প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

সাহিত্যের ভূমিকা

সাহিত্যের ভূমিকা

চিন্তা, ভাব, আবেগ, অনুভূতি, কল্পনা–এ সবই যেমন একদিকে সাহিত্যের উপজীব্য, তেমনি অন্যদিকে এ সবকে জাগিয়ে তোলা, এ সবের দিগন্ত প্রসারিত করাও সাহিত্য শিল্পের এক প্রধান ভূমিকা। আর এ সবেরই ফলশ্রুতি যে সভ্যতা, সংস্কৃতি, তমুদুন ও সার্বিক মানব-চেতনা এ বিষয়েও বোধ করি দ্বিমত নেই। বলা বাহুল্য, চিন্তাই এসব কিছুর মৌল উৎস। তাই চিন্তার উত্তরাধিকার সবচেয়ে বড় উত্তরাধিকার–মহত্তম মিরাছেহ। চিন্তার ক্রমবিকাশের সঙ্গে মানব-সভ্যতার ক্রমবিকাশ একই সূত্রে নিবিড়ভাবে গ্রথিত। যুগ যুগ ধরে চিন্তার বিচিত্র ধারা আত্মপ্রকাশের প্রধান বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছে ভাষা আর সাহিত্যকে। ফলে চিন্তার বৈচিত্র্য আর সমদ্ধির সাথে সাথে ভাষা আর সাহিত্যও হয়ে উঠেছে বিচিত্র আর সমৃদ্ধ। ভাবের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে ও চিন্তায় জোয়ার এলে তার প্রকাশেও গতিশীলতা আর বর্ণবৈচিত্র্য অনিবার্য। তাই ভাবের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও বিকাশ হয়েছে অবাধ ও বহুমুখী। 

সামান্য ক্ষীণ কণ্ঠের কান্না আর ক্ষুদে ক্ষুদে হাত পা নাড়া নিয়ে যার অস্তিত্বের সূচনা তার যে চিন্তা ও ভাবের এমন অগ্নিগর্ভ উৎস রয়েছে তা ভাবা যায় না। তাই অবাক কণ্ঠে ফ্রাঙ্ক হ্যারিস (Frank Harris) এমন ধর্ম-বিরোধী উক্তি করতেও দ্বিধা করেন নিঃ ‘The course of the progress of human thought is to me the only revelation of God,’ হ্যারিসের এ উক্তি শুনে মার্কস নাকি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠেছিলেন:Wonderful! Excellent! অত্যন্ত প্রতিকুল ও বিরুদ্ধ প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রামে চিন্তার এ ক্ষুদ্র বীজটুকুই ছিল মানুষের একমাত্র হাতিয়ার। এ হাতিয়ার দিয়েই সে আত্মরক্ষা করেছে, প্রতিষ্ঠা করছে নিজেকে, করেছে দিগ্বিজয়, হয়েছে জয়ী সব কিছুর ওপরে–সৃষ্টির সেরা বলে লাভ করেছে স্বীকৃতি।

সে চিন্তা আজ আমাদের সাহিত্যে অনেকখানি অস্বীকৃত–একদল প্রাচীন চিন্তার জাবর কেটেই আত্মতপ্ত, অন্যদল পরিবেশ আর জীবন-বিচ্ছিন্ন এক রকম পল্লবগ্রাহিতাতেই খুজছে নিজেদের আত্মপ্রকাশের পথ। বলা বাহুল্য, এর কোনোটাই সাহিত্যে সার্থকতার পথ নয়। এ দুই-ই জীবনবিমুখতা শুধু নয় বাস্তবমুখতাও। ফলে সাহিত্য-শিল্পের যে আসল ভূমিকা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সমন্বয় সাধন, তা আমাদের মনের দিগন্ত থেকে আজ অনেকখানি অপসৃত। আঙ্গিকে চমৎকারিত্ব আর ভঙ্গি আজ যতখানি আমাদের সাধনা আর চর্চার বিষয় সে অনুপাতে নবতর কোনো চিন্তার স্ফুলিঙ্গ খোঁজায় ও সন্ধানে আমরা অনেক বেশি উদাসীন। চিন্তার তেমন কোনো চমক আজো আমাদের রচনায় অনুপস্থিত। নবতর সত্যের তথা চিন্তার সন্ধান দুরূহ ব্যাপার কিন্তু তার জন্য অনলস। সাধনা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো অপরিহার্য–লেখকের তো ওই পথ। 

আমাদের আধুনিক সাহিত্যের অনেকখানি যে বিভিন্ন বিদেশী সাহিত্যের ফলশ্রুতি অর্থাৎ বই পড়ে পাওয়া তাতে সন্দেহ নেই (এ কথা নিন্দা অর্থে বলছি না)। কিন্তু বিদেশী সাহিত্যে শুধু তো আঙ্গিক চর্চাই হচ্ছে না, চিন্তা চর্চাও হচ্ছে। বহু পথ মাড়িয়ে এসে এলিয়ট শেষে ধর্মে জীবনের সমন্বয় খুঁজেছেন–সাত্রে সন্ধান করেছেন তার অস্তিত্ববাদে। এসব অভ্রান্ত সত্যের পথ নাও হতে পারে কিন্তু এদের সন্ধান বা অসীম পরীক্ষা-নিরীক্ষাটা তো মিথ্যা নয়। শিল্পীর জন্য পৌঁছাটা বা গন্তব্য তো কোনোকালেই বড় কথা নয়–চলাটাই বড় কথা। আর সে চলা হবে নিজের শক্তি অনুসারে নবতর চিন্তার পথে। যা প্রকাশেও নবত্ব আর বৈচিত্র্য না এনে পারে না। 

বলা হয়, শিল্প জীবনের অনুকরণ–আদিতে হয়তো তাই ছিল শিল্পের ভূমিকা। আর তখন তার মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল আনন্দ দেওয়া। মানুষের জীবন ক্রমাগত বিশ্বের সঙ্গে সংগ্রামের জীবন–এ সংগ্রামের ভেতর দিয়েই সে বিশ্বের সঙ্গে সমঝোতায় এসেছে। এ সমঝোতা বা সমন্বয় সন্ধান নানাভাবে নানারূপে সাহিত্য-শিল্পে প্রতিফলিত। এ সমন্বয় সন্ধানের যেমন ইতি নেই তেমনি সাহিত্য-শিল্পেরও নেই ইতি। তাই সাহিত্য অনন্ত পথের পথিক। 

সমাজের আদিম রূপ অবিকৃত নেই কোথাও–সমাজের সর্বত্র ক্রমাগতই রদবদল চলছে। ফলে জীবনে সমন্বয় প্রচেষ্টার রূপেরও ঘটছে বদল। সাহিত্য-শিল্পে যুগান্তর বা পরূপান্তরেরও মৌল কারণ এখানেই। সাহিত্যের ভূমিকা শুধু অতীত-বর্তমানে সীমিত নয়–ভবিষ্যৎও তার চিন্তা-ভাবনার বিষয়, তার বিষয়-বস্তুও উপজীব্য। বিশ্বের সঙ্গে জীবনের মিতালি একদিন দুদিনের ব্যাপার নয়–অনন্তকালের সমস্যা। জীবিতদের ছাড়িয়ে অজাতদের সীমা পর্যন্ত তাই শিল্পীর দৃষ্টি প্রসারিত। তবে বর্তমানের প্রতি দায়িত্ব। পালন না করে ভবিষ্যতের প্রতি দায়িত্ব পালনের কথা স্রেফ আকাশ-কুসুম রচনা। 

সময়ের পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের ভূমিকারও পালা বদল ঘটতে বাধ্য–এ কথাটাই বলতে চাচ্ছি। তা উপলব্ধির জন্য চিন্তা আর ভাবের বর্ষণ প্রাথমিক শর্ত। ভাবের অভাব ঘটলেই আঙ্গিকের চাকচিক্য আবশ্যক হয়ে পড়ে। সুন্দরীর জন্য প্রসাধন বা অলঙ্কারের আধিক্য বাহুল্য। সাহিত্য যদি চরিত্রের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে ব্যর্থ হয় তাহলে জীবনের সংগ্রামে তথা জগতের সঙ্গে সমন্বয় সাধনে সাহিত্যের যে বিশেষ ভূমিকা তা পরিণত হবে ব্যর্থতা-হতাশায়। তাই সাহিত্য ও সব রকম শিল্পকর্মে চিন্তা বা ভাবের কিছুটা তড়িৎস্পর্শ থাকা চাই। ‘The thing that gives people courage is idea’ (জর্জ ক্লিমেনসো) রোলাঁ আরো একটু এগিয়ে গিয়ে বলেছেন : ‘Every honest Idea, even when it is mistaken, is sacred and divine.’ 

‘পবিত্র’ বা ‘ঐশ্বরিক’ এসব কথার ওপর আমি কোনো জোর দিতে চাই না। কারণ, আধুনিক মানুষের কাছে তার কোনো আবেদন নেই। কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভাব অর্থাৎ আইডিয়া অমূল্য বলে লেখকের কাছে তা মূল্যবান। মোপাসাকে নাকি ফ্লবেয়র (Flaubert) লেখা সম্পর্কে এ উপদেশটুকু দিয়েছিলেন : Mistrust everything. be honest, Be straight-forward. Despise cleverness.’ আজ আমাদের কাছে শেষোক্তটাই কি অগ্রাধিকার পাচ্ছে না? শুধু রচনায় নয় জীবনেও আজ আমরা অনেক বেশি চালাক’। এ ব্যাপারে প্রবীণরা নাকি নবীনদের ছাড়িয়ে গেছেন। ভাব বা চিন্তার ব্যাপার তো ‘চালাকি’ নয়। মনের ভেতর বেশ কিছুটা গভীর উপলব্ধি থেকেই তার উদ্ভব। আশ্চর্য, আমরা আজ আমাদের প্রবীণ লেখকদের কাছ থেকেও কোনো চিন্তার কী ভাবের কথা শুনতে পাচ্ছি না। সততা আর সত্যভাষণ ছাড়া কোনো রচনাই সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে না। এই দুই গুণ ছাড়া রচনার পরিণতি লাভও সম্ভব নয়। 

সন্দেহ বা কিছুটা অবিশ্বাসও শিল্পের ক্ষেত্রে মূল্যহীন নয়। ইবনে রুশদ বলেছেন মঙ্গলের গোড়া হলো সন্দেহ। যে বহির্জগতের সঙ্গে নিয়ত সমঝোতার সংগ্রামই মানুষের বিধিলিপি, বিনা প্রশ্নে তার সব কিছু মেনে নিলে হাতিয়ারের ধারটাই যায় ভোতা হয়ে। মানুষের পরিবেশ তথা সমাজ সভ্যতা সব কিছুই তখন হয়ে পড়বে স্থবির। জিজ্ঞাসা তাই শিল্পী-মনের এক বড় শর্ত–বহু প্রেরণার এক উৎস-মুখ। এর ফলে সাহিত্য হয় বিচিত্রগামী, হয়ে ওঠে বহুমুখী। 

আমাদের সাহিত্যের আজ এ বহুমুখীনতার অভাব। লেখকের আয়ত্তের বাইরে এমন নানা কারণেও আমাদের লেখকেরা হতে পারছেন না জিজ্ঞাসা-মুখর বা বেপরোয়া। সাহিত্য-শিল্পের ব্যাপারে সমাজ বা রাষ্ট্রকে আরো সহিষ্ণু হতে হবে। এ সহিষ্ণুতার পথ রচনার দায়িত্ব কিন্তু সাহিত্যিক-শিল্পীদের। রাজনৈতিক ক্ষমতার সাহায্যে এ পালা বদল ত্বরান্বিত করা যেতে পারে বটে কিন্তু সে তো পেশাদার রাজনীতিবিদদের দ্বারা হবে না। আর সাহিত্যিক-শিল্পীরা বা তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সংগ্রামে কোনোদিন শরিক হবে তাও ভাবা যায় না। তাই ওই পথ পরিত্যাজ্য। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কোনো রাজনৈতিক দল যদি আইনের সাহায্যে তেমন একটা পরিবেশ গড়তেও চায়, জনসাধারণের সার্বিক সমর্থন ছাড়া তাও ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাই শেষ। পর্যন্ত সাহিত্যের সমৃদ্ধি, বৈচিত্র্য, নব নব পথে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দুঃসাহসিক অভিযান সব কিছুই নির্ভর করছে পাঠক বা জনসাধারণের ওপর। তাদের গড়ে তোলার দায়িত্ব লেখকদের। বিভিন্ন, বিচিত্র আর নব নব চিন্তা পরিবেশন ছাড়া অবশ্য সাহিত্যের লেবাছ এর অন্য কোনো পথ আমার জানা নেই। ‘আমোদ’ দিয়ে এ হবে না–এ বিষয় আমি স্থির নিশ্চিত। ‘আমোদ’ সংগ্রামের আনুষঙ্গিক হতে পারে০০মৌল উপাদান হতে পারে না কিছুতেই। একমাত্র সুস্থ চিন্তাই জীবনের সমন্বয় সাধনে সক্ষম। সে চিন্তার অভাব আমাদের সাহিত্যে পরিলক্ষিত বলেই কথাটা উত্থাপন করলাম। রচনায় চিন্তার দিগন্ত আরো প্রসারিত করার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। আমাদের মানে লেখকদের। 

[১৯৬৬] 

[‘সাহিত্যের ভূমিকা’ প্রথম প্রকাশিত হয় মাহেনও পত্রিকার মার্চ ১৯৬৬ সংখ্যায়। পরে এটি সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধে সংকলিত হয়।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *