প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রসঙ্গে 

ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাপ্রসঙ্গে 

এক

ধর্ম কথাটার মধ্যে একটা অসম্ভব মোহ রয়েছে। ফলে যে কোনো কিছুর সঙ্গে ধর্মকে তথা ধর্ম শব্দটাকে যখন জুড়ে দেওয়া হয় তখন তা হয়ে পড়ে স্রেফ আবেগের বিষয়। কোনো রকম যুক্তি-বিবেচনা তাতে আর ঠাঁই পায় না। এমন কি বুদ্ধি বা যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখার সাহসটুকুও যেন মানুষ তখন হারিয়ে বসে। কেউ কেউ তা করাকে মনে করে রীতিমতো বড় রকমের এক গুনাহ! যারা আরো এক ডিগ্রি বেশি গোঁড়া, তারা মনে করে স্রেফ নাস্তিকতা। বলা বাহুল্য, তারাই গোঁড়া, যারা বিচার-বিমুখ আর পরিচালিত হয় অন্ধ আবেগে। সামাজিক জীবনে এসব মানুষ অত্যন্ত বিপজ্জনক, কারণ, স্বভাবে এরা হয়ে থাকে চরম অসহিষ্ণু। ধর্মে পরমতসহিষ্ণুতার সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও এরা ধর্মের নামেই অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। পরমতসহিষ্ণুতা শুধু-যে সত্যিকারের ধর্ম-জীবনের লক্ষণ তা নয়, সভ্য-জীবনেরও এক প্রধান শর্ত, সমাজ-জীবনেরও বুনিয়াদ। এ ছাড়া সমাজ-জীবন দুদিনেই মগের মুল্লুক না হয়ে যায় না। আমাদের মতো অনুন্নত দেশে ধর্মের বুলি, ধর্মের ভেক আর বাহ্যিক ধার্মিকতার একটা জনপ্রিয় লোক-ভোলানো আবেদন রয়েছে। তাই মানুষ সহজে এ খপ্পরে না পড়ে পারে না, এ কারণে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের এ হয়ে পড়েছে এক মোক্ষম অস্ত্র। ফলে, ধর্ম এখন এদের হাতে সব রকম আধ্যাত্মিক আবেদন হারিয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি তথা রাজনৈতিক হাতিয়ার।

সম্প্রতি আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাসম্বন্ধে একচোট উত্তেজক আলোচনা হয়ে গেছে। এ আলোচনা ভবিষ্যতে আরো যে অধিকতর উত্তেজক হয়ে উঠবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, আমরা নাকি অতি বেশি ধর্মপ্রাণ জাতি। খাঁটি অর্থে আমরা কতখানি ধর্মপ্রাণ তা সঠিকভাবে বলার উপায় নেই, তবে ধর্মের নামে আমরা যে প্রাণ দিতে আর নিতে জানি তার দেদার নজির আমাদের ইতিহাসে রয়েছে। আজো সমাপ্তি ঘটে নি সে ইতিহাসের। 

.

কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করা যায় ধর্মের নামে এই যে আমরা প্রাণ দেওয়া-নেওয়া করেছি, সে। কার সঙ্গে? কোনো বিধর্মীর সঙ্গে কি? ইতিহাস বলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের সঙ্গেই। একদল মুসলমানের সঙ্গেই। ওপরে শিক্ষা নিয়ে যে-উত্তেজক আলোচনার কথা বলেছি তাতেও সীমিতভাবে প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঘটেছে এবং ঘটেছে নিজেদের মধ্যেই। যে ধর্মের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ভ্রাতৃত্ব-প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীদের হাতে সে ধর্ম হয়ে পড়েছে এখন ভ্রাতৃহননের হাতিয়ার! আশ্চর্য, আমাদের তথাকথিত ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা কিন্তু একবারও ভেবে কিংবা বিচার করে দেখে না যে, এতে কার কতটুকু ফায়দা হয়েছে। নিজের ধর্মের, নিজের দেশের, নিজের সমাজের, এমন কি ব্যক্তিগত পর্যায়েও কোনো লাভ হয়েছে কি কারো? বলেছি, তথাকথিত ধর্মপ্রাণরা স্বভাবতই বিচার-বিমুখ হয়ে থাকে। এসব সে বিচারবিমুখীনতারই শোচনীয় পরিণতি। না হয় সেই খোলাফা-এ-রাশেদিনের আমল থেকে ধর্মের নামে যে ভ্রাত হনন শুরু হয়েছে ইতিহাসের বিচিত্র পর্বে যা খারেজি-শিয়া-সুন্নি-ওহাবি-কাদিয়ানি-ফরায়েজি-লা-মজহাবি ইত্যাদি নানা নামে চিহ্নিত হয়ে বর্তমানে আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষতার বহছে এসে ঠেকেছে, তাতে একবিন্দু ফায়দাও আমি লক্ষ করি নি কোথাও। বরং লক্ষ করেছি এতে ইসলামের নাম হয়েছে কলঙ্কিত, মুসলমান হয়েছে দুর্বল, দ্বিধা-বিভক্ত আর খণ্ডিত; আর ধর্মের আসল উদ্দেশ্য হয়েছে পদে পদে ব্যর্থ। 

.

আমার ধারণা, ধর্ম এক অতি সহজ সরল ব্যাপার, তাতে কোনো রকম হেঁয়ালি কিংবা জটিলতার স্থান নেই। কথাগুলি অতি সোজা, অতি সুস্পষ্ট ও সহজে বোধগম্য। বিশ্বাস পোষণ আর তার আনুষঙ্গিক ধর্মীয় নির্দেশ–যেমন, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি পালনের মধ্যেই ধর্ম-জীবন সীমিত। এসব কোনো অর্থেই জটিল কিংবা দুর্বোধ্য নয়। এসবে মতভেদের তেমন অবসর আছে বলেও আমার মনে হয় না। ছেলেমেয়ে আর পোষ্যদের এসব শিক্ষা দেওয়া মুসলমান পরিবারের এক চিরকেলে রেওয়াজ। এখন সে রেওয়াজ যদি অধিকাংশ ক্ষেত্রে লজ্জিত হয়ে থাকে তার জন্য আধুনিক জীবন-সমস্যাই দায়ী–যে জীবনকে অস্বীকার করা এখন কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য, এ জীবন তথা আধুনিক জীবনের বেশির ভাগই জুড়ে আছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেওয়া সোজা, কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার ফল প্রত্যাখ্যান করা কারো পক্ষেই আজ সম্ভব নয়। এ কারণে দেখা যায়, জন-মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্যে মুখে যারা অহরহ ধর্মভিত্তিক শিক্ষার জিকির করে থাকেন ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজনের সময় তারাও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাজাত ফলগ্রহণে এতটুকু অরুচির পরিচয় দেন না। অত্যন্ত সোৎসাহে বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়া এখন ধর্মপ্রাণরাও ভোগ করে থাকেন। অথচ তারা খুব ভালো করেই জানেন ওই বস্তুটা মোটেও ধর্মভিত্তিক শিক্ষার ফল নয়। ওর সবটাই সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষারই ফলশ্রুতি। বাস্তব জীবনে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার নানা ফল ভোগ করা আর স্রেফ লোক ভোলানোর জন্যে মুখে ওই শিক্ষার বিরোধিতা করাকে ঠিক সাধু আচরণ বলা যায় না। এর নাম মানসিক সততা নয়। 

আমাদের যে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবিতে অতিমাত্রায় সোচ্চার কিছুদিন আগে সে প্রতিষ্ঠানের আমিরে আজম চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র লন্ডনে। লন্ডনে তার অপারেশন করেছেন ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষায় শিক্ষিত ডাক্তারেরাই, সেবা করেছেন ওই শিক্ষায় শিক্ষিত নার্সরাই। অধিকন্তু ওই নার্সরা যে বেপর্দায় চলে তাও সকলের জানা কথা। ওই সব ডাক্তার আর নার্সরা যে নিষিদ্ধ তথা হারাম আর পানীয়ও খেয়ে থাকে তাতেও বোধ করি সন্দেহ নেই। তবুও ধর্মভিত্তিক শিক্ষার এমন জেহাদি দাবিদারেরাও চিকিৎসার জন্য সেখানে গেলেন কেন? যান এ কারণে যে, তারাও মনে মনে জানেন, রাজনৈতিক উদ্দশ্য হাসিলের জন্য মুখে যাই বলা হোক না কেন, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা তথা সে শিক্ষাজাত ফল গ্রহণ না করে তাদেরও নিস্তার নেই। এসব রাজনৈতিক আলেমরা যদি জান বাঁচানো ফরজ এ ফতোয়ার দোহাই দিয়ে সেকুলারিজমের ফল গ্রহণকে জায়েজ মনে করেন, তা হলে তাঁদের ‘জেহাদি’ সংকল্পের চেহারাটাই তো অত্যন্ত করুণ হয়ে ওঠে। জেহাদি সঙ্কল্পের অর্থ তো প্রাণ যায় যাক। প্রাণের মায়ায় যদি সেকুলারিজমের তথা ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্যার আশ্রয় নিতেই হয় তাহলে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে সেকুলার তথা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা যে উকৃষ্টতর তা স্বীকার করে নেওয়া হয় না? ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার দাবি যারা করেন তাদেরও তো এ দাবি। আসলে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবিদারেরা ধর্মনিরপেক্ষতার বাসন থেকে গ্রাসটা তুলে হাতটাকে মাথার চারদিকে লন্ডন-প্যারিস ঘুরিয়ে এনে মুখে পুরেছেন মাত্র, আর ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা গ্রাসটি বাসন থেকে তুলে সরাসরি দিচ্ছেন মুখে। তফাতটা শুধু এখানে। না হয় এ রকম বহু নজির দিয়ে দেখানো যেতে পারে যে, ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবিদারেরা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাকে বাদ দিয়ে এ জীবনে এক পাও অগ্রসর হতে পারবেন না এবং পারছেন না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ইহলোকে বেঁচে থাকা, জীবনের বিকাশ সাধন করা। যে যুগে, যে দেশে জন্মগ্রহণ। করা গেছে সে যুগ আর সে দেশের চাহিদা, প্রয়োজন আর সমস্যার মোকাবেলা করে বেঁচে থাকা। স্রেফ ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা দ্বারা এ হওয়ার নয়। হলে নেজামে ইসলামের সম্পাদক নিজের ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে না পাঠিয়ে পাঠাতেন মাদ্রাসা আলিয়ায়। অক্সফোর্ড কেমব্রিজের পরিবেশ আর অধ্যয়ন-অধ্যাপনা সর্বতোভাবেই সেকুলার তবুও ওইখানে। শিক্ষা গ্রহণে সুযোগ পেলে আমাদের মৌলবি মওলানাদের ছেলেজামাইও দেখেছি কৃতার্থ বোধ করেন, এমন কি ওইসব ছেলে-জামাই এর বাপ-শ্বশুররাও মনে করেন যেন হাতে, চাঁদ পাওয়া গেল। এমনতর উৎসাহ নিয়ে এঁরা কখনো নিজের ছেলে কি জামাইকে শিক্ষার জন্য মক্কা-মদিনা কিংবা বাগদাদ-দামেস্ক বা মিসরে পাঠান না। দেশের উচ্চ মাদ্রাসাগুলিতে কি পাঠান? ধর্মভিত্তিক শিক্ষা যদি ভালো হয় তা ষোলআনাই ভালো এ কথা না মেনে উপায় নেই। সে ষোল আনা শিক্ষা আমাদের মক্তব-মাদ্রাসাগুলিতে আবহমানকাল ধরেই চলেছে। কিন্তু সে শিক্ষায় শিক্ষিতদের আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের কোথাও কোনো গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় কি? দেশের প্রশাসন-ক্ষেত্রে কোথাও তো তাদের স্থান। নেই, দেশরক্ষায় তারা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, আজাদী আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা ছিল কিঞ্চিতকর। মোটকথা, আধুনিক রাষ্ট্রীয় দাবি আর জীবনের মোকাবেলায় তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রমাণিত। বৃহত্তর সমাজেরও যে এ সত্য জানা নেই তা নয়, জানা আছে বলেই দেশের সেকুলার শিক্ষালয়ে তার সিকি পরিমাণ ভিড়ও দেখা যায় না। আজ শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা সেকুলার বিদ্যালয় আর সেকুলার বিষয়ে ভর্তির সমস্যা। প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ে ওইসব বিদ্যাকেন্দ্রে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে লেখাপড়াই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। চিকিৎসা আর প্রকৌশল ক্ষেত্রে অবস্থা আরো জটিল। অন্য দিকে ধর্মভিত্তিক শিক্ষা কেন্দ্র মাদ্রাসাগুলিতে অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে কোনো ছাত্র ভর্তির সুযোগ পায় না তেমন কোনো কথা আজো শোনা যায় না। 

দুই

আমাদের দেশ ধর্ম বা ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার সুযোগের কোনো অভাব আছে বলে মনে হয় না। মক্তব মাদ্রাসার কথা বাদ দিলেও নিউ স্কিম মাদ্রাসাগুলি রয়েছে, যেখানে ইংরেজি, বাংলা, অঙ্কের সাথে সাথে প্রচুর ধর্মশিক্ষারও ব্যবস্থা আছে। তবুও শোনা যায় সে সব মাদ্রাসায়ও এখন ছাত্র সংখ্যা দিন দিন কমে এসেছে। যে-কোনো ধরনের মাদ্রাসা আর সেকুলার হাই স্কুলের আর ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সঙ্গে সেক্যুলার। ইন্টারমিডিয়েট কলেজের তুলনা করে দেখলে এ সত্যটাই প্রকট হয় যে, দেশে ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার তেমন কোনো চাহিদা নেই। আমাদের প্রায় সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ম তথা ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। তার জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য সেকুলার বিভাগের সঙ্গে তুলনা করে দেখলেও দেখা যায়, ওই বিভাগে ছাত্রসংখ্যা অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে কম। 

সম্প্রতি ছাত্র ভর্তির প্রবল চাহিদা আর চাপ এড়াতে না পেরে বাধ্য হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিভাগে সিটের সংখ্যা কিছু কিছু বাড়িয়েছে। এ সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তিতে যে পরিসংখ্যান প্রকাশিত হয়েছে তা নিম্নরূপ: 

বিষয় –সিটের সাবেক সংখ্যা –এখন বাড়িয়ে যা করা হয়েছে

ইংরেজি – ৭৫ –৯০

বাংলা – ১০০ –১২০

অর্থনীতি – ১৫০ –১৬০

ইতিহাস – ৭৫ –৮৫

সমাজবিজ্ঞান – ৭৫ –৯০

দর্শন – ৬০–৮০

রাষ্ট্রবিজ্ঞান – ১৫০ –১৮০

বাণিজ্য – ১৫০ –১৭০

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক – ২৫ –৪০

মনস্তত্ত্ব – ৪০ –৪৫

ইসলামের ইতিহাস আর সংস্কৃতি – ৪০ –৬০

আরবি – ১৫ –২০

ইসলামিক স্টাডিজ – ২৫ –৬০

এসব বিষয়ে সিটের মোট সংখ্যা ছিল আগে ৮১৫, এখন বেড়ে তা হয়েছে ১১৭০। 

ইসলামের ইতিহাস আর সংস্কৃতিকে ঠিক ধর্ম-ভিত্তিক বিষয় বলা যায় না, বরং সার্বিক ইতিহাসের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য শাখা এটি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিষয়ের অধ্যাপক একজন হিন্দু। কাজেই আরবি আর ইসলামিক স্টাডিজকেই শুধু ধর্ম-ভিত্তিক বিদ্যা বলা চলে। এ দুই বিষয়ে সিটের সংখ্যাল্পতা কি প্রমাণ করে না যে, দেশে ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার তেমন চাহিদা নেই? থাকলে এ দুই বিষয়ের এমন শোচনীয় দশা ঘটতো না। শোনা যায়, এসব সিটের জন্যও তেমন কোনো প্রতিযোগিতা হয় না। অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়গুলিতে ভর্তির জন্য কী রকম প্রতিযোগিতা ঘটে, তা কারো অজানা নয়। স্থান আর প্রয়োজনীয় সংখ্যক অধ্যাপকের অভাবে প্রবল দাবি থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে সিট বাড়ানো সম্ভব হয় নি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে। বিজ্ঞান শুধু যে ধর্মনিরপেক্ষ তা নয়, বিজ্ঞানের বহু থিওরি আর মতবাদের সঙ্গেও ধর্মের রীতিমতো বিরোধ রয়েছে। তবুও ধর্ম বা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার চেয়ে বিজ্ঞানশিক্ষার চাহিদা দেশে অনেক বেশি। প্রতিবছর বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে বহু ছাত্র যে স্রেফ সিটের অভাবে ভর্তির সুযোগ পায় না, এ এক সার্বজনীন সত্য। দেশের ক্ষেত্রে এই তো বাস্তব অবস্থা। এ অবস্থায় ধর্মভিত্তিক শিক্ষার ধুয়া তুলে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত আর পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় কি? আশ্চর্য, চোখের সামনে সারা মধ্যপ্রাচ্যের শোচনীয় আর করুণ দশা দেখেও আমাদের একশ্রেণীর রাজনৈতিক নেতাদের চোখ খোলে না। একবারও এঁরা তাকিয়ে দেখেন না। বাস্তবের কঠিন মাটির দিকে, যে মাটিতে তারা পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথ যে একবার বলেছিলেন : ‘ধর্ম-মোহের চেয়ে নাস্তিকতা অনেক ভাল,’ মনে হয় কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। ধর্মান্ধতার চেয়ে বড় অন্ধতা আর নেই। চোখের অন্ধতা শুধুমাত্র দৃষ্টিশক্তিই হরণ করে, কিন্তু ধর্মান্ধতা হরণ করে বুদ্ধি-যুক্তি-বিচার-বিবেক আর সব রকম মূল্যবোধ। 

আরবদের মাতৃভাষা আরবি-কোরান-হাদিস, ফেকা-উসুল-তফসির ইত্যাদি যা কিছুকে এক কথায় ইসলামি ধর্ম-বিদ্যা বলা হয় তা সবই আরবিতে। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই আরবেরা এসবের সঙ্গে পরিচিত (এ সবকে বাদ দিয়ে ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা আর কাকে বলা হয় আমার জানা নেই। তবুও শ্রেষ্ঠ ধার্মিকের আদর্শ কি এ যুগের আরবরা? তা যদি হতো আমার বিশ্বাস তাদের অবস্থা কখনো এমন শোচনীয় হতো না। ক্ষুদ্র এক শক্তির হাতে তারা যে শুধু পদে পদে পরাজিত ও লাঞ্ছিত হচ্ছে তা নয় তাদের জীবনমানও এখন সর্বনিম্নস্তরে। এত নিম্নে যে, ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার দাবিদারেরাও দৈহিক আরোগ্যের জন্য যেমন তাদের কাছে যায় না তেমনি পাঠায় না নিজেদের ছেলেমেয়েকে মানসিক সম্পদ তথা জ্ঞান আহরণের জন্যও ওইসব দেশে। ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষার অভাবেই কি এ পরিণতি? মনে হয় না। বরং আধুনিক শিক্ষা আর সেই শিক্ষাজাত দৃষ্টিভঙ্গির অভাবেরই এ ফল। কোনো ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাই এ অধঃপতিত অবস্থা থেকে ওদের উদ্ধার করতে পারবে না। উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় মনেপ্রাণে আধুনিক শিক্ষাকে গ্রহণ করে সর্বতোভাবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান আর যন্ত্রবিদ্যাকে আয়ত্ব করা, পরমুখাপেক্ষিতা ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা। এ করা হলে, আমার বিশ্বাস, দশ কোটি মানুষ পৃথিবীতে আবারও অসাধ্য সাধন করতে পারে। তাদের চোখের সামনে ক্ষুদ্র ইসরাইল তার এক জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। জ্ঞানী শত্রুর কাছ থেকেও সব নিয়ে থাকে। আরবদেরও তা নেওয়া উচিত। ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার কোনো অভাব আরব দেশে নেই, ছিলও না ইসলামের আবির্ভাবের কাল থেকে। জামে আজহার নাকি প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় আর ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাই যে ওখানে দেওয়া হয় তাতে বোধ করি সন্দেহ নেই। তবুও সে-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তেমন কোনো কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারেন না। আরবদের এখন একমাত্র অভাব ধর্মনিরপেক্ষ তথা সেকুলার শিক্ষার। আমাদের দেশেও ধর্ম বা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার সুযোগের কিছুমাত্র অভাব নেই। অসংখ্য মক্তব-মাদ্রাসা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে, যাতে ধর্মীয় শিক্ষার দরাজ ব্যবস্থা রয়েছে। তদুপরি আমাদের প্রায় সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত ধর্মভিত্তিক তথা সব রকম ধর্মীয় বিদ্যা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা আছে। যারা ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবির সমর্থনে জান দেওয়া নেওয়ার হুমকি দিয়ে থাকেন, তাঁরাও কি এসব সুযোগের পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে থাকেন? করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সিট তথা ছাত্র পরিসংখ্যান এমন বিপরীত তথ্য পরিবেশন করতো না। 

তিন

ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা যারা চান তাদের কথা আর কাজে স্ববিরোধিতা দেখেই সবচেয়ে বেশি অবাক হতে হয়। আমার এক অধ্যাপক বন্ধুকে যিনি নিজে ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষা পেয়েছেন এবং ধর্মীয় বিষয়েই সারাজীবন অধ্যাপনা করেছেন–একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম: একজন বেনামাজি, ধর্মকর্মে সম্পূর্ণ উদাসীন এমন সি.এস.পি. যদি তোমার মেয়ের পাণিপ্রার্থী হয় তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে, না একজন নামাজি-কালামি পরহেজগার আলেম প্রার্থীর সঙ্গে দেবে? বন্ধুবর ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবিদার, তাই তাকে এমনতরো প্রশ্ন করা। শুনে অবাক হলাম, তিনি বিনা দ্বিধায় মুহূর্তে বলে ফেললেন, ‘সি.এস.পির সঙ্গেই দেবো।’ তিনি তার এক ছেলেকে পড়িয়েছেন অর্থনীতি, অন্য ছেলেকে বাণিজ্য, এক মেয়েকে বাংলা, অন্য মেয়েকে ইংরেজি। কোনো ছেলেমেয়েকেই ধর্মভিত্তিক শিক্ষা দেন নি, তেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান নি। মনে হয় এরা যে-ধর্মভিত্তিক শিক্ষা চান সে শুধু পরের ছেলের জন্যই, নিজের ছেলেমেয়ের জন্য নয়। যে শিক্ষাপদ্ধতি এঁরা নিজের ছেলেমেয়ের জন্য অকেজো আর অনাবশ্যক মনে করেন সে শিক্ষা-পদ্ধতি এরা দাবি করছেন পরের ছেলেমেয়েদের জন্য। আমার আপত্তি আর প্রতিবাদ এঁদের এ স্ববিরোধিতার প্রতিই, না হয় বিলাতে নাসারাদের মুলুকে অপারেশনের জন্য যাওয়া বা ক্যাডেট কলেজে ছেলেকে ভর্তি করানো কিংবা অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতির মতো ধর্মনিরপেক্ষ বিষয় অধ্যয়নে আমার কোনো আপত্তি তো নেইই বরং আন্তরিক সমর্থন আছে। এমন কি আমার স্পর্শবাদী অধ্যাপক বন্ধুটির সিদ্ধান্তকেও আমি স্বাগত জানাই। (বিশেষত এ কারণে যে, গলার সব জোর দিয়ে ধর্মভিত্তিক শিক্ষার দাবি করলেও তিনিও এ বাস্তব সত্যটুকু ভালো করেই জানেন যে, পরহেজগার আলেমের সাথে মেয়ের বিয়ে হলে মেয়েটির সারা জীবন একটিবার সিনেমা দেখার সুযোগ পাবে না। আর সি.এস.পি’র সঙ্গে বিয়ে হলে ইচ্ছা করলে বসে বসে বিনা পয়সায় রোজই তো দেখতে পারবে।) মোটকথা, মেয়ে-জামাই-এর পরকাল সম্বন্ধে তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা নেই, তার চিন্তা ওদের ইহজীবনের সুখ-সুবিধা নিয়েই। বলা বাহুল্য, ইহজীবনের সুখ-সুবিধারই তো এক নাম ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম। 

এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণীয়, ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা মানে ধর্মহীন শিক্ষা নয়। তা হলে সেকুলার দেশগুলিতে এত সব মহাপ্রাণ ধার্মিকের আবির্ভাব ঘটতো না। মানব কল্যাণে উৎসর্গিত-প্রাণ যত মানুষ ওইসব দেশে দেখা যায়, আমাদের মতো ধর্মপ্রাণ জাতিতে তার সিকি পরিমাণও তো দেখা যায় না। সেকুলার দেশেও ধর্ম আছে, ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হয়। ধর্ম ও ধর্মানুষ্ঠান পালিত হয়। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার যারা পক্ষপাতী তাদের একমাত্র দাবি তো ধর্ম-শিক্ষাকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বাধীনে না আনার। ধর্ম-শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলি চালু থাক, তার সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম স্তর পর্যন্ত অধ্যয়নের সুযোগ যেমন আছে তা অব্যাহত থাক তাতে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার পক্ষপাতীদের কিছুমাত্র আপত্তি নেই। আপত্তি শুধু রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতায়। ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই ধর্ম-শিক্ষাকে সব উন্নত দেশেই পারিবারিক আর বেসরকারি আয়ত্বে রাখা হয়। কারণ, ধর্ম আর রাষ্ট্রের ভূমিকায় যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এ পার্থক্য স্বীকার না করলে ধর্মই ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি। ধর্মের প্রধান কাজ মানুষকে পরলোকের অনন্ত জীবনের জন্য তৈরি করা। সে পথের হদিস বাতলানো। বলা বাহুল্য, পরলোকে বিশ্বাস না থাকলে ধর্মের আবেগ মুহূর্তে নিঃশেষিত। রাষ্ট্র সর্বতোভাবে ইহলৌকিক ব্যাপার। ইহলোকে মানুষের যে সীমিত জীবন, সে জীবনের প্রয়োজন মেটানো আর তার দায়িত্ব গ্রহণ আর পালনই রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য। মানুষের পারলৌকিক জীবনের ভার গ্রহণ কিংবা মানুষকে ধার্মিক বানানো কোনো অর্থেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়, বরং তা করতে গেলে ধর্মের সমূহ ক্ষতি না হয়ে যায় না। ধর্মীয় ব্যাপারে (ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাও এর অন্তর্গত) রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ মানে রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপ। আমার বিশ্বাস, কোনো। প্রকৃত ধার্মিকই তা কাম্য মনে করতে পারেন না। রাষ্ট্র আর রাষ্ট্র পরিচালকরা সব সময় রাষ্ট্রের এবং নিজেদের ইহলৌকিক স্বার্থের দিকে নজর রেখেই রাষ্ট্রীয় সব কিছু, শিক্ষা তো বটেই, পরিচালনা আর নিয়ন্ত্রণ যে করবে এবং করতে চাইবে এ প্রায় স্বতঃসিদ্ধ। সব দেশেই এ ঘটে, ঘটে চলেছে। এ কারণে অনেক সময় খাঁটি ধার্মিক আর শাস্ত্র পণ্ডিতেরা রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্র পরিচালক হতে চান না–এমন কি কেউ কেউ প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতেও যে অস্বীকার করছেন তেমন নজির ইসলামের ইতিহাসেও বিরল নয়।

রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যে শিক্ষা ব্যবস্থা তার প্রধান লক্ষ্যই থাকে উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করা, যে নাগরিক পারবে যথাযথ যোগ্যতার সাথে রাষ্ট্রের সব রকম দায়িত্ব গ্রহণ। আর পালন করতে। ধর্মীয় ব্যাপার সে দায়িত্বের আওতায় পড়ে না–সে দায়িত্ব পরিবার আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আর সংস্থার। ধর্ম মানুষের সর্বাপেক্ষা পবিত্রতম আর সর্বাপেক্ষা স্বাধীন এলাকা। রাষ্ট্রের, বিশেষ করে আধুনিক রাষ্ট্রের প্রবণতাই হলো সব ব্যাপারে নাক গলানো, মানুষের সব কিছুতেই হস্তক্ষেপ করা। ধর্মীয় ব্যাপারেও যদি রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ঘটে তা হলে ধর্মের পবিত্রতা আর স্বাধীনতা দুইই খর্বিত আর লঙ্ঘিত হবে। পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রই ধার্মিক তৈরির উদ্দেশ্যে শিক্ষাপদ্ধতি প্রণয়ন করে না–করতে চাইলে ও ফল সম্পূর্ণ বিপরীতই হবে। কারণ, রাষ্ট্র নিজের স্বার্থেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, চালাবে, প্রয়োজনমতো দোমড়াবে, মোচড়াবে। ধর্মের ঋজু-সারল্য তখন আর থাকবে না, হয়ে পড়বে তা রাজনৈতিক দাবা খেলার গুটি। 

তখন পরলোকমুখীনতা ছেড়ে ধর্মও হয়ে উঠবে ইহলোকমুখী আর ইহলোকমুখীনতা মানে সেকুলারিজম। এখন আমাদের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির যে দশা হয়েছে তখন ধর্ম-শিক্ষারও সে দশা হবে। জমায়াতে ইসলাম বা নেজামে ইসলাম এখন ধর্মের কথা যত না বলে তার চেয়ে অন্তত শতগুণ বেশি বলে নির্বাচনের কথা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতালাভের কথা। ওদের সর্বশক্তি এখন সেদিকেই নিয়োজিত। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের হাতে ধর্মের এ দুর্দশা না হয়ে যায় না। এ অবস্থায় ধর্মের যে আসল উদ্দেশ্য মানুষকে আল্লায় নিবেদিতপ্রাণ করে তোলা, সে ভূমিকা তখন আর থাকবে না। ধর্মকে তখন ইচ্ছামতো রাজনৈতিক তথা দুনিয়ালোভী উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হবে। তাই ধর্মের নামে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান করার আমি ঘোর বিরোধী–এমন কি মসজিদে, মিলাদে, ঈদের জমায়াতে আর যে কোন ধর্মসভায়ও রাজনৈতিক আলোচনা কিংবা রাজনীতি নিয়ে আসারও আমি পক্ষপাতী নই। 

ধর্মের একটা শাশ্বত ভূমিকা আছে। পারলৌকিক জীবনের প্রস্তুতি ছাড়াও মানুষের আত্মার বিকাশ সাধনও ধর্মের উদ্দেশ্য আর ভূমিকা। রাষ্ট্রের এলাকা এসবের বাইরে। পরলোক আর আত্মা নিয়ে রাষ্ট্র মাথা ঘামায় না। ঘামাতে গেলেই রাষ্ট্র আর ধর্ম দুইই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অধিকন্তু তখন ধর্মের সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরোধ নির্ঘাত আর একটা কারবালা ঘটাবে। ঐতিহাসিকদের অজানা নয়, আগের কারবালাটাও ঘটেছিল ধর্ম আর রাষ্ট্রশক্তির বিরোধের ফলেই। ধর্ম সনাতন, চিরন্তন আর অচল, রাষ্ট্র সচল, ক্ৰম-পরিবর্তনশীল, তাবত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয় রাষ্ট্রকে। এ ছাড়া আজকের দিনে রাষ্ট্রের পক্ষে অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব। এ কারণেই ‘ইসলামি’ নাম শিরে বহন করেও পাকিস্তানকে একদিকে কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের সঙ্গে, অন্য দিকে কাট্টা পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সাথে দোস্তি করে চলতে হচ্ছে। 

ধর্ম আর রাষ্ট্রের ভূমিকা যে সম্পূর্ণ আলাদা এ কথা ওপরেও একবার উল্লেখ করেছি। এ সত্যটা অনেক সময় ভুলে থাকা হয় বলে এ দুইকে মিলিয়ে এক বিভ্রান্তিকর অবস্থা ডেকে আনা হয় আমাদের দেশে। ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা নিয়ে যে বিতর্ক, তাও এ বিভ্রান্তিরই নতিজা। ধর্ম যদি মানুষের মনে আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার আর পারলৌকিক জীবনের নির্দেশকের ভূমিকা ছেড়ে রাষ্ট্রের মতো এক স্কুল জাগতিক তথা সেকুলার বিষয়ে জড়িয়ে পড়ে আর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নেয় তাহলে ধর্ম স্বধর্মচ্যুত না হয়ে পারে না। সে সঙ্গে রাষ্ট্রও হবে ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ, রাষ্ট্র তখন তার চলিষ্ণুতা হারাতে বাধ্য হবে। সময়ের সঙ্গে তাল রেখে নীতি নির্ধারণ তখন অসম্ভব হয়ে পড়বে রাষ্ট্রের পক্ষে। রাষ্ট্রের স্বার্থে ধর্মীয় নির্দেশ যুগের প্রয়োজন মেনে চলবে না কোনোদিন। অন্যদিকে রাষ্ট্রকে হতে হয় যুগোপযোগী। ফলে ছোট ছোট ব্যাপারেও তখন দেখা দেবে বহু তর্কযুদ্ধ–অহিংসায় যার সমাপ্তি ঘটবে না কোনো দিনই। পাক-সৈন্যদের প্যান্ট হাফ হবে কি ফুল হবে, য়ুরোপীয় হ্যাটের অনুকরণে তৈরি হেলমেট পরা আমাদের পুলিশের পক্ষে জায়েজ কিনা ইত্যাদি হাজারো বছরের দরজা তখন খুলে দেওয়া হবে, যা প্যানডোরার বাক্সকেও হার মানাবে!

ধর্ম এক নয়, বহু। আবার প্রতি ধর্মের রয়েছে হাজারো ফেরকা। ইসলামও তার ব্যতিক্রম নয়। এক এক ধর্ম এক এক বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য। রাষ্ট্র কিন্তু তা নয়, দেশের ভৌগোলিক সীমার অন্তর্গত সব সম্প্রদায় আর সব মানুষের জন্যই রাষ্ট্র। এমন কি ধর্মহীন অবিশ্বাসীর জন্যও; ধার্মিকরা যাদের ‘কাফের’ বলে তাদের জন্যও। নাস্তিককে রাষ্ট্র অস্বীকার করতে কিংবা কুফরি কি নাস্তিকতার অভিযোগে পারে না দণ্ড দিতে। ধর্ম কিন্তু পারে, দিয়ে থাকে দণ্ড। ধর্ম অবিশ্বাসীকে ইহলোকে একঘরে করতে পারে আর পরকালের জন্য পারে নরকের ব্যবস্থা করে দিতে। রাষ্ট্র এ ধরনের কিছুই পারে না করতে, করলে ওই দেশ রাষ্ট্র নামের যোগ্যতাই হারাবে। আমার বিশ্বাস, ধর্ম দিয়ে রাষ্ট্রের আর রাষ্ট্র দিয়ে ধর্মের কাজ কখনো পুরোপুরি চলতে পারে না। চালাতে গেলেই বিরোধ আর সংঘর্ষ অনিবার্য। স্রেফ মুসলিম রাষ্ট্রেও এ সম্ভব নয়। কারণ, মুসলমানদের মধ্যেও ফেরকার কোনো অন্ত নেই। শিয়া, সুন্নি, আহমদি, কাদিয়ানি, ওহাবি-মজহাবি লামজহাবি ইত্যাদি ফেরকার কোনো সীমা নেই। ধর্মীয় ব্যাপারে সব ফেরকারই ধ্যান ধারণা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস আলাদা। ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষার নামে প্যানডোরার বাক্সেরও মুখ খুলে দেওয়া হলে প্রথম সমস্যাই দেখা দেবে কোন ফেরকার বিশ্বাস আর আকিদা অনুসারে পাঠ্যসূচি তৈরি করা হবে? রাষ্ট্র স্রেফ সংখ্যার দাবিতে কারো ধর্মীয় দাবি অস্বীকার করতে পারে না। শুধু কোরান-হাদিসের দোহাই দিয়েও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, কোরান-হাদিসের ভাষ্য আর ব্যাখ্যা নিয়েই তো ফেরকার উৎপত্তি। মোটকথা, ধর্ম-ভিত্তিক শিক্ষাকে সব দেশের মতো আমাদের দেশেও বেসরকারি পর্যায়ে বেসরকারি নিয়ন্ত্রণেই রাখতে হবে। ধর্ম-শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ আমার মতে কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নয়। তাতে সমস্যা আরো জটিল হয়ে দাঁড়াবে। এ বিতর্কের সূচনায় যে-বিরোধ আর সংঘর্ষ দেখা গেছে তা আরো বৃদ্ধি পাবে। আর এ বিরোধ আর সংঘর্ষ ঘটবে মুসলমানে মুসলমানে, পাকিস্তানিতে পাকিস্তানিতে। 

[‘ধর্মভিত্তিক বনাম ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধটি গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৭০-এ সমকালীন চিন্তা গ্রন্থে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *