লেখকের স্বাধীনতা
লেখকের স্বাধীনতা কথাটা এক হিসেবে স্ববিরোধী এবং আমাদের কাছে আজো কিছুটা বিপজ্জনক। স্ববিরোধী এ কারণে যে, আসলে লেখে তো মন, আর মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ারই তো এক নাম চিন্তা, যা সব লেখার উৎস। সে চিন্তা অত্যন্ত ব্যক্তিক এবং সর্বতোভাবে নিজস্ব। তার ওপর কোনো রকম কর্তৃত্ব অচল। এ এক অতি প্রাচীন আর স্বীকৃত সত্য। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে একজন গ্রিক জ্ঞানী এ সত্যের প্রতি স্বীকৃতি জানিয়ে গেছেন এভাবে: ‘মানুষের নিজস্ব বলতে একমাত্র জিনিস হচ্ছে মনের স্বাধীন চিন্তা। কাজেই আমি মানুষ থাকবো আর স্বাধীন চিন্তাও বিসর্জন দেব এক সঙ্গে তা হয় না। যেমন হয় না সাঁতারও কাটবো অথচ গা ভেজাবো না। এ স্বাধীন চিন্তার সঙ্গে জীবনের বিকাশ আর মনুষ্যত্বের সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। কাজেই যে লেখকের মনুষ্যত্বে বিশ্বাস রয়েছে সে কিছুতেই, কোনো অবস্থাতেই চিন্তার স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে পারে না। দেওয়া মানে লেখক হিসেবে আত্মহত্যা করা।
বিপজ্জনক বলেছি এ কারণে যে, আমরা লেখকরাও কোনো না কোনো দেশের অধিবাসী, কোনো না কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক। রাষ্ট্রশক্তির একটি সাধারণ দুর্বলতা সন্দেহ প্রবণতা, বিশেষ করে মননশীল মানুষকে, সাধারণ অর্থে যাদের বুদ্ধিজীবী বলা হয় তাদের সন্দেহের চোখে দেখা ক্ষমতার একটি স্বভাব। অর্থাৎ যারা লিখে থাকে, নিজের চিন্তাভাবনাকে যারা প্রকাশ করে ভাষায় তাদের প্রতি কিছুটা অবিশ্বাসের চোখে তাকানো। ক্ষমতার যেন এ এক সহজাত প্রবণতা। ক্ষমতার আর একটি দুর্বলতা সুযোগ পেলেই সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া। দেখা গেছে, অতি বড় সজ্জনও যখন ক্ষমতার আসনে বসেন তখন মুহূর্তে তিনি হারিয়ে ফেলেন সব রকম পরিমিতিবোধ, তখন সীমা লঙ্ঘন হয়ে দাঁড়ায় তার স্বভাব। এ কারণে জ্ঞানীরা সব সময় ক্ষমতা থেকে দূরে থাকতে চেয়েছেন এবং কেউ কেউ ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করেছেন। এও দেখা যায়, ক্ষমতা সব সময় ছাপার অক্ষরকেও যেন কিছুটা ভয় করে থাকে। ক্ষমতার এ মনোভাব প্রায়শ সরাসরিভাবে লেখকদের আঘাত হেনে বসে। নীরব কবির মতো নীরব লেখক কথাটাও অর্থহীন–যে নিজের চিন্তাভাবনাকে ভাষায় রূপ দেয় না, আর তা প্রকাশ করে না সে আর যাই হোক লেখক নয়। বোবার যেমন শত্রু নেই, তেমনি এমন তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরও নেই কোনো শত্রু। রাষ্ট্র এদের মনে করে অত্যন্ত ভালো মানুষ, অতি বংশব্দ সৎ নাগরিক। এদের নিয়ে রাষ্ট্র নিশ্চিন্ত। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারীরা চান সারা দেশটা সমতার মরুভূমিতে পরিণত হোক তাদের কাম্য E.M. Forster-এর ভাষায় Desert of uniformity; সবুজের বৈচিত্র্য বা ‘শতপুষ্পে’ তাঁরা আতঙ্কিত।
ক্ষমতা যদি অপরিণত বুদ্ধি, অপরিপক্ষ মানুষ আর অদূরদর্শীদের হাতে পড়ে তখন মননশীল লেখকদের অবস্থা হয়ে দাঁড়ায় অধিকতর বিপজ্জনক। এসব ক্ষমতাসীনদের সভ্যতা আর সংস্কৃতি সম্বন্ধে থাকে না কিছুমাত্র স্বচ্ছ ধারণা। সভ্য সমাজজীবন গড়ে তুলতে কী কী বুনিয়াদি উপাদান অত্যাবশ্যক তা জানার আগ্রহ থেকেও এরা বঞ্চিত। ফলে মননশীলতার সব দরজা-জানালা খুলে দিয়ে তাতে দক্ষিণা বায়ু প্রবেশের পথ করে দেওয়ার বদলে এরা বরং উল্টো দরজা জানালায় আগে যেটুকু ফাঁক ছিল তাও ঠেসে বন্ধ করে অর্গল লাগিয়ে দেয়। মননশীল লেখকদের জন্য এ এক শ্বাসরুদ্ধ দশা। বর্তমানে আমাদের দেশের লেখকরা কেমন অবস্থায় বাস করছেন? আমাদের পদক্ষেপ এখন কোন্দিকে? আমরা কি এখন নিজেদের সম্পূর্ণ স্বাধীন বোধ করতে পারছি?
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে কী দেখতে পাই? আমার বিশ্বাস, লেখকদের পক্ষে এখন এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার সময় এসেছে। দীর্ঘকাল আমরা ইংরেজের অধীন ছিলাম। সে অধীনতার অবসান ঘটেছে ১৯৪৭-এর ১৪ই আগস্ট। কিন্তু ইংরেজ আমলের যে অধীনতা বা বন্দিত্ব তা ছিল অনেকখানি বাহ্যিক বা দৈহিক–সে বন্দিত্ব আমাদের মন-মানসের ওপর তেমন কোনো প্রবল চাপ সৃষ্টি করে নি, রাজনীতির বাইরে তার শাসন ছিল অত্যন্ত শিথিল। ফলে বাংলা সাহিত্যে সব খ্যাতনামা লেখক, বুদ্ধিজীবী, সংস্কারক আর হিন্দুসমাজে সীমিতভাবে হলেও যারা রেনেসাঁস এনেছিলেন। তাদের সবারই আবির্ভাব সম্ভব হয়েছে সে যুগে। এমন কি আমাদের বিদ্রোহী কবিরও আবির্ভাব তখন। আর লেখকরা অনায়াসে বেপরোয়া হতে পারতেন। শরৎচন্দ্র এবং আরো অনেকে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বেপরোয়া হওয়া মানে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে স্বাধীন বোধ করা।
পাকিস্তান আমলে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা এলো বটে কিন্তু তারপর থেকে শুরু হলো অন্যরকম বন্দিত্ব। এ বন্দিত্ব শুধু দৈহিক ছিল না, ছিল অনেকখানি মানসিকও। এ শেষোক্ত বন্দিতুই আমাদের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল সবচেয়ে মারাত্মক। মানুষের চিন্তা ভাবনার একমাত্র বাহন আর প্রকাশ-মাধ্যম তার মাতৃভাষা, আমাদের সে মাতৃভাষার ওপরই তখন যে শুধু হামলা শুরু হলো তা নয়, নানা রকম বিধিনিষেধের দড়াদড়ি দিয়ে আমাদের সামনে বিষয়বস্তুকেও করে দেওয়া হলো সংকীর্ণ–আমাদের কল্পনার পায়ে বেড়ি পরাবার চেষ্টা চললো অনবরত। তখন এ সংকীর্ণতার আবর্তে পড়ে মরা ছাড়া আমাদের আর কোন গতি রইল না। কল্পনায় অবাধ হতে না পারলে লেখক কিছুতেই লেখক হতে পারেন না। সেদিন আমরা লেখকরা কেউই সত্যিকার অর্থে বেঁচে ছিলাম। আমাদের চিন্তা ভাবনাই আমাদের প্রাণ, আমাদের জীবন–সে চিন্তাভাবনাকে আমাদের পদে পদে গলা টিপে হত্যা করতে হয়েছে। যে কথাটা বোরিস পাস্তেরনাক তার ডক্টর জিভাগো উপন্যাসে বলেছেন, ‘… There is only one thing they really want: you should hate what you like and love what you abhor!’ gay ভালোবাস তাকে ঘৃণা করো আর যা তোমার কাছে ঘৃণ্য তাকেই কিনা তোমাকে বাসতে হবে ভালো। পাকিস্তানের চব্বিশ বছর আমাদেরও তাই করতে হয়েছে। যে শাসক আর শাসনকে আমরা মনে প্রাণে ঘৃণা করতাম অনবরত তারই জিন্দাবাদ দিতে হয়েছে আমাদের লেখকদেরও। আর যে ভাষা যে দেশ আর জাতীয়তাকে আমরা অন্তর দিয়ে ভালোবাসতাম প্রচার করতে হয়েছে অনবরত তারই নিন্দা। এমন অবস্থা দীর্ঘকাল চললে যে-কোনো জাতির মানসিক পঙ্গুত্ব অনিবার্য। সুখের বিষয়, মাত্র চব্বিশ বছরে আমরা এ দুঃসহ শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছি।
এখন আমাদের আর একটি নতুন যুগের শুরু, এখন পা বাড়িয়েছি আমরা নতুন ইতিহাসের দিকে। বলা যায় এখন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন–সব রকম বৈদেশিক ও বিজাতীয় প্রভাবমুক্ত। আমরা যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি, যে রাজনৈতিক দলকে আমরা লেখকরাও সর্বান্তঃকরণে সমর্থন জানিয়েছিলাম, পরিণামে সে রাজনৈতিক দল বিজয়ী হয়েছে, যে সরকার আমরা মনেপ্রাণে কামনা করেছিলাম সে সরকারও আমাদের হয়েছে। তবুও আমরা লেখকরা কি পুরোপুরি নিজেদের স্বাধীন বোধ করতে পারছি? আমাদের মনের কথা কি পারছি মনের মতো করে প্রকাশ করতে? লেখা মানে প্রকাশ করা, প্রকাশ ছাড়া লেখার এক কানাকড়ি মূল্যও নেই। লেখা প্রকাশের সব অন্তরায় কি বাংলাদেশের লেখকদের সামনে থেকে দূর হয়েছে এখন? এ প্রশ্নের ‘হাঁ’ উত্তর দিতে পারলে সব চেয়ে খুশি হতাম আমি নিজে। কারণ আমিও তো কায়মনোবাক্যে এ সরকারকেই চেয়েছিলাম। কথাটা আর একটু খোলাসা করা যাক। আজকের দিনে লেখকদের স্বাধীনতার সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। লেখকের চিন্তা-ভাবনা আর বক্তব্যকে বৃহত্তর পাঠক সমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সর্ব প্রধান বাহন দেশের পত্র-পত্রিকা। স্বাধীনতার পর অবস্থার নানা হেরফেরে জাতীয় পত্রিকার বৃহত্তর অংশের ওপর একভাবে না একভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারি কর্তৃত্ব। বড় বড় সব পত্রিকার প্রশাসক, পরিচালক, সম্পাদক ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ পদে সরকার মনোনীতরাই হয়েছে নিযুক্ত। ইতোপূর্বে এমন কাণ্ড কখনো ঘটে নি।
এভাবে বিভিন্ন পদে যারা নিযুক্ত হয়েছেন বা রয়েছেন ব্যক্তিগতভাবে তারা সবাই হয়তো সজ্জন, যোগ্য এবং দেশপ্রেমিকও কিন্তু যে পদের সঙ্গে নিজের আর পরিবার পরিজনের জীবিকার সম্পর্ক রয়েছে, সে পদ আঁকড়ে থেকে তারা তো কোনো রকম ঝুঁকি নিতে পারেন না, ইচ্ছা থাকলেও পারেন না। তেমন আশা করাও হয়তো অন্যায়। যে দেশে বুদ্ধিজীবীর জীবিকার ক্ষেত্র অত্যন্ত সংকীর্ণ সেখানে অবস্থা এ না হয়ে যায় না। জীবিকা হারাবার ভয়ে সব সময় তাদের থাকতে হয় সন্ত্রস্ত। ফলে সরকারের মুখের দিকে চেয়েই তাদের লিখতে হয় এবং লেখা ছাপতে হয়। সরকার তো একজন নন–প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানকে নিয়েই তো কোনো সরকার নয়। এঁরা ছাড়া সরকারের বহু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে–যেমন, মন্ত্রীমণ্ডলী, মন্ত্রণালয়ের সচিব, গণপরিষদ সদস্য, যে পার্টি ক্ষমতায় রয়েছে তার বিভিন্ন স্তরের নেতা-উপনেতারা রয়েছেন, সে সঙ্গে সংগঠন কর্তারাও আছেন–কোন লেখায় এদের কার কখন বিরাগভাজন হতে হয়, সাংবাদিকদের এখন অহরহ সে ভেবেই থাকতে হয় তটস্থ। লেখা প্রকাশের বেলায় তাদের সামনে সে বিবেচনাটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। লেখার গুণাগুণ নয়, লেখকের বক্তব্য সরকারি মহলে কী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে সুর্ভাবনাই হয়ে দাঁড়ায় এখন তাদের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা। ফলে ভয়ের চোটে বহু নিরীহ লেখাও তারা ছাপতে পারেন না, ছাপেন না। আমি ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতা নিয়েই একথা বলছি।
চিন্তার স্বাধীনতা মানে লেখকের স্বাধীনতা। লেখকের স্বাধীনতা মানে প্রকাশের স্বাধীনতা। হিটলারও চিন্তার স্বাধীনতা রোধ করতে চেয়েছিলেন, পারেন নি, সাময়িকভাবে প্রকাশের স্বাধীনতা রোধ করেছিলেন বটে। কিন্তু জার্মানির সে দুঃস্বপ্নের কাল কেটে যেতে খুব বেশি দেরি লাগে নি। ইতিহাসকে ভুলে থাকা হলেও ইতিহাস কাকেও ভোলে না। সব দেশের ক্ষমতাসীনদের উচিত ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করা। হিটলারের পরিণতির সঙ্গে আয়ুব-ইয়াহিয়া-মমানেমের পরিণতির কি কিছুমাত্র সাদৃশ্য নেই? লেখা আর লেখকের একটি বড় ধর্ম পাঠককে সচেতন করে তোলা, পাঠক-মনে সর্ব বিষয়ে জিজ্ঞাসা সঞ্চারিত করা। এ সচেতনতা আর জিজ্ঞাসাকে যে সমাজ বা রাষ্ট্র ভয় করে, সে সমাজ বা রাষ্ট্র নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনে। লেখকের স্বাধীনতা হরণ করা মানে একটা জাতিকে অপরিণত-বুদ্ধি তথা না-বালেগ করে রেখে দেওয়া। নির্বিচারে শাসন-ক্ষমতা চালানোর জন্য এটি একটি মোক্ষম উপায় মনে করা হয় বটে কিন্তু সমৃদ্ধ, উন্নত আর শক্তিশালী জাতি গঠনের পথ এটি নয়। অপরিণত-বুদ্ধি নাবালেগ মানুষকে দিয়ে একটা দাস জাতি গড়া যায় সত্য কিন্তু মহৎ জাতি গড়া যায় না। অবাধ আলো হাওয়া না পেলে গাছ যেমন বড় আর শক্ত হয় না তেমনি মানুষ আর দেশও বিশ্বজ্ঞান আর মুক্ত চিন্তার স্পর্শ না পেলে বড় আর শক্তিশালী হয়ে গড়ে ওঠে না। মানুষ মনোজীবী প্রাণী বলে তার বেলায় এটা আরো বেশি করে সত্য।
রাষ্ট্র সব সময় আনুগত্যের ওপর জোর দিয়ে থাকে। ভালো কথা। কিন্তু তার আগে রাষ্ট্রকে আনুগত্যের কি অধিকারী হতে হয় না? যথার্থ অধিকারী হলে, আনুগত্য স্বতঃস্ফূর্ত না হয়ে পারে না। নিঃসন্দেহে আমি আমার দেশ, রাষ্ট্র আর সরকারের প্রতি অনুগত কিন্তু তাই বলে আমি অন্ধ আনুগত্যের পক্ষপাতী নই। আমার আনুগত্য চক্ষুষ্মনের আনুগত্য। আমি আমার রাষ্ট্রের প্রতি তাকাতে চাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। আমি অনুগত নাগরিক বলেই এ জিজ্ঞাসা আমার জন্য অপরিহার্য। যে সরকার বা রাষ্ট্রের আমি অনুগত নাগরিক, সে সরকার বা রাষ্ট্র আমার আনুগত্যের অধিকারী কি না, আমার আনুগত্যের যথার্থ হকদার কি না তা জানার অধিকার আমার রয়েছে। আমার মানে সমস্ত নাগরিকের। নাগরিকদের এটি একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। আমরা লেখকরা একই সঙ্গে সরকারের সমর্থক আবার সরকারবিরোধীও। সরকার যখন জনগণের কল্যাণের পথের অনুসারী তখন আমরা সরকারের পক্ষে, সরকার যখন জনস্বার্থের বিরোধী তখন আমরাও সরকারবিরোধী। সরকারবিরোধী হওয়া মানে দেশের বিরোধী বা দেশের শত্রু হওয়া নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারল্ড লাকি বলেছেন : ‘To differ from the state does not imply an absence of patriotism and that possibility of making such difference effective is the main safeguard we have against servility in society which the state controls …. in this way Reason has a chance of victory in human affairs. In alternative lies a slavery both intellectual and moral.
জাতিকে নৈতিক আর মন-মানসের দাসত্ব থেকে বাঁচাবার দায়িত্ব লেখক আর বুদ্ধিজীবীদের। বাংলাদেশের মহৎ লেখকরা সব সময় এ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল আজো আমাদের সামনে এ বিষয়ে মূর্তিমান আদর্শ। তাঁদের সে আদর্শ আর দায়িত্ব এখন আমরা যারা বেঁচে আছি আর যারা সামনে আসছেন তাঁদের কাঁধের ওপর এসে পড়েছে। লাকি এও বলেছেন: ‘The power, in short, That call the state to account, is essential to freedom.’ কাজেই বহু ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তাকে রক্ষা করে অর্থপূর্ণ করে তোলার জন্যে রাষ্ট্রের প্রতি। জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাতে আমরা বাধ্য। তা না হলে লেখক হিসেবে আমাদের কর্তব্যচ্যুতি, স্বধর্মচ্যুতি ঘটবে। রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র পরিচালকরা আর যাকেই ফাঁকি দিতে বা বোকা বানাতে পারে না কেন লেখক বা বুদ্ধিজীবীদের পারে না। লেখকরা একটি তৃতীয় নেত্রের অধিকারী–যে চোখ দিয়ে তারা সব কিছু দেখতে পায়। তাই তাদের ক্ষমতার এত ভয়। এ ভয়ের নগ্ন রূপ আমরা পাকিস্তানি আমলে বেশ ভালো করেই দেখেছি। শাসকরা ভালো করেই জানে স্বাধীনতা আর সংগ্রামের, বিদ্রোহ আর প্রতিরোধের বীজ লেখকদের কলমের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়–সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। তাই তাদের সবচেয়ে বড় আক্রোশ লেখকদের ওপর। পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে পাক হানাদার বাহিনী লেখক আর বুদ্ধিজীবীদের তালিকা বানিয়ে খুঁজে খুঁজে যে হত্যা করেছে তা। মোটেই অকারণ নয়। তারা দেখেছে বাংলাদেশে যত আন্দোলন হয়েছে তার পেছনে ভাবগত প্রেরণা যুগিয়েছে লেখকরাই সব সময়।
কলম কথা বলে না সত্য, কিন্তু কলম সব সময় মুখর। কলমের এ মর্যাদা রাখার দায়িত্ব লেখকদের। চারিদিকে যদি অন্যায় অবিচার মিথ্যা আর অনাচার লেখক দেখতে থাকে, তখন কি তার পক্ষে চোখ বুজে থাকা সম্ভব? প্রতিবাদ তাঁকে জানাতেই হয়, অসত্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতেই হয় তাকে। দুঃখের বিষয়, প্রতিবাদী লেখা তো বটেই এমন কি সাধারণ লেখা প্রকাশের পথে আজো যথেষ্ট বাধা রয়েছে আমাদের সামনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও এখন আর আগের মতো স্বাধীন নয়। সামরিক শাসনের আগে এঁরা অনেক বেশি স্বাধীন ছিলেন। আমাদের কোনো কোনো প্রতিভাবান লেখক সরকারি কর্মে নিযুক্ত, বিশেষত শিক্ষাবিভাগে–সরকারের অনুমতি ছাড়া এদেরও নাকি কোনো রকম লেখা প্রকাশের অধিকার নেই। পরাধীনতা কিংবা পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার যুগে লেখকদের সামনে যে বাধা ছিল আজো তা রেখে দেওয়া বা নতুন করে আরোপ করার কোনো মানে হয় না। নিঃসন্দেহে সাহিত্যের অগ্রগতির পথে এ সব প্রবল অন্তরায়। এ সব বিধিনিষেধ এ কারণেও অর্থহীন যে, এ থেকে সরকার বা জনগণ কারো কিছুমাত্র ফায়দা হয় না। অথচ অকারণে এ নিষেধ খড়গের মতো সরকারি চাকরিতে কর্মরত লেখকদের মাথার ওপর ঝুলতে থাকে। নিছক সাহিত্যে পত্রিকা প্রকাশের ডিক্লেয়ারেশন পেতেও নাকি এখন চূড়ান্ত হয়রানি ভোগ করতে হয়। একদিকে সংবাদ পত্রের ওপর কতত্ত্ব, অন্যদিকে এসব বাধানিষেধ, বহু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডিক্লেয়ারেশন নাকি পাওয়া যায় না। ফলে বাংলাদেশের সম্পাদক আর লেখকরা এখন আর কোনো রকম ঝুঁকি নিতেই চান না। অথচ ঝুঁকি না নিলে অন্যায়ের প্রতিকার সম্ভব নয়।
আয়ুবীয় সামরিক শাসনের সূচনায় ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ নামে আমি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। তাতে ই.এম. ফরস্টারের নিম্নলিখিত উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। আজকে স্বাধীন বাংলাদেশে আবারও সে কথাগুলি স্মরণ করার প্রয়োজন বোধ করছি। ফরস্টার বলেছিলেন, ‘তিনটি কারণে আমি লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। প্রথম, লেখককে নিজে বোধ করতে হবে তিনি পুরোপুরি স্বাধীন, তা না হলে সৃষ্টির জন্য ভালো কিছু রচনার প্রেরণাই তিনি পাবেন না। তিনি যদি নির্ভয় হতে পারেন, মনে মনে আত্মস্থ হতে পারেন, সহজ হতে পারেন ভেতরে ভেতরে, একমাত্র তখনই তিনি পাবেন। সৃজনশীলতার অনুকূল পরিবেশ। দ্বিতীয়ত, লেখক শুধু নিজে স্বাধীন এ বোধ করলে চলবে না, স্বাধীনতা হলো লেখকদের জন্য প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু সে সঙ্গে আরো কিছু চাই। লেখক যা ভাবছেন অন্যকে তা বলার স্বাধীনতাও তার থাকা চাই। তা না হলে তার অবস্থা হবে বহুমুখ বোতলের মতো। লেখক শূন্যে বিহার করতে পারেন না। শ্রোতা বা পাঠক না হলে তাঁর চলে না। প্রকাশের পথে অন্তরায় থাকলে তিনি একদিন। অনুভব করতেই ভুলে যাবেন। অনেক সময় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তারাও এ সত্যটা বুঝতে পারেন না, বুঝতে চান না। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা ভালো কিছু সৃষ্টির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান। তৃতীয়ত, জনসাধারণের যদি সব রকম লেখা পড়ার স্বাধীনতা না থাকে, লেখকের চিন্তা আর অনুভূতিকে যদি তারা গ্রহণ করতে অক্ষম হন বা বাধা পান তা হলে তাদের নিজের চিন্তাশক্তি এবং অনুভূতিও চাপা পড়ে যাবে। ফলে তারা থেকে যাবেন অপরিণত অর্থাৎ immature’। কাজেই লেখকের স্বাধীনতা যে শুধু লেখকের জন্যই প্রয়োজন তা নয়। জনসাধারণের বুদ্ধি আর মানস বিকাশের জন্যও তা অত্যাবশ্যক।’ সুখের বিষয়, দেশের সংবিধান রচিত আর অনুমোদিত হয়েছে। আশা করা যায়, এ সংবিধানে লেখকদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃতি পেয়েছে। অবশ্য সংবিধানে স্বীকৃতি পাওয়া তেমন বড় কথা নয়, বড় কথা বাস্তবায়নে অর্থাৎ বাস্তবে স্বীকৃতি। এর আগেও জনগণের বিভিন্ন অধিকারের শাসনতান্ত্রিক স্বীকৃতির কথা আমরা বহুবার সরকারি অমাত্যদের মুখে শুনেছি। কিন্তু জীবনে তা কখনো বাস্তবায়িত হয় নি। ফলে জনগণের অবস্থা যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে। সে সঙ্গে জনমনে বার বার জেগে উঠেছে অসন্তোষও। রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের চক্রান্তে এবারও যেন তেমন না ঘটে। লেখকদের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা যেন স্রেফ কাগজে কলমে নয় বাস্তব জীবনেও লাভ করে স্বীকৃতি। সরকারের মনে রাখা উচিত, সমালোচনা গণতন্ত্রের এক অপরিহার্য অঙ্গ। গণতন্ত্র আর সমালোচনা হাত ধরাধরি করেই চলে। সমালোচনা থেকেই রাষ্ট্র খুঁজে পায় সঠিক তথ্যের দিশা। সমালোচনা ছাড়া কোনো সরকারই সুস্থ ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠতে পারে না। হাঁ-হুজুরেরা কোনো রাষ্ট্রেরই নির্ভরযোগ্য শক্তি নয়। লাকি যাকে healthy experience of criticism বলেছেন তা লেখকের জন্য যেমন তেমন রাষ্ট্রের জন্যও স্বাস্থ্যপ্রদ। ওই না হলে রাষ্ট্র কখনো সঠিক পথ, সুস্থতা আর স্বাস্থ্যের পথ খুঁজে পায় না। লেখকদের দায়িত্ব সে পথ দেখানো। লেখক হাঁ-হুজুর হতে গেলে বলেছি স্বধর্মচ্যুতি ঘটে। আমাদের দেশে তেমন দৃষ্টান্ত বিরল নয়। তবু আমি বলবো, এহ্ বাহ্য। খাঁটি লেখক কখনো হা হুজুরের ভূমিকায় নামতে পারে না। রাজনৈতিক মুক্তির চেয়েও মনের মুক্তি, বুদ্ধির মুক্তি অনেক মূল্যবান। ওই ছাড়া স্বাধীনতা কখনো অর্থপূর্ণ হয় না। স্বাধীন চিন্তা ছাড়া শুধু যে আমাদের বুদ্ধি সংকীর্ণ হয়ে থাকবে তা নয়, দেশের মানুষের মনুষ্যত্বেরও ঘটবে না যথাযথ বিকাশ, জ্ঞানের চর্চা হয়ে থাকবে রুদ্ধ, মন হয়ে থাকবে দুর্বল। দুর্বলচিত্ত মানুষের স্বভাব সত্য-মিথ্যা নানা সংস্কারের শেকলে বাঁধা পড়া। তেমন। অবস্থায় ভেতরে-বাইরে অধীনতার সব বন্ধন ছেদন করে সব রকম অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার সাহসটুকুও আমরা হারিয়ে বসবো। তাই লেখার স্বাধীনতা, লেখকের স্বাধীনতা আমাদের যে কোনো মূল্যে অক্ষুণ্ণই রাখতে হবে। সংবাদপত্র আর সাংবাদিকদের পুরোপুরি স্বাধীনতা বাস্তবক্ষেত্রে যেন স্বীকৃতি লাভ করে আর তা যেন হয় নির্বিঘ্ন। সরকারি বা বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত লেখকদের কেন যে সরকারি দপ্তর বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে লেখা প্রকাশের অনুমতি নিতে হবে তা আমার বুদ্ধির অগম্য। আমাদের দেশে যে-কোনো নাটকে অভিনয় করতে হলেও নাকি আই.বি. পুলিশের মঞ্জুরি প্রয়োজন হয় আজও। এ সবই লেখকের স্বাধীনতার পরিপন্থী। এ সব অচিরে বাতিল হওয়া উচিত। আইনের খেলাপ কিছু লেখা বা বলা কিংবা অভিনয় করা হলে প্রতিকারের ব্যবস্থা প্রচলিত আইনেই তো রয়েছে। যেসব বিধিনিষেধের কথা ওপরে উল্লেখ করলাম তা সাহিত্য-শিল্পের অবাধ বিকাশের পথে অন্তরায় বলেই আমরা সে সবের আশু অবসান কামনা করছি।
আর একটি কথা বলে আমি আমার বক্তব্য শেষ করবো। কোনো বিশেষ দল বা কোনো বিশেষ সরকারের প্রতি আমাদের আনুগত্য নয়, আমাদের আনুগত্য দেশের মানুষের প্রতি, দেশের সাহিত্য আর সংস্কৃতির প্রতি। যে দল বা সরকার এ সবের পক্ষে, আমরা লেখকরাও তাদের স্বপক্ষে; যে দল বা সরকার এ সবের বিরোধী, আমরাও তাদের বিরুদ্ধে। তখন আমাদের একমাত্র হাতিয়ার কলমের সাহায্যে আমরা তার প্রতিবাদ করবো। প্রয়োজন। হলে সংগ্রাম করতেও দ্বিধা করবো না। লেখকরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তার মানে জনগণের ভালো-মন্দের সঙ্গে লেখকরাও একাত্ম। জনগণের কল্যাণের সংগ্রাম লেখকদের সংগ্রাম। এ সংগ্রামের পথেই লেখকদের সৃজনশীলতার ঘটে বিকাশ। বিজ্ঞানী J.B.S. Haldan-এর ভাষায় ‘Creative change always arises from struggle, men don’t become good by being kept in cotton wool, but by fighting difficulties and temptations.’ তাই সব কথার শেষ কথা, লেখকের স্বাধীনতা লেখকের হাতেই। সে স্বাধীনতা বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশের এ যুগের লেখকদের একদিকে যেমন জয়। করতে হবে সব ভয় আর বাধাবিঘ্ন তেমনি অন্যদিকে জয় করতে হবে সরকারি-বেসরকারি সবরকম প্রলোভন। এ দুই জয়ের পথেই লেখকের স্বাধীনতা হবে সুনিশ্চিত।
[‘লেখকের স্বাধীনতা’ ঢাকার আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত (২০-২৭ ডিসেম্বর ১৯৭২) সাহিত্য-সভায় প্রদত্ত সভাপতির ভাষণ। প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয় সমকাল পত্রিকার আষাঢ় ১৩৬৮ সংখ্যায়। পরে শুভবুদ্ধি গ্রন্থে সংকলিত হয়।]