৭
লড়াইটা চলেছিল প্রায় মিনিট পনেরো ধরে। ওর হাত দুটো আমার হাতের মধ্যে ধরে প্রচন্ড আবেগে চেপে ধরে প্রায় গুঁড়িয়ে ফেলার জোগাড় করেছিলাম। ও যখন হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্যে ধস্তাধস্তি করছিল, কাঁদছিল, মুখ বিকৃত করছিল, তখন ওকে অপূর্ব লাগছিল দেখতে। মনে মনে নিশ্চয়ই ও রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রার্থনা করছিল সাহায্যের জন্য। কিন্তু অবশেষে ও হার স্বীকার করলো। পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম ওর মধ্যে এক অদ্ভুত ধরনের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ছিল। যে আনন্দ ছিল বেদনা, শারীরিক সান্নিধ্যের উষ্ণতা, আর ওর ওপরে আমার জোর খাটানোর অধিকারবোধের সংমিশ্রণ।
আমি ওকে ওর শোবার ঘরের দিকে নিয়ে গেলাম।
—উঃ!—আমার হাত দুটো একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন।
আমি ওর হাত দুটো পরম স্নেহভরে তুলে নিলাম। হাত বুলিয়ে দিয়ে ওর হাত দুটো চুম্বনে ভরিয়ে দিলাম। ভারতে এটা একটা অচিন্তনীয় কাজ। যদি কেউ জানতে পারতো তাহলে বোধ হয় মৈত্রেয়ীকে খুন করে ফেলতো।
কিছুক্ষণ পরে ও নিঃশব্দে ঘরে এক গুচ্ছ ফুল ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেল।
.
একদিন অন্যান্যদের সঙ্গে সিনেমায় গিয়ে ও নিজে যেচেই আমার পাশে বসেছিল। অন্ধকার হল-এ ও আমায় বললো যে আমাদের নিজেদের ব্যাপারে একটা আলোচনা করা দরকার। আমি ওকে পরিস্কার জানিয়ে দিলাম যে এখন ঐ আলোচনার সময় নয়, কারণ এখানে আমরা আনন্দ করতে এসেছি। এখানে বসে ওইসব ভাবপ্রবণ আলোচনায় যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও আমার নেই। মৈত্রেয়ীর শান্তভাব চলে গেল এবং ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। কিন্তু আমার মনে সে জন্য একটুও চাঞ্চল্য আমি বোধ করিনি।
সিনেমা হল থেকে বেরিয়েও সে একইভাবে কেঁদে চললো। আমি থাকতে না পেরে বেশ চেঁচিয়েই বললাম, কি হচ্ছে মৈত্রেয়ী!
ওই দিনই সন্ধ্যাবেলা ও আবার আমার শোবার ঘরে এসে শালে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলো। কেন কাঁদছে, এ প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না। একটু পরেই অন্যান্যরা আমার ঘরে যখন উপস্থিত হলো তখন আবার হাসিতে ফেটে পড়লো।
মৈত্রেয়ীর কাছ থেকে কোনো কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আজ দেখলাম অনেকটাই শক্ত হয়ে উঠেছে। একবার মাত্র কান্নাকাটি হলো আজ। আজ আমারই কিন্তু খারাপ লাগছিল বেশি। আজকের কথাবার্তার সময় বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। শেষকালে আমি ওকে চলে যেতে অনুরোধ করলাম। ও চলে যেতেই বিছানায় আশ্রয় নিলাম। নিজেকে ভীষণ হাস্যকর লাগছিল। আমিই ওকে কথা দিয়েছিলাম আমাদের বন্ধুত্ব সম্পর্কে। আমি কী বোকা! নিজের কৌশল প্রয়োগ করতে গিয়ে একটার পর একটা মিথ্যা স্বীকার করে ওর চোখেই ছোট হয়ে গেছি। আমি অদ্ভুত আচরণ করেছি। ও ওর তরফে ঠিক শান্ত ব্যবহারই করেছিল। এই আবেগময় খেলার ফলে আমরা দুজনেই দুজনের কাছে ছোট হয়ে গেছি। ঠিক করলাম আমাদের এই খেলা শেষ করতে হবে। আবার আমাদের পুরনো বন্ধুত ফিরিয়ে আনতেই হবে।
হায়! যতটা মনে হয় সবকিছু এত সহজ নয়। আমি ওকে ভালোবাসি, ভয়ঙ্করভাবেই ভালোবাসি। আবার ওকে ভয়ও পাই। আমার প্রতি ওর অন্যায় ও স্বীকার করলো। মেঘ কেটে গেছে।
ভয় আর আনন্দ, এ দুয়ের সংমিশ্রণে আমার মধ্যে কী যে হয়ে চলেছে! নতুন নতুন সমস্যা আর চিন্তা। ভাবপ্রবণ, আবেগহীন গভীর প্রেম কি সম্ভব? আর, আমি ভাবপ্রবণ হই বা না হই তাতেই বা কী যায়-আসে?
আমার মন কি বিষিয়ে গেছে? আমি কি নিজের খেয়ালেরই দাস হয়ে পড়ছি? সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আমি ছিলাম একজন সুখী পুরুষ। আপ্লুত ছিলাম জীবনীশক্তির জোয়ারে; আবার নতুন করে বাঁচার প্রেরণায়। আমি মৈত্রেয়ীকে বলতে প্রস্তুত ছিলামঃ তুমি কি আমার স্ত্রী হতে চাও? আমি এখনও ওই কথা বলতে প্রস্তুত। ওর স্বামী হতে পারলে আমি সত্যিই সুখী হবো…ও এত পবিত্র…এত শান্ত।
আজ বিকেলে মৈত্রেয়ীর সঙ্গে বিয়ে নিয়ে আলোচনা হলো। কল্পনা করার চেষ্টা করলাম আমি ওকে বিয়ে করেছি। ও আমার স্ত্রী, আমি এই পরিবারের কর্তা! জীবন কি বিস্ময়কর! আমি তৃপ্তি চাই, আর চাই মানসিক শান্তি।
কিন্তু কিছুক্ষণ পরে মৈত্রেয়ী জানালো যে ওর মন খুব খারাপ। রবীন্দ্রনাথ ওকে কোনো চিঠি দেননি। রবীন্দ্রনাথ ওর গুরু, বন্ধু, আদর্শ এবং ভগবান। ও বললো ওদের যোগাযোগ সবাই ভালো চোখে দেখে। একেবারে ‘খাঁটি বাঙালী ভক্তি’। কিন্তু আমার কি ঈর্ষা হচ্ছে? পরোক্ষভাবে আমি ওকে অনেক গোপন প্রেমের কথা বলেছি। ও যখন সব জানে, ঠিক করেছি ওকে বলে দেবো আমাদের এই প্রেমেরও কোনো পরিণতি নেই।
আমি কখনই এমন কাউকে বিয়ে করতে পারবো না যে আগে অন্য কারো সঙ্গে প্রেম করেছে।
আমার যে রাগ হয়েছে তা ও বেশ বুঝতে পেরেছে। রাতের খাওয়ার পর আমাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। এক লাইন লিখে জানিয়েছিল যে আমি ওকে অপমান করেছি। আমি কোনো উত্তর দিইনি।
অপ্রত্যাশিত ঘটনা! কখনও রাগ হয়, আবার আনন্দও হয়। প্রেম বিষের মতো! বিয়ের স্বপ দেখি। আমার সন্তানদের মানসচক্ষে দেখতে পাই। সমস্ত সময় নষ্ট করছি। আমার পক্ষে বাস্তবিকই মনঃস্থির করা শক্ত। আমার আসক্তি আমি ত্যাগ করতে চাই না।
রাত্রিতে ভূমিকম্প হলো। আমার জ্বর ছাড়েনি। সকালে মৈত্রেয়ীকে একটা দামী উপহার দিলাম। প্রচণ্ড মানসিক চাপের দিন। এই দিনের সম্পর্ক বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মৈত্রেয়ী আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে চেয়েছিল। আমায় জিজ্ঞাসা করলো, ব্যাপারটা আমি কোথায় নিয়ে যেতে চাই। ওকে সান্ত্বনা দিতে আমি নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে চললাম। ওর সঙ্গে আপোষ করার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল।
মন্টু, খোকা, সবাই লক্ষ্য করছিল। আমি একটি কথাও বলিনি। ও যদি অপমানিত বোধ করে থাকে তার জন্য আমি দুঃখিত, কিন্তু খুব দৃঢ়তার সঙ্গে আমার নিজের মনটাকে শক্ত করে রাখতে পেরেছি।
খোকা ঠিক সেই সময় আমার ঘরের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল এবং সবই শুনতে পাচ্ছিল। হতাশ হবার ভঙ্গি নিয়ে মৈত্রেয়ী কাঁদছিল। একটা কাগজের ধারে লিখেছিল—ও মরতে চায়। খোকা যা শুনতে পেয়েছিল, একজন ভারতীয় নারীর পক্ষে তা ছিল যথেষ্ট অসম্মানের।
অবশেষে ও শান্ত হলো। আমার ঘর গুছিয়ে দিলো। টেবিলের ওপর ফুলদানিতে ফুল এনে রাখলো। আমি একটাও কথা বলিনি।
অবাস্তব বিশ্বাস এবং মরীচিকার ওপর একটা কবিতার বই লিখছে মৈত্রেয়ী।
ইওরোপে যুবতীরা কি ধরনের স্বাধীনতা ভোগ করে সে সম্পর্কে আজ বললাম ওকে। আমার কৌমার্য এখনও আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলো এবং তা নেই ধরে নিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। দৈহিক শুদ্ধতা নিয়ে ওর এই রহস্যজনক গোঁড়ামি দেখে বিচলিত হলাম।
সন্ধ্যাবেলা আলোচনা আবার সেই এক বিষয়েই এসে দাঁড়ালো—ওর বিয়ে। ওর দৃঢ় বিশ্বাস অন্য যেখানেই ওর বিয়ে হোক না কেন ও অসুখী হবেই। আমি বললাম যে আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ হলো বোধ হয় শ্বেতকায় হয়ে জন্মানো। যদি ভারতীয় হয়ে জন্মাতাম খুব ভাল হতো। আমার এই কথায় ও খুবই বিচলিত হয়ে পড়লো। আমি ভয়ঙ্কর একটা প্রশ্ন করে বসলামঃ আমাদের বিয়ে হতে পারে না কেন?
ও খানিকক্ষণ প্রস্তর-মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে রইল, তারপর আমাদের কথা কেউ শুনে ফেলছে কিনা দেখার জন্য ও ব্যস্ত হয়ে উঠলো। পরে উত্তর দিলো, ভাগ্য বা বিধাতা এইভাবেই আমাদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ভাগ্য বা বিধাতা কেন, গোঁড়া কুসংস্কারই কি এর জন্য একমাত্র দায়ী নয়? ওর উত্তর ছিল, বিধাতা এইসব সংস্কারের মধ্য দিয়েই তাঁর ইচ্ছা পূরণ করেন। আর আমার প্রেম নাকি ক্ষণিকের মোহ।
প্রকৃতপক্ষে এই প্রেম, যা প্রথম আমার অসম্ভব ভাবাবেগের নিদর্শন বা শিশুসুলভ খেয়ালীপনা বলে মনে হতো, তা মৈত্রেয়ীর মনোভাবের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে আমার আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল, টেনে নিয়ে গিয়েছিল অনেক দূর অবধি—প্রায় আমার বুদ্ধির অতীত এ কল্পনার জগতে, যেখানে থেকে নিজেকে আমায় সুখী, পরিপূর্ণ সুখী বলে মনে হতো। জানি না কি ভাবে এর ব্যাখ্যা দেবো।
অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমি বিয়ের কথা চিন্তা করছি।
ওর দেখা পাওয়া দুরূহ হয়ে উঠছে। ও সব সময়ই শোবার ঘরে। হয় লিখছে, নয় গান গাইছে। আমি লীলু মারফৎ কয়েকটা নির্দোষ প্রেমপত্র পাঠালাম, কিন্তু ও কোনো উত্তরই দিলো না। প্রথম রাত্রে খুবই কষ্ট হলো। অনেক কিছু ভাবলাম। দ্বিতীয় দিনেও যে ভাবনা ছিল না তা নয়। তারপর এখন আর কিছুই হচ্ছে না। ভাবছি মৈত্রেয়ী ছাড়া বাঁচা এমন কিছু কঠিন নয়।