প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

সাহিত্য ও সাহিত্যিক 

সাহিত্য ও সাহিত্যিক 

সাহিত্য এক পুরোনো ব্যাপার। মানুষ যখন থেকে মানুষ হয়ে উঠেছে অর্থাৎ ভাবতে আর অনুভব করতে শিখেছে তখন থেকেই সাহিত্যের সূচনা। সংক্ষেপে সাহিত্য ভাব আর অনুভূতির প্রকাশ। প্রকাশ সাহিত্যের অপরিহার্য শর্ত। সব মানুষই অল্পবিস্তর ভাবতে আর অনুভব করতে পারে কিন্তু প্রকাশ করতে পারে লাখে এক। এখানেই সাহিত্যিকের অনন্যতা। ভাব আর অনুভূতি প্রকাশিত হয়ে দেখা না দিলে সাহিত্য হয় না। তাই উপহাসের বেশি নীরব কবি’ কথাটার কোন মূল্য নেই।

মাটির নিচে অজস্র ফল্গুধারার অস্তিত্ব ভূতত্ত্ববিদদের স্বীকৃতি পেয়েছে; কিন্তু সব ধারা নদী হয়ে, ঝরনা হয়ে কিংবা সমুদ্রের রূপ নিয়ে বেরিয়ে আসে না। যে সব স্রোত নিজের দুর্বার গতিতে মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসে স্রেফ সেগুলোই রূপ নেয় নদী, ঝরনা আর সমুদ্রের। বাদবাকি হারিয়ে যায় মাটির নিচে। 

ভাব বা অনুভূতির বেলায়ও এ কথা–যার মনে কোনো চিন্তা বা অনুভূতি দুর্বার হয়ে ওঠে, প্রকাশের জন্য করে আকুলি-ব্যাকুলি সেই হয় সাহিত্যিক, অর্থাৎ সে খুঁজে নেয় বা খুঁজে পায় নিজের প্রকাশের মাধ্যম। অবশ্য কৃত্রিমতা সব ক্ষেত্রেই আছে–সাহিত্যেও দেদার। স্রেফ লেখক হওয়ার জন্যও অনেকে লেখে–হয়তো মনের ভেতর। আন্তরিক কোনো অনুভূতির সঞ্চার হয় নি, কোনো ভাবই মনের ভেতর হয়ে ওঠে নি। দুর্বার, তবুও লিখতে চায় কেউ কেউ, লেখেও হরহামেশাই। এমন লেখাকে স্রেফ কাগজের ফুলের সঙ্গেই দেওয়া যায় তুলনা। বাগানের পুষ্পসভায় যেমন কাগজের ফুলের কোনো স্থান নেই, তেমনি সাহিত্যের শাহি দরবারেও স্থান নেই আন্তরিকতাহীন কৃত্রিম রচনার। আন্তরিক ও হৃদয়-উৎসারিত রচনা আমাদের বর্তমান সাহিত্যে বিরল বললেই চলে। এর জন্য বহুতর কারণ যে রয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। সামাজিক, অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক–অন্য সব মানুষের মতো লেখকদের জীবনও এ তিন সূত্রে বাঁধা–এ তিনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সামাজিক জীব বলেই এ তিনের বন্ধন অস্বীকার করা লেখকেরও সাধ্যাতীত। 

এককালে যখন শিল্পী-লেখকরা রাজা-বাদশা কি ভূস্বামীদের পোষ্য ছিল তখন লেখা হয়তো পণ্য ছিল না, এখন অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত–অন্য দশটা পণ্যের মতো এখন লেখাও একটি পণ্য মাত্র। লেখকরাও পণ্যোৎপাদনকারী। এ পণ্যের ওপরই নির্ভর করে তার জীবিকা আর সামাজিক সত্তা। ফলে স্বভাবতই চাহিদা আর সরবরাহের supply and demand এর কথা এসে পড়ে। আমি অন্য এক প্রবন্ধেও বলেছি, সাহিত্যের উত্তৰ্ষ, প্রকরণ আর বিষয়বস্তুও তাই চাহিদার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সমাজে যদি সৎ, আন্তরিক ও উচ্চ চিন্তার কদর থাকে লেখার মান আর গতিও সেভাবেই মোড় নেবে আর সমাজ যদি হালকা কৃত্রিম সিনেমাধর্মী রহস্য-রচনারই অনুরাগী হয়ে ওঠে সাহিত্যেরও প্রধান প্রবণতা তা না হয়ে পারে না।

সমাজ সাহিত্য গড়ে না সাহিত্য সমাজ গড়ে–কার আগে কে? মুরগি আগে না ডিম আগে? এ প্রশ্নের মতো এও এক অবান্তর প্রশ্ন। কারণ, আমরা জানি মুরগি আর ডিমের অস্তিত্ব যুগপৎ–তেমনি সমাজ আর সাহিত্যের বেলায়ও তা সত্য। সামাজিক উন্নতি সার্বিক না হলে তা কখনো পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না আর সার্বিক উন্নতির আওতায় সাহিত্য-শিল্পেরও রয়েছে এক প্রধান স্থান। সাহিত্য আর সমাজের অগ্রগতিও তাই যুগপৎ হতেই হবে। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা অচল। এই দুই একে অন্যের পরিপূরক। তাই উন্নত দেশে অনুন্নত সাহিত্য বা অনুন্নত দেশে উন্নত সাহিত্য আশা করা যায় না। জৈবিক আর মানবিক এই দুই সত্তা নিয়েই ব্যক্তি–এ দুই সত্তা নিয়েই সমাজ, এ দুয়ের উন্নতির নামই সার্বিক উন্নতি। আমাদের সামাজিক উন্নতির গতি সার্বিক নয় বলেই জীবনে ও সমাজে আমরা পদে পদে ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমাদের দালান-কোঠা, বিশ্ববিদ্যালয় আর কারখানার চিমনি ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে বটে কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রে সমতালে তেমন কোন ঊর্ধ্বগতি কোথাও লক্ষিত হচ্ছে না। সমাজে উচ্চ চিন্তার চাহিদা থাকলে অবস্থা এমন হওয়ার কথা নয়। 

সৎ ও আন্তরিক চিন্তা, যে চিন্তায় লেখকের আস্থা আর প্রত্যয় রয়েছে তার মূল্য সাহিত্য-শিল্পে অপরিমেয়। সাহিত্য-শিল্পের মূল্য আর আবেদনও এ কারণে। আমাদের সাম্প্রতিক রচনায় তা অনেকখানি দুষ্প্রাপ্য হয়ে এসেছে। চিন্তার সততাই লেখককে দিয়ে থাকে সত্য-কথনের দুর্বার সাহস। মহৎ সাহিত্যের প্রাণ এ সত্য–এ সত্যের ফলেই সমাজ হয় কলুষমুক্ত। লেখায় সত্যের প্রতিফলন না ঘটলে সাহিত্য স্বধর্মচ্যুত হতে বাধ্য। আমার আশঙ্কা, আমরা যেন কতকটা স্বধর্মচ্যুত হয়ে পড়ছি। বিজ্ঞানের অভিনব আর নিত্য-নতুন আবিষ্কার সাহিত্যের সামনে খুলে দিয়েছে নতুন দিগন্ত। তাই বিজ্ঞানকে অস্বীকার করারও উপায় নেই আজ সাহিত্যের। বিজ্ঞান আজ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অঙ্গ। তাই বিজ্ঞান-বিমুখ সাহিত্যের জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে পদে পদে। জীবন নিয়ে আর জীবনের জন্যই সাহিত্য–তাই সাহিত্য জীবন ভিত্তিক হওয়া চাই।

জীবনের বিধিবিধান আর তার সূত্র আবিষ্কারের দায়িত্ব বিজ্ঞানের–এ সবকে অস্বীকার করে চলা কোনো সাহিত্যিকের পক্ষেই সম্ভব নয় এবং উচিতও নয়। কারণ এ তাকে বাঁচার পথ ও পাথেয়র সন্ধান দেয়। সন্ধান দেয় বাস্তবধর্মিতার। আধুনিক সাহিত্যের এক বড় মাপকাঠি রচনার বাস্তবধর্মিতার। বিজ্ঞান যেমন বাঁচার পথ বাতলায় তেমনি সাহিত্য জোগায় বাঁচার আনন্দ। সাহিত্যিক বা পাঠক কারো পক্ষেই এ দুয়ের একটাকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। 

সাহিত্য বা শিল্প জীবনের তথা অস্তিত্বের যা আনন্দ তাকেই জাগিয়ে তোলে, বহন। করে বাঁচার সুখ, জীবনকে করে তোলে আকর্ষণীয়। স্নেহে-ভালোবাসায়, প্রেম-প্রীতিতে যে একটা অনির্বচনীয় আবেগী মূল্য রয়েছে, সাহিত্য আমাদের সে সম্পর্কে সচেতন করে তোলে–মনুষ্যত্বের একটা অদৃশ্য অন্তর্জগৎ আমাদের অহরহ ঘিরে রয়েছে–যা না থাকলে মানুষ হিসেবে আমাদের জীবন ব্যর্থ হতো। মানুষের অন্তর্জগতের উদ্ঘাটন সাহিত্যের প্রতিদিনের দায়িত্ব। ক্রমবর্ধমান যান্ত্রিকতার চাপে মানুষের অন্তর্জগৎ আজ অনেকখানি চাপা পড়ে যাচ্ছে অর্থাৎ হৃদয়ের ব্যাপারে আমরা হয়ে যাচ্ছি যান্ত্রিক। তাই সাহিত্য আর সাহিত্যিকের দায়িত্বও গেছে বেড়ে–আজ লেখক ও শিল্পীকে অধিকতর হৃদয়ধর্মী আর বিবেকী হতে হবে। 

মানবতার এক নীরব কণ্ঠস্বর আছে–সাহিত্য আমাদের তা শোনায়। এ কণ্ঠস্বর আদিমকাল থেকে বর্তমানের পথ বেয়ে ভবিষ্যতের দিকে বয়ে চলেছে। এর গতি প্রবাহ অব্যাহত রাখার দায়িত্ব শিল্পীর–সাহিত্যিকের। এ প্রসঙ্গে বোরিস পাস্তেরনাকের এ কয়টি লাইন স্মরণীয় : 

‘Artist, be ever watchful
Lest sleep should close your eyes,
You are eternity’s hostage
In bound to time that flies.’ 

[‘সাহিত্য ও সাহিত্যিক’ প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় (ডিসেম্বর ১৯৬৬)। পরে এটি সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *