ভূতুড়ে কাণ্ড

ভূতুড়ে কাণ্ড

যে কাজ যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না, কিংবা যে কাজ আশ্চর্যজনকভাবে ঘটে যায়, তাকে আমরা বলি ভূতুড়ে কাণ্ড। আবার ভূতরা নিজে যে কাজ করে তাকে তো ভূতুড়ে কাণ্ড বলেই।

আমাদের পরিবারে এমনই এক ভূতুড়ে কাণ্ড ঘটেছিল। পরীক্ষা দিয়ে মামার বাড়ি বেড়াতে গেছি। দিদিমা আর মামাদের আদরের সঙ্গে প্রচুর আম, জাম, জামরুল খাচ্ছি। তোফা আনন্দে সময় কাটাচ্ছি।

তিন মামা। বড়ো মামা রেল অফিসে কাজ করতেন। বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে শহরের বাসাবাড়িতে থাকতেন। মাসে একবার বাড়িতে আসতেন।

তিনি মেজো মামাকে তারই অফিসে চাকরি করে দেবার কথা বলেছিলেন। কিন্তু মেজো মামা রাজি নন। ছেলেবেলা থেকে মেজো মামা একটু ভিন্ন প্রকৃতির। সব ব্যাপারে বেপরোয়া।

তিনি বলেছিলেন, ‘চাকরি বাকরি আমার ধাতে পোষাবে না। আমি স্বাধীন ব্যাবসা করব।’

তা মেজো মামা স্বাধীন ব্যাবসাই শুরু করেছিলেন। পাঁচ মাইল দূরের মাছের ভেড়ি থেকে মাছ কিনে গঞ্জের হাটে ব্যাপারীদের কাছে সেই মাছ বিক্রি করত। পরিশ্রমের কাজ, কিন্তু ভালো টাকাই হাতে থাকত।

ছোটো মামা কিছু করত না। মামাদের চাষবাসের জমি দেখত আর অবসর সময়ে জাল দিয়ে পাখি ধরত, কাঠি দিয়ে খাঁচা করত আর তাতে পাখিগুলোকে রাখত। তবে বেশিদিন নয়। হঠাৎ একদিন খাঁচা খুলে পাখিগুলোকে উড়িয়ে দিত। এক নম্বরের খেয়ালি লোক।

আমাদের গল্প অবশ্য মেজো মামাকে নিয়ে। গল্পই-বা বলি কেন, একেবারে আমার চোখে দেখা ঘটনা।

মেজোমামা ভোরে উঠে সাইকেলে রওনা হয়ে যেতেন। খুব ভোরে, তখন ভালো করে আলোও ফুটত না। রাস্তাটা অনেকটা পাকা নয়। মানুষের পায়ে চলে সরু একটু রেখা। বেশ কিছুটা যাবার পর ইউনিয়ন বোর্ডের পাকা রাস্তা।

একদিন ভোরেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। থেকে থেকে বিদ্যুতের ঝিলিক আর মেঘের গর্জন। বোঝা যাচ্ছে, একটু পরেই ঝড়জল শুরু হয়ে যাবে।

মেঘের ডাকে আমি ভোর ভোর উঠে পড়েছি। উঠে মেজোমামার যাওয়ার তোড়জোড় দেখছি। দিদিমা বললেন, ‘ওরে, এই আবহাওয়ায় আজ না-হয় নাই বেরোলি, আকাশের অবস্থা ভালো নয়, এখনই জোর তুফান উঠছে।’

ঝড়কে দিদিমা তুফান বলতেন।

মেজোমামা হাসলেন। ‘তাহলে বর্ষাকালে বাড়ির বাইরে যাওয়া যায় না। আমার কাছে বর্ষাতি আছে। কোনো অসুবিধা হবে না।’

মেজোমামা যখন বের হলেন, তখন ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। বাতাসও বেশ জোর। আধ ঘণ্টার মধ্যে দারুণ ঝড় উঠল। চারিদিক অন্ধকার। বাজের শব্দে কান পাতা দায়। সেইসঙ্গে তুমুল বর্ষণ। এধারে-ওধারে বড়ো বড়ো গাছ মড়মড় করে ভেঙে পড়ল কী বাড়ির চালা উড়ে গেল। ধসে পড়ল মাটির দেয়াল। দিদিমার কথাই ঠিক। তুফানই বটে!

আমি জানলার ধারে চুপচাপ বসে প্রকৃতির তাণ্ডব দেখছি। একটু পরেই দিদিমা এসে আমার পাশে বসলেন।

বসেই অপেক্ষা করতে লাগলেন, ‘এই দুর্যোগে বাড়ির কুকুর বেড়াল বাইরে বের হয় না, আর এত করে বারণ করা সত্ত্বেও ছেলেটা রাস্তায় বের হল!’

সত্যিই চিন্তার কথা। এই ঝড়জলে বর্ষাতি আর মেজোমামাকে কতটুকু বাঁচাতে পারবে। হাওয়ার দাপটে সাইকেল চালানোই মুশকিল। সাইকেল থেকে নেমে যে কোনো গাছের তলায় আশ্রয় নেবেন, তাও নিরাপদ নয়। মাথার উপর গাছের ডাল ভেঙে পড়লেই হল।

সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা ঝড়বৃষ্টি চলল। দিদিমা খাওয়াদাওয়া ছেড়ে বিছানা নিলেন। মেজোমামার নাম করে অঝোরে কান্না।

মেজোমামা ফিরলেন রাত আটটা নাগাদ। সাইকেল নেই। হেঁটেই এসেছেন। হাঁটু পর্যন্ত কাদা। পরনের জামাকাপড় ছিন্নভিন্ন। বর্ষাতির খোঁজ নেই।

দিদিমা মেজোমামাকে জাপটে ধরলেন। কিছুতেই ছাড়বেন না। শুধু কী জাপটে ধরা, ভেউ ভেউ করে কান্না। মেজোমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আঃ ছাড়ো! জাপটাজাপটি ভালো লাগে না। আমি মরছি নিজের জ্বালায়!’

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মেজোমামা তোমার সাইকেল?’

‘বট গাছ চাপা পড়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে।’

‘বট গাছ চাপা!’

‘হ্যাঁ কাঞ্চনতলার কাছে দারুণ ঝড় উঠল। বট গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ল আমার ওপর। সাইকেল চুরমার হয়ে গেল। আমি ছিটকে পড়লাম মাটির ওপর। এই দেখ না।’

মেজোমামা চুল সরিয়ে দেখালেন। মাথার এক জায়গায় রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে।

তারপর থেকে মেজোমামা কেমন বদলে গেলেন। মাছের ব্যাবসা বন্ধ।

সারাটি দিন ঘুমিয়ে কাটাতেন। রাত্রে বেরিয়ে যেতেন। কখন ফিরতেন কে জানে!

দিদিমা অনেক বলতেন, কিন্তু মেজোমামা নির্বিকার।

শেষকালে দিদিমার নির্দেশে আমি শুতাম মেজোমার সঙ্গে। অবশ্য আলাদা খাটে। একদিন খুব ভোরে মেজোমামার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল।

‘এই, এক কাপ চা খাওয়াতে পারিস?’

ঘরের কোণে স্টোভ ছিল, তাকের ওপর চা চিনি কাপ ডিস। আগে আগে ভোরে বের হবার সময় মেজোমামা নিজে চা করে খেতেন।

ঘুম জড়ানো গলায় বললাম, ‘তুমি নিজে করে খাও না।’

মেজোমামা যেন ভয় পেয়ে গেলেন, ‘না, আমি আগুনের কাছে যেতে পারব না, ভয় করে।’

ভয় করে কথাটা মেজোমামার মুখে নতুন শুনলাম। মেজোমামা চিরকাল দুর্দান্ত প্রকৃতির। দারুণ সাহস।

সেই দুর্ঘটনার পর থেকে মেজোমামা যেন কুঁকড়ে গেছেন। কারও সঙ্গে ভালো করে কথাও বলেন না। কেউ ডাকতে এলে বলে দেন, বল আমি বাড়িতে নেই।

আরও আশ্চর্যের কাণ্ড, মাথার একদিকের রক্ত জমে থাকাটা একইরকম হয়ে গেল। ওষুধপত্র মালিশ কিছুতে কিছু হল না।

অগত্যা উঠে চা তৈরি করে দিলাম। নিজেও খেলাম এক কাপ।

আর এক রাতে এমন এক ব্যাপার ঘটল, তাতে একটু ভয়ই পেয়ে গেলাম। কদিন গুমোট গরম পড়েছে। হাতপাখা নেড়ে নেড়ে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছি।

বহুকষ্টে যাও-বা ঘুম এল, সেটা পেঁচার কর্কশ আওয়াজে ভেঙে গেল।

ভয় পেয়ে উঠে বসলাম। জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। কোথাও একটু অন্ধকার নেই।

মেজোমামার দিকে চোখ ফিরিয়েই চমকে উঠলাম। আমার মামার বাড়ির সবাই বেশ একটু খর্বকায়। মেজোমামা আবার বেঁটে।

সেই মেজোমামাকে দেখলাম, বিরাট চেহারা। দেহ খাটের বাইরে গিয়ে পড়েছে! দুটো চোখ রগড়ে নিয়ে আবার দেখলাম একই দৃশ্য।

খাট থেকে নেমে পালাবার চেষ্টা করতেই দৃশ্য বদলে গেল। মেজোমামা যেন নিজের সাইজে ফিরে এলেন।

মনকে বোঝালাম, ঘুম চোখে নিশ্চয় ভুল দেখেছি। না হলে এমন ব্যাপার হতে পারে নাকি!

একথা কাউকে কোনোদিন বলিনি, জানি কেউ বিশ্বাস করবে না।

কিন্তু পরে যা ব্যাপার ঘটল, তাতে আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম।

এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, মেজোমামা বিছানায় নেই। ভাবলাম প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাইরে গেছেন এখনই ফিরবেন, কিন্তু অনেকক্ষণ কেটে গেল, মেজোমামা ফিরলেন না। উঠে পড়লাম। জানলা দিয়ে বাইরে চোখ পড়তেই বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। মেজোমামা রোয়াকে বসে আছেন। জানলার দিকে পিছন ফিরে। একটু দূরে গোটা দুয়েক গাছ পার হয়ে একটা জাম গাছ আছে, ছোটোমামা জাল পেতে রেখেছে পাখি ধরবার জন্যে। জালের একজায়গায় ফুটো ছিল, ছোটোমামা বোধ হয় লক্ষ করেনি। সেই ফুটো দিয়ে আটকে থাকা পাখিগুলো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে বেড়িয়ে যাচ্ছে।

মেজোমামা বসে বসেই হাত বাড়ালেন। কী বিরাট হাত! রোয়াক থেকে জাম গাছটার দূরত্ব কমপক্ষে ত্রিশ কজ দূরে তো হবেই।

হাতটা সোজা গাছের ওপর চলে গেল। যেখানে জালের ফুটো সেখানে। মেজোমামা আঙুল দিয়ে জাল গিঁট বেঁধে দিলেন। পাখিদের পালানো বন্ধ হল।

আমি বুকের ওপর হাত চেপেও দুপদুপ শব্দ বন্ধ করতে পারলাম না। মনে হল এখনই অজ্ঞান হয়ে যাব। কোনোরকমে কাঁপতে কাঁপতে খাটের ওপর শুয়ে পড়লাম।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না। ভোরে উঠে দেখি, মেজোমামা খাটে শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। আশ্চর্য কাণ্ড, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। কাল রাতে মেজোমামা যখন রোয়াকে বসে তখন লক্ষ করেছি দরজায় ছিটকানি।

তাহলে মেজোমামা বাইরে গেলেন কী করে? বন্ধ দরজা দিয়ে ঘরের মধ্যেই বা কী করে ঢুকলেন? ঠিক করে ফেললাম, আর মামার বাড়ি নয়। কোনো একটা অছিলায় বাড়ি পালাব।

এটাও কি চোখের ভুল? দু-দু-বার এরকম চোখের ভুল হতে পারে কখনো।

দুপুর বেলা কিন্তু মত বদলে গেল। ছোটোমামা জালে আটকানো পাখিগুলো নিয়ে খাঁচায় পুরছিল। আমি বসে মসে দেখছিলাম। মেজোমামাও বসেছিলেন।

বেশিরভাগই মনুয়া আর টুনটুনি পাখি। একটা শুধু বড়ো আকারের টিয়া। গাঢ় সবুজ রং, লাল চোখ। কিছুতেই ধরা দেবে না। ছোটোমামার হাতে ঠুকরে রক্ত বের করে দিল।

আমি তখন দেখছিলামই, আরও একটা জিনিস লক্ষ করছিলাম, আড়চোখে দেখছিলাম উঠানে মেজোমামার ছায়া পড়েছে কিনা।

দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। উঠানের ওপর মেজেমামার রীতিমতো ছায়া পড়েছে আর তাঁর পায়ের আঙুলগুলো একেবারে স্বাভাবিক।

তার মানে রাত্রে নিশ্চয় আমি বিদঘুটে স্বপ্ন দেখেছি। পেট গরম হলে যা হয়। পেট ঠান্ডা করার জন্য রোজ সকালে একটা করে ডাব খেতে হবে।

আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার বিপদও আছে। এখানে দিব্যি হেসেখেলে বেড়াচ্ছি, আর ওখানে বাবা রোজ পাঁচ পাতা হাতের লেখা আর দশটা অঙ্ক কষাবে।

বেশ কিছুদিন অলৌকিক কিছু চোখে পড়ল না। বুঝতে পারলাম নিজের ভয়ের বিকৃত রূপটাই দেখেছি।

মেজোমামা যে মাছের ব্যাবসা ছেড়ে দিয়েছেন তাতে দিদিমা খুব খুশি। তাঁর দুশ্চিন্তার অবসান হয়েছে। কিন্তু আমি ভাবি মেজোমামার চলবে কী করে! একদিন জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম, ‘হ্যাঁ মেজোমামা, তুমি যে মাছের ব্যাবসা ছেড়ে দিলে, কী হবে?’

মেজোমামা চুল আঁচড়াচ্ছিলেন, ফিরে বললেন, ‘কেন? তোর অসুবিধাটা কী হচ্ছে?’

মুশকিলে পড়ে গেলাম। সামনে গিয়ে বললাম, ‘না, অসুবিধা আর কী! আগে তুমি মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো মাছ আনতে—’

আমাকে থামিয়ে দিয়ে মেজোমামা বললেন, ‘ও, এই কথা। তোকে আজই বড়ো মাছ খাওয়াচ্ছি।’ মেজমামা বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন, হাতে একটা প্রকাণ্ড রুই মাছ নিয়ে।

আমি তো অবাক।

‘হ্যাঁ, মেজোমামা, এর মধ্যে এত বড়ো মাছ পেলে কোথায়?’

মেজোমামা হাসলেন, ‘একজন জেলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মাছের ঝুড়ি নিয়ে হাটে যাচ্ছিল। আমার তো সবই চেনা, বলতেই দিয়ে দিল।’

দিদিমার আনন্দ আর ধরে না। বঁটি নিয়ে এসেই মাছ কুটতে বসলেন। আমি কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম।

রোজ ছাই-রঙা একটা উটকো বিড়াল এ বাড়িতে আসত। আহারের সন্ধানে। সেদিনও সে এসে হাজির।

বঁটির পাশে আঁশের স্তূপ। বেড়ালটা এগিয়ে এসে আঁশে মুখ দিয়েই বিকট স্বরে ম্যাও করে উঠল। অস্বাভাবিক স্বর। কেউ যেন তার গলা টিপে ধরেছে।

তারপর ল্যাজটা খাড়া করে সোজা পাঁচিলের ওপর গিয়ে উঠল। দিদিমাও ব্যাপারটা লক্ষ করেছিলেন।

তিনি বললেন, ‘বেড়ালটার কী হল বলতো? ওভাবে চেঁচিয়ে উঠল। গলায় কাঁটা ফুটল না কি?’

কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখেছি বেড়ালটা একটা আঁশও মুখে তোলেনি। খাওয়া তো দূরের কথা। কেবল শুঁকেই ওইরকম চিৎকার করে উঠল। সব ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত মনে হয়েছিল।

এমনকী, দিদিমা যখন একটা কলাপাতায় বড়ো মাছের টুকরো ভেজে আমাকে খেতে ডাকলেন তখন একটু ইতস্তত করেছিলাম।

তারপর মনে সাহস এনে মাছের টুকরো মুখে দিয়ে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। না, কোনো গোলমেলে ব্যাপার নেই। দিব্যি সুস্বাদু মাছ।

কত অল্পেতে আমরা ভয় পেয়ে যাই। বেড়ালটার ওভাবে চিৎকার করে ওঠার হাজার কারণ থাকতে পারে।

তবে সেদিন থেকে বেড়ালটাকে আর ধারে-কাছে দেখতে পাই না। বোধ হয় অন্য বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে।

এতদিন কথাটা দিদিমা কিংবা ছোটোমামাকে বলিনি কারণ প্রথমত, সব ব্যাপারটা নিজেই ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি। হয়তো আমারই চোখের ভুল কিংবা ভয়ের ছায়াটা রূপ ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন হলে এই অলৌকিক কাণ্ড যে কাউকে দেখাতে পারব, এমন সম্ভাবনা কম।

তা ছাড়া দিদিমাকে নিজের ছেলের সম্বন্ধে কী করে এসব কথা বলি!

তবে আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম আর একবার বীভৎস দৃশ্য চোখে পড়লেই মামার বাড়ি থেকে পালাব। এখানে আদরযত্নের লোভে তো আর বেঘোরে প্রাণ দিতে পারি না।

বেশ কিছুদিন সব স্বাভাবিক। কোথাও কোনো গোলমাল হল না। মেজোমামা অবশ্য মাছের ব্যবসায়ে আর গেলেন না। বাড়িতেও বিশেষ থাকতেন না। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াতেন কে জানে!

দিদিমা জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, ‘একটা কিছু করবার চেষ্টায় আছি। কতদিন আর চুপচাপ বসে থাকব।’

তারপরই অঘটন ঘটল। মাঝরাতে বাথরুমে যাবার প্রয়োজনে বাইরে বেরিয়ে দেখি, ছোটোমামা রোয়াকের এককোণে দাঁড়িয়ে। একেবারে পাথরের মূর্তির মতন নিস্পন্দ, নিশ্চল।

আমি কাছে যেতেই আঙুল দিয়ে বাগানের দিকে দেখাল। যা দেখলাম তাতে আমার মাথা ঘুরে গেল।

একটা গাছের ডালে মেজোমামা পা ঝুলিয়ে বসে। মেজোমামা মানে মুখটা মেজোমামার কিন্তু দেহটা বিরাট! মাথাটা প্রায় গাছের মগডালে ঠেকেছে। পা দুটো মাটির অল্প ওপরে।

কী খেয়ে খেয়ে বাগানের দিকে ছুড়ে ফেলছেন। একটা ছিটকে এসে রোয়াকের ওপর পড়তে নীচু হয়ে দেখেই চমকে উঠলাম। রক্তমাখা হাড়ের টুকরো!

সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল এখনই বুঝি অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ব। ছোটোমামা আমার অবস্থাটা বুঝতে পেরে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে এসেছিল।

তারপর দিন পনেরো কী হয়েছে আমি জানি না। দারুণ জ্বরে আমি প্রায় বেহুঁশ। দিদিমা চেয়েছিলেন আমার বাবাকে খবর দিতে, কিন্তু ছোটোমামা অনেক বুঝিয়ে তাঁকে নিরস্ত করেছিল। ছোটোমামা বলেছিল, শুধু ভয় পেয়ে আমার এই জ্বর। ডাক্তারেরও তাই মত। এর মধ্যে বাবাকে টেনে নিয়ে এলে আমার ব্যাপারটা তাঁকে জানাতে হবে।

স্বাভাবিকভাবেই কথাটা বাবা বিশ্বাস করবেন, এটা আশা করা যায় না।

অথচ তার পরের দিন সকালে দিদিমার পোষা ছাগলটা নিখোঁজ, খুঁজতে খুঁজতে বাগানের মধ্যে তার ছিন্ন মুণ্ডটা পাওয়া গিয়েছিল। চারদিকে রক্তমাখা যেসব হাড়ের টুকরো পাওয়া গেল সেগুলো যে ছাগলেরই হাড় সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কিন্তু এমন কথা কে বিশ্বাস করবে? বিশেষ করে শহরের লোক।

মেজোমামা নাকি আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। হাঁটুর ওপর মাথাটা রেখে চুপচাপ বসে থাকতেন ঘরের মধ্যে। হাজার ডাকে সাড়া দিতেন না। খেতে ডাকলে রুক্ষকণ্ঠে উত্তর দিতেন, খিদে নেই শরীর খারাপ।

দিদিমা যে মেজোমামাকে এত ভালোবাসতেন, সেই দিদিমা ছোটোমামার কাছে সব শুনে মেজোমামার ধারে-কাছে ঘেঁষতে চাইলেন না।

আমি যখন সেরে উঠলাম, তখন ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়েছে।

শোবার ব্যবস্থা পালটে গেছে। একঘরে আমরা তিনজন শুতাম। একপাশে দিদিমা, অন্যপাশে ছোটোমামা, মাঝখানে আমি। সারারাত ঘরে আলো জ্বলত।

ছোটোমামা দরজার ভিতর থেকে ডবল তালা লাগিয়ে দিত। আমরা সবাই জানতাম অলৌকিক শক্তির পক্ষে এ তালা কোনো বাধাই নয়, কিন্তু তবু বারণ করতে পারিনি।

ছোটোমামা আর আমি ওই দৃশ্য দেখার পর, আমি আগে যা দেখেছি সব দিদিমা আর ছোটোমামাকে বলেছি। ছোটোমামা বলল, ‘কথাটা আগেই তোমার বলা উচিত ছিল, তাহলে আরও আগে ব্যবস্থা নিতে পারতাম।’ কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তাও ছোটোমামা বলল।

বদনপুর এখান থেকে আড়াই মাইল। সেখানকার ভৈরব রোজা খুবই বিখ্যাত। তার খড়মের আওয়াজে ভূতপ্রেত থরথর করে কাঁপে।

তাকে পাওয়া খুবই মুশকিল। লোকের ডাকে প্রায়ই ভিনগাঁয়ে চলে যায় আর দক্ষিণাও এক মুঠো টাকা।

দিদিমাকে ছোটোমামা অনেক কষ্টে রাজি করাল। দিদিমা সব বুঝেও একটু ইতস্তত করলেন। হাজার হোক ছেলে তো।

ছোটোমামা বোঝাল, ‘বেশ তো, ভৈরব রোজা এলেই সব বোঝা যাবে।’

খুব ভোরে ছোটোমামা বেরিয়ে পড়ল। বদনপুরে ভৈরবকে যদি না পাওয়া যায়, তাহলে অন্য গাঁ থেকে তাকে ধরে আনতে হবে।

ছোটোমামা যখন বের হল তখন মেজোমামা বাড়ি ছিলেন না। আধঘণ্টা পরে কোথা থেকে ফিরে এলেন।

চেহারা দেখে মনে হল অনেক দূর থেকে যেন ছুটতে ছুটতে আসছেন। হাঁটু পর্যন্ত কাদা, সারা দেহ ঘামে ভিজে গেছে। তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে ফতুয়াটা গাছের ডালে লেগে ছিঁড়ে গেছে।

দিদিমা রোয়াকে বসে তরকারি কুটছিলেন। আমি পাশে বসেছিলাম।

মেজোমামা সামনে এসে দাঁড়ালেন। ঠোঁটের দু-পাশে ফেনা। লাল চোখ পাকিয়ে দিদিমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছোনে কোথায় গেছে?’

ছোনে ছোটোমামার ডাকনাম।

আমার বুকের দুপদাপ শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। ভয় হল অবশ হয়ে বঁটির ওপর না পড়ে যাই!

দিদিমা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘নিজের কী-একটা দরকারে গেছে!’

‘নিজের দরকারে না ছাই!’ মেজোমামা দাঁত কিড়মিড় করে উত্তর দিলেন, ‘ভাই তো নয়, শত্রুর শত্রুর, আচ্ছা ঠিক আছে।’

কথাগুলো বলেই মেজোমামা জোরে জোরে পা ফেলে বাড়ির চারপাশে ঘুরতে লাগলেন, দুটো হাত পিছনে, কেবল মাথা নাড়ছেন, থুতু ফেলছেন আর ঘুরছেন।

ব্যাপারটা দেখে দিদিমা আর সাহস পেলেন না। আমার হাত ধরে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজায় খিল তুলে দিলেন।

দিদিমার দিকে চেয়ে দেখি তাঁর দু-চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। তাঁর মনের কথাটা বুঝতে পারলাম।

যতক্ষণ মেজোমামা বাড়ির চারদিকে ঘুরতে লাগলেন, ততক্ষণ আমি আর দিদিমা ঘরের এককোণে চুপচাপ বসে রইলাম।

কিছুক্ষণ পর মেজোমামাকে আর দেখা গেল না। দিদিমা উঠে জানলা দিয়ে দেখে যখন নিঃসন্দেহ হলেন যে মেজোমামা ধারে-কাছে কোথাও নেই, তখন আমাকে খেতে দিলেন।

নিজে কিছু খেলেন না। ছোটোমামা এলে একসঙ্গে খাবেন।

আমি খাব কী! তখনও শরীর থরথর করে কাঁপছে। মনে হচ্ছে কিছু খেলেই বমি হয়ে যাবে। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, কোনোরকমে আজকের রাতটা কাটিয়ে কাল সকালেই বাড়ি রওনা হব। এখানে এভাবে ভয়ে কুঁকড়ে থাকলে শীঘ্রই শক্ত অসুখে পড়ে যাব।

ছোটোমামা ফিরল বেলা আড়াইটা নাগাদ। সাইকেল-রিকশায়। সঙ্গে ভৈরব রোজা।

আমি জানলা দিয়ে দেখতে লাগলাম।

ভৈরবের পরনে লাল টকটকে কাপড়। গায়ে কোনো জামা নেই। গলায় অনেকগুলো রুদ্রাক্ষের মালা। দু-হাতে রুদ্রাক্ষের তাগা। লাল দুটি চোখ। কপালে সিঁদুরের ফোটা। ঝাঁকড়া পাকা চুল কাঁধ পর্যন্ত এসে পড়েছে।

ভৈরব নেমে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাতাসে কী যেন শুঁকল তারপর ছোটোমামার দিকে ফিরে বলল, ‘কেউ গৃহবন্ধন করেছে।’

ছোটোমামা অবাক।

‘গৃহবন্ধন কী?’

‘কেউ মন্ত্র পড়ে গৃহবন্ধন করে দেয়, তাতে এই গৃহের মধ্যে কোনো কাজকর্ম করলে তা ফল দেয় না।’

‘কে এ কাজ করবে?’

‘যাকে তাড়াতে চাও সেই করবে।’

‘কিন্তু তার পক্ষে তো কিছু জানা সম্ভব নয়!’

ছোটোমামার কথায় ভৈরব খুব জোরে হেসে উঠল।

‘প্রেতাত্মার পক্ষে সবকিছু জানতে পারাই সম্ভব। মানুষের চেয়ে তারা অনেক বেশি শক্তির অধিকারী হয়।’

‘তাহলে উপায়?’

‘উপায় আছে বই কী! তুমি আগে সাইকেল-রিকশাকে বিদায় করো।’

ছোটোমামা সাইকেল-রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিল। ভৈরব পাশে রাখা ঝোলা থেকে একটি মাটির সরা বের করল। তার ওপর চারটে পাকা লঙ্কা, একমুঠো সরষে, কতকগুলো কুশের ডগা রাখল। তারপর রাস্তার ওপরই বসে পড়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগল।

মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই লঙ্কা, সরষে আর কুশের ডকা আমাদের বাড়ির দিকে ছুড়তে লাগল।

পিছনে নিশ্বাসের শব্দ হতে ফিরে দেখলাম দিদিমা এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর চোখে তখনও জল।

আধ ঘণ্টা পরে ভৈরব উঠে দাঁড়াল। ‘ঠিক আছে। এবার বাড়ির মধ্যে চলো।’

ভৈরবের কাণ্ডকারখানা দেখে ইতিমধ্যেই রাস্তার ওপর গাঁয়ের কিছু লোক জড়ো হয়েছিল। ভৈরবের পিছনে তারা বাড়ির মধ্যে এসে ঢুকল। উঠানে মাটি দিয়ে বেদি করা হল। তাতে কাঠ, শুকনো ডালপালা দিয়ে আগুন জ্বালানো হল। ভৈরব সেই অগ্নিকুণ্ড প্রদক্ষিণ করতে করতে মাঝে মাঝে কাঠি করে ঘি ছিটিয়ে দিতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে থাকল।

ততক্ষণে সাহস পেয়ে আমি রোয়াকে গিয়ে বসেছি। দিদিমা আমার পাশে। ছোটোমামা ভৈরবের কাছে। তার ফাইফরমাশ খাটছে।

আধ ঘণ্টা কিছু হল না। সব নিস্তব্ধ। শুধু ভৈরবের রুক্ষ গলায় মন্ত্র পাঠের শব্দ শোনা গেল। হিং টিং ছট— অদ্ভুত ভাষা।

আমি তখন ভাবতে শুরু করেছি যে সবটাই বুজরুকি, তখন হঠাৎ শোঁ শোঁ আওয়াজ। ঠিক অনেক দূর থেকে ঝড় এলে যেমন হয়।

পশ্চিমদিকের গাছপালাগুলো ভীষণভাবে দুলতে লাগল। গাছের ডালে বসা কাকের দল চিৎকার করে আকাশে পাক খেতে লাগল।

একটু পরেই গাছপালার পিছন থেকে মেজোমামা এসে হাজির। দুটি চোখ বনবন করে ঘুরছে, ফুলে উঠেছে নাকের পাটা। মুখে একটা মুরগি। বেচারি মরণযন্ত্রণায় পাখা ছটফট করছে! মেজোমামার দু-কষ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে!

মেজোমার সেই মূর্তি দেখে আমি ভয়ে দিদিমাকে জড়িয়ে ধরলাম। দেখলাম উত্তেজনায় দিদিমাও ঠকঠক করে কাঁপছে।

মেজোমামা এসে দাঁড়াতে ভৈরবেরও চেহারা বদলে গেল। সে আরও জোরে জোরে মন্ত্র পড়তে লাগল। আগুনে মুঠো মুঠো কী ফেললে, তাতে আগুন আরও দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।

মেজোমামা এগোতে পারল না। গাম গাছের তলা পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বিশ্রীভাবে ভৈরবকে গালাগাল দিতে লাগলেন। আধ-খাওয়া মুরগিটা ছুড়ে দিল তার দিকে। মুরগিটা এসে পড়ল আগুনের মধ্যে।

‘কে তুই?’ ভৈরব চেঁচিয়ে উঠল।

‘আমি দয়াল বাঁড়ুজ্জে!’ মেজোমামা আরও চিৎকার করে বললেন।

‘না, তুই দয়াল নস। ঠিক করে বল, কে তুই?’

দয়াল বাঁড়ুজ্জে মেজোমামার নাম। ডাকনাম টোনা।

‘বলব না।’

মেজোমামার সে কী গর্জন! ঠোঁটের দু-পাশে ফেনা এসে জমল।

‘বলবি না? আচ্ছা দেখি বলিস কিনা?’ ভৈরব পাশে পড়ে থাকা ঝাঁটাটা তুলে নিয়ে ঘটের ওপর মারতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মেজোমামা আর্তনাদ করে উঠলেন। মনে হল ঝাঁটার প্রত্যেকটা ঘা যেন তাঁর দেহেই পড়ছে।

‘বলছি, বলছি, আর মারিসনি!’

মেজোমামা গাছতলায় বসে পড়লেন।

‘বল।’ ভৈরব ঝাঁটা আছড়ানো শব্দ করল।

‘আমি মহিন্দর ডোম।’

ভৈরব দিদিমার দিকে চোখ ফেরাল, ‘চেনেন মহিন্দর ডোমকে।’

দিদিমা একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘আমি কখনো দেখিনি। বাবার কাছে শুনেছি মহিন্দর পুজোর সময় ঢাক বাজাত। বিষয় সম্পত্তি নিয়ে শরিকদের সঙ্গে গণ্ডগোল হওয়াতে তারা পিছন দিক থেকে মাথায় লাঠি মেরে লোকটাকে শেষ করে দিয়েছে।’

মেজোমামা আর বলব না। মহিন্দরই বলি। মহিন্দর চুপচাপ সব শুনল। দিদিমার কথা শেষ হতে বলল, ‘মাঠাকরুন ঠিক বলেছেন। শিবে আমার মাথায় লাঠি মেরেছিল। আমিও শোধ নিয়েছি। শিবের গুষ্টির ঘাড় মটকে পগারে ফেলে দিয়েছি। ওর বংশে বাতি দিতে আর কেউ নেই।’

‘তুই দয়ালের দেহে এলি কী করে?’

‘সেদিন খুব ঝড়জলের সময় দয়াল সাইকেল চেপে বট গাছের তলা দিয়ে যাচ্ছিল। ওটাই আমার আস্তানা। হঠাৎ মোটা একটা ডাল ভেঙে দয়ালের মাথার ওপর। দয়াল খতম। তার সাইকেল চিঁড়েচ্যাপটা। আমি দেখলাম এমন সুযোগ আর পাব না। অমাবস্যায় বামুনের মড়া। অনেক বছর দেহহীন হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। সুড় সুড় করে ঢুকে পড়লাম।’

‘এ দেহ তোকে ছাড়তে হবে।’ ভৈরব বলল।

‘মাথা খারাপ! আমি ছাড়ব না!’

‘তবে রে!’

আবার ঘটের ওপর ঝাঁটার আছড়ানি।

মাটির ওপর গড়াগড়ি দিয়ে মহিন্দর যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল।

একটু পরে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাব, যাব।’

‘কী করে বুঝব তুই গেছিস?’

‘কী করতে হবে বল?’

ভৈরব এদিকে-ওদিকে দেখল। উঠানের একপাশে মরচে-ধরা একটা বরগা পড়েছিল। সেইদিকে আঙুল দেখিয়ে ভৈরব বলল, ‘ওটা দাঁতে করে তুলে নিয়ে যেতে হবে। আর একটা কথা।’

‘বল।’

‘গাঁ থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে চলে যেতে হবে।’

‘ঠিক আছে। কাসুন্দিপুরের শ্মশানে আস্তানা বাঁধব। এদিকে আর আসব না।’

‘যা তবে।’

লোহার ভারী বরগা যেটা তুলতে অন্তত জন চারেক লোকের দরকার, সেটা মহিন্দর অবলীলাক্রমে দাঁতে করে তুলে নিল।

আবার সেই ঝোড়ো হাওয়া। গাছপালার মধ্য দিয়ে বরগা নক্ষত্রবেগে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

এদিকে নজর পড়তে দেখলাম মেজোমামার প্রাণহীন দেহটা গাব গাছের তলায় পড়ে আছে। দেহ থেকে বিশ্রী পচা গন্ধ বের হচ্ছে।

ভৈরব বলল, ‘এখনই দেহটা সৎকারের ব্যবস্থা করো। অনেক দিনের বাসি মড়া।’

দুম করে একটা শব্দ। দিদিমা অজ্ঞান হয়ে রোয়াকের ওপর ঢলে পড়লেন।

এসব অনেক দিনের কথা।

দিদিমা কবে মারা গেছেন। মামারাও কেউ বেঁচে নেই। মামাতো ভাইবোনেরা কে কোথায় ছিটকে পড়েছে খবর রাখি না।

আমারও বেশ বয়স হয়েছে।

খুব ঝড় জল শুরু হলে সব ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই এসব অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটেছিল?

কিন্তু চোখের সামনে দেখা সবকিছু অস্বীকার করি কী করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *