।

আমি নিজের মনেই প্রশ্ন করছিলাম, খোকা কি শুধু ওইটুকুই বুঝতো, জানতো? সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝতে পারছিলাম এসব নিয়ে এখন আর চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। খোকা আবার বলতে শুরু করলো—ছবু যেন কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলো যখন দেখলো মৈত্রেয়ী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ও বার বার জিজ্ঞাসা করছিল অ্যালেন কোথায় গেল, অ্যালেন কোথায় গেল। মার শাড়ি ধরে টানছিল আর বার বার এক প্রশ্ন করে চলেছিল। আমি যখন ওকে বললাম যে আমি আপনার কাছে যাচ্ছি, তখন ও আপনাকে একটা চিঠি লিখে দিল।

স্কুলের খাতার পাতা ছিঁড়ে হুবু যত্ন করে ওর সবচেয়ে সুন্দর হাতের লেখায় বাংলায় লিখেছিল, ‘প্রিয় অ্যালেন, তুমি কি আমায় ক্ষমা করতে পারবে? জানি না কেন আমি ওসব কথা বলে ফেলেছিলাম। মনে হয়নি যে কোনো অন্যায় করছি, যেহেতু আমি মনে করি না তুমিও ভালোবেসে কোনো অন্যায় করেছো। মৈত্রেয়ীর কষ্ট চোখে দেখা যাচ্ছে না। তুমি একটা কিছু করো যাতে ও এত কষ্ট না পায়। তোমার ভালোবাসা এখন কোথায় গেল? কেন আমি মরছি না? আমি মরে যেতে চাই।’

—ও লেখার সময় প্রচন্ড কাঁদছিল আর আমি যেন অতি অবশ্যই আপনাকে চিঠিটা দিই, এই কথা বার বার বলছিল। ও চায় আপনি ওকে টেলিফোন করুন। ও এখন সুস্থ হয়ে গেছে—এই কথা বলে খোকা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

—কী হলো খোকা?

—আপনাকে দেখে আমার যে কী কষ্ট হচ্ছে, আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না।

খোকা যথেষ্ট করুণ মুখ করে কথাগুলো বলছিল কিন্তু ওকে আমার একজন অপরিচিত ব্যক্তি ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছিল না। ও প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলো—আমি যখন জিনিসপত্র গোছগাছ করছিলাম তখন মৈত্রেয়ী নিচে নেমে এসে আপনার জিনিসপত্র স্পর্শ করে করে দেখছিল। ওকে সবাই মিলে জোর করে সরিয়ে নিয়ে গেল। ও চিৎকার করে কাঁদছিলো আর জবরদস্তি করছিল দেখে ওকে মিঃ সেন এমন মারলেন যে ওর মুখ ফেটে রক্ত পড়তে শুরু করলো। টেনে-হিঁচড়ে ওকে দোতলার ঘরে নিয়ে যেতে ও আবার অজ্ঞান হয়ে গেল।

আমি মানসচক্ষে মৈত্রেয়ীকে দেখতে পাচ্ছিলাম—রক্তাক্ত মুখ, পাগলের মতো ধস্তাধস্তি করছে আর মার খাচ্ছে। কিন্তু ওর ক্ষত, কষ্ট আমাকে যত না যন্ত্রণা দিচ্ছিল, ওর উপস্থিতি ওর সান্নিধ্য যে ক্রমশ বহু দূরে চলে যাচ্ছে এই ভাবনাই আমায় ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছিল।

—ওরা ওকে ওর শোবার ঘরে বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল, যাতে ও আপনার সঙ্গে শেষ দেখাও না করতে পারে। আপনি যে সমস্ত বই উপহার দিয়েছিলেন, সব কেড়ে নিয়েছিল। যতক্ষণ ও অজ্ঞান হয়ে ছিল ততক্ষণ ওর মাথায় জল ঢালছিল আর যেই জ্ঞান ফিরে আসছিল সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হচ্ছিল মার। কারণ জ্ঞান ফিরলেই ও বলে উঠছিলো ‘আমি ওকে ভালোবাসি, আমি ওকে ভালোবাসি’। আমি নিচ থেকে এইটুকুই শুনতে পাচ্ছিলাম। ছবু এসে আমায় আরও বলেছিল যে ও নাকি বলছিল, ‘ও দোষী নয়, ওর কোনো দোষ নেই, তোমরা ওকে কেন শাস্তি দিচ্ছো?’

মৈত্রেয়ী এই রকম কেন ভাবছিল কে জানে। কারণ ওর বাবা, মা এ যাবৎ আমার প্রতি কোনো কিছুই করেননি। মিঃ সেন আমায় মারধোর করতে পারতেন। উল্টে তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘Good bye Allen!’

—মৈত্রেয়ীকে ঘরে নিয়ে যাবার আগে ও আমায় চুপি চুপি বলেছিল আজ আপনাকে ও টেলিফোন করবে। নিশ্চয় করতে পারেনি? ওকে ঘরে বন্ধ করে রেখে দিয়েছে। আমি ওর মাকে বলতে শুনছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওঁরা ওর বিয়ে দিয়ে দেবেন।

খোকার কথাগুলো শুনে আমি আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেলাম। খোকা আমার অবস্থা লক্ষ্য করে নতুন উদ্যমে বলতে শুরু করলো—হ্যাঁ, ওঁরা মৈত্রেয়ীর সঙ্গে এক অধ্যাপকের বিয়ে ঠিক করছেন। মেদিনীপুর থেকে ফিরে এসেই ওদের বিয়ে হবে। আপনি জানেন ওঁরা মেদিনীপুর যাচ্ছেন?

–হ্যাঁ জানি।

—ওরা পশু। সবাই পশু। আপনার ঘেন্না হয় না?

-কেন ওদের ঘেন্না করবো? আমিই তো অন্যায় করেছি। ওঁদের দোষ কোথায়? দোষ যদি কিছ হয়ে থাকে তা হলো আমায় আশ্রয় দেওয়া।

—ওঁরা আপনাকে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। আপনি জানেন?

আমি মৃদু হেসেছিলাম। আমার কাছে এগুলো বৃথা, অপ্রয়োজনীয় আলোচনা মনে হচ্ছিল। আজ আমি যে পরিচয়ে চিহ্নিত হয়ে গেছি তা যদি না হতো, তাহলে আমার সৌভাগ্য এবং সমৃদ্ধি নিয়ে ওঁরা বোধ হয় আমার চেয়েও বেশি চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হতেন।

খোকা আমার চোখে জল দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।

—আমার মা অত্যন্ত অসুস্থ—আমার কাছে একটা পয়সা নেই—আমি ভাবছিলাম আপনার কাছ থেকে ধার চাইবো। বেঙ্গল ফিল্ম কোম্পানির কাছ থেকে পাওনা টাকা পেয়ে গেলেই…

–আমি জানতাম খোকার মার কোনো অসুখ হয়নি এবং তিনি অঁদের আত্মীয়, কালীঘাটের এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে যত্নেই আছেন।

-তিরিশ টাকায় তোমার চলবে?

আমি ওর উত্তরের অপেক্ষা না করে একটা চেক লিখে দিলাম। ও ক্ষীণকণ্ঠে একটা ধন্যবাদ দিয়ে আবার মৈত্রেয়ী প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করলো। আমি ওকে নিরুত্তাপ গলায় বললাম- খোকা আমার প্রচন্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে।

বিকেলে হ্যারন্ডের কাছে খবর পেয়ে মেয়ের দঙ্গল এসে হাজির হলো। ঘেরা বারান্দায় গ্রামোফোন বাজিয়ে গান শুরু হলো, হুইস্কি, সোডার অর্ডার গেল। আমাকে সান্ত্বনা দেবার পর্বটা বেশ বাড়াবাড়ি রকমের শুরু হলো। হ্যারল্ড ওদের বলেছিল যে আমি স্নায়বিক চাপে অসুস্থ হয়ে পড়েছি এবং কলকাতা ছাড়ার আগে আমায় সব ভোলাতে হবে। গারতি আমায় বললো, তারপর অ্যালেন, এখানে একা একা মদ খাচ্ছিস? তোর প্রেমিকাকে কাছে পাচ্ছিস না বলে দুঃখ হচ্ছে?

ও আমার কোলের ওপর বসে পড়লো। ওর দেহের স্পর্শ আমার এত খারাপ লাগছিল যে, আমি উঠে যেতে অনুরোধ করলাম।

–আমি ক্লান্ত আর অসুস্থ গারতি।

—দেখিস বাবা কোনো বাঙালী মেয়ের প্রেমে পড়িসনি তো? জানিস, ওরা খারাপ কাজ করলে কী দিয়ে গা ধোয়? জানিস? জানিস না তো, তবে শোন, ওরা গোবর দিয়ে গা ধোয়। গোবর মেখে গঙ্গায় স্নান করে।

সবাই হাসিতে ফেটে পড়লো। মিসেস রিবেইরো পাশের ঘর থেকে বারান্দায় এসে বললেন- ছেলেটাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও তো…অ্যালেন আর একটা হুইস্কি নাও। দেখবে তোমার ভালো লাগবে।…চোখের অপারেশন এমন কিছু ব্যাপার নয়।

—মিসেস রিবেইরো, আপনি ভাবছেন অ্যালেন চোখে অপারেশনের চিন্তায় কাঁদছে? খুব ভুল করেছেন…ওর সুন্দরী প্রেমিকা আর একজনের সঙ্গে কেটে পড়েছে।

হঠাৎ প্রচন্ড রাগে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে আমি চিৎকার করে বললাম —চুপ কর।

দয়া করে আমার সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বলো অ্যালেন, তুমি এখন তোমার ভবানীপুরের বাড়িতে নেই। ঐ নিগারদের বাড়িতে…

ক্লারা গারতির হাত ধরে ওকে চুপ করানোর জন্য বললো—ছেড়ে দে, গারতি। অ্যালেনকে একটু শান্তিতে থাকতে দে।

—সব জায়গায় আহারে, বাছারে বলে তোরা সবাই ওকে মাথায় তুলেছিস। মেয়েদের মতো কাঁদছে। ও সান্ত্বনা খুঁজুক বাঙালী মেয়েদের আঁচলের তলায়। আমি খ্রীষ্টান…ও কোন সাহসে আমাকে অপমান করে?

-কিন্তু অ্যালেনও তো খ্ৰীষ্টান।

—তোরা বিশ্বাস করিস ও এখনও খ্রীষ্টান আছে?—গারতি হাসিতে ফেলে পড়লো। হাসতে হাসতে হ্যারন্ডের কাছে গিয়ে বসলো।

—তুই কি বলিস হ্যারল্ড? মনে পড়ছে ও যখন হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য নিয়ে, গুরুর মাহাত্ম্য নিয়ে লেকচার মারতো? এসব মনে পড়ছে না তোদের—আর এখন আমি চুপ করবো, না?

হ্যারল্ড ভীষণ দোটানায় পড়ে গেল। মিসেস রিবেইরো সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমি উঠে পড়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম-চললাম। গারতি অদ্ভূত মুখভঙ্গী করে বললো—কোথায়? মন্দিরে পুজো করতে?

একটা জঘন্য রাত কাটালাম। শুতে যাবার আগে অবধি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম।। অজস্র সিগারেট খেলাম। বাঙালী মানুষদের চলাফেলা কথাবার্তা, দেশী চলিত ভাষায় চিৎকার সবকিছু আমায় মৈত্রেয়ীর কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল। ভেবেছিলাম ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে বিছানায় পড়লেই ঘুমিয়ে পড়বো। কিন্তু কোথায় ঘুম! বিছানা, বালিশ, যন্ত্রণায়, কষ্টে দলে মুচড়ে ফেললাম। একটার পর একটা ঘটনা, একটার পর একটা স্মৃতি আমায় পাগল করে দিচ্ছিল। তমলুক, নদিয়া, হাসপাতাল, ভবানীপুর, লেক, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মৈত্রেয়ীর চেহারা, মিঃ সেনের কন্ঠস্বর ‘Good bye Allen’ মিসেস সেন-চা খেয়ে নাও অ্যালেন’…আমি কি পাগল হয়ে যাবো!

রাতে অন্ধকারে গীর্জার ঘন্টার শব্দ রাত্রির বয়স জানিয়ে দিচ্ছিল। পাশের ঘর থেকে হ্যারল্ডর নিরবচ্ছিন্ন নাক ডাকার আওয়াজ। আমি মৃত্যুর কথাও ভাবলাম। আমি যদি গঙ্গায় ডুবে মরি, তাহলে হয়ত মিঃ সেন বুঝতে পারবেন ওঁর মেয়েকে আমি সত্যিই ভালোবাসতাম কি না। পরের দিন কাগজে এই খবর দেখে হয়ত মৈত্রেয়ী অজ্ঞান হয়ে যেতো। মিসেস সেনের অনুশোচনা আসতো। মিঃ সেন ও হয়ত বুঝতেন আমি মনে প্রাণে মৈত্রেয়ীকে ভালোবাসতাম। মৃত্যু এবং মৃত্যুর পূর্ববর্তী প্রস্তুতি পর্বের চিন্তা করতে করতে আমি ভোরের দিকে একটু আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম, এমন সময় হ্যারল্ড এসে বললো আমার ফোন এসেছে।

আমি পাগলের মতো দৌড়লাম। টেলিফোন তুলেই আমি মৈত্রেয়ীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। ওর গলার আওয়াজ আমার কাছে ছিল তৃষ্ণায় কাতর চাতক পাখির কাছে বৃষ্টির জলের মতো। ওর কথার জবাব দিতে পারছিলাম না পাছে হ্যারল্ড শুনতে পায় এই ভেবে। খাপছাড়া ভাবে ও কথা বলছিল। এত আস্তে কথা বলছিল আমি সব কথা স্পষ্ট শুনতেও পাচ্ছিলাম না। নিশ্চয়ই বাড়ির অন্য কেউ যাতে না শুনতে পায় সেই জন্য ও অত নিচু গলায় কথা বলছিল। ওর কন্ঠস্বরে এক আকুতি ছিল যার সঙ্গে খাঁচায় বন্ধ পাখির আর্ত রবেরই তুলনা করা চলে।

—অ্যালেন, তুমি আমায় চিনতে পারছো? আমি, আমিই বলছি। আমি একই রকম আছি অ্যালেন। যাই ঘটুক…মানুষের মতো মানুষ হও অ্যালেন। কাজ করে যাও। হতাশ হয়ো না। আমি আর পারছি না…অ্যালেন আমায় ক্ষমা কোরো। আমি আর পারছি না…। শোনো, তোমায় একটা কথা বলি…

হঠাৎ ও চুপ করে গেল। কেউ নিশ্চয়ই ওকে হাতে-নাতে ধরে ফেলেছে। আমি বৃথাই চেঁচাচ্ছিলাম—মৈত্রেয়ী, মৈত্রেয়ী। হ্যালো, হ্যালো। কেউ আর সাড়া দিলো না।

ঘরে ফিরে আছড়ে পড়লাম বিছানায়। দেওয়ালগুলো যেন ক্রমশ সরে এসে আমায় চেপ্টে দিচ্ছিল। আমার ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা ভবানীপুরের বাড়ির আরাম কেদারা আমায় ব্যঙ্গ করছিল। ওই চেয়ারে কতবার মৈত্রেয়ী বসেছে। প্রত্যেকটা আসবাব আমাকে ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতির কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল। কিছুতেই সেই সব ভাবনার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছিলাম না, যেগুলো রাতারাতি আমায় মানুষ থেকে ছেঁড়া কাগজে পরিণত করেছিল।

হ্যারল্ড এসে জিজ্ঞাসা করলো—মিঃ সেন কেমন আছেন? অপারেশন হয়ে গেছে?

আমি কিছু না ভেবেই উত্তর দিলাম—না হয়নি। আজই বোধহয় হবে।

বিছানায় বসে বসে আবার সিগারেট ধরালাম। মনে হচ্ছিল আমার সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে যাচ্ছে শুধু হাত দুটো ছাড়া। সে দুটো ক্রমাগত কেঁপেই চলেছিল। বেলা দশটা বেজে গেল এইভাবে। এমন সময় একটা লোক সাইকেলে করে এসে আমায় একটা চিঠি দিলো। লোকটি আমার কোনো কথার জন্য অপেক্ষা না করেই সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। চিঠি খুললাম, নরেন্দ্র সেনের চিঠি।

মহাশয়,

আমি বুঝতে পারছি আপনার আত্মসম্মানবোধ বলতে কিছু নেই। আপনার ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে আপনি ঘাসের মেধ্য চরে বেড়ান সাপের মতো। ঠিক সময় যার মাথাটা থেঁতলে না দিলেই যে প্রথম সুযোগেই ছোবল মারবে। এখনও চব্বিশ ঘন্টা পার হয়নি, আপনি ভদ্রলোকের মতো কথা দিয়েছিলেন যে আমার বাড়ির কারো সঙ্গে, কোনোরকম যোগাযোগের চেষ্টা করবেন না। আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন এবং অকারণ একটি শিশুকে কষ্ট দিচ্ছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় যে ইতিমধ্যেই আপনি তার ওপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেয়েছেন। পুনরায় যদি আপনি এই রকম প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেন, তাহলে আপনাকে যথাশীঘ্র সম্ভব দেশে পাঠানোর চেষ্টা করবো। আমি ভেবেছিলাম আপনার যথেষ্ট কান্ডজ্ঞান আছে এবং আপনি এই শহর ত্যাগ করেছেন। আমি টেলিফোনেই আদেশ দিয়েছি যাতে আপনার আজ থেকেই চাকরির পরিসমাপ্তি ঘটে। সুতরাং আপনার পক্ষে যেটুকু করণীয় পড়ে আছে তা হলো আপনার প্রাপ্য মাইনে বুঝে নেওয়া এবং সঙ্গে সঙ্গে শহর ছেড়ে যাত্রা শুরু করা। আপনার অকৃতজ্ঞতার একটা সীমা থাকা উচিত।

নরেন্দ্র সেন

এই চিঠি পড়ার পর আমার বোধশক্তি সম্পূর্ণ লোপ পেল। চাকরির কথা নয়; আমি নিজেই ঠিক করেছিলাম পদত্যাগ করবো। নরেন্দ্র সেনের সঙ্গে কথা বলা, অফিসে দেখা হওয়া ইত্যাদি আর সম্ভব ছিল না। বুঝতে পারছিলাম মৈত্রেয়ী এই ধরনের অসাবধানী কাজ করতেই থাকবে এবং তার ওপর অত্যাচার চলতে থাকবে ক্রমশ বেশি মাত্রায়। আর আমি কোনোভাবেই ওকে সাহায্য করতে পারবো না। আমি খামটা মুড়ে পকেটে নিয়ে শুধু আমার হ্যাটটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। মিসেস রিবেইরো জিজ্ঞেসা করলেন-লাঞ্চে আসবেন তো?

—নিশ্চয়ই!

—আপনার প্রিয় খাবার বানাচ্ছি। হ্যারল্ডই বললো আপনি কী কী খেতে ভালোবাসেন। দেখবেন ভালো লাগবেই…

মৃদু হেসে আমি বেরিয়ে এলাম। কোথায় যাবো, কী করবো কিছুই ঠিক নেই। সত্যই যদি কলকাতা ছাড়তে হয় তার জন্য কিছু টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তোলার দরকার। আমি নিশ্চয়ই মিঃ সেনের হুকুম মতো চলবো না। আমি চলে যাবো তার একটাই কারণ, এছাড়া মৈত্রেয়ীকে বাঁচাবার আর কোনো রাস্তা আমার জানা ছিল না। রয়েড স্ট্রীট থেকে ক্লাইভ স্ট্রীটের দূরত্ব যথেষ্টই ছিল, তবুও আমি হেঁটেই ব্যাঙ্কে এলাম।

টাকার নোটগুলো সব একটা প্যাকেটে করে ফোলিও ব্যাগে নিলাম আর খুচরো পয়সাগুলো পকেটে রাখলাম। হাওড়া স্টেশনের দিকে এগোলাম। হাওড়া ব্রীজের ওপর থেকে দেখলাম অসংখ্যা নৌকা, গঙ্গার নোংরা জল। হঠাৎই মনে হলো আত্মহত্যা কাপুরুষতা। স্টেশনের স্টল থেকে একটা লেমনেড খেলাম। তখন ভর দুপুর। স্টেশনের ডান দিকের রাস্তা ধরলাম। এই রাস্তা আমি জানতাম বেলুডের দিকে গেছে। রাস্তায় গাছের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে আমার নিজেকে অনেকখানি ভারমুক্ত মনে হচ্ছিল স্টেশন থেকে হুগলী অবধি যে মোটরগুলো ভাড়া খাটতো তারা আমাকে পেছনে ফেলে হুস হুস করে চলে যাচ্ছিল। কখনো কখনো কোনো গাড়ি আমার কাছে এসে থেমেও পড়ছিল। ড্রাইভাররা বোধ হয় অবাক হয়ে যাচ্ছিল শহরের বাইরে কোনো ইওরোপীয়ানকে পায়ে হেঁটে একা একা যেতে দেখে। একটা ঝুপড়ি মতো দোকানে একবার থামলাম। এক বৃদ্ধা লেমনেড, পাঁউরুটি ইত্যাদি বিক্রি করছিল আমি একটা ঠান্ডা পানীয় খেতে খেতে দরিদ্র বৃদ্ধার সঙ্গে বাংলায় কথা বলছিলাম। আমি মৈত্রেয়ীর প্রিয় শব্দগুলো ব্যবহার করছিলাম। আর সেগুলো উচ্চারণের সময় আমার এক অদ্ভুত তৃপ্তি হচ্ছিল।

প্রায় আড়াইটায় আমি বেলুড়ে পৌঁছলাম। পথে বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজে গিয়েছিলাম। জামা-কাপড়ে কাদা লেগে বীভৎস মূর্তি হয়েছিল। স্বামী মাধবানন্দ আমার উদভ্রান্তের মতো চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় সেই যখন মৈত্রেয়ীদের গাড়িতে করে এখানে প্রথমে এসেছিলাম তখন থেকে। গঙ্গার ধারে গিয়ে জামা-কাপড় শুকিয়ে নিলাম। ঘাসের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে চোখে সোজা রৌদ্র নিয়ে আমার মনে পড়তে লাগলো মৈত্রেয়ীর সঙ্গে এখানে বেড়াবার নানান স্মৃতি। পকেট থেকে ডায়েরি বের করে লিখতে শুরু করলাম শুধু নিজেরই জন্য। আবার সেই পুরনো টিকাগুলো পড়লাম যেগুলোকে মনে হচ্ছিল আপন রক্তে লেখা। এক জায়গায় লেখা ছিল সব শেষ হলো। কেন? আমার মনের মধ্যে বিশাল মরুভূমি।’ মঠ থেকে ভেসে আসছিল প্রার্থনা সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতের সুরে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিল।…মৈত্রেয়ী, মৈত্রেয়ী, তোমায় আর কোনোদিন আমি দেখতে পাবো না!

আমার কী হয়েছে স্বামীজী জানতে চাইলেন। তিনি যখন শুনলেন যে আমি কলকাতা থেকে হেঁটে এসেছি এবং সারাদিন কিছুই খাইনি তিনি তখনই আমায় ফিরে যেতে আদেশ করলেন। তিনি বললেন আমার আবার ম্যালেরিয়া হতে পারে। তিনি জানতেন আগের বছর আমার ম্যালেরিয়ায় কী অবস্থা হয়ে ছিল। তাঁর কন্ঠস্বরে এক অদ্ভূত ব্যঞ্জনা ছিল। তিনি কি আমার এই অন্ধ আবেগের কাছে আত্মসমর্পণকে ঘৃণা করছিলেন? জাগতিক যন্ত্রণার যারা দাস তারা এই হিন্দু সাধুদের সহানুভূতি পাবার অনুপযুক্ত। ওঁদের জাগতিক মোহমুক্তির আদর্শ ওদের বাস্তবের রূঢ়তার থেকে অনেক ঊর্ধ্বে স্থাপন করেছে। অতিমাত্রায় আধ্যাত্মিকতা ওদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে জগৎ ও জীবন থেকে। আমি বেলুড় মঠে কোনো সান্তনা খুঁজতে যাইনি, গিয়েছিলাম আমার স্মৃতির মৈত্রেয়ীকে, প্রকৃত মৈত্রেয়ীর অস্তিত্ব অনুভব করতে।

স্বামীজীর কথায় আমি একটুও ক্ষুব্ধ হইনি বরং আমি আরও সত্যি করে জানতে পারলাম আমার নিঃসঙ্গতাকে। যেসব ফল, মিষ্টান্ন উনি আমার জন্য আনিয়ে ছিলেন সেগুলোর জন্য ধন্যবাদ দিয়ে আমি আবার যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু আমি কলকাতার রাস্তা ধরলাম না। এগিয়ে চললাম। সন্ধ্যা হয়ে এলো। গঙ্গার জল দেখতে লাগলাম। নিস্তরঙ্গ সেই জল অবিশ্রান্ত বয়ে চলেছে কলকাতার দিকে। কয়েকটা ছোট ছোট ছেলে ততক্ষণে আমাকে ঘিরে ধরেছে। প্রথমে তারা আমাকে দেখে কুকুরের ডাক ডাকছিল, তারপর অশুদ্ধ ইংরেজীতে আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করছিল, White Monkey’ ‘White Monkey’, কিন্তু যখন ওরা দেখলো যে আমি রাগ করছি না, তারা আমার দিকে এগিয়ে এলো। ওরা হয়তো লক্ষ্য করেছিল আমার চোখের জল, আমার চিন্তান্বিত বিষণ্ন মুখ। ওরা একটু ইতস্ততঃ করে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি ওদের সঙ্গে বাংলায় কথা বললাম, ওদের মধ্যে কিছু খুচরো পয়সা বিতরণ করলাম। ওরা আনন্দে হই-হই করে প্রায় একটা শোভাযাত্রা করে আমায় গ্রামের প্রান্ত অবধি পৌছে দিলো। দুপুরে বৃষ্টির ফলে সন্ধ্যা ছিল নির্মল, কিন্তু ভারী আর বিষণ্ন। আমার হাঁটতে ভালো লাগছিল। বড় রাস্তায় আমি একা। মাঝে দু’একটা গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে আমার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। গাড়িগুলো যাচ্ছিল কলকাতার দিকে। কদাচিৎ দু একজন পথচারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হচ্ছিল। ভাবছিলাম ভারতের লোকেরা কী তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে! সেই নির্জন রাস্তায়, সন্ধ্যা ও রাত্রির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ভবানীপুরের সন্ধ্যাগুলোর কথা মনে পড়ছিল। গলার কাছে ব্যথা করে উঠলো। ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছিল। দূরে একটা দোকানের আলো দেখা যাচ্ছিল, আমি তাড়াতাড়ি পা চালালাম। দোকান থেকে এক প্যাকেট সিজারস্ সিগারেট কিনলাম, কারণ একমাত্র সিজারস্ই সেখানে পাওয়া যায়। দোকানের ভেতরে একটা গ্যাসের আলো জ্বলছিল আর কয়েকজন পথিক হুঁকো খেতে খেতে বিশ্রাম নিচ্ছিল।

জানি না রাত কটা অবধি আমি হেঁটেছিলাম আর যে গ্রামগুলো পার হয়েছিলাম তাদের নামই বা কি ছিল। অন্ধকারে আমি হেঁটে চলেছিলাম এক অন্ধ মোহের বশে। এইভাবে আমি আমার চিন্তাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারছিলাম। মনে হচ্ছিল মৈত্রেয়ীর প্রতি ভালোবাসাই ওই কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা যোগাচ্ছিল। রাস্তার ধারে মাথায় ছাউনিওয়ালা একটা জলের কল ছিল। আমি একটু জল খাবার জন্য সেখানে থেমেছিলাম, কিন্তু চওড়া বাঁধানো বেদীতে বসা মাত্রই জগতের সমস্ত ক্লান্তি আমাকে আক্রমণ করলো। নিজের অজান্তেই আমি লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম মাথার তলায় টুপিটাকে বালিশ করে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। মৈত্রেয়ীর স্বপ্নে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে বসলাম। লোকালয় থেকে বহু দূরে নির্জন জায়গা; প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় আমি কাঁপছিলাম। আবার কখন যে আমি শুয়ে পড়েছি জানি না, কয়েকজন লোকের জল তোলার আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। আমাকে অবাক্ দৃষ্টিতে সবাই দেখছিল, কিন্তু কেউই আমায় কিছু প্রশ্ন করতে সাহস করলো না। যদিও আমার জামাকাপড় ছিল কদমাক্ত, জুতো ছিল ছেঁড়া তবু তো আমি সাহেব!

জল দিয়ে মুখ ধুয়ে নিলাম। একটু ভালো লাগছিল। আবার চলা শুরু করলাম। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় লোকচলাচল শুরু করলো। আমি মাথা নিচু করে হাঁটছিলাম। তালগাছের শ্রেণীর মধ্য দিয়ে গঙ্গা দেখা যাচ্ছিল। শুধু ওই নদীটিকে দেখার জন্য আমি মাঝে মাঝে থামছিলাম। বহমান নদীর দৃশ্যে আমাকে এক অবর্ণনীয় সান্ত্বনা দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই জল চলেছে মৈত্রেয়ীর শহরে, মৈত্রেয়ীর কাছে। আমার নিজের শারীরিক কষ্ট সম্পর্কে আমি সচেতন ছিলাম না। এতটুকু দুর্ভাবনা ছিল না মিসেস রিবেইরো বা হ্যারল্ড কী ভাববে, চিন্তা করবে সে সম্পর্কে। শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল খোকা নিশ্চয়ই আমার খোঁজ নিতে এসে জানবে যে আমি সকালে বেরিয়ে আর ফিরিনি, একটা দিন পার হয়ে গেছে। ও নিশ্চয়ই মিঃ সেনকে জানাবে। মিঃ সেন আমার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হয়ে একবার অন্তত ভাববেন আমার সঙ্গে কী ব্যবহার উনি করেছেন।

একটা ছোটখাটো শহরের কাছে রাস্তার ধারে একটা পান্থশালায় আমি কিছু খেয়ে নিলাম। খাদ্যের মধ্যে ছিল ভাত, তরকারি, মাছের ঝোল। উপস্থিত ক্রেতাদের অবাক্ করে দিয়ে আমি মাটিতে বসে হাত দিয়ে ভাত মেখে খেলাম। ইতিমধ্যে তারা আমার বাংলায় কথা বলতেও দেখেছে। আমার পোশাক নোংরা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চুলে চিরুনি পড়েনি তবুও আমি তো শ্বেতকায়! খাওয়া সেরে আমি আবার পথে নামলাম। সন্ধ্যা অবধি হেঁটে চললাম। দিনটা ছিল সূর্যের কিরণে উত্তপ্ত। প্রতিটি জলের কলের কাছে আমাকে থামতে হচ্ছিল জল খাবার জন্য আর মুখে-চোখে জল দেবার জন্য। আকাশে তারা ফুটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে আমি একটা এঁদো পুকুরের ধারে প্রকাণ্ড আম গাছের বাগানের ধারে এসে পড়লাম। আর পারছিলাম না। আম গাছের তলায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড মশার কামড় উপেক্ষা করার শক্তি দিলো আমার শ্রান্তি।

পরদিন বেশ বেলায় আমার ঘুম ভাঙলো। হাত পা সব মনে হলো অবশ হয়ে গেছে। তবুও আবার রাস্তায় নামলাম। সারাদিন ধরে আবার হাঁটা শুরু হলো। ক্রমশ মস্তিষ্ক জড় হয়ে গেল। বিশেষ কিছু আর মনে করতে পারছি না। শুধু মনে পড়ছে যে আমি একটা গরুর গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমি কোথায় এসে পড়েছি, জায়গাটার কি নাম আর কী করে রেল স্টেশনের দিকে যেতে পারবো। লোকটা আমার বর্ধমানের কাছে একটা হল্ট স্টেশনে নিয়ে গিয়েছিল। তখন বেশ রাত। কলকাতা যাবার প্রথম ট্রেন আসে ভোরবেলা এবং এখানে থামেও না। প্রায় মাঝরাত্রে একটা লোকাল ট্রেন বর্ধমান যায়। আমি একটা তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট কাটলাম।

বর্ধমান স্টেশনের তীব্র আলোয় আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। বহুক্ষণ অন্ধকারে থাকার ফলে হয়ত ওইরকম হয়ে ছিল। বহুকাল রোগে ভোগা রুগীর মতো আমি জেগে উঠলাম দারুণ কোলাহলের মধ্যে। এইবার আমি একটা ইন্টাল ক্লাসের কাউন্টার খুঁজছিলাম। আসলে আমার লজ্জা করছিল কয়েকজন অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ও ইংরেজদের দেখে যারা লক্ষ্ণৌ মেল ধরবার জন্য অপেক্ষা করছিল।

শীতে জড়সড় হয়ে আমি স্টলে চায়ের পর চা খেয়ে যাচ্ছিলাম এবং চেষ্টা করছিলাম গত বাহাত্তর ঘন্টার ঘটনাগুলোকে পর পর মনে করতে। কিছুতেই সব পর পর সাজাতে পারছিলাম না, বড় বড় ফাঁক দেখা দিচ্ছিল। আমার স্মৃতি ঠিক কাজ করছিল না। ওই শূন্যস্থানগুলো পূরণ করার জন্য আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। আমি কি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক করলাম আর কিছু ভাববো না। সব কিছুই চলে যাবে, যেমনটি চলার। এই সান্ত্বনা-বাক্যটা পরবর্তীকালে সারা জীবন মনে রেখেছিলাম।

হাওড়া স্টেশনে নেমে প্রচণ্ড ভয় হতে লাগলো। ভয় হচ্ছিল ভবানীপুরের কারোর সঙ্গে না দেখা হয়ে যায়। হঠাৎই মনে পড়ে গেল মিঃ সেনের পরিবারের সবারই এখন মেদিনীপুরে থাকার কথা। অন্য সময় হলে এই ঘটনা, মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমার দূরত্ব বাড়ার জন্য হয়ত যন্ত্রণা দিতো কিন্তু আজ আশীর্বাদ বলে মনে হলো।

আমি আমার গাড়ি থেকে বাড়ির সামনে নেমেই শুনলাম পার্ক স্ট্রীটের পুলিশ অফিসার ইতিমধ্যে আমার নিখোঁজ হওয়া সম্বন্ধে অনুসন্ধান আরম্ভ করে দিয়েছেন। আমার এই প্রায়-পাগলের মতো মূর্তি দেখে মিসেস রিবেইরো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। বললেন—হায় ভগবান! কোথা থেকে আসছেন? এ কি চেহারা আপনার South 1147 আপনাকে অনবরত টেলিফোনে ডাকছে, আর সেই ছেলেটি, যাকে আপনি খোকা বলে ডাকেন, সে কতবার আপনার খোঁজ করতে এলো!

মিসেস রিবেইরোকে ছেড়ে আমি মুখ-হাত-পা ধুতে চলে গেলাম। একটু স্নান, সেই সময় আমার একান্ত দরকার ছিল। হ্যারল্ড অফিস থেকে টেলিফোন করে মিসেস রিবেইরোর কাছে আমার খোঁজ নিচ্ছিল। আমি ফিরেছি শুনে সে তৎক্ষণাৎ একটি ট্যাক্সি নিয়ে আমাদের বোর্ডিং হাউসে এসে উপস্থিত হলো।

-কোথায় ছিলি? কী করছিলি? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

-একটু বেড়াতে গিয়েছিলাম। এমন কিছু সাংঘাতিক ব্যাপার নয়। এত চিন্তা করছিস কেন তোরা? -মৃদু হেসে আমি জবাব দিয়েছিলাম।

-তুই? তুই কেমন আছিস?

—গতকাল মেয়েরা সবাই এসেছিল। সবাই দারুণ চিন্তিত। আমাদের ইচ্ছে ছিল, পৌত্তলিকদের হাত থেকে তোকে মুক্ত করা, উপলক্ষে চায়না টাউনে একটা পার্টির ব্যবস্থা করবো—কিন্তু কী হলো? ও হ্যাঁ, ওই ‘নিগার’ ছেলেটি আবার এসেছিলো তোর খোঁজ নিতে। মনে হলো একটু রেগে গেছে…. আমায় বিরক্ত করছিল। আমি দূর করে দিয়েছি।

ঠিক দুপুরের খাওয়ার পর আশুতোষ মুখার্জী রোডের একটা লাইব্রেরি থেকে খোকা আমায় ফোন করলো। জানলাম ইতিমধ্যে অনেক গুরুতর ঘটনা ঘটে গেছে। অতি অবশ্যই সে আমার সঙ্গে এক্ষুণি দেখা করতে চায়। আমি ওকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে আসতে বলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করতে থাকলাম।

—আপনি কোথায় ছিলেন?

—পরে সব বলবো। আগে বলো ওখানে কি হয়েছে?

বাস্তবিকই অনেক কিছু ঘটে গেছে। মৈত্রেয়ীর বিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সে নাকি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, সে ফুলশয্যার রাত্রিরে তার স্বামীর কাছে স্বীকার করবে আমার সঙ্গে তার সম্পর্কের সমস্ত কথা। সমগ্র পরিবারের সম্মানে এটা যথেষ্টই আঘাত দেবে। তার স্বামীও নিশ্চয়ই তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে এবং গোটা শহরে কেচ্ছা রটবে। এই কথা শোনামাত্র মিঃ সেন সজোরে ওকে একটি ঘুষি মারেন আর ও মাটিতে পড়ে যাওয়ার পর একটানা লাথি মেরে যেতে থাকেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাঁর স্ট্রোক হয় এবং মিঃ সেনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। যদি রক্তচাপ দু-একদিনের মধ্যে কমে, তাহলে তাঁর চোখে অপারেশন হবে। কিন্তু তাঁর অবস্থা নিয়ে চিকিৎসকগণ দুশ্চিন্তিত। এদিকে মৈত্রেয়ীকে তার ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। ঘরে বন্ধ করার আগে মিসেস সেন ড্রাইভারকে ডেকে এনে, ড্রাইভারকে দিয়ে তাঁর সামনে মেয়েকে বেত মারার আদেশ দেন। ড্রাইভার একটানা বেত মেরে গিয়েছিলো যতক্ষণ না মৈত্রেয়ী অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। মিসেস সেন খোকাকেও বলেছিলেন মৈত্রেয়ীকে চাবুক মারতে, কিন্ত সে তা অস্বীকার করে এবং সেখান থেকে পালিয়ে যায়। হবু ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, ফলে সেও এখন হাসপাতালে।

মৈত্রেয়ী খোকার হাতে আমাকে একটা খাম পাঠিয়েছিলো। গোলাপী খামটার ভেতরে জলপাই গাছের একটা মুকুল সমেত দুটো পাতা পুরে দেওয়ার সুযোগটুকু কেবল তার হয়েছিল। আর একটি ছোট্ট কাগজে পেনসিল দিয়ে লেখা ছিল, ‘অ্যালেন, এই আমার শেষ উপহার।’

আমি একটা ঘোরের মধ্যে খোকার কথাগুলো শুনে গেলাম। পরিস্থিতির গুরুত্ব এবং তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া বোঝবার চেষ্টা করছিলাম। খোকা কিছু লিখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। আমার নরেন্দ্র সেনের কাছে প্রতিজ্ঞার কথা মনে পড়লো। আমি বললাম- কী প্রয়োজন? আর কী তার দরকার আছে? আরও কী কী যেন সব বলেছিলাম…..

হঠাৎ লক্ষ্য করলাম যে আমি ভুল বকছি। আমার চারদিকে সব কিছু ঘুরছে।

আমি যদি পারতাম। যদি আমি পারতাম। আমি, আমি কি ওকে ভালোবাসি? খোকা বোকার মতো আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি চিৎকার করে বললাম—আমি ভালোবাসতে চাই। তার আগে ওকে ভালোবাসার উপযুক্ত হতে চাই আমি। মিসেস রিবেইরো দৌড়ে এলেন। হতভম্ব হয়ে আমার কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম।

-আমি মৈত্রেয়ীকে ভালোবাসতে চাই। আমি ওদের কী করেছি? আমার বিরুদ্ধে ওদের কী বলার আছে? আমার বিরুদ্ধে আপনাদের কী বলার আছে?

হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেদিন সকালে টেলিফোনে মৈত্রেয়ীর কথাগুলো—চিরবিদায় অ্যালেন, চিরবিদায় প্রিয়তম। অন্য জীবনে আমরা নিশ্চয়ই ফিরে পাবো আমাদের ভালোবাসা। দুজনে দুজনে নিজের করে পাবো। তখন তুমি আমায় চিনতে পারবে তো? আমার জন্য অপেক্ষা করবে তো? আমায় ভুলো না অ্যালেন। আমি কিন্তু তোমার জন্য অপেক্ষা করবো।’

আমি ওকে কিছুই উত্তর দিতে পারিনি। শুধু বলেছিলাম—মৈত্রেয়ী, মৈত্রেয়ী, আমার মৈত্রেয়ী…..

আমাদের বিচ্ছেদের সপ্তম দিনে আমি চলে গেলাম। চলে যাবার আগের দুই রাত্রি আমি কাটিয়েছিলাম মিঃ সেনের বাড়ির সামনের রাস্তায়। সারাক্ষণ আমি চেয়েছিলাম মৈত্রেয়ীর শোবার ঘরের জানালার দিকে। জানালা অন্ধকার। একবারের জন্যেও আলো জ্বলেনি।

আমার যাত্রার দিন ছবু মারা গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *