সাহিত্যের সঙ্কট
এ যুগের সাহিত্যিক-শিল্পীরা কালের ও রাষ্ট্রের যুপকাষ্ঠের এক রকম বলি বললেই চলে। শহীদ তাঁরা নন। শহীদ কথাটা আরো অর্থপূর্ণ, সঙ্গে সার্থকতার রয়েছে সংযোগ–আদর্শনিষ্ঠা ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত আত্মদানের গৌরব। সাহিত্যিক-শিল্পীরা আজ তা নন–তারা আজ হাড়িকাঠের বলি। স্বাধীনতার পর দেশের যা অবস্থা হয়েছে, সেই অবস্থার যুপকাষ্ঠে সাহিত্যিক-শিল্পীরাই হচ্ছে নির্ভেজাল বলি।
পাকিস্তান হওয়ায় পর ভাষার ওপর চলেছে এক উৎপাত–যে ভাষা হচ্ছে। সহিত্যিকদের আত্মপ্রকাশের প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার। যে আবেগ ও প্রেরণা মহৎ রচনার প্রাণ, যা সাহিত্য-শিল্পীকে রচনায় করে তোলে উদ্বুদ্ধ, যা নিয়ে আসে এক অনির্বচনীয় তন্ময়তা তা আজ অনুপস্থিত–দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য সেই আবেগ ও প্রেরণা আজ রুদ্ধগতি। দেশ বা জাতির কোনো চেহারাই আজ আমাদের মানসপটে ফুটে ওঠে না। আবেগ ও প্রেরণার দেশগত ও জাতিগত ঐক্য-বোধ আজ নিশ্চিহ্ন। ফলে আমাদের বাইরে ও ভেতরে সর্বত্র এক নৈরাজ্য। এ অবস্থা সাহিত্য শিল্পের অনুকূল অবস্থা মোটেও নয়–না সাহিত্য-সৃষ্টির, না সাহিত্য-উপভোগের।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে বিখ্যাত আইরিশ কবি W. B, Yeats ‘Popular memory’ ও ‘ancient imagination’-এর প্রয়োজনের কথা বলেছেন। এসব দেশের ভূগোল ইতিহাস কিংবদন্তি কেচ্ছাকাহিনী ও রূপকথা ইত্যাদি অবলম্বন করে, বংশানুক্রমে জাতির স্মৃতি ও কল্পনায় মিশে, ঐতিহ্য হয়ে শিল্পীর আবেগ। ও প্রেরণার উপকরণ হয়ে ওঠে। popular memory ও ancient imagination কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা ধর্ম-ভিত্তিকও হতে পারে কিন্তু তার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ। দেশ ও দেশের ঐতিহ্যভিত্তিক স্মৃতি ও কল্পনার ক্ষেত্র আরো ব্যাপক, সামগ্রিক ও সার্বজনীন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ তাঁর ‘মোহরম’ থেকে অনেক উচ্চাঙ্গের কবিতা, তার কাব্যগত আবেদনও অনেক বেশি ও ব্যাপকতর। ‘বিদ্রোহী’তে কবির বাণী-মূর্তির সঙ্গে popular memory ও ancient imagination-এর এক চমৎকার সমন্বয় ঘটেছে। কোনো কোনো স্তবক গঠনে ক্রটি ও ভাবের অসঙ্গতি সত্ত্বেও এ কবিতার আবেগ ও ব্যক্তিত্ব যে নির্বিশেষ ও অপ্রতিরোধ্য এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
আজ আমাদের popular memory ও ancient imagination খণ্ডিত শিল্পীর মন মানস বিপর্যস্ত, ছিন্নমূল ও নোঙরহীন। এ অবস্থায় উচ্চাঙ্গের সাহিত্য হতে পারে কিনা জিজ্ঞাস্য।
আমাদের যা কিছু উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি বা রচনা সবই আমরা যখন বাঙালি ছিলাম তখনকার–বিষাদ সিন্ধু, উন্নত জীবন, মহৎ জীবন, পারস্য প্রতিভা, মানব মুকুট, শান্তিধারা, আবদুল্লাহ, মোমেনের জবানবন্দী, নকসী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ইত্যাদি। নজরুলের রচনার উল্লেখ নাই বা করলাম। তথাকথিত এ স্বাধীনতার পর আমাদের প্রবীণরা যেমন কিছু সৃষ্টি করতে পারেন নি, তেমনি পারেন নি তরুণরাও। এমন কি জয়নুল আবেদিনেরও যা কিছু উল্লেখযোগ্য ছবি তাও সব স্বাধীনতার আগেই আঁকা। সাহিত্য যতখানি জীবনের সঙ্গে, পরিবেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ছবি ততখানি নয়। ‘ব্যক্তি’র প্রাধান্য ছবিতে অনেক বেশি। তাই মনে হয়, বর্তমান পরিবেশে ছবির ভবিষ্যৎ কিছুটা উজ্জ্বল হলেও সাহিত্যের মোটেও নয়। জাতির পুরনো ঐতিহ্য, প্রবহমান স্মৃতি ও কল্পনা ছবির ক্ষেত্রেও যে কতখানি প্রেরণার উৎস হতে পারে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল প্রভৃতি শিল্পীর বহু নামকরা ছবিই তার দৃষ্টান্ত। পুরনো স্মৃতি ও কল্পনা অবলম্বন করে আবদুর রহমান চাঘতাই বহু স্মরণীয় ছবি এঁকেছেন। কিন্তু চাঘতাইর জন্য যা স্বাভাবিক জয়নুল আবেদিনের জন্য তা স্বাভাবিক নাও হতে পারে। উভয়ের ‘স্মৃতি’ ও ‘কল্পনার’ ঐতিহ্য এক নয়, তার ওপর নন উভয়ে এক স্কুলের শিল্পী,–দুইয়ের মন-মানস ও ধ্যান-ধারণার পটভূমিও ভিন্নতর। তাই উভয়ের ছবি সম্পূর্ণ আলাদা জাতের ও আলাদা জগতের।
আমরা কী লিখলে, কেমন করে লিখলে শাসকদের বিষনজরে পড়ব না তাও আমাদের এক মহা দুশ্চিন্তা। ফলে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, বিনা আবেগ ও বিনা প্রেরণায় আমরা সাহিত্যিকরাও বহু শ্লোগান আউড়িয়েছি এই কবছর ধরে। তা সত্ত্বেও সাহিত্যের অগ্রগতির চেয়ে পশ্চাদগতিই হয়েছে বেশি। বরং যারা এসব বেশি করে আউড়িয়েছেন তাঁদের পদক্ষেপ সামনের চেয়ে পেছনের দিকেই হয়েছে দ্রুততর। কারণ, পেশাগত তথা অর্থকরী আবেগ ও প্রেরণা ছাড়া এসবের পেছনে আন্তরিকতার লেশমাত্রও ছিল না। যে আন্তরিকতা হচ্ছে সাহিত্য-শিল্পের প্রাথমিক শর্ত। দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আমাদের মনের আন্তরিকতাকে শুধু যে অঙ্কুরিত হতে দেয় নি তা নয়, যা ছিল সহজাত তাকেও অনেকখানি বিনষ্ট করে ছেড়েছে। আর বলেছি আমাদের নতুন ‘স্মৃতি’ ও ‘কল্পনা’ ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে, আবেগ ও প্রেরণায় অনুরঞ্জিত হয়ে, সাহিত্যের উপকরণ হয়ে উঠতে বেশ সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। জাতির মন-মানস স্থিরতা পেতে ও স্থির হয়ে যা আত্মস্থ করার তা আত্মস্থ করতে, যা বর্জন করার তা বর্জন করতে বেশ সময় নিয়ে থাকে। এভাবে ‘গ্রহণ’ ও ‘বর্জনের’ ফলে জাতীয় ‘স্মৃতি’ ও ‘কল্পনা’ স্থিতি লাভ করে। দেশ যেমন আমাদের ছোট হয়ে গেছে, আমাদের আবেগ, প্রেরণা ও উপকরণের ক্ষেত্রও হয়ে পড়েছে ক্ষুদ্র, এমন কি পাঠকও হয়ে পড়েছে শোচনীয় রূপে সীমিত। ভাল ছাত্র ও বড় ক্লাস যেমন অধ্যাপককে ভাল অধ্যাপক হওয়ার ও পঠনীয় বিষয় সম্বন্ধে সর্বাঙ্গিন প্রস্তুতির তাগিদ দিয়ে থাকে, তেমনি ভাল তথা সমজদার পাঠকও বহু সাহিত্যিককে রচনার মান উন্নয়নের প্রেরণা জুগিয়ে থাকে। ইংরেজি সাহিত্য এর বড় দৃষ্টান্ত। আমাদের মনের সামনে, চোখের সামনে পাকিস্তান বলে কোনো দেশ নেই, আছে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। সমগ্র পাকিস্তানের পটভূমিতে, তার ঐতিহ্য ও মানুষের জীবন নিয়ে কিছু লেখা আজ কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। মন-মানসে আমরা আজ হয় পূর্ব পাকিস্তানি না হয় পশ্চিম পাকিস্তানি, এ সত্যকে অস্বীকার করা রাজনৈতিক সুবিধাবাদ হতে পারে কিন্তু বাস্তববোধের পরিচায়ক নয়। আমরা হয় পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যিক, না হয় পশ্চিম পাকিস্তানের সাহিত্যিক। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানের সাহিত্যিক আমরা কেউই নই। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাহিত্যের শুধু যে ভাষা পৃথক তা নয়–তার মন-মেজাজ, জীবন-জিজ্ঞাসা, এমনকি দৃষ্টিভঙ্গি আর শিল্পরূপও পৃথক। পাকিস্তানের দুই অংশের ইতিহাস ভূগোল ও ঐতিহ্য সম্পূর্ণ আলাদা। দুই অংশের মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্ব এত দুস্তর যে কল্পনায়ও সাধারণ নাগরিক একটার সঙ্গে আর একটার যোগসাজস করতে অক্ষম। এই দূরত্ব প্রাকৃতিক বলেই দুর্লঙ্ঘ্য। ইংরেজের সঙ্গে। আমেরিকাবাসীর যতখানি মিল আমাদের ততখানি মিলও নেই। ওদের বংশ এক, ধর্ম এক, ভাষা এক; আচার-বিচার, পোশাক-পরিচ্ছদ পর্যন্ত প্রায় এক। তবুও ওরা এক রাষ্ট্র বা এক জাতি হতে পারে নি। আমাদের এক ধর্ম ছাড়া সব ব্যাপারেই গরমিল। একমাত্র ধর্মই যদি রাষ্ট্র বা জাতির মূলভিত্তি হয় তাহলে আফগানিস্তান আর পাকিস্তান এক রাষ্ট্র বা এক জাতি নয় কেন? ইংরেজ আর ফরাসিই বা নয় কেন? অথচ ইংল্যান্ড আর ফ্রান্সের মাঝখানে একটি মাত্র খালের ব্যবধান, যে খাল পূর্ব পাকিস্তানের ব্রজেন দাসও সতরে পার হতে পারে।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শুধু ইতিহাস-ভূগোলে যে পার্থক্য তা নয়; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা এবং ধ্যান-ধারণায়ও রয়েছে আসমান-জমিন ফারাক। পশ্চিম পাকিস্তান পুরোপুরিই সামন্ততান্ত্রিক–পূর্ব পাকিস্তান তার ঠিক উল্টো, একদম সাধারণ মানুষের দেশ এটা। সামন্ততান্ত্রিক অবস্থার প্রধান গলদ তা মর্মান্তিকভাবেই ব্যক্তিগত স্বার্থকেন্দ্রিক।
এত সব বৈষম্য রয়েছে বলেই তো পাকিস্তানের রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছুতেই স্থিতিশীলতা আসছে না। কেন্দ্রে রাজনৈতিক ব্যারোমিটার ওঠা-নামার সঙ্গে সঙ্গে প্রদেশের রাজনৈতিক ব্যারোমিটারও বিনা কারণে ওঠানামা করে, করতে বাধ্য হয়; ফলে কোথাও স্থিতিশীলতা ও আর্থিক নিরাপত্তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সাহিত্যিক শিল্পীদের সামনে এই তো আজ দেশের রাষ্ট্র-রূপ। এই রূপ সাহিত্য রচনার অনুকূল কিছুতেই নয়।
ব্যক্তিগত প্রতিভার বিচ্ছিন্ন ও খুচরো কিছু কিছু ফসল যে এ অবস্থায় ফলে না তা নয়। কিছু ভাল গল্প-কবিতা এখানে ওখানে হয়ত লেখা হতে পারে, হচ্ছেও। কিন্তু বৃহত্তম পরিধিতে ব্যাপকতর ছকে মহত্তর সাহিত্য–যে সাহিত্য দেশ ও জাতির জীবন জিজ্ঞাসা ও আত্মোপলব্ধি রূপায়িত হয়ে ওঠে, জাতির মন-মানস ও আত্মা প্রতিফলিত হয়, তা কিছুতেই সম্ভব নয়। যে কোনো বড় সৃষ্টির জন্য আর তার সমজদারি তথা appreciation–এর জন্য যে অনুকূল পরিবেশ দরকার তা আজ কোথায়? গুণ-গ্রাহিতার কোনো লক্ষণ আজ কোথাও পরিলক্ষিত হচ্ছে কি? প্রেসিডেন্টের পুরস্কার বড়, বয়স্ক ও veteran-দের জন্যে তোলা থাক। আমি সাধারণ, মাঝারি ও তরুণ লেখকদের কথা বলছি–এঁদের জন্য অনুকূল পরিবেশ চাই। প্রকাশক, ক্রেতা ও সাধারণ পাঠকের আনুকূল্য ছাড়া এসব লেখক লেখক হিসেবে বাঁচতে পারেন না। এঁদের লেখায় আসতে পারে না ক্রমোন্নতি। বলা বাহুল্য, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিভিন্ন বিষয়ে এঁরাই একাগ্র সাধনায় সাহিত্যের সমৃদ্ধি ও প্রসার বাড়িয়ে থাকেন। শেপিয়র বা রবীন্দ্রনাথ আর কয়টা? সংখ্যাতীত মাঝারি লেখকরাই পৃথিবীব্যাপী সাহিত্যকে গড়ে তুলেছেন ও দিয়েছেন বৈচিত্র্য। আমাদেরও এই মাঝারিদের সাধনা-নিষ্ঠার ওপর নির্ভর করতে হবে। জীবন ও জীবনের সমস্যা সম্বন্ধে যে যে মতই পোষণ করুক, অথবা রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা যার যেমন হোক–দল মত নির্বিশেষে সব লেখককে লেখার স্বাধীনতা দিতে হবে। এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্য বিশেষ করে পাকিস্তানের দুই অংশে দৃষ্টিভঙ্গির যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে, তার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের লেখকরা কিছুতেই দ্বিধামুক্ত হতে পারছে না। এমন কি দক্ষিণপন্থী মন্ত্রীসভা কায়েম হলে বামপন্থী লেখকদের বুক দুরু দুরু করতে থাকে আবার বামপন্থী মন্ত্রীদল গঠিত হওয়ার সম্ভবনা দেখা দিলে দক্ষিণপন্থী লেখকদের মুখ কালো হয়ে যায়।
সাহিত্যের মূল্য ও ভূমিকা বুঝতে হলে সাহিত্যকে সাহিত্য হিসেবে দেখার একটা নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি অত্যাবশ্যক। রাজনৈতিক দল ও সুবিধা সন্ধানীরা এই দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করতে পারছে না বলে আজ সাহিত্যিক, সাহিত্য-প্রতিষ্ঠান ও সাহিত্য সম্পর্কিত অনুষ্ঠানাদি এক অবাঞ্ছিত শিকারের লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়েছে। ফলে জাত লেখক ও সাহিত্য-সেবীরা আজ অনেকটা দিশেহারা। সব দেশের মতো আমাদের দেশেরও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয়তার সুষ্ঠু রূপ গ্রহণের ওপর নির্ভরশীল। এ যদ্দিন না হচ্ছে তদ্দিন সাহিত্য সাহিত্যিকের দুর্গতির অবসান ঘটবে না। বর্তমানে যারা প্রগতিশীল বলে পরিচিত, যারা লেখায় কিছুটা তেল-নুন-লাকড়ির কথা বলেন, তাঁদের পক্ষে কোনো সাহিত্যানুষ্ঠানে যোগ দেওয়া পর্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ঢাকা, কাগমারিতে যে কয়টা বড় আকারের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছে, যদিও এর কোনোটাই নিছক বামপন্থীদের অনুষ্ঠান ছিল না, তবুও এর প্রত্যেকটির বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিরোধিতার ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তোলা হয়েছে। প্রতিটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকার কোনো কোনো দৈনিক প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন। তারপর দিনের পর দিন চলতে থাকে নিন্দার খেউড়! এ হচ্ছে এই অভিযোগের প্যাটার্ন! এঁদের চোখা নিন্দা হচ্ছে, ‘ওরা কমিউনিস্ট, ভারতের দালাল অথবা যুক্তবঙ্গের সমর্থক। কোনো যুক্তি নেই, কোনো প্রমাণ নেই–একটা rational উক্তি পর্যন্ত নেই। শুধু কটুক্তি। এদের মনে এ প্রশ্ন উদয় হয় না যে, আমাদের অত বড় গোয়েন্দা বিভাগ কী করতে আছে? এ সব তাদের কাজ। অতগুলি ভারতের দালাল আর কমিউনিস্ট এখানে অত বড় বড় সভা করে বেড়াচ্ছেন আর তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছেন–এটা তাদের পক্ষে কিছুমাত্র প্রশংসার কথা নয়! আশ্চর্যের বিষয়–যুক্তবঙ্গের ধুয়া আজ পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থীদের হাতে একটা মোটা লাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সুযোগ-সুবিধা মতো তাঁরা বামপন্থী লেখক ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাথায় ভাঙতে কিছুমাত্র দ্বিধা করেন না। স্বয়ং শহীদ সোহরাওয়ার্দীও এই লাঠির ঘা থেকে বাঁচতে পারেন নি। অথচ বামপন্থী রাজনৈতিক মতবাদের তার চেয়ে বড় দুশমন বোধ করি আর দ্বিতীয়টি নেই। মুশকিল হচ্ছে, সুবিধাবাদী রাজনীতি ন্যায় ও সত্য ধর্ম কিছুরই তোয়াক্কা করে না। ফলে ‘ইসলাম’ ও ‘পাকিস্তান’ শব্দ দুটিও আজ এদের সুবিধা হাসিলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
এক মন্ত্রিসভার পতনের পর কেন্দ্রে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন উপলক্ষে আমাদের এক অতি প্রবীণ জননায়ক যখন করাচি যাওয়ার সংকল্প করেন তখন তিনি কাগজে এই মর্মে এক বিবৃতি দেন যে, শুধু ইসলামের জন্যই তিনি করাচি যাচ্ছেন। কিন্তু তার যাত্রার আগেই মন্ত্রীসভা গঠিত হয়ে যাওয়ায় তিনি আর করাচি যান নি। লজিক অনুসারে, আর একটা বিবৃতি দিয়ে ইসলামের জন্যই তিনি যাওয়ায় সংকল্প ত্যাগ করেছেন–একথা বলা উচিত ছিল, বোধ করি চক্ষু-লজ্জার খাতিরে বলেন নি। বাঘের রাজনীতিতে যেমন কোনো লজিক নেই, তেমনি সুবিধাবাদী রাজনীতিতেও লজিকের বালাই নেই। থাকলেও সেই লজিক জঙ্গলের লজিক। অর্থাৎ শেরে পাকিস্তান আর শেরে জঙ্গলিস্থান একই লজিকের ম্যাজিসিয়ান–এঁরা নিজস্ব লজিক দিয়ে ম্যাজিক দেখান–কেউ মেষশাবককে, কেউ আমাদের মত বাঙালকে, তাই এ দুটি শব্দকে নিজেদের ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার দিকে চোখ রেখে ইচ্ছামতো বাকানো হচ্ছে, মোচড়ানো হচ্ছে, ব্যবহার করা হচ্ছে। যাক এ সবই রাজনীতির কথা। আমি সাহিত্যের সঙ্কট নিয়েই আলোচনা শুরু করেছিলাম। তার জের টেনেই এই আলোচনা শেষ করা যাক। দেশের রাষ্ট্ররূপ স্থিতিশীল ও সুস্থভাবে গড়ে উঠছে না বলে সাহিত্যিকরাও আজ সাহিত্য-সৃষ্টির অনুকুল পরিবেশ থেকে বঞ্চিত। নিকট ভবিষ্যতেও অনুকূল পরিবেশের কোনো রকম আভাস দেখতে পাচ্ছেন না বলে এক সর্বাঙ্গীণ হতাশার মধ্যে তার জীবন্ত অবস্থায় কোনো রকমে বেঁচে আছেন শুধু। সাহিত্যকে পেশা হিসেবে নেওয়ার আশা আজ পাকিস্তানে রীতিমত দুরাশাই। ফলে প্রবীণরা আজ হয়ে পড়েছেন দিশেহারা। প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের অনেকে অনন্যোপায় হয়ে এমন সব চাকুরিতে ঢুকে পড়ছেন, যে চাকুরির সঙ্গে সাহিত্যের প্রায় অহি-নকুল সম্পর্ক।
তরুণ-প্রবীণ সকলের মুখে আজ এক কথা–কেন লিখব? কার জন্য লিখব? কে ছাপবে? কে পড়বে?
এসব প্রশ্নের কি কোনো উত্তর নেই? নিশ্চয়ই আছে। তবে সেই উত্তরের অনুকূল পরিবেশ রচনার দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের। বিশেষ করে রাষ্ট্রের কারণ রাষ্ট্রের–আদর্শেই সমাজ রূপায়িত হয়ে ওঠে।
আর একটা কথা। পাকিস্তান আন্দোলন ও তার অভাবিত সাফল্য কী মাহেন্দ্র মুহূর্তই না নিয়ে এসেছিল আমাদের সামনে। কিন্তু তার সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারি নি। সুদীর্ঘকালে বহু ঝড়-ঝঞ্ঝায় টিকে থাকা একই রাষ্ট্রীয় কাঠোমো ভেঙে দু-দুটা স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে।
এই জন্ম-বেদনার বেদীমূলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছে, বাস্তুহারা হয়েছে। অনেকে সর্বহারা হয়ে পথের ভিখিরিতে পরিণত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কিছু সংখ্যক সরু সরু আঙুল যে ফুলে কলাগাছ হয় নি তা নয়। তবে বৃহত্তর জনসংখ্যার তুলনায় তা নগণ্য। লক্ষ লক্ষ মানুষ সীমান্তের এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে ছিন্নমূল হয়ে ভেসে গেছে, ভেসে এসেছে। দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে, আমরা এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকারী হয়েছি, এ যেমন অভাবিত আনন্দ-উল্লাসের বস্তু–তেমনি, অগণিত বাস্তুহারার বেদনামথিত চোখের জলে দেশের আকাশ-বাতাস হয়েছে আলোড়িত ও বিক্ষুব্ধ। সীমান্তের দুই পারেই লাঞ্ছিত মানবতার বহু মর্মন্তুদ দৃশ্যই সাহিত্যিক-শিল্পীদের চোখের সামনে অভিনীত হয়েছে। মানুষের বেদনাহত চিত্তের এই গভীর সুখ-দুঃখ ও হাসি অশ্রুর বিচিত্র কাহিনীই তো যুগে যুগে মহৎ শিল্পের প্রেরণা জুগিয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য, এসব এখনো আমাদের কোনো শিল্পীর তুলিতে আঁকা হয় নি, কোনো কবির কণ্ঠে সংগীত হয়ে ঝরে পড়ে নি, কোনো সাহিত্যিকের লেখনীতে রূপ নেয় নি। আমাদের সাহিত্যিকরা কেউ অল কোয়াইট বা ঝড় কী নবম তরঙ্গ লিখতে পারেন নি। অথচ হাতের কাছে চোখের সামনে লেখার যথেষ্ট উপকরণ ছিল। এমন কি কাণ্ডারি হুঁশিয়ারের মত একটা জাতীয় সংগীতও আমাদের কবিরা দেশকে দিতে পারেন নি। যার সুর ও বাণী-রূপ দেশের আপামর জন-চিত্তে বর্ষার বন্যা-বেগ সঞ্চার করে দিতে পারে। বলা বাহুল্য, আন্তর্জাতিকতার আগে জাতীয়তা। জাতীয় সাহিত্য গড়ে তোলার পরই আন্তর্জাতিক সাহিত্যে বিচরণ সহজ ও সম্ভব। যে মানুষ পুকুরে সাঁতার কাটতে অক্ষম তার পক্ষে সমুদ্র সন্তরণের বুলি না আওড়ানোই ভাল।
পাকিস্তান আন্দোলন ও তার সাফল্য কী জানি কেন আমাদের প্রতিভাবান সাহিত্যিক শিল্পীদের মন-মানসে কোনো নতুন জোয়ার আনতে পারে নি, অন্তরের অন্তঃস্থলকে গভীরভাবে নাড়া দেয় নি কারো, খুলে যায় নি তাদের চোখের সামনে সাহিত্য-শিল্পের কোনো নতুন দিগন্তরেখা। স্বাধীনতার অরুণোদয়ে কারো মন-মানস হয় নি মুখর–নতুন আবেগে আরো উদাত্ত-কণ্ঠ হয়ে ওঠে নি উচ্ছ্বসিত। কবি-চিত্তের উল্লাস কতখানি উচ্ছ্বসিত ও কল-মুখর হতে পারে তার নিদর্শন নজরুলের ‘প্রলয়োল্লাস’।
আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বেশ কিছুটা সাদৃশ্য আছে। নৃতত্ত্ব ও ভৌগোলিক ঐতিহ্যের দিক থেকে ইংরেজ ও আইরিশে বিশেষ পার্থক্য ছিল না। সব বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদেরও তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ইংল্যান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন না হলে আয়ারল্যান্ড চিরকাল সংখ্যালঘু হয়েই থাকতো–জাতি হতে পারতো না কখনো। সেই যুগেও ইংল্যান্ডের হাউস অব কমন্সে আয়ারল্যান্ডের প্রতিনিধি ছিল। কিন্তু নিরঙ্কুশ মেজরিটির কাছে সেই প্রতিনিধিত্বের কোনো কার্যকরী মূল্য ছিল না। গণতান্ত্রিক নিয়মানুসারে তাদের চিরকাল মেজরিটির মুখপেক্ষী হয়েই থাকতে হতো। আমাদেরও অবস্থা ছিল অবিকল তাই। পাকিস্তান না হলে আমাদেরও চিরকাল থাকতে হতো মেজরিটির মুখাপেক্ষী হয়েই। আর থাকতে হত। ভারতের বহু সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সম্প্রদায় হয়েই–জাতি হতে পারতাম না আমরা কখনো। হতে হলে নিজেদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বহু জিনিস ত্যাগ করে বৃহত্তর ভারতীয় জীবন-ধারার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে যেতে হতো। তাই স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আয়ারল্যান্ডকে যেমন বৃহত্তর ও সর্বগ্রাসী ইংল্যান্ডের অধীনতাপাশ ছিন্ন করে স্বাধীন হওয়ার আন্দোলন করতে হয়েছিল, তেমনি আমাদেরও বৃহত্তর ও সর্বগ্রাসী ভারতীয় প্রভুত্বের বাইরে স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পাকিস্তান আন্দোলন না করে উপায় ছিল না।
সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে আইরিশ আন্দোলনের ব্যর্থতা দেখে সেই আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা বিশ্ববিখ্যাত কবি W. B. Yeats দুঃখ করে লিখেছেন : Ireland’s great moments had passed, and she had filled no roomy vessels with strong sweet wine where we have filled our porcelain jars against the coming winter.’ ইয়েটস স্বয়ং জাত কবি ও জাত শিল্পী। তাই কাকতালীয় সাহিত্যের ফাঁকি তার চোখে ধরা পড়তে দেরি লাগে নি। এই ব্যর্থতার কারণও তিনি নির্দেশ করেছেন: Immediate victory, immediate utility, became everything…। এই মনোভাব কখনো সাহিত্য শিল্পের অনুকূল নয়। আমাদের দশাও কি আজ তাই নয়? আমাদেরও পাকিস্তান আন্দোলন ও তার সাফল্যের great moment হারিয়ে গেছে, সাহিত্যের সুধাভাণ্ডে তা থেকে আমরা কিছুই সঞ্চয় করতে পারি নি যা দুর্দিনে ও সঙ্কটে আমাদের মন-মানসের পাথেয় হতে পারে। স্বাধীনতার পর আমরাও কি নগদ লাভ ও সদ্য সুবিধা আদায়ে মেতে উঠি নি? জনসাধারণের মত সাহিত্যিক-শিল্পীদেরও এই কি একমাত্র মোক্ষ হয় নি? শিল্পীর জন্য Cause বড় কথা নয়, Cause-কে কেন্দ্র করে যে জীবন আবর্তিত হচ্ছে, সেই নগ্ন। জীবন ও তার সুখ-দুঃখই শিল্পীর উপজীব্য।…’Life is greater than the cause and artists are the servants not of any cause but of more naked life, and above all of that in its nobler forms, where joy and sorrow are one, artificers of the great moment…’ পাকিস্তান আন্দোলন সেই দুর্লভ Great moment অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের জীবনে নিয়ে এসেছিল, কিন্তু সস্তা নগদ লাভের প্রলোভনে দিশেহারা হয়ে আমরা সেই Moment-এর সদ্ব্যবহার করতে পারি নি।
আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা ও পরিবেশের যে আভাস এই প্রবন্ধে আমি দিতে চেয়েছি তাতে শিল্পীর পক্ষে আত্মস্থ হওয়ার সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় যে কোনো great moment হারিয়ে যাওয়ারই কথা। জীবিকার প্রাথমিক স্বাধীনতাটুকুও যদি না থাকে শিল্পী আত্মস্থ হবেন কী করে? কী করে হবেন। বেপরোয়া? সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার থেকে শিল্পী বায়রনের দৃষ্টান্ত টেনে আনার দরকার নেই–বাংলা সাহিত্যে সেই দৃষ্টান্তের কিছুমাত্র অভাব নেই। বলা বাহুল্য, জাতশিল্পী মাত্রই বেপরোয়া। মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল সবাই শিল্পীর এই recklessness তথা বেপরোয়া মনোভাবের অধিকারী ছিলেন। তার জন্য দুঃখ এঁরা পেয়েছেন–বিশেষ করে মধুসূদন ও নজরুল। কিন্তু বেপরোয়া জীবনের যে সূর্য-স্বেদ তা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত হন নি। ব্যবহারিক জীবনে বেপরোয়া হওয়া হয়তো বড় কথা নয়– বড় কথা ভাবে, কল্পনায়, কল্প-বস্তু গ্রহণে ও নির্মাণে বেপরোয়া হওয়ার অধিকার সব বড় শিল্পীরই এই এক বড় গুণ ও এক বড় অধিকার। বেপরোয়া হওয়ার স্বাধীনতা ছিল বলেই তো মধুসূদনের পক্ষে অমন করে রাবণ চরিত্র আঁকা সম্ভব হয়েছে–যা চরিত্র হিসেবে রামকেও ছাড়িয়ে গেছে। আর সমগ্র রবীন্দ্র-সাহিত্যই তো এক জাগ্রতচিত্ত শিল্পীর বেপরোয়া বিবেকেরই নিদর্শন। আজকের দিনে বিসর্জন, চোখের বালি বা ঘরে বাইরে যে সেদিনে কতখানি দুঃসাহসিক ব্যাপার ছিল তা হয়তো অনেকেই অনুমান করতে পারবে না। উগ্র স্বাদেশিকতা, অন্ধ জাতীয়তা, ধর্মীয় গোঁড়ামি রবীন্দ্রনাথের বেপরোয়া কলমের খোঁচা থেকে কিছুই রেহাই পায় নি। মুসলমানের মনে স্বতন্ত্র অস্তিত্ববোধ জাগ্রত হওয়ার বহু আগেই, সেই স্বদেশীযুগের বোমা-পিস্তলের আদি পর্বে তিনি তার ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে সন্ত্রাসবাদ সম্বন্ধে শুধু নয়–‘বন্দেমাতরম’ সংগীতের যথার্থ সম্বন্ধেও প্রশ্ন তুলে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। এই মহাকবি অসংখ্য কবিতা, গানে ও নাটকে যে বেপরোয়া মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন তা ভাবলে অবাক হতে হয়। শরৎচন্দ্র ছাড়া শরশ্চন্দ্রের কালে বইয়ের নাম চরিত্রহীন রাখা কেউ কি কল্পনা। করতে পারতো? এক বিখ্যাত মাসিক তো শুধু এ-নামের জন্যই এই লেখা ছাপতে অস্বীকার করেছিল। অমন বেপরোয়া ছিলেন বলেই তো তার পক্ষে রাজলক্ষ্মীর মত। মেয়েকে, বাসার ঝি সাবিত্রীকে বাংলা সাহিত্যে এক অভাবিত মর্যাদাপূর্ণ স্থান দান সম্ভব হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রও কি কম বেপরোয়া ছিলেন? না হয় সেই যুগে ‘রোহিণী’ চরিত্র আঁকা সম্ভব হত কি? ভাবুন, কতখানি বেপরোয়া হতে পারলে ‘বিদ্রোহী’র মত কবিতা লেখা যায়? নজরুল ছাড়া ‘বারাঙ্গনা’ নিয়ে অমন জোরালো কবিতা আর কে লিখতে পারতো? এখন তো অমন কবিতা লিখতে পারার কথা ভাবাই যায় না। বেপরোয়া মনোভাবের উত্তরাধিকারী ছাড়া বড় সাহিত্য, মহৎ সাহিত্য রচিত হতে পারে কি না এ বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বলা বাহুল্য, অনুকূল পরিবেশই তেমন মনোভাবের জন্ম দিতে পারে।
(আয়ুব আমলে এ প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য ‘সমকালের’ ওই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত হয়েছিল)
[‘সাহিত্যের সংকট’ প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় সমকাল পত্রিকার মাঘ ১৩৬৫ সংখ্যায়। সমকালের ঐ সংখ্যা সে সময়ে পাকিস্তান সরকার বাজেয়াপ্ত করে। লেখাটি সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থে সংকলিত হয়ে পুনরায় প্রকাশিত হয় ১৯৮০-তে।]