অলৌকিক

অলৌকিক

বি কম পাশ করেছি আজ বছর দুয়েক। তারপর থেকে অফিসে অফিসে ঘুরে তিন জোড়া চটি ছিঁড়ল, কিন্তু চাকরি জুটল না। বড়ো, মেজো, ছোটো সব অফিস ঘোরা শেষ। সব জায়গায় এক কথা। দুঃখিত, এখানে কোনো কাজ নেই। বেশ কয়েকটা অফিসে সদর দরজায় মস্ত বড়ো নোটিস লটকানো। নো ভ্যাকেন্সি।

নিতান্ত বাপের পেনসনটুকু ছিল বলে অনাহারে দিন কাটাতে হয়নি। কোনোরকমে দু-বেলা একটা তরকারি ভাত জুটে যেত।

টিউশনির অনেক চেষ্টা করেছি। পাইনি। আজকাল স্কুলের শিক্ষক ছাড়া কেউ টিউটর রাখতে চায় না। শুধু পড়ানো নয়, প্রশ্নপত্রও যাতে জানা যায়।

এইরকম যখন অবস্থা, তখন অদ্ভুত এক কাণ্ড ঘটল। এমন অদ্ভুত যে এত বছর পরে ঘটনাটা মনে হলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে ভাবি, সত্যিই কি এটা ঘটেছিল!

পার্কে একটু বিশ্রাম করে আবার চাকরির সন্ধানে বের হলাম। বড়ো রাস্তা ছেড়ে স্যাঁৎসেঁতে গলিতে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ছোটো ছোটো অফিসে ঘোরা শুরু করলাম।

একটা খুব পুরোনো বাড়ি। ফাটা নল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শ্যাওলায় ইটগুলো সবুজ হয়ে গেছে। সিঁড়ির অনেকগুলো ধাপ ভাঙা। সামনে মাঝারি একটা সাইনবোর্ড। জেনারাল ট্রেডিং কোম্পানি।

জানি কিছু হবার নয়, তবু বরাত ঠুকে সাবধানে সিঁড়ি দিয়ে উঠে পড়লাম।

প্রথমে চোখে কিছু দেখতে পেলাম না, এত অন্ধকার। তারপর চোখ দুটো অন্ধকারে অভ্যস্ত হতে দেখতে পেলাম দু-চার জন লোক ঘোরাঘুরি করছে। সকলের মাথায় টুপি।

খুব কম পাওয়ারের আলো এদিক ওদিক জ্বলছে।

আমাকে দেখে একটা লোক এগিয়ে এল। কাছে আসতে বুঝতে পারলাম, লোকটা গুজরাটি।

অন্য সব লোকগুলোও গুজরাটি। এটা বোধ হয় গুজরাটিদের অফিস।

লোকটা জিজ্ঞাসা করল, কী চাই?

করুণ কণ্ঠে বললাম, একটা চাকরি।

আমাকে অবাক করে দিয়ে লোকটা বলল, আসুন আমার সঙ্গে।

লোকটার পিছন পিছন একটা পার্টিশন ঘেরা কামরায় ঢুকলাম।

ছোটো একটা টেবিল। তার ওপাশে শীর্ণকায় একটি লোক। তার মাথাতেও টুপি। ঝুঁকে পড়ে একটা চিঠি পড়ছিল।

মুখ তুলে বলল, কী?

আমার সঙ্গের লোকটি বলল, ভদ্রলোক চাকরির জন্য এসেছেন।

লোকটি হাত বাড়াল, দরখাস্ত।

দরখাস্ত দিলাম।

পড়ে নিয়ে বলল, আপনি গ্র্যাজুয়েট। ঠিক আছে, আমরা আপাতত দেড়-শো টাকা দেব। যদি টিকে থাকতে পারেন তো দেখা যাবে।

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না। মনে হল ভুল শুনেছি। তখন আমার এমন অবস্থা, পঞ্চাশ টাকার চাকরি পেলে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করতাম।

কি রাজি?

সঙ্গেসঙ্গে আমি মাথা নাড়লাম।

লোকটা বেল বাজাতে একটা বেয়ারা এসে ঢুকল।

বেয়ারাকে দেখে মনে হল, গুজরাটি নয়, উড়িয়া।

মেটাভাইকে ডেকে দাও।

মেটা কামরায় ঢুকতে বলল, এঁকে একটা নিয়োগপত্র দিয়ে দাও। দেড়-শো টাকা মাইনে। প্যারেকের জায়গায় চাকরি করবে।

মেটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ দেখল, তারপর বলল, আসুন।

বাইরে এলাম।

আপনি ওই চেয়ারাটায় ততক্ষণ বসুন। আমি আপনার নিয়োগপত্র দেবার ব্যবস্থা করছি।

একেবারে কোণের দিকে একটা টেবিল। পিছনে চেয়ার। টেবিলের ওপর দোয়াত, পেনসিল, কলম, কাচের টেবিলচাপা।

ওই চেয়ারে বসে পড়ুন।

আমি চেয়ারে বসতে গিয়েই লাফিয়ে উঠে পড়লাম। কে যেন চেয়ারে বসে রয়েছে। আমি তার কোলের ওপর বসে পড়েছি।

উঠে দাঁড়িয়েই আশ্চর্য হলাম। চেয়ার খালি। কেউ তো নেই। তবে!

বুঝতে পারলাম আমারই ভুল। চাকরি পাবার আনন্দে মাথার গোলমাল হল নাকি!

আবার চেয়ারে বসলাম। এক ব্যাপার। কিন্তু এবার আর আমি উঠলাম না। চেপে বসে রইলাম।

স্পষ্ট দেখলাম, আশপাশে দাঁড়ানো গুজরাটি বাবুদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। আস্তে আস্তে তারা যে-যার জায়গায় ফিরে গেল।

যথাসময়ে নিয়োগপত্র হাতে এল।

বাড়ি ফিরে প্রথমেই বাবার কাছে গেলাম। বারান্দায় পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বাবা আর মা। রোজই আমার অপেক্ষায় এভাবে বসে থাকেন।

চাকরি পাবার খবরটা দিতেই দু-জনে কিন্তু বলে উঠলেন, তোমার মাথায় ওটা কী?

মাথায়? মাথায় আবার কী হল?

বারান্দার একদিকের দেয়ালে একটা আয়না টাঙানো ছিল। তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে গেলাম।

আমার মাথায় পুরোনো একটা গুজরাটি টুপি।

আশ্চর্য কাণ্ড, এ টুপি আমার মাথায় এল কী করে?

সহকর্মীদের কেউ রসিকতা করে মাথায় পরিয়ে দিয়েছে? কিন্তু আমার মাথায় পরিয়ে দিল আর আমি টের পেলাম না।

টুপিটা খুলে ঘরের কোণে ফেলে দিলাম।

দিন পাঁচ ছয় অফিসে যাবার পর অনেক কিছু জানতে পারলাম। জানতে পারলাম আমি যে চেয়ারে বসি, সে চেয়ারে আগে প্যারেক বসত। কাজ করতে করতে প্যারেক ওই চেয়ারে বসেই মারা গেছে।

অফিসের সকলের ধারণা প্যারেক এখনও ওখানে বসে।

প্রথম দিন চেয়ারে বসতে গিয়েই মনে হয়েছিল আর কেউ যেন বসে রয়েছে। কিন্তু ওই এক দিনই। তারপর আর কিছু টের পাইনি।

পরে আমার একথাও মনে হয়েছিল যে অফিসে আমি একমাত্র বাঙালি বলে অন্য সবাই আমাকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চায়।

কিন্তু আমার ভুল ভাঙল।

মাথা নীচু করে কাজ করছিলাম, হঠাৎ টুং করে শব্দ।

মুখ তুলে দেখি, টেবিলের ওপর যে জল ভরতি কাচের গ্লাস ছিল সেটা শূন্যে উঠে একটু কাত হল। অর্ধেকের বেশি জল শেষ হয়ে গেল। ঠিক মনে হল পাশে দাঁড়িয়ে কে যেন জল খেল।

আমি ভীতু এমন অপবাদ কেউ কখনো দেয়নি। বরং সবাই আমাকে ডানপিটে বেপরোয়া বলেই জানে। কিন্তু চোখের সামনে ব্যাপারটা দেখে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। বুকের স্পন্দন দ্রুততর হল।

শুধু কি এই! লেজারে দাগ দেব বলে লাল পেনসিলটা যেমনি তুলতে গেছি, অমনি চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিতে হয়েছে। কে যেন আগেই পেনসিলটা আঁকড়ে ধরেছিল।

আমার পাশে মানুভাই বসত। বয়সে প্রায় আমারই সমান।

ছুটির পর তাকে সব কিছু বললাম।

সে মন দিয়ে সব শুনে বলল, প্যারেক এখনও অফিসের মায়া কাটাতে পারেনি। কী করেই বা পারবে, লোকটার অফিস অন্ত প্রাণ ছিল। রোজ আটটা ন-টা পর্যন্ত অফিসে বসে থাকত।

কী বলব, সব শুনে গেলাম। এতদিন আমার ধারণা ছিল মানুষ মৃত্যুর পরেই ছাই হয়ে যায়। তার আর অস্তিত্ব থাকে না। কিন্তু চোখের সামনে অলৌকিক কাণ্ড দেখে আমার ধারণা বদলে যাচ্ছে।

নিজের মনকে বোঝালাম। আত্মা থাক বা না থাক আমার জানবার কোনো দরকার নেই, আত্মা থাকলেও সে তো আমার কোনো অনিষ্ট করছে না। কাজেই আমার চাকরি ছাড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষ করে এত কষ্টে সংগ্রহ করা চাকরি।

এরপর ব্যাপার চরমে উঠল।

ম্যানেজার ডেকে বলল, আজ অফিসের পর থেকে আপনি লেজারটা সব লিখে ফেলবেন। কাল সকালে অডিটর আসবে। বেয়ারাও থাকবে আপনার সঙ্গে।

পুরো লেজার লেখা মানে প্রায় ঘণ্টা তিনেকের ব্যাপার। অফিস ছুটির পর নেমে গিয়ে সামনের দোকানে কিছু খেয়ে যখন ফিরে এলাম, তখন অফিস খালি। শুধু একটা টুলে বেয়ারা বসে আছে।

আমাকে দেখে বেয়ারা বলল, বাবু, আপনি তাহলে কাজ শুরু করুন, আমি বাড়ি থেকে খেয়ে আসি। আমার বাড়ি খুব কাছেই। আপনি আটটা অবধি তো আছেন। তারমধ্যেই আমি ফিরে আসব।

বেয়ারা চলে গেল।

আমি লেজার খুলে বসলাম। কতক্ষণ কাজ করেছিলাম খেয়াল নেই, হঠাৎ খট খট শব্দ হতে মুখ তুলে দেখেই আর চোখ নামাতে পারলাম না।

ঠিক অফিসের মাঝখানে একটা কঙ্কাল মূর্তি হেঁটে বেড়াচ্ছে। মাথায় কালো টুপি। দুটো হাত পিছন দিকে। এদিক থেকে ওদিক আবার ওদিক থেকে এদিক। ঠিক যেমন ভাবে পরীক্ষার সময় গার্ডরা পায়চারি করে, ঠিক তেমনি।

পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ দুটো মুছে নিয়ে ভালো করে দেখলাম। সেই এক দৃশ্য। কঙ্কাল মূর্তি পায়চারি করছে। এক ভাবে।

কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠল। হাত অসাড়। লেজারের পাতায় একটি আঁচড়ও পড়ল না।

ভাবলাম, চাকরি মাথায় থাক। কোনোরকমে বের হতে পারলে আর কোনোদিন এ মুখো হব না।

কিন্তু যাবার উপায় নেই। ঠিক বের হবার মুখে কঙ্কাল মূর্তি বেড়াচ্ছে। তার কাছাকাছি যাবার সাহস আমার নেই।

ভয়ে ভয়ে জলের গ্লাসটায় চুমুক দিলাম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসছিল।

একটু পরেই কঙ্কাল মূর্তি আর দেখতে পেলাম না। যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমন হঠাৎই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

হাতঘড়ি দেখলাম, প্রায় এক ঘণ্টা চুপচাপ বসে আছি। কাজ অনেক পিছিয়ে গেল। তার মানে আরও এক ঘণ্টা দেড় ঘণ্টা বেশি থাকতে হবে।

কী আশ্চর্য, যতক্ষণ কঙ্কাল মূর্তিটা চোখের সামনে ছিল, বেশ ভয় ভয় করছিল। এখন মূর্তিটা সরে যেতেই সাহস ফিরে এল।

কাজে হাত দিলাম।

লেজারে কলম ঠেকাতে গিয়েই চমকে উঠলাম। যেটুকু লেখা বাকি ছিল, অচেনা হাতের লেখায় সব ভরতি হয়ে গেছে। তার মানে আমার বাকি কাজটুকু কে করে দিয়েছে। এ হাতের লেখা আমার নয়, সে বিষয়ে আমি স্থির নিশ্চয়। শুধু লেখাই নয়, প্রত্যেক পাতার শেষে যোগফল পর্যন্ত লাল কালিতে লেখা।

আটটার একটু আগে বেয়ারা এসে হাজির।

আমি তাকে বললাম, আমার কাজ শেষ। তুমি অফিস বন্ধ করে দাও।

রাস্তায় এসে বেয়ারা জিজ্ঞাসা করল, বাবু, কিছু দেখলেন নাকি?

আমি চেপে গিয়ে উত্তর দিলাম, না, কি দেখব?

বেয়ারা আর কিছু বলল না।

পরের দিন অফিসে আসতেই বেয়ারা এসে দাঁড়াল। লেজার বইটা নিয়ে ম্যানেজারবাবু আপনাকে যেতে বলছেন।

বুঝতে পারলাম অডিটর বোধ হয় এসে গেছে। হিসাব দেখার কাজ শুরু হবে।

লেজার বই নিয়ে ম্যানেজারের ঘরে ঢুকলাম। অডিটর নেই। ম্যানেজার একলাই বসে আছে।

আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, কি, সব লেখা হয়ে গেছে?

হ্যাঁ। বলে লেজারটা এগিয়ে দিলাম।

ম্যানেজার লেজারের পাতা ওলটাতে লাগল। কয়েকটা পাতা উলটেই বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বলল, একী, এ কার হাতের লেখা?

কার হাতের লেখা আমার জানা নেই, তাই কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।

ম্যানেজার আস্তে আস্তে বলল, কী আশ্চর্য, এ তো অবিকল প্যারেকের হাতের লেখা। এ লেখা আপনি পেলেন কী করে?

কীভাবে ও লেখা লেজারের পাতায় এল বললাম।

ম্যানেজার সব মন দিয়ে শুনল। কোনো কথা অবিশ্বাস করল না।

বলল, আপনি নিশ্চয় এতদিনে বুঝতে পেরেছেন এ অফিসে প্রেতাত্মার উপদ্রব আছে। প্রেতাত্মা মানে প্যারেকের আত্মা এখনও এ অফিসের মায়া কাটাতে পারেনি। আপনি যে চেয়ারে বসেন সেই চেয়ারে বসে কাজ করতে করতেই প্যারেক হার্টফেল করেছিল। প্যারেকের জায়গায় দু-তিন জন লোককে নেওয়া হয়েছিল, কেউ তিন দিনের বেশি টিকতে পারেনি। আপনি তবু দিন কুড়ি রয়ে গেছেন। উপদ্রবের জন্য রাতে কোনো দারোয়ান থাকতে চাইছে না। অন্য বাড়িতে অফিস সরিয়ে নেবার অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু অফিস এলাকায় জায়গা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। পাওয়া গেলেও সেলামি আর ভাড়া এত বেশি যে আমাদের পক্ষে সে টাকা খরচ করা সম্ভব নয়।

আমি একটু ভেবে কথাটা বলেই ফেললাম।

একটা কাজ করলে হয়।

কী বলুন?

শুনেছি গয়ায় পিণ্ডি দিলে প্রেতাত্মা মুক্তি পায়। সে কি করা সম্ভব?

ম্যানেজার দু-এক মুহূর্ত চিন্তা করল, তারপর বলল, চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। যাবেন আপনি?

আমি!

হ্যাঁ, আমি আপনার যাতায়াত আর অন্য খরচ দেব। আপনি ব্রাহ্মণ। আপনিই বরং চলে যান।

কিন্তু প্যারেকের বাপের নাম দরকার হবে।

সে ব্যাপারে কোনো অসুবিধে হবে না। তার নিয়োগের ফাইলেই সব বিবরণ পাওয়া যাবে। আপনি চলেই যান। সামনের শনিবার গিয়ে সোমবার ফিরে আসতে পারবেন।

অগত্যা রাজি হয়ে গেলাম। দুর্ভোগ আমারই বেশি। প্যারেকের জায়গায় আমি এসেছি, কাজেই তার আক্রোশ আমার ওপর বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। গয়ায় পিণ্ডি দিলে যদি আপদের শান্তি হয় তাহলে ম্যানেজার আমার ওপর খুশিই হবে।

সেদিন বুধবার। মাঝখানে দুটো দিন বৃহস্পতি আর শুক্র। এই তিন দিনে হিসাব পরীক্ষার কাজও শেষ হয়ে যাবে।

বুধ বৃহস্পতি দুটো দিন নির্বিবাদে কাটল।

শুক্রবার টেলিফোন এল। যিনি হিসাব দেখতে আসেন, ঠান্ডা লেগে তাঁর একটু জ্বরভাব হয়েছে। তিনি আসতে পারবেন না। আমি যেন খাতপত্র নিয়ে তাঁর অফিসে যাই।

ম্যানেজারের নির্দেশে তাই যেতে হল।

অফিসে ফিরতে সাড়ে ছ-টা বেজে গেল।

ফিরে দেখি, অফিসের দরজায় তালা দিয়ে বেয়ারা বাইরে অপেক্ষা করছে।

আমাকে দেখে বলল, আপনার এত দেরি হল?

সে প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে বললাম, তুমি দরজাটা খোল, আমি খাতাপত্রগুলো রেখে এখনই আসছি।

বেয়ারা দরজা খুলতে ভিতরে ঢুকে খাতাপত্রগুলো আমার টেবিলে রেখে বেরিয়ে এলাম। অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়ল না।

আমি বাইরে আসতেই বেয়ারা দ্রুতহাতে দরজায় চাবি লাগিয়ে তিরবেগে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল।

সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত ছিলাম। আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম।

বাঁকের মুখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল।

কার একটা হাত আমার কাঁধের ওপর এসে পড়ল। আঙুলগুলোয় যেন এক তিল মাংস নেই, ছুরির ফলা বসানো। আমার কাঁধের মাংস ছিঁড়ে যেতে লাগল।

যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতে গিয়েই থেমে গেলাম। দেয়ালের কোণে দীর্ঘ এক কঙ্কাল মূর্তি। দুটি চোখে আগুনের শিখা। মাথায় কালো টুপি।

এগোবার চেষ্টা করতেই কঙ্কালের দাঁতগুলো কড়মড় করে উঠল। বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর। ইংরেজিতে হুংকার।

গয়ায় পিণ্ডি দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে? এ অফিস থেকে আমাকে সরাবার চেষ্টা? এ অফিসের গোড়াপত্তন থেকে আমি আছি। শেষ অবধি থাকবও। কেউ আমাকে উৎখাত করতে পারবে না।

কথার সঙ্গে সঙ্গে কাঁধের ওপর হাতের চাপ আরও জোর। মনে হল যেন মাংস ভেদ করে আঙুলগুলো হাড়ে গিয়ে ঠেকছে। দুঃসহ ব্যথা।

বল, এ দুর্বুদ্ধি ছাড়বি কি না? বল? তোকে খতম করব।

না, না, আমি এসব কিছু করব না। আমি আর ঢুকবই না এ অফিসে। প্যারেক, আপনি আমায় বাঁচান।

কথাটা মনে থাকে যেন।

ঘাড়ে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা। ছিটকে সিঁড়ির নীচে গিয়ে পড়লাম। বোধ হয় অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছিলাম।

যখন চেতনা ফিরেছিল তখন অনেক রাত। কপাল কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কাঁধে কালসিটের দাগ।

হাঁটতে হাঁটতে মাঝরাতে বাড়ি ফিরেছিলাম।

বাড়ি থেকেই চাকরি ছাড়ার দরখাস্ত পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।

ও অফিসে আর যাইনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অলৌকিক

অলৌকিক

অলৌকিক এইভাবে ঘটে।
হঠাৎ একদিন ফাঁক হয়ে যায় সাদাসিধে ঝিনুক,
ভিতর থেকে ঠিকরে বেরোয় সাদা জ্যোৎস্না।

সেদিন মুক্তোর মতো গড়িয়ে এলে আমার হাতে।
অমনি বদলে গেল দৃশ্য।
আমার ডান দিকে ছিল মেঘলা দিন
হয়ে গেল ডালিম-ফাটানো রোদ।
আর বাঁদিকে ছিল ইটের পাঁজা
হয়ে গেল লাল টালির ডাকবাংলো।

অলৌকিক এইভাবে ঘটে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *