১২
আমার মনে হচ্ছিল, সব কিছুই জানাজানি হয়ে গেছে। বিছানায় পড়ে নিজের সঙ্গে সংগ্রাম করছিলাম, কিন্তু কিছুতেই চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না। দুপুরের দিকে মৈত্রেয়ী এলো। আমাকে না ডেকেই দরজার তলা দিয়ে একটুকরো কাগজ ঢুকিয়ে দিলোঃ ‘মা কিছু জানে না। কষ্ট পেয়ো না। আমি তোমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি’। আমার মনে হয়েছিল ও আমাকে ক্ষমা করেছে অথবা আমার শাস্তিটা স্থগিত রেখেছে। আমি মৈত্রেয়ীকে একটা লম্বা চিঠি লিখেছিলামঃ ‘রাত্রে আমাদের সাক্ষাৎ বন্ধ করা উচিত ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এবং ছবুর অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনা করে’। সত্যি বলতে কি, আমি জানতাম না কী করে আমাদেরএই যোগাযোগ ইতি টানবো।
একদিন মৈত্রেয়ী ওর মাকে বলেছিল যে আমি ওর এক বন্ধুর সঙ্গে প্রেম করছি এবং তাকে বিয়ে করার কথা বলতে আমার অস্বস্তি হচ্ছে। মিসেস সেন উত্তর দিয়েছিলেন যে, এই ধরনের সঙ্গের ফল হলো শুধু মানসিক উত্তেজনা আর দুঃখেই এর সমাপ্তি। ট্রাডিশন অনুযায়ী বা সংসারের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী যা হয় না, সেই কামনার মধ্যে কোনোদিন স্থায়িত্ব এবং আনন্দ জন্ম নেয় না। যারা ভালোবাসা এবং বিবাহের গভীরতা বোঝে না, তাদের পক্ষে এগুলো হঠকারিতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমরা অল্পবয়স্করা যা কল্পনা করি, বাস্তব তার চাইতে অনেক বেশি রূঢ়। বিয়ের অর্থ এই নয় যে সেটা ‘একত্রে ফুল তোলা’ এবং বিয়ের ব্যাপারে কখনোই ক্ষণস্থায়ী ও প্রতারণাপূর্ণ আবেগের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।
স্বীকার করছি, এই সমালোচনা থেকে মেনে নিয়েছিলাম যে আমাদের ভালোবাসা ছিল শুধু আবেগ-তাড়িত এবং আমরা কখনই পরস্পরের স্বপ্ন ছাড়া অন্য কারো কথাই ভাবিনি। মিসেস সেন আরও যোগ করেছিলেন যে বিবাহের ভিত্তি কখনই শুধু ভালোবাসা নয়। তার ভিত্তি হলো স্বাৰ্থত্যাগ, আত্মত্যাগ, আর ভাগ্যের কাছে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া। ভারতবর্ষকে আমি ভালোবাসলেও, ওঁকে শ্রদ্ধা করলেও,এই ধারণা আমি গ্রহণ করতে পারিনি।
বুঝতে পারছিলাম যেদিন আমি মৈত্রেয়ীকে বিয়ে করতে চাইবো, সেদিন কোন অনতিক্রম্য বাধা জেগে উঠবেই আমার সামনে। চিন্তা করলাম, মৈত্রেয়ী যে সমাধান পছন্দ করেছে অর্থাৎ ওকে নিয়ে চলে যাওয়া, তা আদৌ ফলপ্রসূ হবে কিনা। ওর মা-বাবা দেখবেন চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একটা ব্যাপার। সুতরাং তখন আমাকে মেনে নিতে বাধ্য হবেন জামাই হিসেবে, যদিও অন্যরা কখনই মানতে পারবেন না। আজ আমি খুব অল্পই বুঝি এর জন্য কতখানি দরকার ছিল মৈত্রেয়ীর সক্রিয় ভূমিকা।
দিন চলে যাচ্ছিল একইভাবে, ভয় আর বিপজ্জনক ঝুঁকি নিয়ে। আমি আমার পারিপার্শ্বিক সব ব্যাপারেই কখনই অবসর পেতাম না চিন্তা করার বা দৃশ্যগুলোকে খুঁটিয়ে মনে রাখার। আমার সেই সময়ের লেখাগুলো এতই এলোমেলো খাপছাড়া ভাসাভাসা যে পড়লে মনে হয় তা যেন অন্য কোনো লোকের জীবন-কাহিনী।
সেই যন্ত্রণাদায়ক দিনগুলোর মধ্যেই একদিন এলো মৈত্রেয়ীর জন্মদিন,১৫ই অক্টোবর। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব চাইছিলেন যতটা সম্ভব জমকালো করে এই জন্ম দিনটি পালন করতে যদিও তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং হুবু চিন্তাশক্তি হীন অবস্থায় পড়ে ছিল। মৈত্রেয়ী ওর ১৭ বছর পূর্ণ করলো। আমি জানি না কী অর্থ লুকিয়ে থাকে ভারতীয়দের কছে এই বয়সটার। ওর লেখা বই উদ্ধিতা ছাপানো হয়েছিল কয়েকদিন আগে। সমালোচকরা বইটাকে সহানুভূতির সঙ্গে নিয়েছিলেন এবং নরেন্দ্র সেন নিমন্ত্রণ করেছিলেন কথাশিল্প এবং অন্যান্য চারুশিল্পের সব নামজাদা লোকেদের। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া, যত লোকে বাংলাদেশ চেনে এবং ইওরোপে যারা পরিচিত তাঁরা প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন শ্রীকান্ত এর লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং নৃত্য শিল্পী উদয়শংকর ওঁর মুগ্ধকর ছন্দ, ঈশ্বরীয় সৌন্দর্য আমাকে অনেকদিন ধরে আবেগ-মথিত করে রেখেছিল। আগষ্ট মাসের এক অনুষ্ঠানে ওঁকে দেখে মৈত্রেয়ী আমার কথা একদম ভুলে গিয়েছিল কয়েকিদিন ধরে। অনেকদিন ধরে শুধু ওঁর কথাই বলেছিল মৈত্রেয়ী। ও চাইতো ওঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে, শিখতে ‘নৃত্যের গোপন কথা”। ও অপেক্ষা করতো ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ নামক ম্যাগাজিনের সব রচনাগুলোর জন্য। তাতে ছাপা হতো অনেক শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তির রচনা, যেমন অচিন্ত্যবাবু,এক মৌলিক ও বহু আলোচিত কবি।
উৎসবের প্রস্তুতি দেখে আমি একটু আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। আমি জানতাম যে ঐদিন মৈত্রেয়ীকে একটুও কাছে পাবো না ও আমার অধিকারে থাকবে না এবং ওর অহংকার ও প্রভাব দেখিয়ে ও সব অতিথিদের মুগ্ধ করার চেষ্টা করবে। আমি কিছু বই কিনেছিলাম ওকে সকালেই দেবো বলে। প্রস্তুতি পর্বের দরুন ও খুব কমই বিশ্রাম নিতে পেরেছিল আগের দিন। রাত্রে সিঁড়ির ধাপগুলো ও দেওয়ালগুলো পুরনো কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। গদির ওপর চাদর দিয়ে পরিষ্কার করে ফরাস সাজানো হয়েছিল, যার ওপর অতিথিরা খালি পায়ে এসে বসবেন। সব মেয়েরাই প্রচণ্ড রকম পরিশ্রম করেছিল পুরনো চিত্র দিয়ে সিঁড়ি সাজাতে গিয়ে মৈত্রেয়ী কবির একটা চমৎকার প্রতিকৃতি আকস্মিকভাবে ফেলে দিয়েছিল, যে চিত্র রবীন্দ্রনাথ নিজেই ওকে উৎসর্গ করেছিলেন। ঘটনাটা মৈত্রেয়ীকে খুবই কষ্ট দিয়েছিল ও এর মধ্যে একটা অশুভ পূর্বলক্ষণ দেখতে পেয়েছিল। চিত্রের ফ্রেমটা টুকরোয় পরিণত হয়েছিল, ক্যানবাসটা ছিড়ে গিয়েছিল।
ভোরবেলা মৈত্রেয়ীকে দেখতে পেলাম লাইব্রেরিতে। আমি ওকে বইগুলো দিলাম, নিষ্পাপ, উৎসর্গতার সঙ্গে। ওকে জড়িয়ে ধরে প্রার্থনা করলাম ওর জন্য একটা শান্ত জীবন আর সফল সৌভাগ্য, যা ওর প্রাপ্য। এইসব গতানুগতিক কথা বলার সময়ে আমার চোখ জলে ভরে উঠেছিল। ওকে দেখাচ্ছিল অন্যমনস্ক। অন্য দিনের চাইতে সেদিন অনেক বেশি হাল্কাভাবে ও আমার বাহুর মধ্য থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
বিকেলের দিকে আমি সিল্কের তৈরি বাঙালী পোশাক পরেছিলাম এবং সব নামী-দামী ব্যক্তিদের নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলাম। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তাঁর আরামকেদারায় ঠায় বসে ছিলেন। সব নিমন্ত্রিতেরা বসেছিলেন সেই গদির ওপর। মিসেস সেন এবং নিমন্ত্রিত মহিলা পাশের ঘরে ছিলেন। মন্টু ছিল একতলার করিডরে, নতুন অতিথিদের গাইডের কাজ করছিল।
বাড়ির মেয়েদের মধ্যে মৈত্রেয়ীই একা আমাদের ঘরে এসেছিল তার “উদ্ধিতাঃ-এর কপি বিলি করবার জন্য এবং বয়ে নিয়ে এসেছিল তার নম্র স্নিগ্ধতা। মৈত্রেয়ীকে মলিন দেখালেও প্রশংসনীয় আর আকর্ষণীয় ছিল ওর চেহারার স্বাভাবিক মাধুর্য, নীল সিল্কের শাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা তার সেই নগ বাহু দুটো…আঃ! আমি ভিতরে ভিতরে যন্ত্রণা বোধ করছিলাম। কেউ জানতো না আমার কী অবস্থা হয়েছিল। সুন্দর সুঠাম দেহ উদয়শঙ্কর এসে উপস্থিত হলেন। পর্দার থেকে সামনাসামনি দেখতে ওঁকে কতটা সুন্দর লাগছিল না। উনি ছিলেন আমার জানা সবচাইতে মনোমুগ্ধকর মানুষ। ওঁর শরীরটা ছিল পুরুষোচিত, কিন্তু আশ্চর্যরকম স্থিতিস্থাপক। ওঁর চালচলনে, দেখার মধ্যে একটা নারীসুলভ কমনীয়তা ছিল, কিন্তু তা কোনো ভাবেই তাঁকে অসুন্দর করছিল না। মৈত্রেয়ী ওঁকে দেখে লাল হয়ে উঠলো। ওঁকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করলো। অতিথিরা এমনভাবে ওঁর চারপাশ ঘিরেছিলেন যে উনি একগালও খেতে পারছিলেন না। আমার কষ্ট আমি লুকোনোর চেষ্টা করলাম। এই নৃত্যশিল্পীর মধ্যে একটা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব থেকেও বেশি ছিল বিশালতা। আমি অনুভব করেছিলাম যে ওঁর মধ্যে এমন একটা জাদুশক্তি আছে যা সবারই মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে এবং শুধু অনুরাগী মৈত্রেয়ীই নয় যে সহজেই অভিভূত হয়ে পড়েছিল। আমার এঁকে অপছন্দ হয়নি। আমার ইচ্ছা করছিল ওঁর প্রতি মৈত্রেয়ীর গুরুত্ব দেওয়াটাকে বোঝার চেষ্টা করা। তাহলে এক লহমায় আমি আমার ভালোবাসা ফিরিয়ে নেবো। আমার সমস্ত আসক্তি সেই মুহূর্তে লোপ পাবে যখন আমি দেখবো আমার জায়গা অধিকার করেছে আর এক ব্যক্তি। যদি মৈত্রেয়ী উদয়শঙ্করের ঐ জাদুশক্তির বিরুদ্ধে না দাঁড়াতে পারে, তাহলে পরিত্যজ্য হওয়াই ওর প্রাপ্য।
আমি মরমে মরে গেলাম যখন এক ঝলকে দেখলাম মৈত্রেয়ী করিডরে উদয়শঙ্করের কাছে বসে ভয়ে ভয়ে কিছু প্রশ্ন করছে, যেটা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম কী শান্ত হয়ে আমি ঐ দৃশ্যটা সহ্য করছিলাম। কিছুক্ষণ পরে সিঁড়িতে আমি মৈত্রেয়ীর সামনাসামনি হলাম। ও লুকিয়ে আমার বাহু ধরে বললো; নাচের গোপন কথা আমি উদয়শঙ্করের কাছ থেকে শেখবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু উনি আমাকে কিছুই ব্যক্ত করতে পারলেন না। এটা একটা বিরাট বোকামি। উনি নাকি ছন্দ বোঝেন না। যখন উনি কথা বলেন তখন মনে হয় উনি যেন বই থেকে পড়ে যাচ্ছেন। ভালো করতাম যদি ওঁকে নিমন্ত্রণ না করতাম। অনুষ্ঠানে উনি নেচে ছিলেন ঈশ্বরীয় ঢঙে। পরে যখন আমি ওঁকে প্রশ্ন করলাম উনি শুধু অস্পষ্টভাবেই কী সব বললেন, যেন একটা স্কুল কারিগর, মেক্যানিক্যাল। এটা কি সম্ভব যে নৃত্য ওঁকে বোধ বা উপলব্ধি দেয়নি?
আমি জানতাম না মৈত্রেয়ীর এই কথাগুলোর জন্য আমি ওকে কিভাবে ধন্যবাদ দেবো। ও আমাকে লাইব্রেরিতে নিয়ে গেল এবং আমার হাত ধরে আকুল হয়ে বললো-আমি তোমায় পছন্দ করি অ্যালেন, আমি তোমায় সবার চাইতে বেশি পছন্দ করি।
আমার ইচ্ছে করছিল ওকে সজোরে জড়িয়ে ধরি কিন্তু হঠাৎই এক চিৎকার শুনতে পেলাম। আমরা দৌড়ে ওপরে গেলাম। মিসেস সেন ওঁর মেয়েকে ডাকছিলেন এবং অন্য মেয়েরা ভয়ে চিৎকার করছিল। ভয়ংকর ভয়ে আমরা দুজনে দৌড়ে গেলাম যেন একটা সর্বনাশ অনুভব করছিলাম। আমরা দেখলাম ছবু বারান্দা থেকে রাস্তায় ঝাঁপ দিতে যাচ্ছে। মেয়েরা চেষ্টা করছিল ওকে ধরে রাখবার। এই উৎসবের দিনে বলতে গেলে হুবু একাই ছিল ওর ঘরে। ও ওর সুন্দর একটা শাড়ি পরে ছিল-সাধারণত ও ছোট স্কার্ট পরতো। শাড়ি পরে ওকে আরও বয়স্কা দেখাচ্ছিল। ওকে সামনে রাখা হয়েছিল অনুষ্ঠান দেখবার জন্য। কিন্তু করিডরে প্রথম পদক্ষেপেই ও অত লোকজন দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল এবং বারান্দায় চলে গিয়েছিল, যেখানে উদয়শঙ্কর কয়েক মিনিট আগেই উপস্থিত ছিলেন। বারান্দায় গিয়ে ওর অভ্যাসমত গান গাইতে গাইতে হঠাৎ ও রাস্তার দিকে ঝুঁকে ছিল। দুজন মহিলা ওকে দেখতে পেয়েছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে যখন ও রেলিং এর ওপর উঠে পড়েছিল এবং লাফ দিতে যাচ্ছিল। ও ভীষণভাবে হাত-পা ছুঁড়ছিল। করিডরে লোক ভর্তি হয়ে গিয়েছিল এবং ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তাঁর শান্ত ভাব হারিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে ভীষণভাবে ঝগড়া করছিলেন। আমি ছবুকে কোলে করে ওর ঘরে নিয়ে গেলাম। ও সঙ্গে সঙ্গে আমাকে চিনতে পারলো এবং আমার বুকের উপর জড়িয়ে রইল। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো-অ্যালেন! অ্যালেন। আমি ওকে বিছানার ওপর বসিয়ে দিলাম। মলিন মুখে ও হঠাৎ আমাকে বললো-মৈত্রেয়ী কোথায়? ওরা ওকে বেচতে চায়?
উৎসবের পরের দিন প্রচুর কথাবার্তা আর প্রচুর খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই ক্লান্ত। মৈত্রেয়ী অনেক উপহার পেয়েছিল, বিশেষ করে বই। উৎসবের দিনই সকালে কেউ একজন একটা বিরাট ফুলের তোড়ার সঙ্গে একটা খাম পাঠিয়েছিল। ও হাতের লেখাটা দেখে কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। তাড়াতাড়ি চিঠিটা পড়ে ফেললো, ও অবাক হয়ে গিয়ে ভয় পেয়ে গেল। তখনই সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ শুনে তাড়াতাড়ি আমার ঘরে এসে ঢুকলো। খামটা আমাকে দিয়ে লাল হয়ে গিয়ে বললো—এটা তোমার অফিসে লুকিয়ে রেখো, লক্ষ্য রেখো যেন কেউ এটা না দেখে ফেলে। তোমার কাছ থেকে পরে চেয়ে নেবো।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। উদ্বিগ্ন হবার মতো কোনো কারণও খুঁজে পেলাম না। আমার কাছে একটা বাংলা চিঠি রেখে গেল যা আমি পারতাম শুধু ছিঁড়ে ফেলতে অথবা কোনো বন্ধুকে অনুবাদ করার কথা বলতে। এখনও আমার কাছে চিঠিটা আছে। আমার কখনই ওটা পড়বার সাহস হয়নি। প্রায়ই আমি ভাবি নিশ্চয়ই ওর কোনো ভক্ত ওকে পাঠিয়েছিল ঐ ফুলের তোড়া, কিন্তু কেন মৈত্রেয়ী মিথ্যে করে ওর মাকে বলেছিল যে ওটা এসেছিল ওর স্কুলের এক বন্ধুর কাছ থেকে, যে এই উৎসবে যোগ দিতে পারেনি…।
দিন এবং রাত্রিগুলো একঘেয়ে ভাবে কেটে যেতে লাগল। উৎসবের প্রায় এক সপ্তাহ পরে এক ঝড় উঠলো সেই শেষের সময়টার খুঁটিনাটি সব কিছু আমার মনে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু আমার ডায়েরির পাতায় আমি শুধু আমার জীবনের সার সংক্ষেপটুকুই খুঁজে পাচ্ছি। অবশ্য সেই সারাংশে কিছু কম ব্যক্তির কথা আলোচনা করা হয়নি। এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার যে আমি তখন, কখনোই আমার অদূর-ভবিষ্যতের কথা ভাবিনি।
রোজ সন্ধ্যায় আমরা লেকে যেতাম এবং প্রায়ই ছবুকে নিয়ে যেতাম সঙ্গে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজেই আমাদের উৎসাহ দিতেন আমাদের বিনোদনের জন্য। আমাদের শেষের এই সপ্তাহগুলো কাটাচ্ছিলাম এক অসুস্থ ব্যক্তির বিছানার পাশে, মানসিক আলোড়নের মধ্যে। এই সত্যিই যে মৈত্রেয়ী দুর্বল হয়ে পড়ছিল। সেই ১৫ই অক্টোবরের চিৎকারের ঘটনার পর ছবু শান্ত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তব অতদিন ঘরের মধ্যে কাটানোর পর ওরও দরকার ছিল বাইরে বেরোবার। প্রত্যেকদিন গোধূলি লগ্নে আমরা যেতাম আর ফিরতাম রাত্রি নটা-দশটায়। ছবু প্রায় কথাই বলতো না এবং সাধারণত জলের একেবারে ধারে বসে থাকতো, হয় গান গাইতো, অথবা কাঁদতো,-দৃষ্টি থাকতো স্থির। আমরা ওর কাছাকাছিই থাকতাম। আর নিজেরা বকবক করতাম। লুকিয়ে দুজনে দুজনকে আলিঙ্গন করে চুম্বন করতাম। যেন আচ্ছন্ন হয়ে মৈত্রেয়ী তখন বলতো, একদিন তুমি আমাকে নিয়ে যাবে। আমাকে সারা পৃথিবী ঘুরিয়ে দেখাবে।
ও আন্তরিকভাবে পালিয়ে যাবার কথা ভাবতো, বিশেষ করে ওকে যখন শোনালাম যে ব্যাঙ্কে আমার যথেষ্ট টাকা গচ্ছিত আছে। আমার মাসিক চারশো টাকা মাইনের প্রায় কিছুই খরচ হতো না।
একদিন সন্ধ্যাবেলা সেদিন ছিল ২৫শে অক্টোবর, লেকেই ছবু খুব অসুস্থ বোধ করতে লাগলো। ওকে ধরে পাড়ের ওপর শুইয়ে দিলাম। আমরা ওর কাছেই বসে রইলাম এবং ওর সঙ্গে কথা বলতে থাকলাম হালকাভাবে, চেষ্টা করতে থাকলাম ওকে হাসাতে। কিছুদিন ধরেই ও অকারণে হাসছিল এবং ডাক্তারদের মতে ওর ঐ হাসিখুশিভাব ছিল ভালো লক্ষণ।
হঠাৎ ছবু ওর দিদিকে প্রশ্ন করলো-কেন তুমি অ্যালেনকে ভালোবাসো না?
আমাদের হাসি পেলো। ছবু প্রায়ই এরকম অর্থহীন কথা বলতো এবং আমরা ওকে ভয় পেতাম না।
-ওকে তো আমি দারুণ পছন্দ করি! —হাসতে হাসতে বললো মৈত্ৰেয়ী।
—যদি তুমি পছন্দ করো তাহলে ওকে আদর করো।
মৈত্রেয়ী আরো জোরে হাসতে লাগলো এবং বললো যে ওর মতন একটা বুদ্ধিমতী মেয়ের কখনই এমন বোকার মতন কথা বলা উচিত নয়।
—ভালোবাসা বোকামি নয়। —ছবু আন্তরিকভাবে কথাটা বললো-যাও ওকে আদর করো। ঠিক আছে, দেখো আমি কেমন করে আদর করছি।
হবু উঠে এসে আমাকে এক গালে চুমু খেয়ে আদর করলো। হাসতে হাসতে মৈত্রেয়ীও আমাকে আদর করলো আর এক গালে।
-এখন তুই খুশি তো?—জিজ্ঞাসা করলো মৈত্ৰেয়ী।
-তোর তো আদর করা উচিত ঠোঁটে।
-বুঝে সুঝে কথা বল।—জোরেই বলে উঠলো লাল হয়ে যাওয়া মৈত্রেয়ী।
আমি খুশি হয়েছিলাম এই দেখে যে আমার ছোট্ট বোন ছবু, যাকে এত পছন্দ করতাম, সে ঠিক বুঝতে পেরেছিল আমাদের ভালোবাসা। আমি মৈত্রেয়ীকে অনুরোধ করলাম আমার ঠোটের উপর চুম খেতে। ও চাইলো না। তখন যথেষ্ট ঠান্ডা। মৈত্রেয়ীর গায়ে শাল ছিল। আমি জানতাম কীভাবে ওকে উত্তেজিত করে বাধ্য করা যায়। শালের তলা দিয়ে আমার হাত ওর বাঁ দিকের বুক স্পর্শ করলো। আমার দুঃসাহসী আঙুলের তলায় ওর হৃদস্পন্দন অনুভব করতে পারছিলাম। মৈত্রেয়ী এই সোহাগের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে আমার বুকের উপর তক্ষুণি আছড়ে পড়লো। হুবু এলোমেলোভাবে দিদিকে জড়িয়ে ধরতে গেল। ছবুর হাত আমার হাতে ঠেকে গেল। আমি চেয়েছিলাম ওর অজান্তেই যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি হাতটা সরিয়ে আনবো। ও হাসতে আরম্ভ করলো এবং জোরে চেঁচিয়ে উঠলো উল্লসিত হয়ে।
—দেখলি, অ্যালেনের হাত কোথায় ছিল?
-বোকার মতন কথা বলিস না। ওটা আমার হাত। শুকনো গলায় বললো মৈত্রেয়ী।
—আমি যেন জানতাম না। আমি যেন বুঝতে পারিনি অ্যালেনের আংটিটা…
ছবুর মুখে রূঢ় সত্য আমাকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করে তুললেও, যেহেতু ছবু প্রায়ই এরকম উল্টোপাল্টা বলতো, আমি ভাবতে পারিনি যে এই ঘটনা পরে গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে।
মৈত্রেয়ী আমার ঠোটে চুমু খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছিল। তখন রাত্রি হয়ে গেছে, আমরা তাড়াতাড়ি গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। বাড়ি পৌঁছনোর আগেই আমরা সবকিছু ভুলে গেলাম।
সেই রাত্রে মৈত্রেয়ী আমার ঘরে আসেনি। আমি জানি না পরের সারাটা দিন কিভাবে কেটে গিয়েছিল। সন্ধ্যে ছটায় আমি বাঙালী পোশাক পরে লেকে যাবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। কিন্তু কেউ আমায় খুঁজতে এলো না। একটা সাহস নিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম আমরা আজকে সন্ধ্যায় বার হবো কিনা। ও উত্তর দিলো এমন একটা কন্ঠস্বরে যা আমার কাছে মনে হলো উদ্ধত। এই ধরনের কন্ঠস্বর হয়ত ওর ছিল না। ওকে হুকুম দেওয়া হয়েছিল যে গাড়ি যেন গ্যারাজ করে দেওয়া হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই খোকার সঙ্গে দেখা হলো করিডরে। ও আমাকে বললো যে মিসেস সেন মৈত্রেয়ী, ছবু কাউকেই অনুমতি দেননি লেকে যাবার। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এক রহস্য আমাকে ঘিরে ধরছে। এই রহস্য ভেদ করা দরকার। আমি মৈত্রেয়ীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম কিন্তু সফল হলাম না। উদ্বেগ এবং যন্ত্রণা নিয়ে ঘরেই বসে রইলাম।
রাতের খাবারের জন্য বাড়ির লোকরা ডাকতে আসতেন। আজ আর কেউ এলেন না। ডাকতে এলো বাড়ির চাকর। টেবিলে দেখলাম শুধু মিসেস সেন আর মৈত্রেয়ী। তাঁরা কেউ কোনো কথা বললেন না। আমি শান্ত থাকতেই চেয়েছিলাম এবং মনে হয় তাতে দারুণভাবে সফলও হয়েছিলাম। মিসেস সেন আমাকে সোজাসুজি দেখার চেষ্টা করছিলেন। আমি ওঁর স্থির এবং অনুসন্ধানী দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারছিলাম না। সে দৃষ্টি আমার হৃদয় ভেদ করে যাচ্ছিল। ওঁর মুখে লেগেছিল এক ধরনের আশ্চর্যজনক একাগ্রতা এবং ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি! ঠোঁট দুটো পান খেয়ে লাল; যেমন সাধারণত থাকতো। উনি খুব নম্র এবং চুপচাপ ভাবেই আমাকে দেখছিলেন। তারপর একবার ঘুরে এসে নতুন করে বসে, কনুই দুটো টেবিলের উপর ভর দিয়ে আমায় পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। হয়তো উনি মনে মনে ভাবছিলেন, সম্মান এবং সচ্চরিত্রতার ভানের তলায় তলায় কেমন করে ওঁকে আমি এতদিন ধরে ঠকিয়ে আসছিলাম। ওঁর উগ্র ও শ্লেষপূর্ণ ভাবগতিকের মধ্যে আমি ভাবছিলাম উনি মনে মনে বোধ হয় প্রশ্ন করছিলেন কেমন করে আমি ‘এমন কাজ’ করলাম? আমি জানতাম না ‘এমন কাজ’ বলতে মিসেস সেনের মতে কী বোঝায়। কিন্তু উনি যে এই প্রশ্নই করতে চাইছেন সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম এবং ভাব দেখাচ্ছিলাম যে আমি মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যেই আছি। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তাকিয়েছিলাম সোজাসুজি, জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেমন আছেন উনি, কেন আর কেউ রাতের খাবার খেতে আসেননি, ইত্যাদি।
মৈত্রেয়ী টেবিলের তলায় নিজের পা দিয়ে আমার পা জোরে চেপে রেখে ওর আবেগ ও ভয়কে প্রকাশ করছিল। তারপর অনুভব করলাম ওর নরম ত্বক আলতো করে আমার ত্বকে ঘসে যাচ্ছে। এইভাবে ও আমাকে ওর আসক্তি ও উষ্ণতায় ভরিয়ে দিতে চাইলো, যা আমি কোনোদিনই ভুলবো না। এমনকি যদি ওর থেকে আলাদা হয়ে যাই, দূরে চলে যাই, তবুও…
মিসেস সেনকে কেউ ডাকলো। আমরা একা হলাম। মৈত্রেয়ী তার আবেগ চাপতে গিয়ে ঠোক কামড়ে বললো-ছবু মাকে সব বলে দিয়েছে। কিন্তু আমি অস্বীকার করেছি। ভয় পেয়ো না। আমি তোমারই আছি। যদি তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাহলে কিছু স্বীকার করো না। নইলে…
ওর চোখে জল এলো এবং অভ্যাসমতো আমার হাত ধরতে গেল। তখনই মিসেস সেন আসছিলেন। নিচু গলায় ও আমাকে শুধু বলার সময় পেলো-কাল এসো, সকালে, লাইব্রেরিতে।
মৈত্রেয়ীর মুখ থেকে সেই ছিল আমার শোনা শেষ কথা।
ওর মা ওকে নিয়ে গেলেন, আর আমি চলে গেলাম আমার ঘরে-আত্মবিশ্বাসহীন, দিশাহারা। ভাবতে পারছিলাম না পরের দিন কী ঘটবে।
সে রাত্রে ঘুমোতে পারিনি। আমার ঘরে আরাম কেদারায় বসে পাইপের পর পাইপ টেনে গেলাম। ক্রমশ সকাল হয়ে এলো। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি ও এলো। ও এসে ভুলিয়ে দেবে সব দুশ্চিন্তা, সব উদ্বেগ। ভুলে যাবো সব প্রতিযোগিতার কথা, যার সম্মুখীন আমি হয়েছিলাম ওর জন্য, সেই সব সন্দেহ, যার জন্য আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। ভাবছিলাম প্রকাশ করতে পারবো, আমার ভেতর যে ভালোবাসা বেড়ে উঠছে তার কোনো সীমা নেই যা মৈত্রেয়ী কোনো দিন চিন্তাই করতে পারেনি। অধৈর্যভাবে সকাদ্রের জন্য অপেক্ষা করছিলাম কখন ওকে বলবো যে এক রাত্রি আলাদা থাকা আর এই ভীতি আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসা শিখিয়েছে এবং আমি জেনেছি ও আমার কতখানি প্রিয়, যখন আমি ওকে হারানোর ভয় পাচ্ছি।
আমি কাঁদছিলাম একা একাই, ওকে হারানোর ভয় নিয়ে। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমরা আলাদা হয়ে গেলেও আমি বেঁচে থাকতে পারবো। ওকে ভালোবেসেছিলাম সেই সময় থেকে যখন থেকে ওকে জেনেছি যে ও আমার, এবং কেউ আমাকে বাধা দেয়নি ওর সঙ্গে কথা বলতে, ওর দিকে এগিয়ে যেতে। আর আজ একটা বাধা, একটা বিপদ হঠাৎ এলো আমাদের দুজনের মাঝখানে। মনে হচ্ছিল অপেক্ষা করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যাবো। কখন আমি ওকে দেখতে পাবো?
রাত্রিবেলায় অনেকবার বাগানে পায়চারি করতে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ঘরে সর্বদাই আলো জ্বলছিল। ওপর থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসছিল আর মাঝে মাঝে কেটে যাচ্ছিল। শোনা যাচ্ছিল, বিলাপ আর কান্না। কার গোঙানি? মৈত্রেয়ী, ছবু, খোকার বোন, কে? ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারছিলাম না। চূড়ান্ত অসহায় হয়ে পড়লাম। ঘরে এসে আরাম কেদারায় বসে খুঁজতে লাগলাম মৈত্রেয়ীর সেই কথাগুলোর যথার্থ অর্থ-ছবু সব বলে দিয়েছে। ওর মানসিক ভারসাম্যহীনতার মধ্যে ও কী বলতে পারে? ও কী দেখে এবং বুঝে থাকতে পারে? হয়ত রাত্রে কোনো দিন দিদিকে লক্ষ্য করেছিল।
পরে জেনেছিলাম যে ছবুর বিশ্বাস এবং বক্তব্য ছিল একেবারেই ব্যক্তিগত। সেদিন যখন মিসেস সেন ছবুর মাথা ধুয়ে দিচ্ছিলেন, তখন ছবু একটানা কেঁদেই চলছিল। মিসেস সেন ওকে জিজ্ঞেস করলেন, ও কেন কাঁদছে। ও উত্তর দিলো, কেউ ওকে পছন্দ করে না, কিন্তু মৈত্রেয়ীকে সবাই পছন্দ করে। সবাই মৈত্রেয়ীর জন্মদিনে এসেছিলেন এবং উপহার দিয়েছিলেন। বিশেষ করে অ্যালেন পছন্দ করে মৈত্রেয়ীকে—ও যোগ করলো। মিসেস সেন জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কেমন করে জানলি?
-অ্যালেন ওকে আদর করে। আমাকে কেউ আদর করে না…।
হবু এমনভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো যে মিসেস সেন ওকে বারবার জিজ্ঞাসা করতে থাকলেন। সব কথা-ছবু যা দেখেছিল, তা সব বলে দিয়ে তার বক্তব্য শেষ করলো এইভাবেঃ লেকে আমরা এক সঙ্গে ছিলাম, হাসছিলাম, চুম্বন বিনিময় হচ্ছিল, বাহুর মধ্যে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে ছিল…।
আমি ভেবেছিলাম যে ছবু কিছুই খেয়াল করেনি।
মিসেস সেন তৎক্ষণাৎ মৈত্রেয়ীকে ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন, হুবু যা বলেছে তা সব সঠিক কিনা। তারপর উনি ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন গাড়ি গ্যারাজ করার জন্য, আর মেয়েকে নিয়ে ছাদের ওপর উঠে গেলেন। উনি মৈত্রেয়ীকে শপথ করালেন তাঁদের পূর্বপুরুষ ও ঈশ্বরের নামে। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে গেলেন। মৈত্রেয়ী সব অস্বীকার করলো। ও শুধু স্বীকার করলো যে ও আমাকে মাঝে মাঝে মজা করে চুমু খেয়েছে এবং আমি তার বদলে ওকে চুমু খেয়েছি ওর কপালে। মৈত্রেয়ী ওঁর হাঁটু ছুঁয়ে মিনতি করলো যে তিনি যেন তার বাবাকে কিছু না বলেন। আমি কোনো ক্ষতিই সহ্য করবো না, যেহেতু আমি দোষী নই। সবাই যদি বলে তাহলে ও আমার সঙ্গে আর দেখা না করাটা নিশ্চয়ই মেনে নেবে এবং যে অন্যায় ও করেছে বলা হচ্ছে তার শাস্তি ও মাথা পেতে নেবে।
পরে শুনেছিলাম, ও ভেবেছিল যে আমার সঙ্গে ও সময়মত পালিয়ে যাবে। মৈত্রেয়ী বাবাকে খুব ভয় পেতো। উনি ওঁর ঘরে মৈত্রেয়ীকে আটকে রাখতে পারতেন অথবা কয়েকদিনের মধ্যেই ওর বিয়ে দিয়ে দিতে পারতেন, আমার সঙ্গে দেখা করা বা পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করার আগেই। সেই রাত্রে ওকে মায়ের ঘরে বন্ধ করে রেখে দেওয়া হলো। মিসেস সেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে সব কিছুই খুলে বললেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে লাগলেন, এই প্রেমের ঘটনাটা কিভাবে লুকানো যায়…। এই অভিশাপ সমস্ত বাড়ির ওপর এসে পড়বে; এই কলঙ্ক ওঁদের সর্বনাশের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এইসব খুঁটিনাটি আমি জেনেছিলাম পরের দিন অথবা তারপরের দিন খোকার কাছ থেকে। কিন্তু সেই রাত্রে আমি আরও খারাপ কিছুর কল্পনা করলাম। আমার মনে হয়েছিল যে হুবু বোধ হয় ওর দিদিকে দেখেছে আমার ঘরে আসতে। আর সেই সব কথাই ওর মাকে বলে দিয়েছে।
সকাল হবার আগেই আমি লাইব্রেরিতে মৈত্রেয়ীর জন্য অপেক্ষা করে রইলাম সব খবর জানবো বলে। দিন হওয়া পর্যন্ত তাকের আড়ালে লুকিয়ে রইলাম। না এলো মৈত্রেয়ী, না খোকার বোন, না লীলু, যাদের দিয়ে একটা খবর অন্তত ও পৌঁছে দিতে পারে। সাতটা নাগাদ মিসেস সেন নিচে নামলেন চা তৈরির উদ্দেশ্যে। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ঘরে ফিরে এলাম।
অপেক্ষা করছিলাম জলখাবারের জন্য যদি কেউ আসে। কেউ এলো না। খানিক পরে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমার ঘরে এলেন—কালো চশমায় চোখ ঢাকা, বেতালা হাঁটা এবং হাত দুটো কাঁপছে দুর্বলতায়।
—প্রিয় অ্যালেন, আমি ঠিক করেছি এবার অপারেশনটা করিয়েই নেব। ডাক্তাররা অনেকদিন থেকে বলে আসছেন।
ওঁকে মনে হলো খুব আবেগতাড়িত, কিন্তু কন্ঠস্বরে একটা বন্ধুবৎ আন্তরিকতা বজায় ছিল। বললেন,
—অন্তত দু’তিন মাস আমার ক্লিনিকে বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। আমি ভেবেছি আমার স্ত্রীকে তার বাপের বাড়ি মোদিনীপুর পাঠিয়ে দেবো। তুমিও শ্রান্ত, কিছু দিন পাহাড়ে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে এসো।
—কখন যাবো আমি? এমন শাস্তভাবে জিজ্ঞাসা করলাম যে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে কি, আমি ঠিক পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারছিলাম না, যে কী ঘটতে যাচ্ছে।
—আজকেই। উত্তর দিলেন ইঞ্জিনিয়ার। আমি দুপুরের খাওয়া সেরেই ক্লিনিকে চলে যাচ্ছি।
চশমার কাচের আড়াল থেকে তিনি আমায় পর্যবেক্ষণ করলেন। এ কথা সহ্য করার মতো শক্তি কী করে পেলাম জানি না, যদিও মনে হচ্ছিল আমার শরীরের সমস্ত রক্ত শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবে।
—ঠিক আছে, আমি উত্তর দিলাম,-কিন্তু জানি না কোথায় যাবো। আমাকে একটা আস্তানা খুঁজতে হবে, এই সব জিনিসপত্র নিয়ে যেতে হবে। এই বলে আমি আমার দুটো ট্রাঙ্ক এবং অন্যান্য জিনিসপত্র দেখালাম
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব সৌজন্যপূর্ণ হাসি হাসলেন; বললেন–তোমার মত একটা উদ্যমী ছেলে সব সময়েই অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে পারবে। তুমি যদি এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ো তো দুপুরের খাবার আগেই একটা আস্তানা খুঁজে বার করতে পারবে। খোকা ট্রাকে করে তোমার সব জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়ে আসবে। পাহাড়ে যাবার আগে তোমার কোনো বন্ধুর বাড়িতেই থাকতে পারো। ফিরে এসে আরো ভালোভাবে গুছিয়ে নিতে পারবে।…
উনি উঠে পড়লেন। আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত কাঁপছিল। আমি চাইলাম তক্ষুণি চলে যেতে, কিন্তু মিসেস সেন করিডর থেকে সব কিছু শুনেছিলেন, তিনি আমার ঘরে ঢুকে স্মিতহাস্যে বললেন, তুমি না খেয়ে যেতে পারবে না।
—আমি কিছু খেতে পারবো না। নিস্তেজ গলায় বললাম।
—আমি তোমায় খাওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।—উনি বলে চললেন একই নরম গলায়, চা তৈরি হয়ে গেছে।
মনে হচ্ছিল, যে কোনো সময় আমি জ্ঞান হারাতে পারি।
আমি চলে গেলাম।
আমি মৈত্রেয়ীকে আর দেখিনি। জানতে পারিনি ওপরে ওর ঘরে ও কী করছিল তখন…।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব চলে গেলেন এবং আমি চুল টেনে, হাত কামড়ে পাগলের মতো কান্নায় ফোঁপাতে লাগলাম। ইজি চেয়ারে নিজেকে সমর্পণ করলাম। শ্বাস রোধ হয়ে আসছিল যন্ত্রণায়। জানি না, সেই যন্ত্রণাকে কি বলা যেতে পারে। সেটা প্রেমের জন্য খুন হবার যন্ত্রণা নয় বা কষ্ট নয়, কিন্ত একটা সময় অনুভূতির ক্রিয়াশক্তি যেন হারিয়ে যাওয়া। আমি যেন হঠাৎ এসে পড়লাম একা একটা কবরখানার ভেতর, আমার কাছে কেউ নেই যে আমার গোঙানির আওয়াজটুকুও শুনবে বা সান্ত্বনা দেবে। আমি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছিলাম।
লীলু চোখে জল নিয়ে আমার ঘরে ঢুকে ঝটপট এক টুকরো কাগজ দিলো। তাতে লেখা, ওরা কেউ চায় না আমি তোমার দেখা পাই। নিজের জীবনটাকে নষ্ট করে দিও না। নিজেকে ভেঙে পড়তে দিও না। সারা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াও। সবাইকে দেখাও তোমার শুদ্ধতা। একটা মানুষের মতন মানুষ হও। তুমি শীগগীরই আমার কাছ থেকে একটা খবর পাবে—মৈত্রেয়ী।
হাতের লেখাটা বিশৃঙ্খল। লেখাটা অগোছালো ইংরেজীতে। কাগজে কালির দাগ। তাড়াতাড়ি কাগজটা হাতে ফাঁকের মধ্যে লুকোলাম। মিসেস সেন ঘরে ঢুকলেন, পিছনে একজন চাকর।
—আমি তোমাকে অনুরোধ করবো এখনি চলে যেতে। নরম সুরে বললেন উনি। হয়ত সেই কন্ঠস্বরে তখনও ছিল সমবেদনার সুর। উনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন, ছেলে বলে ডাকতেন। ওঁর দুই মেয়ের পরে একটা ছেলের কামনা বোধহয় ছিল।
আমি পারলাম না ওঁর পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে, ক্ষমা চাইতে, ওঁর বাড়িতে আমাকে থাকতে দেবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাতে। দরজার কাছে উনি স্থির দাঁড়িয়েছিলেন, সোজা এবং চুপচাপ। ঠোঁটে লেগেছিল অল্প বিদ্রূপ মেশানো ঠান্ডা হাসি।
—যাবার আগে বাচ্চাদের কি একটু দেখতে পারি?—ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম। ঠিক সেই মুহূতে নরেন্দ্র সেন ঘরে ঢুকলেন।
—মৈত্রেয়ী কষ্ট পাচ্ছে—বললেন উনি—ও এখন ঘর থেকে নেমে আসতে পারবে না।
তারপর স্ত্রীকে বললেন—ছবুকে একবার ডাকো।
মিসেস সেন চলে গেলেন। যখন মিঃ সেন আর আমি একা, তখন তিনি আমায় একটা বন্ধ খাম এগিয়ে দিলেন। বললেন, আমি তোমায় অনুরোধ করবো এটা এই বাড়ি থেকে চলে যাবার পর পড়তে। যতটুকু যা আমি করতে পেরেছি তোমার জন্য এখানে, এই ভারতে, পারলে তার সম্মান দিও; যতটুকু আমার প্রাপ্য ততটুকুই…
উনি আমাকে উত্তর দেবার অবকাশ না দিয়েই চলে গেলেন। যন্ত্রচালিতের মতো আমি চিঠিটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। ছবুকে দেখামাত্র তুলে নিলাম কোলের মধ্যে আর কাঁদতে কাঁদতে ওকে দোলাতে লাগলাম। কী করলে ছবু? কী করলে তুমি? বেচারি বাচ্চাটা কিছুই বুঝলো না, কিন্তু আমাকে কাঁদতে দেখে নিজেও কাঁদতে লাগলো এবং আমার মুখে চুমু খেলো। ওর শরীরের ওপর আমি মাথাটা নুইয়ে দিলাম এবং যন্ত্রের মতন দোলাতে থাকলাম, যেন আমি সংজ্ঞাহীন, অন্য কোনো কিছু বলার শক্তি নেই, শুধু বলছি—কী করলে ছবু? কী করলে?
ওকে মনে হলো যেন জ্ঞান ফিরে পেল এবং আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো—কিন্তু আমি কী করলাম! কেন তুমি কাঁদছো অ্যালেন? তুমি কেন কাঁদছো?
মুখটা মুছবো বলে ওকে নামিয়ে দিলাম মাটিতে। মিসেস সেন এবং ওঁর স্বামী দরজার কাছে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দুজনেই বরফের মত ঠান্ডা, মনে হলো ওঁরা যেন আমায় বলছেন—এবার যাবার সময় হলো। চলে যাও।
আর একবার ছোট্ট মেয়েটাকে দুগালে আদর করলাম এবং মন ঠিক করে ওঁদের আমার শুভেচ্ছা এবং নমস্কার জানালাম।
—গুড বাই অ্যালেন।—বলেই ইঞ্জিনিয়ার সাহেব হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।
করিডরের দিকে এগিয়ে গেলাম, ভাব দেখালাম যেন কিছুই দেখছি না। ছবু কাঁদতে কাঁদতে আমার পিছনে পিছনে দৌড়তে লাগলো—কোথায় যাচ্ছো তুমি অ্যালেন? ওর মাকে জিজ্ঞাসা করলো, ও কোথায় যাচ্ছে?
-অ্যালেন অসুস্থ। ও চিকিৎসা করাতে যাচ্ছে। ওকে ধরে অবাব দিলেন মিসেস সেন, নিচ গলায়।
বারান্দা পেরিয়ে নেমে গেলাম, চোখ আমার ছিল বারান্দার দিকে। দেখতে পেলাম মৈত্রেয়ীকে। আমার নাম ধরে কাঁদছিল। বড় শ্বাস নিচ্ছিল। আতঙ্কে ওর মুখ নীল। দেখলাম উল্টে পড়ে গেল জ্ঞান হারিয়ে, আমি ওপরে উঠতে গেলাম। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আমার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। তুমি কি কিছু ভুলে গেছো?
–না, কিচ্ছু না।
ঝড়ের মতো রাস্তায় বেরিয়ে গেলাম, লাফ দিয়ে প্রথম গাড়িটায় উঠলাম। আর একবার বাড়িটার দিকে তাকাতে চাইলাম কিন্তু তখন চোখ ভর্তি জল। কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই বাঁক নিলো। আমি আর কিছুই দেখতে পেলাম না।
যখন সম্বিৎ ফিরে এলো, দেখলাম গাড়িটা পার্ক স্ট্রীটে। খামটা ছিঁড়ে ফেললাম, মিঃ সেনের চিঠিটা পড়লাম শ্বাসরুদ্ধ হয়ে। কোনো ভূমিকা না করেই উনি লিখেছেন ইংরেজীতে। পাতার এক কোণে উনি লিখে রেখেছেন “একান্ত গোপনীয়”।
“তুমি একজন বিদেশী। আমি তোমায় জানি না। যদি তোমার জীবনে পবিত্র কিছু থাকে এবং তা বিবেচনা করতে সক্ষম হও, আমি তোমায় অনুরোধ করবো আমার বাড়িতে আর কখনও না আসতে, আমার বাড়ির কারও সঙ্গে দেখা না করতে এবং কাউকে কিছু না লিখতে। যদি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে চাও, আমাকে অফিসে পাবে। যদি কোনও দিন আমায় লিখতে চাও তাহলে এমন কিছু লিখবে না যা এক অজানা ব্যক্তি আর একজন অজানা ব্যক্তিকে লিখতে পারে, অথবা একজন অর্ধস্তন তার উপরওয়ালাকে লিখতে পারে। আমি তোমায় অনুরোধ করবো এই চিঠির কথা কারও কাছে প্রকাশ না করতে এবং পড়ার পরে ছিঁড়ে ফেলতে। আমার এই ব্যবহারের কারণ তোমার কাছে মনে হয় পরিস্কার, যদি তোমার স্থূল রুচির মধ্যে অতি সামান্যও বিচক্ষণতা বর্তমান থাকে। তুমি নিশ্চয়ই হৃদয়ঙ্গম করতে পারছো তোমার নিজের অকৃতজ্ঞতা এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার ক্ষতি, যা তুমি আমার ওপর চাপিয়ে দিলে।
নরেন্দ্র সেন।
বিঃ দ্রঃ-তোমাকে অনুরোধ করবো যে, অভিযোগ থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টায় বিরক্তিকর কিছু দেখিয়ো না। তাতে তুমি কেবল নতুন কিছু মিথ্যা যোগ করতে পারবে যা তোমার নোংরা চরিত্র তোমায় এতদিন করিয়েছে।