লাল নিশানা
কচুপাতার ওপর ঘন মাকড়সার জাল। মাদার গাছের তলাটা ঝুপসি অন্ধকার। কচুরিপানা ঢাকা মজা ডোবাটার ওপর বাঁশঝাড়গুলো নুয়ে নুড়ে পড়েছে। দু-একটা বাঁশ জলের বুকও ছুঁয়েছে। ডোবাটার ধারে ধারে কলমিদামের জঙ্গল।
তিনদিন ধরে সমানে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। জুইফুলি বৃষ্টি নয়, একেবারে মুষলধারায়। জল পেয়ে মানগুলো দিব্যি লকলকিয়ে উঠেছে। পিঁপড়ের সার চলেছে ডিম মুখে নিয়ে। এখনও আকাশের মুখ অভিমানের মেঘে ভরা। মনে হচ্ছে, একটু নাড়া পেলেই বুঝি ঝরঝর করে বর্ষণ শুরু করবে। সন্ধ্যার অনেক আগেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে চারপাশে। ঝিঁঝি ডাকছে একটানা। ব্যাঙের গোঙানি মাঝে মাঝে। একটু পরেই জোনাকিরা বেরোবে আলোর পশরা নিয়ে।
বসে বসে থেকে শিবানীর আর ভালো লাগল না। উঠে পড়ল ঘাস বন থেকে। দুটো হাত মাথার ওপর তুলে একবার আড়মোড়া ভাঙল। ঝোপের পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল। সদরের উঁচু পাঁচিলটা দেখা যাচ্ছে। সদরের দরজার কিছুটা। ওপরের ঘরে আলো জ্বলছে। টিমটিমে আলো। ভালো করে দেখাও যায় না।
এক হাতে ঘাসগুলো সরাতে সরাতে শিবানী আরও একটু এগিয়ে এল। ডোবার ঘাট বরাবর।
ঘাট মানে শান-বাঁধানো চাতাল নয়, নারকোলের গুঁড়ি ফেলা। গুঁড়িগুলো শ্যাওলায় সবুজ হয়ে আছে। একটু পা পড়লে আর দেখতে হবে না। একেবারে কাদায় পুঁতে যাবে। ডোবার মতন জল ডোবাটায় নেই এই বর্ষকালেও নয়।
খুব চেনা পথ। কতবার বাসনের গোছা নিয়ে বউটি এই ডোবায় এসেছে। ঝি কামিনি না এলে বউটিই আসত বাসন মাজতে। তা না হলে, আর কে আসবে। বুড়ি শাশুড়ি ভালো করে চোখে দেখতে পেতেন না। একটা চোখে ছানি পড়েছে। ওপর-নীচে চলাফেরা করতেই মুশকিল হত।
ভাঙাচোরা বাড়ি। শ্বশুরের আমলের না মেরামত, না কলি ফেরানো। মেরামত করবেই বা কে? এই একটি মাত্র ছেলে। শিবরাত্রির সলতে। তেজও সলতেরই মতন। মিটমিটে আলো। পার্কিনসন কোম্পানির একেবারে ঘনিষ্ঠ কেরানি। দুনিয়ার যত চিঠিপত্র এসে জমা হয়। সেগুলো খাতায় টুকে সেকশনে সেকশনে পাঠাতে হয়। মাইনে পঁচাশি, তার মধ্যে ট্রেনের মান্থলি বাবদ যায় সাত টাকা। তার ওপর জলখাবারের ব্যাপার আছে। যেটুকু বাকি থাকে, তাতে তিনজনের গ্রাস আর আচ্ছাদন দুটো চলে না।
আর কিছু না থাক, নামের জোর আছে। নাম বাসব। চেহারা আর ঐশ্বর্য কোনোটাতেই ইন্দ্রত্বের ছাপ নেই। কাজেই ও বাড়ি মেরামত করা বাসবের সাধ্য নয়। তিনটে লোকের ভরণপোষণ চলে না ভালো করে, অথচ শাশুড়ির দিনরাত নাকে-কাঁদুনির কামাই নেই। আর একটা বাড়তি প্রাণীর দরকার। আর একজন না হলে সংসার বেমানান।
প্রথম প্রথম বউকে আড়ালে ডেকে শাশুড়ি জিজ্ঞাসা করতেন। খোঁজখবর নিতেন। নতুন অতিথির আসার সম্ভাবনাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিশ্লেষণ করতেন। বউয়ের মাথা নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের কপাল চাপড়াতেন।
এ হল প্রথম পর্ব।
গাব গাছে হেলান দিয়ে শিবানী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। দ্বিতীয় পর্বের অবস্থা আরও মারাত্মক। রাজ্যের শিকড়-বাকড়, মাদুলি-তাবিজ বউয়ের হাতে উঠল। হাত নাড়াই দুষ্কর। প্রতিবাদ করা বৃথা।
গাঁয়ের কোনো সাধু সন্ন্যাসী এসেছেন খবর পেলেই শাশুড়ি টেনে নিয়ে যেতেন বউকে। ছানির অস্পষ্টতা কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারত না।
কিন্তু তবু কিছু হল না। এবারে অন্তিম পর্ব। সে পর্বের চেহারা দেখে বউটি শিউরে উঠল। এতদিন শুধু শাশুড়ি পিছনে লেগে ছিলেন, এবার তাঁর ছেলেও তৎপর হয়ে উঠল।
চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকতে গিয়েই বউটি চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘরের মধ্যে মা আর ছেলের তাকে নিয়েই আলোচনা চলেছে।
‘তুমি আর কী করবে বা, মাদুলি-তাবিজ কত আর বাঁধবে হাতে? বউ তোমার বাঁজা, আমি কলকাতার ডাক্তার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করেছি।’
ডাক্তার বন্ধু মানে লেজার সেকশনের পীতাম্বর মুখুটি। লেজারও লেখে আবার অবসর সময়ে হোমিয়োপ্যাথি করে। একেবারে অব্যর্থ। বড়োবাবুর মেজোছেলের নাকের ওপর বিশ্রি একটা আঁচিল গজাচ্ছিল; ক-ডোজ থুজায়ে সে আঁচিল নিশ্চিহ্ন হল। নিবারণবাবুর শাশুড়ির হাঁপানি, যায় যায় অবস্থা, ছ-ফোঁটা ডিজিটালিসে একেবারে অসাধ্যসাধন। ওষুধ পেটে পড়বার পরের দিনই সেই শাশুড়ি হাওড়া থেকে হেঁটে মেয়ের বাড়ি বালিতে গিয়ে উঠেছিলেন।
আলাপটা বাসর তাঁর সঙ্গেই করেছিল। পীতাম্বর মুখুটি বাসবের বউয়ের চেহারার বর্ণনা, চলাফেরা, কথাবার্তার ধরন সব শুনে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। অনেক পীড়াপীড়ির পর শুধু বলেছিলেন, ওই স্ত্রীর দ্বারা তোমার বংশ রক্ষা হবে না বাসু। তুমি অন্য পত্নী গ্রহণ করো। ক্ষুণ্ণ হবার কিছু নেই। এ বিষয়ে শাস্ত্রে বিধান আছে।
পীতাম্বর মুখুটি শাস্ত্রও আওড়েছিলেন। অফিসশুদ্ধ সবাই অবাক। এই একটি অসাধারণ লোক, লেজারের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। হানেমাতা, চন্দ্রশেখর, কালী, মহেশ ভট্টাচার্য, বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ সব একেবারে নখদর্পণে। তামাম শ্লোক কণ্ঠস্থ।
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হল। ডোবার কচুরিপানার পাতায় পাতায় টুপটাপ শব্দ। বাঁশের বনে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ। সে সন্ধ্যায় বউটি চায়ের কাপ সামলে ধীরে পায়ে রান্নাঘরে ফিরে এসেছিল।
চা না-পেয়ে কিছুক্ষণ পর বাসব চায়ের খোঁজে যখন রান্নাঘরে ঢুকেছিল তখন বউটি বলেছিল, ‘ওগো আমাকে একবার কলকাতায় নিয়ে যাবে?’
‘কলকাতায় কেন?’ বাসব ভ্রূ কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
‘একবার ডাক্তার দেখাব।’
‘ডাক্তার?’ বুঝেও না বোঝার ভান করল বাসব।
‘হ্যাঁ, কেন আমার এমন অবস্থা তাই দেখাব। আমার স্বাস্থ্য তো এমনিতে খারাপ নয়। কোনো শক্ত অসুখবিসুখও নেই। তবে?’
বাসব হেসেছিল, ‘ভগবানের সঙ্গে লড়াইয়ে ডাক্তারকে হারতেই হবে।’
‘তার মানে?’
মানেটা আর বাসব খুলে বলেনি। আস্তে আস্তে সরে গিয়েছিল সেখান থেকে। বউটি অনেকক্ষণ আর মুখ তুলতে পারেনি।
লজ্জা নয়, সংকোচ নয়, একটা দারুণ দাহে অস্থি পুড়ে যেন ছাই হয়ে গিয়েছিল।
অনেকদিন দুজনের মধ্যে কথা বন্ধ ছিল। বউটি যাও-বা দু-একবার কথা বলতে চেষ্টা করেছিল, দারুণ ঔদাসীন্যের ভাব দেখিয়ে বাসব তাকে এড়িয়ে গেছে।
সারাটা দুপুর তক্তপোশে উপুড় হয়ে বউটি কেঁদেছে। নামজানা সমস্ত দেবতাকে স্মরণ করেছে মনে মনে। একটি পৃথক সত্ত্বা, দুজনের মিলিত স্পর্শে আর একটি প্রাণের দীপ্তি প্রার্থনা করেছে আকুলভাবে।
কিন্তু আকুল আবেদনের সাড়া মেলেনি।
চুপি চুপি ঠাকুরঘরে গিয়ে মাথা খুঁড়েছে। পাষাণ বিগ্রহের ভাবান্তর ঘটেনি।
বুকের ব্যথা বুকে চেপে সংসার করেছে বউটি। শাশুড়ির সেবা, স্বামীর সোহাগ খেতে খেতে চমকে উঠেছে মাঝে মাঝে। অন্য কথা মনে এসেছে। ভেবেছে, যে লোকটি এত কাছে এসে একান্ত হয়ে ভালোবাসার মিষ্টি কথা শোনাচ্ছে, সেই একদিন চোখের সামনে দিয়ে অন্য লোকের হয়ে যাবে। আর একজনকে সোহাগ করবে ঠিক এমনিভাবে। ভাবতে ভাবতে দু-চোখ ভরে গেছে জলে। আঁচল দিয়ে চোখ চেপে স্বামীর আলিঙ্গন থেকে অব্যাহতি পাবার চেষ্টা করেছে।
শিবানী আরও একটু এগিয়ে এল। এখান থেকে সদর দরজাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করা। এ ছাড়া আরও একটি দরজা আছে পিছন দিকে। খিড়কি দরজা। সেটা খুললেই আর একটি পুকুর। চারধারে সুপুরি গাছের বাহার। সে পুকুর বাসবদের নয়, মজুমদারদের। কাকচক্ষু জল। প্রত্যেক মাসে শ্যাওলা পরিষ্কার করা হয়। ঝাঁঝি তোলা আর আগাছা ওপড়ানোও হয়।
সেই পুকুরেই বাসবরা স্নান করা, কাপড় কাচা সব করত। খাবার জলও ভরত সেখান থেকে। সেই ঘাটের চাতালে বসে কতদিন বউটি গভীর রাত পর্যন্ত কেঁদেছে। গুমরে গুমরে কান্না। সে কান্না শোনার জন্য কেউ জেগে থাকেনি। কারও ব্যগ্র হাত ছুটে আসেনি, বউটিকে বাড়ির মধ্যে নিয়ে যাবার জন্য।
নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করেছে। একবার নয়, বহুবার।
একী সত্যি, তার স্বামী আবার একজনকে অঙ্কশায়িনী করবে। মন্ত্র পড়ে, এতদিন একসঙ্গে বাস করে, আদর যত্ন কিংবা তার ভালো করে যাকে কাছে কাছে রেখেছিল, যে তার দ্বিতীয় সত্ত্বার মতন, তাকে এক মুহূর্তে সরিয়ে দেবে একপাশে। অবহেলার আর্বজনায়।
আর একজনকে বসাবে তার জায়গায়, একই বাড়িতে দুজনে থাকবে। হয়তো পাশাপাশি নতুন মিলনের খিলখিল হাসি কান পেতে শুনতে হবে। চুরি করে দেখবে দুজনের মদির কটাক্ষ বিনিময়। বউটির প্রথম বিবাহিত জীবনের দৃশ্যগুলো আবার পুনরাভিনীত হবে, অবশ্য কেবল নতুন নায়িকা নিয়ে।
অথচ বউটির কী দোষ? এতটা শাস্তি পাবার মতন কোন অপরাধ সে করেছে?
বাসব বেশ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। নেহাত দায়সারা গোছের উত্তর। তাও দু-একটা কথায়। মনে হল, বাসব কী-একটা যেন ভাবছে। নতুনভাবে, নতুন মানুষ নিয়ে কেমন করে জীবন শুরু করবে, সেই কথাই কি?
একটা সবুজ ফড়িং অনেকক্ষণ ধরে কচুপাতার ওপর বসবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু কী ভেবে বসতে গিয়েও বসছিল না। এলোমেলো হাওয়ায় কচুপাতাগুলো দুলছে, সেইজন্যই বুঝি ফড়িংটা ভয় পাচ্ছে। সেদিনও বউটি এমনই ভয় পেয়েছিল। সমস্ত সংসারটা যেন দুলছিল। মানুষগুলোও অস্থির চিত্ত। কারুর ওপর নির্ভর করা যায় না। অবলম্বন করা যায় না কাউকে। সবাই চাইছে, পুরোনো মানুষ সরে গিয়ে নতুন মুখ আসুক। এক অপূর্ব কলকাকলীতে ভরে উঠুক সংসার। ছোটো দুটি মুঠির বাঁধনে গোটা সংসারটা বাঁধুক। একদিন বউটি লুকিয়ে লুকিয়ে ভাজকে একটা চিঠি লিখেছিল। বাপের বাড়ির দিকে ফিরে চাইবার মতন তার কেউ ছিল না। বাপকে ভালো করে তার মনেই পড়ে না। অস্পষ্ট একটা ছবি দেখে আবছা একটা রূপ কল্পনা করে নেয়।
মাকে দেখেছে। জীর্ণ, রোগক্লিষ্ট চেহারা। দু-পা চলতে গেলে হাঁপায়। মাসের মধ্যে অর্ধেক দিন খাওয়াদাওয়া বন্ধ। ঘরের কোণে ছেঁড়া কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকত।
সংসার করার সাধ তার মিটে গিয়েছিল। সুস্থ থাকলে কেবল ভগবানের কাছে প্রার্থনা জানাত, মেয়েটিকে কোনোরকমে পার করে দাও ঠাকুর। আর কিছু চাই না। বেশি কিছু চাইবার মতন বরাতও করে আসেনি। দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পায় আর পরনের কাপড় জোটে তা হলেই হবে।
বউটির মা বুঝি একটা কথা প্রার্থনায় জানাতে ভুলে গিয়েছিল। ভাত কাপড়ই শেষ কথা নয়, শান্তি— শান্তি যেন পায় মেয়েটা। একবেলা খাবার জুটুক ক্ষতি নেই, পরনের বসন শতচ্ছিন্ন হলেও ক্ষোভের কিছু নেই, কিন্তু যদি সুখ না থাকে, মনে আনন্দ না থাকে, তাহলে জীবনের হাজার সম্পদ বরবাদ হয়ে যায়।
মা যেন বিয়েটা দেখার জন্যই বেঁচেছিল। বিয়ে হয়েছিল মাঘ মাসে, মা গেল বৈশাখে। শেষ সময়ে মেয়ে মাকে একবার চোখের দেখাও দেখতে পায়নি।
ভাই বদলি হয়েছিল জামালপুরে। মা ছেলের কাছে দেহ রেখেছিল। এখন ভাই জামালপুরে নয়, পাটনায়। বউটি সেখানেই চিঠি দিল।
চিঠিটা ভাজকে উদ্দেশ করেই লিখল, কিন্তু আসল লক্ষ্য দাদা। দাদা যেন পড়ে এবং একটা বিহিত করে। নাহলে বউটিই বা যাবে কোথায়! কার দিকে চাইবে?
এদের, মানে এবাড়ির হালচাল যেন ভালো লাগছে না। কেমন একটা থমথমে ভাব। ভালো করে কেউ কথা বলে না। কেবল এধারে-ওধারে ফিসফিস পরামর্শ। বউটি গেলেই সব থেমে যায়। ওরা কথা বলার ভান করে।
আসল কথাটার আভাসও তার মানে?
মানে, তুমি যদি প্রশ্ন করো, ‘আজ রাতে আকাশের নক্ষত্রের সংখ্যা কত?’
‘বলতে পারব না। কারণ সংখ্যাটা আমারই জানা নেই।’
‘চালাকি রাখো। দেবে তো উত্তর?’
‘প্রশ্নটা করেই দেখো না।’
বউটি বাসবের গা ঘেঁষে শুতে শুতে বলেছিল, ‘তুমি নাকি আবার বিয়ে করবে? পাত্রীও নাকি ঠিক হয়ে আছে?’
কয়েক মিনিটের নিস্তব্ধতা। বাসব চুপচাপ রইল। তারপর পাশ ফিরতে ফিরতে বলল, ‘মাঝে মাঝে তোমার মাথায় বুঝি ভূত চাপে?’
‘আজই শুনে এলাম।’
‘কার কাছে?’
‘চাটুজ্জেদের ন-বউ এসেছিল আমার কাছে।’ একটুও না-থেমে বউটি বলেছিল।
‘তোমার চাটুজ্জেদের ন-বউ ঘটকগিরি করছে বুঝি?’
‘না, তবে যিনি করেছেন, তাঁর কাছ থেকেই শুনেছে।’
বাসব এবার উঠে বসল। অন্ধকারে বউটির মুখ ঠিক দেখা গেল না, কাজেই সে মুখের লিপি পড়া সম্ভব হল না। আস্তে আস্তে বলল, ‘ঘটক চূড়ামণিটি কে?’
‘পূর্বপাড়ার দামোদর চক্রবর্তী।’ সঙ্গে সঙ্গে বউটিও উঠে বসেছিল। উত্তেজনায় কণ্ঠস্বর কাঁপছে। বাসবের মনে হল, ইতিমধ্যে দু-এক ফোঁটা জলও বোধ হয় পড়েছে চোখ থেকে।
বাসব নিজেকে সামলে নিয়েছিল। খুব গম্ভীর গলায় বলেছিল, ‘মাঝরাত্রিতে রসিকতা শোনার মতন সময় আমার নেই। ভোরে অফিস আছে। আমায় ঘুমুতে হবে।’
বাসব পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমোবার ভান করেছিল।
বউটি আর কথা বাড়ায়নি। এটুকু বুঝতে পেরেছিল, আর একটা কথা বললেই বিরক্ত হবার ছুতো করে বাসব হয় মেঝের ওপর কিংবা বারান্দায় গিয়ে শোবে।
কিছুক্ষণ পরে বাসব সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু বউটি ঘুমোয়নি। চুপচাপ শুয়ে শুয়ে বাইরের তারা-ভরা আকাশের দিকে চেয়েছিল।
এরা কেউ কিছু বলেনি, কেউ কিছু বলবেও না, কিন্তু বউটি ঠিক বুঝতে পেরেছে। বিরাট একটা বাদুড় কালো ডানা প্রসারিত করে এগিয়ে আসছে। অন্ধকারকে আরও সূচিভেদ্য করে। তমিস্রার গাঢ় স্রোতে বউটি নিঃশেষে মুছে যাবে সে সম্ভাবনা দূরে নয়।
শাশুড়িকেও কথাটা জিজ্ঞেস করেছিল দুপুর বেলা। শাশুড়ির পা দুটো কোলে নিয়ে বউটি বসেছিল। বাঁজা মেয়েকে নিয়ে ঘর করতে স্বামী রাজি নয়। সম্ভবত আর একবার বিয়ে করার চেষ্টা করছে। তাই যদি হয়, স্বামীপ্রেমের শরিক যদি আসে, তাহলে বউটি কী করে বাঁচবে? সবচেয়ে কাছের লোকটা যদি সবচেয়ে দূরে সরে যায় তাহলে সংসারের আকর্ষণটুকুই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
উত্তর এসেছিল। এমন সময়ে এসেছিল, বউটি উত্তরের সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল।
এর মধ্যে এ সংসারে আরও ঢেউ উঠেছে। সে ঢেউ বউটিকে অতলে তলিয়ে নিয়ে যাবার রুক্ষ্ম আক্রোশে আছড়ে পড়েছে তার চারদিকে।
দামোদর চক্রবর্তী, এ গাঁয়ের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা। মাতব্বর লোক। যাগ-যজ্ঞে, শোকে-তাপে, আনন্দে-প্রমোদে গাঁয়ের লোকদের পক্ষে অপরিহার্য। আড়ালে পাঁচজনে পাঁচ কথা বলে, কিন্তু ওই আড়ালেই। সামনে বলার সাহস কারও নেই। কোনো এক বিধবা বউদির সম্পত্তি ফাঁকি দিয়ে নিজে গুছিয়ে নিয়েছেন এমন একটা প্রতিশ্রুতি গাঁয়ে প্রচলিত আছে, কিন্তু তা নিয়ে আজ আর কেউ মাথা ঘামায় না। দামোদর চক্রবর্তীর প্রখর ব্যক্তিত্বের দাপটে ছোটোখাটো ত্রুটিবিচ্যুতি মুছে গিয়েছে।
সেই দামোদর চক্রবর্তী একদিন সদরে এসে বসলেন।
ছুটির দিন। অফিস যাবার তাড়া নেই। সারা দিনটাই ঢিমে ছন্দে বাঁধা। রান্না করার ফাঁকে ফাঁকে বউটি দরজার কপাটের ফাঁকে চোখ রেখেছিল। সব কথা কানে আসেনি, যা দু-একটি এসেছিল তাতেই তার মুখের সবটুকু রক্ত নিঃশেষে শুকিয়ে গিয়েছিল।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বাবাজি, এর জন্য আর চিন্তার কী আছে! শাস্ত্রে তে বিধানই রয়েছে।’ একেবারে অফিসের পীতাম্বর মুখুটির প্রতিধ্বনি।
দামোদর চক্রবর্তী আরও এক ধাপ এগিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গোটা পাঁচেক পাত্রীর ফিরিস্তিও দিয়েছিলেন।
ভেজানো কপাটের ফাঁক দিয়ে বউটি স্বামীর মুখটা দেখবার চেষ্টা করেছিল। পারেনি, দেখতে চেয়েছিল সে মুখে কীসের চিহ্ন! বেদনার না প্রচ্ছন্ন উল্লাসের।
দু-হাতে নিজের বুক চেপে বউটি সরে গিয়েছিল।
ভাজ লিখেছিল, ও সব বাজে কথা। ঠাকুরজামাই ঠাট্টা করেছেন তোমার সঙ্গে। আজকাল আবার এই কারণে দ্বিতীয় বার কেউ বিয়ে করে? তা ছাড়া এমন কিছু বয়স হয়নি তোমার। এর মধ্যে হতাশ হবার মতন কী হয়েছে?
ভাই কিন্তু অন্য কথা লিখেছিল। যদি বাসব অন্য পত্নীই গ্রহণ করে, সংসারের প্রয়োজনে, বংশরক্ষার প্রয়োজনে, হয়তো তার একাজ করা ছাড়া পথ নেই, তাহলে সমস্ত ব্যাপারটা বউটির সহজভাবে গ্রহণ করা উচিত। নিজের ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ-আনন্দ-পুলক সবকিছু সংসারের প্রয়োজনে বলি দেওয়া কর্তব্য। সাধ্বী স্ত্রীলোকদের এই রীতি।
আরও দু-পাতা ছিল সাধ্বীদের অন্যান্য কর্তব্য সম্বন্ধে। সবটা পাড়ার ধৈর্য বউটির ছিল না।
চিঠিটা টুকরো টুকরো করে পিছনের আগাছার জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। মনকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছিল অমোঘকে বরণ করে নেবার জন্য, কিন্তু পারেনি, সবকিছুর অন্তরালে গোপন কাঁটা বুকের মাঝখানে গিয়ে বিঁধেছিল। নড়তে চড়তে গেলেই অব্যক্ত একটা বেদনা, নীরবে রক্তক্ষরণ।
মাঝে মাঝে সোজাসুজি বাসবকে প্রশ্নও করেছিল।
শুতে যাবার আগে মশারি ফেলতে ফেলতে বউটি বলেছিল, ‘কিগো ঘুমুলে নাকি?’ বাসব ঘুমোয়নি। চিৎ হয়ে শুয়ে পান চিবোচ্ছিল। বউটির কথায় উত্তর দিয়েছিল, ‘উঁহু!’
‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’
‘করো।’
‘সত্যি উত্তর দেবে তো?’
‘উত্তর যদি জানা থাকে তো, দেব।’
প্রশ্নটি সে করেছিল, কিন্তু যে উত্তর বউটি আশা করেছিল, তা পায়নি।
পা টিপতে টিপতে শাশুড়িকেও বলেছিল, ‘একটা কথা জিজ্ঞাসা করব মা?’
শাশুড়ি বিরক্ত হয়েছিলেন, ‘বলো বাছা কী বলবে? একটু ঘুম এলেই তোমার যত কথা!’
বউটি ভয়ে কিছুক্ষণ চুপ করেছিল।
একটু পরে শাশুড়িই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘কই কী বলবে বাছা, বলো?’
মাথা নীচু করে খুব মৃদু গলায় বউটি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনার ছেলের নাকি আবার বিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন?’
শাশুড়ি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তা আর কী করব বাছা! তুমি তো পারলে না সংসারে শান্তি আনতে। এত বছর বিয়ে হল, কোলে একটা কিছু এল না। আর যে আনবে এমন সম্ভাবনাও কম। কাজেই, বংশরক্ষার কথা তো ভাবতেই হবে।’
বহু কষ্টে চোখের জল ঠেলে বউটি উঠে পড়েছিল। শোবার ঘরে ঢুকে আর পারেনি নিজেকে সংযত করতে। কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। চোখের জল মোছেনি। শাশুড়ি কান্নার শব্দে ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়াতে পারেন, সে কথা একবারও ভাবেনি। এত সব ভাববার অবকাশ ছিল না। পায়ের তলা থেকে আচমকা মাটি সরে গেলে যেমন নিরালম্ব অবস্থা হয়, বউটির অবস্থা ঠিক তেমনই হয়েছিল।
এতদিন যে কথাটি বউটির আড়ালে ফল্গুস্রোতের রূপ নিয়েছিল, আন্দাজে শুধু স্বরূপ বুঝতে হয়েছিল বউটিকে, সেই কথাটা গোপনতার বোরখা খুলে একেবারে মুখোমুখি দাঁড়াল।
তার মানে এ সংসারে আর কেউ বউটিকে চায় না। সংসার ভালোবাসে, ছায়া দেয়, পরিবর্তে প্রতিদান চায়। পুরুষ অর্থ দিয়ে তাকে পরিপূর্ণ করবে। নারী দেবে নিজের হৃদয়ের অংশ। নিজের মমতা আর পুরুষের পৌরুষ মিশিয়ে নতুন যে সত্ত্বার আবির্ভাব হবে তাকে পৃথিবীতে আনার দায়িত্ব নারীর।
এ প্রতিদান বউটি দিতে পারেনি, তাই সংসারের বিরাট চাকার তলায় তার পিষ্ট হওয়া ছাড়া অন্য গতি নেই।
শিবানী এবারে হন হন করে বেশ কিছুটা এগিয়ে এল। পায়ে চলা পথটার কাছাকাছি।
ঠিক দরজার ওপারে তুলসী মঞ্চ। রোজ সন্ধ্যায় তার তলায় প্রদীপ রেখে আঁচল জড়িয়ে বউটি প্রণাম করত। বিয়ের পর স্বামীর মঙ্গল কামনা করত। সংসারের উন্নতি, তারপর রোজ সন্ধ্যায় শুধু এক প্রার্থনা।
সে সন্তানবতী হতে চাইত; তার সামর্থ স্বল্প, বিত্ত প্রায় শূন্য, তবু তার যা আছে, যতটুকু আছে, দেবতাকে অর্পণ করবে, শুধু পরিবর্তে একটি প্রার্থনা। তরু ফলবতী হোক।
বউটি বুক চিরে রক্ত দেবে, হাতের ক্ষয়ে যাওয়া চুড়ি দুটো বাঁধা দিয়ে, বেচে ঠাকুরের পুজো দেবে। নতুন অতিথির কলঝংকারে শুধু এ সংসার মুখরিত হোক।
বন্ধ্যা নারীর প্রার্থনাও বন্ধ্যা হল।
আরও কঠোর হল সংসার। সংসারের লোকগুলো মুখের ওপর নিস্পৃহতার মুখোশ টেনে দিল।
প্রত্যেক শনিবারেই বাসবের অফিস থেকে ফিরতে দেরি হত। কোনো একদিন রবিবার বিকালেও বেরিয়ে যেত। ফিরে এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে মা-বেটায় চাপা গলায় ফিসফিস কথাবার্তা।
বন্ধ দরজায় কান পেতে বউটি শোনবার চেষ্টা করত। কিছু শুনতে পেত, বেশিরভাগই পেত না। যেটুকু পেত না, সেটুকু কল্পনার রূপ মিশিয়ে উজ্জ্বল করে তোলার চেষ্টা করত।
ভাবী সংসারের ছবি যত উজ্জ্বল হয়ে উঠত, বউটির মনের ছবি সেই পরিমাণে বিবর্ণ।
অবশেষে কাল রাত্রি এল।
খাওয়াদাওয়ার পর বউটি ঘরে ঢুকেই দেখেছিল, বাসব জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট থেকে ক্ষীণ ধোঁয়া উঠছে কুণ্ডলী পাকিয়ে।
বউটি ঘরে ঢুকতেই বাসব ঘুরে দাঁড়াল।
‘বসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।’
‘আমার সঙ্গে?’ ভয়ার্ত, ক্ষীণ কণ্ঠে বউটি অন্ধকার বিছানার এক কোণে বসেছিল। পা দুটি ঝুলিয়ে।
একটামাত্র চেয়ার, যে চেয়ারটাকে টেনে তক্তপোশের কাছাকাছি বাসব নিয়ে গিয়েছিল। হাতের সিগারেটটা ছুড়ে বাইরে ফেলে দিতে দিতে বলেছিল, ‘লুকোচুরি করে আর লাভ কী! কথাটা তোমার জানাই দরকার।’
বউটির মনে হয়েছিল, আস্তে আস্তে সব দুলছে। তক্তপোশ, ঝোলানো বাতি, চেয়ার, চেয়ারে বসা মানুষটা পর্যন্ত। ক্লান্ত দুটি দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল। না, বাসবের দিকে নয়— জানলার বাইরে জমে-থাকা গাঢ় তমিস্রার দিকে। যে তমিস্রা ওর ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতীক।
‘অনেক ভেবে দেখলাম, এ ছাড়া আমার আর পথ নেই। গোটা সংসারটা তো আর নষ্ট করা যায় না এইভাবে। মারও খুব ইচ্ছা নাতির মুখ দেখেন, আর আমিও—’
‘তুমি, তুমি কী ভাবো? একটা নিরাপরাধ দুঃখিনী মেয়ের জীবনে এইভাবে অশান্তির দাবানল জ্বালাবে!’
এত কথা শুধু বউটির মনেই এসেছিল, ঠোঁট দুটো থর থর করে কেঁপে উঠেছিল। একটি কথাও সে বলতে পারেনি।
বাসবই বলেছিল, ‘তোমার আর কী অসুবিধা! দুজনে থাকবে দুই বোনের মতো। আগেকার দিনে তো এমন হত। তোমাকে তো আর কেউ অযত্ন অবহেলা করছে না।’
না, তা কেউ করবে না। কেবল রাত হলেই শাশুড়ির সঙ্গে শুতে হবে এক বিছানায়। সারাটা রাত নিদ্রাহীন শরশয্যায় বিছানা করতে হবে। নতুন বউটিকে স্বামীর কাছে এগিয়ে দিয়ে, নিজেকে সরে দাঁড়াতে হবে।
তারপর, তারপর, ক্ষণেকের জন্য বউটির দুটি চোখ জ্বলে উঠেছিল, যদি কোলে সন্তান আসে নতুন বউটির, তাহলে এ সংসারের জীর্ণ আবর্জনার সমগোত্র হয়ে বউটি সারাজীবন একপাশে পড়ে থাকবে।
কোনো অসুবিধা নেই। দু-বেলা দু-মুঠো অন্ন, আর পরনের বাস, এটুকু দিতে এ সংসার কখনো হয়তো কার্পণ্য করবে না। তা হলে আর কীসের দুঃখ বউটির?
সে রাতে অনেকক্ষণ পর্যন্ত বাসব অনেক কিছু বউটিকে বুঝিয়েছিল, কথাবার্তার ফাঁকে একবার তার গায়েও হাত রেখেছিল, কিন্তু শীতল স্পন্দনহীন একটা দেহের ওপর বেশিক্ষণ হাতটা রাখতে পারেনি।
চোখে আঁচল চাপা দিয়ে বউটি সারাক্ষণ শুধু ভেবেছে, এ সংসারে তার ভূমিকা শেষ, এবার সে কোথায় যাবে? এ কালামুখ লুকাবে কোন অন্ধকারে?
শিবানী দরজা পার হয়ে উঠানে এসে দাঁড়াল। অনেক দিন পর সে এ বাড়িতে ঢুকেছে। কিন্তু কিছুই নতুন বলে মনে হচ্ছে না। পাঁচিলের গায়ে ঘুঁটের সার। উঠানের কোণ ঘেঁষে আগাছার ঝোপ। সিঁড়ির তলায় কাঠকুটোর স্তূপ। ভাঙা চেয়ার থেকে শুরু করে টেবিলের পায়া, ঝুড়ি, চুবড়ি, চেরাকাঠের জঞ্জাল।
আর একবার ওপরের দিকে শিবানী চেয়ে দেখল। আলো জ্বলছে। মিটমিটে আলো, তারই ম্লান ছায়া জামরুল গাছের পাতাগুলোর ওপর পড়েছে।
সেদিন এই উঠানটাই সাজানো হয়েছিল, পাড়ার পুরুষেরা এসে জড়ো হয়েছিল। মেয়ের দল এসেছিল শাঁখ ঘণ্টা হাতে। বাসবের অন্তরঙ্গ যারা, তারা এগিয়ে গিয়েছিল স্টেশন পর্যন্ত। বর বধূকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে।
সে রাতে বউটির বিশেষ খোঁজ পড়েনি। সে যে আনন্দমুখর এই জনতার মধ্যে থাকবেই না, এটুকু সকলের জানা ছিল। বেচারি হয়তো অন্ধকারের মধ্যে কোথাও চুপচাপ বসে আছে, কিংবা মুখ ঢাকা দিয়ে বিছানায় পড়ে আছে।
মোট কথা, বউটি কোথায় সেদিকে কারোর বিশেষ আগ্রহ ছিল না। সবাই উঁকি দিচ্ছিল স্টেশনের রাস্তার দিকে। কখন আমবাগানের ফাঁকে অনেকগুলো আলো দেখা যাবে। অনেকগুলো কণ্ঠের সম্মিলিত কলরব।
বউটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল অনেক পরে।
এঁটো বাসনের স্তূপ নিয়ে কামিনী ডোবার কাছ বরাবর গিয়েই চিৎকার করে উঠেছিল, পথের ওপরে বাঁশে একটা হ্যারিকেন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আলো হয়তো খুব জোর নয়, কিন্তু সেই আলোতেই বেশ দেখা গেল।
‘ওগো মাগো!’ কামিনীর চিৎকার, সঙ্গে সঙ্গে বাসনের ঝনাৎকার।
খুব ঘটার বিয়ে না হলেও, বড়িতে বাড়তি লোক কিছু ছিলই। তারা ছুটে এসে দাঁড়াল। একবার উঁকি দিয়ে পুরুষরা সরে গেল। মেয়েরা পালটা চেঁচামেচি শুরু করল।
লোকের পিছনে বাসবও এসে দাঁড়িয়েছিল, দুটো চোখ বিস্ফারিত করে সেও দৃশ্যটা দেখেছিল।
এতটা কিন্তু কেউ আশা করেনি। ছেলেও নয়, ছেলের মাও না।
বউটি অসুখী, এমন একটা ব্যাপারে সেটাই স্বাভাবিক। স্ত্রীলোক সব দিতে পারে, সবকিছুর ভাগ, কেবল স্বামীর ভাগ ছাড়া। কিন্তু তা বলে মাদার গাছের নীচু ডালে পরনের শাড়ি বেঁধে এভাবে নিজেকে শেষ করবে— এ কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি!
এমন নির্লজ্জ কী করে হতে পারল বউটি! নাকি, নিজের যৌবনপুষ্পিত দেহ সকলের সামনে উন্মোচিত করে প্রমাণ করতে চেয়েছিল, এ বন্ধ্যাত্ব তার দোষ নয়। পীন পয়োধর, ক্ষীণ কটি, গুরু ঊরু, নারীর সমস্ত ঐশ্বর্যের সে অধিকারিণী। সংসার তাকে বঞ্চনা করেছে, সংসারের মানুষ প্রতারিত করেছে তাকে। অকারণে তাকে সংসারচ্যুত করেছে বিনা দোষে।
সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিল নতুন বউ সুরমা। উন্মুক্ত অবারিত নারীদেহের দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারেনি, কিন্তু যখন বউটির দেহ নামিয়ে, পুলিশের ঝামেলা মিটিয়ে লালপাড় শাড়ি পরিয়ে, সীমন্তে সিঁদুর পায়ে আলতা দিয়ে বাঁশের শয্যায় শোয়ানো হয়েছিল, তখন সুরমা নিষ্পলক নেত্রে চেয়ে চেয়ে দেখেছে। অন্য সব স্ত্রীলোকের সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ে পায়ের ধুলো নিয়েছে। স্বীকার করেছে, আজকের উৎসব সুরমাকে কেন্দ্র করে হবার কথা, কিন্তু ওই নিষ্প্রাণ চন্দনচর্চিত বিয়ের সাজে সজ্জিতা মহিলাটি উৎসবের সবটুকু আনন্দ অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। আজ সে নিজেকে নিঃশেষ করেও বিজয়িনী।
তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে শিবানী ওপরে উঠে এল। কেউ কোথাও নেই। তাতে তার কোনো অসুবিধা নেই। সিঁড়ির প্রত্যেকটি ধাপ তার চেনা, বাড়িঘরের প্রতিটি জানলা, দরজা।
তারস্বরে শিশুটি চেঁচিয়ে চলেছে। ধারে-কাছে কেউ নেই। শাশুড়ি ভিনগাঁয়ে বোনের বাড়ি আজ সকালে গেছেন গোরুর গাড়ি করে। ইদানীং ছানি কাটিয়ে অনেকটা সমর্থ হয়েছেন। এদিক-ওদিক যাওয়া-আসা করেন।
বাসব এখনও ফেরেনি। আজকাল তার ফিরতে বেশ রাত হয়, এটা শিবানী লক্ষ করেছে। অফিসের পরেও একটা টিউশনি করে। শুধু মাইনের হাওয়ায় সংসার তরণী অচল। পালে বাড়তি হাওয়ার জন্য বাড়তি রোজগারের প্রয়োজন। ছোট্ট একটা বাড়তি প্রাণী হলে হবে কী! তার ঝঞ্ঝাট অনেক। সুরমার বুকে দুধ নেই, কাজেই নানা ধরনের ফুডের প্রয়োজন। প্রসবের পর থেকেই আনুষঙ্গিক নানা ব্যাধিতে শরীর দুর্বল। দেহে রক্ত নেই, কালি পড়েছে দু-চোখের কোণে। একটু চলতেই বুক চেপে হাঁপাতে থাকে। একটা বউ গেছে দুর্বার স্বাস্থ্য নিয়ে, আধিব্যাধির বালাই তার ছিল না। কিন্তু এ বউয়ের দাম অনেক বেশি। এর কল্যাণে বংশরক্ষা হয়েছে। সোনার চাঁদ এসেছে। এ বউয়ের প্রাণের মূল্য অনেক। তাই ডাক্তার আসছে, কবিরাজ আসছে। অফিস ফেরত বাসব দু-হাতে রোজ ওষুধের পোঁটলা বয়ে আনছে।
ওপরে উঠে শিবানী চৌকাঠের কাছে দাঁড়াল। ঘরের এককোণে ছেলেটি শুয়ে চেঁচাচ্ছে। নকশা-কাটা কাঁথা, লাল রং-এর দুটো বালিশ। চুলগুলো ঝুঁটি করে বাঁধা লাল ফিতে দিয়ে। কপালের এককোণে কাজলের ফোঁটা। এর অর্থ শিবানী অজানা নয়। কুনজর যেন না পড়ে, খারাপ বাতাস না লাগে— কোনো অমঙ্গল না হয় শিশুর।
সুরমা নেই। সুরমা কোথায় গেছে! শিবানী জানে। পিছনের পুকুরে গা ধুতে গেছে। যাবার সময় ছেলেটাকে হয়তো ঘুম পাড়িয়েই গিয়েছিল। হঠাৎ জেগে উঠেছে। ধারে-কাছে কাউকে না-পেয়ে চিৎকার শুরু করেছে।
এ কান্না সুরমার কানে যাবার কথা নয়। বাড়ির দরজা জানলা সব বন্ধ। বৃষ্টির জন্য সুরমা সম্ভবত বন্ধ করে দিয়েছে।
কিন্তু শিবানীর কানে ঠিক গেছে। দেড় বছর ধরে এমনই এক সুযোগের প্রতীক্ষায় সে ছিল। ধারে-কাছে কেউ থাকবে না। অসহায় শিশু শুধু থাকবে অরক্ষিত অবস্থায়। ছোট্ট একটা মাংসপিণ্ড। ক্রন্দন সম্বল, নিস্তেজ, কিন্তু তবু শক্তি কম নয়! একটা নারীর জীবনের গতি ঘুরিয়ে দিল। একজনের অস্তাচলের রং নিয়ে আর একজনের উদয়াচল রাঙাল।
এ শত্রুকে পরমায়ু ভিক্ষা শিবানী দেবে না।
আস্তে আস্তে এগিয়ে শিবানী একেবারে শিশুর গায়ের কাছে দাঁড়াল। একটা পা তুলল। শিশুর ক্রন্দন এখনই থেমে যাবে। এই মুহূর্তে। একেবারের চিরদিনের মতন।
পা দিয়ে শিশুর গলাটা চাপতে গিয়েই শিবানী থেমে গেল। চোখে পড়ল দেয়ালের ফোটোটার ওপর।
শিবানীর ফোটো। সীমন্তে সিঁদুর, সিঁদুর পায়ের কাছে। ফোটোতে টাটকা ফুলের মালা। বোধ হয় বিকালেই দেওয়া হয়েছে। শিবানী চমকে উঠল।
তারই ফোটোর সামনে সুরমা এভাবে শিশুটিকে শুইয়ে রেখেছে? শিবানী ভেবেছিল এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সে মুছে গেছে। ওই বাড়ির বাসিন্দাদের মনে তার স্মৃতির ছায়া মাত্রও নেই। পরাজিত, নিষ্পাপ সত্ত্বাকে কেউ মনে রাখে না।
কিন্তু সুরমা আজও তাকে স্মরণ করে। কে জানে বাসবও কোনোদিন এ ছবির সামনে এসে দাঁড়ায় কিনা!
নতুন জীবন উপভোগ করতে করতে পুরোনো কোনো কথা, কোনো চিন্তা সামান্য ঢেউ তোলে কিনা মনের সায়রে।
সবচেয়ে বড়ো কথা, যে স্বাদ সংসারে থাকতে শিবানী পায়নি, তার ক্ষোভ, তার তৃষ্ণা মেটাবার জন্যই বুঝি রক্তমাংসের এই ঢেলাটাকে দুজনে মিলে তার প্রকৃতির সামনে রেখে দিয়েছে। তার ভালোবাসা, তার ঘৃণাকে রক্ষা করবে এই সম্ভাবনায়।
শিবানী পা তুলে নিল। দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠোনে এসে দাঁড়াল।
আশ্চর্য, পরিপূর্ণ এই সংসার থেকে চলে যেতে শিবানীর মন যেন উঠছে না, কিন্তু তবু যেতে হবে।
অনেক দূরে। এই শিশুর অসহায় কান্না যেখানে পৌঁছাবে না। তৃপ্তির সমুদ্রে প্রতিহিংসার নীল ফসফরাস আর তাকে কোনোদিন চঞ্চল করবে না।
শিবানী সদর দরজা পার হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।