রাত্রি নিশীথে
চামেলি বউদি ছাড়লেন না বললেন, ‘তুমি আমার সঙ্গে চলো। ঘাটশিলার জল বিখ্যাত। পনেরো দিনে তোমার শরীর ফিরে যাবে।’
কোথাও একটু যাবার প্রয়োজনবোধ করছিলাম। কলকাতার ভিড়, ধোঁয়া, ধুলো প্রায় দুঃসহ হয়ে উঠেছিল।
ভাবলাম দিন কতক বাইরে ঘুরে আসি। ঘাটশিলায় মুকুলের বাড়ি আছে। চামেলি বউদি মুকুলের স্ত্রী। অনেক সময় দেখা যায় আত্মীয়দের চেয়েও অনাত্মীয়রা বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
কিন্তু ঘাটশিলায় গিয়ে এত অভিজ্ঞতা হবে ভাবতেও পারিনি।
একেবারে পরিপূর্ণ বিশ্রাম। সম্পাদকের কিংবা পরিবেশকদের তাগাদা নেই। খুব ভোরে মুকুলের সঙ্গে ফুলডুংরির পথ ধরে বেড়িয়ে আসি। বিকালে মোটরে কোনোদিন টির্কার কিংবা মশাবনীর দিকে।
একদিন রাত তখন এগারোটা, ভাড়াটেরা সবাই চলে গেছে, আমি আর মুকুল উঠব উঠব করছি, চামেলি বউদি রান্নাঘরে আমাদের রাতের আহারের তদারকিতে ব্যস্ত, সেই সময় সামন্ত এসে দাঁড়ালেন। অধ্যাপক সামন্ত রঘুনাথপুর কলেজে রসায়ন পড়ান। স্থির, নির্বিকার মানুষ। আমাদের অনেক আড্ডায় যোগ দেন না। স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে বেড়াতে যান। মুকুল জিজ্ঞাসা করল, ‘কিছু বলবেন প্রফেসর সামন্ত?’
ভাবলাম হয়তো বাড়ি সম্বন্ধে সামন্ত কোনো অভিযোগ পেশ করবেন, তাই আমি উঠে দাঁড়ালাম।
সামন্ত হাত নেড়ে আমাকে বাধা দিলেন। বললেন, ‘আপনিও থাকুন, আপনারও শোনা দরকার।’
অগত্যা আবার চেয়ারে বসে পড়লাম।
‘ব্যাপারটা তিনদিন যাবৎ হচ্ছে, কিন্তু আমি সাহস করে আপনাদের বলতে পারছি না।’
মুকুল খুব নিরীহ মানুষ, স্থিতধী। খুব সহজে বিচলিত বা বিগলিত কোনোটাই হয় না। সে শুধু জিজ্ঞাসা করল, ‘ব্যাপারটা কী?’ উত্তরে সামন্ত পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন।
এবার লক্ষ করলাম সামন্তর মুখ পাংশু, নীরক্ত, ভয়ার্ত।
একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে বললেন, ‘দিন তিনেক ঠিক রাত দেড়টার সময় আওয়াজটা শুনছি। জানলার ওপাশে উঠানের উপর ঘুঙুর পায়ে কে যেন নাচছে, ঝুন, ঝুন, ঝুন। ভাগ্যে আমার স্ত্রীর ঘুম খুব গাঢ়। এসব আওয়াজ তার কানে যায় না, না হলে এখানে বাস করা দুষ্কর হত।’
আমি হাসলাম, ‘আপনি বিজ্ঞানের অধ্যাপক হয়ে শেষকালে এমন একটা ভূতের গল্প ফাঁদলেন।’
সামন্ত কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে দেখলেন তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আপনার কি মনে হয় বিজ্ঞান পৃথিবীর শেষ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে? সমাধান করতে পারে সব রহস্যের?’
আমি উত্তর দিলাম, ‘সে তো কোনো কালেই পারে না, কিন্তু আপনি কোনোদিন জানলা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করেছেন?’
‘না করিনি। আমার মনে হয় সেই ঝুন ঝুন শব্দ শুনলে আপনারও বিছানা থেকে ওঠবার সাহস হত না।’
আমি উঠে দাঁড়ালাম। ‘যদি সাহস করে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেন, দেখতে পেতেন একটা কালো বেড়ালের গলায় ছোটো ঘণ্টা বাঁধা। তার লাফালাফির সঙ্গে ওইরকম ঝুন ঝুন শব্দ হচ্ছে।’
কথাটা বলে আমি সোজা বাড়ির মধ্যে চলে এসেছিলাম।
চামেলি বউদি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার দাদা কোথায়?’
বললাম, ‘ভূতের গল্প শুনছে।’
‘ভূতের গল্প? কার কাছে?’
‘প্রফেসর সামন্ত বলছেন।’
চামেলি বউদি শুধু বললেন, ‘ওঁরা দশ নম্বরে আছেন না?’
বলেই তিনি চুপ করে গেলেন।
একটু পরে মুকুল খাবার টেবিলে এসে বসল। তার মুখ রীতিমতো গম্ভীর।
‘কীহে, ভূতের গল্প শুনলে।’
‘হুঁ।’ মুকুল গলা খাদে নামিয়ে ছোট্ট করে উত্তর দিল।
খাওয়া শেষ করে মুকুল আর আমি ওপরে উঠে এলাম। বিছানায় যাবার আগে আমরা কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে থাকি।
বারান্দা অন্ধকার। কেউ কারুর মুখ দেখতে পাচ্ছি না।
মুকুলের গলা শুনতে পেলাম। ‘আজ একটু জেগে থেকো।’
‘জেগে থাকব? কেন?’
‘রাত দেড়টা নাগাদ প্রফেসর সামন্ত আমাদের ডাকতে পারেন।’
আশ্চর্য হলাম, ‘কী ব্যাপার বলোতো মুকুল? কিছু রহস্য তুমি যেন চেপে যাচ্ছ বলে মনে হচ্ছে। সামন্তর গল্পে বিশ্বাস করে তুমি কি রাতের ঘুমটা নষ্ট করতে চাও?’
মুকুল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। যখন মনে হল সে আর কিছু বলবে না, এবার শুতে যাবে, তখন তার কণ্ঠ ভেসে এল।
‘দশ নম্বরটা আমি সচরাচর ভাড়া দিই না। এ বছর চেঞ্জার এত বেশি এসেছে, আর প্রফেসর সামন্ত কোনো খবর না-দিয়ে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে যেভাবে হাজির হয়ে পড়লেন, কাকুতিমিনতি করতে লাগলেন যে একমাত্র খালি বাড়ি ওই দশ নম্বর ওটাই ওঁকে দিতে হল।’
এবার আমি চেয়ার ঠেলে মুকুলের কাছাকাছি চলে গেলাম।
চাপা গলায় বললাম, ‘এভাবে আর উৎকণ্ঠিত রেখো না। ব্যাপারটা বলেই ফ্যালো।’
মুকুল কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। তারপর যেন স্বগতোক্তি করছে এমনভাবেই ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট স্বরে শুরু করল—
‘ছোটোবেলা থেকেই আমি রাজা-বাদশাদের প্রাসাদ-মহল এসব জায়গায় ঘুরতে যেতে বেশি পছন্দ করতাম। বড়ো হয়ে কর্মজগতে প্রবেশ করলেও অভ্যাসটা রয়ে গিয়েছিল। একদিন হঠাৎই ঘাটশিলার নবাবের এই পরিত্যক্ত বাড়িটি বিক্রি হওয়ার খবর কানে এল। এমন খবরে যে আমি আকৃষ্ট হব সেটা বলাই বাহুল্য। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম আর্থিক দূরবস্থার কারণে বর্তমান মালিক বাড়িটি বিক্রি করতে চায়। কিন্তু চাইলেই তো হল না। খরিদ্দার কোথায়? সবায়েরই ধারণা ওটা ভূতুড়ে বাড়ি। তাই কেনার জন্য অনেকে এগিয়ে এলেও শেষপর্যন্ত পিছু হঠল।
এমন একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই আমি ছিলাম। কিনে নিলাম; প্রায় বলতে পারো জলের দরেই বাড়িটা কিনে নিলাম। অবশ্য সিদ্ধান্তটা তাড়াতাড়ি নেবার পিছনে অন্য আর একটা কারণও ছিল। এই ঘাটশিলায় জল-হাওয়ার গুণে মানুষের স্বাস্থ্য ফিরে যায়— এমন একটা কথা চালু থাকায় ফি বছর বহু মানুষ এখানে আসে। তাই যদি একটা বোর্ডিং খুলতে পারি তাহলে রোজগারের আর ভাবনা কী!
যাইহোক, তখন কিছুদিন হল বিয়ে করেছি। আগে একদিন আমি এসে বাড়ি পরিষ্কার ও মেরামতি করিয়ে সস্ত্রীক এখানে চলে এলাম। বাড়ি দেখে তোমার বউদি ভীষণ খুশি। তিনতলা বাড়ি। দেওয়ালগুলোতে পর্যন্ত নানা কারুকার্য করা, লতাপাতার নানা নকশা আঁকা। বাড়ির সামনে উঠোনের মতো অনেকটা ফাঁকা জায়গা। তার একদিকে একটা কুয়ো। চারিদিকে গাছপালা, নিরিবিলি পরিবেশ।
যেদিন আমি এখানে প্রথম এসেছিলাম, সেদিন এখানকার বাজারে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। নাম আমজাদ আলি। স্থানীয় লোক। মাঝবয়সি, মিডিয়াম হাইট, রোগাটে গড়ন। পেশায় দর্জি। কথা প্রসঙ্গে আমি নবাব বাড়ি কিনেছি শুনে প্রথম কিছুক্ষণ আমার দিকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। তারপর শুধু বলল, ‘একটু সাবধানে থাকবেন, বাড়িটার বদনাম আছে।’ আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। সে কোনো উত্তর না-দিয়ে হনহন করে চলে গেল।
আমি ব্যাপারটি নিয়ে একটু চিন্তায় থাকলেও এখানে এসে যখন সবকিছু স্বাভাবিক চলতে থাকল তখন ও বিষয়টা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম।
কিছুদিন পর তোমার বউদি বাপের বাড়ি কলকাতায় চলে গেল। আমি একা। সারাদিন টুকিটাকি কাজ করার পর সন্ধ্যে নেমে এল। আর দিন-দুই পরেই অমাবস্যা। তাই এই সন্ধ্যে বেলাও চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেছে। গরমকাল। ভাবলাম আজ দোতলার ওদিকের ওই ধারের ঘরটাই শোব। কারণ ওদিকে জানালা থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসে। রাতের খাওয়া সেরে রাত্রি দশটার দিকে শুয়ে পড়লাম।
মাঝরাতে হঠাৎ একটা আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। ভালো করে কান পাতলাম আওয়াজটা কী শোনার জন্য। মনে হল কোনো মেয়ে পায়ে ঘুঙুর পরে গানের তালে তালে নেচে বেড়াচ্ছে। রাত্রির নিস্তব্ধতায় ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়িয়ে সে শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠল। আমি ভীতু এমন অপবাদ কেউ কখনো দিতে পারবে না। কিন্তু ওই জনমানবহীন পরিবেশে ওই আওয়াজ একটা ভয়ের আবহ তৈরি করল। চুপ করে শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, সকালের পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল।
ঘুম ভেঙে সকালের ঝলমলে পরিবেশ দেখে রাত্রির ঘটনাটি দুঃস্বপ্ন মনে হল। সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলাম। কিন্তু সেদিন রাতেও একই ঘটনা ঘটল। পরদিন সকালে উঠে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আজ যদি এমন ঘটনা ঘটে জানলা দিয়ে দেখব, কপালে যা আছে হবে।
সেদিন ছিল অমাবস্যা। একে ঘোর কালো রাত, তায় আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন। যে কোনো সময় বৃষ্টি নামবে। চারিদিকে গুমোট পরিবেশ। হাওয়া না থাকায় ঘুমও আসছিল না। ঝিঁঝির আওয়াজ রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করে দিচ্ছিল।
রাত্রি আন্দাজ দেড়টা হবে। আবার সেই শব্দ শুনলাম। আজকে শব্দটা যেন আরও কাছে, আরও স্পষ্ট। আমি সাহসে ভর করে বিছানা থেকে উঠে খোলা জানলার কাছে গিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। রাত্রির কালো অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখলাম— একটি তরুণী পরনে বাইজিদের পোশাক; খোঁপা-বাঁধা চুল, পায়ে ঘুঙুর পরে ঝুনঝুন শব্দে ছন্দে ছন্দে সারা উঠোন জুড়ে নেচে বেড়াচ্ছে।
আমার সারা শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল। মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। পা দুটো যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি আটকে রেখেছে। চলার শক্তি লোপ পেয়েছে।
একটু পরেই নাচতে নাচতে তরুণী উঠানের একপাশে চলে গেল। তারপর আর তাকে দেখা গেল না।
আমি জানতাম উঠানের ওইপাশে একটা কুয়া ছিল। সে কুয়া বহুদিন কেউ ব্যবহার করত না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আমি ফিরে এসে শুলাম।
সারা রাত আর ঘুম এল না। একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হবার সঙ্গে সঙ্গে কানে শব্দ ভেসে এল, ঝুন, ঝুন, ঝুন।
তারপর ওখানে আর শোবার সাহস হয়নি। অর্ধনিমীলিত ওই বসতবাড়ির একতলাতেই রাত কাটাতে হল।
তোমার বউদি বাপের বাড়ি থেকে কয়েক দিন পর ফিরে এল। কিন্তু ভয় পাবে ভেবে কথাটা আর তাকে বলিনি।
জানতাম, অন্য কাউকে বললেও এই উদ্ভট কাহিনি কেউ বিশ্বাস করবে না।
এর দিন কয়েক পরেই আমজাদ আলির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। হাটে।
তাকে বললাম, ‘আলি, তোমার সঙ্গে দরকারি কথা আছে। একবার সময় করে দেখা করতে পারবে?’
আমজাদ আলি মোলায়েম করে উত্তর দিল, ‘কোথায় দেখা করতে হবে বলুন মালেক!’
‘আজ বিকেলে আমার ডেরায় এসো। একসঙ্গে চা খাওয়া যাবে।’
‘ঠিক আছে সরকার, যাব।’
বিকালে চা জলখাবার খাওয়ার পর কথাটা পাড়লাম।
প্রথমে আমজাদ কিছু না জানার ভান করল। আমি অযথা ভয় পেয়েছি সে কথাও বলল, তারপর আমি চেপে ধরলাম।
‘আমি একটি কাহিনি আব্বাজনের কাছে শুনেছিলাম। কিন্তু সেটা কতদূর সত্যি জানি না।’
‘বেশ কী শুনেছ বলো।’
আমজাদ কাহিনি শুরু করল—
‘যে মেয়েটি নাচে সে বেনারসের মুন্নাবাই। যেমন চমকদার চেহারা, তেমনই ময়ূরের মতন নাচে। তখন এ এলাকার নবাব ছিলেন মহিউদ্দিন। দোর্দণ্ড প্রতাপ। সকলের হাতে মাথা কাটেন। দিনের বেলা ঘোড়ার পিঠে চরকি ঘুরতেন, অন্ধকার নামলেই অন্য অবস্থা। শরাব চাই, বাইজি চাই— চারপাশে চাই মোসায়েবের দল।
মুন্নাবাইয়ের তখন খুব নাম। কিছুটা বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু দেহে একটুও মেদের সঞ্চার হয়নি। বেতের মতন ছিপছিপে গড়ন।
তবে যেখানে-সেখানে মুজরা নেয় না। খুব রহিস আদমির কাছ থেকে ডাক না-এলে মুন্নাবাই ফিরিয়ে দেয়।
মহিউদ্দিনের খেয়াল হল মুন্নাবাইকে আনবেন। টাকা কোনো প্রশ্ন নয়, স্ফূর্তিটাই আসল।
মুন্নাবাইও মহিউদ্দিনের নাম শুনেছিল। তাঁর আভিজাত্য, প্রতিপত্তি, কৌলিন্য।
শুনে বলেছিল, এক রাতের বেশি থাকতে পারবে না। মহিউদ্দিন তাতেই রাজি। সুধা বেশি পান করা অনুচিত।
তখন ট্রেনের যুগ নয়। আসতেও বেশ সময় লাগত। কিছুটা বজরায়, বাকিটা পালকিতে। মহিউদ্দিন নিজে মুন্নাবাইকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলেন। বাইমহলে থাকতে দিলেন।
একটা রাতের ব্যাপার। পরের দিন সকালেই মুন্নাবাই ফিরে যাবে। ফৈজাবাদে মুজরা আছে।
রাত্রে নাচের ব্যবস্থা হল। সে এক এলাহি কাণ্ড!
মুন্নাবাইয়ের সঙ্গে সারেঙ্গিবাদক আর তবলচি এসেছে।
মুন্নাবাই ঘণ্টা দুয়েক নাচবে। রাত বারোটা থেকে দুটো।
মোসায়েবের দল দশটা থেকে আসরে এসে জমল। মহিউদ্দিন সায়েব এলেন বারোটা বাজবার ঠিক দশ মিনিট আগে।
বারোটায় মুন্নাবাই কুর্নিশ করে এসে দাঁড়াল। অনুমতি পেলেই নাচ শুরু করবে।
তখন মুন্নাবাইয়ের বয়সের অপরাহ্ন। কিন্তু কোথাও মাংস একটু কোঁচকায়নি। স্বর্ণাভবর্ণ একটুও তামাটে নয়। খোঁপা বাঁধা, চুল খুলে দিলে নিতম্ব স্পর্শ করত। দেখতে একেবারে তরুণী।
নাচ শুরু হল। অপূর্ব নাকি সেই নাচ! নাচ নয়— যেন নিবেদন। নিজেকে কলালক্ষ্মীর দরবারে নিবেদন করছে মুন্নাবাই।
মহিউদ্দিন সাবাস বলতেই মোসায়েবের দল সমস্বরে বলে উঠল, ‘কেয়াবাত, কেয়াবাত!’ সকলের আওয়াজ ছাপিয়ে একটি কিশোর কণ্ঠ শোনা গেল, ‘বেহস্ত কা হুরি!’
মনে হল মুন্নাবাই যেন চমকে উঠল। ঘাড় ফিরিয়ে একবার কিশোরকে দেখবার চেষ্টা করল। বুঝি দেখলও। মুহূর্তের জন্য সারা মুখ আরক্ত হয়ে উঠল।
তারপর থেকেই নাচের জোর যেন কমে এল। দু-একবার ছন্দপতন ঘটল। বিরক্তিতে তবলচি ভ্রূ কোঁচকাল।
মুন্নাবাই সামলে নিল, কিন্তু পুরোপুরি নয়। বার বার কিশোরের দিকে দৃষ্টিপাত করতে লাগল। তারপর অদ্ভুত এক কাণ্ড করল। নাচতে নাচতে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল উঠানে।
তারপর ঝুপ করে একটা শব্দ। ক্ষীণ আর্তনাদ বাতাসে মিশে গেল।
মহিউদ্দিন সাঙ্গোপাঙ্গা নিয়ে ছুটে বাইরে এলেন।
ঘন অন্ধকার। আলো জ্বালালেন। সেই আলোয় খুঁজতে খুঁজতে সবাই দেখল কুয়ার মধ্যে মুন্নাবাই পড়ে আছে। বহু কষ্টে তার দেহ ওপরে ওঠানো হল। প্রাণহীন দেহ। ঘাড়টা মটকে গিয়ে চাপ চাপ রক্ত জমে আছে। সারা মুখে যন্ত্রণার ছাপ!
সেই থেকে প্রতি অমাবস্যতেই দিন তিনেক মুন্নাবাইয়ের ঘুঙুরের শব্দ ভেসে আসে।
সামনের পেয়ারা গাছটায় রোজকার মতন প্যাঁচাটা এসে বসেছে। হঠাৎ সেটা ডেকে উঠল, হুম, হুম, হুম!
মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের স্রোত বয়ে গেল। মনে হল এই পরিবেশে সাহস, যুক্তি সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আদিম সংস্কার, পুরোনো চিন্তাধারা মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করে।
লক্ষ করিনি, খাওয়া সেরে কখন চামেলি বউদি পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
মুকুল চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড়ো। আবার প্রফেসর সামন্ত হয়তো ডাকতে আসবেন।’
আমি ব্যাকুলকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘একটা কথা মুকুল বলো। ওই কিশোরটি মুন্নাবাইয়ের কে?’
‘ছেলে, আমজাদ বলেছিল, ছেলেটি নাকি হারিয়ে গিয়েছিল। তারপর ভাসতে ভাসতে নানা ঘাটের জল খেয়ে মহিউদ্দিনের কাছে এসেছিল। কুসঙ্গে পড়ে ছেলেটির সার পদার্থ ছিল না।’
আবার প্রশ্ন করলাম, ‘বোঝা যাছে মুন্নাবাই আত্মহত্যা করেছিল।’
‘সেটাই সম্ভব। মার নাচের আসরে ছেলের বাহবা— এটা সহ্য করা তার মনে কঠিন হয়েছিল।’
আর কোনো কথা হল না। আমি শুতে চলে এলাম।
শুলাম বটে, কিন্তু ঘুম এল না। চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় মুন্নাবাইয়ের নাচের আসর চলেছে। অপরূপ ছন্দে বাইজি নেচে চলেছে। তারপর একটা শব্দ, একটা আর্তনাদ, কিন্তু মুন্নাবাইয়ের অতৃপ্ত আত্মা এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে কীসের আশায়?
মাথার কাছে টর্চ আর লাঠি নিয়ে শুয়েছিলাম।
রাত্রে জেগেই ছিলাম। প্রফেসর সামন্ত ডাকতে আসবেন।
সাহস করে জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে চোখ বোলালাম। কয়েক বছর আগে মুকুল যে দৃশ্য দেখেছিল, তাও দেখব।
খুব বেলায় মুকুলের ডাকে ঘুম ভাঙল। তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। চারদিকে রোদে ভরে গেছে। মুকুল মুখ টিপে হাসল।
‘কিহে, তোমার না জেগে থাকবার কথা।’
লজ্জা-জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘প্রফেসর সামন্ত ডাকতে এসেছিলেন নাকি? আমি রাতে কিন্তু জেগে ছিলাম। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছি।’
মুকুল মাথা নাড়ল, ‘না আসেননি। উনি যে আসবেন না সেটা আমি জানতাম। অমাবস্যা থেকে তিনদিন ওই শব্দ শোনা যায়।’
দিন তিনেক কাটল। ইতিমধ্যে প্রফেসর সামন্ত চলে গিয়েছেন তাঁর বাড়িতে পূজা। পূজার সময় বাড়িতে যান।
সপ্তমীর দিন লনে চেয়ার পেতে চুপচাপ বসেছিলাম।
মুকুল আর চামেলি বউদি মৌভাণ্ডার গেছেন পূজা দেখতে। সব চেঞ্জাররাই নানা পূজামণ্ডপে চলে গেছে। তাই যেন খালি।
আমাকে মুকুল সঙ্গে যেতে বলেছিল। আমি রাজি হইনি।
পূজার হইচই, গোলমাল এড়াবার জন্যই কলকাতা ছেড়েছি। সেইজন্যই আওয়াজের মধ্যে যেতে আর ইচ্ছা করল না।
হঠাৎ ঝুপ করে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেল। লোডশেডিং। ঘাটশিলায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
চুপচাপ বসে রইলাম। অন্ধকার সূচিভেদ্য।
লনের গাছপালাগুলোকে আলাদা করে চেনার উপায় রইল না।
ঝুন, ঝুন, ঝুন। আওয়াজটা কানে যেতেই চমকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। মনে হল খুব কাছে মুন্নাবাইয়ের ঘুঙুরের একটানা শব্দ।
আশ্চর্য লাগল। অমাবস্যা পার হয়ে গেছে। এখন তো মুন্নাবাইয়ের নাচের আসর বসবার কথা না।
অস্বীকার করব না। সারা শরীর ভিজে গেছে। তালু শুকিয়ে কাঠ। চিৎকার করে কাউকে যে ডাকব এমন শক্তিও নেই।
অথচ ঘুঙুরের শব্দের বিরতি নেই। হঠাৎ মনে পড়ে গেল গেটে রমেশ রয়েছে। এ দেশের আদিবাসী ছোকরা। তার কাজ গেট পাহারা দেওয়া।
ছুটে গেটের দিকে চলে গেলাম। ‘রমেশ, একটু এদিকে এসো!’
আমার নিজের কণ্ঠস্বর নিজের কানেই অদ্ভুত শোনাল। বিকৃত ভীত স্বর।
আমার অবস্থা দেখে রমেশও বোধ হয় একটু আশ্চর্য হয়ে থাকবে।
টর্চ আর লাঠি নিয়ে আমার পিছন পিছন এল।
তখনও অবিশ্রান্ত বেজে চলেছে, ঝুন, ঝুন, ঝুন। রমেশকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ওটা কীসের আওয়াজ বলোতো?’
কান পেতে একটু শুনে রমেশ হেসে উঠল, খুব জোরে।
‘কী হল?’
‘পোকার ডাক বাবু। আমাদের এখানে বলে মাতরু পোকা। পুজোর আগে আমদানি হয়, থাকবে লক্ষ্মীপূজা পর্যন্ত। এ পোকাটা নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ওদিকের উঠানে, এই ঝোপঝাড়ে, মাঝে মাঝে সিঁড়ির তলায়। দেখবেন—’
রমেশ লাঠি নিয়ে এগিয়ে গেল। জানলার পাশে একটা কামিনী ফুলের ঝাড়। সেই গাছে বার কয়েক জোরে জোরে লাঠি ঠুকতেই আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল।
রমেশ হেসে বলল, ‘এমন মজার শব্দবাবু, ঠিক মনে হয় মেয়েছেলে ঘুঙুর বাজিয়ে চলেছে।’
আমি একটা কথাও বলতে পারলাম না। মুকুল সব জেনেশুনেই তাহলে অলৌকিক এক কাহিনির অবতারণা করেছে। অধ্যাপক সামন্তকেও সম্ভবত ব্যাপারটা বলেছে। চামেলি বৌদিরও ষড়যন্ত্রে অংশ ছিল।
নিজেকে খুব বোকা মনে হল। চুপচাপ বসে আলো জ্বলে ওঠার অপেক্ষা করতে লাগলাম। তা হলেই অন্ধকার কেটে যাবে।