আবার ভূত

আবার ভূত

অনেক অলৌকিক কাণ্ড পৃথিবীতে ঘটে, যার বুদ্ধিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়।

এরকম দু-একটি ঘটনা নিশ্চয় তোমাদেরও শোনা।

স্বামী-স্ত্রী ফোটো তুলেছে, সেই ফোটোতে স্বামী আর স্ত্রীর মাঝখানে আর একটি মেয়ের মুখ। মুখটি অবশ্য খুব পরিষ্কার নয়, কিন্তু বেশ দেখা যায়।

দোকান থেকে ফোটোটা যখন বাড়িতে দিয়ে গেল, তখন স্বামী অফিসে। স্ত্রী ফোটো দেখেই চমকে উঠল।

একী, ফোটো তোলবার সময় স্টুডিয়োতে তো খালি তারা দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল। এ মেয়েটির মুখ এল কোথা থেকে?

ফোটো প্রিন্ট করার সময় অন্য কোনো ফোটোর সঙ্গে জুড়ে গেছে?

স্ত্রী রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়ল।

স্বামী অফিস থেকে ফিরতেই স্ত্রী ফোটোটা নিয়ে তার কাছে ছুটে গেল। ‘একেবারে বাজে স্টুডিয়ো, দেখো আমাদের ছবিটা কীভাবে নষ্ট করে দিয়েছে!’

ফোটোটা দেখেই স্বামী চমকে উঠল।

‘একী, আশ্চর্য কাণ্ড!’

তাদের দুজনের মাঝখানে যে মুখটি দেখা যাচ্ছে সেটা তার খুব চেনা। কিন্তু তার পরিচয় স্ত্রীর কাছে সে দেবে কী করে?

মেয়েটি তার প্রথম পক্ষের পরিবার। বিয়ের ছ-মাস পরে সে মারা গিয়েছিল। তার কোনো ফোটো তোলা হয়নি। অথচ এ ফোটোতে তার মুখ এল কী করে?

স্বামী যে আগে একবার বিয়ে করেছিল, সে কথা স্ত্রী জানে না। তাকে বলা হয়নি।

ফোটোটা নিয়ে স্বামী বলল, ‘আমি এখনই স্টুডিয়োতে যাচ্ছি। এভাবে ফোটো নষ্ট করার জন্য খুব কড়া কথা শুনিয়ে দেব।’

স্টুডিয়োর মালিককে স্বামী সব বলতে, মালিক বলল, ‘আর বলবেন না মশাই। আমরা কিছু ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না। যতবার ওয়াশ করি, ওই একই ব্যাপার, মেয়েটির মুখ ফুটে ওঠে। আপনি মেয়েটিকে চেনেন নাকি?’

‘না, না, আমি চিনব কী করে? এ ফোটো আপনারাই রেখে দিন, আমার দরকার নেই।’

ঝঞ্ঝাট এড়াবার জন্য স্বামী ফোটোটা স্টুডিয়োতেই রেখে এসেছিল। কিন্তু তাতে বিপদ কমেনি।

মাঝরাতে স্ত্রী চিৎকার করে বিছানার ওপর উঠে বসেছে।

‘কী হল, কী হল?’ বলে স্বামীও ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে।

‘সেই মুখটা আমাকে কী সব বলছে!’

‘কোন মুখ?’

‘যে মুখ আমাদের ফোটোতে দেখা গিয়েছিল। চোখ দুটো লাল করে খোঁনা খোঁনা গলায় আমাকে শাসাচ্ছে, ”এ আমার বাড়ি, আমার স্বামী। তুই যা, যা এখান থেকে। নইলে তোর গলা টিপে ধরব!” ‘

স্বামী স্তোকবাক্যে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছে।

‘তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ। তোমার কোনো ভয় নেই। স্বপ্ন দেখে ওরকম মনে হয়।’

স্বামী কিছু না বললেও, পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকে স্ত্রী কথাটা শুনতে পেল।

তারাই বলে ফেলল, বারণ সত্ত্বেও, যে স্বামীটি আগে একবার বিয়ে করেছিল। প্রথম স্ত্রী কুয়োতলায় জল তুলতে গিয়ে পা পিছলে সিমেন্টের ওপর পড়ে মাথায় চোট পায়। দু-দিন পরেই মারা যায়।

এরপরের খবর আমার জানা নেই। এটা বোধ হয় ‘পরলোকের কথা’ বইতেই পড়েছিলাম।

যাক, এবার নিজের কথা বলি।

ভূত সম্বন্ধে আমার কৌতূহল ছেলেবেলা থেকেই। বড়ো হয়ে ইংরাজি বাংলা ভূততত্ত্বের বই জোগাড় করে পড়েছি। ঠিক কোনো সমস্যায় পৌঁছোতে পারিনি।

ভগবানকে বিশ্বাস করার ব্যাপারে যেমন মোটামুটি তিনটে দল আছে। আস্তিক, নাস্তিক আর সন্দেহবাদী। ভূতের বেলাতেও ঠিক তাই। আমি এই সন্দেহবাদীদের দলে।

ভূত থাকতেও পারে, আবার না থাকলেও আশ্চর্য হব না।

কিন্তু গত নভেম্বর মাসের একটা ঘটনার পর, নিজের মত বদলাতে বাধ্য হয়েছি।

সভাসমিতির ব্যাপারে আমি চিরকালই ভয় পাই। বিশেষ কোথাও যাই না। সবিনয়ে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করি।

কিন্তু জামশেদপুরের এক সাহিত্য সম্মেলনে যেতে হয়েছিল, কারণ আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে সম্মেলনের উদ্যোক্তা।

আমার সঙ্গে আরও যে তিনজন সাহিত্যিক গিয়েছিলেন, তাঁরা আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখবার জন্য রয়ে গেলেন। সভার অধিবেশন শেষ হতেই আমি বেরিয়ে পড়লাম।

তার অবশ্য কারণ ছিল।

আমার ঘাটশিলার অন্তরঙ্গ বন্ধু মুকুল চক্রবর্তী বিশেষ করে আমাকে লিখেছিল, সভা শেষ করেই ফেরার পথে ঘাটশিলায় যেন কয়েকটা দিন কাটিয়ে যাই তার কাছে।

বিভূতিভূষণের স্পর্শে ঘাটশিলা সাহিত্যিকদের তীর্থস্বরূপ।

কিন্তু মানুষ গড়ে আর ভগবান ভাঙে।

ট্রেন গলৌডির কাছ বরাবর গিয়ে আটকে রইল।

একদল লোক লাইনের ওপর বসে পথ অবরোধ করে। ট্রেন তারা একচুল নড়তে দেবে না, যতক্ষণ না তাদের আবেদন মঞ্জুর হয়।

‘কী তাদের আবেদন?’

এতদিন বম্বে এক্সপ্রেস গলৌডিতে থামত। হঠাৎ নতুন সময়পঞ্জিতে নিয়ম হয়েছে, সে আর থামবে না। হাওয়ার বেগে স্টেশন অতিক্রম করে যাবে।

তাই গলৌডিবাসীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল।

ড্রাইভার আর গার্ড তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

এ ট্রেনটা আজকের মতন অন্তত চলতে দিন। কারণ, আজ রবিবার। চক্রধরপুরে খবর দিলেও কোনো লাভ হবে না। ছুটির দিন ঊর্ধ্বতম কর্মচারীরা কেউ অফিসে আসে না, অথচ তারা ছাড়া এ বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়।

বিক্ষোভকারীরা চুপচাপ। এসব কথা তাদের কানে গেছে এমন মনে হল না।

দু-ঘণ্টা পার হয়ে গেল। চারদিকে অন্ধকার। কয়েকটা জোনাকি উড়ছে। কামরা থেকে নেমে পড়লাম।

একজন মাতব্বরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী ভাই, কখন ট্রেন ছাড়বে?’

আমার দিকে অবহেলা-ভরে একবার চোখ ফিরিয়ে দেখে লোকটা বলল, ‘আমাদের দাবি মানলেই ছাড়বে। আজ ছুটির দিন, কর্তারা বুঝি কেউ নেই, কাজেই কাল বেলা দশটার আগে তো ছাড়ছেই না।’

সরে এলাম। কামরার মধ্যে চুপচাপ বসে থাকতে ভালো লাগল না। তা ছাড়া এক মারোয়াড়ি দম্পতি দুটি নাবালক নিয়ে আমার সহযাত্রী। ইতিমধ্যে সঙ্গে যে খাবার ফলমূল ছিল নাবালক দুটি খেয়ে শেষ করেছে, তাতেও ক্ষুধা মেটেনি। দুজনে তারস্বরে চিৎকার করছে। কামরার মেঝে ফলের খোসা, জল আর শালপাতার নরককুণ্ডের রূপ নিয়েছে।

রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। কলকাতার দিকে নয়— এমনই হাঁটার উদ্দেশে।

মেঘে-চাঁদে লুকোচুরি খেলা চলছে। ফলে, কখনো আলো, কখনো অন্ধকার। আকন্দ গাছ, বনতুলসি আর ছোটো ছোটো কাঁটাগাছের ঝোপ।

বেশ কিছুটা এগিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

চারদিকে ধুধু মাঠ। এলোমেলো হাওয়া বইছে, ম্লান জ্যোৎস্না।

স্পষ্ট দেখলাম, মাঠের ওপর একটি মেয়ে শুয়ে। দুটো হাত বুকের ওপর, মাথায় বেণী ছড়িয়ে পড়েছে।

এমন জায়গায় মেয়েটি এল কী করে? শাড়ি পরার ধরনে বাঙালি মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে। বয়স চোদ্দো-পনেরোর বেশি নয়।

আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম, তারপরই কথাটা মনে পড়ল।

মেয়েটিকে কেউ মেরেফেলে এখানে রেখে যায়নি তো? তাই হওয়া সম্ভব, না-হলে মেয়েটি এমন নিস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকত না।

চিন্তাটা মনে আসতেই পিছিয়ে এলাম।

মেয়েটির কাছে গিয়ে বিপদ ডেকে আনব নাকি? হঠাৎ যদি পুলিশের লোক ধরে ফেলে। কী বলব তাদের?

ট্রেনে আটকেছে, তাই ফাঁকা মাঠে একটু পায়চারি করছি, এমন একটা কথা নিজের কানেই অসংলগ্ন ঠেকল।

তারপর আমি যে নির্দোষ তা প্রমাণ করতে পারব, কিন্তু বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশ ছুঁলে চুয়ান্ন। মনোকষ্ট, অর্থনাশ, স্রেফ ঝামেলা।

কয়েক পা গিয়ে কৌতূহলের বশে ফিরে দেখলাম।

কোথাও কেউ নেই। তাহলে কি চোখের ভুল? অনক সময় ফিকে চাঁদের আলো বিভ্রমের সৃষ্টি করে।

কিন্তু এত কাছ থেকে ভুল দেখলাম!

এদিক-ওদিক চোখ ফিরিয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

মেয়েটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে! শুধু দাঁড়ানোই নয়, আমার দিকে ফিরে ফিক ফিক করে হাসছে।

তবে কি মেয়েটি এই ট্রেনের যাত্রী। ট্রেন চলবার সম্ভাবনা নেই দেখে আমারই মতন নেমে পড়ে এদিক-ওদিক হাঁটছিল।

তারপর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিল, কিংবা ঘুমিয়েই ছিল, আমি দেখে মৃত মনে করেছিলাম।

মেয়েটির কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে কী করছ?’

মেয়েটি হেসেই বলল, ‘আপনার মতন বেড়াচ্ছি।’

‘কেন, ট্রেনে ভালো লাগে না?’

‘বিচ্ছিরি! লোকের ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। এ জায়গা আমার খুব চেনা। চলুন আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই।’

বুঝতে পারলাম মেয়েটি কাছাকাছিই থাকে। সম্ভবত গিডনীতে। স্বাস্থ্যের জন্য অনেকেই গিডনীতে আসে।

বললাম, ‘চলো। ট্রেন আবার ছেড়ে দেবে না তো?’

‘দিক না, ট্রেনের চেয়ে আগে আমি ছুটতে পারি।’

কথাটা সত্যি। কারণ কোনো মেয়ে যে এত দ্রুত হাঁটতে পারে তা আমার ধারণার অতীত ছিল। আমি লম্বা লম্বা পা ফেলেও তার নাগাল পেলাম না। সে আমার চেয়ে অন্তত চার-পাঁচ গজ আগে রইলই।

‘তুমি থাকো কোথায়?’

আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটি ফিক করে হাসল।

‘ওই তো রেললাইনের ধারে।’

বুঝতে পারলাম মেয়েটি পরিহাস করছে। আসল ঠিকানা আমাকে বলতে চায় না।

হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। উঁচু-নীচু জমি। মাঝে মাঝে পাথরে হোঁচট খাচ্ছিলাম, কিন্তু আশ্চর্য, একটানা মেয়েটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছিলাম।

মেয়েটি বোধ হয় আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছিল।

হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আপনারা কলকাতা শহরের লোক কিনা, তাই হাঁটতেই পারেন না। একটু পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে ওঠেন। নিন, হাত ধরুন।’

ঠিক মনে হল আমার হাত যেন বরফের স্পর্শ পেল! আমার সব রক্ত জমে হিম হয়ে গেল! সারা হাত অবশ।

‘তোমার হাত এত ঠান্ডা যে?’

মেয়েটি আবার ফিক করে হাসল।

‘সব সময়েই বাইরে থাকি কিনা। তা ছাড়া, শরীরে রক্তই যে নেই।’

মেয়েটি প্রায় টানতে টানতে আমায় নিয়ে চলল।

চাঁদের ফালি মেঘে ঢাকা পড়ে গেল। সব অন্ধকার।

অনেক কষ্টে মেয়েটির হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মাটির ওপর বসে পড়লাম।

‘আর চলতে পারছি না।’

‘চলতে তোমাকে হবেই!’

মেয়েটির গম্ভীর কণ্ঠস্বরে মুখ তুলতেই চমকে উঠলাম।

কোথায় মেয়েটি? তার জায়গায় একটি নরকঙ্কাল! শুধু দুটো চোখ দিয়ে যেন আগুনের দীপ্তি বের হচ্ছে।

বাতাস লেগে দাঁতগুলো কড়মড় শব্দ করে উঠছে।

আমি খুব ভীরু প্রকৃতির নই। বন্ধুমহলে সাহসী বলে নাম আছে, কিন্তু মেয়েটিকে এভাবে নরকঙ্কালে রূপান্তরিত হতে দেখে, আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল।

এত কাছ থেকে এরকম চোখের ভুল হতে পারে?

‘ওঠো, চলে এসো!’

কণ্ঠস্বরও স্বাভাবিক নয়। অন্তত মেয়েটির গলার সঙ্গে কোনো মিল নেই।

বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। দুটো পা-ই ঠকঠক করে কাঁপছে। একবার ভাবলাম, তিরবেগে পিছন দিকে দৌড়াই, কিন্তু বুঝতে পারলাম, তাতেও মেয়েটির কাছ থেকে নিস্তার পাব না।

দুটি হাত দিয়ে হয়তো কণ্ঠনালী চেপে ধরবে। আমার প্রাণহীন দেহ এই তেপান্তর মাঠে পড়ে থাকবে।

মেয়েটিকে অনুসরণ করলাম। মেয়েটি নয়— একটা কঙ্কাল।

প্রতি পদক্ষেপে আওয়াজ হল, ঠক, ঠক, ঠক।

আমার চারপাশ ঘিরে ঠান্ডা বাতাসের আমেজ। মনে হল, ধারে-কাছে প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেছে।

নিজের শক্তিতে নয়, কঙ্কালের আকর্ষণে ছুটে চলেছি।

হঠাৎ লক্ষ করলাম, এগোবার সঙ্গে সঙ্গে কঙ্কালটি লম্বায় বাড়ছে— ছ-ফুট, সাত ফুট, আট ফুট!

গাছ ছাড়িয়ে কঙ্কালের মাথা। পাঁজরের মধ্য দিয়ে বাতাস বইছে। তার শন শন শব্দ।

ভয়ে চলবার শক্তি হারালাম। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাম।

কঙ্কাল কয়েক পা গিয়েই দাঁড়াল। দু-চোখে আগুনের হলকা। আমার অবস্থা দেখে হা হা করে পৈশাচিক হাসি হেসে আমার দিকে দীর্ঘ মাংসহীন হাত বাড়িয়ে দিল।

চিৎকার করে জ্ঞান হারালাম।

কতক্ষণ অচেতন ছিলাম, জানি না। যখন জ্ঞান হল, দেখলাম অন্ধকার আর নেই, প্রায় ভোর হয়ে এসেছে।

উঠে বসলাম। চারদিকে মাটির হাঁড়ি, বাঁশের টুকরো আর হাড় ছড়ানো। বোঝা গেল জায়গাটা শ্মশান।

সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম।

অনেক দূরে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে দুজন লোক যাচ্ছিল, হাততালি দিয়ে তাদের ডাকলাম।

কাছে আসতে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘গলৌডি স্টেশন এখান থেকে কতদূর?’

একজন বলল, ‘তা মাইল সাতেক হবে।’

সাত মাইল! কাল রাতে এই দীর্ঘ সাত মাইল কী করে হেঁটে এলাম, তা ভাবতেই আশ্চর্য লাগল।

এতটা পথ ফিরব, দেহে এমন শক্তি নেই। অথচ ফিরে আমাকে যেতেই হবে।

খুব ধীর পদক্ষেপে এগোতে আরম্ভ করলাম।

নিজেকে বোঝালাম, কাল রাতে যা ঘটেছে, নিজের চোখে যা দেখেছি, সবই আমার মনের কল্পনা। কোনো কারণে ভয় পেয়েছিলাম, ভয় থেকেই মন-গড়া মেয়েটির মূর্তি জন্ম নিয়েছে।

গলৌডি স্টেশনে যখন পৌঁছোলাম, তখন আর আমার দাঁড়াবার মতন অবস্থা নেই।

বোধ হয় অল্পক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম, চোখ খুলে দেখলাম আমার চারপাশে ছোটো একটা জনতা।

‘যাও, যাও, ভিড় করো না এখানে!’

স্টেশনমাস্টার লোকজন সরিয়ে দিয়ে আমার হাত ধরে নিজের কামরায় নিয়ে গেলেন। পোর্টারকে বলে এক গ্লাস গরম দুধ এনে মুখের সামনে ধরলেন।

দুধ খেয়ে অনেকটা চাঙ্গা হলাম।

স্টেশনমাস্টার প্রশ্ন করলাম, ‘বম্বে এক্সপ্রেস কি ছেড়ে দিয়েছে?’

‘না। স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। চক্রধরপুর থেকে ট্রলি করে কর্তারা আসছেন। তাঁরা কথা দিলে তবে গাড়ি ছাড়বে; কিন্তু আপনি কে, ওই শ্মশানে কী করছিলেন?’

শ্মশানে কী করে গেলাম, স্টেশনমাস্টারকে সবিস্তারে বললাম।

সব শুনে তিনি শিউরে উঠলেন।

‘সর্বনাশ, আবার সেই রেবা সোমের ব্যাপার!’

‘রেবা সোম? সে কে?’

‘বছর দুই আগের ঘটনা। এই বম্বে এক্সপ্রেসেই। যাত্রীর ছদ্মবেশে কয়েক জন ডাকাত মেয়ে-কামরায় উঠেছিল। তাদের আগাগোড়া বোরখা ঢাকা। হঠাৎ তারা বোরখা খুলে পিস্তল ছোরা দিয়ে মহিলাদের সামনে দাঁড়াল।’

‘সর্বনাশ, তারপর?’

‘সবাই অর্থ, অলংকার সব খুলে দিল, কেবল চোদ্দো-পনেরো বছরের একটি মেয়ে রুখে দাঁড়াল। ”না, কিছু দেব না। এখনই শিকল টানব।”

শিকল আর তাকে টানতে হয়নি। একটা ডাকাত তার গলাটা সাঁড়াশির মতন হাত দুটো দিয়ে চেপে ধরল, তারপর নিস্পন্দ দেহটা কামরার জানলা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিল।

তারপরই প্রায়ই রেবা সোমকে দেখা যায়। কখনো কামরার ভিতরে, কখনো জানলার বাইরে ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটে।

ভয় পেয়ে অনেকে অনেক বার চেন টেনে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে।’

‘তাহলে আমি যাকে দেখেছিলাম—’

‘নিঃসন্দেহে সে রেবা সোম। আপনার ভাগ্য খুব ভালো মশাই, প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছেন। আর একবার লাইন মেরামত হচ্ছিল, ট্রেন আধঘণ্টার জন্য থেমেছিল। একটি কলেজের ছোকরা আপনার মতন ট্রেন থেকে নেমে মাঠে দাঁড়িয়েছিল। ব্যস, তীক্ষ্ন একটা চিৎকার। চর্ট জ্বেলে অনেকে নেমে পড়ে দেখে ছেলেটি পড়ে আছে। গলায় দশ আঙুলের ছাপ। শ্বাসরোধ করে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।

লোকের ধারণা কোনো দুর্বৃত্ত ওত পেতে ছিল, সুযোগ বুঝে ছেলেটিকে মেরে ফেলেছে।

আমি কিন্তু সে কথা বিশ্বাস করিনি। দুর্বৃত্তই যদি ছেলেটিকে মারবে, তাহলে তার পকেটের ব্যাগ, হাতের ঘড়ি এসব ঠিক থাকবে কী করে? কেউ কাউকে বিনা উদ্দেশ্যে কখনো হত্যা করে?

অবশ্য কেবল রেবা সোম ছাড়া। তার আত্মা প্রতিহিংসা নেবার জন্য হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব পুরুষ মানুষের প্রতি তার ক্রোধ, ঘৃণা। কারণ পুরুষ মানুষের দ্বারাই সে নিহত হয়েছে এবং তার চরম বিপদে কোনো পুরুষ তাকে রক্ষা করতে ছুটে আসেনি।’

সেবারে ঘাটশিলায় আর নামিনি। কোথাও নামতে সাহস করিনি।

সোজা কলকাতায় ফিরে এসেছি।

অবসর সময়ে নিজের মনের সঙ্গে অনেক তর্ক করেছি। বার বার বোঝাতে চেষ্টা করেছি, যা কিছু ঘটেছে সব মিথ্যা, মনের কল্পনা। ভূতের অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমার চারপাশে ঠান্ডা একটা বাতাসের বলয় অনুভব করেছি। হাত থেকে এক গোছা কাচের প্লেট ভেঙে গেলে যেমন শব্দ হয়, তেমনি শব্দ করে কে যেন হেসে উঠেছে।

রেবা সোম বুঝি বলতে চেয়েছে, ‘ওরে অবিশ্বাসী, আমরা আছি। অর্থহীন যুক্তি দিয়ে আমাদের উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।’

ক্রমে যেন বিশ্বাসের বাঁধন শিথিল হয়ে আসছে। রেবা রোম আছে, তারা চিরদিন ছিল, থাকবেও— এই সত্যই স্বীকার করতে ইচ্ছা হচ্ছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *