জনাব মঞ্জিল

জনাব মঞ্জিল

হাসপাতাল থেকে বের হয়েই মুশকিলে পড়ে গেলাম। চারিদিক ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এদেশের বিখ্যাত আঁধি।

হাসপাতাল থেকে স্টেশন মাইল তিনেকের কম নয়। কিন্তু এই অন্ধকারে যখন দু-হাত দূরের বস্তু দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, তখন টাঙ্গা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

হাসপাতালে আশ্রয় নেব তাও সম্ভব নয়। ছ-টায় গেট বন্ধ।

কোনোরকমে পথ হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগলাম। যদি কোথাও কোনো আশ্রয় পাই।

হাতে ওষুধের নমুনা ভরতি ব্যাগ। জীবিকা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের। পথেই বাস। ডাক্তারখানা আর হাসপাতাল ঘুরে বেড়াতে হয়।

সোনায় সোহাগা। কনকনে বাতাস শুরু হল। মনে হল ধারে-কাছে কোথাও বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। বৃষ্টি এখানে হলেই দুর্দশার একশেষ!

বেশ কয়েক বার হোঁচট খেলাম, পাথরে ঠোক্কর, গাছের টুকরো ডাল এসে কপালে লাগল।

ঘন অন্ধকারে সাদা মতো কী-একটা বস্তু দেখা গেল।

খুব কাছে গিয়ে দেখলাম একটা গেট। প্রায় জরাজীর্ণ। পা দিয়ে অনুভব করে বুঝলাম, ছোটো ছোটো নুড়ি বিছানো।

লখনউ শহরে বহু রহিস আদমির পরিত্যক্ত আবাস আছে। যত্নের অভাবে ভগ্নপ্রায়।

পাথরের ওপর দিয়ে এগোতেই একটা বাড়ি নজরে এল।

একতলা বাড়ি, কিন্তু গড়ন দেখে মনে হয় এক সময়ে খুব মজবুত আর সুদৃশ্য ছিল। সুগোল থাম, লতাপাতার নকশা আঁকা। দরজা বন্ধ। ভারী পাল্লার দরজা।

ছুটে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলাম।

মাথার ওপর আচ্ছাদন চাই। প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে নিষ্কৃতি।

দু-বার ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল।

অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত হয়ে যেতে দেখতে পেলাম, ছিন্ন ধুলি মলিন কার্পেট। চারদিকে কিংখাবের তাকিয়া। তাদের অবস্থাও খুবই খারাপ।

বাইরের অন্ধকার বোধ হয় কিঞ্চিৎ তরল হয়ে এসেছে, তাই অভ্যন্তরের সব কিছু একটু একটু দেখা যাচ্ছে।

খুব ক্লান্ত লাগছে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। একটা তাকিয়া টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লাম। ব্যাগটা জড়িয়ে ধরে।

বিকেলে পেটে পড়েছে শুধু চা আর শীর্ণদেহে দুটি পাউরুটির টুকরো। ভেবেছিলাম স্টেশনে গিয়ে পেট পুরে রাতের খাবার খেয়ে নেব, কিন্তু বিধি বাদ সাধলো।

এ দুর্যোগ কখন থামবে ঈশ্বর জানেন!

ঘুমিয়ে পড়ার আগে টের পেলাম ভারী পাল্লার দরজাটা এক সময়ে বন্ধ হয়ে গেছে, তাই বাইরের ঠান্ডা বাতাস আর ভিতরে আসছে না।

নূপুরের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।

চোখ খুলে দেখলাম, ঝোলানো বাতিদানে অজস্র বাতি। দেয়ালে কম্পমান একটা ছায়া।

উঠে বসলাম। প্রথমে ভাবলাম স্বপ্ন ছাড়া আর কী!

কিন্তু না, বার বার দু-হাতে চোখ মুছেও সামনের দৃশ্য মুছতে পারলাম না।

অনিন্দসুন্দরী এক নর্তকী। বুকে কাঁচুলি। পরনে ঘাগরা। নাচের তালে জরি-বাঁধা বিনুনি দুলছে।

সারেঙ্গির আওয়াজ। তবলার বোল।

চোখ ফিরিয়ে দেখলাম সবুজ তাকিয়া ঠেস দিয়ে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। মাথার চুলে, দাড়িতে কমলা রং-এর কলপ। দৃষ্টিতে কলুষ কামনার ছাপ। পলকহীন চোখে নর্তকীর যৌবন জরিপ করছে।

বৃদ্ধের সামনে শ্বেতপাথরের রেকাবিতে স্তূপীকৃত বেলফুল।

দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলাম।

একটু পরে নাচ থামল। সারেঙ্গি-বাদক আর তবলচি সেলাম করে বিদায় নিল।

নর্তকী এগিয়ে এসে একেবারে বৃদ্ধের কোলের কাছে বসল।

বৃদ্ধ আবেগ কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘কুলসম—’

‘হুজুর!’

‘তুমি যে আমার নাচের আসরে আবার আসবে তা আমি ভাবতেও পারিনি।’

‘আমি কি না-এসে পারি হুজুর!’

‘দু-বার ফৈজাবাদে তোমাকে খবর পাঠিয়ে ছিলাম, তুমি ছিলে না।’

‘না হুজুর, আমি মুজরোয় গোয়ালিয়র গিয়েছিলাম। ফিরে খবর পেয়েই চলে এসেছি।’

‘আজ আমার ভগ্নদশা কুলসম। তোমাকে নজরানা দেবার অর্থ আমার নেই। এই ভাঙা মঞ্জিলে মৃত্যুর অপেক্ষা করছি।’

‘ওভাবে কথা বলবেন না হুজুর। আপনার সঙ্গে যে আমার টাকা পয়সার সম্পর্ক নয়, তাতো আপনি ভালোই জানেন।’

‘কিন্তু আমাদের মহব্বতের সম্পর্ক— এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে?’

‘কে কী বিশ্বাস করবে তা নিয়ে আমার একটুও মাথাব্যথা নেই। আমি চিরদিন আপনার বাঁদী।’

‘পিয়ারি কুলসম!’

বৃদ্ধ নর্তকীকে বুকে টেনে নিতে যাবার চেষ্টা করতেই বিপর্যয়।

দুম করে একটা শব্দ। থামের আড়ালে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। নর্তকী চিৎকার করে বৃদ্ধের পায়ের কাছে পড়ে গেল।

‘একী হল? কোন দুশমন এমন কাজ করলে?’

বৃদ্ধ নীচু হয়ে কম্পমান হাতে নর্তকীর কাঁচুলি খুলে ফেলল।

দুটি স্বর্ণাভ পয়োধর। তার মাঝখানে রক্তের ধারা।

‘এই কে আছিস! হাকিম সায়েবকে একবার ডাক।’

বৃদ্ধের ভীত কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল। কেউ সাড়া দিল না।

নর্তকী ক্রমে নির্জীব হয়ে পড়ল।

বৃদ্ধ শ্লথগতিতে বোধ হয় অন্তঃপুরের দিকে গেল। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না। আবার শব্দ।

‘ইয়া আল্লা’ বলে চিৎকার করে মেঝের ওপর পড়ে গেল।

একটা ছায়া নিঃশব্দে সরে গেল।

আমার অবস্থা কাহিল। ক্ষুধার্ত শরীর এমনিতেই অবসন্ন ছিল, সামনে দুটি হত্যাকাণ্ড দেখে শরীরের রক্ত শীতল হয়ে গেল।

একবার ভাবলাম এইবেলা এখান থেকে পালাই। বাইরে হয়তো এতক্ষণে আঁধি পরিষ্কার হয়ে গেছে। পথ চলতে কোনো অসুবিধা হবে না। উঠতে গিয়েই থেমে গেলাম। বাইরে মোটরের শব্দ। সিঁড়িতে ভারী বুটের আওয়াজ।

একজন ইনস্পেকটর, সঙ্গে দুজনে পুলিশ। একেবারে পিছনে কামিজ পাজামা-পরা একটি লোক, ভৃত্য শ্রেণির বলেই মনে হল।

‘এই দেখুন হুজুর কুলসমের লাশ।’

কুলসম একভাবে পড়ে আছে। ঊর্ধ্বাঙ্গে কিছু নেই। দুটি স্তনের মাঝখানে শোণিতের গাঢ় কালো রেখা।

ইনস্পেকটর হাঁটু মুড়ে বসে পরীক্ষা করলে, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘জনাবের দেহ কই?’

‘ওই যে হুজুর সিঁড়ির ওপর। থামের পাশে।’

ইনস্পেকটর এগিয়ে গেল।

বৃদ্ধের মৃতদেহ পরীক্ষা করল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘এ বাড়িতে কে থাকে?’

‘জনাব আর আমি, হুজুর!’

‘তাহলে গুলি করল কে?’

‘তাতো জানি না হুজুর। আমি রসুইখানায় ছিলাম। পর পর দু-বার বন্দুকের শব্দ শুনে রসুইখানা থেকেই উঁকি দিয়ে দেখলাম এই কাণ্ড। আমি আর এদিকে আসিনি। কোতোয়ালিতে খবর দিতে ছুটেছিলাম।’

‘তাহলে তো তোমাকে গ্রেপ্তার করতে হয় মনসুর।’

মনসুর ভীতি-বিহ্বল কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে? আমি বন্দুক কোথায় পাব হুজুর। তা ছাড়া জনাবকে আমি কেন গুলি করতে যাব, যদিও ওই বাইজি মেয়েটা আমার দু-চোখের বিষ।’

‘তাহলে আসমান থেকে গুলি এল?’

ইনস্পেকটর এদিক-ওদিক চোখ ফেরাতেই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। বাইরের লোক তো আমিই রয়েছি। যদিও আমার কাছে বন্দুক নেই, কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পর কোনো আসামিই নিজের কাছে হত্যার হাতিয়ার রেখে দেয় না।

নীচু হয়ে একটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করে রইলাম।

ভাগ্য ভালো, আমার দিকে ইনস্পেকটরের নজর পড়ল না।

‘কুসলম এতদিন এই মঞ্জিলে রয়েছে?’

‘আজ বিকালে এসেছে হুজুর। ফৈজাবাদ থেকে টানা মোটরে। এক রহিস আদমি নামিয়ে দিয়ে গেছে।’

‘তোমার মনিবের বাইজি পোষার মতন টাকাকড়ি আছে এখনও? আমরা তো জানি কিছুই নেই। যৌবন থেকে দু-হাতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সব নষ্ট করেছেন।’

‘কিছুই নেই হুজুর। আপনারা ঠিকই জানেন। এ পয়সাকড়ির ব্যাপার নয়।’

‘তবে?’

‘মহব্বতের ব্যাপার।’

‘মহব্বত? একটা বুড়োর সঙ্গে নও জোয়ানির মহব্বত?’

‘হ্যাঁ হুজুর! আজ দশ বছর ধরে। কুলসমের বয়স যখন ষোলো তখন থেকে।’

ইনস্পেকটর হাতের ছড়িটা নিজের প্যান্টে আছড়াল।

‘তাজ্জব কী বাত! ব্যাপারটা কী?’

‘ব্যাপার জানি না হুজুর, শুনেছি দুর্ভিক্ষের সময় একটা গাছের নীচে জনাব কুলসমকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। কেউ বোধ হয় ফেলে দিয়েছিল। নিজের বাড়িতে আওরত কেউ না থাকায় কানপুরে বোনের কাছে দিয়েছিল। মানুষ করতে। তারপর জনাবের আর খেয়াল ছিল না। শিকার আর শরাবের নেশায় ডুবে ছিলেন। বেশ কয়েক বছর পর খবর পেলেন, বোনের বাড়ি থেকে কুলসম পালিয়েছে। বোধ হয় কারও হাতছানিতে।

জনাব কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করেননি। আমাকে বলেছিলেন, সব বাজে কথা মনসুর। আমার বোনকে তো আমি চিনি। নিশ্চয় পয়সার লোভে কুলসমকে কারও কাছে বিক্রি করে দিয়েছে।

তার বছর দুয়েক পর কুলসম এসেছিল। আমি তখন জনাবের কাছে বসে তাঁর পা টিপে দিচ্ছি। বিশ্বাস করুন হুজুর, আমার মনে হল, বেহস্ত থেকে হুরি এসে দাঁড়াল। মানুষের দেহে এতরূপ হয়, হতে পারে— আমার জানা ছিল না।

জনাব প্রশ্ন করলেন, ”কে?”

”আমি কুলসম।”

”কুলসম! কুলসম কে?”

জনাব স্মৃতি হাতড়েও কিছু পেলেন না।

”চিনতে পারলেন না হুজুর, এ নাম তো আপনারই দেওয়া। এ দেহও গাছতলা থেকে আপনিই তুলে নিয়েছিলেন।”

”ও কুলসম তুমি? এতদিন পরে তুমি এলে?”

”আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে। সেদিন কেন আমায় বাঁচিয়ে ছিলেন হুজুর! যদি দেহই বাঁচিয়ে ছিলেন, তবে সে দেহ পবিত্র রাখার ভার নেননি কেন?”

”পবিত্র রাখার ভার? কিন্তু তুমি তো স্বেচ্ছায় আমার বোনের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলে।”

”হ্যাঁ গিয়েছিলাম, কারণ এ ছাড়া আমার অন্য পথ ছিল না। আপনার বোন আমাকে দিয়ে ব্যাবসা করতে চেয়েছিলেন। তাই পালিয়ে ছিলাম। কিন্তু পালিয়েও নিজেকে বাঁচাতে পারিনি হুজুর।

মেয়েদের দেহই তাদের বড়ো শত্রু। আর একজনের হাতে পড়লাম। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে রক্ষা করতে পারলাম না। আজ আমি বাইজি হুজুর! নজরানা নিয়ে গান গাই, নাচি, দেহও বিক্রি করি।”

”তুমি এখানে থাক কুলসম। আমার কাছে।”

কুলসম রয়ে গেল।

আমি জনাবের কাছে অনেক দিন রয়েছি, তাঁর ধাত আমার খুব চেনা। আমি দেখতাম যখনই কুলসম কাছে এসে বসত, জনাবের চোখের কোণে রক্ত জমত। তার মানে আমি বুঝি। তার মানে দেহের তৃষ্ণা। উচ্ছল যৌবনকে ভোগ করার স্পৃহা।’

‘হুঁ, তারপর?’

‘সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, মেয়েটাও মজল। জনাবের দেহে যেন নতুন যৌবন ফিরে এল। ওদের ব্যাপার দেখে আমারই লজ্জা করত। কুলসম কিন্তু থাকল না। কুসলমকে তবিয়ত করার, খাওয়াবার সামর্থ্য জনাবের ছিল না।

কুলসম চলে যেত, টাকাপয়সা রোজগার করে আবার ফিরে আসত।’

‘তাহলে কুলসমই তোমার জনাবকে পুষত?’

‘তাই।’

‘তাহলে মনে হচ্ছে কুলসমের কোনো বাবুই বোধ হয় এ কাজ করেছে। প্রতিহিংসা নিয়েছে।’

ইনস্পেকটর কিছুক্ষণ কী ভাবল, তারপর সঙ্গের পুলিশ দুজনকে বলল, ‘এই লাশ উঠিয়ে নিয়ে চলো।’

তারপর মনসুরের দিকে ফিরে বলল, ‘তুমি এ মঞ্জিল ছেড়ে কোথাও যাবে না। বাইরে পুলিশ মোতায়েন করে রাখলাম। পালাবার চেষ্টা করলে মুশকিলে পড়বে।’

এত দুঃখ, এত ভয়ের মধ্যেও কৌতুক অনুভব করলাম। জাঁদরেল পুলিশ কুলসমের যৌবন পুষ্পিত অনিন্দিত দেহ কাঁধে ফেলে নিল।

আর একজন পুলিশ জনাবের দেহ তুলে নিয়ে গেল।

আমি নিজীবের মতন বসে। সব অনুভূতির ঊর্ধ্বে।

পুলিশরা বোধ হয় বাইরের দরজা খুলে রেখে গেছে। কনকনে ঠান্ডা বাতাস। ভোরের বাতাস।

ঠিক করলাম আরও পুলিশি হাঙ্গামা হবার আগেই পালিয়ে যাব।

যথেষ্ট শীতবস্ত্র সঙ্গে নেই, কিন্তু প্রাণের দাম এসব কিছুর চেয়ে বেশি। ব্যাগ হাতে উঠাতে গিয়েই থেমে গেলাম। মনে পড়ে গেল, গেটে পুলিশ মোতায়েন আছে। আমি বাইরে যাবার চেষ্টা করলেই ধরা পড়ব। খুট করে শব্দ হতেই চোখ ফেরালাম।

অদ্ভুত দৃশ্য।

মনসুর সিঁড়ির ধাপে বসেছে। হাতে একটা বন্দুক!

দুটো চোখ লাল টকটকে। গালের মাংসপেশী থরথরিয়ে কাঁপছে।

হ্যাঁ, আমি খুন করেছি বেশ করেছি। কুলসম আমাকে ভালোবাসেনি। বলেনি আমিই তার আসল লক্ষ্য, বুড়ো উপলক্ষ্য মাত্র। এখন বুঝতে পারছি, দিনের পর দিন আমার সঙ্গে ছলনার অভিনয় করেছে। সারা মঞ্জিল ঘুমিয়ে পড়লে নিঃশব্দ চরণে আমার কাছে এসেছে। প্রতি রাতে।

তারপর আসা বন্ধ করেছে।

একদিন আড়ালে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কি হল, আর আসো না যে?’

কুলসম দৃষ্টিতে অবজ্ঞা আর ঔদাসীন্য ফুটিয়ে বলেছে, ‘এখন আমার দর অনেক বেশি। নজরানা এক-শো আশরফি। নোকরের এ নজরানা দেবার সাধ্য নেই।’

‘নোকরের নেই, মনিবের কি আছে?’

‘তবে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জনাবের কাছে কেন পড়ে থাকতে? দৈহিক সুখ, মানসিক তৃপ্তি কোনটা তুমি পেতে?’

‘এ ছাড়া আমার আর কোনো পথ ছিল না।’

দুজনকেই দুনিয়া থেকে হটিয়ে দিতে বাধ্য হলাম।

আমি এবার মনস্থির করে ফেললাম।

কোনোরকমে গেটের কাছে পুলিশকে খবর দিই। বন্দুক সুদ্ধু আসামি মজুত। তা হলেই সমস্যার সামধান হবে।

উঠতে গিয়েও পারলাম না। দুটি চোখ ঘুমে বুজে আসছে। শরীরের গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে অবসাদ।

আবার শুয়ে পড়লাম।

খুনি ধরার দায়িত্ব আমার নয়। আমি বিদেশি। শেষকালে কোন বিপদের জালে জড়িয়ে পড়ব।

চোখ বন্ধ করতে গিয়েই চমক উঠলাম।

আবার বাইরে অনেকগুলো বুটের আওয়াজ। প্রথমে ইনস্পেকটর, তারপর নীল সুট পরা এক ভদ্রলোক। তার হাতে চামড়ার দড়িতে বাঁধা বিরাট আয়তন একটা অ্যালসেশিয়ান। অ্যালসেশিয়ানই যেন লোকটাকে ঠেলে নিয়ে আসছে।

ইনস্পেকটর হাত দিয়ে দেখাল। যেখানে কুলসমের কয়েক ফোঁটা রক্ত পড়েছিল সেই জায়গাটা।

অ্যালসেশিয়ান রক্তের গন্ধ শুঁকেই উত্তাল হয়ে উঠল। বাঁধন ছেঁড়ার নেশায় দুর্বার। ভদ্রলোক নীচু হয়ে বাঁধন খুলে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে অ্যালশেসিয়ান তিরবেগে ভিতরের দিকে ছুটল।

ভিতরে যেতে গিয়েও সিঁড়ির ধাপের কাছে আবার থামল। এখানেও কয়েক ফোঁটা রক্ত। সে রক্তও শুঁকল তারপর সিঁড়ি দিয়ে সজোরে লাফ দিল।

উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসলাম। বুঝতে পারলাম এখনই অ্যালসেশিয়ান লাফ দিয়ে মনসুরের টুঁটি কামড়ে ধরে তাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে আসবে।

জোড়া খুনের আসামি।

কিন্তু না, অ্যালসেশিয়ান বাইরে এসে আবার চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। একটা থাম বেষ্টন করে।

তার মার্বেলের মতন নীল চোখ দপদপ করে জ্বলছে। জিভ ঝুলে পড়েছে। বিদ্যুতের মতন ক্ষিপ্রগতি।

অ্যালসেশিয়ানের তীক্ষ্ন দৃষ্টি আমার দিকে। ভয়ে সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল!

হঠাৎ যদি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে? এই বিদেশে, সহায় সম্বলহীন অবস্থায় কী করব? কী করে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করব?

যেকোনো খুনের একটা উদ্দেশ্য থাকে। এই বাইজি আর বৃদ্ধকে হত্যা করার পিছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

আমি যে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। অফিসের কাজে লখনউ এসেছি, যেসব হাসপাতালে আর ডাক্তারদের কাছে গেছি, তারাই এর প্রমাণ দেবে।

কিন্তু এসব তো পরের কথা। উপস্থিত দুর্ভোগের হাত থেকে আমি কী করে পরিত্রাণ পাব?

বুঝতে পারলাম এই ঠান্ডা আবহাওয়াতে ঘামে আমার সর্বশরীর ভিজে গেল।

কী কুক্ষণে যে লখনউতে পা দিয়েছিলাম!

কিন্তু না, অ্যালসেশিয়ান আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। দ্রুত পায়ে থামের চারপাশে ঘুরতে লাগল, তারপর পায়ের নখ দিয়ে থামটা আঁচড়াতে আরম্ভ করল।

ইনস্পেকটরের সঙ্গে যে যে লোকটি এসেছিল, সে বলল, ‘কী ব্যাপার, লুসি এমন করছে কেন?’

লোকটা এগিয়ে এসে থামটা মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করল।

ইনস্পেকটরের দিকে চেয়ে বলল, ‘একটা হাতুড়ি পাওয়া যাবে?’

ইনস্পেকটর মনসুরকে বলল, ‘এই একটা হাতুড়ি নিয়ে এসো তো।’

‘হাতুড়ি? হাতুড়ি কোথায় পাব হুজুর?’

‘কয়লা ভাঙো কী দিয়ে?’

‘ইট দিয়ে। কয়লা ভাঙার রোজ দরকারই হয় না। প্রায়ই তো হোটেল থেকে খানা আসে।’

ইনস্পেকটর বলল, ‘ঠিক আছে। আমি দেখছি।’

একটু পরেই ফিরে এল। এক হাতে মোটর উঁচু করার জ্যাক।

জ্যাকটা নিয়ে ভদ্রলোক আস্তে আস্তে থামের গায়ে ঠুকতে লাগল। কিছুক্ষণ ঠোকার পরই থামের গায়ে একটা ফাটল দেখা গেল। ফাটলে চাপ দিতেই ছোটো দরজার মতন সেটা খুলে এল।

ভদ্রলোক ফাটলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা বন্দুক বের করে আনল।

‘এটা কার বন্দুক?’

স্পষ্ট দেখলাম মনসুরের মুখ পাংশু, নীরক্ত।

কাঁপা গলায় উত্তর দিল, ‘জনাবের।’

‘জনাবের বন্দুক এখানে কেন?’

‘জানি না হুজুর।’

ইনস্পেকটর বন্দুক খুলে কী দেখল। তারপর বলল, ‘নল দেখে বোঝা যাচ্ছে, এই বন্দুক থেকেই কিছু গুলি ছোড়া হয়েছিল। কে ছুড়তে পারে?’

মনসুর বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে হুজুর, জনাবই কুলসমকে গুলি করে তারপর নিজে আত্মহত্যা করেছেন।’

ভদ্রলোক একবার মনসুরের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে দেখল, তারপর বলল, ‘নিজেকে গুলি করে তোমার জনাব আবার এই থামের ফাটলে বন্দুকটা লুকিয়ে রেখেছে? তুমি যা-ইচ্ছা তাই বোঝাচ্ছ। জনাবের মাথায় গুলি লেগেছে, তার মানে প্রায়ই সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু। বন্দুক লুকোবার তার শক্তিও ছিল না, প্রয়োজনও নয়।’

ইনস্পেকটর আর ভদ্রলোকটি যখন বন্দুক পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ অ্যালসেশিয়ানের বিকট আওয়াজ শোনা গেল।

আমি চমকে মুখ ফেরালাম।

অ্যালসেশিয়ান মনসুরের একটা হাত কামড়ে ধরল।

মনসুরের করুণ কণ্ঠ, ‘বাঁচান হুজুর, বাঁচান! এ ইবলিশের বাচ্ছা আমাকে শেষ করে দিল!’

ইনস্পেকটর এগিয়ে এসে মনসুরের দু-হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।

বলল, ‘চলো ফটকে। সেখানে তোমার যা বলবার শুনব।’

আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম।

কেবল একটা কথা মনে হতে লাগল— এ রাত কী অনন্ত! কিছুতেই শেষ হবে না!

রাত শেষ হলেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ব।

উঁকি দিয়ে দেখলাম।

কয়েক মুঠো নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে। শীতের কনকনে বাতাস তখনও রয়েছে। তাকিয়ার ওপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। শোবার সঙ্গেই নিদ্রা।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল।

নূপুরের শব্দ। সারেঙ্গির আওয়াজ।

দু-হাতে চোখ মুছে উঠে বসলাম।

একী সম্ভব? আমার চোখ কি আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে?

সেই এক দৃশ্য!

অপূর্ব ছন্দে কুলসম নেচে চলেছে। সারেঙ্গির তালে তালে?

জনাব তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সজাগ করে নাচের তারিফ করছে।

এ কী করে সম্ভব! কোন দৃশ্য ঠিক? আগের না পরের?

চোখের সামনে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখলাম, তারপরেও এ নৃত্য কী করে সম্ভব হতে পারে!

আমি কি স্বপ্ন দেখছি!

পকেট থেকে রুমাল বের করে দুটো চোখ ভালো করে মুছে নিলাম।

না, সেই একই দৃশ্য!

বেশিক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারলাম না। ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল।

নূপুর আর সারেঙ্গির শব্দ ক্রমে দূরাগত মূর্ছনার মতন মনে হল।

* * *

কয়েক জন লোকের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল।

সকাল হয়েছে। চড়া রোদে সবকিছু স্পষ্ট, উজ্জ্বল।

‘সাহাব! সাহাব!’

চোখ খুলে দেখলাম কয়েক জন লোক আমার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। তাদের সাজপোশাক ঝাড়ুওয়ালা বলেই মনে হল।

উঠে বসলাম।

জরাজীর্ণ বাড়ি। অনেক জায়গা ধসে পড়েছে। দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে বট-অশ্বত্থের চারা।

ওপর দিকে দেখলাম, অবারিত আকাশ। ফাঁক নেই।

‘এখানে কী করে এলাম? তাকিয়া নেই, পুরোনো কার্পেট, কুলসম, মনসুর সব উধাও।

আমি কোথায়?’

আমার প্রশ্ন শুনে লোকগুলো পরস্পরের দিকে দেখল।

একজন বলল, ‘এখানে এলেন কী করে? লখনউ-এর লোক ভুলেও এদিক মাড়ায় না।’

‘কেন?’

‘এ জনাব সায়েবের কোঠি।’

‘জনাব সায়েব? যে জনাব সায়েবকে তার নোকর মনসুর গুলি করে মেরেছে?’

‘হ্যাঁ্য, হ্যাঁ, সেটা আপনি জানলেন কী করে?’

‘কাল রাতে আমি যে দেখলাম নিজের চোখে।’

আমার কথা শুনে লোকগুলো ফিস ফিস করে নিজেদের মধ্যে কী বলাবলি করল। একটা কথা আমার কানে এল। ‘বাওরা।’

বাওরা তো মানে পাগল।

এরা কি আমায় পাগল সাব্যস্ত করল।

‘কেন বাওরা কেন? আমি সব দেখেছি। মনসুর জোড়া খুন করেছে। জনাব আর বাইজি কুলসমকে।’

একজন আমার খুব কাছে এসে আমাকে নিরীক্ষণ করল। বোধ হয় পরীক্ষা করল শরাবের ঘোরে আমি এসব বলছি কিনা।

তারপর বলল, ‘উঠুন সাহাব। নিজের চোখে দেখুন।’

উঠলাম।

ভাঙা পাথর ডিঙিয়ে পিছন দিকে এলাম। সবুজ উঠোন। উঠোনের মাঝখানে পাশাপাশি দুটো কবর।

কবরের মাথায় উর্দুতে কী সব লেখা।

লোকটাই বলল, ‘এই দেখুন এটা জনাব সায়েবের কবর। লেখা রয়েছে, জনাব গিয়াসুদ্দিন রিজভি। জন্ম আঠেরো-শো চুয়ান্ন, মৃত্যু উনিশ-শো চব্বিশ।

আর এ পাশে দেখুন, কুলসম বাইয়ের কবর। জন্ম জানা নেই, মৃত্যু উনিশ-শো চব্বিশ।

বিস্মিত হলাম, তাহলে আমি কী দেখলাম!

একজন বলল, ‘খোয়াব।’

আর একজন বৃদ্ধ মৌলভি, যে ভিড় দেখে সরে এসে দাঁড়িয়েছিল, সে বলল, ‘না, না, খোয়াব নয়। এরকম ব্যাপার আগেও ঘটেছে। আমরা আত্মা মানি না। কিন্তু এ ঘটনা ব্যাখ্যা করার মতো বুদ্ধিও রাখি না। সাহাব, আপনি খুব বেঁচে গেছেন।’

উত্তর দিতে গিয়ে চমকে উঠলাম।

আবার কানে নূপুরের শব্দ ভেসে এল। সারেঙ্গির সুর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *