মৃত্যুর পরে
পরীক্ষা শেষ। অঢেল অবসর। কী করে সময় কাটাব তাই ভাবছি।
সিনেমার নেশা আমার বিশেষ নেই। খেলা দেখবার শখ একটু আছে। তবে আজকাল খেলা দেখা মানে মারপিট দেখা। শুধু মারপিট দেখাই নয়, মার খাওয়াও। পুলিশ মাঝে মাঝে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। শিক্ষিত ঘোড়া ঠিক পা চালায় মানুষের তলপেট লক্ষ করে। প্রায়ই মনে হয় খেলোয়াড়দের বদলে যদি এইরকম এগারোটা ঘোড়াকে নামিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে বোধ হয় খেলাটা সত্যিই জমে। গোলের কাছে এরকম লুকোচুরি না-করে, জালে বল আটকানোর আসল চেষ্টা হয়।
এইরকম যখন মনের অবস্থা, সারা দিন গল্পের বই পড়ে কাটাচ্ছি, গল্প আর ভালো লাগছে না, তখন এক কাজ ঘাড়ে এসে চাপল।
এর আগে অবশ্য পাড়ার সরকারি কাকা একটা কাজের ভার দিয়েছিলেন, ‘হ্যাঁরে সতে, রকে বসে বসে সময় নষ্ট করছিস কেন? খবরের কাগজও পড়িস না?’
কথাটা বুঝতে পারলাম না।
আমতা আমতা করে বললাম, ‘খবরের কাগজ? হ্যাঁ, পড়ি তো।’
‘ছাই পড়িস!’ সরকারি কাকা মুখে অদ্ভুত ভঙ্গি করলেন, ‘পড়িসনি, ছেলেরা পরীক্ষার পর সব গাঁয়ে গিয়ে সেখানকার লোকদের অক্ষরপরিচয় করাচ্ছে। এতে দেশের কত উপকার হয় বল তো?’
এবারে কোনো উত্তর দিলাম না।
এ ব্যাপারে আমার নিজের খুব তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।
একবার পরীক্ষার পর ঠিক করলাম অশিক্ষিতদের জ্ঞানদান করব। হাতের কাছে ঘরামি হারাধনকে পেয়ে গেলাম। সেইসময় বাড়ির চুনকাম হচ্ছিল। হারাধনকে বললাম, ‘হারাধন, তোমার তো ভারি কষ্ট।’
হারাধন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘খুব কষ্ট দাদাবাবু। কী করে জানতে পারলে? চুলকানিতে সারা গা ভরে গেছে।’
‘আহা, সে কষ্ট বলছি না। এই যে লেখাপড়া জানো না, এর জন্য কষ্ট হয় না?’
‘কষ্ট? তা একটু একটু হয়। লোকে ঠকায়।’
‘তাই তো বলছি, রোজ রাত্রে আমি তোমাকে পড়াব।’
হারাধন যে খুব খুশি হল না, সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা গেল। অবশ্য প্রথম পড়তে বসতে সবাই এইরকম গররাজি হয়।
সে রাতেই প্রথম ভাগ নিয়ে বসলাম। হারাধন মুখ-হাত ধুয়ে এসে বসল। স্বরবর্ণ পার হলাম কোনোরকমে, আটকাল ‘ঞ’-তে গিয়ে। হারধন ‘ঞ’ বলতে পারল না। বলল, মিও।
আমি চটে উঠতে বলল, ‘ওসব বেড়ালের ডাক পারব না দাদাবাবু। ওটা তুমি বাদ দাও।’
‘ঞ’-র বিশেষ সার্থকতা নেই। ওটা বাদই দিলাম।
এরপর আটকালে ‘দ’য়ে। ‘দ’ বলতেই হারাধন হেসে কুটিপাটি। ‘একবার মিত্তিরবাবুদের বাড়ি রং করার সময় মচা ভেঙে একেবারে রাস্তার ওপর পড়েছিলাম। সবাই বলেছিল, আমি হাড়গোড় ভাঙা ”দ” হয়ে গেছি। বাঁচবার আশা ছিল না দাদাবাবু। ওই ”দ”টাও বাদ দাও। আমার সেদিনের চেহারাটা মনে পড়ে যায়।’
এবার আমি বাদ দিতে রাজি হলাম না।
হারাধন হঠাৎ বলল, ‘ওটা কী গো দাদাবাবু?’
আমি দেয়ালের দিকে চোখ ফেরালাম, ‘কোনটা?’
‘ওই যে একটা ফাটল। এইবেলা মোরামত না করলে দেয়াল যে ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে!’
চিন্তিত হলাম। ‘তাহলে কী করা যায়?’
হারাধন অভয় দিল, ‘কোনো ভয় নেই। বাড়িতে বালি, চুন, তো রয়েইছে। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। তুমি আমাকে লেখাপড়া শেখালে, আমি শেখাব বাড়ি মেরামত।’
পাড়ার পার্ট শেষ হল।
কর্ণিক হাতে আমি মিস্ত্রিগিরির প্রথম পাঠ নিলাম। মাস খানেক পরে দেয়াল ভেঙে বালির প্রলেপ। রাতে ঠিক থাকে, সকাল হলেই চুল-সরু ফাটল দেখা যায়। আশা ছেড়ে দিলাম আমি।
হারাধন বলল, ‘আপনার মশলা মেশানো ঠিক হয়নি দাদাবাবু।’
সেই থেকে শিক্ষাদানের ব্যাপারে আমি রীতিমতো শঙ্কিত।
‘জানিস, বিদেশে ছেলেরা কীভাবে ছুটি কাটায়?’ সরকারি কাকার কথায় বর্তমানে ফিরে আসি। ব্যাপারটা জানা ছিল না, তাই সরকারি কাকার কথায় মাথা নাড়লাম।
‘হুঁ।’ নাক দিয়ে সরকারি কাকা ঘোড়ার মতন একটা শব্দ করে বললেন, ‘ভালো খবর জানবি কী করে? কোথায় কী সিনেমা হচ্ছে কণ্ঠস্থ। শোন বলি—’
সরকারি কাকা একেবারে পাশে বসে পড়লেন। তারপর শুরু করলেন, ‘বড়োদিনের সময় ছেলেমেয়েরা সব পোস্টফিসে ঢুকে পড়ে। এইসময় রাশি রাশি উপহারের পার্সেল যাওয়া-আসা করে। বড়োদিনের উপহার। কাজও খুব বেড়ে যায়।’
সরকারি কাকার আরও অমৃত উপদেশ বিতরণ করার ইচ্ছা হয়তো ছিল, কিন্তু পারলেন না, পাড়ার রামদুলাল ঘোষালকে দেখতে পেলেন। ভদ্রলোক বাজার থেকে ফিরছিলেন। সরকারি কাকা রোয়াক থেকে ঝাঁপিয়ে রাস্তায় পড়লেন, ‘এই যে রামদা, নস্যি হবে এক টিপ?’
সরকারি কাকার হাত থেকে পরিত্রাণ পেলাম, কিন্তু চিন্তা থেকে নিষ্কৃতি নয়। সত্যিই তো, এই দীর্ঘ সময় কাটাই কী করে?
আশ্চর্যভাবে কাজ জুটে গেল।
পাশের বাড়ির রেবতীমেসোমশাই এসে দাঁড়ালেন। অমায়িক ভদ্রলোক। মানুষের দায়ে-বিপদে বুক দিয়ে এসে পড়েন। যেমন ভদ্রলোক তেমন তাঁর স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নেই। বসে বসে পত্রিকার পাতা ওলটাচ্ছিলাম। বাবা আর মা দুজনেই ছিলেন। বাবার হাতে চায়ের কাপ। মার হাতে সেলাই। রেবতীবাবু ঢুকলেন টেলিগ্রাম হাতে করে।
বাবা বললেন, ‘কী ব্যাপার!’
রেবতীবাবু ভগ্নকণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘বড়ো বিপদে পড়েছি!’
‘কী হল?’
‘দেশে আমার ভাই থাকে জানেন তো। সেই ভাইয়ের খুব অসুখ, খবর এসেছে।’
‘তাই নাকি?’
‘এর আগের চিঠিতে অসুখের সব বিবরণ ছিল। আমি এখানকার এক বড়ো ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে ওষুধপত্র কিনেছি। ভেবেছিলাম নিজেই নিয়ে যাব, কিন্তু কাল থেকে বাতের ব্যথাটা দারুণ বেড়েছে। চলা-ফেরাই করতে পাচ্ছি না।’
লক্ষ করলাম রেবতীবাবুর হাতে মোটা লাঠি। কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে মুখটা বিকৃত করছেন।
আমরা আশপাশের সবাই জানতাম, মাঝে মাঝে রেবতীবাবু বাতে একেবারে পঙ্গু হয়ে যান। তাঁর অসহ্য কাতরানি আমরা বাড়ি থেকেই শুনতে পাই।
‘কী করি বুঝতে পারছি না!’
হঠাৎ বাবার নজর আমার দিকে পড়ল। বললেন, ‘এক কাজ করলে হয়।’
‘কী?’
‘সতু তো বসে আছে, সে যেতে পারে।’
রেবতীবাবু কৃতার্থ হয়ে গেলেন, ‘তাহলে তো কথাই নেই। সতু পারবে তো যেতে? অচেনা জায়গা।’
আত্মসম্মানে লাগল। বললাম, ‘এ আর শক্ত কাজ কী?’
‘তাহলে আর দেরি করো না। কাল সকালেই রওনা হয়ে পড়ো। আমার সঙ্গে এসো, আমি সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।’ কথা শেষ করেই রেবতীবাবু লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে আমিও।
আমরা একতলায় থাকি, কাজেই সিঁড়ি ভাঙার হাঙ্গামা নেই। কিন্তু এটুকু পথ চলতে রেবতীবাবু যেরকম সময় নিলেন, তাতেই বুঝতে পারলাম বাতটা রীতিমতো বেড়েছে।
বাড়িতে এসে রেবতীবাবু বললেন, ‘কাল বেলা দশটা পনেরোতে গাড়ি। হাওড়া স্টেশন। দু-নম্বর প্ল্যাটফর্ম। থার্ড ক্লাসে ভাড়া ন-টাকা কুড়ি পয়সা। ট্রেন মজিদপুর পৌঁছাবে সন্ধ্যা ছ-টায়। স্টেশনে গাদা গাদা সাইকেল-রিকশা। রিকশায় বড়োজোর মিনিট পঁচিশ, কী আধ ঘণ্টা। ভাড়া নেবে এক টাকা। এই নাও টাকা। পঞ্চাশ টাকা দিলাম। বিদেশ বিভুঁয়ে সঙ্গে বাড়তি টাকা থাকা ভালো। আর ওই ওষুধের ব্যাগ।’
রেবতীবাবু চামড়ার ছোটো একটা সুটকেস এগিয়ে দিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অসুবিধা হবে?’
হেসে বললাম, ‘আপনি যেমন চমৎকারভাবে বুঝিয়ে দিলেন তাতে মোটেই অসুবিধা হবার কথা নয়।’
‘আমার ভাইয়ের নাম অদিতি। অদিতি ভটচাজ। গাঁয়ের স্কুলের হেডমাস্টার। সবাই এক ডাকে চেনে। তুমি রিকশাওয়ালাকে হেডমাস্টারের বাড়ি যাব বললেই হবে।’
পরের দিন ন-টা বাজতেই ট্যাক্সি এসে হাজির। রেবতীবাবু সে ব্যবস্থাও করে রেখেছেন। আমি ট্যাক্সিতে উঠতে রেবতীবাবু লাঠিতে ভর দিয়ে পাশে দাঁড়ালেন। আমি অনুযোগের সুরে বললাম, ‘আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন?’
‘কষ্ট আর কী! তা ছাড়া তুমি আমার জন্য এতটা করছ, আমি এটুকু করব না? তুমি বউমাকে বলো, শরীরের এই অবস্থার জন্য আমার যাওয়া সম্ভব হল না। কিছু যেন মনে না করে। সুটকেসের মধ্যে একটা কাগজে ওষুধ সেবনের সব বিধি লেখা আছে। কখন কোন ইনজেকশন দিতে হবে, তাও। গায়ের প্রফুল্ল ডাক্তারই দেখাশোনা করে। তাকে দেখালেই হবে।’
যতক্ষণ ট্যাক্সি দেখা গেল, পিছন ফিরে দেখলাম, রেবতীবাবু লাঠি হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন।
ট্যাক্সি যখন হাওড়ায় পৌঁছাল, তখন সাড়ে ন-টা। ট্রেন ছাড়তে তখনও অনেক দেরি। টিকিট কেটে উঠে পড়লাম।
বিশেষ ভিড় নেই। অন্তত তখনও পর্যন্ত হয়নি। বেশিরভাগই চাষাভুষো লোক। সঙ্গে বিরাট বস্তা।
একেবারে কোণের দিকে জানলার পাশে বসলাম।
মালপত্র বলতে আমার কিছুই নেই। ওষুধের সুটকেস আর কাঁধের পোঁটলায় কাপড়চোপড়।
বিছানা আনিনি। রেবতীবাবু বারণ করে দিয়েছিলেন, ‘কোনো দরকার নেই। একজনের শোবার ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে।’
বসে বসে ভাবতে লাগলাম। এর আগে কোনোদিন গ্রামে যাইনি। আমার আত্মীয়স্বজন সবাই শহরের লোক। গ্রাম সম্বন্ধে আমার একটা মোহ ছিল বই কী! পদ্মফুল-ফোটা পুকুর, ঝোপঝাড়ে জোনাকির মেলা, ধান খেত, পাখির কাকলি।
কিন্তু মজিদপুরে হয়তো এসব দেখার অবকাশ হবে না। অসুখের বাড়ি। গৃহস্বামীর কঠিন অসুখ। এমন অবস্থায় গ্রামে বেড়ানো সম্ভব নয়। রোগীর কাছে বসে থাকতে হবে।
ট্রেন ছাড়ল।
দু-দিকের শহরে চিহ্ন দ্রুত মুছে গেল। তার পরিবর্তে পানাঢাকা ডোবা, বাঁশঝাড়, কুঁড়ে ঘর।
মাঝে মাঝে ট্রেন থামছে। লোক যে অনুপাতে উঠছে, সে অনুপাতে নামছে না।
কামরার ভিতর দারুণ হট্টগোল। কে বুঝি আর একজনের পোঁটলা নিয়ে নেমে গেছে।
রোদ বাড়ছে। ঘুমের ভাব আসছে।
এক ভাঁড় চা খেয়ে নিলাম।
যখন আবার চোখ খুললাম, তখন রোদের তেজ কমে এসেছে। কামরাটা অনেকটা খালি। বহুলোক ইতিমধ্যে নেমে গেছে।
বিকাল। হাতের ঘড়ি দেখলাম। পাঁচটা পাঁচ। আর ঘণ্টা খানেক, তারপরই মজিদপুর পৌঁছাব। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সাত সকালে খেয়ে বেরিয়েছি। মাঝখানে শুধু এক ভাঁড় চা খেয়েছি। অসুখের বাড়ি, খাবার মিলবে কিনা কে জানে!
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে থেমেছে। স্টেশনের নাম শক্তিনগর। স্টেশনের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, ট্রেন কিছুক্ষণ থামবে! ট্রে হাতে একটা বয় যাচ্ছিল। তাকে ডেকে চা, টোস্ট আর ডিমের অর্ডার দিলাম।
খাওয়া শেষ হতেই ট্রেন ছাড়ল।
যখন মজিদপুর পৌঁছালাম, তখন বেশ অন্ধকার। ছ-টার সময় এত অন্ধকার হবার কথা নয়, কিন্তু আকাশে কালো মেঘের সমারোহ। স্টেশন দেখে মাথায় হাত দিয়ে পড়লাম। নীচু খোয়া-ওঠা প্ল্যাটফর্ম। টিমটিম করছে তেলের বাটি। গোটা দুয়েক চাষি নামল। নেমেই তারা অন্ধকারে মিশে গেল।
নেমে পড়লাম। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, দু-একবার মেঘ ডাকল।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক দেখলাম। একটা সাইকেল-রিকশা কোথাও নেই। ভাবলাম, স্টেশন মাস্টারের কাছে একবার জিজ্ঞাসা করি।
ফিরে এলাম। টিকিট ঘরের সামনে বড়ো তালা ঝুলছে। ইতিমধ্যে ট্রেনও ছেড়ে দিয়েছে। গেটের কাছে টিকিট চেকারেরও দেখা পাইনি। স্টেশনের বাইরে বিদ্যুতের আলোয় দেখলাম, তিনটে রাস্তা তিনদিকে গিয়েছে। রাস্তা মানে অসমতল গ্রাম্য পথ। দারুণ সমস্যা। দুর্যোগপূর্ণ রাতে কোন রাস্তা ধরে এগোব?
সাইকেল-রিকশার সন্ধানে এদিক-ওদিক দেখছি, হঠাৎ পিছনে মোটা গলার আওয়াজ, ‘সাইকেল-রিকশা পাবেন না, সব নবীন মাইতির ওখানে গেছে।’
চমকে উঠলাম। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, আধা অন্ধকারে দীর্ঘাকৃতি একটি ভদ্রলোক। পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। ভদ্রলোক কি আমার সঙ্গেই ট্রেন থেকে নেমেছেন। এতক্ষণ তাহলে কোথায় ছিলেন?
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘নবীন মাইতির ওখানে?’
‘হ্যাঁ, নবীন মাইতির ছেলের বিয়ে। বরযাত্রীদের জন্য তিরিশখানা সাইকেল-রিকশা ভাড়া করেছে। সম্পন্ন জোতদার। পয়সার তো আর অভাব নেই। তা আপনি যাবেন কতদূর?’
‘অদিতি ভটচাজের বাড়ি।’
‘হেডমাস্টারমশাইয়ের বাড়ি? তাঁর তো খুব অসুখ চলেছে। দিন দশেক যমে মানুষে টানাটানি।’
‘হ্যাঁ শুনেছি। আমি কলকাতা থেকে তাঁর ভাইয়ের কাছ থেকে ওষুধ নিয়ে এসেছি। আমার একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছানো দরকার। কী করে যাই বলুন তো?’
‘পায়ে হাঁটা ছাড়া তো উপায় নেই। গোরুর গাড়িও আজকাল পাওয়া যায় না।’
‘কতটা পথ হবে?’
‘তা মাইল তিনেক। আমিও ওদিকে যাব। যাবেন তো চলুন, রওনা হওয়া যাক। দেরি করে লাভ কী? আকাশের অবস্থা ভালো নয়।’
অগত্যা। আমি মালকোঁচা মেরে নিলাম। কাঁধে ব্যাগ, হাতে ওষুধের বাক্স।
এত সরু রাস্তা, পাশাপাশি দুজনের যাবার উপায় নেই। ভদ্রলোক আগে, আমি পিছনে।
বিদ্যুতের আলোয় পথ চলা।
একদিকে বাঁশঝাড়। বাতাসে বাঁশগুলো দুলছে, ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করছে। আর একদিকে ডোবা! একটু পা ফসকালেই বিপদ।
কিছুটা পথ চলার পর ভদ্রলোককে আর দেখতে পেলাম না। অন্ধকারে যেন মিলিয়ে গেছেন।
ভয় হল। আতঙ্ক মেশানো কণ্ঠে বললাম, ‘কই, কোথায় আপনি?’ পিছন থেকে শব্দ হল, ‘এই যে পিছনে।’
আশ্চর্য, ভদ্রলোক সামনে থেকে পিছনে গেলেন কী করে? এই সংকীর্ণ রাস্তায় পাশ কাটিয়ে তো যাওয়াও সম্ভব নয়!
কৈফিয়ত স্বরূপই ভদ্রলোক বললেন, ‘গাছের আড়ালে বিড়ি ধরাবার চেষ্টা করছি, হাওয়ার জন্য কিছুতেই পারছি না।’
দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন দিকে দেখলাম। একটা গাছের আড়ালে ভদ্রলোক হাত ঢাকা দিয়ে দেশলাই জ্বালাবার চেষ্টা করছেন।
একবার, দু-বার, তিনবার। তিনবারের চেষ্টায় দেশলাই জ্বলল।
সেই আলোতেই ভদ্রলোকের মুখ দেখলাম। কপালে একটা দাগ। খুব ছোটো ছোটো চুল। তীক্ষ্ন দুটি চোখ। সাধারণ গ্রাম্য চেহারা।
‘আপনার এসব চলে?’
মাথা নাড়লাম, তারপরেই মনে পড়ে গেল, অন্ধকারে আমার মাথা নাড়া ভদ্রলোকের দৃষ্টিগোচর হবার কথা নয়। তাই মুখে বললাম, ‘না, ওসব আমার চলে না।’
‘কি করেন? পড়াশোনা?’
‘হ্যাঁ, এবার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিয়েছি।’
ভদ্রলোক হাসলেন, ‘আজকাল তো ছেলেরা লোয়ার সেকেন্ডারি দেবার আগেই ধূমপান করতে শিখে যায়, আপনি তাহলে ভালো ছেলের দলে।’
কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কি এই ট্রেন থেকে নামলেন?’
‘না, না। আমি মাঝে মাঝে স্টেশনে বেড়াতে আসি। আজও এসেছিলাম।’
এতক্ষণ পর্যন্ত শুধু মেঘের ডাক আর বিদ্যুতের চমক ছিল। এবার বৃষ্টি শুরু হল। খুব জোরে নয়, কিন্তু আমাদের বিব্রত করার পক্ষে যথেষ্ট।
রাস্তা রীতিমতো পিছল হয়ে উঠল। পায়ের জুতো খুলে হাতে নিলাম ভদ্রলোকের নির্দেশে।
পথের যেন আর শেষ নেই!
অতিষ্ঠ হয়ে ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘আর কত দূর? শুনেছিলাম অদিতিবাবুর বাড়ি স্টেশন থেকে খুব দূরে নয়।’
‘মাইল তিনেক। এমন আর দূর কী! দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে চলেছি কিনা, তাই পথ বেশি মনে হচ্ছে। আমি জলার ভিতর দিয়ে চলে যেতে পারি, কিন্তু আপনি শহরের ছেলে। আপনার অসুবিধা হবে।’
খালি পায়ে বেশ কষ্ট হতে লাগল।
ঝড়ে দু-একটা বাঁশ রাস্তার ওপর কাত হয়ে পড়েছে। বাঁশের কাঁটা পায়ে ফুটছে। যন্ত্রণায় দু-একবার চেঁচিয়ে উঠলাম।
‘কী হল?’ ভদ্রলোক অনেক দূর থেকে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘পায়ে বাঁশের কাঁটা ফুটছে।’
‘বাড়ি পৌঁছে চুন দিয়ে দেবেন, নইলে বড্ড ব্যথা করবে।’ চুপচাপ আরও আধঘণ্টা কাটল।
বৃষ্টি কম, কিন্তু লোকালয়ের ইশারা নেই। দু-দিকে জঙ্গল আর মজা পুকুর।
‘অদিতিবাবু কেমন আছেন জানেন?’ আমি জিজ্ঞেস করি।
ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি কাছাকাছি যেতে বললেন, ‘সকালে বিশেষ ভালো ছিলেন না। প্রফুল্ল ডাক্তার তো আশা ছেড়েই দিয়েছিল। দুপুরে অবস্থা একটু ভালো হয়েছিল। তবে খুব আশাপ্রদ নয়, বুঝলেন?’
বুঝলাম। মনে মনে ভাবলাম, ওষুধপত্র নিয়ে যেন সময়ে পৌঁছাতে পারি।
আরও দ্রুত চলতে লাগলাম।
কিন্তু বাধা। বিরাট একটা পাকুড় গাছ পথরোধ করে পড়ে রয়েছে। পার হয়ে যাওয়াই দুষ্কর! বললাম, ‘সর্বনাশ! কী হবে?’
ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। নীচু হয়ে দেখে বললেন, ‘ডালপালা সরাতে হবে, এ ছাড়া উপায় নেই।’
‘অন্ধকারে ডালপালা সমেত এই গাছ সরানো সোজা কথা?’
‘আপনি একটু সরে যান তো।’
সভয়ে সরে গেলাম।
ভদ্রলোক মোটা একটা ডাল ধরে টানতে টানতে রাস্তার পাশে রাখলেন।
চেহারা দেখে বোঝবার উপায় নেই। শরীরে অসীম শক্তি। বললেন, ‘চলে আসুন এবারে। গাঁয়ের ছেলে, মাখনছানা দিয়ে তৈরি দেহ নয়। রীতিমতো ডনবৈঠক দিয়েছি বহুদিন। সাঁতার কেটে ফুলাই নদী এপার-ওপার করেছি।’
আর কোনো বাধা নয়।
দুর্যোগ কেটে ফিকে জ্যোৎস্না দেখা গেল। দু-একটা বাতিও নজরে পড়ল। গ্রামের সীমানায় এসে গেছি।
বাঁশের একটা সাঁকো। সেটা পার হতেই ভদ্রলোক বললেন, ‘এবার দুজনে দু-দিকে। আপনার আমার পথ এক নয়। আমি বাঁ-দিকে যাব, আপনি ডানদিকে।’
‘আমি অদিতিবাবুর বাড়ি চিনব কী করে?’
‘চেনবার অসুবিধা হবে না। উঠানে অনেক লোক দেখবেন। হেডমাস্টারকে গাঁয়ের সবাই ভালোবাসে কিনা।’
‘আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’
আমার কথা শেষ হবার আগেই ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। একেবারে মুখোমুখি। দীর্ঘ চেহারা, রক্তাভ দুটি চোখ, বিসৃদশ দাঁতের সার। ভদ্রলোক মোটেই সুদর্শন নন।
বাড়িটা বেশি দূরে নয়। দু-তিনখানা বাড়ি পরেই। উঠানে দাওয়ায় গোটা তিনেক হ্যারিকেন।
বেশ কয়েক জন লোক চলাফেরা করছে।
আমি উঠানে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন ফিরে দেখল, ‘কে?’
‘আমি কলকাতা থেকে আসছি।’
‘কলকাতা থেকে?’
‘হ্যাঁ, অদিতিবাবুর দাদা রেবতীবাবুর কাছ থেকে। বাতে শয্যাশায়ী বলে তিনি নিজে আসতে পারলেন না, আমার হাত দিয়ে ওষুধ পাঠিয়েছেন।’
‘ওষুধ!’
বাড়ির মধ্যে থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে এল।
‘সেই এলেন, যদি আর একটু আগে আসতেন। আজ সন্ধ্যায় সব শেষ হয়ে গেছে!’ বিষণ্ণকণ্ঠে লোকটি বলল, ‘আসুন এখানে।’
দাওয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম।
বাঁশের খাটিয়ায় অদিতি ভটচাজ শুয়ে আছেন।
তাঁর পায়ের ওপর মাথা রেখে একটি স্ত্রীলোক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
মৃতদেহের দিকে চোখ ফিরিয়েই চমকে উঠলাম। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল শিহরণ। এ কি সম্ভব!
যে ভদ্রলোক স্টেশন থেকে আমার পথপ্রদর্শক হয়ে এলেন, এ বাড়ির নির্দেশ দিলেন, তাঁর চেহারার সঙ্গে অদ্ভুত মিল! একেবারে অভিন্ন!
অদিতি ভটচাজও চোখ চেয়ে রয়েছেন। অবিকল এক— রক্তাভ চোখ, অসমতল দাঁতের সার, ছোটো ছোটো চুল।
পরলোকযাত্রী কি আমাকে পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এলেন?
কিন্তু কেন? তিনি তো জানতেন, আমার ওষুধের বাক্স কোনো প্রয়োজনে লাগবে না।
জানি না। এর উত্তর এত বছরেও আমার জানা সম্ভব হয়নি।