আগামী দিনের সভ্যতা : একটি কল্পনা

আগামী দিনের সভ্যতা : একটি কল্পনা 

I love God, because, He has given me the 
freedom to deny Him. 
—Rabindranath Tagore 

Lord, I disbelieve–help thou my unbelief. 
—E.M. Forster 

 

মানবজাতির পরম শত্রু শয়তান সম্বন্ধে খাস আরব জগতের অন্তর্গত লেবাননের বিখ্যাত আরবি লেখক খলিল জিব্রান (১৮৮৩–১৯৩১) একটি চমৎকার গল্প লিখেছেন। বলা বাহুল্য জিব্রান জাতে আরব ও ধর্মে খ্রিস্টান ছিলেন আর লিখতেন তাঁর মাতৃভাষা আরবিতে। তাঁর গল্পটির প্রাথমিক অংশটুকুই এখানে উদ্ধৃত হলো: একদিন এক পাদ্রী সাহেব জনহীন এক প্রান্তরের উপর দিয়ে একা একা বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ এক করুণ আর্তনাদ তাঁর কানে ভেসে এলো। তিনি থমকে দাঁড়ালেন। এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলেন কে একজন রাস্তার পাশের খাদে আহত অবস্থায় পড়ে আছে, সারা অঙ্গে তার ক্ষত চিহ্ন। মাথা আর বুকের ক্ষতস্থান থেকে তখনও রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। পাদ্রীকে দেখতে পেয়ে লোকটি কাতর কণ্ঠে বলে উঠল: দয়া করে আমাকে বাঁচান, যন্ত্রণায় আমি মারা যাচ্ছি, দোহাই, আমার প্রতি একটুখানি সদয় হোন। 

পাদ্রী সাহেব ধাঁধায় পড়লেন। লোকটি কে হতে পারে? ভাবলেন হয়ত চোর-ডাকাতই হবে। ধরা পড়ে বেদম মার খেয়েছে। এমন লোককে সাহায্য করতে গেলে নিজেই না জানি কি বিপদে পড়ে যাই। যদি বেঁচে উঠে ত লোকে বলবে আমি বোধ করি চোরের সাথী আর মরে গেলে ত বলবে আমি ওকে খুন করেছি। বাবা অত হ্যাঙ্গামে গিয়ে কাজ নেই। এ ভেবে পাদ্রী সাহেব সামনে পা বাড়ালেন। মুমূর্ষ লোকটি আবারও আর্তনাদ করে উঠলো: দোহাই, আমাকে এভাবে ফেলে যাবেন না স্যার। আমি মারা যাচ্ছি, দয়া করে আমাকে বাঁচান। 

পাদ্রী সাহেবের মনে দ্বিধা জাগল: আর্তের সাহায্য না করাও ত অন্যায়। লোকটি পাগল-টাগলও ত হতে পারে, পাগলামি করতে গিয়েই হয়ত পড়ে গেছে খাদে। উঃ ক্ষতস্থান থেকে এখনো যে ভাবে রক্ত ঝরছে দেখলেই ত ভয় হয়। তবে আমি হচ্ছি আধ্যাত্মিক অসুখ-বিসুখের চিকিৎসক, দেহের ক্ষত আমি কি করে সারাবো? 

ফের পা বাড়ালেন তিনি নিজের গন্তব্য পথের দিকে। 

দেখে আহত লোকটি আরো জোরে কাকুতি-মিনতি করতে লাগল: আমাকে চিনতে পালেন না, স্যার? কাছে এলে হয়ত চিনতে পারবেন। আমরা ত দীর্ঘকালের সহকর্মী, বন্ধু বলা যায়। আপনি পাদ্রী, লোকের পথপ্রদর্শক, মানুষের উদ্ধারকর্তা। আর আমাকে এ সামান্য দয়াটুকুও করতে আপনার ইচ্ছা হচ্ছে না, স্যার? আমি চোর নই, ডাকু নই, পাগল-ছাগলও নই। আর একটু কাছে এসে দাঁড়ান, স্যার, আমার পরিচয়টা না হয় বলেই ফেলি। এবার পাদ্রী সাহেবের কৌতূহল গেল বেড়ে, এগিয়ে এসে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন লোকটার মুখের দিকে। লোকটির কেমন এক অদ্ভূত চেহারা, বুদ্ধির সঙ্গে ধূর্ততার, সৌন্দর্যের সঙ্গে বীভৎসতার দুষ্টুমির সঙ্গে কোমলতার সে এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ। এমন চেহারা পাদ্রী এর আগে আর কখনও দেখেন নি, বিস্মিত পাদ্রী জিজ্ঞাসা করলেন: তুমি কে? মুমূর্ষ লোকটি ক্ষীণকণ্ঠে বললে: আমাকে ভয় পাবেন না, স্যার। আসলে আপনি আর আমি বহুকালের পুরোনো দোস্ত। আমাকে ধরে একটুখানি নদীর ধারে নিয়ে চলুন, ক্ষতস্থানগুলি ধুয়ে একটু বেঁধে দিন। অন্তত রক্ত পড়াটা ত বন্ধ হোক। 

পাদ্রীর বিস্ময়ের ঘোর যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। বললেন: আগে বল তুমি কে? আমি ত তোমাকে মোটেও চিনতে পারছি না। কোনোদিন তোমাকে দেখেছি বলেও ত মনে পড়ে না। আহত লোকটি এবার অস্থির কণ্ঠে বলে উঠল: আমার পরিচয়, স্যার, আপনি ভালো করেই জানেন, দিনে আপনি হাজার বার নিয়ে থাকেন আমার নাম। ধরতে গেলে আমি আপনার প্রাণের চেয়েও প্রিয়…। 

পাদ্রী সাহেব এবার আর ধৈর্য রক্ষা করতে পারলেন না। ধমকে উঠলেন: তুমি একটা আস্ত জোচ্চর, ডাহা মিথ্যাবাদী, বলছি তোমার এপাপ মুখ আমি জীবনে কখনও দেখিনি, তবুও। যাগ্‌গে যদি বাঁচতে চাও তা হলে খুলে বলো তুমি কে? 

মুমূর্ষ লোকটি এবার মরীয়া হয়ে আর একটু সরে এলো পাদ্রীর দিকে। ভালো করে তাকিয়ে দেখল পাদ্রীর দুই চোখের পানে। দেখতে দেখতে ওর বিষণ্ণ মুখে ফুটে উঠল এক বাঁকা ব্যঙ্গ-হাসি। তারপর স্থির গম্ভীর কণ্ঠে বললে: আমি শয়তান। 

ধর্ম-ভীরু পাদ্রী শুনেই আঁৎকে উঠলেন। হায় হায় কি গজব। কি গজব! আমাকে কিনা আজ তোমার নারকীয় মুখ দেখতে হলো। চির অভিশপ্ত তুমি মর, মর। মরে জাহান্নামে যাও। 

বলতে বলতে হন্ হন্ করে পাদ্রী সাহেব হাঁটা শুরু করলেন সামনের দিকে নাছোড়াবান্দা শয়তান আবারও কাতর কণ্ঠে বলে উঠল: দোহাই আমাকে এভাবে ফেলে যাবেন না, স্যার। আমাকে বাঁচান; শিগির আমার ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়ে রক্তপাত বন্ধ করুন। 

অগ্নি-দৃষ্টি হেনে পাদ্রী রুষ্টস্বরে বললেন: যে হাতে রোজ রোজ আমি ঈশ্বরের তর্পণ করে থাকি সে হাত আমি কিছুতেই তোমার নাপাক দেহে লাগাতে পারবো না। 

শয়তান এবার এক হাতের কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে রক্তসিক্ত মাথাটা সামান্য আলগা করে বললে: আপনি নিজের পায়েই নিজে কুড়াল মারছেন স্যার, অথচ তা বুঝতে পারছেন না। জানেন, আপনার সব রকম সুখ-শান্তি র মূল 

কিন্তু আমি। আর আপনি আমাকে ই কিনা দিচ্ছেন অভিশাপ! আমার অস্তিত্বের উপর আপনার জীবন, ধন-দৌলত, সুখ-সমৃদ্ধি সবকিছুই ত নির্ভর করে। আর আপনি কিনা আজ আমার এ চরম দুর্দিনে আমার প্রতি সামান্য এ দয়াটুকু দেখাতেও নারাজ। আপনার জীবনধারণের একমাত্র হাতিয়ার ত আমি, একমাত্র পুজি ত আমার নাম। আমার নাম ভাঙিয়েই ত আপনার যতসব হালুয়া-রুটি। আমি আছি বলেই ত আমার ভয় দেখিয়ে নিজের সব রকম তুক্তাকের সাফাই গাইতে পারেন সরল বিশ্বাসী মানুষের কাছে। আমার ভয় দেখিয়ে জীবনে কত ধন রোজগার করেছেন একবার ভেবে দেখুন দেখি। আমি মরে গেলে আপনাকেও কি স্রেফ উপোসে মরতে হবে না? আজ যদি আমার মৃত্যু ঘটে তা হলে কাল থেকে আপনিও কি সম্পূর্ণ বেকার হয়ে যাবেন না? মনে রাখবেন দুনিয়া থেকে আমার নাম মুছে গেলে, নির্ঘাত আপনার পেশারও ঘটবে ভরাডুবি। কাল থেকে আপনার ঘরেও জ্বলবে স্রেফ লালবাতি। ভেবে দেখুন, সারা জীবন গ্রামে গ্রামে ঘুরে শয়তানের খপ্পরে না-পাড়ার জন্য লোককে ইনিয়ে বিনিয়ে কত উপদেশ খয়রাত করেছেন আপনি? বিনিময়ে গরিবের ক্ষেতের কত ফসল, কত ফলমূল, দুঃখের কত সন্ধ্যা, সোনাদানা আপনার ঘরে আপনার আলখাল্লার পকেটে আশ্রয় নিয়েছে একবার হিসেব করে দেখুন। আমি না থাকলে তাবিজ-মাদুলি আর ঝাড়-ফুঁকের জন্য কেই-বা আপনার দোরগোড়া মাড়াবে বলুন ত! গাঁয়ের লোকেরা যখন শুনবে তাদের পরম শত্রু শয়তান আর ইহজগতে নেই তখন তারা কি আপনার শরণাপন্ন হবে? তখন হাঁস-মুরগি আর ছাগল-দুম্বার কল্লাটা কি আর ওরা আপনার পাতে তুলে দিতে গরজ করবে বলুন? অতএব আমি মরলে শুধু যে আমি মরবো তা নয় আপনিও মরবেন এবং মরবেন ঝাড়েবংশে…। 

শয়তানের এ সুচিন্তিত আর সারগর্ভ বক্তৃতা শোনার পর পাদ্রীর যেন মুহূর্তে জ্ঞান-চক্ষু খুলে গেল। তখন বিনাবাক্যে তৎক্ষণাৎ তিনি আহত শয়তানের বিশাল দেহটা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। শয়তানের ক্ষতস্থান থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্তে তাঁর সাদা ধবধবে লম্বা আলখাল্লাটা ভিজে রক্তাক্ত হয়ে গেল। পাদ্রী সাহেবের সেদিকে কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই। শয়তানের দেহ-ভারে তাঁর নিজের দেহটা ধনুকের মতো বেঁকে পড়েছে। তবুও প্রাণপণে অত বড় দেহটা তিনি একাই বয়ে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়ি এবং বেশ আলতোভাবে অতি প্রিয়জনের মতো শুইয়ে দিলেন নিজের সযত্নে-পাতা ধবধবে বিছানায়। তারপর স্বহস্তের সেবা-যত্নে শয়তানকে নিরাময় করে তুললেন অল্পদিনের মধ্যেই। 

সেই থেকে আবার নব উৎসাহ ও নতুন উদ্যমে ঈশ্বর-ভক্ত পাদ্রী ও ঈশ্বর দ্রোহী শয়তান সহ-অংশীদার হয়ে সগৌরবে আর অতি সাফল্যের সাথে নিজ নিজ পেশা চালিয়ে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান তথা Co-existence- এর এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টি মিলবে কিনা সন্দেহ। 

 

ঈশ্বরকে আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু ঈশ্বর-ভক্ত পাদ্রীকে দেখতে পাই। তিনি এবং তাঁর অনুরূপ পেশার লোকেরা ঈশ্বরের স্বনির্বাচিত প্রতিনিধি। ঈশ্বরের বিপরীতে শয়তানকে না দাঁড়া করালে চিত্রটা পূর্ণাঙ্গ হয় না। তাই ঈশ্বর-রূপী কল্প-মূর্তির স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে বিপরীত কল্পমূর্তি শয়তানের আবির্ভাবও অপরিহার্য। তবে জিজ্ঞাস্য মানুষ কেন ঈশ্বর আর শয়তানে বিশ্বাস করে? যুক্তি প্রমাণ দিয়ে এযাবত কোনো দার্শনিক ধর্মবেত্তাই এ জিজ্ঞাসার সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। এসবের সপক্ষে এযাবত যত যুক্তিই দেওয়া হয়েছে তা সবই অনুমান, মন গড়া। কোনোটাই প্রামাণ্য নয়। দণ্ড ও পুরস্কারদাতা হিসেবে ঈশ্বরের যে ধারণা বা স্বর্গ- নরকের যে চিত্তাকর্ষক বর্ণনা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে দেখতে পাওয়া যায় তাতে একটা প্রবল আকর্ষণ আর কৌতূহল জাগে বটে কিন্তু জিজ্ঞাসু মন তাতে তৃপ্তি কিম্বা সান্ত্বনা খুঁজে পায় না। স্বর্গ-নরকের ভৌগোলিক, স্থানিক আর জৈবিক জীবনের যে চেহারা তা এত বেশি স্থুল আর গ্রাম্য যে তাতে রুচিশীল মনের তেমন উৎসাহ বোধ করার কথা নয়। হালে নানা শূন্যযান আবিষ্কার করে চন্দ্রে মানুষের অবতরণ ইত্যাদি অকল্পনীয় কাণ্ডের পর স্বর্গ- নরকের ভূগোল একদম গোল বা শূন্যে বিলীন, সে সঙ্গে মানুষের দীর্ঘকালের অনেক আস্থাও। 

বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কারের ফলে আজ বুঝতে পারা যাচ্ছে একমাত্র মৃত্যুই সত্য, মৃত্যুই অমর। অর্থাৎ যমই চিরজীবী দেবতা। পূজা যদি কারও করতে হয় তাহলে একমাত্র যমরাজেরই করা উচিত। দেখা যায় একমাত্র মৃত্যুর সামনেই মানুষ ভীত আর অসহায়, তখনই সে খোঁজে কোনো না কোনো অবলম্বন আর সন্ধান করে আশ্রয়, হোক না তা সমুদ্রে ভাসমান তৃণখণ্ড। এর ফলেই বা এভাবেই মানুষের মনে জন্ম নেয় এক অশরীরী শক্তির উপর বিশ্বাস আর সে সঙ্গে আত্মসমর্পণের আকুতি। আজ যদি বিজ্ঞান এমন অঘটন ঘটাতে পারে, যার ফলে মানুষের জীবন থেকে মৃত্যু যাবে মুছে, মানুষ হতে পারবে নিশ্চিন্ত, ‘শেষের সে ভয়ংকর দিনের’ ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। তা হলে আমার বিশ্বাস কেউই ঈশ্বর বিশ্বাস করবে না, বিশ্বাস করার প্রয়োজনই তখন যাবে ফুরিয়ে। স্বর্গ-নরকেও রাখবে না এতটুকু আস্থা এবং শয়তানের ভয়েও হবে না মানুষ মোটেও ভীত। এযাবত বিজ্ঞান বহু অসাধ্য সাধনই ত করেছে, শত বছর আগে যা ছিল অকল্পনীয় তা আজ বাস্তবে রূপায়িত। তেমন আর এক অসাধ্য সাধন করে বিজ্ঞান যদি মানুষকে মৃত্যু জয় করার হদিস বাতলাতে পারে তা হলে ঈশ্বর বা অনুরূপ কোনো অশরীরী শক্তির প্রয়োজনই থাকবে না মানুষের জীবনে। বলা বাহুল্য মানুষ নিজের প্রয়োজনেই ঈশ্বরকে, লৌকিক ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। স্রষ্টা কি ঈশ্বর না মানুষ এ নিয়ে রীতিমতো তর্ক চলতে পারে। যুগে যুগে জিজ্ঞাসু আর কৌতূহলীদের মনে এ তর্ক যে জাগেনি তা নয়। তবে এ তর্কের কোনো মীমাংসা নেই। অন্তত যদ্দিন না মানুষ মৃত্যুকে আয়ত্তে আনতে পারছে। বলা বাহুল্য আধ্যাত্মিক চেতনায় যে ঈশ্বরের উপলব্ধি মানুষ কোনো কোনো দুর্লভ মুহূর্তে বা শোক-দুঃখের বিহ্বল অবস্থায় অনুভব করে, যা মহৎ মনের স্বাভাবিক অনুষঙ্গ বলা যায়, সে ঈশ্বর বা তেমন ঈশ্বর-চেতনা আমাদের এ আলোচনার বহির্ভূত। 

 

জন্ম ও মৃত্যু—জীবনের দুই সীমা। জন্ম মানুষ জয় করেছে, অর্থাৎ নিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে সামাজিক ধর্মবোধে এসেছে এক বিরাট পরিবর্তন। এ আবিষ্কারের আগে নরনারীর যৌন অপরাধের বিচার হতো দুই পৃথক মানদণ্ডে। এখন দুই মানদণ্ড এক হয়ে গেছে। গুরুত্বে দু’য়েরই অপরাধ সমান ভাবতে এখন আর কারও আপত্তি দেখা যায় না। বিজ্ঞান মানুষের নৈতিক-চেতনাকেও কিভাবে বদলে দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরো বেশি করে যে দেবে এ বোধ করি তার এক বড় দৃষ্টান্ত। আসলে ধর্ম বা নীতি বড় কথা নয়, বড় কথা সমাজ বা মানুষের সামনে মুখরক্ষা। এভাবে বিজ্ঞান সমাজের অর্ধাংশকে মুখ রক্ষার সুযোগ দিয়ে অন্য অর্ধাংশের সঙ্গে এক করে দিয়েছে। অন্তত এ একটা ক্ষেত্রে নরনারীকে সমানাধিকার দিতে বিজ্ঞান সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞানের এ অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের অন্য সীমা মৃত্যুকেও যদি বিজ্ঞান জয় করতে, অন্ততপক্ষে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তা হলে প্রচলিত ধর্মের পনেরো আনাই অকেজো হয়ে যাবে। প্রচলিত ধর্মের মূল ভিত ঈশ্বর আর শয়তানের ভবিষ্যৎও এ জয়ের উপরই নির্ভর করছে। শুধু ঈশ্বর ও শয়তানের নয় সব রকম দেব-দেবী, ফেরেস্তা, হুর, গেলমান, স্বর্গ-নরক, পাপপুণ্য অনেক কিছুরই ভাগ্য নির্ভর করছে এ জয়ের উপর। নির্ভর করছে মোল্লা-মৌলবী, পাদ্রী-পুরোহিত, খাদেম-পাণ্ডা আর তথাকথিত সাধু-সন্নাসীর রুজি রোজগারও। তখন সমাজে কোনো পাত্তা থাকবে না এ সব লোকের। পাপ-পুণ্যের ধারণা যাবে মুহূর্তে বদলে, যেমন বদলে গেছে যৌন অপরাধের বেলায়। 

তখন কি মানুষ অমানুষ হয়ে যাবে? নিশ্চয়ই না। নৈতিক-বোধ, কর্তব্য- জ্ঞান, ন্যায়-অন্যায় চেতনা অবশ্যই মানুষের থাকবে। শুধু থাকবে না বিদেহীজীবনে দণ্ড পুরস্কারের ভয় কিম্বা লোভ। বলা বাহুল্য মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি-চেতনা ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকৃতির উপর কিছুমাত্র নির্ভর করে না, করে নৈতিক ধারণা, সৌন্দর্য-চেতনা, দায়িত্ব ও কর্তব্যজ্ঞান এবং সর্বোপরি জীবনের মূল্যবোধের উপর। এখন সে মূল্যবোধ অনেকক্ষেত্রে, বিশেষ করে যে সব দেশে ও যে সব সমাজে ঈশ্বরকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি চলে সেখানে, ভয়ানকভাবে উপেক্ষিত। লোক-দেখানো আনুষ্ঠানিক ধর্ম তথা ঈশ্বর স্বীকৃতির নামে নৈতিক চেতনা ও নৈতিক দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া সেখানে অতি বেশি সহজ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ ঈশ্বরকে মুখে স্বীকার করা বা মানা খুবই সহজ কিন্তু নৈতিক দায়িত্ব পালন রীতিমতো কঠিন ব্যাপার। মানুষ চিরকালই সহজের ভক্ত। তাই দেখা যায় সামাজিক ঈশ্বরে বিশ্বাস- অবিশ্বাসের মূল্য অন্য দশটা লৌকিক ব্যাপারের চেয়ে বেশি নয়। ‘Beware of that man whose God is in heaven’ শ’ এর উক্তি যথেষ্ট অর্থপূর্ণ। আকাশবিহারী ঈশ্বরই সামাজিক ঈশ্বর, যা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে ভিটেমাটির মতো পেয়ে থাকি। 

কথায় বলে ভাগের মা গঙ্গা পায় না। কারণ তিনি কারো মা নন পুরোপুরি। সামাজিক ঈশ্বরেরও সে দশা। সমাজকে দেখিয়ে দূর থেকে একটু নমো নমো করলেই চলে। অন্তর দিয়ে বোঝা কিম্বা উপলব্ধির দরকার পড়ে না। যে ঈশ্বর মানুষের চরিত্রে নৈতিক চেতনায় আর মূল্যবোধে রূপায়িত সে ঈশ্বরেরই যা কিছু মূল্য। ব্যক্তি-চেতনায় সজীব হয়ে মিশে থাকে থাকুক। ঈশ্বরই মানুষকে মানুষ হতে সাহায্য করে। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনদেবতা’ একমাত্র রবীন্দ্রনাথেরই জীবনদেবতা। ঘটা করে প্রতি বছর যারা রবীন্দ্র-জয়ন্তী পালন করে, তাদের কারো নয়। 

 

দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষেরই সাধ-স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায়। আশাভঙ্গের বেদনা বোধ করেনি বা করে না এমন মানুষ বিরল। এদের কাছে জীবন সহনীয় হয়েছে একমাত্র পরলোকে বিশ্বাসের জোরেই। এখানে তারা যা পায়নি সেখানে তা পাবে। এখানকার অপূর্ণ বাসনা কামনা সেখানে গেলেই পূর্ণ হবে। এমনতরো বিশ্বাসে তারা যেন কিছুটা স্বস্তিবোধ করে। ইহজীবনে তারা যে অবিচার ভোগ করেছে—পরজীবনে তার সুবিচার পাবে। আর সুবিচার পেতে হলে একজন নিরাসক্ত নিক্তিধর সুবিচারক দণ্ডধর থাকা চাই। যে সমাজব্যবস্থা এখন কায়েম রয়েছে তাতে ওরা দেখতে পায় পৃথিবীটা প্রায় শয়তানেরই রাজ্য। এ শয়তানকে নরকে ফেলে আচ্ছা করে শায়েস্তা করতে না পারলে এদের মন কিছুতেই শান্তি পায় না। একজন সর্বশক্তিমান দণ্ডধর না হলে দণ্ড দেবে কে? তাই ঈশ্বরের নাম ‘দণ্ডধর’, ঈশ্বরের নাম ‘বিচারক’, ঈশ্বরের নাম ‘পুরস্কারদাতা’ ইত্যাদি। আশা অমর, আশা অশেষ। আশা কুহকিনীই ঈশ্বরকে নানা রঙ্গে নানারূপে রূপায়িত করে তোলে। বলা বাহুল্য যুগের সঙ্গে মানুষের আশারও রূপ-বদল ঘটে। যে লোক একদিন জুড়ি গাড়ির স্বপ্ন দেখত, সে এখন মটরের স্বপ্ন দেখে, অনেকে মটর ছাড়িয়ে এরোপ্লেনের। যে স্বর্গে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ি নেই, সিনেমা, টেলিভিশন নেই, সিনেমা তারকারা থাকবে না, তেমন স্বর্গের প্রতি এ যুগের তরুণেরা তেমন আগ্রহ বোধ করবে বলে মনে হয় না। যুগের সঙ্গে সঙ্গে এ ভাবে স্বর্গ-নরকের ধারণা বদলে যাচ্ছে তেমনি আমার মনে হয় ঈশ্বর আর শয়তানের ধারণায়ও রদবদল ঘটছে; এবং না ঘটে পারে না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানতে হলে শয়তানের অস্তিত্বও মানতে হয়। এ প্রায় গণতন্ত্রের মতো ব্যাপার। গণতন্ত্রের ঈশ্বর যদি হন লীডার অব দি হাউস, শয়তান হচ্ছে লীডার অব্ দি অপজিশন। একে অন্যের পরিপূরক। শয়তান না থাকলে ঈশ্বরের প্রয়োজনও নিঃশেষিত। ঈশ্বর মানে না এমন মানুষ কিম্বা সম্প্রদায়ের অভাব নেই কিন্তু শয়তান মানে না এমন লোক বিরল। এমন কি আস্ত নাস্তিকও শয়তানে বিশ্বাস করে। শনি ত শয়তানেরই নামান্তর। আর শনি পূজাই ত একমাত্র সাপ্তাহিক পূজা। অপজিশন ছাড়া যেমন গণতন্ত্ৰ অচল, তেমনি শয়তান ছাড়া ঈশ্বরতন্ত্রও অচল অন্তত সৎশক্তি। 

মানুষের ভাগ্য, মানুষের ভবিষ্যৎ আর মানব সভ্যতার রূপান্তর সবকিছু নির্ভর করছে মৃত্যুকে আয়ত্তে আনার উপর। মৃত্যু থাকলে পরকালের ধারণা আর তাতে বিশ্বাসও একভাবে না একভাবে থাকবে। তেমন অবস্থায় ঈশ্বর আর শয়তানের ধারণাও অপরিহার্য। এই দুই বিপরীতমুখী শক্তির আয়ু নির্ভর করছে পরকালে দণ্ড পুরস্কারের আশা আর বিশ্বাসের উপর। মৃত্যু না থাকলে বা মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে পরকালও থাকবে না তখন ঈশ্বরের অস্তিত্ব শুধু বিপন্ন নয়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা। সঙ্গে সঙ্গে শয়তানেরও একই দশা। সাথে সাথে মোল্লা-মৌলবী পাদ্রী-পুরোহিতের পেশার দুয়ারেও পড়বে তালা। জন্ম-মৃত্যু জীবনের দুই তীর–দুই মেরু। এর একটাকে মানুষ জয় করেছে, অন্যটাকেও যদি জয় করতে পারা যায় তা হলে মানব-সভ্যতার ভবিষ্যৎ চেহারাই যে শুধু বদলে যাবে তা নয়, অতীতের অনেক ধ্যান-ধারণা, ধর্মকর্ম, ক্রিয়া-কাণ্ড স্রেফ অর্থহীন হয়ে পড়বে। মনে হবে কি বিরাট অপচয়। বিয়ের পর মেয়েদের যেমন ছেলেবেলার পুতুল খেলাকে মনে হয়, যত সব ছেলেমানুষী কাণ্ড, আজকের ধর্মকর্মকেও সেদিন তাই মনে হবে। অনেক মহাপুরুষকে মহাপুরুষই আর মনে হবে না, মনে হবে স্রেফ ফাঁকি দিয়েই তাঁরা মানুষের পূজো আদায় করে নিয়েছেন এতকাল। হয়তো মহাপুরুষ কথাটারই মানে যাবে বদলে। আজকের এ দুই প্রাতঃস্মরণীয় নাম—ঈশ্বর আর শয়তান, সেদিন হয়ত পুরাতত্ত্বের সামিল হয়ে পড়বে এবং গবেষকদের থীসিস ছাড়া এ দুটি নাম আর কোথাও পাওয়া যাবে না খুঁজে। শুধু শাস্ত্রগ্রন্থ নয়, অনেক কাব্য- কাহিনীও সেদিন অর্থ আর সব রকম আবেদন হারিয়ে বসবে। মনে হবে যতসব ভূতুড়ে কাহিনী। অতবড় দান্তেকে মনে হবে একদম ছেলেমানুষ। আমাদের রবীন্দ্রনাথও হয়তো আর্দ্ধেক হয়ে যাবেন। ভক্তি-গদগদ অনেক গান কিম্বা কবিতা মনে হবে স্রেফ প্রলাপ। 

বর্তমান, সভ্যতা, তথাকথিত ‘স্বাধীন বিশ্বে যে সভ্যতা এখন চলতি তা মোটামুটি ধর্মকেন্দ্রিক অর্থাৎ ঈশ্বর আর শয়তানের ধারণাকে কেন্দ্র করেই তা শাখায়িত ও পল্লবিত। সে দুটি যেদিন ভেঙে যাবে আনুষঙ্গিক অন্য সবকিছুও সেদিন লোপ না পেয়ে পারে না। তখনই হয়তো মানুষ হতে পারবে পুরোপুরি মুক্ত, তখনই শুধু মানুষের মন থেকে ঘুচবে যত সব অদৃশ্য আর অশরীরী বন্ধন, খসে পড়বে মুহূর্তে যুগযুগান্তরের যত সব সংস্কারের শিকল। সর্ব-বন্ধনমুক্ত সে মানুষের সভ্যতা নিশ্চয়ই ভিন্নতর হবে। ঈশ্বর হীন, শয়তান-হীন সে সভ্যতার কল্পনাই রীতিমতো রোমাঞ্চকর! স্বর্গের লোভ নেই, নরকের ভয় নেই, নেই আর আজাবের আতংক; পীর- পুরোহিত, পাদ্রী-যাজক নির্মূল, মন্দির-মসজিদ, গীর্জা-মঠ, দরগা-মাজার আর সংখ্যাহীন তীর্থভূমি পুরাতত্ত্বে পরিণত। আর্কোলজিকেল বিভাগের সংরক্ষিত দর্শনীয় বস্তুর বাইরে যার আর কোনো মূল্যই থাকবে না। তখন জেরুজালেম আর জাকার্তা, বৃন্দাবন আর বান্দরবনকে সমান ভাবতে কিছুমাত্র বেগ পেতে হবে না। থাকবে না তখন পূর্ব আর পশ্চিমে কোনো ভেদ। রাম-রহিমকে জুদা না ভাবা তখনই শুধু হবে সম্ভব। তখন মনে হবে পদ্মা-যমুনা বা গঙ্গা-জর্ডনও তাই। শুধু ওঝার হাত থেকে বাঁচা নয়, পাঁচ বেলা ওজু আর দু’বেলা সন্ধ্যা আহ্নিকের হাত থেকেও রেহাই। ধৰ্ম নেই, ধর্মগ্রন্থ নেই, নেই দেব-দেবী, মহাপুরুষ কিম্বা অবতার কি অপৌরুষের বাণী, নেই ওসবের হুমকি ধমকি তম্বি। থাকবে না তাবিজ মাদুলির বালাই, পূজা-পার্বণের ঘটা, ঘুম তাড়ানো শঙ্খ ঘণ্টার কান ফাটানো আওয়াজ। এখন ত হজের মতো ধর্ম-কাজ করতে গেলেও লটারির মতো অধর্মের আশ্রয় না নিয়ে উপায় থাকে না। তখন ধর্মের সঙ্গে এ ধরনের সঙ্গে বহু অধর্মেরও ঘটবে অবসান। শাসকেরাও হবেন খুশি; কারণ তখন দেদার বৈদেশিক মুদ্রা যাবে বেঁচে। তবে যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্যকে গদি ছাড়া করে নিজেরা গদিনশিন হতে চায় তারা কিছুটা বেকায়দায় পড়ে যাবে। কারণ তখন ধর্মের হাতুড়ি দিয়ে ক্ষমতার বাদাম কিছুতেই আর ভাঙা যাবে না জনগণের মাথার উপর। তখন সব দেশের সংখ্যালঘুরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে, কারণ তখন সাম্প্রদায়িকতা হবে সব দেশ থেকে দেশ-ছাড়া। লৌকিক ঈশ্বরের ব্যাখা নিয়েই ত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। স্বয়ং ঈশ্বরই যখন থাকছেন না তখন সম্প্রদায় থাকে কি করে? ধার্মিকেরা অবশ্য সাফাই দিয়ে থাকেন যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে শয়তানের কারসাজি; তা যদি সত্যও হয় তাতেও বাঁচোয়া। কারণ ঈশ্বর না থাকলে শয়তানও ঝাড়ে-বংশে নির্মূল না হয়ে যায় না। তখন ত নিজেদের কৃতকর্মের অপরাধ শয়তানের ঘাড়ে চাপিয়ে রেহাই পাওয়া যাবে না কিছুতেই। 

তেমন দিন যদি কখনো আসে, আমার বিশ্বাসী পৃথিবীতে তখনই মাত্ৰ মানুষের রাজত্ব তথা মানবতন্ত্র আর মানুষের সভ্যতা দেখা দেবে। এখন ত শুধু কথায় কথায় ঈশ্বরের রাজ্য, ধর্ম-রাজ্য, খোদার রাজ্য ইত্যাদি বুলির শাক দিয়ে মাছ ঢাকাই চলছে স্রেফ। তখন এসব বুলির আর কোনো প্রয়োজন থাকবে না। তবে ঈশ্বর আর শয়তানের নামে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছে তা গড়ে উঠতে যেমন দীর্ঘসময় লেগেছে তা লোপ পেতেও তেমনি দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। তার উপর নতুন করে মানবতন্ত্রী সভ্যতার ভিত পত্তনেও ঢের ঢের সময় লেগে যাবে। তার জন্য সবুর করা ছাড়া উপায় নেই। 

অবশ্য এও হয়তো অসম্ভব নয় যে, প্রথম প্রথম তাতে অনেকেই বেশ অস্বস্তি বোধ করবে, যেমন অনেকে অস্বস্তিবোধ করেছিল ইংরেজ চলে যাওয়ার পর। এমন মানুষ আজো বিরল নয় যারা ইংরেজ রাজত্বের কথা স্মরণ করে আজও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দাস-প্রথা উচ্ছেদের পর আমেরিকার অনেক নিগ্রোও নাকি আশ্রয় ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি। দাসত্ব ওদের মন থেকে সাহসের বীজটুকুও এভাবে নির্মূল করে ছেড়েছিল। আমাদেরও আজ সেই একই দশা। বংশানুক্রমে বিশ্বাসের যে ছায়াতলে আমাদের মন-মানস লালিত পালিত হয়ে গড়ে উঠেছে তার বাইরে পা বাড়াতে শুধু নয়, ভাবতেও আমরা আজ অপারগ। ভাবার জন্য যে সাহসটুকু দরকার তাও যেন আমরা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না। 

এমনও হতে পারে ঈশ্বর আর শয়তানহীন মানবতন্ত্রের যুগেও হয়তো এমন মানুষের অভাব হবে না যারা ঈশ্বর আর শয়তানকে আবার ফিরিয়ে আনতে চাইবে। এজন্য তারা হয়তো তুমুল গণআন্দোলনও গড়ে তুলতে পারে। এমন কি রক্তবিপ্লবের হুমকিও দিতে পারে। উভয়ের সমর্থকরা মিলে শক্তিশালী যুক্তফ্রন্ট গঠন করাও বিচিত্র নয়। তারা তখন হয়ত রাস্তায় সুদীর্ঘ মিছিল করে ‘ঈশ্বর-শয়তান জিন্দাবাদ’ ‘ঈশ্বর-শয়তান ভাই ভাই’ শ্লোগান দিয়ে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলতে চেষ্টার ত্রুটি করবে না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, তখন বড় বড় পুঁজিপতিরা এ ধরনের আন্দোলনকে জিইয়ে রাখার জন্য তলে তলে প্রচুর অর্থও জোগাতে থাকবে; এমনকি পয়সা দিয়ে দাঁড় করাবে বহু দালালও। আরসি.আই.এ.ত ধারে-কাছে রয়েছেই। 

তাহলেও মনে হয় সাময়িক বিভ্রান্তির হাত থেকে মানুষ মুক্তি পাবেই। মুক্ত- বুদ্ধি মানুষের স্বাধীন চিন্তার জয়যাত্রা কিছুতেই রোখা যাবে না। কল্পনা কখনো স্তব্ধ হয়ে থাকতে পারে না। আদি মানব-মানবী জ্ঞান-বৃক্ষের ফল খেয়ে মানুষের মনে যে জিজ্ঞাসা আর অসন্তোষের বীজ বপন করে দিয়েছে তার হাত থেকে মানুষের রেহাই নেই। কিন্তু আশ্চর্য দুর্বল মানুষের মন। মৃত্যুকে জয় করার কথায় এখনো মনে তার দ্বিধা জাগে। নিজের চারপাশে অহরহ এত অজস্র মৃত্যু দেখতে হয় যে, মৃত্যুহীন অবস্থা কল্পনা করাও আজ দুঃসাধ্য। মানুষ কোনোদিনই মরবে না। চিরজীবিত হয়ে থাকবে একথা আজ কিছুতেই ভাবা যায় না। তবে আশার কথা এটুকু আজ যা ভাবা যায় না, বা যায়নি, এমন অনেক কিছুই ত কালে কালে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। একদিন যা কল্পনারও অতীত ছিল আজ তার অনেক কিছুই মানুষের আয়ত্তে এসে গেছে। মৃত্যুর বেলায়ও তা সত্য হবে কি? পুরোপুরি না হোক আংশিক সত্য হলেও ঈশ্বর আর শয়তানের প্রচলিত ধারণায় বদল ঘটবে। 

আণবিক বোমা আবিষ্কারের আগে সামান্য অণুর মধ্যে যে এত অসীম শক্তি সুপ্ত রয়েছে তা কে জানতো? যে অণু-তুল্য জীবকোষ দিয়ে মানবদেহ গঠিত তার ক্ষয় নিবারণ করতে পারলে, অন্তত বিলম্বিত করতে পারলে মানুষের আয়ু-সীমা নিশ্চয়ই অনেক বেড়ে যাবে। এক নাগাড়ে দু’ তিন শ’ বছর বাঁচার পর মানুষের নিজেরই হয়ত আর তখন বাঁচতে ইচ্ছা হবে না। কাজেই তেমন অবস্থায় মৃত্যু ভয়ও স্বভাবতই কমে আসবে। সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক ঈশ্বর আর শয়তানভীতিও পাবে লোপ। ফলে পরকালের ধারণাও যাবে পাল্টে। এখনকার মতো তখন আর কেউ ঈশ্বর, শয়তান, গোর-আজাব ইত্যাদির ভয়ে মরার আগে মরবে না। আর অতকাল ধরে জীবনটাকে ইচ্ছামত ভোগ করার পর পরপারে বা পরকালে কি হবে না হবে তা নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন দু’চার জন অতি লোভী পুণ্যবান আর অতি পাপী ছাড়া আর কেউই হয়তো বোধ করবে না। এ বোধ না করলেই ত ঈশ্বর আর শয়তানের যুগপৎ যুগল সহমরণ। সঙ্গে সঙ্গে এ দুই মূলধন আজ যাদের একমাত্র পুঁজি তাদের পেশারও তখন ভরাডুবি। আমার বিশ্বাস একমাত্র তখনই নির্ভেজাল মানবতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। আমি এ আলোচনায় মানুষের ধ্যান-ধারণা আর বিশ্বাসের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত এমন একটি বিষয়ে পাঠকের মনকে একটুখানি নাড়া দিতে চেয়েছি শুধু। পাঠকও জিজ্ঞাসু হয়ে উঠুক আর সে জিজ্ঞাসা কোনো একটা চীনের প্রাচীরে এসে আটকা না পড়ক এ আমার ইচ্ছা। অত্যন্ত আশার কথা কিছুদিন আগে আমার বক্তব্যের অনুকূল একটি চমকপ্রদ সংবাদ লন্ডন থেকে পরিবেশিত হয়েছে। বলা বাহুল্য লন্ডন আজও বিশ্বের সংস্কৃতি-কেন্দ্র। তাই সংবাদটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ধর্মীয় ব্যাপারেও মানুষের ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস যে নতুন পথে মোড় নিচ্ছে এ তারই যেন শুভ সূচনা। ধর্মের খুঁটিনাটি ব্যাপারেও এত কাল যাঁরা গোঁড়া রক্ষণশীলের ভূমিকায় অভিনয় করে এসেছেন আজ তাঁদের মনেও দেখা দিয়েছে ফাটল। বিজ্ঞান আর নতুন জীবন-চেতনার শক্তি এমনি অমোঘ আর এমনি দুর্বার! সংবাদটি এই 

“London Jan. 19 (1961)-All mention of the devil is to be dropped from the new catechism of the church of England, adds, A.F.P. A revised version of the catechism modernizing some of the earlier phraseology notably omits the phrase: “I renounce the devil and all his works.” The new wording was approved last night at a synod of Anglican clergy here but not without some criticism of the omission. এমন দিন হয়তো বেশি দূরে নয় যখন শয়তানের নাম না নিতে নিতে শয়তানের অস্তিত্বই মানুষ ভুলে যাবে। তখন এতদিন ধরে শয়তানের হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ অহরহ যার আশ্রয় ভিক্ষা করে এসেছে তাঁর সম্বন্ধে ধারণায়ও কি খানিকটা রদবদল ঘটবে না? 

আশ্চর্য, আমি যে বলেছি শয়তান না থাকলেও শয়তানের সমর্থকদের কিন্তু অভাব হবে না, আমার সে কথারও সমর্থন রয়েছে উদ্ধৃত সংবাদটিতে (Not wihthout critcism কথাটা লক্ষ্য করার মতো!)। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *