অবিশ্বাস্য

অবিশ্বাস্য

বিশ্বাসই হচ্ছে আসল বস্তু। এই বিশ্বাসে ভগবান আর ভূত দুই-ই পাওয়া যায়।

আশ্চর্যের কথা, পৃথিবীতে ভূতে বিশ্বাস করে যত লোক, অবিশ্বাসীদের সংখ্যা তার চেয়ে কম নয়।

যাঁরা অবিশ্বাসী তাঁরা বলেন, ভূত বলে কিছু নেই। ও শুধু চোখের ভুল, মনের ভুল।

বিশ্বাসীরা ঘোরতরভাবে আপত্তি করে, এতগুলো লোকের চোখের ভুল, মনের ভুল কখনো হতে পারে!

এ তর্কের শেষ নেই। মীমাংসাও নয়।

আমি নিজে একটা ঘটনা জানি। এই শহরেরই কোনো এক বাড়ির ব্যাপার। ছেলে খেতে বসেছে, পাতের কাছে ঠক করে একটা শব্দ। রক্তমাখা একটা হাড় এসে পড়ল। বাড়ির প্রৌঢ় কর্তা পূজায় বসেছেন, তাঁর পূজার থালায়, ফুল-চন্দনের ওপর ছর-ছর করে রক্তের ছিটে পড়তে লাগল।

তারপর বাতাস নেই, বৃষ্টি নেই, অথচ হঠাৎ জানালা দরজা খুলে গেল। ছাদের ওপর বৃষ্টিপাতের আওয়াজ। এ তো হামেশাই লেগেছিল।

সে বাড়ি এখন আর নেই। করপোরেশন থেকে ভেঙে ফেলা হয়েছে বড়ো রাস্তা করার জন্য। বাড়ি ভাঙতে দেখা গেল, ভিতের নীচে একটা কবর। কার কবর, কবেকার কেউ জানে না, কিন্তু সকলের ধারণা এটাই বিপদের কারণ।

অবশ্য এ ঘটনা আমার চোখে দেখা নয়। আমার এক শিক্ষকের কাছে শোনা। বিজ্ঞ বয়স্ক লোক, ভূতের মায়াজাল সৃষ্টির জন্য তিনি অযথা কল্পনা করে কিছু বলবেন, এ আমি ভাবতেই পারি না।

আজ তোমাদের যে ঘটনা শোনাব, সেটা আমার নিজের চোখে দেখা। সমবয়সিদের কথাটা বলেছি, তারা মুচকি হেসেছে। বলেছে, ডাক্তার দেখাও হে, তোমার হজমের গোলমাল হচ্ছে।

আমি জানি তোমরা মানুষকে নিরর্থক সন্দেহ করো না। সব কিছু সহানুভূতি দিয়ে বিচার করো। সেই সাহসেই এ কাহিনি তোমাদের বলছি—

আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগেকার কথা। সবে কলেজ থেকে বেরিয়েছি, ইতস্তত চাকরির সন্ধান করছি।

এমন সময় পাড়ার ছেলেরা আমার কাছে এসে হাজির।

‘কী ব্যাপার, এখন তো পূজার মরশুম নয়, তবে কীসের চাঁদা?’

ছেলেরা হাসল।

‘না, চাঁদা নয়। স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে, আমরা অভিনয় করব, একটা বই ঠিক করে দিন।’

বললাম, ‘অভিনয় কেন, নতুন কিছু করো।’

‘কী করব বলুন?’

হঠাৎ মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘জলসা করো। বিচিত্রানুষ্ঠান।’

তখন এ যুগের মতন গলিতে গলিতে সপ্তাহে দুটো করে জলসার রেওয়াজ হয়নি। তাই ছেলেদের বললাম, ‘গান থাকবে, বাজনা থাকবে, আবৃত্তি আর তোমরা যদি চাও দু-একটি নাটকের খণ্ড দৃশ্য অভিনয়ও করতে পারো।’

ছেলেরা খুব খুশি, তবে একটু আপত্তির সুর তুলল।

‘দু-একজন ভালো শিল্পী না থাকলে শুধু আমাদের গান-বাজনা শুনতে কি কেউ টিকিট কিনবে? আমরা লাইব্রেরির জন্য কিছু টাকা তুলতে চাই।’

কলেজে আমাদের বছরে দুটো করে বিচিত্রানুষ্ঠান হত। সেইসব পরিকল্পনা আর আয়োজনের ভার ছিল আমার উপর। বাইরে থেকে গায়ক-গায়িকারা কলকাতায় এলেই আমি যোগাযোগ করতাম। তাঁদের নিয়ে আসতাম কলেজে।

কিন্তু কলেজের অর্থসামর্থ্য ছিল। পাড়ার ছেলেরা কি মোটা টাকা দক্ষিণা দিয়ে এঁদের আনতে পারবে?

ছেলেদের এ কথা কিছু বললাম না। বেচারিরা কষ্ট পাবে। তাই মুখে বললাম, ‘ঠিক আছে, খোঁজ করে দেখি কলকাতায় কে আছে! অন্তত একজনকে আনতে চেষ্টা করব। তোমাদের কবে হবে?’

ছেলেরা তারিখ বলল।

আমি যথাসময়ে বেড়িয়ে পড়লাম।

আগেই খোঁজ নিয়েছিলাম, দু-জন এ সময় শহরে আছেন। লখনউয়ের বেগম আনোয়ার আর ওস্তাদ জামির খাঁ।

এঁদের দুজনের সঙ্গেই যথেষ্ট হৃদ্যতা আছে। অনেকবার কলেজে এসেছেন।

প্রথমে গেলাম বেগম আনোয়ারের কাছে। সব শুনে বেগম বললেন, ‘নিজে এসেছেন বাবুজি, কী আর বলব, কিন্তু আমি আজ রাতেই পাটনা রওনা হচ্ছি।’

‘পাটনা?’

‘হ্যাঁ, গর্দানিবাগে গানের আসর আছে। কথা দিয়েছি, জবান রাখতেই হবে। কসুর মাপ করবেন বাবুজি।’

এরপর আর কী বলব! জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা, ওস্তাদ জামির খাঁ কোথায় আছেন বলতে পারেন? শুনেছিলাম তিনি ভূপাল থেকে এখানে এসেছেন।’

বেগম আনোয়ার বিষণ্ণকণ্ঠে বললেন, ‘জামির খাঁ সাহেব এখানেই আছেন। তবে শুনলাম, তাঁর শরীর খুব খারাপ। আসরে কি আর গান গাইবেন?’

‘দেখি চেষ্টা করে। আপনি ঠিকানাটা বলুন।’

‘সাতের তিন বেনেটোলা লেন।’

বেগম আনোয়ারকে সেলাম জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।

ঠিক জায়গায় ট্রাম থেকে নামলাম।

অপ্রশস্ত গলি। দু-পাশে বস্তির সার। ইতস্তত মুরগির পাল চরে বেড়াচ্ছে।

জরাজীর্ণ বাড়ি। একপাশের দেয়াল ভেঙে পড়েছে। আগাছার ঝোপ। সাদা রং দিয়ে বাড়ির নম্বর লেখা।

শিল্পীর খেয়াল ছাড়া আর কী! নইলে এমন জায়গায় ওস্তাদ জামির খাঁ থাকবেন এটা কল্পনারও অতীত।

উঠানে দাঁড়িয়ে ডাকলাম, ‘ওস্তাদজি, ওস্তাদজি!’

বার তিনেক ডাকার পর ভিতর থেকে ক্ষীণকণ্ঠ ভেসে এল।

‘কে? কে ওখানে?’

ভিতরে ঢুকলাম। ঢুকেই চমকে উঠলাম।

পাতলা একটা ফতুয়া পরনে। গালে দাড়ির ঝোপ। কোটর গত চোখ। ময়লা একটা তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসে আছেন।

‘একী, আপনার চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে ওস্তাদজি!’

ওস্তাদজি ম্লান হাসলেন।

‘শরীরটা ক-দিন খুব খারাপ যাচ্ছে। হাঁপানিতে বড়ো কষ্ট পাচ্ছি।’

একটু ইতস্তত করে আমার কথাটা নিবেদন করলাম।

ওস্তাদজি থেমে থেমে বললেন, ‘আপনি এসেছেন, আপনাকে না বলি কী করে! আপনার হাত দিয়ে অনেক দিন অনেক টাকা পেয়েছি। কলেজের উৎসবে প্রত্যেক বছরেই আপনি নিয়ে গেছেন। কবে আপনাদের অনুষ্ঠান?’

‘সামনের শনিবার।’

‘শনিবার। তার মানে এখনও চারদিন সময় আছে। আপনি তো জানেন আমি মাঝরাতের আগে গান গাই না আসরে। আমি ঠিক রাত বারোটায় যাব। আমার এক দোস্তের মোটরে। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।’

দক্ষিণার টাকা ক-টা ওস্তাদজির সামনে রাখতেই তিনি মাথা নাড়লেন।

‘টাকা আপনি উঠিয়ে নিয়ে যান বাবুজি। আপনি আমার বহুদিনের চেনা লোক। সে রাতেই টাকাটা আপনার কাছ থেকে নেব।’

খুশি মনে উঠে এলাম।

খবরটা দিতেই ছেলেদের মধ্যেও খুশির বন্যা বয়ে গেল।

ওস্তাদ জামির খাঁ বিখ্যাত খেয়াল গায়ক। তাঁর মতো গুণী শিল্পী এই ছোটো অনুষ্ঠানে গাইতে সম্মত হবেন, তা তারা ভাবতেই পারেনি। লাল শালুর ওপর জামির খাঁর নাম লিখে ছেলেরা পাড়ার পথেঘাটে টাঙিয়ে দিল।

অনুষ্ঠানের দিন আমি গেটের কাছে অপেক্ষা করতে লাগলাম। জলসা শুরু হয়েছে সাড়ে ন-টায়, এখন রাত এগারোটা আসরে লোক ভরতি।

জামির খাঁ অসুস্থ মানুষ, আশা করেছিলাম তিনি ঘণ্টা খানেক আগেই আসবেন। একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।

সাড়ে এগারোটা বাজল। পৌনে বারোটা সর্বনাশ, ওস্তাদজির দেখা নেই!

সম্ভবত অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আসতে পারবেন না। কিন্তু এই কথাটা ঘোষণা করলেই চেঁচামেচি শুরু হবে। লোকে ভাববে মিথ্যা স্তোকবাক্য দিয়ে তাদের টিকিট কিনিয়েছি।

শামিয়ানা জ্বালিয়ে দেওয়া বিচিত্র নয়। আমরাও যে অক্ষত থাকব, এমন সম্ভাবনা কম।

বারোটা বাজতে যখন মিনিট দুয়েক, তখন ভিতর থেকে একটি ছেলে এসে বলল, ওস্তাদজি এসে গেছেন।

সেকী, আমি ঘাঁটি আগলে রয়েছি, ওস্তাদজি এলেন কোথা দিয়ে!

ভিতরে গিয়ে দেখলাম, মঞ্চের এক কোণে ওস্তাদজি বসে। সারা শরীরে কালো পোশাক।

আমি প্রশ্ন করার আগেই বললেন, ‘দোস্ত পিছনের রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে গেল। একটু ঘুরপথ। তা আসতে অসুবিধা হয়নি।’

ঠিক বারোটায় ওস্তাদজির গান শুরু হল।

ভালো করে গান শোনবার জন্য আমি আসরে গিয়ে বসলাম।

দুটি খেয়াল গাইলেন। রাগ যোগিয়া আর বৃন্দাবনী সারং।

কী অপূর্ব কণ্ঠলালিত্য, বোঝানো সম্ভব নয়। গান শুনে মনেও হল না ওস্তাদজি অসুস্থ।

আসর থেকে আরও গাইবার অনুরোধ আসতে ওস্তাদজি সেলাম জানিয়ে উঠে পড়লেন।

তন্ময় হয়ে শুনেছিলাম। যখন খেয়াল হল দেখলাম, মঞ্চে একটি তরুণ আধুনিক গান গাইছে। পাড়ারই কোনো ছেলে।

ওস্তাদজির সম্মান দক্ষিণা আমার মুঠোর মধ্যেই ছিল। তাঁকে দেবার জন্য মঞ্চের ভিতর গেলাম।

ওস্তাদজি নেই। কে একজন বলল, শরীর খারাপ বলে গান শেষ করেই চলে গিয়েছেন।

পরের দিন ভোরে সেক্রেটারির মোটরগাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

ওস্তাদজির হাতে টাকাটা দিয়ে আসব আর সেইসঙ্গে তাঁকে ধন্যবাদও দিয়ে আসব, অমন চমৎকার গান করার জন্য।

জামির খাঁর গান আমি আগেও অনেকবার শুনেছি। আমাদের কলেজে, কলেজের বাইরে, কিন্তু কাল রাতের মতন তাঁর গাইবার ঢং, গলার অমন অপূর্ব কাজ কোনোদিন বোধ হয় শুনিনি।

কী লজ্জার কথা, তাঁর মতন একজন উঁচুদরের শিল্পী শহরের নিভৃত কোণে অসুস্থ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন!

মোটরগাড়ি থামল।

উঠানের ওপর একটা বেঞ্চ পাতা। তাতে গুটি তিনেক ভদ্রলোক বসে আছেন।

শিল্পীদের পরিত্রাণ নেই। কাল অত রাতে ফিরেও আবার কোথাও যেতে হবে, কিংবা লোকেরা আগাম বায়না দিতে এসেছেন।

উঠানে দাঁড়িয়ে ডাকলাম—

‘ওস্তাদজি, ওস্তাদজি!’

কোনো সাড়া নেই। খুব সম্ভবত ওস্তাদজি ক্লান্ত হয়ে ঘুমুচ্ছেন। আর একটু বেলা করে এলেই হত।

ভিতরে যাব কিনা ভাবছি, এমন সময় বেঞ্চে বসা একটি লোক এগিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়াল।

‘আপনি কাকে খুঁজছেন?’

‘ওস্তাদজিকে।’

‘কোন ওস্তাদজি?’

‘ওস্তাদ জামির খাঁ। বিখ্যাত খেয়াল গায়ক।’

লোকটি বার কয়েক আমার আপাদমস্তক দেখে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কোথা থেকে আসছেন?’

‘আমি চাঁপাতলা বয়েজ ক্লাব থেকে আসছি। কাল রাতে ওস্তাদজি আমাদের ওখানে গান গাইতে গিয়েছিলেন। শরীর খারাপ বলে তাড়াতাড়ি চলে আসেন। তাই তাঁকে টাকাটা দিতে এসেছি।’

লোকটি আমার মুখের দিকে একটু দেখে হাত নেড়ে বেঞ্চে বসা একটি লোককে ডাকলেন।

তিনি আসতে উর্দুতে তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কী বললেন!

তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘আপনি আসুন আমার সঙ্গে।’

লোকটির পিছন পিছন ভিতরে গেলাম।

একহাতে পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়েই চমকে উঠলাম।

ওস্তাদ জামির খাঁ শুয়ে আছেন। দুটি হাত বুকের ওপর জড়ো করা। চোখ নিমীলিত। বোঝা যায় দেহে প্রাণের লক্ষণ নেই।

লোকটি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘ওস্তাদজির কাল রাত বারোটায় এন্তেকাল হয়েছে। আমরা মৌলভির জন্য অপেক্ষা করছি বাবু।’

রাত বারোটায়! রাত বারোটায় ওস্তাদজি মারা গেলেন?

আস্তে আস্তে পিছিয়ে এলাম। ঘর থেকে উঠানে। উঠান থেকে রাস্তায়। একী সম্ভব! এ তো শুধু আমার চোখের ভুল নয়; অগণিত দর্শক তাঁকে দেখেছে, অগণিত শ্রোতা তাঁর গান শুনেছে।

লিখতে লিখতে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। কত বছর হয়ে গেল, কিন্তু এখনও যেন সমস্ত ঘটনা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।

কী এর ব্যাখ্যা?

জবান রাখবার জন্য ওস্তাদ জামির খাঁর আত্মা আমাদের আসরে গিয়ে গান গেয়ে এসেছিলেন কিনা, এমন প্রশ্ন করো না, এর উত্তর আমার জানা নেই।

তবে এইটুকু জানি, সংবাদপত্রে ওস্তাদজির মৃত্যুর খবর পড়ে আমার মতন বহুলোকই চমকে উঠেছিলেন, যাঁরা সে রাতে আসরে ওস্তাদজিকে দেখেছিলেন, তাঁর দু-খানি অনবদ্য গান শুনেছিলেন।

অনেকেই মনকে বুঝিয়েছিলেন, কাগজে মৃত্যুর সময়টা ভুল লিখেছে।

কিন্তু আমি মনকে কী বোঝাব!

তাই বলছিলাম, বিশ্বাস করো। বিশ্বাস ছাড়া আর পথ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *