সভ্যতার সংকট
মানুষের একটা বড় পরিচয় সে ভাবতে পারে। করতে পারে যে-কোনো বিষয়ে চিন্তা। যে চিন্তা ও ভাব মানুষকে সাহায্য করে মানুষ হতে। পশুপাখিকে পশুপাখি হতে ভাবতে হয় না—পারেও না ওরা ভাবতে বা চিন্তা করতে। সে বালাই ওদের নেই—যে-টুকু পারে তার পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ—বাঁচা ও প্রজননের মধ্যে তা সীমিত। সভ্য-অসভ্যের পার্থক্যও এ ধরনের। যারা যত বেশি চিন্তাশীল সভ্যতার পথে তারাই তত বেশি অগ্রসর। আর চিন্তার ক্ষেত্রে যারা পেছনে পড়ে আছে, সভ্যতার পেছনের সারিতেই তাদের স্থান। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, জাতি, দেশ এসবের বেলায় এ সত্যের তারতম্য নেই। মোট কথা সভ্যতার প্রথম সোপানই হলো চিন্তা—চিন্তার অভ্যাস তথা বুদ্ধির চর্চা।
শুধু রসের দিক বা সৌন্দর্য সাধনার দিক যেমন সাহিত্যের সবকিছু নয়, তেমনি সভ্যতার বেলায়ও শুধু আনন্দ ও আরাম আয়েসের উপকরণ বাহুল্য কখনো সভ্যতার সবকিছু নয়। এমনকি সভ্যতার বড় অংশও নয় এসব। সভ্যতা বলতে আমরা যা বুঝি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্ক রয়েছে মানুষের হৃদয়, মন ও চরিত্রের আর মানসিক উৎকর্ষের। মাত্রাধিক আরাম ও উপকরণবাহুল্য এ সবকে দৃঢ় ও পুষ্ট করে তোলার পরিবর্তে বরং করে তোলে আরো শিথিল ও দুর্বল। আজ সভ্যতা মানে উপকরণ-প্রাচুর্য ও গতি। আধুনিক সভ্যতার বাহন হয়েছে এ দুই অপদেবতা। দ্রুতগামী বায়ুযানে কে কত হাজার মাইল ঘুরে এলো, কার আগে কে পৃথিবী চক্কর দিতে পারলো—এ হলো এখন সভ্যতার মাপকাঠি।
মানুষ ভাববে কখন, চিন্তা করবে কখন——জীবনের গভীরত্ব উপলব্ধির অবসর কোথায় আজ মানুষের? তাই আজ মানুষের জীবনে কোনো দর্শন নেই। নেই কোনো নীতিনিষ্ঠা ও চারিত্রিক সততা। ফলে মানুষের মন থেকে মানুষের সভ্যতা আজ আশ্রয়চ্যুত।
প্রাচীন জীবন-দর্শন থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন। অথচ নতুন কোনো জীবন- দর্শনও গড়ে ওঠেনি। সব জীবন-দর্শনের গোড়া হল চিন্তা-চিন্তার চর্চা। মানুষের জীবন থেকে আজ চিন্তার ক্ষেত্র অপসারিত–ফলে কোনো জীবন-দর্শনই আজ মানুষের সামনে নেই। সিনেমা, টেলিভশন-রেডিও, গ্রামোফোন যেখানে মানুষের অবসর সময়টুকুর অধিকাংশ গ্রাস করে চলেছে, সেখানে চিন্তা চর্চার সময় কোথায়? ফলে আজ ধীরে ধীরে, নিজের অজ্ঞাতেই মানুষ যন্ত্রের সামিল হয়ে পড়েছে। মানুষের এখন যা নিয়ে অধিকাংশ সময় কাটে তা হচ্ছে যন্ত্র ও যান্ত্রিকতা। একজন মনীষী বলেছেন: If you live too long with a machine, you being to grow like it. এ কারণেই মানুষ হয়ে পড়েছে আজ যান্ত্রিক। হৃদয়, মন, আবেগ, অনুভূতি সবই যন্ত্রের সুরে বাঁধা। আমি এমন পরিবারও দেখেছি যাঁরা এক ঘুমের সময় ছাড়া আর সব সময় নিজেদের রেডিও যন্ত্রটা খুলে রাখেন। নিস্তবদ্ধতার যে একটা অনির্বচনীয় শান্তি আছে এঁরা তার স্বাদ থেকে ত বঞ্চিত থাকেনই তদুপরি নিজেদের সুকুমার বৃত্তির উপর কি যে নিষ্করুণ উৎপীড়ন এঁরা করছেন তাও বুঝতে পারেন না। অতি-যান্ত্রিকতার এ হচ্ছে পরিণাম। এসব মানুষের জীবনের মহত্ত্ব সম্বন্ধে ভাববার বা অন্ন-চিন্তার অতিরিক্ত অন্য চিন্তা করবার অবসর কোথায়? ফলে জীবন-দর্শন সম্বন্ধে এঁদের কোনো মাথাব্যথা থাকার কথাই নয়। রেডিও বাজানোকেই এঁরা মনে করেন চরম সংস্কৃতিচর্চা। এ যুগের বিখ্যাত চিন্তাবিদ, মানবকল্যাণে উৎসর্গিত প্রাণ Albert Schweitzer বলেছেন: “With the spirit of the age I am in complete disagreement, because it is filled with disdain for thinking” চিন্তার প্রতি এই বিরাগ ও বিতৃষ্ণা মানব সমাজে এক মারাত্মক ব্যাধির রূপ নিয়েছে আজ। আজ সভ্যতার যে সংকট তা হচ্ছে এই চিন্তাহীনতার সংকট। আণবিক বোমা বা আনুষঙ্গিক অন্যান্য মারণাস্ত্র নয়। তথাকথিত ‘শীতলযুদ্ধ’ও এই চিন্ত াহীনতার ফল। জীবনের মূল্য ও মহত্ত্ব সম্বন্ধে ভাবতে ভুলে গিয়েছে আজ মানুষ। ফলে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবই প্রায় হয়ে পড়েছে নীতিভ্রষ্ট। বুদ্ধি ও চিন্তার চর্চা মানুষকে যুক্তিবাদী ও বিবেকী করে তোলে। যে-কোনো অবস্থায় বিবেকী মানুষ হিরোশিমা ও নাগাসাকি ঘটাতে পারে না। বিবেকহীন সভ্যতা মানুষকে বর্বরতার কোন চরম সীমায় নিয়ে গেছে—ইতিহাসের পৃষ্ঠায় এ দু’টি নাম তার অক্ষয় স্বাক্ষর। নীতি ও জীবনের মূল্যবোধ ছাড়া যান্ত্রিক সভ্যতা ও তার প্রগতি মানুষকে কোনো লক্ষ্যেই নিয়ে যায় না। চিন্তাহীনতার শোচনীয় পরিণাম সম্বন্ধে Schweitzer-এর মন্তব্য হচ্ছে: “Renunciation of thinking is a declaration of spiritual bankruptcy where there is no longer a conviction that men can get to know the truth by their own thinking, skepticism begins. Those who work to make our age skeptical in this way, do so in the expectation that as a result of denouncing all hope of self-discovered truth, men will end by accepting as truth what is forced upon them with authority and by propaganda.”
নীতি ও জীবনের মূল সম্বন্ধে অবিশ্বাসের চরম পরিচয় মেলে যুদ্ধ ও তথাকথিত জাতীয় সংকটের সময়। তখন নীতি, ন্যায়, ধর্ম, সত্য ও মূল্যবোধ সবই হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়া হয়। যান্ত্রিক সভ্যতার চরম কাম্য যে-কোনো মূল্যে জয় অর্জন। হিরোশিমা ও নাগাসাকি এই আদর্শেরই দুই বলি। চিন্তা করার বা চিন্তা করতে না দেওয়ার ফলে তাবৎ সভ্য দেশের অধিকাংশ লোক ‘কর্তার ইচ্ছার কর্ম’ বলে একে মেনে নিয়েছেন। নিজে চিন্তা না করার সবচেয়ে বড় কুফল হচ্ছে সত্য মিথ্যা যে-কোনো কথা ও প্রচারণাকে বিশ্বাস করে বসা, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন লোকের স্বার্থমূলক কথাকেও বেদবাক্য মনে করা। একনায়ক ও ডিক্টেটররা চিরকাল এ করে এসেছে—স্বাধীন চিন্তাকে তারা মনে করে তাদের স্বার্থের পরিপন্থী এবং তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। ক্ষমতার ঐ এক ধর্ম—ক্ষমতা সব সময় মাথার চেয়ে হাতের উপর আর হাতের থেকেও হাতের ডাণ্ডার উপর নির্ভর করে বেশি। এই ডাণ্ডার ভয়েই লোকে তাদের মিথ্যাকেও সত্য বলে মেনে নেয়। মেনে নেয় দিনকে রাত ও রাতকে দিন বলে। এজন্যই বোধ করি, ক্ষমতাসীন লোক সম্বন্ধে জালাল উদ্দিন রুমী এই মন্তব্য করেছেন: “এরা মানুষের কাঁধে বাহিত শবের মতো, আত্মার বিনিময়ে এরা ক্ষমতা লাভ করে গর্ববোধ করে।” যে মানুষ কিছুটা ভাবে, করে চিন্তার চর্চা, তার কাছে এরা যে খড়ের দেবতা তা ধরা পড়তে দেরি লাগে না। তাই জনসাধারণ বুদ্ধির চর্চা করুক, মাথা খাটাক এ ক্ষমতাসীন লোকেরা মোটেও চায় না। আর যান্ত্রিক সুখ-সুবিধায় অভ্যস্ত মানুষও মাথা খাটাবার কষ্ট স্বীকার করতে অনিচ্ছুক। তাই আজ সর্বত্র চিন্তার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে বন্ধ্যাত্ব, মানুষ হয়ে পড়েছে গতানুগতিক, হারিয়ে বসেছে সত্যের প্রতি সবরকম অনুরাগ! মানুষের জীবনে সত্য ও ন্যায়ের যে কোনো মূল্য আছে মানুষের মন থেকে সে বোধও আজ নিশ্চিহ্ন। যন্ত্র-জগতের যেমন দিনে দিনে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় বদল হচ্ছে—মানুষের মত, বিশ্বাস আর ধারণাও তেমনি দিনে দিনে ও ঘণ্টায় ঘণ্টায় পাল্টাচ্ছে। কোনো মত বা বিশ্বাসই আজ মানুষের মনে দানা বাঁধতে পারছে না। আজ সভ্যতার এই এক শোচনীয় দশা। এ অবস্থায় কোনো বড় ও উচ্চ জীবনদর্শন আশা করাই যায় না। আশা করা যায় না কোনো মহৎ শিল্প সাহিত্যও। রম্য রচনার সংখ্যা বৃদ্ধির এও এক বড় কারণ। বিগত সভ্যতা—যা মহৎ শিল্প সাহিত্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, এমন কি রেনেসাঁ ও এনসাইক্লোপিডিস্টদের যুগের দিকে তাকালেও আমরা বুঝতে পারবো, মত-বিশ্বাস-আদর্শ-নিষ্ঠা, যা চিন্তা চর্চারই ফল—সভ্যতার স্থিতি, বিকাশ ও সমৃদ্ধির জন্য কতখানি আবশ্যক। আধুনিক সভ্যতার পায়ের তলায় এই অত্যাবশ্যক শর্তগুলি অনুপস্থিত। ফলে আজ সভ্যতার ত্রিশঙ্কু দশা।
বর্তমান সভ্যতা কোনো গভীর ভাব ও চিন্তার উপর প্রতিষ্ঠিত নয় বলে, ক্রমবর্ধমান এত উন্নতি সত্ত্বেও পদে পদে ট্র্যাজিক পরিণতির হাত থেকে তা রেহাই পাচ্ছে না। আজ এই মহাসংকটের দিনে বাঁচতে হলে মানব- সভ্যতাকে একটা নীতি ও সত্যের উপর দাঁড় করাতে হবে। আর তা করাতে হলে মানুষকে ভাবতে হবে, করতে হবে চিন্তা ও যুক্তির চর্চা, হতে হবে বিবেকী।