প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

সমালোচনা 

সমালোচনা 

আমাদের সাহিত্যের সমালোচনা শাখা অত্যন্ত দরিদ্র, দুর্বল আর অবৈজ্ঞানিক। সাহিত্য ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দুর্বলতা–বিচারবিমুখীনতাও এ সামগ্রিক দুর্বলতারই হয়তো আনুষঙ্গিক। এর পেছনে সঙ্গত কারণ নিশ্চয় আছে। সমালোচনায় আমাদের দেশে শুধু যে বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে তা শত্রুতায়ও হয় পরিণত। লেখকদের পক্ষে শুক্র বাড়াতে না চাওয়া খুবই স্বাভাবিক। তাই সমালোচনার ক্ষেত্রে ‘সাপও মরুক লাঠিও না ভাঙুক’ এ নীতিই আমরা অনুসরণ করে থাকি। এতে সমালোচনার আসল উদ্দেশ্য যায় ব্যর্থ হয়ে। 

সমালোচনা সাহিত্য-পত্রিকার এক বিশেষ অংশ হওয়া উচিত–দুঃখের বিষয় আমাদের কোনো পত্রিকাই সচেতন দায়িত্ববোধের সাথে এ কর্তব্য পুরোপুরি পালন করছে না। হয়তো ইচ্ছা থাকলেও পারছে না পালন করতে। পরিমিত ও গণা লেখকের ওপর নির্ভর করে যেখানে পত্রিকা চালু রাখতে হয় সেখানে স্বভাবতই সম্পাদকরা লেখক হারাতে চায় না। নিয়মিত সমালোচনা বিভাগ চালানোর পথে এও হয়তো এক অন্তরায়। দ্বিতীয়ত, উপযুক্ত সমালোচকের অভাব। প্রচার-প্রকাশের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নতুন নতুন লেখক তৈরি যেমন সম্পাদকের এক দায়িত্ব তেমনি সমালোচক তৈরির দায়িত্বও তার। দায়িতু কথাটা এখানে সাধারণ অর্থে অর্থাৎ সুযোগ-সুবিধা ও তাগাদা দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া অর্থেই ব্যবহার হলো। না হয় আমি জানি–অন্তরে সাহিত্যের অসীম প্রেরণা আর শিল্পের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধ না থাকলে কারো পক্ষে সত্যিকার অর্থে লেখক বা সমালোচক হওয়া যায় না। বলা বাহুল্য, সমালোচনাও এক রকম সৃষ্টি। সৃষ্টি কথাটাও শুধু যে বিভ্রান্তিকর তা নয়, তার পরিধি-ব্যাপ্তিও অসীম। বহু নামকরা ও অসন্দিগ্ধ সাহিত্য-স্রষ্টাও যে দেদার সমালোচনা লিখেছেন তা নিরর্থক নয়। তাঁদের সৃষ্টি-প্রেরণাও মাঝে মাঝে সমালোচনায় খুঁজেছে মুক্তি। এমন খাঁটি স্রষ্টা খুব কমই আছেন যিনি সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনায়ও হাত দেন নি। এ যুগে রবীন্দ্রনাথ, টি.এস, ইলিয়ট তার সাক্ষাৎ নজির। 

সৃষ্টি আর সমালোচনা হাত ধরাধরি করে না চললে সাহিত্য কিছুতেই সমৃদ্ধ হতে পারে না–এমন কি সৃষ্টি আর সমালোচনার গতি দ্বান্দ্বিক হলেও ক্ষতি নেই। দ্বন্দ্ব দিয়ে থাকে সৃষ্টির নতুন প্রেরণা। সমৃদ্ধ সাহিত্য মানে সমৃদ্ধ সমালোচনাও। এ ক্ষেত্রে ইংরেজি সাহিত্যের তুলনা নেই। পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্য আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে আর সমৃদ্ধতর–এ শুধু ওদের দীর্ঘ ঐতিহ্যের ফল নয়। ওদের সমালোচনা-সাহিত্যও আমাদের তুলনায় অনেক অগ্রসর। গদ্যে ওদের প্রথম স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র একাধারে সমালোচকও ছিলেন। সৎ ও নিষ্ঠাবান অনেক সমালোচক–তার মধ্যে অনেকে মৌলিক রচনায়ও যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, অহরহ ওখানকার সাহিত্যের বিচার ও মূল্যায়ন করছেন। ফলে ওখানে বেশ বলিষ্ঠ এক সমালোচনা সাহিত্যও গড়ে উঠেছে। এ সব সমালোচকের অধিকাংশই অধ্যাপক–এ কোনো ব্যতিক্রম নয়; সব দেশেই সাহিত্যের অধ্যাপকরা পঠন-পাঠনের সাথে সাথে সাহিত্য-সমালোচনার দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকেন। সাহিত্যের গঠন প্রকরণ ও শিল্পমূল্যায়ন তাদের পেশার অন্তর্গত বলে এ দায়িত্ব পালন তাদের পক্ষে, বিশেষ করে পরিশ্রমী অধ্যাপকদের পক্ষে কিছুটা সহজও হয়ে থাকে। শিক্ষা ও সাহিত্যের স্বতন্ত্র ঐতিহ্যবোধ আমাদের পক্ষে নতুন–আশা করা যায়, কালক্রমে আমাদের অধ্যাপকরাও তাদের এ দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠবেন আর পেশার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষণকেও অতিরিক্ত একটা নেশায় পরিণত করবেন তারা। অবশ্য সবার পক্ষে যে এ সম্ভব তা নয় কিন্তু যাদের পক্ষে সম্ভব ও যাদের প্রবণতা আর যোগ্যতা রয়েছে তারা এ দায়িত্ব পালনের শ্রম স্বীকার করবেন না কেন?

আমাদের অধ্যাপকদের কেউ কেউ সাহিত্যের ইতিহাস রচনা করেছেন–নিঃসন্দেহে এসব মূল্যবান অবদান। সমালোচনার জন্যও সাহিত্যের ইতিহাসের প্রয়োজন নিঃসন্দেহ। উপকরণ ছাড়া সমালোচনা বা মূল্যায়ন সম্ভব নয়। অন্তত অতীত উপকরণের জন্য আমরা আমাদের এসব ঐতিহাসিকদের কাছে ঋণী। কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাস যেমন আছে তেমনি সাহিত্যের ভূগোলও আছে। এ ভূগোল রচনার দায়িত্ব সমালোচকদের। দেশের বিভিন্ন এলাকা আর নদনদীর নাম যেমন ভূগোল নয়, তেমনি নাম ফিরিস্তি বা ঘটনার ধারা বর্ণনাও সমালোচনা নয়। এখন ভূগোল একটা বিজ্ঞানে পরিণত, সমালোচনাও সাহিত্যের বিজ্ঞান। তবে সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গি বৈজ্ঞানিকের বটে কিন্তু তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে শিল্প-রসিক তথা শিল্প-বোদ্ধাও হতে হয়। সমালোচকের জন্য দুটি শর্ত অপরিহার্য–এক, তাঁকে শিল্পী বা শিল্প-সমজদার হতে হয়, দ্বিতীয়ত, তাকে হতে হয় চিন্তাশীল, ইংরেজিতে যাকে বলে–thinker। এ দুই গুণ ছাড়া ভাল সমালোচক হওয়া সম্ভব নয় বলেই আমার বিশ্বাস। শিল্প সমালোচককে শিল্প-সমজদার হতে হবে এ প্রায় স্বতঃসিদ্ধ কথা কিন্তু চিন্তাশীল কেন হতে হবে এ নিয়ে কিছু খটকা থাকা হয়তো সম্ভব। সব শিল্পকর্মই শিল্পীর সৌন্দর্য-চেতনা তথা aesthetic experience এরই ফল–এ চেতনা বা অভিজ্ঞতার পেছনে চিন্তা সব সময় সক্রিয়। চিন্তার সাহায্যেই অভিজ্ঞতা শিল্পে রূপান্তরিত হয়। জীবন থেকে বা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যেমন শিল্পের উৎপত্তি তেমনি শিল্পের লক্ষ্যও জীবন অর্থাৎ জীবনের জন্যই শিল্প। সমালোচকের চারদিকে আবর্তিত বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে রচিত শিল্পের সাযুজ্য কতখানি, তার মূল্যও বা কতটুকু, এসবের মাপকাঠি একমাত্র চিন্তাবিদদেরই হাতে। আর চিন্তাই দিয়ে থাকে অনুভূতি আর চেতনাকে তীক্ষ্ণতা–কালের গতিধারা আর ভবিষ্যৎ রূপকল্প একমাত্র চিন্তাবিদের ধারণায় দিতে পারে ধরা। মূল্যবোধও স্থাণু নয়–কালের সঙ্গে সঙ্গে তারও রদবদল অনিবার্য। জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে চিন্তার কষ্টিপাথরেই এ সবের যাচাই সম্ভব। তাই শিল্পকর্মে মূল্যবোধের প্রতিফলন কতটুকু হয়েছে না হয়েছে, জীবনের সঙ্গে তার মৈত্রী বা বৈরিতা বিচারের জন্য শিল্পবোধের সঙ্গে চিন্তাশীলতাও অত্যাবশ্যক। কোনো শিল্পই অসীম, বেপরোয়া বা উদ্ধত কি উদ্ভট নয়–চিন্তাই শিল্প রচনা আর শিল্পবিচারে দিয়ে থাকে পরিমিতিবোধ। সমালোচককেও তাই একাধারে শিল্পী আর চিন্তাশীল হতে হয়। শিল্পবোধ সমালোচককে পদ্মবনে মত্ত হাতি হতে বাধা দেয় আর চিন্তা শিল্পের দিগন্ত উপলব্ধিতে করে সহায়তা।

সৌন্দর্য-চেতনাকে জাগানোই শুধু শিল্পের কাজ নয়, আত্মানুসন্ধান তার প্রধানতম দায়িত্ব। মানুষের আত্মাকে উন্মোচন করে মানুষকে তার মুখোমুখী দাঁড় করানোই শিল্পের কাজ। এ সম্পর্কে বার্নাড শ’র মন্তব্য : ‘…art is the magic mirror you make to reflect your invisible dreams in visible pictures. You use a glass-mirror to see your face : you use works of art to see your soul.’ (Back to Methuselah)

সমালোচক নিজে শিল্পী হলেই শিল্পের এ বৃহত্তর ভূমিকা তিনি উপলব্ধি আর ব্যাখ্যা করতে সক্ষম। শিল্পের শিল্পগত গুণে সমালোচক নিজে সাড়া দিতে পারলেই সেদিকে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করা তাঁর পক্ষে সহজ হয়। বলা বাহুল্য, সমালোচকের এটিই বড় দায়িত্ব। রচনার শৈল্পিক গুণ বা সাফল্যের দিকে অনেক সময় সাধারণ পাঠকের নজর পড়ে না। সমালোচকের নিজের অনুভব-অনুভূতি ও বিচার-বিশ্লেষণ শক্তি যদি সযত্নে অনুশীলিত হয় তা হলেই আলোচনা আর উদ্ধৃতির সাহায্যে তিনি অবহেলিত ও অস্বীকৃত শিল্পকর্মকে পাঠকদের কাছে পরিচিত করে তুলতে পারেন। রচনা-বিশেষ কেন ভালো তার ব্যাখ্যা আর ভাষ্যে তিনি না এগুলেও ক্ষতি নেই–ভালো দিকটা আবিষ্কার করে সেদিকে পাঠককে সজাগ করে তুলতে পারলেই তার কর্তব্য সমাধা হয়। টি. এস, ইলিয়টের মতেও সমালোচকের কাজ হচ্ছে সাহিত্য বা শিল্পবোধ তথা understanding-কে জাগ্রত করা, ভালো-মন্দের রায় দিয়ে গ্রহণ বা বাতিল করা তার দায়িত্ব নয়। মনে হয় ক্লাসিক্স-এর সাথে পরিচয় আর অন্তরঙ্গতা থাকলে সৎ সাহিত্যের আবেদনে সাড়া দেওয়া সমালোচকের পক্ষে হয় সহজ। সমালোচকের জন্য সাড়া দিতে পারাটাই বড় কথা–তিনি নিজে সাড়া দিতে পারলেই না তবে পাঠকের মনেও তিনি সাড়া জাগাতে পারবেন। 

অবশ্য শিল্প আর মানুষ দুয়েরই রয়েছে সীমা–সে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আবার মানুষ নিজের মতামতের সীমায়ও আবদ্ধ। নৈর্ব্যক্তিক হওয়া যতই প্রশংসনীয় হোক–পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক কেউ হতে পারে না। সাহিত্য-শিল্পে রচিয়তার মতামত aforato 2631 ‘It is impossible to be an impersonal artist in literature, if you are an artist at all.’(M. Murray) কাজেই সমালোচনার ক্ষেত্রেও ব্যক্তি-মনের সীমাবদ্ধতার প্রতি স্বীকৃতি জানিয়েই আমরা নিরপেক্ষতার দাবি জানাবো। তিনি বস্তুনিরপেক্ষ হতে পারেন, আত্মনিরপেক্ষ হবেন কী করে? 

সাহিত্যে যাকে critical record বলা হয় আমাদের সাহিত্যের তেমন সমালোচনামূলক ইতিবৃত্ত আজো গড়ে ওঠে নি। এখন অন্তত তার সূচনা হওয়া উচিত। তা না হলে আমাদের সাহিত্যের সঠিক কোনো খতিয়ান পাওয়া যাবে না–ফলে আমাদের সাহিত্যে থেকে যাবে বিভ্রান্তি, এমন কি লেখকেরাও নিজেদের শিল্প-মূল্য সম্বন্ধে থেকে যাবেন অজ্ঞ। খাঁটি সমালোচনায় লেখকেরাও নিজেকে খুঁজে পান–অনেক সময় তেমন রচনায় নিজেকে আবিষ্কার করে বিস্মিতও কম হন না তিনি। সমালোচনা লেখকের জন্যও অত্যাবশ্যক। লেখককে খুঁজে বার করেন, আত্মপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন সমালোচক। 

সমালোচনাকে সাধারণত দু ভাগে ভাগ করা হয়–গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক। বলা বাহুল্য, এও অনেকখানি মনগড়া বিভাগ। রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক আর নির্বিচার ব্যবহারের ফলে এ দুই শব্দের অর্থ আর প্রয়োগ নিয়েও যথেষ্ট বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। পারস্পরিক স্বার্থের দৃষ্টিতে দেখা হয় বলেই উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যা দেওয়া হয় এ দুই শব্দের। সাহিত্যে আমরা গুণগ্রাহিতাকেই মোটামুটি গঠনমূলক সমালোচনা বলতে পারি আর স্রেফ নির্জলা নিন্দামূলক সমালোচনাকে বলতে পারি ধ্বংসাত্মক। ধ্বংসাত্মক বা নিন্দামূলক সমালোচনাও একেবারে ব্যর্থ নয়–তারও কিছু সুফল রয়েছে। তাতে লেখক আরো সতর্ক, সচেতন ও তীক্ষ্ণ হন–লেখাকে আরো উন্নত করার একটা প্রেরণাও যে তিনি তখন বোধ না করেন তা নয়। এ সম্বন্ধে প্রখ্যাত সমালোচক রেমন্ড উইলিয়ামসের নিম্নলিখিত মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে : Yet there is an essential place, in development of literature, for criticism of the kind that is usually called destructive. The large body of destructive criticism of the last seventy years was fundamentally necessary to the reform of the drama.’(Drama from Ibsen to Elliot) কাজেই কোনো সমালোচনাই সম্পূর্ণ ব্যর্থ নয়। উপেক্ষাই সাহিত্যের জন্য মারাত্মক। আমাদের যেটুকু সাহিত্য হয়েছে ও হচ্ছে তার কোনো মূল্যায়ন ও বিচার-বিশ্লেষণ হচ্ছে না। তা প্রায় উপেক্ষিত হচ্ছে, হচ্ছে অবহেলিত। এটা আশঙ্কার কথা। এ কারণে সাহিত্যে প্রবীণ রুচির মানদণ্ড আমরা খুঁজে পাচ্ছি না–সমালোচক সে মানদণ্ড নির্মাতা। 

[‘সমালোচনা’ প্রথম প্রকাশিত হয় সমকাল পত্রিকার কার্তিক-পৌষ ১৩৭৩ সংখ্যায়। পরে তা সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *