বানরের পাঞ্জা

বানরের পাঞ্জা

লখনউ থেকে দিল্লি, সেখান থেকে আগ্রা।

মনোজ, অসীমাভ আর সরোজ, তিনজন অন্তরঙ্গ বন্ধু। স্কুলের নীচু ক্লাস থেকে পাশাপাশি বসত; তারপর কলেজে এসে ছাড়াছাড়ি। মনোজ আর পড়ল না। বাপের বাসনের কারবারে ঢুকে পড়ল। অসীমাভ ডাক্তারি লাইনে গেল আর সরোজ অধ্যাপক। ছাড়াছাড়ি মানে আগের মতন পাশাপাশি বসল না, কিন্তু যোগাযোগ ঠিকই রইল। সপ্তাহে একদিন কী দু-দিন মনোজের দোকানে কিংবা অসীমাভ অথবা সরোজের বাড়িতে ঠিক তিনজনের দেখা হত। একটানা ঘণ্টা তিনেক আড্ডা।

তিনজনের কেউ এখনও বিয়ে করেনি, তবে সরোজের একটি মেয়ের সঙ্গে প্রগাঢ় প্রেম চলছে। মেয়েটির নাম লীলা। বন্ধুরা আশা করছে শীঘ্রই একটা বিয়ের নিমন্ত্রণ পাবে।

পূজার ছুটিতে তিনজন ঠিক করল বেড়িয়ে আসবে। প্রথমে লখনউ, তারপর দিল্লি হয়ে আগ্রা। যেখানে মুসলিম ভাস্কর্য আর স্থাপত্যের চিহ্ন আছে, সেইসব জায়গা।

সরোজ এসব নিয়ে গবেষণা করছে, তার কাজের সুবিধা হবে।

আগ্রায় ফতেপুর সিক্রি থেকে বেরিয়েই তিন বন্ধু দাঁড়িয়ে পড়ল। গাছের তলায় দু-তিনজন লোক নানারকমের পাথরের মালা বিক্রি করছে।

সরোজের খুব ইচ্ছা ছিল লীলাকে সঙ্গে আনে, কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজে বিয়ের আগে এভাবে ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ নেই, তাই লীলার যাওয়া সম্ভব হয়নি।

সরোজ মালা কেনবার জন্য লোকটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

এর আগে লখনউ থেকে লীলার জন্য সরোজ নাগরা কিনেছিল। দিল্লি থেকে সোয়েটার, আগ্রা থেকেও কিছু-একটা নিয়ে যেতে চায়।

বন্ধুরাও সরোজের পিছন পিছন এসে হাজির। অনেক রকমের মালা দেখা হল, কিন্তু সরোজের পছন্দ হল না। অসীমাভ সরোজকে বলল, ‘চল, ওইদিকে একটা লোক বসে আছে। ওর কাছে দেখি।’

একদিকে পাঁচিল ঘেঁষে বিরাট একটা গাছের নীচে পাথরের ওপর একটা লোক বসে। তার সামনে একটা ডালায় নানারকমের হার, লকেট, পাথরের তাজমহল, দোয়াতদান।

লোকটার চোখে চশমা, মুখে বসন্তের দাগ। তামাটে রং, অতি শীর্ণকায়, মাথায় ‘কত করে’ বসানো মুসলমানি টুপি।

তিন বন্ধু তার সামনে বসল।

নানা রং-এর হার রয়েছে। নানা প্যাটার্নের। সরোজ বেছে বেছে গোটা ছয়েক কিনল। অসীমাভ আর মনোজ কিনল দুটো পাথরের তাজমহল।

ওঠবার মুখে হঠাৎ অসীমাভর নজরে পড়ল, ‘ওটা কী? ওটা?’

লোকটা তাড়াতাড়ি জিনিসটা সরিয়ে ফেলে বলল, ‘ওটা বিক্রির নয় হুজুর!’

অসীমাভ নাছোড়বান্দা। বলল, ‘আরে বিক্রির নাই-বা হল, একবার দেখিই না।’

অনেক ধরাধরির পর লোকটা দেখাল। ডালার নীচে একটা বইয়ের মধ্যে জিনিসটা ছিল।

একটা বানরের হাত। কবজি পর্যন্ত কালো লোম। হাতের চেটোয় লাল রং-এর মাংস।

‘এটা এখানে রেখেছো কেন?’

মনোজের কথার উত্তরে লোকটা বলল, ‘খুব পয়মন্ত জিনিস হুজুর। সেকালের জিনিস। আমার নানার কাছ থেকে বাবা পেয়েছিল। তাঁর কাছ থেকে আমি। এখানকার বানর নয় হুজুর, মধ্যপ্রদেশের।’

মনোজ বলল, ‘কত পেলে এটা দেবে বলো তো? পয়মন্ত কিনা আমাদের জানবার আগ্রহ নেই, নতুন ধরনের জিনিস বলে কিনতে চাই।’

লোকটা মাথা নীচু করে বলল, ‘না হুজুর, এটা বেচব না।’

কোনো কথা না-বলে মনোজ ব্যাগ থেকে একটা এক-শো টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিল, ‘এই নাও— এটা রাখো।’

নোটটা দেখে লোকটার দুটো চোখ জ্বলে উঠল। তবু মুখে বলল, ‘কিন্তু হুজুর—’

‘আর কিন্তু নয়, দিয়ে দাও।’ লোকটা একটু ইতস্তত করে একটা কাগজে ভালো করে বানরের পাঞ্জাটা প্যাক করে বলল, ‘একটা কথা আছে হুজুর।’

‘কী বলো?’

‘কোনো আওরত যেন এ পাঞ্জা না ছোঁয়।’

মনোজ হেসে উঠল, ‘ঠিক আছে। সে ভয় নেই। আমি বিয়ে-থা করিনি। এ পাঞ্জা আমার দোকানে রাখব।’

‘আর একটা কথা।’

‘কী?’

‘কোনো বাক্স বা সিন্ধুকে এটাকে রাখবেন না। বইয়ের মধ্যে রাখবেন, তবে ইংরেজি বইয়ের মধ্যে নয়।’

টাকা দিয়ে মনোজ পাঞ্জাটা নিয়ে এল।

রাস্তায় অসীমাভ বলল, ‘তোর কি মাথা খারাপ, এ জিনিস কিনতে গেলি কেন?’

মনোজ উত্তর দিল, ‘কত দিকে তো কত বাজে খরচ করি। দেখাই যাক-না পাঞ্জার কেরামতি! আশেপাশে অনেকগুলো বাসনের দোকান হওয়াতে আমার দোকানের অবস্থা খুব ভালো নয়। কার মধ্যে কী শক্তি আছে, বলা যায়। তা ছাড়া আরও কথা।’

‘কী?’

‘এ তো পুরোনো বানরের পাঞ্জা, সেই তুলনায় ছোটো, কত লাল আর তুলতুলে হয়েছে। তুই তো ডাক্তার, বল অসীমাভ, এ কি করে সম্ভব?’

অসীমাভ হেসে উঠল, ‘তোকে লোকটা যা বলেছে, সবই দেখছি তুই বিশ্বাস করে বসে আছিস। মোটেই পাঞ্জাটা এত পুরোনো নয়। তা ছাড়া বইয়ের মধ্যে রাখতে হবে, কোনো স্ত্রীলোকে ছোঁবে না— এসব যা বললে সবই ভড়ং। এ ধনের কথা না বললে তোর মনে বিশ্বাস জন্মাবে কী করে?’

ব্যাস, এ সম্বন্ধে আর কথা হল না।

আগ্রা থেকে তিনজনে কলকাতায় ফিরে এল।

সপ্তাহে দিন দুয়েক যদিও তিন বন্ধুর দেখা হত, কিন্তু বানরের পাঞ্জার কথা কেউ তুলত না। কারও খেয়ালই হত না।

পাঞ্জাটা মনোজ তার দোকানে রাখল। একটা বাঁধানো বইয়ের মাঝখানে।

আশ্চর্য কাণ্ড, মাস খানেকের মধ্যে দোকানের উন্নতির আভাস দেখা গেল!

দুটো অভিজাত পরিবার বিয়ের বাসনের অর্ডার মনোজ পেল। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গে এক দোকানদার বাসনের এজেন্সি নিল। সারা উত্তরবঙ্গের জন্য।

একদিন মনোজই কথাটা পাড়ল। বলল, ‘তোরা বিশ্বাস করতে চাইবি না; পাঞ্জাটায় যেন আমার উপকার হয়েছে।’

‘ও, সেই পাঞ্জাটা? কী রকম?’

মনোজ দোকানের বিক্রির উন্নতির কথাটা বলল।

অসীমাভ হাসল, ‘বন্ধু, ওটা কাকতালীয় ব্যাপার। পাঞ্জা না এলেও এসব অর্ডার তোর আসত!’

সরোজ শুধু বলল, ‘যাক, তোর ভালো হলেই ভালো।’

দিন পনেরো পর অসীমাভ আর সরোজ দুজনেই খবরের কাগজে দেখল মনোজের দোকানে আগুন লেগে বেশ ক্ষতি হয়েছে।

দুজনেই মনোজের সঙ্গে দেখা করতে গেল। মনোজের অবস্থা অবর্ণনীয়। দু-চোখ লাল। ভগ্নকণ্ঠ। বন্ধুদের দেখে বলল, ‘আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে ভাই! কী করে যে আগুন লাগল ভগবান জানেন। মনে হচ্ছে আগুন যেন আমার দোকানকে শেষ করার জন্যই শুরু হয়েছিল। আশপাশের দোকানে আঁচটুকু লাগেনি।’

অসীমাভ প্রশ্ন করল, ‘কেউ শত্রুতা করে আগুন লাগিয়ে দেয়নি তো?’

‘কে দেবে? এতদিনকার দোকান, কারও সঙ্গে তো আমার শত্রুতা নেই।’

‘কর্মচারীরাও খুশি। তবে—’

‘কী তবে?’

মনোজ কিন্তু বলল না। দুই বন্ধুর মুখের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখল। দ্বিধাগ্রস্ত ভাব।

‘কী হল, বল?’ সরোজ তাড়া দিল।

‘বলব, কিন্তু তোরা কি বিশ্বাস করবি?’

‘আগে বলেই দেখ।’

মনোজ বলতে আরম্ভ করল।

‘রাধার মা বলে একটি ঝি আমার দোকান ঝাঁট দেয়। দিন পাঁচেক আগে দোকানে বসে আছি, রাধার মা সেই বানরের পাঞ্জাটা হাতে করে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। ”বাবু, এটা কী দেখুন তো?”

পাঞ্জাটা দেখেই চমকে উঠলাম, ”একী, এটা তুমি পেলে কোথা থেকে?”

”ওই বড়ো বইটার নীচে মেঝের ওপর পড়েছিল।”

আমি তাড়াতাড়ি পাঞ্জাটা রাধার মার হাত থেকে আবার বইয়ের মধ্যে রেখে দিলাম। বুঝতে পারলাম ঠিক সেদিন থেকে সর্বনাশ শুরু হল, কারণ স্ত্রীলোক পাঞ্জা স্পর্শ করেছে। দোকানের বিক্রি কমল। দু-একজন ভালো খদ্দের বাসনপত্র ফেরত দিয়ে গেল মনোমত হয়নি বলে। ওপরের তাকে রাখা কিছু বাসনপত্র পাওয়া গেল না। এই নিয়ে কর্মচারীদের সন্দেহ হল, কিন্তু কাউকে কিছু বললাম না, বুঝলাম সবই আমার অদৃষ্ট। তারপর চরম সর্বনাশ এই অগ্নিকাণ্ড!’

‘পাঞ্জাটা এখন কোথায়?’

‘সেটা যাতে দ্বিতীয়বার না ওই মহিলা হাত দেয়, তাই বাড়িতে নিয়ে গিয়ে আমার বসবার ঘরে একটা বই-এর মধ্যে রেখে দিয়েছি।’

মনোজের বর্তমান অবস্থায় পাঞ্জার ব্যাপার নিয়ে অসীমাভ আর সরোজ কোনো তর্কের অবতারণা করল না।

দিন সাতেক পর অসীমাভ সরোজের বাড়ি এল, রাত তখন দশটা। বলল, ‘মনোজের মা ফোন করেছিলেন, কাল থেকে মনোজ নাকি বাড়ি ফেরেনি।’

‘সেকী? দোকানের লোকেরা কী বলে?’

‘তারা বলে কাল রাত আটটায় দোকানে তালা দিয়ে মনোজ রোজকার মতন বাড়ি ফিরছিল। আজ সকালে অনেক বেলা অবধি দোকান না খোলাতে দুজন কর্মচারী বাড়িতে খবর নিতে এসে মনোজের নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটা শোনে।’

ইতিমধ্যে মনোজের মা থানায় খবর দিয়েছেন। কান্নাকাটি আরম্ভ করেছেন। বাড়িতে কেবলমাত্র মনোজের মা, আর কেউ নেই।’

অসীমাভ আর সরোজ দুজনেই মনোজের বাড়ি গিয়ে হাজির হল।

তারা পৌঁছোবার আধ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ খবর পাঠাল একটা লাশ পাওয়া গেছে। সনাক্তকরণের জন্য মনোজের মার যাওয়া প্রয়োজন।

মনোজের মার সঙ্গে অসীমাভ আর সরোজ দুজনেই গেল।

মনোজেরই লাশ। দেহে কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই, শুধু গলার দু-পাশে পাঁচ আঙুলের নীলচে দাগ।

পুলিশ বলল, ‘মানুষের আঙুলের দাগ বলে কিন্তু মনে হচ্ছে না।’

সঙ্গে সঙ্গে অসীমাভ আর সরোজের বানরের পাঞ্জার কথা মনে পড়ে গেল।

মনোজের মৃত্যুর ব্যাপারে পুলিশ তোলপাড় করে ফেলল, কিন্তু হত্যাকারীর সন্ধান পেল না।

একসময় সবকিছু স্তিমিত হয়ে এল।

মনোজের দোকান আর একজন ব্যবসায়ী কিনে নিল। টাকাটা অসীমাভ আর সরোজ মনোজের মা যাতে পায় তার ব্যবস্থা করে দিল।

অসীমাভ একটা হাসপাতালের ডাক্তার ছিল।

হঠাৎ প্রসিদ্ধ চিকিৎসক রুদ্রপ্রসাদ সিংহ অসীমাভকে ডেকে পাঠালেন তাঁর লোটাস নার্সিং হোমে যোগ দেবার জন্য।

অসীমাভ সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। দু-এক মাসের মধ্যে তার পশার খুব বেড়ে গেল। নার্সিংহোমে প্রচুর রোগী সমাগম হতে লাগল। সার্জারিতে অসীমাভের হাত ভালোই ছিল, সুযোগ পেয়ে হাত-যশ আরও বাড়ল।

সরোজ পরিহাস করে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার, ডাক্তার রুদ্রপ্রসাদের মেয়ে আছে নাকি?’

অসীমাভ হেসে উত্তর দিল, ‘একটিই মেয়ে, কিন্তু বিবাহিত। বিলেতে স্বামীর কাছে থাকে।’

মাস কয়েকের মধ্যে অসীমাভ মোটর কিনল, কলকতার উপকণ্ঠে বেশ কিছু জমি। তখন এত ব্যস্ত যে সরোজের সঙ্গে সপ্তাহে একবার দেখা করারও সময় করে উঠতে পারে না।

এক শনিবারের বিকালে সরোজই গিয়ে অসীমাভকে পাকড়াও করল। সবে একটা শক্ত অপারেশন সেরে অসীমাভ নিজের রুমে এসে বসেছে, সরোজ বলল, ‘কি ব্রাদার, একেবারে ডুমুরের ফুল হয়ে গেছ?’

অসীমাভ সলজ্জ হাসল।

‘তোর উন্নতিতে আমি খুবই খুশি।’

অসীমাভ বলল, ‘বোস সরোজ, তোর সঙ্গে দরকারি কথা আছে। তোর মনে আছে মনোজের মার ফোন পেয়ে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম? সেইসময় চুপি চুপি তার বসবার ঘর থেকে বানরের পাঞ্জাটা নিয়ে আসি। প্রথমে উদ্দেশ্য ছিল এটা সরিয়ে নিয়ে মনোজকে বিপদমুক্ত করব, তারপর লোভ হল, দেখি পাঞ্জা আমাকে কী দেয়! আশ্চর্য কাণ্ড, পাঞ্জাটা আমার ঘরে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেখছিস তো সবদিক থেকে আমার কীরকম উন্নতি হচ্ছে!’

সরোজ বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘পাঞ্জাটা এখন তাহলে তোর কাছে?’

‘এই যে,’ অসীমাভ সেলফ থেকে মেডিকোর একটা বই পেড়ে পাতা খুলে দেখাল। সেই বানরের পাঞ্জা। আরও যেন জীবন্ত, আরও লোমশ মনে হল।

মাস ছয়েক পর।

অসীমাভ নার্সিং হোমের ডিউটি সেরে নিজের রুমে ঢুকেই চমকে উঠল।

নার্স বাসন্তী তার টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে। তার হাতে পাঞ্জা।

অসীমাভকে দেখে বাসন্তী জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কী ড. সেন, আপনার বইয়ের মধ্যে ছিল?’

কিছুক্ষণ অসীমাভ কথা বলতে পারল না। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল। বুকের স্পন্দন দ্রুততর হল।

পাঞ্জা স্ত্রীলোক স্পর্শ করেছে; তার অর্থ বিপদ ঘনিয়ে আসছে। কখন কীভাবে আসবে কে জানে! জড়ানো গলায় অসীমাভ কোনোরকমে বলল, ‘পরীক্ষা করার জন্য এটা জোগাড় করেছিলাম। দিন আমাকে।’

পাঞ্জাটা নিয়ে আবার সে বইয়ের মধ্যে রেখে দিল।

তিনদিন পার হল না।

একটা অপারেশন করতে করতে অসীমাভ মাথা ঘুরে পড়ে গেল। রোগিণীর পাশে। নিজের হাতের অস্ত্র বুকে বিঁধে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু।

সঙ্গে যারা ছিল হইহই করে উঠল। সহকারী ডাক্তার রোগিণীর অপারেশনে মন দিলেন। অসীমাভর দেহ বাইরে আনা হল। করোনারি অ্যাটাক, তার কোনো স্থির প্রমাণ পাওয়া গেল না।

যথাসময়ে সরোজের কানে খবর গেল। সে ভাবল কোনোরকমে পাঞ্জাটা হস্তগত করে গঙ্গাগর্ভে বিসর্জন দেবে। ও পাপ আর পৃথিবীর বুকে রাখবে না।

কিছুদিন পর সরোজ অসীমাভর রুমে গেল। সেখানে অন্য এক ডাক্তার বসছে।

সরোজ বলল, ‘অসীমাভর কাছে আমার একটা জিনিস ছিল।’

‘কী জিনিস বলুন তো?’

‘ওই মেটিরিয়া মেডিকোর মধ্যে আছে। একটা বানরের পাঞ্জা।’

মেটিরিয়া মেডিকা খুলতেই পাঞ্জা বেরিয়ে পড়ল, ‘এটা পেলেন কোথা থেকে?’

‘হরিদ্বারে এক সাধুর কাছ থেকে। পরীক্ষা করার জন্য অসীমাভ আমার কাছ থেকে চেয়ে এনেছিল।’

বানরের পাঞ্জা নিয়ে সরোজ বাড়ি এল।

ফিরতে ফিরতেই প্রতিজ্ঞা করল, এই অশুভ প্রত্যঙ্গ নিশ্চিহ্ন করবেই!

বাড়ি ফিরে পুরোনো খবরের কাগজের গোছার মধ্যে পাঞ্জাটা রেখে দিল।

দু-দিন পরে সরকারি এক কলেজ থেকে সরোজের নিয়োগপত্র এল। এ চাকরির জন্য অনেক দিন ধরে সে চেষ্টা করছিল। হবে এমন আশা করেনি। এ চাকরির ওপর তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছিল। মাইনে অনেক বাড়বে। লীলাকে জীবনসঙ্গিনী করার পথে আর বাধা থাকবে না। সরোজের মনের গোপনে ক্ষীণ একটা চিন্তা ক্ষণেকের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। বানরের পাঞ্জার জন্য এ উন্নতি নয় তো? সঙ্গে সঙ্গে সরোজ নিজেকে ধমকাল। আর সে লোভের বশবর্তী হবে না। দুই বন্ধু লোভের ফাঁদে প্রাণ হারিয়েছে।

সরোজের একলার সংসার। একটি ঝি আছে। রান্না-বান্না গৃহস্থালির সব কাজ সে করে দেয়। মাঝে মাঝে লীলা আসে। ঘর গুছিয়ে দেয়। দু-একদিন রান্নাও করে। আবার লীলার বাড়িতেও সরোজের নিমন্ত্রণ থাকে।

এ বাড়ির বাড়তি একটা চাবি আছে লীলার কাছে। কাজেই সরোজ না থাকলেও তার প্রবেশের কোনো অসুবিধা হয় না।

একদিন বিকালে সরোজ কলেজ থেকে ফিরে দেখল, লীলা বসে আছে। সরোজকে দেখে লীলা হাসল, ‘কী মশাই, নতুন চাকরি হল, সন্দেশ কই?’

সন্ধ্যার দিকে দুজনে যখন চায়ের টেবিলে, তখন লীলা বলল, ‘তোমায় একটা কথা বলা হয়নি। কোণের ঘরে খবরের কাগজের স্তূপ জমা হয়ে রয়েছে, বিক্রি করার জন্য নামতে গিয়েই দেখি, বাবা কী বিরাট এক মাকড়শা! আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছি।’

সরোজ চেয়ারে টান হয়ে বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি সেটা ছোঁওনি তো?’

‘না, না, ছোঁব কেন?’

সরোজ আর দেরি করল না। পরের দিন কাগজে প্যাক করে পাঞ্জাটা কলেজে নিয়ে গেল।

দিন দুয়েক পর দুজন অধ্যাপক বারোজন ছাত্র নিয়ে আন্দামান যাবার কথা।

একজন অধ্যাপকের হাতে প্যাকেটটা দিয়ে সরোজ বলল, ‘এটাতে আমার এক আত্মীয়ের অস্থি আছে। আপনি দয়া করে সমুদ্রে ফেলে দেবেন।’

অধ্যাপকরা ছাত্রদের নিয়ে আন্দামান রওনা হয়ে যেতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। যাক আর ভয় নেই। দেশের মাটি থেকে পাপ দূর হয়েছে।

দিন সাতেক পর, ঝিয়ের চিৎকারে প্রতিবেশীরা সরোজের শোবার ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকেই পুলিশে খবর দিল। খবর পেয়ে লীলাও ছুটে এল।

বিছানায় সরোজ চিৎ হয়ে শুয়ে। দুটি চোখ বিস্ফারিত। মনে হয় বীভৎস কোনো দৃশ্য দেখে ভয় পেয়েছে। শরীর বরফের মতন ঠান্ডা। বুকের উপর বানরের একটা পাঞ্জা।

সেই দেখেই লীলা চিৎকার করে উঠল, ‘সেদিন কাগজ সরাতে গিয়ে ওইটে আমার গায়ে পড়েছিল, আমি হাত দিয়ে ছুড়ে সরিয়ে দিয়েছিলাম। ওটা এখানে এল কী করে!’

থানা থেকে দারোগা এসে লাশ মর্গে পাঠাল আর পাঞ্জাটা নিজের পকেটে রেখে দিল। কিন্তু কী আশ্চর্য! থানায় নেমে পকেট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাঞ্জাটা আর পেল না। পাঞ্জাটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *