পাঁচ
বিলের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর একমাস কেটে গেছে। পল বুহের তার নতুন অফিস সাজাচ্ছে এখনও। পুরানো ওয়ালপেপার ঢেকে ফেলা হয়েছে কাঠের কাজ আর নতুন কাগজে। আসবাবপত্র বদলে নতুন আধুনিক নকশার টেবিল চেয়ার আনা হয়েছে। তার বাইরের অফিসে-যেখানে তার রিসেপশনিস্ট আর সেক্রেটারি বসে, সেখানে বিল অ্যাদারটনের ছবির জায়গায় এখন সুন্দর করে বাধানো পলের ছবি ঝুলছে।
জানুয়ারির সকালে তার শোফার চালিত লিমোসিন থেকে নেমে বায়রনকে অফিসের গেটে অপেক্ষা করতে দেখে খুশি হল পল। বায়রন তারই সহকারী—অসম্ভব চটপটে আর কাজের লোক। হেসে এগিয়ে এসে পলের হাতে একটা বিশেষ ম্যাগাজিন ধরিয়ে দিল সে।
ওটা ‘ফরচুন’ এর নতুন সংখ্যা। কভারে পল বুহেরের ছবি ছাপা হয়েছে। নিচে টিকাঃ পল বুহের, থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির নতুন প্রেসিডেন্ট।
ওই ম্যাগাজিন দেখিয়ে বসকে চমকে দিয়ে একটু খুশি করার জন্যেই সেই সাত-সকালে এসে গেটে দাঁড়িয়ে আছে সে।
ম্যাগাজিনটা হাতে নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে চলল পল।
একেবারে চুপসে গেল বায়রন। ‘ওহ, তাহলে ওটা আগেই দেখেছ তুমি,‘ মন্তব্য করল সে।
অবজ্ঞা লুকাবার চেষ্টা করল না পল। একটু বিরক্ত স্বরেই বলল, ‘তোমার কি ধারণা এসব দৈবাৎ ঘটে?’
এর কোন জবাব খুঁজে পেল না বায়রন। শুকনো মুখে বলল, ‘ছবিটা কিন্তু খুব সুন্দর এসেছে।’
একসাথেই লিফটে উঠল ওরা।
‘প্যাসারিনের থেকে কোন খবর এসেছে?’ প্রশ্ন করল বুহের।
‘না, সে একেবারেই ডুব দিয়েছে—কোন খবর নেই।’
লিফট থেকে বেরিয়ে আঘাতটা হানল বায়রন। ‘ভাল কথা, তুমি এলে সাথে সাথেই তোমাকে দেখা করতে বলেছে রিচার্ড।’
মুহূর্তের জন্যে হলেও একটু চমকাল পল। শিখরে ওঠার পথে এই কৌশল সে নিজেও বহুবার ব্যবহার করেছে। বায়রন বলতে চাইছে : রিচার্ড পুরো ছুটি না কাটিয়েই ফিরে এসেছে খবরটা তোমারই রাখা উচিত ছিল। তুমি রাখনি কিন্তু আমি রাখি। যাকে আমি রিচার্ড বলে সম্বোধন করলাম তাকে আগে কোনদিন মিস্টার থর্ন ছাড়া আর কিছু ডাকিনি—অর্থাৎ তোমার অজান্তে তার সাথে আমার আলাদা একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। অফিস সাজানো আর ম্যাগাজিনে নিজের ছবি ছাপানোয় মেতে ছিলে বলে এসব কিছুই খেয়াল করনি তুমি। বড় সাহেবের ঘরে ডাক পড়েছে তোমার—সম্ভবত খারাবি আছে তোমার কপালে। রিচার্ড যে কেন তোমাকে ডেকেছে সেটাও হয়ত আমার অজানা নয়।
কিন্তু সেরা খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে খেলছে বায়রন। ব্যাপারটা অনেকটা দাবাড়ু ক্যাপাবলাঙ্কার বিরুদ্ধে ক্যাপাবলাঙ্কা ডিফেন্স খেলার মত। ‘তাই?’ শান্ত গলায় বলল পল। ‘এরই মধ্যে এসে গেছে?’
পলের অটল শান্ত মূর্তির সামনে তার আত্মবিশ্বাস ভেঙে খানখান হয়ে গেল। ‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল সে। তারপর বলার মত আর কিছু খুঁজে না পেয়ে মাথা নিচু করে সরে পড়ল।
রিচার্ডের কামরায় ঢুকে পল দেখল রিচার্ড তার বিশাল লম্বা টেবিলটার এক মাথায় বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। পল বুহেরকে ‘হ্যালো’ বলারও সুযোগ দিল না রিচার্ড, খেঁকিয়ে উঠল, ‘প্যাসারিন ইণ্ডিয়ায় কি করছে?’
টেবিলের ওপর ব্রীফকেসটা নামিয়ে রেখে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল পল। জবাবটা মনে মনে গুছিয়ে নেয়ার সুযোগটা পুরোপুরিই নিল সে। থর্নের পরনের ব্রুক্ড ব্রাদার্সের মনোগ্রাম করা শার্টটার বোতাম খোলা। গলায় টাই নেই। শেভও করেনি সে। গুরুতর কিছু না ঘটলে এই অবস্থায় রিচার্ড কখনও অফিসে আসত না।
রাগের ভাব দেখাচ্ছে না থর্ন—আসলেই রেগেছে সে।
‘ওখানে কিছু জমি কেনার ব্যাপারে আরও খোঁজখবর নিতে পাঠিয়েছি ওকে, ‘ বলল বুহের। ‘ওর চেয়ে ভাল…’
তাহলে কেনা শুরু করেছি আমরা?’ প্রশ্ন করল থর্ন। সত্যিই অবাক হয়েছে সে।
‘আপনি স্বীকার করেছিলেন যে আমি আমার রিপোর্ট অনুযায়ী কাজ করতে পারব,’ একটু সতর্কভাবে জবাব দিল পল। ‘এই শর্তেই প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছিলাম আমি।’
হাত দিয়ে নিজের মুখ ঘষে শব্দ করে শ্বাস ফেলল থর্ন। ‘কিন্তু তার মানে এই নয় যে তুমি আমারই কোম্পানি আমাকে বাদ দিয়ে চালাবে। আমাকে না জানিয়ে নতুন কোন পদক্ষেপ নেবে। কথাটা যদি আগে তোমার কাছে পরিষ্কার না হয়ে থাকে তবে এখন ভাল করে বুঝে নাও।’
আপনি ছুটি কাটাচ্ছিলেন, ভাবলাম আপনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না, স্বপক্ষে যুক্তি দিল পল। কিন্তু নিজেও বুঝল যুক্তিটা খুব খেলো শোনাল।
‘ফোনে সবসময়েই আমাকে পাওয়া যেত,’ বলল থর্ন। ক্লান্তিতে মাথা নুইয়ে নিজের বুকে থুতনি রেখে স্বগতোক্তি করল। ‘বিল কখনও আমাকে না জানিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিত না।’
‘আমি বিল নই,’ পলের স্বরটা একটু রুক্ষ শোনাল।
‘তোমাকে বিল হতে বলছে না কেউ!’ থর্নও তেতে উঠল। ‘কিন্তু কোম্পানির নিয়মকানুন তুমি মেনে চলবে এটুকু আশা করি!’
অনেকক্ষণ কেউ আর কথা বলল না। থর্ন যখন নিঃসন্দেহে বুঝল এর জবাব ওর কাছে নেই, তখন সুর নামিয়ে সে বলল, ‘পল, আমি জানি কাজে তোমার জুড়ি নেই—যথার্থই সবচেয়ে উঁচু পদে থাকার যোগ্যতা তোমার আছে—কিন্তু কোম্পানিটা কার, এটা কখনও ভুলো না।’
‘এমন আর হবে না,’ অনুতপ্ত স্বরে বলল পল। আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইল সে। ‘আপনি প্যাসারিনকে কেন খুঁজছেন?’
‘ওর নক্সা করা পি ৮৪ ইউনিটে গোলমাল দেখা দিয়েছে,’ বলল রিচার্ড। ‘ওয়াকার এ ব্যাপারে খুব বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে।’ কথা বলতে বলতেই থর্ন-এর ভাব সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। এটাই আশা কারেছিল পল। থর্নের যা বলার সে বলেছে— ব্যস, ঘটনা ওখানেই শেষ। এ নিয়ে আর কখনও আলোচনা হবে না। যদি পল আবারও একই ভুল করে তবে আর কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে না—খড়গ নেমে আসবে ওর মাথায়।
‘ওয়াকার অবশ্য অল্পতেই চোখে আঁধার দেখে,’ বলে চলল থর্ন, ‘কিন্তু এবারে সে আমাকে সুদ্ধ ভয় পাইয়ে দিয়েছে।’
‘ঠিক আছে, ওদিকটা আমি সামলাব,’ বলে উঠে দাঁড়াল পল।
‘হ্যাঁ, তাই কর।’ পল বেরিয়ে গেলে উঠে গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়াল রিচার্ড। প্রশস্ত জানালা দিয়ে পুরানো পানির ট্যাঙ্কটা দেখা যায়। ওদিকে চেয়ে সাধারণত মনে একটা সান্ত্বনা খুঁজে পায় থর্ন। কিন্তু আজ সকালে তা হল না। আজ তার মনটা বেশি বিক্ষিপ্ত।
অ্যাদারটনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর থেকেই কি যেন একটা চিন্তা তার ভিতরটা কুরেকুরে খাচ্ছে। ছুঁই ছুঁই করেও ওকে ধরাছোঁয়ার মধ্যে পাচ্ছে না থর্ন।