শিল্পীর স্বাধীনতা
‘মানুষের নিজস্ব বলতে একমাত্র জিনিস হচ্ছে স্বাধীন চিন্তা’–ডায়োজিনিস (খ্রি. পূ. ৪১২-৩২২)।
‘To differ from the state does not imply an absence of patriotism and that possibility of making such difference effective is the main safeguard we have against servility in society which the State controls… In this way reason has a chance of victory in human affairs. In alternative lies a slavery both intellectual and moral.’
কথাগুলি বলেছেন সমাজ-বিজ্ঞানী হারল্ড লাসকি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো যোগ করেছেন: ‘The power, in short, to call the state to account, is essential to freedom.’
রাষ্ট্রের সুরে সুর না মেলালেই মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহী হয় না, হয় না রাষ্ট্রের দুশমন বা সমাজের শত্রু। যে সব বৃত্তি মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে তার মধ্যে সবার সেরা হচ্ছে reason বা যুক্তি। মানব সভ্যতার সব উপকরণ যে যুক্তিচর্চার ফল তা বোধ করি। দ্বিতীয়বার বলার তোয়াক্কা রাখে না। যুক্তি তথা reason-এর চর্চা অব্যাহত রাখতে, আর সমাজকে নৈতিক ও মানসিক দাসত্বের হাত থেকে বাঁচাতে হলে–স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ও সেই চিন্তাকে প্রকাশ ও গ্রহণ করার অধিকার মানতেই হবে–সমাজকে দিতেই হবে সেটুকু স্বাধিকার। নইলে স্বাধীনতার কোনো মানেই থাকে না।
বাংলা ভাষার প্রায় সব বড় কবি শিল্পী সাহিত্যিকের জন্ম পরাধীনতার যুগে। সে আবহাওয়া ও পরিবেশে তারা রচনা করেছেন তাদের সাহিত্য, যে সাহিত্য তাবত প্রাদেশিক সাহিত্যকে ছাড়িয়ে গেছে এবং নোবল প্রাইজ পর্যন্ত জয় করে আনতে হয়েছে সক্ষম। বিদেশী শাসকদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও অধিকারে হস্তক্ষেপ না করলে তারা আমাদের মানস চর্চা নিয়ে কিছুমাত্র মাথা ঘামাত না। সেদিনের পরাধীনতা ছিল মূলত রাজনৈতিক। ইংরেজদের রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে শিল্পী ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। ধর্ম, সমাজ ও প্রচলিত সংস্কার সম্বন্ধে দেশের লেখকরা বেপরোয়াভাবেই কলম চালিয়েছেন সেদিন। যার ফলে বাংলাদেশের সামাজিক উন্নতি এত দ্রুত ও নতুন ধর্মান্দোলন এত সহজ ও সম্ভব হয়েছে। তাই তো মধুসূদনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে জনপ্রিয় দেবতা বা দেবতুল্য রামচন্দ্রের চেয়েও রাক্ষসরাজ রাবণকে বড় করে আঁকা। ধর্মের দিক থেকে এ নিন্দনীয় হতে পারে কিন্তু শিল্পের দিক থেকে এ অনিন্দ্য এবং রসোত্তীর্ণ। রবীন্দ্রনাথ আস্ত দেব মূর্তিকে গোমতীর জলে নিক্ষেপ করে তাকে লক্ষ করে বলেছেন—’গেছে পাপ’ (বিসর্জন)। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ তো সাক্ষাৎ কালাপাহাড়ি কাণ্ড। শিল্পীর জন্য যে টুকু স্বাধীনতা অত্যাবশ্যক–পরাধীনতার যুগে সে টুকু স্বাধীনতা আমাদের ছিল, পুরোপুরিই ছিল। নজরুল যখন কারাগার আর শাসকদের মাথা ভাঙার কথা বলেছেন, তখনি মাত্র তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে, তাও রীতিমত বিচার করে ও নির্দিষ্টকালের জন্য। শরৎচন্দ্র যে বইতে সশস্ত্র বিপ্লবের ছবি এঁকেছেন তার শুধু সে বইটাই সেদিন বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। ধর্মের বিরুদ্ধে, সমাজের জনপ্রিয় সংস্কারের বিরুদ্ধে কমলের মুখ দিয়ে, কমল রাজলক্ষ্মীর মুখ দিয়ে কী বেপরোয়াভাবেই না তিনি তার মনের ঝাল ঝেড়েছেন। শাসকরা সেদিকে ফিরেও তাকায় নি। সমাজের বিরুদ্ধে, চলতি সংস্কারের বিরুদ্ধে অর্থাৎ মনের শেকল ভাঙার হেন কথা নেই যা রবীন্দ্রনাথ বলেন নি। অথচ শাসকগোষ্ঠী সেই রবীন্দ্রনাথকে সম্মান করেছেন ‘নাইট’ উপাধি দিয়ে। স্বাধীনতার আগে আমাদের মাত্র দুটি স্থায়ী সাহিত্য মাসিকী ছিল–সওগাত ও মাসিক মোহাম্মদী। আমাদের অনেকের সাহিত্যে হাতেখড়ি হয়েছে এ দুটির পাতায়। এ দুটির সম্পাদক ও পরিচালকরা কখনো বামপন্থী ছিলেন না–বরং শেষোক্তটির পরিচালকদের দক্ষিণপন্থীদের মধ্যেও দক্ষিণতম বলা যায়। তবু এঁরা সে যুগের লেখকদের প্রকাশের স্বাধীনতা পুরোপুরি মেনে চলেছেন ও দিয়েছেন। তাদের এ ভূমিকা ঐতিহাসিক এবং সপ্রশংস মনে স্মরণ রাখার যোগ্য। সেদিন নিছক মতামতের জন্য তারা আমাদের কোনো লেখাই প্রত্যাখ্যান করেন নি।
স্বদেশে ইংরেজ সন্তান যে শাসনতন্ত্রের আওতায় মানুষ সেই শাসনতন্ত্র অত্যন্ত সহিষ্ণ। বিরোধীপক্ষ সেখানে রীতিমত স্বীকৃত ও সম্মানিত–Her majesty’s Government-এর পাশে Her Majesty’s opposition-এর স্থান। এ পরিবেশে মানুষ হওয়ার ফলে ইংরেজ সমালোচনাকে যে শুধু সহ্য করে তা নয়, তাকে জানায় স্বাগত। ইংরেজের এ মনোভাব তার সাহিত্যেও প্রতিফলিত–অন্য অনেক বিষয়ের মত ইংরেজি সাহিত্যের সমালোচনাংশেরও কোনো তুলনা নেই। অথচ সমালোচনা-সাহিত্য অন্য কোনো ভাষায় এখনো গড়ে ওঠে নি। আমার বিশ্বাস, ইংরেজ লেখকেরা যে অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে এটি তারই ফল। ইংল্যান্ডের শাসনযন্ত্র কদাচিৎ সাহিত্য-শিল্পের গায়ে হাত তোলে। আমাদের স্মরণকালের মধ্যে যেটুকু হস্তক্ষেপ হয়েছে তা ইংরেজদের টনটনে নীতিবোধকে আঘাত করার ফলেই হয়েছে। তাও সাময়িকভাবে। কমিউনিজম সম্বন্ধে ইংল্যান্ডে ও ইংরেজি ভাষায় যত বই লেখা হয়েছে, রাশিয়ার বাইরে অন্য কোনো ভাষায় অত বই লেখা হয় নি। তবুও ওই নিয়ে ইংরেজের কোনো দুশ্চিন্তা নেই। পুঁজিবাদী ইংল্যান্ড ওসব বই কেনে আর গোগ্রাসে গেলে। না হয় ওসব বইয়ের এত সংরক্ষণ হয় কী করে? ওয়েব-দম্পতি তো বনিয়াদি ইংরেজ; আর সর্বাগ্রে পশ্চিম মুলুকে তারাই তো কমিউনিস্ট-রাশিয়া সম্বন্ধে প্রামাণ্য বই লিখেছেন। এমন কি বিশ্ববিখ্যাত কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো পর্যন্ত রচিত হয়েছিল ইংরেজ জাতির নাভি-কেন্দ্র লন্ডনে! আবার ইংল্যান্ডে যদিও কমিউনিস্ট পার্টি রীতিমত আইনসঙ্গত কিন্তু তারা ভোট পায় সবচেয়ে কম।
ভোট দেওয়ার সময় ইংরেজ ভোট দেয় ‘রক্ষণশীল’কে না হয় ‘শ্রমিক’কে। ওখানে নাগরিকদের রয়েছে বিচার গ্রহণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা।
ইংরেজের কনস্টিটিউশন শুধু ইংরেজের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণাকে গড়ে তোলে নি তার সামাজিক ও ব্যক্তিমানসকেও গড়ে তুলেছে। তাই কোনো চরম পন্থায় সে ধা করে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। ক্ষমতার অপব্যবহার বা বেপরোয়া ব্যবহারও তাই ওখানে অত্যন্ত সীমিত।
সমাজ বা মনোবিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ ক্ষমতা বস্তুটিই এক অদ্ভুত নেশা। লাগাম বা শাসন না থাকলে এ নেশা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। তখন কোনো reason-এর ধার ধারে না তা, তোয়াক্কা করে না কোন যুক্তির। অবশ্য ব্যতিক্রম সব কিছুরই আছে। ক্ষমতার মনোভাব হল–আমি যা ভাল মনে করি তাই একমাত্র ভালো–অদ্বিতীয় ভালো, জুনসাধারণ তা মেনে নিতে বাধ্য। এ অবস্থায় যারা নিজের বিবেককে ঘুম পাড়িয়ে ক্ষমতার ‘ইয়েসম্যান’ হতে পারলেন তারা বেঁচে গেলেন। বেঁচে গেলেন শুধু নয়, তাঁদের এক রকম পোয়াবারো অবস্থা। কিন্তু যে হতভাগ্যরা কথায় কথায় ইয়েস বলতে পারল না তারাই হল রাষ্ট্রদ্রোহী। যে দেশে এ পরিস্থিতি দেখা দেয় সেখানে জাগ্রত-বিবেক শিল্পীরা অত্যন্ত বেকায়দায় পড়ে যান–কোনো না কোনো অজুহাতে তারা হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রের শিকার। এটা কোনো দেশ বিশেষের কথা নয়, প্রায় সব দেশে, সব যুগে এ রকম পরিস্থিতিতে এ রকম পরিণতিই হয়েছে।
ইতিহাসে প্রায়ই দেখা যায়–অবাধ ক্ষমতার অধিকারী নিজেকে মনে করেন সর্বেসর্বা, সিজার পত্নীর মত তিনি সব সন্দেহের অতীত। জনসাধারণের ভাল-মন্দের একমাত্র মানদণ্ড তার ইচ্ছা বা অনিচ্ছা। এরা হয়ত আন্তরিক ও খাঁটি। Aristotle অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গেই বিশ্বাস করতেন—’Slavery is good for slaves’। কিন্তু সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, এ আন্তরিকতার দাম কতটুকু? জনাব হিটলারও মনে। করতেন তিনি যা ভাল মনে করতেন তাই হচ্ছে জার্মানির জন্য একমাত্র ভাল। তার ওপর–‘Herr Hitler does not doubt that his conception of German wellbeing must be-enforced upon his critics in their own interest. (E.M.Forster) ভয়াবহ যুক্তি! আর এ যুক্তির কী ভয়াবহ পরিণতি!
১৩ই মে, ১৯৩৩। জার্মানির বিশ্ববিখ্যাত বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পঁচিশ হাজার বই, বই তো নয়, মানবাত্মার পঁচিশ হাজার প্রস্ফুটিত পুষ্প স্তূপীকৃত। হিটলারের আদেশে ওই স্কুপে করা হল অগ্নিসংযোগ। মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল মানব প্রতিভার এক বিরাট অবদান, বার্লিনের আকাশ লালে লাল–সেই বহ্নিউৎসব দেখতে চল্লিশ হাজার নর-নারী নাকি সমবেত হয়েছিল আর তাদের উল্লাস-ধ্বনি নাকি শোনা গিয়েছিল বহুদূর পর্যন্ত। এ দিন যাদের রচনা উৎসব করে পোড়ানো হয়েছিল তার মধ্যে ফ্রয়েড, এরিখ মারিয়া রেমার্ক প্রভৃতির লেখাও ছিল। এই বিংশ শতাব্দীতে যে বর্বরতার কথা ভাবাই যায় না, ক্ষমতার নেশা মানুষকে দিয়ে সেই বর্বরতাও এভাবে করিয়ে নেয়। হিটলারের জার্মানিতে Heine-এর লেখা নিষিদ্ধ ছিল। জার্মানির তথা সারা ইউরোপের অন্যতম মহাপ্রতিভা গ্যেটের লেখা যদিও বাজেয়াপ্ত করতে হিটলারের মত দুঃসাহসীরও সাহসে কুলায় নি কিন্তু হিটলারের ‘কালো তালিকায় গ্যেটের নামও নাকি ছিল এবং তাঁকে মনে করা হত জার্মান ও জার্মানি ‘কুলটুরের’ দুশমন। জার্মানির এ যুগের সেরা সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিকরা জার্মানি থেকে নির্বাসিত হয়েছেন–মান ও আইনস্টাইন দেশ ছেড়ে গিয়ে ধনে না হলেও প্রাণে বেঁচেছিলেন। এঁদের বিরুদ্ধে একমাত্র অভিযোগ: এঁদের রচনা ‘অ-জার্মান’; অর্থাৎ হিটলারের সুরের সঙ্গে এঁদের সুর মিলছে না, মেলে নি। এঁরা মেলাতে পারেন নি। এঁরা কিছুতেই হন নি হিটলারের ‘ইয়েসম্যান’।
কিন্তু ইতিহাসের কী নির্মম প্রতিশোধ! ইতিহাসের পাতায় একটি কালো দাগ মাত্র রেখে অত বড় দোর্দণ্ডপ্রতাপ হিটলার আজ নিশ্চিহ্ন। আর যাদের তিনি নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন তারা আবার ফিরে এসেছেন জার্মানির ইতিহাসের পাতায়, জার্মানিকে ছাড়িয়ে এরা চিরজীবী হয়ে আছেন মানুষের মনে মনে।
তবুও এক শ্রেণীর শাসক চিরকালই সাহিত্য-শিল্পকে সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে এবং তাকে দমন করে কাবু করে রাখতে চেষ্টার ত্রুটি করে নি। কিন্তু সাহিত্য-শিল্পের ঐতিহ্য এত সুদীর্ঘ ও মানুষের আত্মার সঙ্গে তা এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে তার মূলোৎপাটন করতে হলে গোটা মানব-বংশের মূলোৎপাটন করতে হবে। যা করা কোনো হিটলার বা তার অনুকারকের পক্ষেই সম্ভব নয়।
মানুষ বিকাশধৰ্মী জীব–তার বিকাশের জন্য এ যাবৎ যত উপায়-উপকরণ আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে সাহিত্য-শিল্প শ্রেষ্ঠতম। এই বিকাশ-ধর্ম মানুষের এত সহজাত যে–মানুষকে মানুষ রেখে এর লোপ-সাধন কিছুতেই সম্ভব নয়।
বলা বাহুল্য, পোষা বাঘ যেমন পুরোপুরি বাঘ নয়, তেমনি পোষা শিল্পীও খাঁটি শিল্পী নয়। শিল্পীর জন্য স্বাধীনতা–বিকাশের স্বাধীনতা, প্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য। যেমন অপরিহার্য পুরোপুরি বাঘ হওয়ার জন্য স্বাধীন অরণ্য-জীবন। সার্কাসের রয়াল বেঙ্গল টাইগারের চেয়ে বনের কেঁদো বাঘ যে অনেক বেশি বাঘ তা বোধ করি সকলেই স্বীকার করবেন।
দুর্দান্ত শাসকেরা চিরকালই শিল্পীর স্বাধীনতাকে হরণ করতে ও দমন করতে চেয়েছে। আজও বহু দেশে তার দৃষ্টান্তের অভাব নেই। কিন্তু এসব দুশ্চেষ্টা বার বারই ব্যর্থ হয়েছে, সামনেও হবে। এক চক্ষু হরিণের মত ক্ষমতার নেশায় পাওয়া শাসকরা কিন্তু তা দেখতে পান না বা দেখেও না দেখার ভান করেন।
বোরিস পাস্তেরনাককে নিয়ে যে কাণ্ডটা ঘটে গেল তা শাসকদের এ অদূরদর্শিতার আর এক নিদর্শন। তবে হিটলার তার দেশের সাহিত্যিক-শিল্পীদের প্রতি যে বর্বর ব্যবহার করেছেন সে তুলনায় পাস্তেরনাকের ভাগ্য অনেক ভালই বলতে হবে। তাকে শুধু নোবেল প্রাইজ নিতেই দেওয়া হয় নি, তা ছাড়া সরকারি বাড়ি, গাড়ি ও ভাতা থেকে তিনি নাকি বঞ্চিত হন নি। তবে জিজ্ঞাসা, এই ব্যবহারিক সুবিধাই কি শিল্পীর জন্য সবটুকু? ওইটুকু আরাম-আয়েস নিয়ে কি শিল্পী সন্তুষ্ট থাকতে পারেন? না পারেন ইচ্ছামতো রচনায় আত্মনিয়োগ করতে! শিল্পীর জন্য মনের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতা, প্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য। বোরিস পাস্তেরনাকের সেই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ ঘটেছে এটিই আপত্তিকর, এর বিরুদ্ধেই আমাদের প্রতিবাদ। এর ফলেই কি পাস্তেরনাক আজ অনুবাদ কার্যে আত্মনিয়োগ করেছেন? রাষ্ট্রের প্রতিকূল নীতির ফলে প্রতিভাবান শিল্পীরা যদি সৃষ্টির পথ থেকে দূরে সরে থাকেন তাহলে ক্ষতিটা কার? সমগ্র দেশের ও সাহিত্যের ক্ষতি নয় কি? উপন্যাসের ক্ষেত্রে রাশিয়া ছিল একদিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী–আজ কি তা আর বলা যায়?
অবশ্য পশ্চিমি দেশগুলিতে পাস্তেরনাককে নিয়ে যে যথেষ্ট বাড়াবাড়ি ঘটে নি তা নয় : In a letter to the New York Herald Tribune published today (Nov. 15, 1958) Aleksis Rannit, President of the Estonian Literary Society and Vice President of the International PEN Club centre for writers in exile, decried the ‘indelicate way in which the Nobel Prize was announced.’ He said there was really no need to mention ‘Dr. Zhivago,’ it is the author’s intensely symbolized and very originally insrumented poetry, anyway, which makes Pasternak truly great. He also decried the sending of congratulatory telegrams and appeals and the ‘unwarranted’ invitations of American communities asking Pasternak to settle down in the United States. These people, he wrote, were not thinking one single second that this is an invitation to join the deadly enemy of the Soviet Union.’ (UPI) কাজেই শিল্পগত কারণে নয়, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে এ হৈ হুল্লোড় আর পাস্তেরনাককে ব্যবহার করা হয়েছে হাতিয়ার হিসাবে। এটাও নিন্দনীয়।
আশ্চর্য, রাশিয়ায় যখন চরম স্বৈরতন্ত্র–সেন্সরের কঠোরতা যখন অসীম, তখন জার প্রথম নিকোলাস যে রসবোধের পরিচয় দিয়েছিলেন, হিটলার যেমন সে রসবোধের পরিচয় দিতে পারেন নি, তেমনি পারেন নি নিকোলাসের আধুনিক উত্তরাধিকারীরাও। গোগোলের বিখ্যাত নাটক Rerizor (The Govt. Inspector) জার নিকোলাসের আমলাতন্ত্রকে বিদ্রূপ করেই লেখা। অথচ বইটি যখন তাকে পড়ে শোনানো হয় তখন বইটির শিল্পগত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি তখনি সেন্সরের হুকুম বাতিল করে দিয়ে বইটির অভিনয়ের আদেশ দিয়েছিলেন এবং এর পর থেকে তিনি দরিদ্র গোগোলকে মাঝে মাঝে গোপনে অর্থ সাহায্য পাঠাতেন। আর পাঠাবার সময় বলে দিতেন, ‘Don’t let him know the source of these gifts; for then he might feel obliged to write from the official point of view.’ হিটলারের official point of view-এর সঙ্গে মেলে নি বলে পঁচিশ হাজার বই আগুনের খোরাক হয়েছে। রাশিয়ায় বর্তমান official point of view এর সঙ্গে মেলে নি বলে Dr Ztivago রাশিয়ায় নিষিদ্ধ আর তার লেখকের ভাগ্যে এ দুর্ভোগ। ব্যক্তি স্বাধীনতা যেখানে অস্বীকৃত সেখানে সাহিত্যিক শিল্পীদের দুর্ভোগ অনিবার্য। যারা official point of view-এর সঙ্গে তাল রেখে মিলিয়ে মিলিয়ে লিখতে পারবেন অর্থাৎ যারা শাসকদের সুরে সুর মেলাতে পারবেন তাদের। কথা অবশ্য স্বতন্ত্র। কিন্তু যারা তা পারেন না তাদেরই নাজেহাল অবস্থা।
লেখকের জন্য কেন স্বাধীনতা অত্যাবশ্যক সে কথা বলতে গিয়ে ই, এম, ফরস্টার বলেছেন, ‘তিনটি কারণে আমি লেখকের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। প্রথমত, লেখককে নিজে বোধ করতে হবে তিনি পুরোপুরি স্বাধীন, তা না হলে সৃষ্টির জন্য ভাল কিছু রচনার প্রেরণাই তিনি পাবেন না। তিনি যদি নির্ভয় হতে পারেন, মনে মনে আত্মস্থ হতে পারেন, সহজ হতে পারেন ভেতরে ভেতরে, একমাত্র তখনই তার জন্য সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ রচিত হবে। দ্বিতীয়ত, লেখক শুধু নিজে স্বাধীন এ বোধ করলে চলবে না। স্বাধীনতা হলো লেখকের জন্য প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু লেখক ও শিল্পীর আরো কিছু চাই। অর্থাৎ লেখক যা বোধ করছেন তা অন্যকে বলার স্বাধীনতাও তাঁর থাকা চাই। তা না হলে তাঁর অবস্থা হবে বদ্ধমুখ বোতলের মতো। লেখক শূন্যে বিহার করতে পারেন না–শ্রোতা বা পাঠক না হলে তার চলে না। তাঁর প্রকাশের পথে অন্তরায় ঘটতে পারে এ আশঙ্কা থাকলে তিনি একদিন অনুভব করতেই ভুলে যাবেন। অনেক সময় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রাজ কর্মচারীরাও এই সত্যটা বুঝতে পারেন না, ফলে তারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভাল রচনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ান। তৃতীয়ত, যদি পড়ার স্বাধীনতা জনসাধারণের না থাকে, লেখকের অনুভূতি যদি তারা গ্রহণ করতে অক্ষম হন তাহলে তাঁদের নিজের অনুভূতি বা অনুভব করবার শক্তিও চাপা পড়ে যাবে এবং তারা থেকে যাবেন অপরিণত–চির immature.’
কাজেই লেখকের স্বাধীনতা যে শুধু লেখকের জন্যই প্রয়োজন তা নয়। দেশের জনসাধারণের জন্যও তা অত্যাবশ্যক।
ফরস্টারের মন্তব্যের আলোকে আমার প্রাথমিক বক্তব্যের দিকে আর একবার ফিরে তাকানো যেতে পারে। ইংরেজ শাসনকালে আমাদের লেখকেরা অনুভূতির ক্ষেত্রে অনেক বেশি নিঃশঙ্ক ছিলেন। তাই মধুসূদনের পক্ষে রামকে ছেড়ে রাবণে রঙ চড়ানো, রবীন্দ্রনাথের পক্ষে হিন্দুর চিরপ্রিয় সংস্কারকে গোমতীর জলে নিক্ষেপ করা বা নজরুলের পক্ষে ‘খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া’ মাথা তোলা সম্ভব হয়েছিল। বল বীর আমি চির উন্নত শির’–মানব মহিমার এমন অবিস্মরণীয় উক্তি সত্যিই দুর্লভ। এ উক্তিটির জন্যও নজরুল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সমস্ত সাহিত্য শিল্পেরই মর্মকথা এটি। ‘বিদ্রোহী’ মানব অনুভূতি ও অনুভূতির অবাধ প্রকাশেরও এক স্মরণীয় নিদর্শন।
গোর্কি তাঁর The Artamonows (‘ক্ষয়’ নাম দিয়ে যার বাংলা অনুবাদ হয়েছে) উপন্যাসে এক চরিত্রের মুখ দিয়ে যে বলেছেন : ‘কারবারটা আমাদের সকলের কিন্তু জীবনটা যার যার নিজের’–এটাই হচ্ছে সমাজ ও জীবন সম্বন্ধে শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি। এখানে official point of view-র রোলার চালাতে গেলেই শিল্প স্বধর্ম হারাতে বাধ্য। শিল্প ও শিল্পী স্বধর্ম হারালে সমাজও স্বধর্ম তথা মানবধর্ম না হারিয়ে পারে না। সাহিত্যের প্রাণবায়ু ও তার বিচিত্র অনুভূতি থেকে যে সমাজ বঞ্চিত, সে সমাজ অপরিণত মানুষের সমাজ তথা ‘ছোটলোকের সমাজ। সে সমাজের চাওয়া-পাওয়া, বাসনা-কামনাও হবে তেমনি ক্ষুদ্র ও সামান্য। সে সমাজের পক্ষে বড় কিছু করা, মহৎ কিছু গড়া এমন কি বৃহৎ কিছু আকাক্ষা করাও সম্ভব নয়। এ সমাজ সম্বন্ধেই কি বোরিস পাস্তেরনাকের মন্তব্য : ‘… a society whose demands are very slight; there is only one thing they really want : you should hate what you like, and love what you abhor!’ Dr. Zhivago.
মনের ওপর, আত্মার ওপর কী প্রচণ্ড জুলুম!
এ অসহ্য কূপমণ্ডুকতার হাত থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে শিল্পীকে অভিব্যক্তির স্বাধীনতা দিতে হবে–মেনে নিতে হবে সাহিত্য-শিল্পের এ প্রাথমিক শর্তটুকু।
[‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ ১৯৫৯ সালে উত্তরণ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথম গ্রন্থাকারে সংকলিত হয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি সাধনা গ্রন্থে।]