প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

সাহিত্যে বিদ্রোহ 

সাহিত্যে বিদ্রোহ 

এক

সাহিত্যে বিদ্রোহ কথাটার দুটো দিক আছে–একটা ভাবগত অন্যটা আঙ্গিক বা প্রকাশগত। দুইই গভীরতর উপলব্ধি আর জীবনকে দেখার বিশেষ এক দৃষ্টিভঙ্গিরই ফল। যা গতানুগতিকের বিপরীত একটা বৈশিষ্ট্য আর স্বাতন্ত্র্য-চেতনায় যা দীপ্যমান। এ দুই মোটেও বিচ্ছিন্ন বা সম্পৰ্করহিত নয় বরং একটা আর একটারই পরিণতি। গতানুগতিক ভাবই গতানুগতিক ভাষায় রূপ পেয়ে থাকে–স্বতন্ত্র ভাব-চেতনা ভাষা আর প্রকাশেও নিয়ে আসে অভিনবত্ব। সাহিত্যের ভাষা আর ব্যবহারিক আটপৌরে ভাষার পার্থক্যটাও লক্ষ করবার মতো–এ পার্থক্যটাও ঘটে ভাবগত তারতম্যের জন্যেই। নিত্যদিনের বস্তুগত প্রয়োজনে যে ভাষা আমরা প্রয়োগ করে থাকি তা দিয়ে কখনো মানস প্রয়োজন পুরোপুরি মিটতে পারে না, বিশেষত মননশীল মানুষের। আমাদের মানস-খোরাক যেমন দৈহিক খোরাক থেকে আলাদা তেমনি তার প্রকাশের মাধ্যম আর আঙ্গিকও পৃথক। সাহিত্যে মৌখিক বুলির দাবি যখন উত্থাপিত হয় তখন আমরা এ মৌলিক কথাটা ভুলে যাই।

বিদ্রোহের মূল উৎস ভাব বা আইডিয়া–সেখানে বিদ্রোহ দানা না বাঁধলে প্রকাশের বিদ্রোহ কখনো খাঁটি হতে পারে না। নকল পালোয়ানিতে যেমন শক্তির পরিচয় মেলে 

তেমনি স্রেফ আঙ্গিকগত বিদ্রোহেও শিল্পগত সৌন্দর্যের থাকে না কোনো পরিচয়। তা দু দিনেই আসে ফিকে হয়ে। এককালে বাংলা সাহিত্যের ত্রিশের কিছু সংখ্যক কবি আর লেখককে ‘বিদ্রোহী’ মনে করা হতো, কিন্তু সে বিদ্রোহও যতখানি ভাবগত ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল ভঙ্গিগত–ফলে তা সৃষ্টিশীল ফসলের দিক দিয়ে শোচনীয়ভাবেই হয়েছে ব্যর্থ। বাংলা সাহিত্যের ঐ যুগে এমন কোনো সাহিত্যকর্ম সৃষ্ট হয় নি যা শিল্পোত্তীর্ণের দাবি রাখে। 

শুধু প্রচলিত ধারা কি গতানুগতিকতার বিরোধিতা কিংবা সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র বা পারিপার্শ্বিকের সমালোচনা কি তার নিখুঁত রূপায়ণ কখনো সাহিত্যে-শিল্পে বিদ্রোহ বলে স্থান পেতে পারে না যদি তা সত্যিকার সৃষ্টিতে রূপায়িত হয়। সৃষ্টির জন্যে যে গ্রহণশীলতা, সহনশীলতা আর ঔদার্য প্রয়োজন তা ‘প্রতিবাদমুখী’ মনে অনেক সময় আশ্রয় পারে না। তেমন মন কখনো যথার্থ সৃষ্টিশীল হতে পারে না এ কারণে। আমাদের সমাজের হত-শ্রী অবস্থা দেখে আমরা অনেকেই অনেক সময় বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর হয়েছি। আমাদের বহু রচনায় তার প্রতিফলন ঘটেছে। এ সবকেও। স্রেফ প্রতিবাদী’ সাহিত্যই বলা যায়। যথার্থ ‘বিদ্রোহী সাহিত্য’ এ নয়। আমরা জীবনে। যা মেনে নিয়েছি অনেক সময় তারই প্রতিবাদ করেছি কলমের মুখে। ফলে আমরা খটি হতে পারি নি, সাহিত্য-কর্মে হতে পারি নি ‘সত্য’। ত্রিশের লেখকদেরও এ দশা ঘটেছিল। এ হয়তো প্রাচ্য সমাজ-ব্যবস্থা আর তাতে লালিত মনেরই এক স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। আমাদের লেখকদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক স্ববিরোধী সমাজেই বাস করতে হয়। এ সমাজকে অস্বীকার করা আজ কোনো শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব নয়। এর পেছনে বহু কারণ রয়েছে। বিশ্বের তাবৎ দেশের সঙ্গে আমাদের ভাবের আদান প্রদান এখন দ্রুত ও সহজতর হয়েছে। যে কোনো ভাবতরঙ্গ এখন আমাদের শিল্পীদের মনেও হানা দেয়, নব-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে তাদেরও। কিন্তু শিল্পে এর অভিব্যক্তি এখন দু কারণে অসম্ভব। এক, সমাজ তথাকথিত ঐতিহ্য-বিরোধী রচনার প্রতি মোটেও সহিষ্ণু নয়। বলা বাহুল্য, এ সামাজিক সহিষ্ণুতাটুকু শিল্পের জন্য অত্যাবশ্যক–সমজদারির কথা নাই বা বললাম। দ্বিতীয়ত, গাছের মতো যে কোনো ভাব-চেতনাও একটা মাটি বা পরিবেশকে অবলম্বন করেই গড়ে ওঠে, সেখান থেকে রস আর খাদ্য গ্রহণ করেই ওঠে বেঁচে, হয় পল্লবিত। কাজেই বিদেশের যে কোন ভাবতরঙ্গ আমাদের মনে দোলা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক বটে কিন্তু তা আমাদের শিল্পকর্মের সহজাত অবলম্বন হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। দেখা গেছে, যতবারই এ চেষ্টা হয়েছে। ততবারই তা হয়েছে ব্যর্থ।

লেখকের ব্যবহারিক জীবন আর তাঁর শিল্প-সত্তায় যে কিছুটা পার্থক্য নেই তা নয়–তা হলেও তার ভাববস্তু যদি তার কাছে ‘বিজাতি থেকে যায় তা নিয়ে সার্থক শিল্প-সৃষ্টি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বিদেশী জীবন বা সাহিত্য থেকে আহরিত ভাব চেতনা এমন কি আঙ্গিক চেতনাও আমাদের অনেকের কাছে বিজাতি’-ই থেকে যায়। এমন ভাব-চেতনা নিয়ে কিছুটা আকাশকুসুম হয়তো রচিত হতে পারে কিন্তু সাহিত্যের পুষ্পোদ্যান রচিত হয় না। যে পরিবেশ চেতনায় লেখকের শিল্পীসত্তার বিকাশ ঘটে সেটাকে অতিক্রম করে যে শিল্পকর্ম তাতে কৃত্রিমতার অনুপ্রবেশ অনিবার্য। শিল্পের পক্ষে কৃত্রিমতা সবচেয়ে মারাত্মক।

নানা অভিঘাতে মানুষ অহরহই পরিবর্তিত হচ্ছে–কিন্তু এ পরিবর্তন অত সহজে ঘটে না। সাহেবি পোশাক পরে বাইরে সাহেব হওয়া অতি সোজা ব্যাপার কিন্তু মনের দিক দিয়েও সাহেব হওয়া অত সহজ নয়, এমন কি অসম্ভবও বলা যায়। অথচ মনই সৃষ্টি করে সব রকম সাহিত্য আর শিল্প কর্ম। গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিদ্রোহের একটা লক্ষণ হতে পারে, এ লক্ষণ আমাদের অনেকের রচনায় আছে কিন্তু মনে-প্রাণে পুরোপুরি বিদ্রোহী না হলে সাহিত্যে সত্যিকার বিদ্রোহ আমদানি সম্ভব নয় কিছুতেই। রাজনৈতিক আর সামাজিক বিদ্রোহের চেয়ে সাহিত্যের বিদ্রোহ স্বতন্ত্র। এর উৎস মূল শিল্পীর আভ্যন্তরীণ সত্তায়–আর এর অভিব্যক্তি নবতর ভাব-চেতনায় আর তার রূপায়ণে। 

দুই

সব সাহিত্য-শিল্পই সভ্যতার উপকরণ–লেখক আর শিল্পীরা সভ্যতা নির্মাতা আর সভ্যতার কারিগর। মহৎ সাহিত্য-কর্মের ওপরই রচিত হয় সব রকম সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভিত। মহৎ সাহিত্য মানে মানবাত্মার উদ্ঘাটন ও অভিব্যক্তি। ব্যক্তি আর সমষ্টিগত সব মানুষের জীবনেই বাইরের সঙ্গে ভেতরের দ্বন্দ্ব এক চিরকেলে ব্যাপার। বাহ্যিক জীবনের দাবি আর আভ্যন্তরীণ জীবনের চাহিদা বা আকুতির সংঘর্ষ যেমন অনিবার্য তেমনি তার সমাধান সন্ধানও মানুষের অবিরাম সাধনা। অতীত বা বর্তমান সব মহৎ সাহিত্যে এ সাধনাই প্রতিফলিত। এর সমাধানের পথে বিদ্রোহেরও আবির্ভাব। এ বিদ্রোহ যখন গভীর জীবন-জিজ্ঞাসায় রূপান্তরিত হয় অথবা রচনা আর শিল্পকর্মে যখন তারই সার্থক প্রতিফলন ঘটে তখনই তাকে বিদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। এই বিদ্রোহ মানবাত্মারই অনুষঙ্গ, সভ্যতারই অঙ্গ। এ ছাড়া সভ্যতা এগুতে পারে না, পারে না হতে নবায়িত। স্থির, স্থাণু আর একটা অচলায়তনে বাঁধা পড়া কখনো সভ্যতার আদর্শ নয়। সভ্যতাকে সচল ও সজীব রাখার জন্যেই বিদ্রোহ অত্যাবশ্যক–সভ্যতার প্রধান বাহন। সাহিত্য বলে তাতেই রূপায়িত হয় এ বিদ্রোহ সর্বাগ্রে। এ কারণেই উন্নত সাহিত্যে–বলা বাহুল্য, উন্নত সাহিত্য মানে উন্নত সমাজও–বারে বারে বিদ্রোহ দেখা দেয়–যার ফলে তা হয়ে ওঠে প্রাণ-চঞ্চল ও চলিষ্ণু। তখনই দেখা দেয় সাহিত্যে নবতর ফসল–যা স্বাদে, ভঙ্গিতে আর বৈচিত্র্যে পূর্ববর্তীদের থেকে আলাদা।

বলা হয়ে থাকে গ্রিক সভ্যতাই আধুনিক সভ্যতার জনক। তার আগে মানুষের ভাবনা-চিন্তা আর সব রকম উপলব্ধি ছিল অশরীরী, অপার্থিব আর অপৌরুষের চেতনায় সীমাবদ্ধ। গ্রিকরাই প্রথম ফিরে তাকায় মানুষের দিকে, মানুষের মন আর মনের অসীম দিগন্ত রেখার পানে। মন আর আত্মা–এ দুয়ের অধিকারী বলেই মানুষ মানুষ। তার স্বাতন্ত্র আর শ্রেষ্ঠত্বও এ কারণে। এ দুয়েরই চর্চা গ্রিক সভ্যতার অবদান। পরবর্তী য়ুরোপীয় সভ্যতাও গড়ে উঠেছে এ পথের অনুসরণ করেই। ‘The Greeks were the first intellectualists. In a world where the irrational had played the chief role, they came forward as the protogonists of the mind.’ (Edith Hamilton. The Greek Way to Western Civilization) 

অন্যত্র : ‘Mind and spirit together make up that which separates us from the rest of the animal world, that which enables a man to know the truth and that which enable him to die for truth.’ (ঐ)

মননশীলতার সূচনা যেমন এখান থেকে তেমনি মননশীলতার ফলে যে স্বাধীন চিন্তার উদ্ভব, যা সব বিদ্রোহের মূল কারণ, তারও শুরু এখান থেকেই। ফলে যুক্তিহীন স্বৈরাচারী ও নির্মম পৌরহিত্যতন্ত্রের যে শুধু অবসান ঘটলো তা নয়; ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য-বিজ্ঞান, শিল্প ও রাষ্ট্রতন্ত্রেও দেখা দিল নতুন ধ্যান-ধারণা, নতুন রূপ ও চেহারা। ব্যক্তি-স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রেও দেখা দিল নতুন ধ্যান-ধারণা, নতুন রূপ ও চেহারা। ব্যক্তি-স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রেরও আবির্ভাব এ কালে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা মানে স্বতন্ত্র চিন্তা–আর স্বতন্ত্র চিন্তাই জন্ম দেয় শিল্প-সাহিত্য, দর্শন আর বিজ্ঞানের, যা সব। সভ্যতার পাদপীঠ। গ্রিকরা মনের আবিষ্কার করেছে, মনের বিচিত্র ফসলে তাদের সভ্যতাও হয়েছে সমৃদ্ধ। মনকে আবিষ্কার করা বা খুঁজে পাওয়া মানে জীবনকে খুঁজে পাওয়া–জীবনের আনন্দ আর উল্লাসকে ফিরে পাওয়া। গ্রিক সভ্যতায় জীবনের আনন্দেরই অভিব্যক্তি ঘটেছে নানাভাবে। এ সভ্যতার ভাব-সন্তান বলে য়ুরোপীয় সভ্যতায়ও আমরা জীবনের বিচিত্র আনন্দেরই প্রকাশ দেখতে পাই।

আমাদের মুশকিল, আমাদের সভ্যতা জীবনমুখী নয়, অনেকখানি পরলোকমুখী। ফলে জীবনের বিচিত্র বিকাশ আর তার আনন্দের প্রকাশ আমাদের সভ্যতায় তেমন ঘটে নি। সভ্যতায় না ঘটা মানে সাহিত্য-শিল্পেও না ঘটা। এ যুগেও আমাদের সমাজ যতখানি অনুষ্ঠান-অনুরাগী ততখানি জীবন-প্রেমিক নয়। মন আমাদের অনেকখানি একই বৃত্তে বাধা। আমাদের সাহিত্যিক-শিল্পীরাও এ বৃত্তরেখা ডিঙিয়ে যেতে পারে না–না পারার কারণ ওপরে উল্লেখিত হয়েছে। মন যদি অবাধে বিচরণ করতে না পারে আর না পারে তাকে অবাধে প্রকাশ করতে, তাহলে সেখানে জীবন-চেতনা তথা জীবনের আনন্দের প্রকাশও অবাধ হতে পারে না। আমাদের এ সীমাবদ্ধতাই আমাদের বিদ্রোহের প্রতিকূল। এ যুগে আধুনিকতার পথেই সাহিত্যে বিদ্রোহের আবির্ভাব–আধুনিকতা মানে সমকালীন জীবন ও জীবনের সমস্যার মুখোমুখি হওয়া; উন্মুক্ত চোখে তার নগ্ন রূপটা দেখে নেওয়া আর তাকে শিল্পায়িত করা। এ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না বলে আমাদের আধুনিকতাও হচ্ছে না খাঁটি। ফলে বলিষ্ঠ কোন বিদ্রোহের সুরও আমরা শুনতে পাচ্ছি না আমাদের সাহিত্য ও শিল্পে। মনে হয়, বিদ্রোহী সাহিত্য-শিল্পীর জন্য আমাদের আরো দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হবে।

বিদ্রোহ বলিষ্ঠ জীবন আর জীবনমুখী দর্শনের অভিব্যক্তি–আমাদের জীবন তার বিপরীত। কবর বা সমাধিসৌধের যত কদর আমাদের সমাজে তার সিকির সিকিও রঙ্গমঞ্চের নয়। বলা বাহুল্য, সমাধিসৌধ পরলোকমুখী দর্শনেরই প্রতীক আর রঙ্গমঞ্চ বা থিয়েটার জীবনমুখী দর্শনের। 

(মার্চ, ১৯৬৮) 

[‘সাহিত্যে বিদ্রোহ’ প্রথম প্রকাশিত হয় মার্চ ১৯৬৮ সালে। এটি পরে সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধে গ্রন্থভুক্ত হয়।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *