প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

আধুনিক মন : আধুনিক সাহিত্য 

আধুনিক মন : আধুনিক সাহিত্য 

পুরোনো হলেও অনেক কথা বার বার স্মরণ করতে হয়। বিশেষত, সাহিত্য ও শিল্পের ব্যাপারে। মানুষের মতো সাহিত্য-শিল্পের ঐতিহ্যও পুরোনো। পরিবেশের বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনেরও বদল ঘটে। বদল ঘটে বলেই মনের যে ফসল–যাকে আমরা মানুষের সৃজনী-প্রতিভার অবদান বলে অভিহিত করে থাকি তাতেও পরিবর্তন ঘটে–অন্তরঙ্গে যেমন বহিরঙ্গেও তেমনি। এ পালাবদলের চিহ্ন এঁকে এঁকেই সাহিত্য-শিল্পের অশেষ অভিযাত্রা। 

মনের মতোই তা যেমন পুরোনো ও চিরন্তন তেমনি গতিশীল ও গ্রহণশীল। তাই গতিধর্মের স্বাভাবিক নিয়মে শত পরিবর্তন মেনে নিয়েও মনের মতোই সাহিত্য-শিল্পেও চিরন্তনতার উপস্থিতি অপরিহার্য। না হলে পুরোনো শিল্পকর্ম কবেই বাতিল হয়ে যেতো–এমন কি দূর অতীত যুগে পরিবেশিত নন্দন-তত্ত্বকেও তো আমরা পারছি না আজও অস্বীকার করতে। শিল্প সম্বন্ধে এরিস্টটলের মতামত তাই আজও পরম শ্রদ্ধেয়। 

বাংলা সাহিত্যে ত্রিশের সাহিত্যান্দোলন নামে পরিচিত শিল্প-সচেতনতার একটা ঢেউ উঠেছিল, যার তরঙ্গাঘাত পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যে এসে পৌঁছেছে অনেক পরে–বিভাগোত্তর কালেই, সে আন্দোলন বা ঢেউয়ের মৌল ত্রুটি বা কৃত্রিমতা সম্বন্ধে সজাগ না হলে ওখানে তার যে শোচনীয় পরিণতি ঘটেছে আমরাও তার হাত থেকে রেহাই পাবো না। সাহিত্যের যে মৌল উৎস নিজের মন ও পরিবেশ–বা উভয়ের সংগতি সাধন, অতি উৎসাহ বা সাহিত্যে নবত্ব আনয়নের মোহে ওখানকার শিল্পীরা তা আমলেই আনেন নি সেদিন; ফলে তাদের অধিকাংশ রচনাই হয়ে পড়েছে কৃত্রিম’ আর ‘ভূঁইফোড়’। প্রতিভা আর প্রস্তুতি সত্ত্বেও এ কারণে তাঁদের কেউ সার্থক শিল্পীর মর্যাদায় পারেন নি পৌঁছতে। ঐ আন্দোলনের তিন পুরোধা–প্রেমেন্দ্র মিত্র আশ্রয় আর স্বস্তি খুঁজেছেন সিনেমায়, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত রামকৃষ্ণে আর বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ারে। বোদলেয়ারের। কাব্য-উৎস আর পরিবেশ বাঙালি সাহিত্যিকের জন্য ‘গ্রিক’ বললে খুব কম বলা হয়–‘কেতাবি আনন্দের’ বেশি তার কাছে আশা করা বাতুলতা। বৈদেশিক উৎসের ওপর নির্ভর করলে শিল্পীকে হতাশার শিকার হতেই হবে। বিশ বছর সংগ্রামের পর কবিতা বন্ধ করে দিয়ে বুদ্ধদেব বোদলেয়ারে আশ্রয় খুঁজেছেন। যেমন তাঁর বন্ধু প্রেমেন্দ্র মিত্র আশ্রয় নিয়েছেন দেশী সিনেমায় আর অচিন্ত্য সেনগুপ্ত রামকৃষ্ণে–এও এক রকম স্বদেশী ধর্মীয় ‘ছায়াছবি’ বই তো নয়। পার্থিব আর অপার্থিবের এমন জগাখিচুড়িই কি সাহিত্যে আধুনিকতার লক্ষ্য ও আদর্শ? সাহিত্যের ইতিহাসে বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়ার নজিরের। বেশি এসবের কোন মূল্য নেই। অথচ আমাদের কোন কোন সাহিত্য-কর্মীকে তাই যেন আজ পেয়ে বসেছে। আশ্চর্য, যে ঘোড়াটা পশ্চিমবঙ্গে মরে প্রায় ভূত হয়ে গেছে আমাদের এসব সাহিত্য-কর্মীরা প্রাণপণে তাকেই পিটিয়ে চলেছেন।

আমাদের সাহিত্য আজ এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন–এ কৃত্রিমতার অকারণ মোহ ছাড়াতে না পারলে আমাদের সাহিত্যে যাকে স্বকীয়তা বা চরিত্র বলা হয় তার পরিচয় ফুটে উঠবে না। 

যুগ-জিজ্ঞাসায় সব সাহিত্যই আধুনিক–কিন্তু এ আধুনিকতার পটভূমি সব সময়। শিল্পীর মন আর পরিবেশ। সাহিত্যের মূল প্রেরণা-উৎস মন বটে কিন্তু পরিবেশ-বিচ্ছিন্ন মন আশ্রয়চুত বলে সে মন যে শিল্প-বস্তুর প্রেরণাস্থল সে শিল্পেরও আশ্রয়-চুত বা কৃত্রিম না হয়ে উপায় নেই। আধুনিক যুগ তথা আধুনিক মন এক বিচিত্র আন্তৰ্বান্দ্বিক জটিলতার সম্মুখীন–তার সংঘর্ষে ক্ষতবিক্ষত। সমস্ত পৃথিবী আর গোটা মানবজাতিই আজ শিল্পীর সামনে–কিন্তু পায়ের তলার সীমিত মাটিটুকুর আশ্রয় না হলে এবং সে আশ্রয় শক্ত না হলে কিসের ওপর দাঁড়িয়ে শিল্পী আজ এ বিরাটের সঙ্গে মোকাবিলা করবে? শিল্পীর সামনে আধুনিক যুগের এ এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জের সামনে হাওয়াই দুর্গ নিরাপদ আশ্রয় নয়–হাওয়াই হাতিয়ার দিয়েও জেতা যাবে না এ লড়াই। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের উল্লিখিত শিল্পীদের মতো পার্থিব কি অপার্থিবের নির্ঝঞ্ঝাট পক্ষ পটে আত্ম-পলায়নই হবে আমাদের শিল্পীদেরও ভাগ্যলিপি। 

এখন পৃথিবী আর পৃথিবীর মানুষ শিল্পীর মনের এত কাছাকাছি এসে পড়েছে যে, যে কোন সৎ শিল্পী আজ মানবতন্ত্রী না হয়েই পারে না। ফলে যুগ-সচেতনতা বা যুগ জিজ্ঞাসা তার পক্ষে আজ অপরিহার্য। এ না হলে এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি পরিবেশের সঙ্গে বিরোধ আর অবিরাম সংঘর্ষ–তার ফলে হতাশা ও অতৃপ্তি। যা অনেকের ক্ষেত্রে বিষণ্ণতায় পরিণত। যুদ্ধোত্তর য়ুরোপে তাই আত্ম-সমালোচনাই বড় হয়ে উঠেছে–যেহেতু চিন্তার ক্ষেত্রে আমরা য়ুরোপের অনুগামী আমাদের সাহিত্য-শিল্পেও তাই তার ছায়াপাত না ঘটে পারে না। আমাদের সচেতন শিল্পীদের রচনারও এ কারণে এক বড় বৈশিষ্ট্য আত্মসমালোচনা। 

সাহিত্যে ও শিল্পে আত্মসমালোচনার এক বিশেষ মূল্য রয়েছে–বলা বাহুল্য, এটা য়ুরোপীয় রেনেসাঁরই দান। এর ফলে মানুষ সংকীর্ণতার হাত থেকে রেহাই পায়, মনের দিগন্ত যায় বেড়ে, নিজের মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়, আর মূল্যবোধ সম্বন্ধে হয়ে ওঠে অধিকতর সচেতন। 

আধুনিক সাহিত্য রচনা করতে হলে চাই আধুনিক মন। মনে যদি আধুনিকতা সম্বন্ধে সুষ্ঠু কোন ধারণা না থাকে তা হলে আধুনিককালে রচিত হলেও তা আধুনিক সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করবে না। শুধু আঙ্গিকে আধুনিকতার কোন মানে হয় না–আঙ্গিক-নির্ভর রচনার আয়ু কোন সময় দীর্ঘ নয়। সুসজ্জিতা, সালঙ্কারা তরুণী সুন্দরীর মৃতদেহের প্রতি মানুষ এক নজরের বেশি ফিরে তাকায় না, কিন্তু কৃষ্ণবর্ণা জীবন্ত সাঁওতাল তরুণীর প্রতি বয়োবৃদ্ধও ফিরে ফিরে তাকায়! আঙ্গিক-নির্ভর রচনা এক শারের বেশি দুবার কে পড়ে দেখে! 

পাঠকে পাঠকেও বেশ-কম আছে বই কি। সচিত্র সিনেমা পত্রিকার পাঠক-সংখ্যা যে অনেক বেশি তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু খাঁটি শিল্পী কি অমন পাঠক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন? আর ঐ পাঠক-নির্ভর সাহিত্যের প্রসার হলেই কি কোন দেশের সাহিত্য শিল্পের প্রসার ও সমৃদ্ধি হয়েছে বলে ভাবা যায়? কোন মহৎ সাহিত্যের প্রধান অংশ কি রম্যরচনা বা সিনেমা সাহিত্য? 

তার যুগে অস্কার ওয়াইল্ড কম আধুনিক ছিলেন না, আজকের দিনেও তিনি অনাধুনিক হয়ে যান নি। এ আঙ্গিক-নির্ভর আধুনিকতা সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য : 

আমি নাম করতে চাই না–এরই মধ্যে আমাদের কারো কারো কোনো কোনো রচনায় কৃত্রিম আধুনিকতার এ দুর্লক্ষণ কি দেখা দেয় নি? 

আমাদের সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমি আশাবাদী। আমাদের নতুন যাত্রার এ সামান্য কাল পরিসরে অগ্রগতি যেটুকু হয়েছে এবং যে সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে তা নিরাশ হওয়ার মতো নয়। তবে আমি সব রকম হীনম্মন্যতার বিরোধী–অনুকরণ হীনম্মন্যতারই আর এক নাম। সৃজনী-প্রতিভা ব্যক্তিকেন্দ্রিক–ব্যক্তি-মন আধুনিক হলে অর্থাৎ আধুনিকতা সম্বন্ধে পুরোপুরি সচেতন হলেই সাহিত্যে আধুনিকতার আবির্ভাব অনায়াসে হবে। সে সাহিত্যে লেখক যেমন, পাঠকও তেমনি খুঁজে পাৰে, দেখতে পাবে নিজের চেহারা। 

ধার করা জামা-কাপড়ের মতো ধার করা আধুনিকতাও অশোভন, বেমানান। 

[১৩৭১] 

[‘আধুনিক মন; আধুনিক সাহিত্য’ প্রথম প্রকাশিত হয় মাহেনও পত্রিকার মার্চ ১৯৬৫ সংখ্যায়। এটি পরে সংকলিত হয় সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থে (১৯৮০)।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *