অশুভ সংকেতের পর – ৯

নয়

খবর পেয়েই লেক সাইড ভিলা থেকে প্লেনে ও’হেয়ার পৌঁছেছে রিচার্ড আর অ্যান। ওখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা শিশু হাসপাতালে এসেছে। দুর্ঘটনার পর ছেলেদের ওই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

থর্নকে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, শেভ করেনি পরনে আর্মি জ্যাকেট, লেক জেলেভার ধারে বলে হাঁটতে যাবার সময়ে সে সাধারণত ওটা পরে। হাসপাতালে ছেলেদের কামরার বাইরে করিডোরে দাঁড়িয়ে ফোনে বুহেরের সাথে কথা বলছে রিচার্জে।

‘ওরা মোটামুটি ভালই আছে বলে মনে হল, কিন্তু ডাক্তারের সাথে এখনও আমার কথা হয়নি। কি ঘটেছিল কাল সকালেই আমার টেবিলে তার পুরো রিপোর্ট আমি তৈরি চাই!’ দড়াম করে রিসিভার রেখে ক্লান্তিতে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়াল পূর্ণ।

ওখানে দাঁড়িয়েই আড়চোখে ছেলেদের কামরায় একজন ডাক্তারকে ঢুকতে দেখল সে। প্রাথমিক পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্যে তাড়াতাড়ি তার পিছু নিল থর্ন।

মার্ক আর ডেমিয়েনের বিছানা দুটোর মাঝখানে একটা চেয়ারে বসে আছে অ্যান। মার্ককে খুব কাহিল দেখাচ্ছে। মায়ের হাত ধরে বসে আছে ও। ডেমিয়েন যাহোক ভালই আছে।

ডাক্তার অ্যানের কাছে এগিয়ে গিয়ে ডা. কেইন বলে নিজের পরিচয় দিল। পিছন পিছন থর্নও ওখানে উপস্থিত হল।

‘চিন্তার কোন কারণ নেই,’ অভয় দিল ডাক্তার। ‘সবাইকেই পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে—ফুসফুসে কারও কোন ক্ষতি হয়নি। সাময়িকভাবে ওদের কিছুটা খারাপ লাগবে—মাথা ঝিমঝিম করবে—কিন্তু স্থায়ী…’

‘আমি চাই ছেলেদের চিকিৎসায় কোন ত্রুটি যেন না হয়,’ বাধা দিয়ে বলে উঠল থর্ন।

মাথা ঝাঁকাল কেইন। ‘অবশ্যই, খুব যত্নের সাথেই ওদের দেখাশোনা করা হচ্ছে,’ বলে থর্নকে একপাশে টেনে নিয়ে গেল সে। ‘আপনার সাথে একটু আলাদা আলাপ করতে চাই আমি।’

‘নিশ্চয়ই,’ বলে আবার ডাক্তারের পিছু পিছু করিডোরে বেরিয়ে এল থর্ন

বিছানার ওপর বসে কৌতূহলী নজরে ওদের বেরিয়ে যাওয়া লক্ষ্য করল ডেমিয়েন।

.

বাইরে বেরিয়ে আশেপাশে কেউ আছে কিনা দেখে নিল কেইন। ওর চেহারা দেখে থর্ন বুঝল কিছু একটা ডাক্তারকে খুব বিব্রত করছে।

‘আমরা রক্ত আর টিস্যুর ক্ষতি কার কতটা হয়েছে জানার জন্যে ব্যাপক পরীক্ষা চালিয়েছি,’ বলল সে। সবারই কম-বেশি কিছু ক্ষতি হয়েছে—যদিও সেটা খুব সামান্যই— একমাত্র আপনার ছেলে ডিমিয়েনেরই কোন ক্ষতি হয়নি।’

থর্নের মুখের একটা পেশী আপনাআপনি কেঁপে উঠল। ‘তার মানে?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘ও কি…

‘না, না মিস্টার থর্ন, আপনি যা ভাবছেন তা নয়।’ যা বলতে চাইছে সেটা বোঝাবার জন্যে কথা খুঁজল ডাক্তার। ‘মানে…হওয়া উচিত ছিল…কিন্তু কিছুই হয়নি ওর…কিচ্ছু না।’

.

হাসপাতালের কামরায় অ্যানকে প্রশ্ন করল ডেমিয়েন, ‘কি এমন গোপন কথা বলতে বাইরে গেল ওরা?’ চোখে ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা একটা রাগের ভাব ফুটে উঠতে শুরু করেছে।

অ্যান তা খেয়াল করল না। রিচার্ড কখন ফেরে দেখার জন্যে দরজার দিকে চেয়ে আছে সে। ‘ও কিছু না,’ জবাব দিল অ্যান। ‘ডাক্তার ওরকম একটু ভাব দেখাতে পছন্দ করে।

আবার ঘরে এসে ঢুকল ওরা দু’জন। থর্নকে খুব বিচলিত দেখাচ্ছে। ‘ডাক্তার ডেমিয়েনকে এখানে দু’দিন রাখতে চায়, গলার স্বরে কিছুই হয়নি এমন ভাব দেখাবার চেষ্টা করল থর্ন। ‘আরও কয়েকটা পরীক্ষা চালাতে চায় ডাক্তার।’

উঠে বসল ডেমিয়েন। ‘আমি তো ঠিকই আছি!’ প্রতিবাদ করল সে। ‘তবে আমাকে কেন থাকতে হবে?’

‘আর কিসের টেস্ট দরকার?’ বাধা দিয়ে কেইনকে প্রশ্ন করল অ্যান।

দু’জনের দিকেই একবার চেয়ে দেখে থর্ন বলল, ‘ছেলেদের সামনে নয়!

‘কিছুতেই আমি এখানে থাকব না,’ জোর আপত্তি জানাল ডেমিয়েন।

অ্যান আগে বেড়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। মার্ক তাড়াতাড়ি বলে উঠল, থাকলে আমিও যাব না, আমিও থাকব ওর সাথে।

ডাক্তারের দিকে চেয়ে কাঁধ ঝাঁকাল অ্যান। ‘আজ বরং ওকে বাসায় নিয়ে যাই, সামনের সপ্তাহে পরীক্ষার জন্যে নিয়ে আসব? ওদের সবারই খুব ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছে আজ।’

‘সেটা কি ঠিক হবে?’ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করল থর্ন।

প্রস্তাবটা কেইনের মোটেও পছন্দ হয়নি—কিন্তু থর্নের মুখের ওপর কিছুই বলতে সাহস পেল না সে। বলল, ‘আপনি যা ভাল মনে করেন—আমার আপত্তি নেই।

বিজয়িনীর হাসি হেসে ডেমিয়েনকে আবার আদর করে জড়িয়ে ধরল অ্যান। ‘ঠিক আছে, আপাতত তোমরা বিশ্রাম নাও, আমরা পরে এসে তোমাদের লেক সাইডে নিয়ে যাব। মুক্ত বাতাসে দু’দিনেই সেরে উঠবে তোমরা।’

দু’জনেই, উৎসাহের সাথে সম্মতি জানাল। চুমো খেয়ে বাপমাকে বিদায় জানাল ওরা। ডা. কেইনের সাথে বেরিয়ে গেল থর্ন আর অ্যান।

ওরা বেরিয়ে যাবার আগে ডা. কেইনকে খুব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করল ডেমিয়েন। মনে হল সে যেন ডাক্তারের চেহারাটা মুখস্থ করে রাখছে।

.

সেদিনই, অনেক রাত হয়েছে। এখনও মাইক্রোস্কোপের ওপর ঝুঁকে পড়ে আছে ডা. কেইন। যা দেখছে সেটাকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছে সে।

হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে সম্পূর্ণ একা কাজ করে চলেছে সে। রাতের খাবারটাও খায়নি ডাক্তার। এই নিয়ে আজ প্রায় একশোবার হল, কাঁচের ওপর রক্তের ফোঁটাটা মাইক্রোস্কোপের নিচে বসিয়ে আর একবার দেখল সে। বিচিত্র এক অনুভূতিতে সামান্য শিউরে উঠল কেইন। এই আবিষ্কারের কোন তুলনা নেই—সে নিশ্চিত জানে যে চোখের সামনে সে যা দেখছে, তা এর আগে আর কারও দেখার সুযোগ হয়নি।

পাশে রাখা বইটার খোলা পাতায় চোখ বুলিয়ে আবার মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগাল সে। বই-এর প্রতি পাতায় রয়েছে শক্তিশালী ক্যামেরা দিয়ে তোলা বিভিন্ন প্রাণীকোষের ছবি। না, কোন ভুল নেই।

ডেমিয়েনের কোষের সাথে শিয়ালের কোষ হুবহু মিলে যাচ্ছে। এর কোন অর্থ হয় না। ঠাট্টার মতো মনে হচ্ছে— অথচ ওর কাছে সব প্রমাণ রয়েছে।

নিজের মধ্যে খবরটা ধরে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। তারই ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বন্ধুকে ফোন করল কেইন।

আটবার রিং হবার পর নিরাশ হয়ে ফোন ছেড়ে দিচ্ছে, এই সময়ে ওদিক থেকে শোনা গেল, ‘কে?’

‘বেন! ভাগ্য ভাল তুমি এখনও বাড়ি যাওনি। নিচে এসে তোমার সাথে এক মিনিট আলাপ করতে পারি?’

‘খুবই দরকার?’ জবাব এল। আমি বাড়ির পথে রওনা হচ্ছিলাম।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুব জরুরি।

‘ঠিক আছে, তুমি নিচে চলে এসো, আমি অপেক্ষা করছি।’

‘আসছি,’ ফোন ছেড়ে দিয়ে স্লাইডটা যত্নের সাথে খাপে ভরে বইটা বগলদাবা করে লিফটের দিকে এগোল কেইন।

.

লেক সাইডে সবাই ঘুমে অচেতন। একমাত্র ডেমিয়েন জেগে। ওর দেহটা আড়ষ্ট হয়ে আছে, চোখ দুটো খোলা। চেয়ে আছে কিন্তু ঘরের কিছুই দেখছে না সে। বহুদূরে অন্য কোথাও কিছু দেখছে যেন—অত্যন্ত কঠিন মনোযোগ দিয়ে দেখছে ও। পরিশ্রমে কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে—থরথর করে কাঁপছে ওর সারা শরীর।

.

লিফটে চড়ে ষোলো তলায় নামার জন্যে বোতাম টিপল ডা. কেইন। দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে লিফট চলতে শুরু করল।

নিচে না নেমে উপরে উঠছে লিফট

উপরে বাতি জ্বালানো সংখ্যাগুলোর দিকে চাইল কেইন… ২১. ২২…২৩…আবার ষোলোর বোতাম টিপল সে। লিফট থামল, দরজা খুলে গেল।

কিন্তু ওখানে লিফটের জন্যে অপেক্ষা করছে না কেউ। তৃতীয়বার ষোলো তলায় যাবার জন্যে বোতাম টিপল ডাক্তার।

দরজা বন্ধ হল। এবার নিচে নামছে লিফটঃ ১৯-১৮… ১৭…

গতি বেড়ে চলেছে, ষোলো পেরিয়ে নিচের দিকে চলল লিফট।

কিছুই বুঝতে পারছে না কেইন। ভয় করছে ওর। বই আর স্লাইড ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আতঙ্কিত ভাবে একটার পর একটা বোতাম টিপতে শুরু করল সে। সব ক’টা বোতামেই এখন আলো জ্বলছে। কোন নিয়ম না মেনে নিজের খুশি মতো জ্বলতে নিভতে শুরু করেছে আলো। গতি আরও বাড়ছে-প্রচণ্ড ভাবে কাঁপছে লিফট।

১০… ৯… ৮…

‘ঈশ্বর!’ সভয়ে চিৎকার করে লিফটের গায়ে কিল মারতে আরম্ভ করল সে।

৫…8…৩…

হঠাৎ ভীষণ একটা ঝাঁকুনির সাথে থেমে গেল লিফট। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল ডাক্তার। কোথাও কোন শব্দ নেই—নড়তেও ভয় পাচ্ছে কেইন। শ্বাস নিতেও ভুলে গেছে সে।

সাবধানে গড়িয়ে উঠে বসল ও। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না বেঁচে আছে সে। হাড়গোড় ভেঙেছে কিনা পরীক্ষা করে দেখল। না, সব ঠিকই আছে—কোথাও চোট পায়নি। লক্ষ্য করল স্লাইডটা পড়ে গুঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। বেঁচে আছে, এতেই সে খুশি!

অনেক উপরে লিফটের একটা তার ছিঁড়ে গেছে প্রচণ্ড চাপে।

মোটা স্টীলের তারটা এখন একটা বিশাল চাবুকের মতো বেগে নিচে নেমে আসছে।

বাতাস কেটে ওটা নিচে নামার চড়া সুরের শব্দটা কেইনের কানে গেল। কিন্তু শব্দটা কোথা থেকে এসেছে বুঝতে পারল না। শেষ পর্যন্ত উপর দিকে চেয়েই হঠাৎ দেখতে পেল লিফট চিরে ছাদ থেকে নেমে আসছে তারটা। লিফটের মেঝে কেটে নিচে চলে গেল ওটা। কিন্তু যাবার আগে ডাক্তারের দেহটাকেও দু’টুকরো করে দিল।

.

ডেমিয়েনের দেহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। চোখ দুটো বন্ধ। ৬ জুনের পরে আজই প্রথম শান্তিতে ঘুমাল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *