প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

সাহিত্যের উপকরণ

সাহিত্যের উপকরণ

জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব কিছুই সাহিত্যের উপকরণ–মানুষের চেতনা, অনুভব আর কৌতূহলকে যা স্পর্শ করে সে সবকেই সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ হয়তো একটা শিথিল ঢালা কথা। কারণ যে কোন উপকরণ সাহিত্যে ব্যবহারোপযোগী হয়ে উঠতে মাঝখানে আরো বহু স্তর পার হয়ে আসতে হয়। জীবন, জীবনের ঘটনা আর অভিজ্ঞতা–এ সব স্রেফ কাঁচা মাল। অন্য কাঁচা মাল যেভাবে পণ্য বা বস্তু হয়ে ওঠে, এসবও সেভাবেই সাহিত্যের সামগ্রী হয়ে ওঠে। অন্য কাঁচামালের যে রূপান্তর, এক স্তর থেকে অন্য স্তরে উত্তরণ যা পুরোপুরি ব্যবহারিক তথা যান্ত্রিক বলে চাক্ষুষ আর সর্বজনদৃশ্য এবং সেভাবেই তা গ্রাহ্য। গো চর্মটা কী করে নানা স্তর পার হয়ে জুতো হয়ে ওঠে অথবা সবুজ পাট কী করে কার্পেটে রূপান্তরিত হয় তার সব প্রক্রিয়াই চোখে দেখা যায়, অবিশ্বাস কি অনুমানের অবসর তাতে নেই। তা নিয়ে তাই বিতর্কও ঘটে না। 

কিন্তু সাহিত্য বস্তুটা এভাবে তৈরি হয় না আর ওটা বাহ্যিক বা ব্যবহারিক নয়। মোটেও। বাহ্যিক ঘটনা উপকরণ জোগায় সত্য কিন্তু সাহিত্যে রূপান্তরিত হওয়ার আগে তার যা কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তা সম্পূর্ণভাবে মানসিক তথা আভ্যন্তরিক–যেখানে চক্ষু-কর্ণের প্রবেশ নিষেধ। এ কারণে সাহিত্যের উপকরণ কথাটায় জটিলতা যেমন আছে তেমনি বিভ্রান্তি ঘটারও সুযোগ রয়েছে অনেক বেশি ঘটেও প্রচুর। তাই অনেক সময় ঘটনার নিখুঁত বর্ণনাকেও অনেকে সৎ-সাহিত্য বলে অভিহিত করে থাকেন। কবি থেকে সাংবাদিক বা শিল্পী থেকে ফটোগ্রাফার যে বর্ণনায় আর চিত্রণে সুদক্ষ তাতে সন্দেহ নেই–তাই বলে সাংবাদিকের নিখুঁত বর্ণনাকে বা ফটোগ্রাফারের নিপুণভাবে ভোলা ছবিকে কেউ সাহিত্য কি শিল্পের মর্যাদা দেবে না। যে মানসিক ক্রিয়ায় ঘটনা বা কোন বিশেষ অনুভব সাহিত্য আর শিল্প হয়ে ওঠে তার স্পর্শ ঐ সবে লাগে নি বলে ঐ সব অবিকল বা তার বেশি হতে পারে নি। এই বেশি হওয়াটাই মানসিক ক্রিয়া, এজন্যই শিল্পকে জীবনের চেয়ে বৃহত্তর (Larger than life) বলা হয়। যা আছে বা যা ঘটেছে। তার চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার নামই সাহিত্য বা শিল্প। এ কথাটাই রবীন্দ্রনাথ আরো সুন্দর করে বলেছেন তাঁর ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় : 

‘সেই সত্য, যা রচিবে তুমি 
ঘটে যা তা সব সত্য নহে।’

অর্থাৎ সাহিত্যের সত্য আর ব্যবহারিক সত্য এক নয়। ব্যবহারিক বাস্তবে আর সাহিত্যের বাস্তবে দুস্তর ব্যবধান রয়েছে–শিল্পী-সাহিত্যিকের এ জ্ঞানটুকু অত্যাবশ্যক। 

স্রেফ তাকানো নয়, সত্যিকার অর্থে দেখা সব ঘটনাই হয়তো সাহিত্যের উপকরণ হতে পারে, কিন্তু তা হয় লেখকের কল্পনা আর অভিজ্ঞতার জারক রসে জারিত হয়ে। এ ভাবেই তা সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে বিকশিত হয়ে ওঠে। লেখকের জন্য চিন্তাও একটা বড় শর্ত, তবুও সাহিত্য-শিল্প শুধু চিন্তার ফল নয়। চিন্তা যুক্তির পথে শিল্পের সিদ্ধান্ত আর রূপকল্পকে গড়ে তোলে বটে কিন্তু তা জীবনমুখী আর জীবনের সঙ্গে সুসমঞ্জস কিনা তার যাচাই প্রয়োজন। অনুভূতির বেলায়ও এ সত্য–আবেগী ঘটনার অভিজ্ঞতা সহজেই শিল্পী মনকে আলোড়িত করে তোলে কিন্তু সুনিয়ন্ত্রিত চিন্তার সাহায্যে শিল্পীর জাগ্রত অনুভূতি অভিজ্ঞতার সাথে একাত্ম না হলে শিল্প-বস্তু গড়ে ওঠে না। তা-ই সাহিত্য শিল্পীর মানস ক্রিয়ার এক অত্যাবশ্যক অনুষঙ্গ চিন্তা–সুনিয়ন্ত্রিত চিন্তা। জীবনে অনেক ঘটনাই ঘটে–ঘটে নিজের জীবনে, পরের জীবনে, নিজের মানস অভিজ্ঞতার দিগন্তে। কিন্তু সব ঘটনা মনে দাগ কাটে না। যে ঘটনা বা অভিজ্ঞতা মনের গভীরে দাগ কাটে না অর্থাৎ গভীরভাবে কোনো নাড়া দেয় না, তা নিয়েও ভালো সাহিত্য রচিত হতে পারে না। ভাসমান ঘটনাস্রোত সাহিত্যের উপকরণ হতে পারে না কিছুতেই–মনের গভীরে তার অনুপ্রবেশ অত্যাবশ্যক। সব বড় সাহিত্যকর্মই গভীর অনুভূতির ফল। বাস্তব জীবনের মোকাবেলার সঙ্গে সঙ্গে, দেখা যায়, অনেকের আবেগ-অনুভূতি কমে আসে, নিস্তেজ হয়ে পড়ে, হারিয়ে বসে ধার ও তীক্ষ্ণতা–মনের এমন অবস্থায়ও উঁচু দরের সাহিত্য রচনা সম্ভব নয়। জীবনের সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতা যতই বাড়ক, সে অভিজ্ঞতা যদি মনে সাড়া না জাগায়, তীব্রভাবে গভীরভাবে শিল্পী-মনকে নাড়া না দেয়, তা হলে অভিজ্ঞতা বা মহৎ উপকরণও কোন কাজেই আসবে না। সে সব উপকরণ শিল্পী-মনের বাইরের দরজা থেকেই করবে বিদায় গ্রহণ। পারবে না অন্তর্লোকে প্রবেশ করতে। অথচ এ অন্তর্লোকই সৃষ্টি করে সাহিত্য ও শিল্প। এ কারণেই সবাই শিক্ষিত হতে পারলেও সবাই লেখক হতে পারে না–লেখক হয় কেউ কেউ। সত্যিকার সাহিত্যিক বা শিল্পীর সংখ্যা সব দেশে সীমিত হওয়ার এটাই কারণ। আবেগ জাগ্রত থাকলেই মনের কৌতূহলও জাগ্রত থাকে–কৌতূহল মরে গেলেও সাহিত্য হওয়ার কথা নয়। কৌতূহলের বশেই মানুষ জানতে চায়–নিজের ও পরের তথা সব জীবনের সব কিছু, প্রকৃতির দিকেও তখন টান থাকে অব্যাহত। এ জানাই অভিজ্ঞতা হয়ে মনের গভীরে স্থান গ্রহণ করে, পরে দেখা দেয় সাহিত্যের উপকরণ হয়ে। এমন কি দূর অতীতের অভিজ্ঞতাও এভাবে সাহিত্যের উপকরণ হয়ে ওঠে। লেখকের জন্য স্মৃতি এক অফুরন্ত ভাণ্ডার–এ ভাণ্ডারেই সঞ্চিত থাকে সাহিত্যের উপকরণ। বলা বাহুল্য, গভীর ভাবে যা মনে দাগ কাটে বা অনুভূতিতে গভীর অনুরণনের সঞ্চার করে, মনের ভাণ্ডারে তাই সঞ্চিত হয়, অন্যগুলি হয় পরিত্যক্ত অর্থাৎ চিরতরে হারিয়ে যায় স্মৃতি থেকে। কৌতূহলই জীবনের রহস্য সন্ধানে শিল্পীকে নিয়ে যায় অভিজ্ঞতার এক স্তর থেকে অন্য স্তরে, মানস-ক্রিয়ার এক বৃত্ত থেকে অন্য বৃত্তে। মনের কৌতূহল জাগ্রত রাখা সম্বন্ধে যে কথা বলেছি সে সম্পর্কে একটি ঘটনা মনে পড়ছে। ঘটনাটি নজরুল ইসলামের মুখেই শোনা। কোনো এক সাহিত্য সভা উপলক্ষে একবার শরৎচন্দ্র আর নজরুল নাকি ট্রেনে করে কোথায় যাচ্ছিলেন এক সঙ্গে। দুজনে পাশাপাশি ট্রেনের জানালার ধারে বসেছেন। কোনো এক স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছতেই ট্রেনের গতি যথারীতি মন্থর হয়ে এলে তারা দেখলেন রেল রাস্তার পাশের চলতি পথ ধরে একদল মেয়ে বেশ সেজেগুজে কোথায় যেন চলেছে। শরৎচন্দ্র একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন, নজরুল কিন্তু তাকিয়েই রইলেন মেয়েদের চলমান সারির দিকে। কিছুক্ষণ পর শরৎচন্দ্র নজরুলকে বললেন : ‘আমি আর সাহিত্য করতে পারবো না, কারণ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের কৌতূহল মরে গেছে। তুমি এখনো তরুণ, তোমার কৌতূহল পুরোপুরি জাগ্রত, তুমি আরো বহুদিন লিখতে পারবে। এ কৌতূহলটাকে বাঁচিয়ে রেখো। বলা বাহুল্য তখন শরৎচন্দ্র বার্ধক্যে পা দিয়েছেন আর নজরুল যৌবন-মধ্যাহ্নে। কৌতূহল মানে স্রেফ নারী সম্বন্ধে কি পুরুষ সম্বন্ধে কৌতূহল নয়–জীবনের সব ব্যাপারে, সব কিছু সম্বন্ধেই কৌতূহল। 

[‘সাহিত্যের উপকরণ’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *