সংস্কৃতি

সংস্কৃতি 

সংস্কৃতি সম্বন্ধে আমি কিছুমাত্র বিশেষজ্ঞ নই। বলাবাহুল্য বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনা আমার পেশা আর ঐ সাহিত্যের চর্চা যে আমার নেশা, তা আমার বন্ধুদের অজানা নয়। তবুও বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধেও আমি বিশেষজ্ঞ এই দাবিও আমার পক্ষে অগ্রাহ্য ও অশোভন। সাহিত্যের তবুও একটা সুনির্দিষ্ট সীমানা আছে, তার নীতি ও ধর্ম অন্তত শিক্ষিত সমাজের জানা ও পরিচিত। তাই শিক্ষিত জনের সামনে সাহিত্যালাপ করা সহজ ও তাকে করা যায় বোধগম্য। কিন্তু সংস্কৃতি সম্বন্ধে কি এ কথা বলা যায়? 

সংস্কৃতি শব্দটি চলতিও নয়, লৌকিকও নয়, ফলে তার সঙ্গে আছে আমাদের জনসাধারণের অপরিচয়। আমরা শিক্ষিতরা ঐ শব্দটি ইংরেজি Culture শব্দের অনুবাদ হিসাবেই গ্রহণ ও ব্যবহার করছি। বলা যায় অপব্যবহার করছি সবচেয়ে বেশি। দেশে-বিদেশে এই শব্দের ব্যাপক অপব্যবহার কার না আজ লক্ষগোচর? সংস্কৃতি কি, তার অর্থের গভীরতা ও পরিধি উপলব্ধি অধিকাংশ লোক করে না বলেই তার অপব্যবহার আজ এমন অবাধ ও সহজ হয়েছে। আমাদের চোখের সামনে দু’দুটো প্রলয়ঙ্কর মহাযুদ্ধ ঘটে গেল, এ দুই মহাযুদ্ধে দুই বিপরীত পক্ষ তাদের যুদ্ধনীতির সমর্থনে দোহাই পেড়েছেন সভ্যতা ও সংস্কৃতির। ব্যাপক ও বেপরওয়াভাবে শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে বা সৈন্যবাহিনীর উপর নয়, জনবহুল ঘুমন্ত নগরীর উপর অকাতরে বর্ষিত হয়েছে মারাত্মক শেল, বোমা ও এটমবোমা, দু’পক্ষের মেসিনগানের গুলি থেকে রেহাই পায়নি নিরীহ শিশু ও নারী, বৃদ্ধ ও রুগ্ন। এ সবই হয়েছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির নামে। আমাদের দেশেরও অপেক্ষাকৃত সঙ্কীর্ণতর ক্ষেত্রে যে নির্লজ্জ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে তারও পেছনে সক্রিয় প্রেরণা জুগিয়েছে ধর্মের নাম ও সংস্কৃতির সঙ্কট। ইউরোপ, আমেরিকা রাষ্ট্রকে সংস্কৃতি আর আমাদের দেশ সংস্কারকে সংস্কৃতি ধরে নিয়ে নিজেদের পশু-মানসের সমর্থন খুঁজেছে ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির আড়াল। আমার মতে সংস্কৃতির, সত্যিকার কোনো ধর্মগত বা দেশগত রূপ হতেই পারে না, নাম আরোপও তেমনি শব্দের অপব্যবহার ছাড়া কিছুই নয়। ইউরোপীয় সংস্কৃতির কথা যখন আমরা বলি তখন আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে ইউরোপের রাষ্ট্ররূপ, সেখানকার দেশাচার ও সংস্কার। তেমনি হিন্দু ও মুসলিম সংস্কৃতির কথা যখন বলি তখনো আমাদের চোখের সামনে তাঁদের সামাজিক আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি ও সংস্কারের ছবিই আমরা দেখতে পাই। ধুতি-চাদর পরা হিন্দু সংস্কৃতি নয়, কোনো কোনো হিন্দুর দেশাচার বলা যেতে পারে, আচকান পায়জামা পরাও তেমনি মুসলিম সংস্কৃতি নয়। কোট-প্যান্ট-হ্যাট্ পরাও খ্রিস্টান বা ইউরোপীয় সংস্কৃতি নয়। এই সবই আচার–ব্যক্তিগত বা দেশগত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধর্মগত। তেমনি দাড়ি রাখাও মুসলিম সংস্কৃতি নয়, তা যদি হতো তা হলে পাকিস্তান মন্ত্রিসভার অধিকাংশকেই মুসলিম সংস্কৃতির দুষমন বলতে হতো (বলাবাহুল্য ধর্মীয় বিধান ও সংস্কৃতি এক কথা নয়)। শেভ্ করাও খ্রিস্টান বা ইউরোপীয় সংস্কৃতি নয়, তা হলে রাজা পঞ্চম জর্জ ও সপ্তম এডওয়ার্ড এবং খ্রিস্টান পাদ্রিগণ ইউরোপীয় সভ্যতার শত্রুরূপেই গণ্য হতেন। যদি বলা হয় লোকটি খুব Cultured বা সংস্কৃতিবান তা হলে কারো মনে এমন কথা কি জাগে যে ক হচ্ছে হিন্দু, বা মুসলমান বা খ্রিস্টান, বা ক পরে হ্যাট্ কোট্ বা আচকান-পাজামা বা ধুতি-চাদর? বা ক মাংসাশী কি নিরামিষভোজী? অথবা ক যায় মসজিদে, কি মন্দিরে অথবা গীর্জায়? বা ক হচ্ছে, বি.এ.পাস কি এম.এ.পাস—কখনো নয়। তা হলে বুঝতে হবে যে সব দেশগত বা রাষ্ট্রগত বা ধর্মগত বা সম্প্রদায় ও দলগত আচার-ব্যবহার, মতামত ও রীতি-নীতিকে আমরা সংস্কৃতি বলে পরিচয় দিয়ে নিজদের কার্যকলাপের সমর্থন খুঁজি, তা আসলে সংস্কৃতি নয়। তা যদি হতো তবে উত্তম হ্যাট্ কোধারী বা দামি শেরওয়ানী পরুয়া বা মূল্যবান গরদের ধুতি- চাদর পরিধানকারী কখনো বর্বরের মত আচরণ করত না এবং এম.এ. বা বা পিএইচ.ডি ডিগ্রীধারী কখনও করত না অসভ্যের মত ব্যবহার। তাই আমাদের বক্তব্য রাষ্ট্র বা সংস্কার যেমন সংস্কৃতি নয়, তেমনি প্রচলিত ধর্মীয় আচার বা শিক্ষাও সংস্কৃতি নয়। পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই, যে ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে অসভ্যের দেখা মিলবে না এবং অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত লোককেও নেহাৎ পাষণ্ডের মতো ব্যবহার করতে কে না দেখেছে? কাজেই ইসলাম, হিন্দু, খ্রিস্টান বা অন্য যে কোনো ধর্মগ্রহণ করেও লোক Uncultured থাকতে পারে, তেমনি এম.এ. পাস করে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে- কোনো উচ্চতম ডিগ্রী নিয়েও Uncultured থাকা অসম্ভব নয়। 

সংস্কৃতি ও সভ্যতা কি জিনিস তা না জেনেই আমরা বিশেষ বিশেষ সভ্যতার প্রতি আগ্রহ ও পক্ষপাত দেখিয়ে থাকি। এইভাবে আমাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয় বলেই আমরা সংস্কৃতির আসল স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি না। সংস্কৃতির প্রতি যাঁর সত্যিকার দরদ রয়েছে, তিনি কখনও সংস্কৃতির নামে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় গ্রহণ করতে পারেন না। যদি কেউ এরকম করেন তিনি কখনও cultured বা সংস্কৃতিবান ন্ন। 

কেউ কেউ পরাধীনতাকে সংস্কৃতির অন্তরায় বলেছেন কিন্তু তা যদি সত্য হতো তা হলে স্বাধীন দেশের অন্তত অধিকাংশ নাগরিক হতো সুসভ্য আর পরাধীন দেশে সুসভ্য ও সংস্কৃতিবান লোকের আবির্ভাব আদৌ ঘটত না। সংস্কৃতির সঙ্গে যদি রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোনো যোগাযোগ থাকত, তা হলে, স্বাধীন ইউরোপ বা স্বাধীন জাপানের পক্ষে যুদ্ধের নামে এমন অমানুষিক বর্বরতার আশ্রয় গ্রহণ কি সম্ভব হতো? আর এই পৌনে দুশো বৎসরব্যাপী সুকঠোর ব্রিটিশ পরাধীনতার মধ্যে পাক-ভারতে কি বহু সংস্কৃতিবান বা cultured লোকের আবির্ভাব ঘটেনি? 

.

তবে স্বাধীনতা যে সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক জীবনের সহায়ক এ বিষয়ে সন্দেহ নেই এবং সাংস্কৃতিক জীবনযাপনের জন্য ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অপরিহার্য। কারণ সভ্যতা বা সংস্কৃতি সৃষ্টি করে ব্যক্তি আর রুচিবান সুন্দরচিত্ত মানুষেরই প্রভাবে গড়ে উঠে সংস্কৃতি। রুচি বিশেষ করে সুরুচি ব্যক্তি- স্বাধীনতার ছায়াতলেই হয় বিকশিত। রাষ্ট্রের কাজ নিরাপত্তা ও অবসর সৃষ্টি করা, সেই নিরাপত্তা ও অবসরের ব্যবহার মানুষ কিভাবে করবে তা নির্ধারণের ভার রাষ্ট্রের নয় মানুষেরই উপর। আর বাঁচার সংস্থান যাদের আছে তারাই করতে পারে সংস্কৃতির চর্চা, বেঁচে থাকাটা মানুষের প্রাথমিক ও আদিম দায়িত্ব। এই দায়িত্বের ভার কিন্তু একান্তভাবেই স্বাধীন রাষ্ট্রের। নাগরিকদের খাওয়া-পরা ও নিরাপত্তার ভার যে-কোনো রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব। আমাদের রাষ্ট্র এ দায়িত্ব এখনো পুরোপুরি পালন করছে না বলেই আমাদের দেশে সংস্কৃতি-চর্চা নিষ্ফল ও বিড়ম্বিত হচ্ছে। কিন্তু ব্যক্তিমনের উৎকর্ষের উপরই নির্ভর করছে সংস্কৃতি, এখানে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করলে ফল বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। মনের চর্চা ও উৎকর্ষের দ্বারা ব্যক্তিমানস গড়ে ওঠে; তাই ব্যক্তির জীবন-দর্শন রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি একান্তভাবেই তার নিজস্ব। এই ব্যক্তি-মানসের উৎকর্ষের উপর নির্ভর করছে তাঁর সাংস্কৃতিক জীবনের মান। তাই আমার কাছে শিক্ষা, সভ্যতা বা সংস্কৃতি বড় কথা নয়, বড় কথা সুশিক্ষা, সুসভ্যতা ও সুসংস্কৃতি। সব দেশে কোনো-না কোনো ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা আছে, আর আছে তথাকথিত সভ্যতা বা সংস্কৃতি ইউরোপীয় সভ্যতা, ভারতীয় সভ্যতা, চীনা সভ্যতা, আরবীয় সভ্যতা ইত্যাদি সভ্যতার কত নামই প্রচলিত আছে। তবুও সুশিক্ষিত ও যথার্থ cultured বা সংস্কৃতিবান লোকের সংখ্যা পৃথিবীতে কত নগণ্য! স্কুল কলেজ অশিক্ষিতকে শিক্ষিত করতে পারে, কিন্তু সংস্কৃতিবান করতে পারে না। সংস্কৃতি-বিষয়ক বহু বিষয় অধ্যয়ন করে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায় কিন্তু সংস্কৃতিবান বা Cultured হওয়া যায় না। সভ্যতার যুগ মৌলিক সৃষ্টির যুগ না হলেও বিশেষ ক্ষতি নেই, কিন্তু গ্রহণ ও সমঝদারি ছাড়া সভ্যতা বা সংস্কৃতির জন্ম হতেই পারে না। 

কতিপয়ের সৃষ্ট বিষয় যখন অনেকের উপভোগের ব্যাপার হয়, অতীত ও বর্তমানের উৎকৃষ্ট বস্তুগুলি যখন মানুষ সাগ্রহে গ্রহণ করে ও তার উপযুক্ত মূল্য দেয়, তখন সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। তাই সংস্কৃতির জন্য প্রতিভার চেয়ে সমঝদারি বেশি দরকার, এই সমঝদারির ফলেই ব্যক্তির স্বভাব ও চরিত্রে আলোক ও মাধুর্যের বিকিরণ ঘটে। সংস্কৃতিবান বা cultured হওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের মতো কবি-প্রতিভার অধিকারী না হলেও চলে; কিন্তু রবীন্দ্র-সাহিত্যের সমঝদারি করে ও তার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ও বাণীকে গ্রহণ ও হজম করে cultured বা সংস্কৃতিবান হওয়া যায়। সব বড় সৃষ্টি সম্বন্ধেই এ কথা বলা যায়। কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক ও ধার্মিকের সৃষ্টিকে হজম করেই সংস্কৃতিকে করা যায় আয়ত্ত এবং একমাত্র এ ভাবেই হওয়া যায় সংস্কৃতিবান। সমঝদারি মানে সুশোভন ও আনন্দিত জীবনের জন্যে প্রস্তুতি-প্রকৃত মূল্যবোধ ও যুক্তি বিচার তার সহায়। শিল্প বা কাব্যসৃষ্টি অনেক সময় প্রাকৃতিক ব্যাপার কিন্তু সুশিক্ষা বা আত্মসৃষ্টি প্রাকৃতিক ব্যাপার নয়, তা সচেতন সাধনারই বিষয়। এই সচেতন সাধনাই সুসংস্কৃতির বুনিয়াদ। 

দুঃখের বিষয় এ যুগে এই গ্রহণশীলতা বা সমঝদারি হচ্ছে পদে পদে উপেক্ষিত। সমঝদারি ও গ্রহণের জন্যে চাই আন্তরিক প্রীতি ও শ্রদ্ধা, আজ আমাদের জীবনে সে প্রীতি ও শ্রদ্ধারই অভাব। তাই আজ আমাদের জীবনে সংস্কৃতি-সঙ্কট এমন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। সৌন্দর্য ও মহত্ত্বের সাধনাই সংস্কৃতি, তার জন্যে সংস্থান, অবসর ও নিরাপত্তার যেমন দরকার, প্রীতি ও শ্রদ্ধার আরো বেশি। আজ নানা কারণে আমাদের জীবনে স্কুল প্রয়োজনের তাগিদ সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে। ইউরোপের দেখাদেখি তাই গতি হয়েছে আমাদেরও—চরম আদর্শ এবং সৌন্দর্য-চর্চা ও মহত্ত্বের সাধনা পাচ্ছে পদে পদে বাধা। তাই বৃদ্ধ বয়সে রবীন্দ্রনাথ দুঃখ করে লিখেছেন: “এখন ব্যস্ত লোকেরা ধমক দিয়ে বলে, রেখে দাও তোমার সুন্দর, সুন্দর পুরোনো, সুন্দর সেকেলে। স্বল্পায়ু ফ্যাসান হঠাৎ-নবাবের মত উদ্ধ্যত তার প্রধান অহংকার এই যে সে অধুনাতম অর্থাৎ তার বড়াই গুণে নিয়ে নয়, কাল নিয়ে।” সত্যিকার সাহিত্য যেমন কালাকালের মধ্যে আবদ্ধ নয়, সত্যিকার সংস্কৃতিও দেশ কাল বা সামাজিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সৌন্দর্য ও মহত্ত্বকে দেশও কালের সঙ্কীর্ণ গণ্ডিতে ফেলে বিচার করবে? প্রকৃত মূল্যবোধ যাঁর আছে তাঁর কাছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সত্যপালন ও বিংশ শতাব্দীর সত্যপালন সমান মর্যাদারই অধিকারী। ঐতিহাসিক পরিচয়ের খাতিরে তাজমহলকে মোগল সংস্কৃতির একটি নিদর্শন বলে উল্লেখ করা যায়। তবুও সব দেশে সব যুগের মানুষের পক্ষে তার সৌন্দর্য উপলব্ধি আটকায় না। প্রয়োজনকে প্রয়োজনের সীমার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে না পারলে তা পদ্মবনে মত্ত হস্তীর মতই জীবনের মহত্ত্ব ও সৌন্দর্য সাধনাকে দলিত মথিত করে দেয়। ফলে প্রয়োজন হয়ে উঠে জীবন, তখন মহত্ত্ব ও সৌন্দৰ্য-চৰ্চাকে মনে হয় বিলাস। তাই দেখা যায় হাজার টাকা মাইনের কর্মচারীও নেয় ঘুষ ও সারা বৎসরে কেনে না একটি বই ও রাখে না খবর সাহিত্য ও শিল্পের। নিছক বেঁচে থাকা বা বাঁচার উপকরণটা যখন বড় হয়ে ওঠে তখন জীবন হয় সংকীর্ণ ও দরিদ্র, বাঁচার উদ্দেশ্যটা বড় হয়ে উঠলেই জীবন হয় সুন্দর ও ঐশ্বর্যমণ্ডিত। মহত্ত্ব ও সৌন্দর্য সাধনাকে যাঁরা ফাঁকা বিলাস বলে বিদ্রূপ করেন তাঁরা ভুলে যান যে এ বিলাসই সভ্যতা বা সংস্কৃতি। প্রয়োজনের সংকীর্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখলে তাজমহল বা অজন্তা বিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়। তবুও তাই হচ্ছে মানুষের সংস্কৃতি সাধনার নিদর্শন। তাজমহল নির্মাণের বিপুল ব্যয়কে অপব্যয় মনে করেননি বলেই তাজমহলে শাজাহানের সংস্কৃতিবোধ পেয়েছে অমরত্ব। হাজার টাকা মাইনের চাকুরে বই কেনাকে মনে করে অপব্যয় কিন্তু ব্যয় সঙ্কোচ ও কৃপণতা করে জীবন বিমার সংখ্যাকে তিনি হাজারের সীমা ছাড়িয়ে নিয়ে যান লাখের সীমায়। কিন্তু সংস্কৃতি-বোধ আছে অর্থাৎ নিজের মনের চর্চা অব্যাহত রাখতে চান তেমন পঞ্চাশ টাকার কেরানীও বই কিনতে না পারলে যৌথ পাঠাগারের সভ্য হয়ে নিজের সংস্কৃতি-চেতনাকে সজাগ রাখেন ও এভাবে মনের উৎকর্ষ সাধন করে তৃপ্তি পেয়ে থাকেন—এমন দৃষ্টান্ত এ দুর্দিনেও বিরল নয়। 

জীবনকে সুন্দর ও মহৎ করতে ত্যাগের প্রয়োজন, ত্যাগ বর্জন নয়, বরং বড় কিছুকে পাওয়া ও চাওয়ারই প্রমাণ বহন করে ত্যাগ। ফুল ফলে পরিণত হয় তার পাপড়ি ঝরিয়ে দিয়ে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্যও এ ধরনের ত্যাগের প্রয়োজন। শুধু আর্থিক, বৈষয়িক ও আরাম আয়াসে ত্যাগ যে দরকার তা নয়, সংকীর্ণ দেশাচার ও সাম্প্রদায়িক সংস্কারও তার মোহ ত্যাগ করতে না পারলেও প্রকৃত সংস্কৃতি-সাধক হওয়া যায় না। তা পারি না বলেই আমরা হিন্দু সংস্কৃতির ও মুসলিম সংস্কৃতির নামে উত্তেজিত হয়ে উঠি।

উৎকট বিশ্বাস ও অন্ধভাবাবেগ হচ্ছে সাংস্কৃতিক জীবনের অন্তরায়। যে- কোনো উৎকট ভাব মানুষের বুদ্ধি ও মনকে করে রাখে সম্মোহিত ও আচ্ছন্ন। বিপ্লব ও আন্দোলন জাতীয় জীবনে নিয়ে আসে ঝড় ও ভূমি কম্পের প্রচণ্ডতা, তখন কারো মন থাকে না সুস্থ ও দৃষ্টি থাকে না স্বচ্ছ। ফলে তখন সংস্কৃতি থেকে সংস্কার হয়ে ওঠে বড়। এই সংস্কারই জাতীয়, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্যের লেবেল এঁটে বাধায় বিরোধ, ফলে সমাজ বা সম্প্রদায় হয়ে পড়ে এককেন্দ্রিক। আত্মকেন্দ্রিকতার অপর নাম হচ্ছে কূপমণ্ডুকতা। এতদিন আমরা ছিলাম পরাধীন। এই পরাধীনতার কাল নিশ্চয়ই আমাদের জন্যে ছিল দুর্দিন, দুর্দিনে দিশেহারা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে মনে রাখতে হবে দুর্দিনে যে কথাটি বড় হয়ে ওঠে সেটিই বড় সত্য নয়, সুদিনে যে কথাটি বড় হয়ে ওঠে সেটিই বড় কথা। দুর্দিনের উত্তেজনার মুহূর্তে ভাইকে যে আঘাত দিয়েছি এটা জীবনের বড় বা ছোট কোনো সম্পদই নয়, বড়জোর তা আত্মবিস্মৃতিরই স্মারক। সুদিনে স্বাভাবিক অবস্থায় সুস্থ চিত্তে ভাইকে যে ভালোবেসেছি এটি বড় কথা এবং এইটেই জীবনের সম্পদ। 

আজ আমাদের জীবন থেকে পরাধীনতার দুর্দিন গত হয়েছে, আমরা স্বাধীন ও আজাদ হয়েছি। আশা করি আজ অন্তত দুর্দিনের দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে এবং সুদিনের দর্শন অর্থাৎ মহত্ত্ব ও সৌন্দর্য সাধনা যার অপর নাম সংস্কৃতি তা বড় হয়ে উঠবে। আজ আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক চিত্তে এবং স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জীবনের দিকে ফিরে তাকাতে পারব। ঘরের প্রয়োজন আমাদের নিশ্চয়ই আছে এবং চিরকাল থাকবে; কিন্তু ঘর যেন কবর হয়ে না ওঠে অর্থাৎ ঘর যেন ঘরের থেকেও বড় পৃথিবী ও আকাশকে আমাদের মন ও চোখ থেকে রুদ্ধ করে না রাখে। ঘরে বসে আমরা যেন বিশ্বের সঙ্গে বাণী বিনিময় করতে পারি। বলেছি মহত্ত্ব ও সৌন্দর্য সাধনাই সংস্কৃতি, মহত্ত্ব ও সৌন্দর্যের নেই কোনো সীমা, তা আকাশেরই মত অসীম। মহত্ত্ব ও সৌন্দর্য সাধনার উপর এক কথায় মনুষ্যত্বের উপর যে সংস্কৃতির ভিত্তি, একমাত্র সেই সংস্কৃতিই মানবজীবনে বিকিরণ করতে পারে আলো। যে আলোর নেই কোনো দেশ, কোনো কাল ও কোনো জাত। 

সংস্কৃতি ও সজ্জীবন আমার কাছে একার্থবোধক। Cultured লোক বললে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে এমন লোকের ছবি যিনি সজ্জীবনের অধিকারী। সজ্জীবন বা good life -কে বাদ দিয়ে কোনো সংস্কৃতিরই আমি ধারণা করতে পারি না এবং সে রকম সংস্কৃতি আমার কাছে কিছুমাত্র শ্রদ্ধার বস্তু নয়। Clive-Bell সাহেব তাঁর Civilization গ্রন্থে একটি চমৎকার সত্য কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন: “The Civilized man is made not born” সংস্কৃতি কারো পৈত্রিক সম্পত্তি নয়, সংস্কৃতি নিয়ে কেউই জন্মায় না এবং কেউ তা পেতে পারে না উত্তরাধিকার সূত্রে। প্রতিদিন সচেতন সাধনার দ্বারা সংস্কৃতিকে আয়ত্ত করতে হয়। এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ সহজলভ্য হবে যিনি পরিচালিত হবেন যুক্তি, বিচার ও শুভবুদ্ধির দ্বারা। জীবনে বুদ্ধি ও বিচারের আসন সুদূর-প্রসারী। কিন্তু বুদ্ধি ও বিচারশক্তির প্রয়োগ করতে হবে জীবন- সাধনায়, মানুষের জন্য জীবনই সবচেয়ে বড়। ব্যক্তি নয়, জাতি নয়, জীবন। এই জীবনসাধকই হতে পারেন প্রকৃত সংস্কৃতিবান বা cultured, তাই সমঝদার ঐতিহাসিক হযরত মুহম্মদকে বলেছেন জীবনসাধক, আর রসগ্রাহী সমালোচক রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিয়েছেন জীবন-শিল্পী বলে। 

মোটকথা, মনুষ্যত্ব তথা মানব-ধর্মের সাধনাই সংস্কৃতি এবং একমাত্র এ সাধনাই জীবনকে করতে পারে সুন্দর ও সুস্থ। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *