বুদ্ধির মুক্তি

বুদ্ধির মুক্তি 

ইংরেজী ১৯২৬ সাল। তখন ঢাকায় একটি ঢেউ উঠেছিল। চিন্তার ক্ষেত্রে, ভাবের ক্ষেত্রে, আদর্শের ক্ষেত্রে এই ঢেউ বেশ নাড়া দিয়েছিল তখনকার মুসলিম তরুণদের মনে। জিজ্ঞাসু ও কিছুটা সচেতন প্রবীণরাও এই ঢেউয়ের ধাক্কা এড়াতে পারেননি। দেশ, ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্য সম্বন্ধে গতানুগতিক চিন্ত াধারা বাদ দিয়ে একটু নূতন করে, পরীক্ষা ও বিচারের দৃষ্টি দিয়ে দেখার প্রেরণাই ছিল এই ঢেউয়ের লক্ষ্য। এই ঢেউ নাম নিয়েছিল- ‘ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। বলাবাহুল্য ‘ঢাকা’ বা ‘মুসলিম’ বিশেষণ দু’টির বিশেষ সার্থকতা ছিল না। কর্মক্ষেত্রের একটা স্থানিক পরিচয় দরকার বলেই এর নামের পূর্বে ঢাকা না লিখে উপায় ছিল না। না হয় এই ঢেউয়ের প্রভাব ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। এর বিভিন্ন অধিবেশনে ঢাকার বাইরের বহু সাহিত্যিক ও চিন্তাশীল সুধীও যোগ দিয়েছেন। একাধিক অধিবেশনের উদ্বোধন সঙ্গীত গেয়েছেন নজরুল ইসলাম। তাঁর সুখ্যাতি ‘ভোরের সানাই’ গানটি বিশেষভাবে এই সমাজের এক বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষেই রচিত। কলকাতা থেকে ঢাকার পথে রেলে ও জাহাজে বসে লেখা। খাতা দেখেই সেদিন গানটি তিনি তাঁর স্বাভাবিক উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছিলেন মনে পড়ে। প্রাচীন মুসলিম হলের ডাইনিং হল ভর্তি লোক-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছাত্র ও বাইরের জন-সমাগমে হলের কোথাও তিল ধারণের স্থান নেই-কবি কণ্ঠের এই গান সেদিন যে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও উল্লাসের সঞ্চার করেছিল তার তুলনা বিরল। মুসলিম সমাজ ও তার নানা সমস্যাই এই সমাজের প্রধান আলোচ্য ছিল বটে, কিন্তু বহু সুধী অমুসলিমও এই সমাজের প্রত্যেক অধিবেশনে যোগ দিতেন, প্রবন্ধ পড়তেন, আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতেন। 

সুকবি ও সুগায়ক অধ্যক্ষ সুরেন মৈত্র এই সমাজের বহু অধিবেশনে গেয়েছেন বহু গান। সুবিখ্যাত সাহিত্যিক চারু বান্দোপাধ্যায় ও ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার যোগ দিয়েছেন এই সভার বহু আলোচনায়। এ’র এক বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন স্বয়ং শরৎচন্দ্র। তাঁর অভিভাষণে এবার থেকে মুসলিম সমাজ নিয়ে তিনি উপন্যাস লিখবেন এই সংকল্পও জ্ঞাপন করেছিলেন। এরপর দীর্ঘদিন তিনি সুস্থ ছিলেন না। পরেত মারাই গেলেন। 

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের’ বার্ষিক মুখপত্রের নাম ছিল ‘শিখা’। সাধারণত বার্ষিক সম্মেলনে পঠিত রচনাগুলি দিয়েই শিখা’র কলেবর ভর্তি করা হতো। যতদূর মনে পড়ে ‘শিখার’ মাত্র পাঁচটি কি ছয়টি সংখ্যাই বেরিয়েছিল। সম্পাদক হিসেবে যাঁর নামই মুদ্রিত হউক না কেন আসলে সম্পাদনা করতেন কর্মবীর আবুল হুসেন সাহেব। বেশীরভাগ খরচও বহন করতেন তিনি। ‘শিখা’র টাইটেল পৃষ্ঠায় একটি ক্ষুদ্র রেখা-চিত্র ছিল শুনেছি তাও এঁকেছিলেন আবুল হুসেন সাহেব। একটি খোলা কোরাণ শরীফ মানব বুদ্ধির আলোর স্পর্শে কোরাণের বাণী প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে, এ ছিল রেখা চিত্রটির মর্ম। কিন্তু এর একটা কদর্থ বের করতে বিরুদ্ধবাদীদের বেগ পেতে হয়নি। তাঁরা এর অর্থ রটালেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের সমর্থকরা কোরাণকে পুড়িয়ে ফেলে শুধু মানব বুদ্ধিকেই দাঁড় করাতে চাচ্ছে। বলাই বাহুল্য গোড়া থেকেই গোঁড়ার মুসলিম সাহিত্য সমাজের বিরোধী ছিল। চিন্তার কোষত্রে কায়েমী স্বার্থের বুনিয়াদ সবচেয়ে শক্ত। এর পর এঁরা রীতিমত বিরুদ্ধতা করতে লাগলেন সাহিত্য সমাজের। ফলে ছাত্রদেরও এক বড় দল সাহিত্য সমাজের বিপক্ষে চলে গেল। মুসলিম হলে মুসলিম সাহিত্য সমাজের অধিবেশনে নিষিদ্ধ হলো। বাধ্য হয়ে জগন্নাথ হল ও লীটন হলে সভা করতে হতো। সমাজ নেতাদের কাছে আবুল হুসেন সাহেব ও কাজী আবদুল ওদুদকে সাহিত্য সমাজের নেতা হিসেবে জবাবদিহি হতে হলো। নবাব বাড়ীতে সভা বসল। ইসলাম গেল, মুসলিম সমাজ ডুবল এ ধরনের একটা মনোভাব বিরুদ্ধ শিবিরে ছড়িয়ে পড়ল। যুক্তি ও বুদ্ধির কাছে হেরে সেদিনকার সমাজ নেতারা সাহিত্য সমাজের কোনো কোনো কর্মীর উপর গায়ের জোর প্রয়োগ করতেও দ্বিধা করেনি। এর ফলেও কিন্তু সাহিত্য সমাজে ভাঙ্গন ধরেনি। ভাঙ্গন ধরেছিল সাহিত্য সমাজের যাঁরা স্তম্ভ তাঁরা যথন নানাদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লেন তখন। কাজী আবদুল ওদুদ কলকাতায় বদলি হয়ে গেলেন। আবুল হুসেন সাহেব বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে প্রথমে ঢাকা বার, পরে কলকাতা হাইকোর্টে যোগদিলেন। উৎসাহী ও কর্মী ছাত্ররা পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় তথা ঢাকা ছেড়ে নানা কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়লেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতৃস্থানীয়দের একমাত্র সবেধন নীলমণি হয়ে কাজী মোতাহার হোসেন রইলেন ঢাকায়। মুসলিম সাহিত্য সমাজ উঠে গিয়েছে দীর্ঘকাল, ‘শিখা’ও বন্ধ হয়ে গেছে, তবুও ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের আদর্শ ও মনোভাব একা কাজী মোতাহার হোসেন সাহেবই বহন করে চলেছেন এ-যাবৎ। “শিখার শেখ সংখ্যায় সম্পাদক হিসেবে আমার নাম ছাপা হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে ‘শিখা’র শিরোদেশে মটো হিসেবে ছাপা হতো- “জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।”

মুসলিম সাহিজ্য সমাজের ঢেউ যাঁদের মনে নাড়া দিয়েছিল আর যাঁরা এই প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের কারো মনে সাম্প্রদায়িক মনোভাব, গোড়ামী ও কোনো রকম সংকীর্ণতা কিছুমাত্র রেখাপাত্র করতে পারেনি। তখনো যেমন পারেনি, পরে সংক্রামক ব্যাধির মত সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখন সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তখনো তাঁরা ছিলেন এবং এখনো আছেন সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। স্বাধীন-চিন্তা ও মুক্ত-বুদ্ধির চর্চা তাঁরা এখনো অব্যাহত রেখেছেন। 

মুসলিম সাহিত্য সমাজের কর্মযোগী ছিলেন মরহুম আবুল হোসেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সূচনায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমার্সের অধ্যাপক ছিলেন। ভাবযোগী ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ’শাশ্বত-বঙ্গ’ ও ‘কবি গুরু গ্যোট’ যাঁর অমর কীর্তি এবং ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র সম্পাদক হিসেবে যিনি সম্প্রতি উভয় বঙ্গের সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তখন তিনি ছিলেন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক 

যাঁরা জাত সাহিত্যিক নন এই ঢেউয়ের ধাক্কায় তাঁদেরও অনেকে সেদিন চিন্তা করতে শুরু করেছিলেন, লিখতে কলম তুলে নিয়ে ছিলেন হাতে। তাঁদের মধ্যে কাজী আনওয়ারুল কাদীর ও কাজী মোতাহার হোসেনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। আগেই বলেছি মুসলিম সাহিত্য সমাজ তথা বুদ্ধির মুক্তিবাদীদের ভাবাদর্শ ও ঐহিত্য ঢাকায় এখনো মোতাহার হোসেন সাহেব একাই বহন করছেন। এখনো সেখানকার যতসব উদার ও প্রগতিশীলদের যেসব অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান হয় তাতে অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবেই তাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। তিনি এযাবৎ ‘সঞ্চরণ’ নামে একটি মাত্র প্রবন্ধের বই বের করেছেন। পরে অবশ্য তাঁর প্রবন্ধ, অভিভাষণ ও বক্তৃতা নানা সাময়িক কাগজে বেরিয়েছে। দুঃখের বিষয় সেসব এখনো সংকলিত হয়নি। হলে তাঁর চিন্তার পরিধি, ভাব ও ভাষার সারল্য ও প্রাঞ্জলতা, সর্বোপরি তাঁর মুক্ত-বুদ্ধির পরিচয় লাভ সহজ হতো। আনওয়ারুল কাদীর সাহেব আজ পরলোকে। সাহিত্য সমাজের সূচনায় তিনি ঢাকা কলেজে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। পরে শেষ পর্যন্ত বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শক হয়েছিলেন। প্রায় কুড়ি একুশ বছর আগে তিনি ‘আমার দুঃখ’ নাম দিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন। সেই বইর বিভিন্ন প্রবন্ধ আমাদের ভাষা, সাহিত্য, দেশ ও সমাজ সম্বন্ধে তাঁর উদার মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে, এই প্রবন্ধগুলি মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রভাব ও আবহাওয়ায় রচিত—কাজেই মুসলিম সাহিত্য সমাজ তথা বুদ্ধির মুক্তিবাদীরা যেসব কথা সেদিন বলতে চেয়েছিলেন তার কিছু কিছু তাঁর প্রবন্ধগুলিতে তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলা হয়েছে। অবশ্য আবুল হোসেন সাহেব ও কাজী আবদুল ওদুদের মতো ভাষার জোর ও চিন্তার ব্যাপকতা তাঁর ছিল না। 

কোনো চিন্তাই ব্যর্থ নয়। বিশেষ করে যেসব চিন্তায় রয়েছে সহানুভূতি ও সত্যকে বলবার নির্ভীকতা। আনওয়ারুল কাদীর সাহেবের বইটি এখন দুষ্প্রাপ্য—এই বই কখনো দ্বিতীয়বার ছাপা হবে কিনা জানি না। তাই তা থেকে কিছু কিছু রচনা এখানে উদ্ধৃত করে পাঠকদের খেদমতে পেশ করতে চাই। এতে তাঁর চিন্তাধারার যেমন পরিচয় মিলবে তেমনি পাওয়া যাবে মুসলিম সমাজের ভাবাদর্শের কিঞ্চিত আভাস। 

জাতিভেদ প্রথা, হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ ইত্যাদির ফলে দেশের বৃহত্তর কল্যাণ যেভাবে ব্যাহত হচ্ছে তার আলোচনা করে ঐ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘আমাদের দুঃখ’ এ বলে তিনি শেষ করেছেন: ‘এ ছাড়া ধর্মান্ধতা মুসলমানদের মধ্যে এত বেশি যে কোনরূপ স্বাধীন চিন্তার দরজা একেবারে বন্ধ। মুসলমানদের মধ্যে যারা একটু ঘরানা বা উচ্চবংশের বলে দাবি করতে চায়, তারা চাচ্ছে যে তারা যা বুঝেছে সবাইকে তাই বুঝতে ও মানতে হবে। তা না মানলেই ভাষা একদম কাফের। আর সব মুসলমান এক ছাঁচে গড়া হবে। খোদা এক, রসুল এক সব মুসলমানও তাই ঠিক এক ভাবাপন্ন হবে। জগতে দেখতে পাই ফুল ফল গাছ পাতা সব ভিন্ন ভিন্ন রকমের। একই জাতের গোলাপ ফুল তার মধ্যে কত রকমারি। আবার একই গাছের দু’টি গোলাপ ফুল এক রকম নয়। দু’টি জীবন্ত চলন্ত চেতনাযুক্ত মানুষ একরকম পাওয়া দায়। আর সমগ্র মুসলমান সমাজের লোকগুলি সব একই রকম হওয়া চাই। হচ্ছে না তবু হওয়াতেই হবে এই যে দুরাশা এতে খেয়ে সেরেছে মুসলমানকে। লাঠির আঘাতে সব হিন্দু যদি মুসলমান হয়ে যায় তার পরক্ষণেই দেখতে পাওয়া যাবে আবার হিন্দুর বীজ গজিয়ে উঠেছে। আবার সেই দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়েছে। কি হবে হিন্দুকে মুসলমান করে? মানুষ-মানুষ। দেশের লোক না খেয়ে মরছে; পেটে অন্ন নাই, পরিধানে বস্ত্র নাই। ‘স্ফীতকায় অপমান অক্ষমের বক্ষ হ’তে রক্ত শুষি করিতেছে পান লক্ষ মুখ দিয়া।’ এমন দুর্দশার দিনেও দেশের নেতাদের এইরূপ মনের ভাব। এভাব কি চিরস্থায়ী হবে?” 

স্যার পি.সি.রায় একবার হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা আলোচনা করতে গিয়ে বহু হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পর হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তার উত্তরে আনওয়ারুল কাদীর সাহেব ‘নেতাদের কথা’ নামে এক নাতিদীর্ঘ আলোচনা লেখেন। তার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন: “স্যার পি.সি রায় তাঁর এই প্রবন্ধ হিন্দু সমাজের মঙ্গলকে দেশের মঙ্গল বলতে চান। এ সম্বন্ধে ভারতবাসীকে নতুন করে ভাবতে হবে। দেশের মঙ্গল অর্থে দশের মঙ্গল বুঝতে হবে। দশ মানে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব।” অন্যত্র: “স্যার পি.সি.রায় সম্বন্ধে এখানে যে কথাটা বলতে চেয়েছি সেটা আমাদের দেশের সব নেতাদের সম্বন্ধেই খাটে। দেশের সব নেতাই ‘হিন্দু মুসলমান’ ইত্যাদি কথা এতই ব্যবহার করেন যে তাঁরা দেশের মঙ্গল চান এ-কথা স্বীকার করা যায় না। এঁরা কেউ হিন্দুর মঙ্গল কেউ মুসলমানের মঙ্গল চান। সাহিত্য বা বক্তৃতায় হিন্দুর মঙ্গল বা মুসলমানের মঙ্গলের জন্য যখন কোনো নেতা বিশেষ আগ্রহ দেখাতে যান বা তাঁর নেতৃত্বের দাবী সপ্রমাণ করতে চান তখন যে বিদ্বেষের বহ্নি জ্বলে ওঠে তাতে পুড়ে মরে উভয়েই। যাঁরা দেশের প্রকৃত নেতা হতে চান তাঁদের ‘হিন্দু মুসলমান’ এসব কথা বাদ দিয়ে কথা বলতে হবে। সম্প্রদায় বিশেষের নেতা হওয়া এক কথা আর দেশের সেবা করা অন্য কথা। একথা আমাদের বুঝতে ও শিখতে হবে। ‘হিন্দু মুসলমান এর এসব কথায় হয়ত নতুন ব্যাখারও দরকার হতে পারে। দেশ সেবার পন্থা সম্বন্ধে গতানুগতিকতার অনুসরণ করলে চলবে না। এ সম্বন্ধে নতুন করে ভাবতে হবে।’ 

এই প্রবন্ধের নিম্নলিখিত মন্তব্যও বেশ অর্থপূর্ণ ও স্মরণীয়: “সর্ব বিষয়ে এমন কি ধর্মের বেলায়ও ভারতবাসীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। আধ্যাত্মিক আহার যোগানই ধর্মের প্রধান কাজ। যে যে-ভাবে পার ‘শুদ্ধ’ হয়েই হোক বা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেই হোক যাতে তার আধ্যাত্মিক ক্ষুধা মিটবে তাই তাকে গ্রহণ করার মতো স্বাধীনতা দিতে হবে। তাতে কারো মনে ব্যথা লাগলে চলবে না। বৈচিত্র জগতের নিয়ম। বৈচিত্রকে মেনে নিতে হবে।” 

‘সামাজিক গলদ’ প্রবন্ধে লেখক বহু কথাই বলেছেন। কথাগুলি অবশ্য অপ্রিয় সত্য। কালের দীর্ঘ ব্যবধানেও তাঁর কথাগুলির অর্থ বা তাৎপর্য কিছুমাত্র কমেনি। তিনি এই প্রবন্ধে লিখেছেন: “আমাদের যোগ্য হওয়ার কতকগুলি অন্ত রায় আজকাল দেখতে পাওয়া যায়। প্রধান অন্তরায় হচ্ছে আমাদের শিক্ষা সম্বন্ধে উদাসীনতা। বাংলার মুসলমান সমাজের বয়স নিতান্ত কম নয়, কিন্তু এই দীর্ঘকালের মধ্যে আমাদের মধ্যে একজন রুশো, একজন পেট্‌সালট্জী একজন হারবার্ট স্পেসার জন্মান নি। আমাদের সমাজ একজন রাজা রামমোহন, একজন বিদ্যাসাগর, একজন বঙ্কিমচন্দ্র, একজন পিয়ারীচরণ, একজন রামতনু লাহিড়ী, একজন রাজনারায়ণ বসু কি একজন স্যার আশুতোষ তৈরি করতে পারেনি। এর একমাত্র কারণ আমরা শিক্ষা চাই না, আমরা বিদ্যা চাই না, জ্ঞানের মর্যাদা বুঝি না, সাহিত্যের আদর করি না, তাই আমাদের মধ্যে বিদ্বান নেই, বৈজ্ঞানিক নেই, সাহিত্যিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক নেই। আমরা দান ভালোবাসি। তাই আমদের মধ্যে দাতা আছে এবং দাতা আছে বলেই ভিক্ষুকের অভাব নেই। সেই রূপ আমরা যদি শিক্ষা ভালবাসতাম তবে শিক্ষাদাতা, শিক্ষিতজন ও শিক্ষান্বেষী কোনোটিরই অভাব হতো না।” 

এই প্রবন্ধের অন্যত্র লেখক ধর্ম সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে লিখেছেন : “বুদ্ধির মুক্তি না হলে ধর্ম শিক্ষা হতে পারে না। ধর্মের আদেশ ও নিষেধ পালন করার জন্য বুদ্ধির দরকার। বুদ্ধির অভাবে আজকাল আমাদের ভিতর প্রকৃত ধর্মভাব লোপ পেয়েছে। এখন গোঁড়ামিই আমাদের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে…আমাদের এই গোঁড়ামির প্রধান কারণ এই যে আমরা ধর্মের সব বিধি নিষেধের কতগুলো সহজ অর্থ করে নিয়েছি।…সহজ অর্থ করার দরুণ আমাদের ধর্মের সবার সার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই—রসুলোল্লাহর নামে দরুদ পড়া, রসুলোল্লাহ্র না’আত্‌ মিলাদশরীফ, ঈদ, বকর ঈদের সময় কিছু ঘটা আর বক্তৃতায় নামাজ রোজা হজ্জ জকাৎ ফেত্রা-এগুলির প্রশংসা করা। এ-গুলির পেছনে যে আরো কিছু থাকতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দেবার কোনো দরকার সমাজ অনুভব করতে চানা। আমাদের মানুষ হতে হবে। বলবান, জ্ঞানবান, বুদ্ধিমান মানুষ হতে হবে এ কথা আমাদের মনেও হয় না। নামাজ রোজা যদি অর্থশূন্য হয় তবে সে নাজাম রোজায় কতটুকু ক্ষতি বৃদ্ধি?… নামাজের এইরূপ সহজ অর্থে গোঁড়া মুসলমান সন্তুষ্ট হতে পারে কিন্তু জগৎ সেই মুসলমানকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখবে না। ফলে দাঁড়িয়েছে তাই, বর্তমান জগৎ মুসলমানকে কাঁটা মনে করছে। এদিকে এই সহজ অর্থের ফলে মুসলমান নিজেও ধর্মের কোনো স্বাদ পাচ্ছে না।” একদিন মুসলমান সমাজ সর্বত্র করুণা ভিক্ষা করত—চাইত সর্বত্র রক্ষা কবচ। সমাজের সেই মনোভাববে আনওয়ারুল কাদীর সাহেব এইভাবে দিয়েছেন ধিক্কার: “এখন আমাদের একমাত্র ভরসা Concession বা সরকারের দান বা অনুগ্রহের উপর। পরের দয়ার দানে প্রকৃত শক্তি অর্জন সম্ভবপর হবে না। পরে কতটুকু দিতে পারে! আর তাতে কি পেট ভরে? আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বলতে চান যে অবস্থা অনুসারে কিছু Special treatment বা বিশেষ ব্যবস্থা দরকার; না হলে চলে না। এমন চলা আমার মতে না চলা অপেক্ষা লজ্জাকর। বহুকাল ধরেই আমরা Concession Concession করছি। পেয়েওছি তা কিছু কিছু; কিন্তু অগ্রসর হয়েছি কতটুকু? সরকারের দয়ার (Concession) আশায় প্রকৃত মানুষ হওয়ার চেষ্টা আমাদের মধ্যে একদম নেই, থাকতে পারে না। যাদের কনসেশনের দিকে দৃষ্টি তাদের আত্মসম্মান জ্ঞান জন্মাতে পারে না। যাদের আত্মসম্মান জ্ঞান নেই তারা প্রত্যাশী হতে বাধ্য। পর-প্রত্যাশীর অন্য নাম ভিক্ষুক। ভিক্ষুক সমাজে লজ্জা, সমাজের বোঝা, উন্নতির কাটা। ধনী আত্মীয়ের উপর উদরান্নের জন্য নির্ভর করা যেমন ভিক্ষাবৃত্তিরই নামান্তর, সরকারের দিকে কনসেশনের (দয়ার) জন্য তাকিয়ে থাকাও সেইরূপে ভিক্ষুকতা। আমাদের বিদ্যা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রমশীলতা কোনোরূপ যোগ্যতা নাই বরং এ সমস্ত বিষেয়ে অন্যের চাইতে কম, অথচ সরকারের দয়ার উপর নির্ভর করে শতকরা ৮০ জনের চাকরি চাই এ ভাবটা যত শীগগির আমাদের মধ্য থেকে দূর করা যায় ততই আমাদের মঙ্গল, প্রতিবেশীর জগতের মঙ্গল। নচেৎ আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকব। জগৎ অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলছেও বলবে—ঐ যে সব ভিক্ষুকের দল। 

‘শিক্ষিতা নারীর বিবাহ’ শীর্ষক প্রবন্ধ লেখক কথা প্রসঙ্গে লিখেছেন: ‘অনেক সময়ে নাটক-নভেল-ভক্ত শিক্ষিতা নারীরা অত্যধিক তীব্র সতীত্বের উপাসক হয়ে পড়েন। কবে কোনো একদিন কোনো যুবক একটু স্নেহ দেখিয়ে মনকে আকৃষ্ট করেছিল, সেই স্মৃতিকে মনোমন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে আজীবন কুমারীব্রত অবলম্বন করে সতীত্বের আদর্শ রচনা করবার জন্য নিজেকে কল্পনায় উৎসর্গ করে ফেলেন। এই উৎকট সতীত্ব যে একটা খেয়াল এ সম্বন্ধে শিক্ষিতা নারীদের সচেতন হওয়া দরকার। সংসারে যে যার পথে চলে যায়। এঁদের উৎকট সতীত্বের মূল্য এঁদের কাছে যত বেশি, অন্যের কাছে তা না হতেও পারে। প্রত্যেক নারীর নারীত্ব তখনই সার্থক হয়, যখন তিনি বধূরূপে, মাতারূপে, প্রীতি বিলিয়ে গৃহে বিরাজ করেন। সতীত্বের উচ্চ আদর্শকে আমি সম্মান করি, তাই বলে মোহকে খেয়ালকে সম্মান করতে নারাজ।”

আজকের দিনের মত সে দিনও মুসলমান সমাজে উর্দু বাংলার তর্ক ছিল। ‘উর্দু বাংলা তর্ক নামক প্রবন্ধে আনওয়ারুল কাদীর সাহেব লিখেছেন: “যে সব সম্ভ্রান্ত মুসলমান বাংলা বর্জন করেছেন, উর্দু, যাঁদের মাতৃভাষা, কৃষ্টির দিক দিয়ে তাঁদেরও বিশেষ কিছু পরিচয় পাওয়া যায় না। অবশ্য উর্দুতে কথা বলতে পারাই একটি কৃষ্টি যদি বলা হয়, তবে স্বতন্ত্র কথা। তা না হলে ভাব (idea) হিসাবে এঁরাও যে এমন কিছু সম্পদশালী তা নিশ্চয় করে বলা চলে না। উর্দুসাহিত্যে এঁদের কারও কোনো বিশেষ দানের কথা শোনা যায় না। অন্য কোনো ললিতকলায়ও এঁদের কোনো এমন কিছু উল্লেখযোগ্য দানের নিদর্শন দেখা যায় না।” 

এ প্রবন্ধের উপসংহার করেছেন লেখক এই ভাবে: ‘অদৃষ্টের কি নিষ্ঠুর পরিহাস! এই হতভাগ্য বাঙালী মুসলমানই সবচেয়ে কম খেয়ে, কম পরে সকলের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করে এবং সকলের অসম্মান মাথায় নিয়ে দেশের সকলেরই অনু যোগাচ্ছে। তাদেরই মাথা গুতির উপর নির্ভর করে সম্ভ্রান্ত মুসলমান জজ্‌জ্ ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন। কিন্তু এরা কী অন্ন খায়, কী জলে তাদের পিপাসা মেটে, কী সুগভীর এদের অশিক্ষা, তা খোঁজ করবার কেউ নেই। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্র, শ্রাবণের অবিরাম ধারা, মাঘের প্রচণ্ড শীত, সবই এদের গায়ের উপর দিয়ে বয়ে যায়। এদের তপ্ত অশ্রু এদের গন্ড বেয়ে আপনিই ঝরে পড়ে, মোছাবার কেউ নেই। সকল সুযোগ ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত এরা। তার উপর এই উর্দুও বাংলা তর্ক দিয়ে তাদের ভাষাটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেবার বন্দোবস্ত, আর তাতে করে এই শ্রেণী বিভাগ। এমনি করে এই সর্বহারাদের একেবারে সর্বনাশ করা হচ্ছে।” 

“আমাদের দুঃখে” লেখকের দুঃখের কথাই বলেছেন। আমাদের অনেকের মতো তাঁরও একটি বড় দুঃখ সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’। তাঁর এই নামের প্রবন্ধটি তিনি শেষ করেছেন নিম্নলিখিত মন্তব্য দিয়ে: “কোনো তীব্র মন্তব্যের দ্বারা দেশের মঙ্গলের আশা করা বিড়ম্বনা। সাহিতিক্যের পথ নির্দেশ করে দেবার মত ধৃষ্টতা কারো নেই। সাহিত্যিক তাঁর স্বীয় অনুভূতি, তাঁর ভিতরকার অনুপ্রেরণা দ্বারাই পরিচালিত হবেন। তবে একথা ঠিক যে বর্তমানকালে সাম্প্রদায়িকতা হিন্দু-মুসলমান এ কথগুলো বাদ না দিলে সৎ সাহিত্য ঠিকমত গড়ে উঠবে না। সাহিত্যিক এসব সম্বন্ধে আচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে কোনো শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি সম্ভব করে তুলতে পারবেন না। 

হিন্দু মুসলমানদের বিরোধ, পড়শীর প্রতি অবিশ্বাস, অপ্রেম, এইসব দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তির চেষ্টা করা সবার দরকার। প্রার্থনা-আল্লাহ যেন এই দুর্ভাগা দেশকে চিরলাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দিয়ে সত্য ও প্রেম, জ্ঞান ও কল্যাণের দিকে অগ্রসর হওয়ার মত শক্তি দেন হিন্দু-মুসলমান সবাই যেন পূর্ণ প্রস্ফুটিত মানুষ হতে সক্ষম হয়।” 

আজ দেশ যে শুধু স্বাধীন হয়েছে তা নয় সামাজিক প্রগতিও অনেকখানি এগিয়ে গেছে। সাহিত্য সম্বন্ধেও আমাদের দৃষ্টি আজ অনেকখানি স্বচ্ছ। আচার বিচারের নিষেধ হয়েছে অনেকখানি শিথিল। নতুন সমাজের চেহারা পুরোপুরি না দেখলেও তার আভাস আমরা পাচ্ছি। এই বিপুল পরিবর্তন একদিনে হয়নি, কারও একার চেষ্টায় ঘটেনি। দীর্ঘদিন ধরে বহু মানুষ বহুভাবে এর পথ কেটেছেন, ভিত গেড়েছেন, আগামী দিনের পথ রচনা করতে নানা মালমসলা জুগিয়েছেন। তাঁদের অনেকের কথা আমরা ভুলে গিয়েছি। অনেকের স্মৃতি বিস্মৃতি গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সমাজের রথ-চক্র বড় ধীরে ও অলক্ষ্যে চলে। অলক্ষ্য থেকে নানা জনের নানা হাত তাকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। মুখর রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে এদের দানের মূল্য অনেক বেশী। শান্ত ও গম্ভীর প্রকৃতির, স্বল্পভাষী ও উদার-চেতা আনওয়ারুল কাদীর সাহেবও অলক্ষ্য থেকে সমাজ ও দেশের মঙ্গল চিন্তা করতেন এবং উপরের উদ্ধৃতিগুলি থেকেই পাঠক দেখতে পাবেন সেই চিন্তা মামুলী ও গতানুগতিক ছিল না। এ যুগে ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ যে মুক্ত-বুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তার ঢেউ তুলেছিল আনওয়ারুল কাদীর সাহেবের চিন্তা ও রচনা তারই সাক্ষাৎ ফল। আমরা শুধু বাঁচতেই চেয়েছি, চাই নি নিজের অস্তিত্বে ফলপ্রসূ করে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে। মনের তথা চিন্তার দিক দিয়ে ইতিহাসের মোকাবেলায় আমরা খুঁজে পাইনি কোনো নতুন হাতিয়ার অর্থাৎ নতুন কোনো সত্যের, যা সাহিত্য ও শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়ে জাতীয় মানসে কোনো নতুন সম্পদের অবদান রাখতে পেরেছে। মননশীলতার ক্ষেত্রে এমন বন্ধ্যাত্ব ইতিপূর্বে ইতিহাসের অন্য কোনো পর্বে দেখা যায় নি। 

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বুদ্ধির মুক্তি
প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

বুদ্ধির মুক্তি 

বুদ্ধির মুক্তি 

ইংরেজি ১৯২৬ সাল। তখন ঢাকায় একটি ঢেউ উঠেছিল। চিন্তার ক্ষেত্রে, ভাবের ক্ষেত্রে, আদর্শের ক্ষেত্রে এই ঢেউ বেশ নাড়া দিয়েছিল তখনকার মুসলিম তরুণদের মনে। জিজ্ঞাসু ও কিছুটা সচেতন প্রবীণরাও এই ঢেউয়ের ধাক্কা এড়াতে পারেন নি। দেশ, ধর্ম, সমাজ ও সাহিত্য সম্বন্ধে গতানুগতিক চিন্তাধারা বাদ দিয়ে একটু নতুন করে, পরীক্ষা ও বিচারের দৃষ্টি দিয়ে দেখার প্রেরণাই ছিল এই ঢেউয়ের লক্ষ্য। এই ঢেউ নাম নিয়েছিল–‘ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। বলা বাহুল্য, ‘ঢাকা’ বা ‘মুসলিম’ বিশেষণ দুটির বিশেষ সার্থকতা ছিল না। কর্মক্ষেত্রের একটা স্থানীয় পরিচয় দরকার বলেই এর নামের পূর্বে ঢাকা না লিখে উপায় ছিল না। না হয় এই ঢেউয়ের প্রভাব ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। এর বিভিন্ন অধিবেশনে ঢাকার বাইরের বহু সাহিত্যিক ও চিন্তাশীল সুধীও যোগ দিয়েছেন। একাধিক অধিবেশনের উদ্বোধন সঙ্গীত গেয়েছেন নজরুল ইসলাম। তাঁর সুবিখ্যাত ‘ভোরের সানাই’ গানটি বিশেষভাবে এই সমাজের এক বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষেই রচিত। কলকাতা থেকে ঢাকার পথে রেলে ও জাহাজে বসে লেখা। খাতা দেখেই সেদিন গানটি তিনি তার স্বাভাবিক উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছিলেন মনে পড়ে। প্রাচীন মুসলিম হলের কোথাও তিল ধারণের স্থান নেই–কবি কণ্ঠের এই গান সেদিন যে উৎসাহ, উদ্দীপনা ও উল্লাসের সঞ্চার করেছিল তার তুলনা বিরল। মুসলিম সমাজ ও তার নানা সমস্যাই এই সমাজের প্রধান আলোচ্য ছিল বটে কিন্তু বহু সুধী অমুসলিমও এই সমাজের প্রত্যেক অধিবেশনে যোগ দিতেন, প্রবন্ধ পড়তেন, আলোচনায় অংশ গ্রহণ করতেন। 

সুকবি ও সুগায়ক অধ্যক্ষ সুরেন মৈত্র এই সমাজের বহু অধিবেশনে গেয়েছেন বহু গান। সুবিখ্যাত সাহিত্যিক চারু বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডা. রমেশ মজুমদার যোগ দিয়েছেন এই সভার বহু আলোচনায়। এর এক বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেছেন স্বয়ং শরৎচন্দ্র। তার অভিভাষণে এবার থেকে মুসলিম সমাজ নিয়ে তিনি উপন্যাস লিখবেন। এই সংকল্প জ্ঞাপন করেছিলেন। এর পর দীর্ঘদিন তিনি সুস্থ ছিলেন না। পরে তো মারাও গেলেন। 

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজের’ বার্ষিক মুখপত্রের নাম ছিল শিখা। সাধারণত বার্ষিক সম্মেলনে পঠিত রচনাগুলি দিয়েই শিখার কলেবর ভর্তি করা হত। যতদূর মনে পড়ে শিখার মাত্র পাঁচটি কি ছয়টি সংখ্যাই বেরিয়েছিল। সম্পাদক হিসেবে যার নামই মুদ্রিত হোক না কেন আসল সম্পাদনা করতেন কর্মবীর আবুল হোসেন সাহেব। বেশির ভাগ খরচও বহন করতেন তিনি। শিখার টাইটেল পৃষ্ঠায় একটি ক্ষুদ্র রেখা চিত্র ছিল, শুনেছি তাও এঁকেছিলেন আবুল হোসেন সাহেব। একটি খোলা কোরান শরিফ–মানব বুদ্ধির আলোর স্পর্শে কোরানের বাণী প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে, এই ছিল রেখাচিত্রটির মর্ম। কিন্ত এর একটা কদৰ্থ বের করতে বিরুদ্ধবাদীদের বেগ পেতে হয় নি। তারা এর অর্থ রটালেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের সমর্থকরা কোরানকে পুড়িয়ে ফেলে শুধু মানব বুদ্ধিকেই দাঁড় করাতে চাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, গোড়া থেকেই গোঁড়ারা মুসলিম সাহিত্য সমাজের বিরোধী ছিল। চিন্তার ক্ষেত্রে কায়েমি স্বার্থের বুনিয়াদ সবচেয়ে শক্ত। এর পর এঁরা রীতিমত বিরুদ্ধতা করতে লাগলেন সাহিত্য সমাজের। ছাত্রদেরও বড় দল সাহিত্য সমাজের বিপক্ষে চলে গেল। মুসলিম হলে মুসলিম সাহিত্য সমাজের অধিবেশন নিষিদ্ধ হল। বাধ্য হয়ে জগন্নাথ হল ও লিটন হলে সভা করতে হল। সমাজ নেতাদের কাছে আবুল হোসেন ও কাজী আবদুল ওদুদকে সাহিত্য সমাজের নেতা হিসেবে জবাবদিহি করতে হল। নবাব বাড়িতে সভা বসল। ইসলাম গেল, মুসলিম সমাজ ডুবল–এ ধরনের একটা মনোভাব বিরুদ্ধ শিবিরে ছড়িয়ে পড়ল। যুক্তি ও বুদ্ধির কাছে হেরে সেদিনকার সমাজনেতারা সাহিত্য সমাজের কোনো কোনো কর্মীর ওপর গায়ের জোর প্রয়োগ করতেও দ্বিধা করে নি। এর ফলেও কিন্তু সাহিত্য সমাজে ভাঙন ধরে নি। ভাঙন ধরেছিল সাহিত্য সমাজের যারা স্তম্ভ তারা যখন নানা দিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়লেন তখন। কাজী আবদুল ওদুদ কলকাতায় বদলি হয়ে গেলেন। আবুল হোসেন সাহেব বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে প্রথমে ঢাকা বারে, পরে কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দিলেন। উৎসাহী ও কর্মী ছাত্ররা পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় তথা ঢাকা ছেড়ে নানা কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়লেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে একমাত্র সবেধন নীলমণি কাজী মোতাহার হোসেন রইলেন ঢাকায়। মুসলিম সাহিত্য সমাজ উঠে গিয়েছে দীর্ঘকাল; শিখাও বন্ধ হয়ে গেছে তবুও ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের আদর্শ ও মনোভাব একা কাজী মোতাহার হোসেন সাহেবই বহন করে চলেছেন এ যাবৎ। শিখার শেষ সংখ্যার সম্পাদক হিসেবে আমার নাম ছাপা হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে শিখর শিরোদেশে মটো হিসেবে ছাপা হতো : জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। 

মুসলিম সাহিত্য সমাজের ঢেউ যাদের মনে নাড়া দিয়েছিল আর যারা এই প্রতিষ্ঠানে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের কারো মনে সাম্প্রদায়িক মনোভাব, গোঁড়ামি ও কোনো রকম সঙ্কীর্ণতা কিছুমাত্র রেখাপাত করতে পারে নি। তখনো যেমন পারে নি, পরে সংক্রামক ব্যাধির মত সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখন সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তখনো তারা ছিলেন এবং এখনো আছেন সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। স্বাধীন চিন্তা ও মুক্ত বুদ্ধির চর্চা তারা এখনো অব্যাহত রেখেছেন। 

মুসলিম সাহিত্য সমাজের কর্মযোগী ছিলেন মরহুম আবুল হোসেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সূচনায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমার্সের অধ্যাপক ছিলেন। ভাবযোগী ছিলেন। কাজী আবদুল ওদুদ—’শাশ্বতবঙ্গ ও কবিগুরু গ্যেটে’ যার অমর কীর্তি এবং ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’র সম্পাদক হিসেবে যিনি সম্প্রতি উভয় বঙ্গের সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তখন তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক।

যাঁরা জাত সাহিত্যিক নন এই ঢেউয়ের ধাক্কায় তারাও অনেকে সেদিন চিন্তা করতে শুরু করেছিলেন, লিখতে কলম তুলে নিয়েছিলেন হাতে। তাদের মধ্যে কাজী আনওয়ারুল কাদীর ও কাজী মোতাহার হোসেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আগেই বলেছি, মুসলিম সাহিত্য সমাজ তথা বুদ্ধির মুক্তিবাদীদের ভাবাদর্শ ও ঐতিহ্য ঢাকায় এখনো মোতাহার হোসেন সাহেব একাই বহন করছেন। এখনো সেখানকার যতসব উদার ও প্রগতিশীলদের যে সব অনুষ্ঠান হয় তাতে অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবেই তাকে দেখতে পাওয়া যায়। তিনি এ যাবৎ সঞ্চরণ নামে একটি মাত্র প্রবন্ধের বই বের করেছেন। পরে অবশ্য তাঁর বহু প্রবন্ধ, অভিভাষণ ও বক্তৃতা নানা সাময়িক কাগজে বেরিয়েছে। দুঃখের বিষয় সেই সব এখনো সংকলিত হয় নি। হলে তার চিন্তার পরিধি, ভাব ও ভাষার সারল্য ও প্রাঞ্জলতা, সর্বোপরি তার মুক্ত-বুদ্ধির পরিচয় লাভ সহজ হতো। 

আনওয়ারুল কাদীর সাহেব আজ পরলোকে। সাহিত্য সমাজের সূচনায় তিনি ঢাকা কলেজে দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। পরে শেষ পর্যন্ত বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শক হয়েছিলেন। প্রায় কুড়ি একুশ বছর আগে তিনি আমাদের দুঃখ নাম দিয়ে একটি বই প্রকাশ করেন। সেই বইয়ের বিভিন্ন প্রবন্ধে আমাদের ভাষা, সাহিত্য, দেশ ও সমাজ সম্বন্ধে তার উদার মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। এই প্রবন্ধগুলি মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রভাব ও আবহাওয়ায় রচিত–কাজেই মুসলিম সাহিত্য সমাজ তথা বুদ্ধির মুক্তিবাদীরা যেসব কথা সেদিন বলতে চেয়েছিলেন তার কিছু কিছু তার প্রবন্ধগুলিতে তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলা হয়েছে। অবশ্য আবুল হোসেন ও কাজী আবদুল ওদুদের মতো ভাষার জোর ও চিন্তার ব্যাপকতা তার ছিল না।

কোনো চিন্তাই ব্যর্থ নয়। বিশেষ করে যে সব চিন্তায় রয়েছে সত্যানুভূতি ও সত্যকে বলবার নির্ভিকতা। আনওয়ারুল কাদীর সাহেবের বইটি এখন দুষ্প্রাপ্য–এই বই কখনো দ্বিতীয়বার ছাপা হবে কিনা জানি না। তাই তা থেকে কিছু কিছু রচনা এখানে উদ্ধৃত করে পাঠকদের খেদমতে পেশ করতে চাই। এতে তার চিন্তাধারার যেমন পরিচয় মিলবে তেমনি পাওয়া যাবে মুসলিম সাহিত্য সমাজের ভাবাদর্শেরও কিঞ্চিৎ আভাস। 

জাতিভেদ প্রথা, হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ ইত্যাদির ফলে দেশের বৃহত্তর কল্যাণ যেভাবে ব্যাহত হচ্ছে তার আলোচনা করে ওই প্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ আমাদের দুঃখ এই বলে তিনি শেষ করেছেন : ‘এ ছাড়া ধর্মান্ধতা মুসলমানদের মধ্যে এত বেশি যে কোনরূপ স্বাধীন চিন্তার দরজা একেবারে বন্ধ। মুসলমানদের মধ্যে যারা একটু ঘরানা বা উচ্চবংশের বলে দাবি করতে চায়, তারা চাচ্ছে যে, তারা যা বুঝেছে সবাইকে তাই বুঝতে ও মানতে হবে। তা না মানলেই তারা একদম কাফের। আর সব মুসলমান এক ছাঁচে গড়া হবে। খোদা এক, রসুল এক, সব মুসলমানও তাই ঠিক এক ভাবাপন্ন হবে। জগতে দেখতে পাই ফুল ফল গাছ পাতা সব ভিন্ন ভিন্ন রকমের। একই জাতের গোলাপ ফুল তার মধ্যে কত রকমারি। আবার একই গাছের দুটি গোলাপ ফুল এক রকম নয়। দুটি জীবন্ত চলন্ত চেতনাযুক্ত মানুষ এক রকম পাওয়া দায়। আর সমগ্র মুসলমান সমাজের লোকগুলি সব একই রকম হওয়া চাই। হচ্ছে না তবু হওয়াতেই হবে–এই যে দুরাশা এতে খেয়ে সেরেছে মুসলমানকে। লাঠির আঘাতে সব হিন্দু যদি মুসলমান হয়েও যায় তার পরক্ষণেই দেখতে পাওয়া যাবে আবার হিন্দুর বীজ গজিয়ে উঠেছে। আবার সেই দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয়েছে। কী হবে হিন্দুকে মুসলমান করে? মানুষ-মানুষ। দেশের লোক না খেয়ে মরছে; পেটে অন্ন নাই, পরিধানে বস্ত্র নাই। ‘স্ফীতকায় অপমান অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান লক্ষ মুখ দিয়া’–এমন দুর্দশার দিনেও দেশের নেতাদের এইরূপ মনের ভাব। এ ভাব কি চিরস্থায়ী হবে? 

স্যার পি.সি. রায় একবার হিন্দু সমাজের জাতিভেদ প্রথা আলোচনা করতে গিয়ে বহু হিন্দু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে পর হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। তার উত্তরে আনওয়ারুল কাদীর সাহেব নেতাদের কথা নামে এক নাতিদীর্ঘ আলোচনা লেখেন। তার এক জায়গায় তিনি লিখেছেন : ‘স্যার পি. সি. রায় তার এই প্রবন্ধে হিন্দু সমাজের মঙ্গলকে দেশের মঙ্গল বলতে চান। এ সম্বন্ধে ভারতবাসীকে নতুন করে ভাবতে হবে। দেশের মঙ্গল অর্থে দশের মঙ্গল বুঝতে হবে। দশ মানে হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান সব।’ অন্যত্র : ‘স্যার পি. সি. রায় সম্বন্ধেই এখানে যে কথাটা বলতে চেয়েছি সেটা আমাদের দেশের সব নেতাদের সম্বন্ধে খাটে। দেশের সব নেতাই ‘হিন্দু মুসলমান’ ইত্যাদি কথা এতই ব্যবহার করেন যে, তারা দেশের মঙ্গল চান এ কথা স্বীকার করা যায় না। এঁরা কেউ হিন্দুর মঙ্গল, কেউ মুসলমানের মঙ্গল চান। সাহিত্যে বা বক্তৃতায় হিন্দুর মঙ্গল বা মুসলমানের মঙ্গলের জন্য যখন কোন নেতা বিশেষ আগ্রহ দেখাতে যান বা তার নেতৃত্বের দাবি সপ্রমাণ করতে চান তখন যে বিদ্বেষের বহ্নি জ্বলে ওঠে তাতে পুড়ে মরে উভয়েই। যারা দেশের প্রকৃত নেতা হতে চান তাদের ‘হিন্দু মুসলমান’ এসব কথা বাদ দিয়ে কথা বলতে হবে। সম্প্রদায় বিশেষের নেতা হওয়া এক, আর দেশের সেবা করা অন্য কথা। এ কথা আমাদের বুঝতে ও শিখতে হবে। ‘হিন্দু মুসলমান’ এসব কথার হয়তো নতুন ব্যাখ্যারও দরকার হতে পারে। দেশসেবার পন্থা সম্বন্ধে গতানুগতিকতার অনুসরণ করলে চলবে না। এ সম্বন্ধে নতুন করে ভাবতে হবে।’ 

এই প্রবন্ধের নিম্নলিখিত মন্তব্যও বেশ অর্থপূর্ণ ও স্মরণীয় : 

‘সর্ব বিষয়ে এমন কি ধর্মের বেলায়ও ভারতবাসীকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। আধ্যাত্মিক আহার যোগানই ধর্মের প্রধান কাজ। যে যেভাবে পারে ‘শুদ্ধ’ হয়েই হক বা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করেই হ’ক যাতে তার আধ্যাত্মিক ক্ষুধা মিটবে তাই তাকে গ্রহণ করার মতো স্বাধীনতা দিতে হবে। তাতে কারো মনে ব্যথা লাগলে চলবে না, বৈচিত্র্য জগতের নিয়ম। বৈচিত্র্যকে মেনে নিতে হবে।’ 

‘সামাজিক গলদ’ প্রবন্ধে লেখক বহু কথাই বলেছেন। কথাগুলি অবশ্য অপ্রিয় সত্য। কালের দীর্ঘ ব্যবধানেও তার কথাগুলির অর্থ বা তাৎপর্য কিছুমাত্র কমে নি। তিনি এই প্রবন্ধে লিখেছেন : ‘আমাদের যোগ্য হওয়ার কতগুলি অন্তরায় আজকাল দেখতে পাওয়া যায়। প্রধান অন্তরায় হচ্ছে আমাদের শিক্ষা সম্বন্ধে উদাসীনতা। বাংলার মুসলমান সমাজের বয়স নিতান্ত কম নয়। কিন্তু এই দীর্ঘকালের মধ্যে আমাদের মধ্যে একজন রুশো, একজন পেট্‌সালট্‌জী, একজন হারবার্ট স্পেনসার জন্মান নাই। আমাদের সমাজ একজন রাজা রামমোহন, একজন বিদ্যাসাগর, একজন বঙ্কিমচন্দ্র, একজন পিয়ারীচরণ, একজন রামতনু লাহিড়ী, একজন রাজনারায়ণ বসু কি একজন স্যার আশুতোষ তৈরি করতে পারে নি। এর একমাত্র কারণ, আমরা শিক্ষা চাই না, আমরা বিদ্যা চাই না, জ্ঞানের মর্যাদা বুঝি না, সাহিত্যিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক নাই। আমরা দান ভালবাসি তাই আমাদের মধ্যে দাতা আছে এবং দাতা আছে বলেই ভিক্ষুকের অভাব নাই। সেইরূপ আমরা যদি শিক্ষা ভালবাসতাম তবে শিক্ষাদাতা, শিক্ষিতজন ও শিক্ষান্বেষী কোনটির অভাব হত না।’ 

এই প্রবন্ধের অন্যত্র লেখক ধর্ম সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে লিখেছেন : ‘বুদ্ধির মুক্তি না হলে ধর্ম শিক্ষা হতে পারে না। ধর্মের আদেশ ও নিষেধ পালন করার জন্য বুদ্ধির দরকার। বুদ্ধির অভাবে আজকাল আমাদের ভিতর প্রকৃত ধর্মভাব লোপ পেয়েছে। এখন গোঁড়ামিই আমাদের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। … আমাদের এই গোঁড়ামির প্রধান কারণ এই যে, আমরা ধর্মের সব বিধি-নিষেধের কতগুলো সহজ অর্থ করে নিয়েছি।… সহজ অর্থ করার দরুণ আমাদের ধর্মের সার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই রসুলুল্লাহর নামে দরুদ পড়া, রাসুলুল্লাহর না’আত, মিলাদ শরীফ, ঈদ, বকর ঈদের সময় কিছু ঘটা, আর বক্তৃতায় নামাজ রোজা হজ্ব জাকাত ফেতরা–এগুলির প্রশংসা করা। এগুলির পেছনে যে আরো কিছু থাকতে পারে সে দিকে দৃষ্টি দেবার কোন দরকার সমাজ অনুভব করতে চান না। আমাদের মানুষ হতে হবে–বলবান, জ্ঞানবান, বুদ্ধিবান মানুষ হতে হবে এ কথা আমাদের মনেও হয় না। নামাজ রোজা যদি অর্থশূন্য হয় তবে সে নামাজ রোজায় কতটুকু ক্ষতি বৃদ্ধি? নামাজের এই রূপ সহজ অর্থে গোঁড়া মুসলমান সন্তুষ্ট হতে পারে কিন্তু জগৎ সেই মুসলমানকে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখবে না। ফলেও দাঁড়িয়েছে তাই, বর্তমান জগৎ মুসলমানকে কাঁটা মনে করছে। এদিকে এই সহজ অর্থের ফলে মুসলমান নিজেও ধর্মের কোন স্বাদ পাচ্ছে না।’ 

একদিন মুসলমান সমাজ সর্বত্র করুণা ভিক্ষা করতো—চাইতো সর্বত্র রক্ষা কবচ। সমাজের সেই মনোভাবকে আনওয়ারুল কাদীর সাহেব এইভাবে দিয়েছেন ধিক্কার : ‘এখন আমাদের একমাত্র ভরসা–concession বা সরকারের দান বা অনুগ্রহের উপর। পরের দয়ার দানে প্রকৃত শক্তি অর্জন সম্ভবপর হবে না। পুর কতটুকু দিতে পারে। আর তাতে কি পেট ভরে? আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বলতে চান যে অবস্থা অনুসারে কিছু Special treatment বা বিশেষ ব্যবস্থা দরকার; না হলে চলে না। এমন চলা আমার মতে না চলা অপেক্ষা লজ্জাকর। বহুকাল ধরেই আমরা concession, conces-sion করছি। পেয়েছিও তা কিছু কিছু; কিন্তু অগ্রসর হয়েছি কতটুকু? সরকারের দয়ার (concession) আশায় প্রকৃত মানুষ হওয়ার চেষ্টা আমাদের মধ্যে একদম নাই; থাকতে পারে না। যাদের কনসেশনের দিকে দৃষ্টি তাদের আত্মসম্মান জ্ঞান জন্মাতে পারে না। যাদের আত্মসম্মান জ্ঞান নাই তারা পরপ্রত্যাশী হতে বাধ্য। পর প্রত্যাশীর অন্য নাম ভিক্ষুক। ভিক্ষুক সমাজের লজ্জা, সমাজের বোঝা, উন্নতির কাঁটা। ধনী আত্মীয়ের উপর উদরান্নের জন্য নির্ভর করা যেমন ভিক্ষাবৃত্তিরই নামান্তর, সরকারের দিকে কনসেশনের (দয়ার) জন্য তাকিয়ে থাকাও সেইরূপ ভিক্ষুকতা। আমাদের বিদ্যা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শ্রমশীলতা কোনরূপ যোগ্যতা নাই বরং এ সমস্ত বিষয়ে অন্যের চাইতে কম, অথচ সরকারের দয়ার উপর নির্ভর করে শতকরা ৮০ জনের চাকরি চাই–এ ভাবটা যত শীগগির আমাদের মধ্য থেকে দূর করা যায় ততই আমাদের মঙ্গল, প্রতিবেশীর মঙ্গল, জগতের মঙ্গল। নচেৎ আমরা যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকব। জগৎ অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলছে ও বলবে–ঐ যে সব ভিক্ষুকের দল।’ 

‘শিক্ষিতা নারীর বিবাহ’ শীর্ষক প্রবন্ধে লেখক কথা প্রসঙ্গে লিখেছেন :

‘অনেক নাটক-নভেল-ভক্ত শিক্ষিতা নারীরা অত্যধিক তীব্র সতীত্বের উপাসক হয়ে পড়েন। কবে কোনো একদিন কোনো যুবক একটু স্নেহ দেখিয়ে মনকে আকৃষ্ট করেছিল, সেই স্মৃতিকে মনোমন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে আজীবন কুমারীব্রত অবলম্বন করে সতীত্বের আদর্শ রচনা করবার জন্য নিজেকে কল্পনায় উৎসর্গ করে ফেলেন। এই উৎকট সতীত্ব যে একটা খেয়াল এ সম্বন্ধে শিক্ষিতা নারীদের সচেতন হওয়া দরকার। সংসারে যে যার পথে চলে যায়। এদের উৎকট সতীত্বের মূল্য এঁদের কাছে বেশি, অন্যের কাছে তা না হতেও পারে। প্রত্যেক নারীর নারীত্ব তখনই সার্থক হয়, যখন তিনি বধূরূপে, মাতারূপে প্রীতি বিলিয়ে গৃহে বিরাজ করেন। সতীত্বের উচ্চ আদর্শকে আমি সম্মান করি, তাই বলে মোহকে, খেয়ালকে সম্মান করতে নারাজ।’ 

আজকের দিনের মত সেদিনও মুসলমান সমাজে উর্দু বাংলার তর্ক ছিল। ‘উর্দু বাংলা তর্ক’ নামক প্রবন্ধে আনওয়ারুল কাদীর সাহেব লিখেছেন : ‘যে সব মুসলমান বাংলা বর্জন করেছেন, উর্দু যাদের মাতৃভাষা, কৃষ্টির দিক দিয়ে তাদেরও বিশেষ কিছু পরিচয় পাওয়া যায় না। অবশ্য উর্দুতে কথা বলতে পারাই একটি কৃষ্টি যদি বলা হয়, তবে স্বতন্ত্র কথা। তা না হলে ভাব (idea) হিসাবে এঁরাও যে এমন কিছু সম্পদশালী তা নিশ্চয় করে বলা চলে না। উর্দু সাহিত্যে এদের কারো কোনো বিশেষ দানের কথা শোনা যায় না। অন্য কোনো ললিতকলায় এঁদের কোনো এমন কিছু উল্লেখযোগ্য দানের নিদর্শন দেখা যায় না।’ 

এই প্রবন্ধের উপসংহার করেছেন লেখক এই ভাবে : অদৃষ্টের কী নিষ্ঠুর পরিহাস! এই হতভাগ্য বাঙালি মুসলমানই সবচেয়ে কম খেয়ে, কম পরে সকলের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করে এবং সকলের অসম্মান মাথায় নিয়ে দেশের সকলেরই অন্ন যোগাচ্ছে। তাদেরই মাথা গুণতির ওপর নির্ভর করে মুসলমান জজ ম্যাজিস্ট্রেট হচ্ছেন। কিন্তু এরা যে কী অন্ন খায়, কী জলে তাদের পিপাসা মেটে, কী সুগভীর এদের অশিক্ষা, তা খোঁজ করবার কেউ নেই। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্র, শ্রাবণের অবিরাম ধারা, মাঘের প্রচণ্ড শীত, সবই এদের গায়ের উপর দিয়ে বয়ে যায়। এদের তণঅশ্রু এদের গণ্ড বেয়ে আপনিই ঝরে পড়ে, মোছাবার কেউ নেই। সুযোগ ও সুবিধা থেকে বঞ্চিত এরা। তার উপর এই উর্দু ও বাংলা দিয়ে তাদের ভাষাটুকু পর্যন্ত কেড়ে নেবার বন্দোবস্ত, আর তাতে করে এই শ্রেণী বিভাগ। এমনি করে এই সর্বহারাদের সর্বনাশ করা হচ্ছে।’

‘আমাদের দুঃখে’ লেখক বহু দুঃখের কথাই বলেছেন। আমাদের অনেকের মত তারও একটি দুঃখ সাহিত্যে সাম্প্রদায়িকতা’। তাঁর এই নামের প্রবন্ধটি তিনি শেষ করেছেন নিম্নলিখিত মন্তব্য দিয়ে: ‘কোনো মন্তব্যের দ্বারা দেশের মঙ্গলের আশা করা বিড়ম্বনা। সাহিত্যিকের পথ নির্দেশ করে দেবার মত ধৃষ্টতা কারো নেই। সাহিত্যিক তার স্বীয় অনুভূতি, তার ভিতরকার অনুপ্রেরণা দ্বারাই পরিচালিত হবেন। তবে একথা ঠিক যে বর্তমানকালে সাম্প্রদায়িকতা, হিন্দু-মুসলমান, এ কথাগুলো বাদ দিলে সৎ সাহিত্য ঠিকমত গড়ে উঠবে না। সাহিত্যিক এসব সম্বন্ধে আচ্ছন্ন দৃষ্টি নিয়ে কোন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি সম্ভব করে তুলতে পারবেন না। 

হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ, পড়শীর প্রতি অবিশ্বাস, অপ্রেম, এইসব দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তির চেষ্টা করা সবার দরকার। প্রার্থনা–আল্লাহ যেন এই দুর্ভাগা দেশকে চির লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দিয়ে সত্য ও প্রেম, জ্ঞান ও কল্যাণের দিকে অগ্রসর হওয়ার মত শক্তি দেন, হিন্দু-মুসলমান সবাই যেন পূর্ণ প্রস্ফুটিত মানুষ হতে সক্ষম হয়।’ 

আজ দেশ যে শুধু স্বাধীন হয়েছে তা নয় সামাজিক প্রগতিও অনেকখানি এগিয়ে গেছে। সাহিত্য সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টি আজ অনেকখানি স্বচ্ছ। আচার-বিচারের বিধি নিষেধও হয়েছে অনেকখানি শিথিল। নতুন সমাজের চেহারা পুরোপুরি না দেখলেও তার আভাস আমরা পাচ্ছি। এই বিপুল পরিবর্তন একদিনে হয় নি, কারও একার চেষ্টায় ঘটে নি। দীর্ঘকাল ধরে বহু মানুষ বহুভাবে এর পথ কেটেছেন, ভিত গেড়েছেন, আগামী দিনের পথ রচনা করতে নানা মাল-মসলা জুগিয়েছেন। তাদের অনেকের কথা আমরা ভুলে গিয়েছি। অনেকের স্মৃতি বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সমাজের রথ-চক্র বড় ধীরে ও অলক্ষে চলে। অলক্ষ থেকে নানা জনের নানা হাত তাকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। মুখর রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে এদের দানের মূল্য অনেক বেশি। শান্ত ও গম্ভীর প্রকৃতির, স্বল্পভাষী ও উদারচেতা আনওয়ারুল কাদীর সাহেবেরও অলক্ষে থেকে সমাজ ও দেশের মঙ্গল চিন্তা মামুলি ও গতানুগতিক ছিল না। এ যুগে ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ যে মুক্তবুদ্ধি ও স্বাধীন চিন্তার ঢেউ তুলেছিল আনওয়ারুল কাদীর সাহেবের চিন্তা ও রচনা তারই সাক্ষাৎ ফুল। 

[‘বুদ্ধির মুক্তি’ প্রথম প্রকাশিত হয় পঞ্চাশের দশকে, রেলওয়ে মেনস্ ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পরিচিতি পত্রিকায়। পরে তা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন গ্রন্থে সংকলিত হয়।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *