প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

সাহিত্যের একটি সমস্যা 

সাহিত্যের একটি সমস্যা 

বাংলাদেশের সাহিত্যের আয়ু খুব দীর্ঘ নয়–১৯৪৭ সনের দেশবিভাগের সঙ্গে সঙ্গেই এখানকার সাহিত্যেরও যাত্রা শুরু। তৎকালীন দেশবিভাগের প্রাক্কালে প্রায় আক্ষরিক অর্থেই বাংলা সাহিত্য ছিল কলকাতা-কেন্দ্রিক। তখন লেখকরাও নানা অছিলায় জড়ো হতেন কলকাতায় গিয়ে–স্বপ্নও দেখতেন কলকাতা থেকে বই প্রকাশের। সব রকম প্রকাশনারও নাভি-কেন্দ্র ছিল তখন কলকাতা–কলকাতার বাইরে একটিও উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা-সংস্থা ছিল না। তাই বাংলা সাহিত্যের যা কিছু প্রসার ও সমৃদ্ধি তা কলকাতাকে কেন্দ্র করেই। 

সাহিত্য এক দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার–অন্যান্য ব্যবহারিক শিল্প প্রয়োজনের তাড়নায় রাতারাতি গড়ে ওঠা হয়ত তেমন অসম্ভব নয়। কিন্তু সাহিত্য-শিল্পের তেমন কোনো ত্বরিত তাড়না নেই বলে তার গতি স্বাভাবিক নিয়মেই মন্থর। সাহিত্যের প্রস্তুতি পর্ব যেমন দীর্ঘ তেমনি ব্যক্তি বা সমাজ মনে তার চাহিদার তাড়না সৃষ্টিও সময় সাপেক্ষ; আর তা আরো কিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত। স্মরণীয়, সাহিত্যের সমস্যা শুধু লেখক-কেন্দ্রিক নয়, পাঠক-কেন্দ্রিকও। ডিম আগে না মুরগি আগে, গাছ আগে না বীজ আগে–এসব তর্কে না গিয়েও বলা যায়, লেখক আর পাঠক পরস্পরের পরিপূরক। প্রায় ষাট বছর আগে রবীন্দ্রনাথ যে লিখেছিলেন : ‘অনেকে কবিতু করিয়া বলেন যে, পাখী যেমন নিজের উল্লাসেই গান করে লেখকের রচনার উল্লাসও সেইরূপ আত্মগত। পাঠকেরা যেন। তাহা আড়ি পাতিয়া শুনিয়া থাকেন। পাখীর গানের মধ্যে পক্ষি-সমাজের প্রতি যে কোন লক্ষ্য নাই এ কথা জোর করিয়া বলিতে পারি না। না থাকে তো নাই রহিল, তাহা লইয়া তর্ক করা বৃথা। কিন্তু লেখকের প্রধান লক্ষ্য পাঠক সমাজ।’ এ সম্বন্ধে আজো দ্বিমত ঘটার কোন কারণ দেখি না। যে দেশে পাঠক যত বেশি সে দেশে সাহিত্যের প্রসারও তত অধিক–এ তো আমাদের এক সাধারণ অভিজ্ঞতা। পাঠকের মান উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের মানেরও উন্নয়ন না হয়ে পারে না। অবশ্য উন্নত সাহিত্য সৃষ্টির জন্য আরো যে কিছু শর্ত নেই তা নয়, যেমন সাহিত্য-শিল্পের ঐতিহ্যবোধ, সমাজের সার্বিক সংস্কৃতি-চেতনা ইত্যাদি। তবুও পাঠক প্রধান শর্ত, পাঠক ছাড়া আজকের দিনে সাহিত্য আর সাহিত্যিকের বেঁচে থাকাই অসম্ভব। সাহিত্যকে বাদ দিয়ে পাঠক বরং বাঁচতে পারে, তবে সে বাঁচা মন আর মূল্যবোধকে শিকেয় তুলে রেখে বাঁচা। প্রাচীন কালে যে উন্নত সাহিত্য-সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে তার বড় কারণ তখন সাহিত্য ও সাহিত্যিক এমন পাঠক-নির্ভর ছিলো না। রচিত হতো তখন শুধু কবিতাই, আর কবি মাত্রই ছিলেন সভা কবি। রাজাই ছিলেন তখন সাহিত্যের রক্ষক, ভক্ষকও বলা যায়। এখন সে আসন জনসাধারণের। সে জনসাধারণ যদি সাহিত্যের ভক্ষক না হন তা হলে সাহিত্যের ফুল ফোঁটা বিলম্বিত হবেই। সাহিত্য তো আর কোন বনফুল নয় যে আপনাআপনি ফুটে আপনাআপনি ঝরে পড়বে!

লেখক না হয় মরিয়া হয়ে লিখেই চললো; কিন্তু প্রকাশক তা ছাপবে কেন যদি এক হাজার বই ছেপে তাকে পাঁচ সাত বছর বসে থাকতে হয়? তিনি ত ব্যবসায়ী, টাকাটা ফেরত না এলে তার ব্যবসা টিকে কী করে? আমরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে সংখ্যায় অনেক বেশি হতে পারি। এ সংখ্যা নিয়ে গর্ব করতেও আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা। এখনও এমন কি দুহাজার স্বদেশপ্রেমিক পাঠকও সৃষ্টি করতে পারি নি, যারা স্রেফ স্বদেশের লেখক, প্রকাশক আর মুদ্রাকরের খাতিরে নির্বিচারে ভালোমন্দ বই কিনে এঁদের বেঁচে থাকার, একটু প্রসারিত হওয়ার সুযোগ দেবেন। না হয় নির্বাচন করে কিনেই সে সুযোগ দিক।

ব্রিটিশ আমলের একটি শোনা ঘটনা : একটা সাহেব তার চাপরাশিকে কিছুটা কাপড় কিনে আনতে দিয়েছিল, কিনে আনার পর সাহেব দেখতে পেলো কাপড়টা জাপানের তৈরি। তৎক্ষণাৎ কাঁচি বের করে কাপড়টা কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে সাহেব আবার টাকা দিয়ে চাপরাশিকে বলে দিলে : Made in England কাপড়া লে আও। হয়তো কোনো ব্যাপারেই এতখানি গোঁড়ামি বা সংকীর্ণতা ভালো নয়—সাহিত্য-শিল্পের ব্যাপারে তো নয়-ই। তবুও স্বদেশানুরাগের যে দৃষ্টিভঙ্গি এর অন্তরালে সক্রিয়–তার মূল্য নেহাত কম নয়। ইংরেজ যে নানাদিকে বড় হয়েছে তার পেছনেও রয়েছে এ দৃষ্টিভঙ্গি। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের যে তুলনা নেই তাও এ কারণে। জনৈক আমেরিকা ফেরত বন্ধুর মুখে শুনেছি, ওখানে মোটামুটি পরিচিত যে-কোনো লেখকের কোনো বই ই লাখের কমে ছাপা হয় না, আর বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কয়েক হাজার বই বিক্রি হয়ে যায় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আর সাধারণ পাঠাগারে। সব প্রকাশিত বই কেনা যাদের জন্য বাধ্যতামূলক ওসব দেশে চলনসই গোটা দুই বই লিখতে পারলেও কোন লেখককেই রাত জেগে সংবাদপত্র অফিসে প্রফ দেখতে হয় না বা করতে হয় না সরকারি চাকুরির শৃঙ্খলে বাধা থেকে জীবিকা অর্জন। ঢাকার এক প্রকাশক-বন্ধু বলেছেন, বাংলাদেশে ভালো-মন্দ যে বই-ই প্রকাশিত হোক, তার প্রত্যেকটার আঠারো কপি আমেরিকান সরকার বা ঐ সরকারের এজেন্টের কাছে সরবরাহ করার নির্দেশ আছে তাদের প্রতি। আমাদের সরকারের নিজেদের দেশে প্রকাশিত বইগুলো কেনারও এমন কোন ব্যবস্থা আছে বলে আমার জানা নেই।

ভেরা ব্রিটেন (Vera Brittain) একবার লিখেছিলেন, কাগজ দুষ্প্রাপ্য ছিল বলে যুদ্ধের সময় তাঁর একটা বই মাত্র পঞ্চাশ হাজার ছাপতে হয়েছিল আর তা-ও বই মুদ্রাযন্ত্রের জঠর থেকে বেরিয়ে আসার আগেই আগাম বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। তার দুঃখ বইগুলো এক সঙ্গে বিক্রি হয়ে যাওয়ায় তাকে অনেক বেশি ট্যাক্স দিতে হয়েছে। বলা বাহুল্য, ভেরা ব্রিটেন এমন কোন প্রথম শ্রেণীর লেখিকা নন। শুনতে পাই, পশ্চিমবঙ্গেও এখন প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই পাঁচ হাজারের কম ছাপা হয় না (অবশ্য কবিতা ছাড়া)। অথচ আয়তন আর লোকসংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ আমাদের থেকে কত ছোট। পূজায়-পরবে পশ্চিমবঙ্গের পাঠকেরা কত বেশি বই কেনে আর সে তুলনায় ঈদে-পরবে আমাদের এখানে কটা বই হয় বিক্রি? বই পড়ার যে অদম্য ক্ষুধা আর নিজের দেশের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার যে আগ্রহ তা আমাদের কোথায়? তার কোন পরিচয় কোথাও আজো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কি? 

‘চাহিদা আর সরবরাহ’ অর্থনীতির কথা বটে কিন্তু আমার বিশ্বাস, জীবনের সব কিছুর সঙ্গেই রয়েছে এর সম্পর্ক। সাহিত্যিক-শিল্পীরা তো বটেই, এমন কি ওলি দরবেশ, পির-মুর্শেদ, ইমাম-মোয়াজ্জেন, পাদ্রি-পুরোহিত সবাই এ শৃঙ্খলে বাধা। এ সবের পেছনে আধ্যাত্মিকতা যতটুকু আছে তার অনেক বেশি আছে পার্থিব চাহিদা আর সরবরাহ-এর টানাপোড়েন। একই পিরের পৃথক হয়ে যাওয়া ওয়ারিশরাও যে ভিন্ন ভিন্ন তারিখে ‘ওরশ করে থাকে, তা মোটেও আধ্যাত্মিক কারণে নয়। সেও এক প্রকার ‘ক্লোজড় মার্কেট। সাহিত্যের ব্যাপারে তা আপত্তিকর হবে কেন? সাহিত্য তো পুরোপুরি পার্থিব ব্যাপার, চাহিদা আর সরবরাহ নীতির বাইরে সাহিত্যেরও বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। ক্লোজড় মার্কেট বা সংরক্ষণ নীতি আমাদের কি কোন ফায়দা করে নি? এ নীতির ফলে অনেক বিষয়ে আমরা এখন স্বাবলম্বী বা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছি। আমাদের বই-এর ছাপা, গেটআপ, অঙ্গসজ্জা যে এখন প্রায় কলকাতার সমকক্ষ হয়ে উঠেছে, তা-ও কলকাতার ওপর নির্ভর না করারই ফল। সংবাদপত্রের পাঠক-সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে বলেই সংবাদপত্রের সংখ্যা, এমন কি মানও অনেক বেড়ে গেছে। সাহিত্যের পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে আমার বিশ্বাস সাহিত্যের সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে–সংখ্যা এবং গুণ উভয় ক্ষেত্রে। 

এখন আমাদের অবস্থা? 

একটি প্রতিনিধি স্থানীয় দৃষ্টান্ত : ঢাকার একটি প্রগতিশীল পত্রিকার তরুণ সম্পাদকের সঙ্গে একদিন দেখা। তিনি নিজেও প্রগতিপন্থী, উচ্চ-শিক্ষিত, দেশের সাংস্কৃতিক জীবন তার নখদর্পণে, আমার সমধর্মী, আমার মতামতের ভক্ত, আমার লেখার অত্যন্ত অনুরক্ত। তার নিজেরই এ দাবি। কিন্তু আশ্চর্য, আমার পাঁচ-সাত বছর আগে প্রকাশিত বইও তিনি পড়েন নি, আলাপে মনে হলো সে সব বইয়ের চেহারাও দেখেন নি তিনি। তার পরিবারটি শিক্ষিত আর সংস্কৃতিবান। তিনি নিজেই জানালেন চিকিৎসার জন্য তিনি শিগগিরই বিলাত যাচ্ছেন। কাজেই বাংলাদেশের লেখকরা বছরে যে কয়খানা বই লেখেন তা কেনার সামর্থ্য যে তাঁর তথা তাঁর পরিবারের আছে তা সহজে অনুমেয়। অথচ কেনেন বলে মনে হয় না। এদিকে বাংলাদেশের সাহিত্যে বন্ধ্যাত্ব সম্বন্ধে তার দুর্ভাবনারও অন্ত নেই। এ ব্যাপারে তিনি ব্যতিক্রম নন–আমরা সকলে এ অপরাধে অপরাধী। আসলে আমাদের জীবনটাই এক স্ববিরোধিতা। আমার বিশ্বাস, আমাদের শিক্ষক, অধ্যাপক, সাহিত্যসেবী, সাংবাদিক (অন্যদের কথা বাদ দিলাম) কারো ঘরে বাংলাদেশের প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই কয়টাও আছে কিনা সন্দেহ। এ কয় বছরে বাংলাদেশে পড়বার মতো বই কিছুই লেখা হয় নি, অতি বড়ো স্বদেশ-নিন্দুকও বোধ করি এমন কথা বলবে না। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশে স্বদেশ নিন্দুকের সংখ্যা স্বদেশ-প্রেমিকের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়। কিনে পড়া দূরে থাকুক অনেক ব্যক্তি দেশের লেখকদের বই বিনে পয়সায় পড়ে দেখার যোগ্যও মনে করেন না। শিক্ষা বিভাগের উচ্চতম চাকুরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত আর ইসলামি সংস্কৃতির নামে উচ্চকণ্ঠ এক সুধী ব্যক্তি আমাদের এক তরুণের কাছ থেকে প্রায়ই গল্প-উপন্যাসের বই চেয়ে নিয়ে পড়তেন কিন্তু তিনি নাকি উক্ত তরুণকে খাড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছিলেন, বাংলাদেশের লেখকদের কোন বই পাঠিয়ে না! 

পাঠকের তো এ মনোভাব, প্রকাশক আর গ্রন্থ-বিক্রেতাদের মনোভাবও এর চেয়ে উৎসাহবর্ধক নয়। আমার নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা নাই বা উল্লেখ করলাম। আমাদের এখানকার প্রতিভাবান তরুণ লেখকদের অনেকেই আমাকে কথা প্রসঙ্গে বলেছেন–তাদের যে-সব বই প্রকাশিত হয়েছে, তা হয় তারা নিজের খরচে ছেপে বের করেছেন না হয় প্রকাশকদের বহু তোয়াজ আর সাধ্য-সাধনা করেই করাতে হয়েছে ছাপাতে রাজি। এমন কি বই দোকানে জমা রাখতেও অনেক দোকানদার রাজি হন না। 

বাংলাদেশের সাহিত্যিকরা আজ শুধু পাঠকের মুখাপেক্ষী নয়, প্রকাশক আর গ্রন্থ বিক্রেতাদেরও মুখাপেক্ষী। লেখক, পাঠক আর প্রকাশক–এ তিনের যোগসূত্রে সাহিত্যের গতি আর সমৃদ্ধি বাধা আর গাঁথা। এ শৃঙ্খলের একটি কড়ার অনুপস্থিতিও সাহিত্যের গতি বিঘ্নিত হতে বাধ্য। শুধু লেখা বা বই পুস্তকের ব্যাপারে নয়, অন্য আরো অনেক সাংসারিক ব্যাপারেও আমার যে অভিজ্ঞতা তাতে আমার ধারণা : আমাদের দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা যে করে না তা নয়; তবে সে ভক্তি শ্রদ্ধা হচ্ছে পুরোপুরি থিয়োরিটিকেল, প্র্যাকটিকেলের সীমায় তার অবতরণ কদাচিৎ ঘটে। কিন্তু সাহিত্য আর সাহিত্যিক ও সম্পূর্ণ প্র্যাকটিকেল বা বাস্তব ব্যাপার। লেখা আর লেখক দুই-ই একান্তই সলিড–শুধু হাওয়াই ভক্তি-শ্রদ্ধায় তার চলে না। প্রশংসা শুনে সামাজিকভাবে মনটা যে চাঙ্গা হয়ে ওঠে না তা নয় কিন্তু মনের ঠিক নিচেই উদর নামক যে বস্তুটা আছে তা অতি বেশি প্র্যাকটিকেল বলে নিছক প্রশংসায় এর মন মেজাজ কিন্তু একটুও চাঙ্গা হয়ে ওঠে না। মন আর মস্তিষ্কের সঙ্গে এ যন্ত্রটার সম্পর্ক যে কত ঘনিষ্ঠ তা জানার জন্য বায়োলজিস্ট হওয়ার কোন দরকার পড়ে না। আমার বিশ্বাস, শুধু লেখকদের নয়; পাঠক, প্রকাশক, গ্রন্থ বিক্রেতা সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত না হলে অর্থাৎ স্বদেশের সাহিত্যের প্রতি নিবদ্ধ না হলে আমাদের সাহিত্যের দারিদ্র্য ঘোচানোর পটভূমিই রচিত হবে না। দেশের বই দেশের পাঠকরা না কিনলে কে কিনবে? এক সময় ফেরেস্তারা এসে নাকি মুসলমানের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করতেন কিন্তু বই-পুস্তক পড়ার মতো বীরতুহীন কাজে তাদের তেমন উৎসাহ আছে শোনা যায় নি। কাজেই দেশের অধিকাংশ লেখক মুসলমান বলে তারা এসে যে এখানকার বই-পুস্তক কিনে নিয়ে এখানকার সাহিত্যের সমৃদ্ধির পথ রচনা করে দেবেন তেমন ভরসা আমার নেই। এ বিষয়ে আমি চরম অবিশ্বাসী। 

তিরিশ বছরে সাহিত্য-শিল্পের মতো দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপারে খুব বেশি আশা করা সঙ্গত নয়। তবে দেখতে হবে গোড়াপত্তন ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা অর্থাৎ সাহিত্য-শিল্পের যে বুনিয়াদি শর্ত তা আমরা পালন করছি কিনা, পদক্ষেপটা পড়ছে কিনা ঠিকভাবে। সাহিত্য ধর্ম বা রাষ্ট্রের শেকলে কখনো বাধা থাকে নি। থাকবেও না কোনো কালে। কাফেরি ফতোয়া নজরুল ইসলাম বা পূর্বসূরী পারস্য কবিদের সাহিত্যের পথ থেকে ফেরাতে পারে নি। ইকবালেও শাস্ত্র-বিরোধী কথার অন্ত নেই। নজরুলকে যারা কাফেরি ফতোয়া দিয়েছিল, দেখা গেছে পরে তারাই হয়েছে গোঁড়া নজরুল-ভক্ত। সাহিত্যের ইতিহাসে এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটেছে। 

খাঁটি সাহিত্যের কাছে শাস্ত্রকে এমন কি রাষ্ট্রীয় শক্তিকেও একদিন মাথা নোয়াতে হবে–এ বিশ্বাসে আমি বিশ্বাসী। ইতিমধ্যেই মিসরে শাস্ত্র অনেকখানি পেছনে হটে গেছে। আধুনিকমনা পাঠক-সংখ্যা অগুনতি হলে শাস্ত্রের পশ্চাদগতি যে দ্রুত ও ত্বরান্বিত হবে এ বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। সাময়িকভাবে সবকিছুই রাহুগ্রস্ত হতে পারে। সাহিত্য একটা বন্ধনমুক্ত ব্যাপার–প্রথমে এ বোধটা থাকা চাই। তারপর চাই তার জন্য ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতি। শেষোক্ত ব্যাপারে আমরা ব্যর্থ, অনিচ্ছুক ও অপ্রস্তুত। সাহিত্য-শিল্প Whole time job। আমরা একজনও সেভাবে সাহিত্যকে নিই নি, সে অদম্য সাহিত্য-প্রেম আমাদের কারো নেই। তারাশঙ্কর মাত্র ত্রিশ টাকা আয় সম্বল করে পাইস হোটেলে খেয়ে কাটিয়েছেন বহুকাল–সে অবস্থায়ও সাড়ে চার শ’ টাকার চাকুরি প্রত্যাখ্যান করেছেন স্রেফ সাহিত্য-সাধনায় ছেদ পড়বে বলে। সবটুকু শক্তি আর অবসর নিয়ে সাহিত্য করেন বলে অন্নদাশঙ্কর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে আই.সি.এস.-এর চাকুরি ছেড়ে দিয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েও শুধু সাহিত্যের খাতিরে সরকারি চাকুরি নেন নি। বেসরকারি চাকুরিও যখনি দেখেছেন সাহিত্যের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখনই তা বিনা দ্বিধায় ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে এদের সাফল্যটা দেখেন, ত্যাগটা দেখেন না। ত্যাগের দীক্ষা যতদিন না হবে, ততদিন সাহিত্যের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল–এ শুধু এক সুখদ আশা হয়েই থাকবে।

আগেই বলেছি সাহিত্য অপ্রাকৃত, অপার্থিব বা অলৌকিক কিছু নয়–নয় কিছুমাত্র আধ্যাত্মিক ব্যাপার, অন্তত জন্ম বিকাশ আর প্রসারের বেলায়। অন্য দশটা পার্থিব আর লৌকিক ব্যাপারের মতই তারও বিকাশের ধারা একই। প্রয়োজন হলে, বিশেষ করে গঠনের যুগে ‘ক্লোজড মার্কেট’ বা সংরক্ষণ রীতি খুব ক্ষতিকর বলে আমার মনে হয় না। ‘সংরক্ষণ’ চাওয়া হচ্ছে নিছক অর্থনৈতিক স্বার্থে, যেভাবেই হোক অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষিত না হলে সাহিত্য আর সাহিত্যিক দাঁড়াতে পারবে না। এখন লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম বাংলার বই বাংলাদেশের বাজার ছেয়ে ফেলছে। লাইসেন্স তুলে দিয়ে এটাকে উন্মুক্ত বাজার ঘোষণা করলে অবস্থা আরো কাহিল হবে। 

সাহিত্যের ব্যাপারেও সব দেশেই অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার কোন না কোন ব্যবস্থা আজও আছে। ইংরেজি বহু বইয়ের গায়ে লেখা থাকে এই সংস্করণ কানাডায় বিক্রি নিষিদ্ধ, ঐ সংস্করণ আমেরিকায়, কোনোটা বা গ্রেটব্রিটেনে ইত্যাদি। এসবই তো অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার কলা-কৌশল। প্রকাশ-শিল্পের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে আইন করে ফরাসি প্রকাশকদের বাধা দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে কোনো বই কি পশ্চিমবঙ্গে বা কলকাতায় রপ্তানি হয়? পড়ার যোগ্য এক-আধটা বইও কি এখানে ছাপা হয় নি? 

শুধু আমদানি-নির্ভর কোন শিল্পই বাঁচতে পারে না, পারে না বাড়তে। বই পুস্তকও একটা শিল্প। দশটা পণ্যের একটা পণ্য। অন্য পণ্যের বেলায় বা সাধারণ নিয়ম বা রাষ্ট্রীয় বিধি তা বই-পুস্তকের বেলায়ও প্রযোজ্য বলেই আমার বিশ্বাস। পৃথিবীর তাবত মহৎ রচনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া ভালো। তাতে মনের আর জ্ঞানের চৌহদ্দি বাড়ে, শেখা যায় লেখার কায়দা-কানুন, মন হয়ে ওঠে বড় আর উদার–এসবে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন দেশের বা কোন শ্রেণীর লেখা বই না পড়লে। মহৎ কিছু যে সৃষ্টি করা যায় না, তা সত্য নয়। সত্য হলে রাশিয়ায়, চীনে–যেখানে কঠোরতম সংরক্ষণ বা ক্লোজড মার্কেট নীতি চলছে সেখানে কোন মহৎ সৃষ্টিই সম্ভব হতো না। কিন্তু তাতো সত্য নয়–সাহিত্যে, শিল্পে, সংগীতে, বিজ্ঞানে, চিত্রকলায় তারা তো ক্রমাগতই এগিয়ে চলেছে। শত্রুপক্ষের রিপোর্ট থেকেই তো এসব খবর আমরা জানতে পারছি। এমন কি ওসব দেশে অপ্রধান কবিদের কবিতার বইও নাকি লাখ কপির কমে ছাপা হয় না, আর তা নিঃশেষে বিক্রি হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যানুপাতে আমাদের দেশে বই-পুস্তুকের চাহিদা হলেই আমরা বেঁচে যাই। তা হচ্ছে না বলেই আমাদের আপত্তি।

‘সংরক্ষণ’ নীতি সব ক্ষেত্রে যে ক্ষতিকর তা আমার মনে হয় না। আমরা যে আজ অনেক বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভর হতে পেরেছি তা সংরক্ষণ-নীতিরই ফল। 

সংরক্ষণ-নীতি না হলে অনেক কল-কারখানাই এখানে গড়ে উঠতো না–কল কারখানা মানে শুধু উৎপন্ন দ্রব্য নয়, অগণিত মানুষের জীবিকা সংস্থানও। পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের ঝগড়ার একটা কারণ এই যে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের এমপ্লয়মেন্ট বা নিয়োগ সম্বন্ধে তারা মোটেই আমল দিচ্ছেন না। ওখানে যে কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এখানে সে রকম আর একটা প্রতিষ্ঠা না করার যে যুক্তি তারা দিয়ে থাকেন তা মানবীয় দিক থেকেও ভ্রান্ত। ‘সংরক্ষণ নীতি’ উঠে গেলে, আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের অনেক দৈনিক পত্রিকাই উঠে যাবে–এ উঠে যাওয়ার সঙ্গে শুধু যে মালিকদের স্বার্থ গ্রথিত তা নয়, অনেক সাধারণ মধ্যবিত্ত সন্তানের জীবিকার সম্পর্কও এর সঙ্গে জড়িত। বই পুস্তকও একটা শিল্প–এ শিল্পের ওপর শুধু যে লেখক-পাঠকের ভাগ্য নির্ভর করে তা নয়; প্রকাশক, মুদ্রাকর, দপ্তরি, ব্লকমেকার প্রভৃতি আরও তাদের হরেক রকম কর্মচারীর জীবিকার সম্পর্কও এ-শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। লেখক আর পাঠকের সহযোগিতা না হলে এ শিল্প কিছুতেই গড়ে উঠতে পারে না। চাহিদার ফলে যেমন নানা কল-কারখানা গড়ে উঠেছে, চাহিদার ফলেই যেমন আমাদের সংবাদপত্র শিল্পের প্রসার ঘটেছে তেমনি চাহিদার ফলেই সাহিত্যও গড়ে উঠবে, বৃদ্ধি পাবে তার প্রসার–যদিও অন্যগুলির তুলনায় সাহিত্য বেশ গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার।

সাহিত্যের জন্যও আত্মরক্ষা বড় কথা–এ আত্মরক্ষার জন্য ‘ক্ষুদ্রতা’ আর ‘সংকীর্ণতার’ অপবাদ কিছুটা শুনতে হলেও আপত্তি নেই। যদি বিশ্বসাহিত্য প্রতিষ্ঠাই আমাদের কাম্য হয়, তা হলে সব রকম ‘ক্ষুদ্রতা’ আর ‘সংকীর্ণতা’ পরিহার করে দেশগত বা জাতিগত কোন সাহিত্যের কথা না ভেবে, সহজেই আমরা সংরক্ষণ নীতি ছেড়ে ‘উন্মুক্ত বাজারে’ পা বাড়াতে পারি। কিন্তু দেশগত ও জাতিগত সাহিত্যের যদি কোন মূল্য থাকে আর তা যদি স্বীকৃত হয় তা হলে কোন না কোন রকমের সংরক্ষণ নীতির প্রয়োজন প্রাথমিক অবস্থায় অন্তত মানতেই হবে। চারা গাছে বেড়া দেওয়ার নিয়ম খুব অস্বাভাবিক নয়।

সাহিত্য গাছের ফল নয় যে আপনা-আপনি ফলবে, বাতি হয়ে পেকে ঝরে পড়বে, কেউ কুড়িয়ে চেখে দেখলেও দেখলে, না-হয় শিয়াল কুকুরে খেয়ে শেষ করলে–সে পরিত্যক্ত বীজ বা আঁটি থেকে আরো গাছ জন্মে দেশটাকে ফলফলান্ত করে তুলবে।

ঠাকুর বাড়ির ফুটফুটে ছেলেটার মোহে নিজের খাদা-নাকা আর কাদা-মাখা ছেলেটাকে অবহেলা করলে বংশ উজাড় হতে বেশি দেরি লাগবে না। কোলে তুলে নেবেন ঠাকুরবাড়ির ছেলেটা আর নিজের কালো ছেলেটা রবি ঠাকুর হলো না বলে আফসোস করবেন–এ আফসোসের কোনো মানে হয় না। নিজের ছেলেটাকে প্রতিপালন করে বাড়বার সুযোগ দিয়ে, স্নেহ দিয়ে, ভালোবেসেও প্রতিবেশীর ছেলেকে ভালোবাসা যায়, যায় আদর করা, প্রয়োজন হলে নেওয়া যায় পোষ্য। প্রতিবেশীর ছেলের চেয়ে নিজের ছেলে অপকৃষ্ট বলে তাকে উপেক্ষা করাতেই আপত্তি। এটা ‘সাম্প্রদায়িকতা কিংবা বিদেশ-বিদ্বেষ বা বিজাতি-ঘৃণা নয়। এ নেহাত জৈবিক আর স্বাভাবিক মানবীয় ব্যাপার। 

পরলোকগত বল্লভ ভাই প্যাটেল একবার কিছুটা শ্লেষের সঙ্গে বলেছিলেন, ভারতীয় কাপড় বিলাতের শিলমোহর নিয়ে এখন বাংলাদেশের বাজারে বিক্রয় হচ্ছে। একমাত্র সংরক্ষণ নীতির সাহায্যে আমরা সেই অসহায় অবস্থার হাত থেকে রেহাই পেয়েছি। একদিন বস্ত্র শিল্পের বাজারে যা ঘটেছিল এখন কি অবিকল সাহিত্যের বাজারে তা ঘটছে না? বাংলাদেশের ভারতীয় পুস্তকের ব্যাপক মুদ্রণ কি আমাদের সাহিত্য-প্রীতির পরিচায়ক, না কি ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির নমুনা? এতে কি আমাদের সাহিত্যের অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে? বিলাতের শিলমোহর মারা কাপড়ের সঙ্গে এর তফাত কোথায়? দুই-ই তো ফাঁকি আর দেশের অর্থনীতির ওপর চোরা আঘাত। বইয়ের ব্যাপারে শুধু অর্থনীতির ওপর নয়, সাহিত্যের ওপরও। 

সাহিত্যের মূল্য শুধু মানসিক নয়, তার একটা অর্থনৈতিক দিকও আছে। এ দিকের নিরাপত্তা ছাড়া সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্যের অসম্ভব প্রসার তার এক বড় নজির। আমরা যে বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য কিছুটা ‘সংরক্ষণ’ চাই তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ সংরক্ষণের অর্থ এ নয় যে, আমরা দেশ-বিদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে কোন সংযোগই রাখবো না। আমরা চাচ্ছি, আমাদের নির্মীয়মান সাহিত্যের জন্য কিছুটা আর্থিক নিরাপত্তা। দেশ-বিদেশের সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় রক্ষা করেও এ নিরাপত্তা কীভাবে রক্ষিত হতে পারে এ বিষয় অর্থনীতিবিদরা ভেবে দেখতে পারেন। 

আমার নিজের দু’টা নিবেদন : একটার কথা আগেই বলেছি, দেশের সাহিত্যের প্রতি অকৃত্রিম মমতা। দেশের বই-পুস্তককে নিজের সংস্কৃতি চর্চার অঙ্গ করে দেওয়া। হাজারো ব্যাপারে এমন কি যেখানে প্রাণের দায় (যেমন ঔষধপত্র) আছে সেখানেও আজকাল আমরা আর বিদেশের সঙ্গে তুলনা করি না। সাহিত্যের ব্যাপারেও কথায়। কথায় সে তুলনা নাই বা করলাম–অন্তত কিছুকাল।

আমার দ্বিতীয় নিবেদন : সাহিত্য আমদানির ব্যাপারে কিছুটা নির্বাচন নীতি গ্রহণ অর্থাৎ নির্বিচারে যে-কোন বইপত্র না এনে সাহিত্যমূল্য বিচার করে বই আমদানি করা। লাইসেন্স প্রথা থাকা সত্ত্বেও এখন সে নীতি পালিত হয় বলে মনে হয় না। যে কোনো উপযুক্ত লোক দিয়ে গঠিত কমিটির দ্বারা এ কাজ অর্থাৎ নির্বাচন সহজেই করানো যায়।

বয়স্কদের কথা নাই বা তুললাম। তারা যা হওয়ার তা হয়ে গেছেন, কিন্তু আমাদের যে ছেলে-মেয়ে আর ছাত্র-ছাত্রীরা বড়ো হয়ে উঠছে তাদের আজ দৈহিক খোরাক যোগাচ্ছে বাংলাদেশ, কিন্তু মানসিক খোরাক জোগাচ্ছে অন্য দেশ বা দেশের সাহিত্য। যদি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের আর স্বতন্ত্র জাতীয়তায় বিশ্বাস করা হয় তা হলে এটা কি শুভ লক্ষণ? এরা কি একদিন অন্তর্দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হবে না? দেশাত্মবোধ আর জাতীয় চেতনা জাগিয়ে তোলা কি সাহিত্যেরও এক কাজ নয়? সব দেশে জাতীয় সাহিত্য আর সংস্কৃতির বুনিয়াদ পাকা করে নিয়ে তবে বিশ্বসাহিত্য বা বিশ্ব-সংস্কৃতির দিকে পা বাড়ানো হয়, আমাদের যাত্রা কি অনেকটা বিপরীত দিক থেকে শুরু হয় নি? অবশ্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র বা জাতীয়তায় বিশ্বাস না করলে এসব প্রশ্ন আদৌ ওঠে না।

বাংলাদেশের সাহিত্য বন্ধ্যা হয়ে আছে–এ আমি বিশ্বাস করি না। এখনো আশানুরূপ প্রাচুর্য হয়তো দেখা দেয় নি, তার পেছনে বহুতর কারণ রয়েছে। পাঠকের সহযোগিতা পেলে, এখানকার সাহিত্যের পাঠক সংখ্যা যদি বৃদ্ধি পায় আমাদের সাহিত্যের যে দারিদ্র্য দেখে আমরা আজ কিছুটা হতাশা বোধ করছি তা আর থাকবে না। সাহিত্যের শৈশব দীর্ঘ বলে মাতৃস্নেহও দীর্ঘস্থায়ী হওয়া উচিত। অনেক সময় প্রকাশকরাই পাঠক তৈরি করেন, আমাদের আজো তেমন একটি প্রকাশক সংস্থাও গড়ে ওঠে নি। সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারেও কোন ভালো বই (মন্দ বইও) প্রকাশিত হলে আমরা তার খবর পাই কী করে? কেমন করে ওসব বই ঢাকা-চাটগাঁর বাজারে এসে পৌঁছে কোনো কোনোটা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই। সুষ্ঠু প্রচার ব্যবস্থার ফলেই এসব ঘটে থাকে। অথচ ঢাকায় প্রকাশিত অনেক বইয়ের খবর আমাদের মফস্বল শহরের স্কুল-কলেজেও কোনোদিন পৌঁছে না। এখন আমাদের অনেকের স্বদেশে সাহিত্যের প্রতি একটা উন্নাসিক মনোভাব রয়েছে–অন্যান্য দেশে সাহিত্য কীভাবে গড়ে উঠেছে সে ইতিহাস অধ্যয়ন করলে এ মনোভাব অনেকখানি দূর হবে। প্রাথমিক অবস্থায় মহৎ সব কিছুর প্রতি একটা অটল নিষ্ঠা থাকা চাই; অনেক সময় সে নিষ্ঠা হয়তো গোঁড়ামির কাছাকাছি গিয়েও পৌঁছে। তবে স্মরণীয়: সাহিত্যই যোগায় সব রকম গোঁড়ামির সীমা পেরিয়ে উদার সূর্যালোকে পৌঁছার প্রেরণা। 

[‘সাহিত্যের একটি সমস্যা’ ১৯৬৪-তে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যে বন্ধ্যাত্ব কেন?’ শীর্ষ আলোচনার অংশ হিসেবে ধারাবাহিক ভাবে দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত। পরে এটি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবন গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *