১
মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের সঠিক তারিখটা মনে না থাকায়, কাহিনীটা কোথা থেকে শুরু করবো ঠিক বুঝতে পারছি না। সত্যি বলতে কি সে বছরে আমার ডায়েরিতে এ বিষয়ে কিছুই লেখা নেই। অনেক পরে স্যানাটোরিয়াম থেকে ছুটি পাবার পর তার নাম ডায়েরিতে পেলাম? আমি তখন থাকতাম ভবানীপুরে, নরেন্দ্র সেনের বাড়ি। সেটা ১৯২৯ সাল। সে বাড়িতে মৈত্রেয়ীকে আমি দেখেছি অন্তত দশমাস আগে। কাহিনী শুরু করবার সময় আমার অস্বস্তি একটাই। আমি মৈত্রেয়ীর সে সময়কার মুখ, কেন জানি না, ঠিক মনে করতে পারছি না। তাছাড়া আমাদের প্রথম সঙ্কাতের সেই বিস্ময়, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ আর উদ্বেলতার কথা আমি কী করে ভাষায় প্রকাশ করবো তাও বুঝতে পারছি না।
মনের মধ্যে শুধু তার একটা অস্পষ্ট স্মৃতিই এতকাল ধরে রেখেছিলাম, অক্সফোর্ড বুক অ্যাণ্ড স্টেশনারি স্টোর্সের সামনে, মোটরে অপেক্ষমান মৈত্রেয়ীর সেই চেহারা। তার বাবা আর আমি ‘বড়দিন উপলক্ষে কিছু বই পছন্দ করতে সেখানে ঢুকে ছিলাম। মনে আছে সেদিন তাকে প্রথম দেখে এক অস্বস্তিকর শিহরণ হয়েছিল আমার শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে একটা বিতৃষ্ণার ভাবও এসেছিল। কৌতূহলও যে হয়নি এমন নয়। আমার কৌতূহলী চোখ দেখেছিল তার কালো রঙের খুব বড় বড় চোখ আর পুরু ঠোঁট। আর দেখলো উন্নত বুক যা বাঙালী কুমারী মেয়েদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী খুব দ্রুত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে যায়। …..মৈত্রেয়ীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। আমাকে নমস্কার করার সময় সে যখন কপালে হাত ঠেকালো, আমি দেখলাম তার দুটি নগ্ন বাহু। তার গায়ের রঙ অনুজ্জ্বল, বাদামী, মাটি আর মোমের যেন সংমিশ্ৰণ।
সে সময়ে আমি থাকতাম ওয়েলেসলী স্ট্রীটের ‘রিপন ম্যানসনে’। আমার পাশের ঘরে থাকতো ‘হ্যারল্ড কার’। হ্যারল্ড ছিল ‘আর্মী-নেভী’ স্টোর্সের কর্মচারী। আমরা দুজনে ছিলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার সঙ্গে কলকাতার অনেক পরিবারের পরিচয় ছিল। তার সঙ্গে আমি অনেক সন্ধ্যা এইসব পরিবারদের বাড়িতে কাটিয়েছি। সপ্তাহে একদিন যুবতী মেয়েদের আমরা আমাদের নাচের আসরে আনতাম।
মৈত্রেয়ীর নগ্ন বাহু আর তার অদ্ভূত কালচে বাদামী গায়ের রঙের কথা আমি হ্যারল্ডকে জানাবো ভাবছিলাম। হাত দুটো আমার কাছে সত্যিই পুরুষালি লেগেছিল এবং সেজন্য অস্বস্তিকর মনে হয়েছিল। আসলে এ বিষয়ে আমার যা মনে হয়েছিল, তা আমি ওর কাছে যাচাই করে নিতে চেয়েছিলাম।
দৃশ্যটা এখনও স্পষ্ট মনে পড়ে। হ্যারল্ড তখন দাড়ি কামাচ্ছিল। ওর পা দুটো তখন একটা ছোট টেবিলের ওপর তোলা। সামনে ছোট আয়না, চায়ের কাপ আর হাল্কা বেগুনি রঙের নাইট গাউন, যাতে জুতোর কালির দাগ। মনে আছে এ জন্য ও ওর চাকরকে মেরে রক্ত বার করে দিয়েছিল, অথচ সে বেচারীর কোনো দোষ ছিল না। একদিন রাত্রিবেলা Y. M. C. A.-তে নাচের পর মত্ত অবস্থায় সে নিজেই নাইট-গাউনটা নোংরা করে দিয়েছিল। যাই হোক, আমি দেখছিলাম, তার অগোছালো বিছানার ওপর কয়েকটা খুচরো পয়সা পড়ে আছে। আর আমি তখন কাগজ পাকিয়ে সরু করে পাইপের মুখ পরিষ্কার করার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম।
আমার কথা শুনে সে বললে, না রে অ্যালেন, একটা বাঙালী মেয়েকে তোর ভালো লাগবে কি করে? ওদের দেখলে গা ঘিনঘিন করে, ওদের সঙ্গও বিরক্তিকর। আমি তো এখানে জন্মেছি। আমি ঐসব মেয়েদের তোর চাইতে অনেক ভালোভাবে জানি। বিশ্বাস কর, ওরা এতো নোংরা যে ওদের সম্বন্ধে আর কিছু ভাবা যায় না। আর প্রেম? সে তো একেবাবেই চলে না। আর তাছাড়া ওই মেয়েটা তোকে কোনোদিনও পাত্তা দেবে ভেবেছিস্!
আসলে হ্যারল্ডই ওই ভুল করেছিল। আমি ভালোভাবে এক বাঙালী তরুণীর বর্ণনা করেছি, তাই শুনেই সে ধরে নিয়েছিল যে, আমি তাকে ভালোবাসতে চাইছি। হ্যারল্ড, সব অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানদের মতই নির্বোধ আর গোঁড়া কিন্তু বাঙালী মেয়েদের নিয়ে ওর রূঢ়, নির্বোধ সমালোচনা আমার মনে এক অদ্ভূত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো। বসে থাকতে থাকতেই আমার অস্পষ্ট ধারণা হলো যে মৈত্রেয়ীর স্মৃতি ইতিমধ্যেই ক্ষণিকের জন্য হলেও আমার বাসনা-কামনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এই আবিষ্কার আমায় একাধারে খুশি করলো আবার বিচলিতও করলো। যন্ত্রচালিতের মত পাইপ পরিষ্কার করতে করতে আমি আমার ঘরে চলে গেলাম।
এইসব কথা আমার ডায়েরিতে আমি কিন্তু কিছুই লিখে রাখিনি। না লিখলেও সেই সব মুহূর্তগুলো আবার আমার স্মৃতিতে ফিরে এসেছিল। বিশেষ করে সেই দিনটির কথা, যে দিন রাত্রে আমি জুঁই ফুলের মালা উপহার পেয়েছিলাম মৈত্রেয়ীর কাছ থেকে।
তখন আমি ভারতে সবেমাত্র আমার চাকরি-জীবন শুরু করেছি। কুসংস্কারাচ্ছান্ন মন নিয়েই এসেছি এদেশে। রোটারী ক্লাবের মেম্বার আমি, সে গর্বও ছিল, আর ছিল আমার জাতীয়তাবোধ, পাশ্চত্যে আমার জন্মের অহংকার ইত্যাদি। আমার সে সময়ে পাঠ্য ছিল পদার্থবিদ্যা, গণিত ও সাধারণ বিজ্ঞানের বই। এ সব পড়তাম অথচ ছেলেবেলায় কল্পনা করতাম মিশনারী হবো আমি। আরও একটা অভ্যাস ছিল আমার। যত্নের সঙ্গে লিখতাম আমার প্রিয় ডায়েরি।
এদেশে আমি এসেছিলাম Noel & Noel কোম্পানির প্রতিনিধি হয়ে। এখানে টেকনিক্যাল ড্রাফটসম্যান হিসাবে বদ্বীপে খাল খননের কাজে যোগ দিয়েছিলাম। এখানেই পরিচয় হলো এডিনবার্গের ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত প্রধান ইঞ্জিনিয়ার এবং কলকাতার অন্যতম গণ্যমান্য ব্যক্তি, মৈত্রেয়ীর বাবা নরেন্দ্র সেনের সঙ্গে। আমার জীবনের পরিবর্তনের সূত্রপাত ঠিক সেখান থেকেই। আমার আয় হয়তো তুলনায় অল্প ছিল, কিন্তু আমার কাজে আমি আনন্দ পেতাম। ক্লাইভ স্ট্রীটের অফিসের মধ্যে ছোট্ট উনুনে রান্না করা, অসংখ্য কাগজে সই করা অথবা তার মর্মোদ্ধার করা, গ্রীষ্মের প্রতি সন্ধ্যায় স্নায়বিক অবসাদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য মাতাল হওয়ার একঘেয়ে রুটিন-জীবন। দুতিন সপ্তাহ অন্তরই বাইরের কাজে যেতে হতো। আর যখন যেতাম, তখন মুক্তি পেতাম ঐ একঘেয়েমি থেকে। তমলুকের নির্মাণ কার্যের প্রাথমিক দায়িত্ব আমার হাতে ন্যস্ত ছিল। প্রতিবারই অফিস থেকে কর্মক্ষেত্রে এসে যখন দেখতাম বাঁধগুলো আরও উঁচু হয়ে উঠেছে, তখন আমার মন আনন্দে ভরে উঠতো।
সে সময়টা সত্যিই সুখের সময় ছিল। ভোরবেলা হাওড়া-মাদ্রাজ এক্সপ্রেস ধরে প্রাতরাশের আগেই কাজের জায়গায় পৌঁছে যেতাম। স্টেশনটা ছিল যেন প্রতীক্ষারত বন্ধুর মতো। তাছাড়া ভারতে প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণ যথেষ্টই আরামদায়ক। মেরুণ রঙের হেলমেটটা প্রায় চোখের ওপর নামিয়ে প্ল্যাটফর্মের ওপর দিয়ে গটগট করে হেঁটে যেতাম, বগলে গোটা পাঁচেক ইলাস্ট্রেটেড ম্যাগাজিন, হাতে দুপ্যাকেট ক্যাপস্টান সিগারেট আর পেছনে আমার চাকর। তমলুকে থাকাকালীন আমি বড্ড বেশি সিগারেট খেতাম। এমনকি প্ল্যাটফর্মের সিগারেট স্টলগুলোর সামনে দিয়ে যাবার সময় কেবলই মনে হতো সিগারেট বোধ হয় যথেষ্ট কেনা হয়নি। একদিনের বিশ্রী অভিজ্ঞতা আমি ভুলবো না। সিগারেটের অভাবে মজুরদের কাছ থেকে খৈনী নিয়ে পরখ করতে গিয়ে আমার সারা অঙ্গে সে কী কাঁপুনী। আমি কখনই কামরার সহযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করতাম না। মোট কথা, আমার সহযাত্রী বলতে যারা ছিল, তারা অক্সফোর্ডের মাঝারি ধরনের ছাত্র, অথচ এখানকার ‘বড় সাহেব’, যাদের পকেটে সর্বদাই থাকতো ডিটেকটিভ উপন্যাস, আর নয়তো এমন সব ভারতীয় বড়লোক, যারা টাকার জোরে প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণে অভ্যস্ত হলেও ঠিকমতো কোট পরতে আর দাঁত মাজতে শেখেনি। তার থেকে আপন মনে জানালার বাইরে তাকিয়ে বাংলার সমতল ভূমির সৌন্দর্য উপভোগ করা ছিল অনেক আনন্দের।
একমাত্র সাদা চামড়ার মানুষ বলেই আমার কর্মস্থলের ওপর ছিল আমার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব। কয়েকজন অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান অবশ্য ছিল, যারা ব্রীজের কাজই মূলত দেখা শোনা করতো, কিন্তু তারা কখনই আমার সমমর্যাদা পেত না। তারা ট্রেনে তৃতীয় শ্রেণীতে যাতায়াত করতো এবং ওখানকার রীতি অনুয়ায়ী খাকী রঙের ছোট হাফ প্যান্ট আর বড় পকেটওয়ালা খাকী রঙের হাফসার্ট পরে বিশুদ্ধ হিন্দীতে মজুরদের গালিগালাজ করতো। অপর পক্ষে আমার হিন্দী উচ্চারণ ছিল খুবই খারাপ আর ভাষাটাও হতো বেশ অশুদ্ধ। কিন্তু তাতে কিছু এসে যেত না। শ্রমিকদের ওপর আমার প্রভাব ছিল অন্য কারণে। কারণটা হলো আমি বিদেশী। সুতরাং আমার বক্তব্য অভ্রান্ত এবং শ্রেষ্ঠ, এটাই ছিল অবধারিত। সারাদিন ওদের সঙ্গে বক্ করে, সন্ধ্যায় তাঁবুতে ফিরে লেখালেখির কাজ সেরে শেষে পাইপটা ধরিয়ে নিবিষ্ট মনে চিন্তা করা, এটাই ছিল আমার প্রাত্যহিক কর্ম। সমুদ্রের ধারে তালগাছের সারি আর উগ্রগন্ধযুক্ত ঝোপঝাড়ওয়ালা এই সমতল জায়গাটায় সাপের উপদ্রব যথেষ্ট থাকলেও আমার খুব ভাল লেগে গিয়েছিল। হট্টগোল কোলাহল থেকে দূরে নির্জন, নিস্তব্ধ এই জায়গাটা আমার মনে এনে দিতো এক অসীম প্রশান্তি। নীল আকাশের নিচে এই সবুজ পরিত্যক্ত সমতলভূমি যেন ভ্রমণকারীদের জন্যে বিষণ্ণ প্রতীক্ষায় থাকতো। তখনকার দিনগুলো ছিল যেন অবকাশযাপনের সময়ের মতো আনন্দমুখর। প্রচুর উৎসাহ। আমার ওপর কর্তৃত্ব করার কেউ ছিল না। ডাইনে বাঁয়ে হুকুম চালাতাম। শুধু অভাব ছিল একজন বুদ্ধিমান সঙ্গীর। তেমন সঙ্গী যদি কেউ তখন থাকতো তাহলে হয়ত তাকে আমি অনেক বিস্ময়কর কিছু শোনাতে পারতাম।
ঘটনাচক্রে একদিন লুসিয়্যাঁ মেজ-এর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে গেল। আমি রোদে পুড়ে ক্ষিদে- তেষ্টায় কাতর হয়ে প্ল্যাটফর্মের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছি, আমার চাকর গেছে ট্যাক্সি ডাকতে, আর এদিকে তখন সবে বম্বে এক্সপ্রেস এসে পৌঁছেছে। তার ফলে হাওড়া স্টেশনে প্রচণ্ড ভীড়। এর মধ্যে দেখা লুসিয়্যাঁর সঙ্গে।
লুসিয়্যাঁর সঙ্গে আমার আলাপ বছর দুয়েক আগে এডেন বন্দরে। জাহাজ কয়েক ঘন্টার জন্য থেমে ছিল। আমি যাবো ভারতবর্ষের পথে আর লুসিয়্যাঁ মিশরে যাবার জন্য একটা ইটালিয়ান জাহাজের অপেক্ষায়। যদিও সে ছিল একটু বেশি মাত্রায় দাম্ভিক তবু তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন, প্রতিভাবান এই সাংবাদিককে আমার বেশ ভালো লেগেছিল। জাহাজে বসেই সে তখন একটা অর্থনৈতিক প্রবন্ধ লিখছিল, দেশের মূল্যতালিকা আর সেই বন্দরের মূল্যতালিকার তুলনামূলক পর্যালোচনা করে। লুসিয়্যাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। একঘন্টা মাত্র একটা মোটরে ঘুরে, যে-কোনও একটা শহর সম্পর্কে সে নিখুঁত বিবরণ লিখতে পারতো। যে সময়ে তার সঙ্গে আমার আলাপ, তখন তার একাধিকবার ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, জাপান ঘোরা হয়ে গেছে। যারা মহাত্মা গান্ধীর সমালোচনা করতো তাদের সঙ্গে সে ছিল একমত। তবে সেটা মহাত্মাজী যা করেছিলেন তার জন্য নয়, উনি যা করতে পারতেন অথচ করেন নি, সেই ব্যাপারে তার বক্তব্য ছিল তীক্ষ্ণ যুক্তিভিত্তিক।
আমাকে হঠাৎ দেখে কিছুমাত্র অবাক না হয়ে লুসিয়্যাঁ ফরাসী ভাষায় চিৎকার করে উঠলো, হ্যালো অ্যালেন! সেই ভারতেই রয়ে গেছিস? শোন, লোকটাকে বলে দে তো, আমার ইংরেজী না বোঝার সুযোগ নিয়ে আমাকে কোনো হোটেলে না তুলে দেয়। সোজা Y.M.C.A.-তেই যেন যায়। ভারতের পটভূমিতে একটা বই লিখছি। বইটা সাকসেসফুল হবেই। ডিটেকটিভ উপন্যাসে রাজনীতির মশলা মেশানো। শোনাবো তোকে।
আধুনিক ভারতের ওপর লুসিয়্যাঁর একটা বই লেখার ইচ্ছে অনেক দিনের। এর জন্য কয়েক মাস ধরে সে বিভিন্ন লোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। জেলখানাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেছে, অনেক ছবিও তুলেছে। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় Y.M.C.A.. হোটেলে গিয়ে তার অ্যালবামগুলো দেখলাম এবং বুঝলাম একমাত্র ভারতীয় নারীদের ব্যাপারটাই তাকে কিছুটা অসুবিধায় ফেলেছে। এ ব্যাপারে তার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। পর্দার অন্তরালে যাদের জীবন-যাত্রা চলেছে তাদের সম্পর্কে লুসিয়্যাঁর ধারণা ছিল স্বাভাবিকভাবেই খুব অস্পষ্ট। তাদের নাগরিক অধিকার সম্বন্ধে তার কিছুই জানার অবকাশ ছিল না। বিশেষতঃ সে খুবই কৌতূহলী ছিল বাল্যবিবাহ সম্পর্কে। অনেক বার সে আমাকে প্রশ্ন করেছে যে, এদেশে আট বছরের মেয়েরও বিয়ে দেওয়া হয় কিনা। অস্বীকার করতে পারিনি, কারণ এ ঘটনার উল্লেখ আমি এক বিশিষ্ট ব্যক্তির বইতে পড়েওছি, যিনি এখানে প্রায় তিরিশ বছর ধরে ম্যাজিস্ট্রেটের মত দায়িত্বশীল পদে আসীন ছিলেন।
এসব ব্যাপারে আলোচনা করতে করতে ঘেরা বারান্দার লাউঞ্জে একটা সুন্দর সন্ধ্যা কেটেছিল। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাকে এ সমস্ত বিষয়ে বিশেষ কোনো ধারণা বা জ্ঞান আমি দিতে পারলাম না। আমি নিজেও এদেশের নারীদের চিনতাম না। কদাচিৎ তাদের সিনেমা হলে অথবা সভা- সমিতিতে দেখেছি। ভাবতে ভাবতে একটা বুদ্ধি মাথায় এলো, যদি নরেন্দ্র সেনকে অনুরোধ করি আমার বন্ধুকে চায়ের নিমন্ত্রণ করতে তাহলে হয়ত লুসিয়্যাঁ তাঁর কাছ থেকে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পেলেও পেতে পারে। আর সেই সুবাদে আমিও মৈত্রেয়ীকে হয়ত কাছ থেকে দেখার একটা সুযোগ পেতে পারি। সেই অক্সফোর্ডের দোকানের সামনে প্রথম দেখা হয়েছিল, তার পরে তাকে আর আমি দেখিনি। মিঃ সেনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল আন্তরিকতার, যদিও তা সীমাবদ্ধ ছিল অফিসের কাজকর্ম এবং গাড়িতে একসঙ্গে যাতায়াতের সময় কথাবার্তার মধ্যে। অবশ্য এর মধ্যে দুবার তিনি আমায় তাঁর বাড়িতে চা খেতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, কিন্তু তখন আমার অবসর সময়ের পদার্থবিদ্যা, গণিতবিদ্যার আকর্ষণ কাটিয়ে ওঁর বাড়ি যেতে পারিনি।
আমি মিঃ সেনকে জানালাম, লুসিয়্যাঁ ভারতের ওপর একটা বই লিখছে যেটা প্যারিস থেকে প্রকাশিত হবে এবং এ ব্যাপারেই সে ওঁর সঙ্গে কিছু আলোচনা করতে চায়। মিঃ সেন সানন্দে রাজী হলেন এবং সেই দিনই সন্ধ্যায় আমাদের নিমন্ত্রণ জানালেন। আনন্দের সঙ্গে লুসিয়্যাঁকে খবরটা জানালাম। লুসিয়্যাঁ কোনো দিনই কোনো সম্ভ্রান্ত ভারতীয়ের বাড়িতে ঢোকেনি, তাই সে নিজে মনে মনে তৈরি হতে লাগলো একটা নিখুঁত বিবরণ নেওয়ার জন্য। লুসিয়্যাঁ আমায় প্রশ্ন করলো—মিঃ সেনেরা কী জাত?
—ব্রাহ্মণ, তবে যতটা সম্ভব কম গোঁড়া। রোটারি ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা-সভ্য, ক্যালকাটা ক্লাবের সভ্য, চমৎকার টেনিস প্লেয়ার এবং নিজের গাড়ি অধিকাংশ সময় নিজেই চালিয়ে থাকেন। ব্রাহ্মণ হলেও মাংস খান; বাড়িতে অতিথি এলে, এমন কি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান হলেও স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না। আমি নিশ্চিত, মিঃ সেনকে তোর ভালো লাগবেই।
তবে একথা অবশ্যই স্বীকার করা উচিত যে ভবানীপুরে তাঁর বাড়ি আমি অফিসের প্রজেক্ট-প্ল্যান নিতে যাওয়ার সময় গাড়ি থেকে দেখলেও, বাড়ির ভেতরে যে জিনিস-পত্র আমি দেখলাম তা আমাকে লুসিয়্যাঁর চেয়ে কম বিস্মিত করেনি। দরজায় স্বচ্ছ পর্দা, নরম কার্পেটে ঢাকা মেঝে; কাশ্মিরী উলের কাপড় দিয়ে ঢাকা সোফা। সোফার পাশে ছোট ছোট একপায়াওয়ালা টেবিল। টেবিলে চায়ের কাপ আর এক ধরনের খাবার রাখা, যাকে ঠিক ‘কেক’ না বলে ‘পিঠে’ বলা ভালো, ভারতীয়রা তাই বলে থাকে বটে। মিঃ সেন নিজেই ওগুলো পছন্দ করেছেন যাতে তাঁর অতিথিকে তিনি স্থানীয় খাদ্য সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকিবহাল করতে পারেন।
আমি অবাক হয়ে ঘরটা দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন এইমাত্র ইউরোপ থেকে ভারতের মাটিতে পা দিলাম। দুটো বছর এদেশে কাটালেও আমার কখনও ইচ্ছা হয়নি। একটা বাঙালী পরিবারের অন্দর মহলের জীবনটা জানতে, এমন কি অভ্যন্তরীণ জীবনযাত্রা না হোক, তাদের শিল্পকর্মগুলো সম্পর্কেও বুঝতে বা তাদের সৌন্দর্য উপলদ্ধি করতে। এ যাবৎ ঔপনিবেশিক প্রভুর জীবনই যাপন করেছি অফিসে বা কোম্পানির কর্মক্ষেত্রে। কাজ নিয়ে ব্যস্ততা, অবসরে বই পড়া অথবা সেই সব প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে সময় কাটানো, যা আমার নিজের দেশেও এমন কিছু দুর্লভ বস্তু ছিল না। সে দিন বিকেলেই আমার মনে এই সব প্রশ্ন ভীড় করে এলো। লুসিয়্যাঁ অত্যন্ত উৎসাহভরে কোনো কোনো ব্যাপারে আমার মতামত চেয়ে নিজের অনুভূতি আর পর্যবেক্ষণের ফলশ্রুতি যাচাই করতে দেখছিল। মিঃ সেনের কথাবার্তা সে সঠিক বুঝতে পেরছে কিনা তা-ও যাচাই করছিল। আমি ক্রমশ চিন্তার ভীড়ে ডুবে যাচ্ছিলাম। সে সময়ে ডায়েরিতেও কিছু লিখিনি, তাই আজ বিস্তৃত বিবরণ দিতে পারছি না। সেদিন গোধূলিলগ্নে মৈত্রেয়ী আমার মনে কি ধরনের ছাপ ফেলেছিল। আজ ভাবতে খুবই অবাক লাগে, সেদিন সেই সব মানুষদের সম্পর্কে এতটুকু ধারণা করতে আমি কী করে সক্ষম হইনি যারা কিছুকাল পরেই আমার জীবনধারা সম্পূর্ণ ভাবে পাল্টে দেবে।
ফিকে চা-রঙের স্বচ্ছ শাড়ি, রূপোলী জরির কাজ করা চটি, গায়ে চেরী হলুদ রঙের শালে তাকে খুবই সুন্দরী মনে হচ্ছিল। তার কুঞ্চিত কালো কেশরাশি, গভীর কালো চোখ, আরক্তিম অধর, যৌবন- উদ্বেলিত শরীর দেখে মনে হচ্ছিল, তা যেন বাস্তব হয়েও পুরোপুরি বাস্তব নয়! অদম্য কৌতূহলী চোখ মেলে তাকে আমি দেখছিলাম। রেশমের মত লুঘু তার অঙ্গ সঞ্চালন, লজ্জাজড়িত, ভয়মিশ্রিত মৃদ হাসি, নতুন নতুন সরধ্বনিতে বেজে ওঠা কণ্ঠস্বর, সব কিছু দেখে শুনে মনে হচ্ছিল এই মহান সৃষ্টির মধ্যে কতই না রহস্য লুকিয়ে আছে। মৈত্রেয়ীর ইংরেজী ছিল বিশুদ্ধ কিন্তু স্কুল-ঘেঁষা। কিন্তু যতবারই সে মুখ খুলছিল, আমি আর লুসিয়্যাঁ তার দিকে না তাকিয়ে পারছিলাম না।
চায়ের স্বাদ ছিল আশাতীতভাবে উপাদেয়। প্রত্যেকটা খাবার চেখে দেখে লুসিয়্যাঁ সেগুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করে জ্ঞাতব্য তথ্য টুকে নিচ্ছিল। প্রশ্ন করছিল ভাঙা ইংরেজীতে। মিঃ সেন অবশ্য বলছিলেন যে তিনি ফরাসী বোঝেন, তাঁকে দুবার প্যারিসে কনফারেন্সে যোগদান করতে হয়েছে এবং তাঁর লাইব্রেরীতে কিছু ফরাসী উপন্যাসও আছে। লুসিয়্যাঁ তাঁকে অত্যন্ত চলতি ফরাসীতেও মাঝে মাঝে প্রশ্ন করেছিল। আর মিঃ সেন তার উত্তরে মৃদু হেসে ‘তা বটে, তা বটে’ গোছের উত্তর দিচ্ছিলেন আর আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন পরম পরিতৃপ্তির দৃষ্টিতে।
লুসিয়্যাঁ, হঠাৎ মৈত্রেয়ীর পোশাক আর অলঙ্কার কাছ থেকে দেখতে চেয়ে বসলো। মিঃ সেন সানন্দে রাজী হলেন, কিন্তু মৈত্রেয়ী ভয় পেয়ে জানালার দিকে সরে গেল। ভয়ে তার ঠোঁটটা তখন কাঁপছিল। লুসিয়্যাঁ ওর কাছে দিয়ে অলঙ্কারগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করে গভীর বিস্ময় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য প্রশ্ন করে চলেছিল আর উত্তরগুলো টুকে নিচ্ছিল। মৈত্রেয়ীর পা থেকে মাথা অবধি কাঁপছিল আর সে কোন দিকে যে তখন দৃষ্টি রাখবে তা বুঝতে পারছিল না। এক সময় তার চোখ আমার চোখের ওপর পড়লো। তার চোখে চোখ রেখে আমি মৃদু হেসে ইঙ্গিতে তাকে আশ্বস্ত করলাম। সে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এবং ক্রমশ শান্ত হয়ে এলো। মনে এলো যেন সে খুঁজে পেয়েছে তার নির্ভরতার বন্দর। কতক্ষণ যে তাকিয়েছিল তা বলতে পারবো না, কিন্তু এটুকু বলতে পারি, এ যাবৎ বিনিময় করা দৃষ্টির সঙ্গে সে দৃষ্টির কোনো মিল ছিল না। লুসিয়্যাঁর দেখা শেষ হলো। মৈত্রেয়ী তার জায়গায় ফিরে গেল, কিন্তু পরস্পরের দিকে তাকানো আমার সেই মুহূর্ত হয়ে রইলো অতি গোপন আর উষ্ণ এক অভিজ্ঞতা।
মৈত্রেয়ীর থেকে দৃষ্টি এড়াতে আমি তার বাবার দিকে মনোযোগ দিলাম। কিন্তু তাঁকে কেমন যেন নিষ্প্রভ আর ভাবলেশহীন মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। কাছ থেকে তাঁকে আমি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। প্রকাণ্ড একটা মুখে বড় বড় দুটো কুৎকুতে চোখ, কালো মাথাটা যেন একটা হাঁড়ির মতো নিচু কপাল, কালো কয়লার মত কোঁকড়ানো চুল, ঝোলা কাঁধ, বেঢপ ভুঁড়িওয়ালা পেট, বেঁটে পা, এই সব দেখে আমার একটা কোলা ব্যাঙের কথা মনে পড়লো। এই মানুষটার ভেতরেও যে স্নেহ, সহানুভূতির প্রাচুর্য আছে, তা বোঝাই দুষ্কর ছিল। তবুও মানুষটাকে আমার সম্মোহক, বুদ্ধিমান, দক্ষকর্মী, খোসমেজাজী, শান্ত আর সৎ মনে হলো।
এরকম সময় তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা দেবী এলেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হলো। কিন্তু কেন জানি না আমার মনে হোল মিসেস সেন যেন এক অকারণ ভয়ের ভাব নিয়ে এলেন। তাঁর পরনে ছিল নীল রঙের শাড়ি আর গায়ে ছিল সোনালী কাজ করা নীল শাল। তাঁর পায়ে কোনো জুতো ছিল না। পায়ের পাতা আর আঙুল ছিল আলতা রঞ্জিত। তিনি ইংরেজী প্রায় জানতেন না বললেই হয়, আর বোধ হয় সেজন্যই কথার বদলে মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর দিচ্ছিলেন। সেদিন বোধ হয় তিনি খুব পান খেয়ে ছিলেন, তাই তাঁর ঠোঁট ছিল রক্তিম। তাঁকে এত কম বয়সী, লজ্জাশীলা আর সজীব লাগছিল যে তাঁকে অনায়াসে মৈত্রেয়ীর মা না বলে বড় বোন হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেতো। তাঁর মেজো মেয়ে ছুবু সেই সময়ে ঘরে এলো। তাঁর বয়স আন্দাজ দশ-এগার হবে। চুল ছোট করে ছাঁটা, ইউরোপীয়ান পোশাক পরা কিন্তু পায়ে কোনো জুতো ছিল না।
তার নগ্ন পা, বাহু, সুন্দর কালচে মুখ, আমাদের দেশের বোহেমিয়ান মেয়েদের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল।
এরমধ্যে একটা অঘটন ঘটে গেল। তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে দুঃসাধ্য। ঘরের মধ্যে তিনটি মহিলা প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে, সবার মুখেই বাইরের লোকের সামনে দাঁড়ানোর জন্য এক ভয়ার্তভাব, আর মিঃ সেন তাদের স্বাভাবিক হতে আর কথা বলাবার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত। মিসেস সেন চা পরিবেশনের দায়িত্ব নিয়ে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই মত পাল্টে তিনি বড় মেয়েকে বললেন আমাদের চা দিতে। জানি না কার দোষে ঘটল অঘটন। হঠাৎ চায়ের পট উল্টে গিয়ে পড়লো লুসিয়্যাঁর প্যান্টের ওপর। গরম চায়ে ভিজে গেল তার প্যান্ট। তাকে সাহায্যের জন্য সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লো। মিঃ সেন তাঁর শান্ত ভাব হারিয়ে চিৎকার করে বাংলায় সবাইকে প্রচণ্ড বকাবকি করতে করলেন। লুসিয়্যাঁ ফরাসীতে কিছুই হয়নি বলে সবাইকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু কে তার ভাষা বুঝছে বা কথা শুনছে! মিঃ সেন ভাঙা ফরাসীতে লুসিয়্যাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে তাকে অন্য জায়গায় বসতে অনুরোধ করলেন। সোফার রেশমের ঢাকাটা বদলাবার জন্য মেয়েরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিঃ সেন ক্রমাগত তাদের বকেই যেতে লাগলেন। পক্ষান্তরে আমার আর লুসিয়্যাঁর অবস্থা হলো শোচনীয়। সে মুহূর্তে আমাদের যে কী করণীয়, আমরা তা বুঝতে পারছিলাম না। যদিও ফেরবার পথে লুসিয়্যাঁ ঘটনাটা নিয়ে দারুণ হাসাহাসি করছিল, কিন্তু ঘটনাটা ঘটবার সময় তার মুখ যা হয়েছিল তা দেখবার মতো। সে সময়ে একমাত্র মিসেস সেনকেই দেখেছিলাম অচঞ্চল।
কথাবার্তা আর বেশিক্ষণ জমেনি। মিঃ সেন লুসিয়্যাঁকে তাঁর কাকার কথা বললেন। তার কাকা ছিলেন সংস্কৃতে পণ্ডিত। সরকারি স্বীকৃতিও তাঁর ছিল। কাকার সংগ্রহের বহু প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি দেখালেন। আমরা ওঁদের পারিবারিক ছবির অ্যালবাম দেখলাম। পরে ওঁর সংগ্রহের প্রাচীন কিছু শিল্পনিদর্শনও উনি দেখালেন।
জানালার বাইরে বাড়ির উঠোনটা দেখা যাচ্ছিল। উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, ছোট ছোট পাতাবাহারি গাছ, লতানে গাছের ফুল। আরেক দিকে একটা তাল গাছ মাথা তুলে অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল। হাওয়ায় তার পাতা কাঁপছিল। এতদিন কলকাতায় আছি, কিন্তু এই নিস্তব্ধ অন্দর মহলের অভ্যন্তরে কোথা দিয়ে যেন এক আনন্দস্রোত বয়ে যাচ্ছিল তা আমার সম্পূর্ণ অজানা ছিল। বারান্দা দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে আসছি, এমন সময়ে হঠাৎ সেই স্তব্ধতা ভেঙে ভেসে এলো এক সম্মিলিত হাসির রোল। মহিলা-শিশু কণ্ঠের সেই হাসির আওয়াজ সরাসরি আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। শিহরণ এলো শরীরে, মনে। ফিরে তাকাতেই আমার চোখে পড়ল এক অদ্ভুত দৃশ্য। প্রায় বিবস্ত্র মৈত্রেয়ী উপুড় হয় পড়েছে উঠোনের সিঁড়ির ধাপে। চুলগুলো মুখের ওপর, হাত দুটো বুকের কাছে। হাসির দমকে তার শরীর কাঁপছে। হাসতে হাসতে সে গোড়ালির এক এক ঝটকায় পায়ের চটি ছুড়ে ফেলে দিচ্ছিল সামনের দেওয়ালের দিকে। তাকে ওই অবস্থায় দেখে আমার যেন আশ মিটছিল না। মনে হচ্ছিল সেই কয়েক মিনিট সময় অনন্তে পর্যবসিত হোক। তার হাসি, শৃঙ্খলমুক্ত দেহের বন্য আগুন, এসব দেখা উচিত ছিল কিনা আমি জানি না, তবে সে-জায়গা ছেড়ে নড়বার শক্তিও যেন আমার ছিল না।
অনেক ঘর পার হয়ে সদর দরজা অবধি আসার পরও উদ্দাম হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছিল।