কুপার সাহেবের বাংলো

কুপার সাহেবের বাংলো

কাজ শেষ হতেই স্টেশনের দিকে রওনা হলাম। নামেই স্টেশন। টিনের ছোটো একটা চালা। সেখানে টিকিট বিক্রির বন্দোবস্ত। সাড়ে দশ হাত প্ল্যাটফর্ম। দুটি টিমটিমে তেলের বাতি।

স্টেশনে যখন গিয়ে পৌঁছোলাম, তখন সাড়ে সাতটা। কেউ কোথাও নেই। টিকিট ঘর বন্ধ। প্ল্যাটফর্মের ওপর কে একজন ঘুমোচ্ছিল। আমার আওয়াজে উঠে বসল।

তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ট্রেন ক-টায় রে? জামশেদপুরে ফিরব।’

লোকটা আদিবাসী। দু-হাতে চোখ মুছে বিস্মিত দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ আমাকে দেখল; তারপর বলল, ‘সাড়ে ছ-টায় শেষ ট্রেন চলে গিয়েছে বাবু। আবার ট্রেন কাল বেলা দশটায়।’

‘সর্বনাশ! তাহলে রাত কাটাব কোথায়? শীতকাল। এক-একবার হাওয়া দিচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন গায়ে হাজার ছুঁচ ফুটছে!’

স্টেশনে কোথায় শোব, তার উপায় নেই।

তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। সাইকেল-রিকশার চিহ্নও নেই। লোকটা বোধ হয় আমাকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেছে।

আবার প্ল্যাটফর্ম ফিরে এলাম। আদিবাসীর সামনে।

‘হ্যাঁরে, এখানে কোথাও হোটেল আছে?’

‘হোটেল!!’

লোকটা এমনভাবে চেয়ে রইল, হোটেল শব্দটা যেন সে জীবনে এই প্রথম শুনছে।

বুঝিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বললাম, ‘সরাইখানা, যেখানে রাতটা কাটাতে পারি?’

‘না বাবু।’

কথা শেষ করেই লোকটা গায়ে কাপড় টেনে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে নাসিকা-ধ্বনি। এরপর ধাক্কা দিলেও উঠবে এমন মনে হল না।

সঙ্গে বিছানাপত্র বা বাক্স-প্যাঁটরা কিছুই ছিল না। থাকবার কথাও নয়। শহরের অফিস থেকে এখানে একটা জরুরি চিঠি বহন করে এনেছিলাম। বনবিভাগের ছোট্ট একটা অফিস আছে। সেখানে একটা টেন্ডার পৌঁছে দেওয়া।

আসবার সময় বাসে এসেছিলাম। যাবার সময় শুনলাম বাস বন্ধ। পথের মাঝখানে একটা বাস বুঝি মানুষ চাপা দিয়েছে। ব্যস, তাই নিয়ে হইহই কাণ্ড। ইঁট মেরে গোটা কয়েক বাস অচল করার পর, বাস আর যাচ্ছে না। অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে একটা সাইকেল-রিকশা ধরে স্টেশনে এসেছিলাম।

ট্রেনেরও এই ব্যাপার।

এই ঠান্ডায় এভাবে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকলে জমে যাবার আশঙ্কা। যেভাবেই হোক আশ্রয় একটা খুঁজতেই হবে।

আলোয়ানটা কোটের ওপর ভালো করে জড়িয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলাম।

দু-পাশে ঘন জঙ্গল। বন্য জন্তু আছে কিনা ঈশ্বর জানেন। উপস্থিত জোনাকির ঝাঁক দেখা যাচ্ছে।

সমস্ত শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। বার বার হাঁটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি হয়ে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে এমন শব্দ হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে হৃদস্পন্দন থেমে যেতে পারে।

অনেকটা চলার পর জঙ্গলের এলাকা পার হলাম। লোকালয়ের চিহ্ন নেই। কুলিদের দু-একটা ঝুপড়ি। সেখানে আশ্রয় চাওয়া অর্থহীন।

অন্ধকার রাত। আকাশে চাঁদ নেই। একটা নক্ষত্রও নয়। ভাবলাম, বনবিভাগের অফিসেই চলে যাই। প্রহরীকে ডেকে তুলে তার ডেরায় রাত কাটাবার ব্যবস্থা করি।

আন্দাজে রাস্তা ধরে অনেকটা চললাম। তেপান্তরের মাঠ। মাঝে মাঝে আগাছার ঝোপ। আসবার সময় এ মাঠ দেখেছিলাম বলে মনে পড়ল না। তার মানে রাস্তা ভুল করেছি।

শুধু কি কনকনে শীত! সকালে পেটে শুধু চা-রুটি পড়েছিল, ব্যস! তারপর থেকে পেট খালি। ভেবেছিলাম, বাস যখন মাঝে মাঝে থামে, তখন রাস্তার পাশের দোকান থেকে কিছু কিনে নেব।

হাতঘড়ি দেখে বুঝলাম, প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে ঘুরপাক খাচ্ছি। গাছ দেখে মনে হচ্ছে একই জায়গায় ঘুরছি।

এভাবে সারারাত ঘুরলে তো মারা পড়ব!

এবার রাস্তা ছেড়ে মরিয়া হয়ে মাঠের মধ্যে দিয়ে কোণাকুণি হাঁটতে শুরু করলাম। উঁচু-নীচু জমি। বার বার ঠোক্কর লাগল। কাঁটাগাছে পায়ের ছাল রক্তাক্ত হল।

হঠাৎ সামনের দিকে চেয়ে চমকে উঠলাম। অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে, সাদা একতলা বাড়ি। টালির ছাদ।

ক্লান্ত দুটি পা টেনে নিয়ে কোনোরকমে বাড়ির দরজায় গিয়ে উপস্থিত হলাম।

মনে মনে ঠিক করলাম, যারই বাড়ি হোক, হাতে-পায়ে ধরে আশ্রয় ভিক্ষা করব। বিছানার দরকার নেই, মেঝের ওপর শুয়ে থাকব। তবু তো মাথার ওপর একটা আচ্ছাদন থাকবে।

দরজা ঠেলবার আগেই দরজা খুলে গেল। পাদরির পোশাক পরা দীর্ঘ চেহারার একটি লোক হাতে হ্যারিকেন নিয়ে এসে দাঁড়াল।

‘কে?’

‘আমি আশ্রয়প্রার্থী। শীতে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, দয়া করে যদি একটু আশ্রয় দেন আজ রাতটুকুর জন্য—’

‘আসুন, আসুন।’

পাদরি একপাশে সরে দাঁড়াল।

আমি তার গা ঘেঁষে ছুটে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সামনেই আগুন জ্বলছে। ফায়ারপ্লেসে অনেক কাঠ জড়ো করা। আমি আগুনের সামনে বসে হাত-পা সেঁকতে লাগলাম। আঃ, কী আরাম! ঈশ্বর করুণাময়। প্রাণটা বাঁচল।

পাদরি দরজা বন্ধ করে পেছনে এসে দাঁড়াল। ‘এখানে কোথায় এসেছিলেন?’

‘বনবিভাগের অফিসে।’

‘বনবিভাগের অফিস? সে তো এখান থেকে মাইল দশেকের কম নয়!’

আমার দুর্ভোগের কাহিনি বললাম।

পাদরি সমবেদনাসূচক শব্দ করে বলল, ‘পুয়োর বয়! অনেক কষ্ট পেয়েছেন। বুঝতে পারছি আপনি খুব ক্ষুধার্ত, কিন্তু আমার ভাঁড়ার একেবারে খালি। আমি আটটায় খেয়ে নিয়েছি। বোধ হয় একটা ডিম পড়ে আছে। সেটাই আপনাকে দিতে পারি।’

ছোটো একটা ডিম। ওমলেট করে পাদরি নিজে আমার মুখের সামনে ধরল। খুব ক্ষুধার্ত কুকুরের সামনে রুটির টুকরো ফেলে দিলে যেমন হয়, তেমনি ভাবে আমি ওমলেটের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কয়েকটা মুহূর্ত, তারপরই প্লেট পরিষ্কার।

ধবধবে কোমল বিছানা। গরম কম্বল।

পাদরি দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। ‘আর দেরি করবেন না। আপনি ভীষণ পরিশ্রান্ত। শুয়ে পড়ুন। আশা করি, কাল বাস চালু হয়ে যাবে।’

খুব সাবধানে দরজা ভেজিয়ে পাদরি বেরিয়ে গেল।

কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে বিছানায় শরীর ঠেকাবার সঙ্গে সঙ্গে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে গেলাম।

রাত কত জানবার উপায় নেই। হাতঘড়িটা খুলে জানলার তাকে রেখে দিয়েছিলাম।

হঠাৎ চোখে উজ্জ্বল আলো লাগাতে চমকে চোখ খুললাম। ভোর হয়ে গেল বোধ হয়। কাচের জানলা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে। ঘুমের ঘোর কাটতে একটু সময় নিল।

চোখ চেয়ে যা দেখলাম, তাতে আমার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। খাড়া হয়ে উঠল চুল। উজ্জ্বল হ্যারিকেন হাতে একটা মুখ আমার ওপর ঝুঁকে পড়েছে! মুখ বললাম বটে, কিন্তু মুখ নয়, একটা মড়ার মাথা! চোখের জায়গায় বিরাট গর্ত। দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে!

‘এ যে জ্যান্ত মানুষ গো! কতদিন পরে জ্যান্ত মানুষ দেখলাম। তাও আবার পুরুষমানুষ।’

পুরুষ মানুষ কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, চোখের গর্ত থেকে তীব্র লাল আলো বিচ্ছুরিত হল। খটখট করে উঠল দাঁতের সার।

‘এই পুরুষগুলোকে দুনিয়া থেকে মুছে ফেলতে পারতাম!’

কথাগুলো সব আমার কানে এল, কিন্তু সমস্ত ইন্দ্রিয় এত ক্লান্ত যে, সবকিছু শোনার বা বোঝার সাধ্য আমার ছিল না।

‘কী হয়েছে রে? কী হয়েছে?’

আর একটা কর্কশ শব্দ কানে এল।

চোখ ফিরিয়ে দেখলাম, আলোর আওতায় আর একটা মুখ ভেসে উঠল। এও মুখ নয়, করোটি। শূন্যে শুধু মুখটা ভাসতে ভাসতে এল।

‘এই দেখ, জলজ্যান্ত পুরুষ একটা এসেছে। গায়ে মাংস রয়েছে। আরাম করে আমাদের জমিতে শুতে এসেছে।’

‘বলিস কী জোয়ান! স্পর্ধা তো কম নয়!’

‘তোর তো মনে আছে আমার কথা?’

‘ওমা, মনে আবার নেই! এই তো সেদিনের কথা। আমার চোখের সামনেই তো সবকিছু ঘটল।’

‘আমি তো কোনোদিন ভুলব না। সে ঘটনা ভোলা যায় না ডরোথি।’

এটুকু বুঝতে পারলাম, দুজনেই মেয়ে। একজনের নাম জোয়ান, আর একজনের নাম ডরোথি।

উজ্জ্বল হ্যারিকেনটা দুলে দুলে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ একটা শব্দ। ঘর-ঘর-ঘর।

বাড়ির সাদা দেয়ালগুলো সরে সরে গেল। হালকা সবুজ রং করা চারটে দেয়াল এসে আমাকে ঘিরে ফেলল। আগের দেয়াল সাদা আর একেবারে শূন্য। কিন্তু এ দেয়ালে নকশা-কাটা কাগজ আঁটা। গোটা দুয়েক ছবি টাঙানো রয়েছে। একটা ক্যালেন্ডার।

আমি অবশ হয়ে পড়ে আছি। দু-একবার ওঠবার চেষ্টা করেও পারলাম না। নিজের গায়ে চিমটে কাটলাম। বেশ লাগল।

তার মানে সজ্ঞানে রয়েছি।

তাহলে চোখের সামনে এসব কী!

ওমলেটের সঙ্গে অল্প একটু জল খেয়েছিলাম। পাদরি দিয়েছিল। সেই জলের মধ্যে কি মাদক দ্রব্য কিছু মেশানো ছিল?

যার ফলে চোখের সামনে অলৌকিক এসব দৃশ্য দেখে চলেছি।

একটু দূরে কোলাহল শোনা গেল।

পুরুষ-পুরুষ কণ্ঠ।

তারপরই দেখলাম, একটি যুবতীকে টানতে টানতে একজন যুবক প্রবেশ করল।

এদিকে লক্ষ করিনি। গোটা দুয়েক সোফা। সামনে একটা সেন্টার টেবিল। যুবতীকে এনে যুবকটি সোফার ওপর আছড়ে পড়ল।

যুবতীর সাজপোশাক দেখে লজ্জা পেলাম। পাতলা ফিনফিনে একটা স্কার্ট পরনে। ভেতরে আর কোনো আবরণ নেই। তা ছাড়া টানাটানি করে আনার জন্য স্কার্টের অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে।

যুবকটি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। ‘শয়তানি, এবারে তোকে হাতেনাতে ধরেছি। বল, জানলা দিয়ে যে লোকটা পালাল, সে কে?’

যুবতী মাথা নাড়ল। ‘আর্থার ভুল দেখেছ তুমি। নিশ্চয় ক্লাব থেকে নেশা করে এসেছ। আমি তোমার দেরি দেখে বিছানায় শুয়ে পড়েছিলাম। জানি, তোমার কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে, ঢুকতে কোনো অসুবিধে হবে না। যিশুর দিব্যি, তোমাকে আমি সত্যি কথা বলছি।’

যুবক সজোরে যুবতীকে একটা লাথি মারল। যুবতী সামলাতে না-পেরে কৌচ থেকে মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ল। পোশাক সরে গিয়ে ঊর্ধ্বাঙ্গ একেবারে অবারিত।

‘বিচ, তোর এই পাপমুখে যিশুর পবিত্র নাম উচ্চারণ করিস না! যে লোকটা পালাল, সে কপার কারখানার ম্যানেজার হালদার, তা আমি জানি। তোদের আসনাই অনেকদিন থেকে চলছে, সে খবরও আমি রাখি, আমি শুধু ধরবার অপেক্ষায় ছিলাম।’

‘তুমি মিথ্যা দোষারোপ করছ আর্থার। ডরোথিকে জিজ্ঞাসা করো, সে তোমাকে সব কথা বলবে।’

‘ডরোথি!’ আর্থার মাটিতে থুথু ফেলল। ‘সে তো আর একটা শূকরী। তা কাজ, কলোনির মেয়েদের পুরুষ জোগানো স্বামীর অনুপস্থিতিতে, তা আমার জানতে বাকি নেই। তাকেও আমি ছাড়ব না। সে অনেক ঘরের শান্তি নষ্ট করেছে, তাঁকে দুনিয়া থেকে হটাতে হবে।’

‘তুমি সব বাজে কথা বলছ। নিজের দোষ ঢাকবার জন্য এসব কথার অবতারণা করছ তুমি।’

‘চোপরাও! আমি ক্লাবে জুয়া খেলি, মদ খাই, কিন্তু কোনোদিন কোনো মেয়েছেলের দিকে চোখ তুলে চেয়েছি, কেউ বলতে পারবে?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি, পুরুষ মানুষের সাতখুন মাপ!’

‘দোষ করে আবার উলটোপালটা কথা!

এবার আর্থার সজোরে যুবতীর পেটে একটা লাথি মারল।

দু-হাতে পেট টিপে ধরে যুবতী ককিয়ে উঠল, ‘কী সর্বনাশ করছ তুমি? জানো না, আমার পেটে তোমার সন্তান। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরকে তুমি মেরে ফেলবে?’

আর্থার যুবতীর চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলতে যাচ্ছিল, কথাটা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘আমার সন্তান!’

‘নিশ্চয়! তোমার ছাড়া আর কার? জোয়ান আর আর্থার পিটারের সন্তান। ছেলে হলে এর নাম রাখব ড্যানিয়েল আর মেয়ে হলে ক্যারোলিন।’

জোয়ান আর বলতে পারল না। আর্থারের উৎকট হাসির শব্দে মাঝপথে থেমে গেল।

দেয়ালে একটা কোট টাঙানো ছিল। হাসতে হাসতে আর্থার পকেট থেকে একটা খাম বের করল। তারপর সেই খাম খুলে একটা কাগজ বের করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘দেখো, ডাক্তার সেনের রিপোর্ট। আমি কোনোদিন সন্তানের জন্ম দিতে পারব না। গত যুদ্ধ আমার এই সর্বনাশ করেছে। অপারেশন করে গুলি বের করার সময়ে আমার পৌরুষত্ব হরণ করেছে। কাজেই যেটা তোর পেটে এসেছে, সেটা নেটিভ হালদারের দান। নিজের কথায় নিজে ধরা পড়েছিস। শয়তানি, আজ তোর শেষ দিন!’

আর্থার কোমর থেকে রিভলভার বের করল। রিভলভার দেখে জোয়ান মরিয়া হয়ে আর্থারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। দুজনে ধস্তাধস্তি শুরু হল।

আমি বুঝতে পারলাম, ঘামে আমার সমস্ত দেহ ভিজে গেছে। চেঁচাতে গিয়ে দেখলাম, গলা থেকে কোনো স্বর বের হচ্ছে না।

চোখের সামনে একটা নারকীয় কাণ্ড ঘটে যাবে, অথচ নিজে আমি অসহায়ের মতন তাই দেখব, ভাবতেও খারাপ লাগল। কিন্তু নিরুপায়। উঠে বসবার শক্তিও সংগ্রহ করতে পারলাম না।

‘কী হচ্ছে কী আর্থার? বাড়িটা নরককুণ্ড করে তুলেছ যে!’

জানলার কাছে আর একটি তরুণী এসে দাঁড়াল।

জোয়ান মেয়েটিকে দেখে চিৎকার করে উঠল, ‘ডরোথি, আমাকে বাঁচাও! পশুটা আমাকে শেষ করে দিতে চাইছে!’

মুহূর্তের জন্য জোয়ান একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। আর্থার এ সুযোগ হারাল না। রিভলভারের নল একেবারে জোয়ানের মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপল।

গুড়ুম! নীল আলোর শিখা। সঙ্গে সঙ্গে ঘিলুর কিছুটা ছিটকে দেয়ালে আটকে রইল। জোয়ানের শরীরটা দু-এক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইল, তারপর টলে পড়ল মেঝের ওপর। সারা মুখ রক্তে ভেসে গেল।

‘খুন— খুন, আর্থার খুন করেছে!’ ডরোথি চিৎকার করে উঠল।

‘তোকেও শেষ করব! সাক্ষী রাখতে নেই।’

আর্থার রিভলবার হাতে জানলা দিয়ে লাফিয়ে বাইরে পড়ল। একটু পরেই ‘গুড়ুম’ করে আর একটা শব্দ নারীকণ্ঠের চিৎকার।

তারপরই অখণ্ড নিস্তব্ধতা। বোঝা গেল, আর্থারের দ্বিতীয় গুলিতে ডরোথি খতম।

আবার ওঠবার চেষ্টা করলাম; পারলাম না।

ঘর-ঘর-ঘর করে শব্দ। বিরাট একটা কাঠের চাকা যেন ঘুরছে।

দেয়ালগুলো সরে সরে গেল। বুঝতে পারলাম, আবার পুরোনো দেয়াল ফিরে আসবে। পুরোনো পরিবেশ। কিন্তু না, এবার আর কোনো দেয়ালই ফিরে এল না। পরিবর্তে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া। হাড়ের মধ্যে রক্ত জমিয়ে দেবার মতন অবস্থা।

হাত দিয়ে অনুভব করলাম। বিছানা উধাও। ভিজে ঘাসের ওপর শুয়ে আছি। শিশিরে ভেজা মাঠ। আকাশের দু-একটা নক্ষত্র। মিটমিটে দীপ্তি।

তার মানে অনাবৃত আকাশের তলায়, মাটির শয্যায় শুয়ে ছিলাম। উঠে বসলাম। সারারাত ঠান্ডায় শুয়ে হাত-পা নড়াবার সাধ্য নেই। হিমে আড়ষ্ট। অনেক কষ্টে উঠে বসলাম।

রাত প্রায় শেষ। পূর্বদিকে আলোর আঁচড়। এবার ভোর হবে।

একটু একটু করে আলো ফুটল। পরিবেশের দিকে নজর দিয়েই এবার চমকে উঠলাম। কবরখানার মধ্যে শুয়ে আছি। একেবারে দু-পাশে দুটো কবর।

ঝুঁকে পড়ে প্রস্তরফলকের লেখা পড়লাম

জোয়ান পিটার। জন্ম উনিশ-শো ছাব্বিশ। মৃত্যু উনিশ-শো পঞ্চাশ।

এপাশের প্রস্তরফলকে দেখলাম ডরোথি জোনস। জন্ম উনিশ-শো কুড়ি। মৃত্যু উনিশ-শো পঞ্চাশ।

জানি না এগিয়ে গেলে আর্থারের কবরও দেখতে পাব কি না। আগ্রহ আর সাহস কোনোটাই হল না।

বুঝতে পারলাম, মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা একটা শিহরণ। বুকের স্পন্দন অত্যধিক দ্রুত।

যেমন করে হোক, এ পরিবেশ ছেড়ে পালাতেই হবে।

সম্ভবত কাল আশ্রয়ের আসায় মাঠে মাঠে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে কবরখানার মধ্যেই শুয়ে পড়েছিলাম। তারপর উত্তেজিত মনে বিচিত্র স্বপ্ন দেখেছি।

উঠে পড়লাম রাস্তার দিকে এগোতেই মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল।

একটা শাল গাছের নীচে পাদরি দাঁড়িয়ে।

আমাকে দেখে বলল, ‘আশা করি ভালোই ঘুমিয়েছেন। এই রাস্তা ধরে সোজা চলে যান। বাসস্টপ পাবেন। প্রথম বাস এখানে ছ-টা দশে।

মাথাটা ঘুরে উঠল। পেছন দিকে ফিরে দেখলাম, ঘন কুয়াশায় কবরখানা ঢাকা পড়ে আছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না।

পাদরিকে বললাম, ‘কাল আমি তো আপনার বাড়িতেই আশ্রয় নিয়ে ছিলাম।’

পাদরি বলল, ‘হ্যাঁ এখানে আমার বাড়িকে সবাই বলে কুপার সাহেবের বাংলো।’

‘কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারছি না। রাত্রে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখেছি। জোয়ান, ডরোথি আর আর্থারের। নৃশংস হত্যাকাণ্ড। জেগে উঠে দেখি, কবরখানায় শুয়ে আছি।’

‘কী সব বলছেন? ওই তো আমার বাংলো।’

পেছন ফিরে দেখলাম, কিছুই দেখতে পেলাম না। সামনের দিকে চেয়ে দেখলাম, গাছতলায় পাদরি নেই। একেবারে ফাঁকা।

আবার পেছনে দেখলাম, কুয়াশা সরে গেছে। কবরখানা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। প্রস্তরফলকগুলো শানিত বর্শার মতন রোদে চকচক করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *