চার
উইকসিন্ এলাকার চেয়ে সুন্দর জায়গা আমেরিকায় খুব কমই আছে। অনেকের মতে ওখানকার লেকগুলোর মধ্যে লেক জেনেভাই হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর। শিকাগোর বেশ কাছেই ওটা–বিত্তশালী শহরবাসীদের শীতকালীন খেলাধুলার আনন্দ দেয়ার জন্যে চমৎকার জায়গা।
লেক জেনেভার ধারে ‘লেকসাইড’ থর্ন পরিবারের নিজস্ব বাড়ি। শীতকালে ওরা প্রত্যেক বছরই কয়েকটা দিন এই প্রকাণ্ড বাংলো-ধরনের বাড়িতে কাটাতে আসে। এখানে ক্লোজ সার্কিট টেলিভিশন থেকে শুরু করে হেলিকপ্টার ল্যাণ্ডিং প্যাড পর্যন্ত সবরকম আধুনিক সুবিধার বন্দোবস্ত আছে।
থর্ন ছেলেদের তেরোতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লেকসাইডে হাজির হয়েছে পরিচিত ব্যবসায়ী আর ঘনিষ্ঠ লোকজন—সবাই নিমন্ত্রিত 1
আসলে ডেমিয়েনের জন্মদিন হচ্ছে জুন মাসের ছয় তারিখে। কিন্তু আমেরিকায় চাচার সাথে থাকতে আসার পর থেকে তার জন্মদিনও মার্কের জন্মদিনের সাথে একসাথেই পালন করা হয়। সুবিধার জন্যেই এমন করা হয় বলে সবাই ধরে নিয়েছে। রিচার্ড ভুলতে পারেনি যে তার ভাই রবার্টের ডেমিয়েনকে খুন করতে যাওয়ার পিছনে জন্মদিনের তারিখটার একটা রহস্যপূর্ণ যোগাযোগ রয়েছে—তাই জেনেশুনেই ওই দিনটাকে এড়িয়ে যাবার জন্যে এই ব্যবস্থা নিয়েছে সে।
সন্ধ্যায় বসার ঘরে দুই ভাই ছক্কা আর গুটি দিয়ে ব্যাকগ্যামন খেলছে। স্বভাবত ডেমিয়েনই জিতছে—তবে এই গেমটায় মার্কের অবস্থাই ভাল।
যে কারণেই হোক ডেমিয়েনের কাছে হারতে মার্কের খারাপ না লাগলেও সমবয়সী অন্য কোন ছেলের কাছে হারা সে সহ্য করতে পারে না। ডেমিয়েন কারও কাছে হারলে সেটাও ওর কাছে অসহ্য ঠেকে। ডেমিয়েন খুব ছেলেবেলায় তার বাবা-মাকে হারিয়েছে বলেই হয়ত ওর জন্যে মার্কের এই দুর্বলতা। নিজের স্বার্থহানি করে হলেও ডেমিয়েনকে সুখী দেখতে চায় সে।
ছেলেরা খেলায় মত্ত। কখন যে অ্যান ঘরে ঢুকেছে দু’জনের কেউ তা খেয়াল করেনি। নীরবে দাঁড়িয়ে ওদের দু’জনকে সস্নেহ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করল সে। সত্যি দু’জনে একেবারে গলায়-গলায় ভাব। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওদের খেলায় বাধ সাধল অ্যান। আর কত খেলবে তোমরা? রাত হয়েছে, এবার শুতে যাও। কালকেই তো বিরাট উৎসবের দিন।
আজ সন্ধ্যায় এই প্রথমবার খেলায় জিতেছিল মার্ক। সে মুখ তুলে বলল, ‘খেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে মা, আর একটু খেলি, কেমন?’ সমর্থনের জন্যে ডেমিয়েনের দিকে চাইল মার্ক।
দুষ্টু হেসে ডেমিয়েন বলল, ‘তর্ক করো না মার্ক, মা বলছে খেলা শেষ—ব্যস, এবার গু’তে চল।’
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খিকখিক করে হেসে উঠল অ্যান।
অগত্যা মার্ককেও হাসতে হল। কিন্তু তার মাথায়ও দুষ্টু বুদ্ধি খেলছে। আপাতত হার মেনে চকচকে চোখে সে প্রস্তাব দিল, ‘ঠিক আছে, গুটিগুলো তবে এইভাবেই থাক–কালকে গেমটা শেষ করা যাবে।
ওর কথায় সবাই হেসে উঠল। চুমু বিনিময়ের পরে ওরা মা’র কাছে বিদায় নিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নিজ নিজ ঘরে রাতের জন্যে বিশ্রাম নিতে চলল।
উপরে উঠতে উঠতে হঠাৎ মার্ক বলল, ‘ডেমিয়েন, তোমাকে একটা কথা কয়েকদিন থেকেই জিজ্ঞেস করব ভাবছি।
পাকা ব্যাবসায়ীর মত সাবধানতার সাথে ডেমিয়েন প্রশ্ন করল। ‘জরুরি কোন কথা?’
‘না, তেমন কিছু না।’ জবাব দিল মার্ক
‘তাহলে বল,’ অনুমতি দিল ডেমিয়েন।
‘নেফের সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?’
এ ধরনের প্রশ্ন মোটেও আশা করেনি ডেমিয়েন। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মার্কের দিকে চেয়ে সে বলল, ‘তার মানে?’
‘জানি না, মনে হয় যেন লোকটা তোমাকে একটু বিশেষ নজরে দেখে। ব্যাপারটা কি?’
‘হ্যাঁ ব্যাপারটা একটু উদ্ভট,’ বলে অন্ধকার বারান্দা দিয়ে হেঁটে নিজের ঘরের দরজা খুলে ঘুরে দাঁড়াল ডেমিয়েন। মার্ক তখনও ওর মুখের দিকে চেয়েই আছে। ‘কিন্তু নেফ তো একজন সার্জেন্ট, আর সার্জেন্টরা একটু উদ্ভট কিসিমেরই হয় তাই না?’ বলে নাটকীয় ভঙ্গিতে কুর্নিশ করে হেসে বুঝিয়ে দিল সে ঠাট্টা করছে। তারপর ফিসফিস করে ‘শুভরাত্রি’ জানিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ডেমিয়েন।
.
পরদিন বিকেলের মধ্যেই নিমন্ত্রিত অতিথিরা সব এসে গেল। বুহের, অ্যাদারটন, ডক্টর ওয়ারেন—অ্যাকাডেমি থেকে কিছু ছেলেও এসে হাজির হয়েছে।
থর্ন কেনেডি বা রকফেলারের মত পরিবার আমেরিকায় খুব কমই আছে। জন্মদিন, বিশেষ করে পুরুষ ছেলের তেরোতম জন্মদিন এসব পরিবারে ফলাও করে পালন করা হয়। কারণ এই বয়সেই সাবালকত্ব প্রাপ্ত হয় ছেলেরা, আর ক্ষমতাশালী পরিবারের ছেলেরাই শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হাতে নিয়ে দেশ আর দশের ভবিষ্যৎ পরিচালনা করে।
মার্ক আর ডেমিয়েন দু’হাতে নিজের চোখ ঢেকে বিশাল খাবার ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই ওদের ঘিরে রয়েছে। লম্বা টেবিলের ওপর সাজানো সুস্বাদু খাবারের গন্ধ বাতাসে ভাসছে।
কেক আনা হবে এখন। সবাই অপেক্ষা করছে।
‘চোখ খুলব?’ হাতের আড়াল থেকে প্রশ্ন করল মার্ক।
‘আর একটু পরে,’ সস্নেহে জবাব দিল অ্যান।
পাশের ঘর থেকে পুরুষ কণ্ঠে গান শোনা গেল, ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে…‘
‘এবার খুলব?’ মার্ক জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ, এবার!’ উত্তেজিত স্বরে বলে উঠল অ্যান। দু’জনে একই সাথে হাত নামাল।
‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ!’ গান শেষ হল।
ওরা দেখল চওড়া দরজা দিয়ে কয়েকজন কর্মচারী ধরাধরি করে নিয়ে আসছে অতিকায় একটা কেক। রিচার্ড থর্ন আর অ্যাদারটন তদারকি করছে। কেকটা এতই বিশাল যে অ্যাকাডেমির সব ছেলে মিলে পেট পুরে খেলেও শেষ হবে না। তিনতলা কেকের উপরটা দেখতে মোটেও কেকের মত নয়। খাবার ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে চাইলে যে দৃশ্য দেখা যায়, লেক জেনেভার ঠিক সেই দৃশ্যটাই ফুটে উঠেছে কেকের ওপর। সাদা চিনির তৈরি লেকের ওপর স্কেটিং করছে কয়েকটা চিনির পুতুল। বিখ্যাত কয়েকজন শিল্পীর নকশা দেখে সবচেয়ে সুন্দর বলে এটাকেই বেছে নেয়া হয়েছে। এমন মনোরম বার্থডে কেক আজ পর্যন্ত কোনদিন কোথাও তৈরি হয়নি। চার্লস ডিকেন্সকে বললে তিনি এর বর্ণনা দিতে গিয়ে একটা পুরো অধ্যায় লিখে ফেলতেন।
খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল মার্ক। আনন্দে ডেমিয়েনের সব ক’টা দাঁত বেরিয়ে পড়ল। উপস্থিত সবাই হাতে তালি দিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করল।
‘অবিশ্বাস্য!’ বিস্ময় প্রকাশ করল মার্ক।
দু’হাতে জড়িয়ে ধরে আদর করে চুমো খেয়ে ওদের জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল অ্যান।
কৌতূহল আর উত্তেজনা চাপতে না পেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কামরার একপাশে রাখা কেকটার দিকে রওনা হল মার্ক। ডেমিয়েনও আর দেরি না করে ওকে অনুসরণ করল।
পল বুহের এইসময়ে ঘরে ঢুকল। কুঁচাকানো পোশাকে ওকে একটু বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় বেচারা সারা দুপুর শুয়ে কাটিয়েছে। অ্যানই প্রথম ওকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করল, ‘এখন কেমন বোধ করছ, পল?’
‘অনেকটা ভাল,’ জবাব দিল সে। কিন্তু ওর মুখের চেহারা দেখে অ্যানের তা মনে হল না। সেটা বুঝতে পেরেই পল আবার বলল, ‘গত কিছুদিন খুব পরিশ্রম আর মানসিক চাপ গেছে।’ মুখ তুলে অ্যাদারটনের দিকে চাইল পল। মার্ক আর ডেমিয়েনের পাশে উদ্ভাসিত হাসিমুখে গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ওদের ‘আঙ্কেল বিল’। ওই জায়গা থেকে ওকে সরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে খুশি হত সে।
আনন্দ আর ধরে রাখতে পারছে না মার্ক। সুন্দর কেকটা দেখিয়ে সবাইকে খুশির ভাগ দিতে চাইছে ও। মুখ তুলে ওদের দেখেই ডাকল সে, ‘মা, মিষ্টার বুহের! শিগগির দেখে যাও!’
হেসে ওর দিকে এগিয়ে গেল অ্যান। একটু ইতস্তত করে ডেমিয়েনের দিকে এগোল পল।
বুহেরকে ওর দিকেই আসতে দেখে বিনীতভাবে একটু হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে অভিবাদন জানিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইল ডেমিয়েন। এখন কেক কাটার সময়ে বড়দের সাথে কথা বলে আনন্দ মাটি করার পক্ষপাতি নয় সে।
কিন্তু তাকে পালাবার সময় দিল না পল। ‘অ্যাকাডেমিতে তোমার সময় কেমন কাটছে, ডেমিয়েন?’ প্রশ্ন করল সে।
‘ভালই, মিস্টার বুহের,’ নিরুৎসাহিত গলায় জবাব দিল সে। সার্জেন্ট নেফকে কেমন লাগে তোমার?’
নেফের কথা উঠতেই চকিত হল ডেমিয়েন। আপনি তাকে চেনেন?’ আগ্রহ প্রকাশ পেল ওর স্বরে।
ছেলেটাকে চমকে উঠতে দেখে হেসে ওর কাঁধে হাত রাখল পল। ‘তোমার ওপর ওকে একটু বিশেষ নজর দিতে বলেছিলাম।’
এ কথার কি জবাব দেবে বুঝে পেল না ডেমিয়েন। একটু অপ্রস্তুত হয়ে কেকের দিকে মনোযোগ দিল সে।
কিন্তু এত সহজে পলের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া গেল না। ‘আচ্ছা, ডেমিয়েন, থর্ন ইণ্ডাস্ট্রি সম্পর্কে কতটুক জান তুমি?’
আবার তার দিকে তাকাল ডেমিয়েন। ‘জ্বী, বিশেষ কিছুই না।’
‘সব খবরই তোমার রাখা উচিত,’ বলল পল। ‘কারণ এসব সবই তোমার হবে একদিন।’
‘মার্ক আর আমার,’ সাথে সাথেই ওকে সংশোধন করল ডেমিয়েন।
‘ওই একই কথা,’ এড়িয়ে গেল পল। ছেলেটা সত্যিই বুদ্ধিমানঃ এই বয়সেই কূটনীতিতে দক্ষ হয়ে উঠেছে! এবার অন্য পথ ধরল সে। ‘একদিন এলেই তো পার-প্রধান কলকারখানাগুলো ঘুরে দেখবে।’
প্রস্তাবটা ডেমিয়েনের মনে ধরল। ‘বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আসা যাবে?’ জিজ্ঞেস করল সে। ছেলেদের একদিনের ট্রিপে নিয়ে গেলে ক্লাসে তার জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে।
‘নিশ্চয়ই,’ বলে উঠল পল। ‘সবাইকে রাজকীয় সম্মানের সাথে সব ঘুরিয়ে দেখানো হবে।’
একটা রূপার চামচ হাতে তুলে নিয়ে শ্যাম্পেন গ্লাসে বাড়ি দিয়েছে রিচার্ড। ‘ঠুন’ করে একটা মিষ্টি আওয়াজেই কামান দাগার মত কাজ হল। মুহূর্তে সবাই চুপ হয়ে গেল।
সবার জন্যেই শ্যাম্পেন হাজির করা হয়েছে। টেবিলের ধারে এগিয়ে গেল—সবাই। রিচার্ড তার গ্লাসটা তুলে ধরে বলল, ‘এই ধরনের অনুষ্ঠানেই বক্তৃতা দিতে ইচ্ছা করে আমার। নিজেদের সৌভাগ্যের জন্যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছা করে। আসলেই অনেক পেয়েছি আমরা— ধন, মান আর ক্ষমতা। থর্ন পরিবারের এই প্রচণ্ড ক্ষমতা বিচক্ষণতার সাথে ব্যবহার করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে সব সময়ে এমন ছিল না। কঠিন পরিশ্রম করেই আমাদের পৌঁছতে হয়েছে এখানে। এর বেশি কিছু আর আমার বলার নেই। তুমি শুনে খুশি হবে, মার্ক, আমি আজ বক্তৃতা দেব না।
‘বক্তৃতাই তো দিলে, বাবা!’ মন্তব্য করল মার্ক। ওর কথায় সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
হাত তুলে সবার হাসি থামিয়ে রিচার্ড বলল, ‘আর মাত্র একটা কথা বলেই আমি আমার কথা শেষ করব।’ কপট আর্তচিৎকার করে উঠল সবাই।
হেসে রিচার্ড বলল, ‘তোমরা যতই বাধা দাও আমার শেষ কথা আমি বলবই—সবাই জানালার ধারে যাও!’
মজার আর একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে মনে করে মার্কই সবচেয়ে প্রথম ওখানে পৌছল। ‘লাইট নিভিয়ে দাও,’ রিচার্ডের গলা শোনা গেল। কথা শেষ হবার আগেই অন্ধকার হয়ে গেল ঘর।
বাইরে অন্ধকার আকাশে যেন জাদুমন্ত্রেই আতশবাজির খেলা শুরু হল। টাকায় কী না হয়— এমন সুন্দর আতশবাজির খেলা ওরা কেউ এর আগে দেখেনি। উজ্জ্বল লাল, নীল, হলুদ আর সবুজের সমারোহ যেন রামধনু রঙে বারবার রাঙিয়ে দিচ্ছে আকাশ। চারদিকে আলো করে একঝাঁক হাউই বাজি আকাশে উঠে গেল। দেড়শো গজ উপরে উঠে সবগুলো ফেটে একাকার হয়ে গেল। মিলেমিশে বিভিন্ন রঙের অক্ষর বেরিয়ে এল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লেখা রয়েছেঃ
শুভ জন্মদিন, মার্ক ও ডেমিয়েন।
বিশ্বয়ে অভিভূত হয়ে হাততালি দিতেও ভুলে গেল ওরা। হাঁ করে অবাক চোখে চেয়ে রইল সবাই। তারপরই শুরু হল তালি, পরস্পরে আলিঙ্গন আর চুমো।
‘অপূর্ব! সত্যি চমৎকার!’ বলে ছুটে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আদর জানাল মার্ক।
ডেমিয়েন হাসল। সে-ও মার্কের মতই উপভোগ করছে, কিন্তু আবেগকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখেছে সে।
এই চিত্তাকর্ষক প্রদর্শনীতে কেবলমাত্র একজন নির্বিকার রইল—সে হচ্ছে বুহের। একা পেয়ে আবারও সে ডেমিয়েনের দিকে এগিয়ে গিয়ে ঠিক ওর পিছনে এসে দাঁড়াল। নিচু স্বরে ফিসফিস করে কথা বলল সে। অন্য কেউ শুনতে পেল না।
‘ছেলেদের তেরোতম জন্মদিন অনেকের মতেই বিশেষ একটা দিন। জু মতে এই সময়েই মানুষ পৌরুষত্ব পায়। একে ওরা বলে ‘মিজভা’ হিব্রু ভাষায় এর মানে হচ্ছে ‘নেতার পুত্র’ বা ‘যোগ্য পুরুষ’।
পল যে কি বলছে কিছুই বুঝল না ডেমিয়েন। কিন্তু ভদ্রতা বজায় রেখে সে বলল, ‘তাই নাকি?’ আবার আতশবাজির দিকে মনোযোগ দিল ও।
‘তুমিও চিহ্নিত হবে,’ বলল বুহের।
ওর দিকে ফিরে চাইল ডেমিয়েন। চোখে চোখে চেয়ে রয়েছে ওরা।
আরও মৃদু কণ্ঠে সম্মোহিতের মত বুহের বলে চলল, ‘বাইবেলের কথা বলছি বলে দোষ নিও না, কিন্তু করিংথিয়ানসের প্রথম বই-এ লেখা আছে, ‘আমি যখন শিশু ছিলাম শিশুর মতই ভাবতাম, কথা বলতাম—কিন্তু যখন প্রাপ্তবয়স্ক হলাম সব ছেলেমানুষী দূর হয়ে গেল।’ … তোমারও সেই বয়স হয়েছে ..এখন তোমার জানতে হবে তুমি কে।
‘জানতে হবে আমি কে? তার মানে?’
‘তোমার জীবনের এটা একটা চরম মুহূর্ত। হয়ত এরই মধ্যে তুমি তা কিছুটা অনুভব করতে পেরেছ।’
ওর কথাগুলো ডেমিয়েনকে ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছে। অবাক হয়ে শুনছে সে। প্রথমে ভেবেছিল বাবার সুনজরে পড়ার জন্যেই পল তার সাথে ভাব জমাচ্ছে। কিন্তু কেবল মাত্র এই পল বুহেরই গত কয়েক মাস তার মনে যে আলোড়ন চলছে তা সঠিক বুঝতে পেরেছে। মনে হচ্ছে লোকটা যেন তার ভিতরটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে।
‘কেমন যেন মনে হয়,’ বলল ডেমিয়েন। ঠিক বুঝতে পারি না আমি…টের পাই আমার ভিতরে কিছু একটা ঘটছে…ঘটতে যাচ্ছে।’ কথাটা পল বুঝল কিনা দেখার জন্যে ওর চোখের দিকে চাইল ডেমিয়েন।
হাসল পল। ‘অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, তাই না? আমাদের সবারই এমন হয়। তোমার বাবার, বিল অ্যাদারটনের… এমন কি আমারও।’ একটু থেমে নাটকীয়ভাবে সে আবার বলল, ‘জানো? আমিও বাপ-মা হারা একজন এতিম।
মাথা নাড়ল ডেমিয়েন।
‘তাই তোমার মনের কথা আমি বুঝতে পারি। আমি জানি গত জুনমাস থেকেই তোমার ভিতরের পরিবর্তনটা তুমি উপলব্ধি করতে আরম্ভ করেছ,’ বলে চলল পল। ‘তোমার প্রকৃত জন্মদিন ছিল…’
বিশ্বয়ে অভিভূত হল ডেমিয়েন। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ওদিক থেকে অ্যাদারটন ওদের চেঁচিয়ে ডাকল। ‘তোমরা দু’জন ওখানে কি করছ? এদিকে এসে অনুষ্ঠানে যোগ দাও!’
ওরা চেয়ে দেখল ওদিকে কেক কাটার প্রস্তুতি চলছে।
‘ডেমিয়েন, জলদি এসো!’ মার্কের আর তর সইছে না—জ্বলন্ত মোমবাতিগুলো নেভাবার জন্যে তৈরি সে।
একছুটে মার্কের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ডেমিয়েন। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, গুরুগম্ভীর আলোচনা আর ভাল লাগছিল না তার। কেকের ধার ঘেঁষে জ্বলছে তেরোটা মোমবাতি। সমবেত হর্ষধ্বনির মাঝে দু’জনে মিলে একসাথে ফুঁ দিয়ে বাতিগুলো নেভাল।
‘এবার কেক কাটা হোক,’ বলল অ্যান। আমরা সবাই অধীর ভাবে কেকের অপেক্ষায় আছি।’
‘কিন্তু তার আগে মার্ককে একটা সামান্য কিছু উপহার দিতে চাই আমি, ‘ বলেই পকেটে হাত ঢোকাল ডেমিয়েন।
মুচকি হেসে মার্ক দুঃখিত ভঙ্গিতে বলল, ‘হায়, তোমার জন্যে কিছু আনিনি আমি একেবারে ভুলে গেছি!’ গম্ভীর থাকার বৃথা চেষ্টা করে সে-ও শেষে নিজের পকেটে হাত দিল।
দু’জনের প্যাকেটই আকারে একেবারে সমান। এমন কি মোড়কের রঙও এক। মোড়ক খুলতে খুলতে হাসছে মার্ক। ‘তুমি যদি আমার জন্যে…’ আরম্ভ করল সে।
…..একই জিনিস…’ ওকে বাধা দিয়ে বলল ডেমিয়েন।
দু’জনেই একসাথে মায়ের দিকে ফিরে চাইল। ‘মা!’
বোঝা গেল উপহার দুটো অ্যানের কেনা। দু’জনেই আগ্রহভরে উপরের কাগজ ছিঁড়ছে। চমৎকার দুটো চকচকে কারুকাজ করা সুইস আর্মি ছুরি বেরিয়ে এল। উৎফুল্ল প্রশংসা উঠল অতিথিদের ভিতর।
‘আমার অনেক দিনের শখ ছিল!’ বলে উঠল মার্ক।
‘আমারও!’ বলে মার্ককে আদরের ছোট্ট একটা ঠেলা দিল সে।
কেকের ওপরই ছুরির ধার পরীক্ষা করবে বলে ঠিক করল ওরা। ছুরির সাহায্যেই কেকের ওপর থেকে স্কেটিংরত একটা মূর্তি সরিয়ে ফেলল ডেমিয়েন। তারপর দু’জনে একসাথে ছুরি চালাল কেকে। আনন্দমুখর হয়ে উঠল ঘরটা।
*
পরদিন সকালে লেক জেনেভার বরফের ওপর সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে রামধনুর রঙ ধরেছে। প্রকৃতি যেন আজ সকালে তার নিজস্ব ধারায় আলোর খেলা দেখাচ্ছে। গত সন্ধ্যায় আতশবাজির শোভা থেকে এটা কোন অংশে কম নয়।
লেক থেকে যে নদীটা বেরিয়েছে সেটা মুখের কাছে বেশ চওড়া হলেও এঁকেবেঁকে বনের ভিতর ঢুকে ধীরে ধীরে সরু হয়ে এসেছে। নদীর উপরটায় বরফে জমাট বেঁধেছে। এখানেই সচরাচর আইস হকি খেলা হয়। নদীর দুই পাড় সীমানার কাজ করে।
বিকেলের দিকে নদীর ওপর সবাই জড়ো হয়েছে। একটু পরেই শুরু হবে খেলা। থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির বড় বড় কর্মকর্তাদের নিয়ে দুটো দল তৈরি হবে। কমবয়সীদের মধ্যে মাত্র দু’জন খেলবে। মার্ক আর ডেমিয়েন। দু’জনে দুই দলের ক্যাপ্টেন। অ্যাকাডেমির বাকি ছেলেরা সবাই দর্শক।
টসে জিতেছে ডেমিয়েন। প্রথম বাছাই করার সুযোগ পেয়ে সে রিচার্ডকে বেছে নিল। ক্যাপ্টেনের প্রথম বাছাই হবার সম্মান পেয়ে অকৃত্রিম আনন্দে ছেলেমানুষের মত জোড়া পায়ে একটা লাফ দিয়ে স্কেট করে ডেমিয়েনের পাশে এসে দাঁড়াল রিচার্ড।
অ্যাদারটনকে বেছে নিল মার্ক। ভাল খেলোয়াড় সে মোটেও নয়, তার আকৃতিও ঠিক খেলার উপযোগী নয়। তবে খেলাধুলায় নিজের উৎসাহ দিয়ে সে আর সব ঘাটতি পূরণ করে নেয়। খুশি মনে মার্কের পাশে এসে দাঁড়াল বিল অ্যাদারটন।
দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে পলকে পছন্দ করল ডেমিয়েন। ওকে যে কি কারণে দলে নিল তা সে নিজেও বলতে পারবে না। হয়ত গতরাতে ওদের মধ্যেকার অদ্ভুত ধরনের কথাবার্তার ফলেই ডেমিয়েন একটু সৌজন্য দেখাল। যা হোক, ডেমিয়েনের দলে নির্বাচিত হয়ে পল খুব খুশি হয়েছে বোঝা গেল। উৎসাহিত হয়ে ছুটে গিয়ে বরফ ছিটিয়ে ‘ঘ্যাচ’ করে থেমে দাঁড়াল সে ডেমিয়েনের অন্য পাশে।
দল বাছাই-এর শেষে খেলা শুরু হল।
পল বুহেরকে দলে নিয়ে ভুল করেনি ডেমিয়েন। দক্ষ খেলোয়াড় সে। কিন্তু ডেমিয়েন হয়ে দাঁড়াল খেলার প্রধান আকর্ষণ। বল যেখানেই থাক, বলের সাথে ডেমিয়েন আছে। এই বয়সেই পেশাদার স্কেটারদের মত স্কেট করা শিখেছে ও।
অ্যান আর ওয়ারেন পাড়ে বসে খেলা দেখছে। হঠাৎ জোনের কথা তুলল অ্যান। ‘কাগজে তোমার রিপোর্টার বান্ধবীর কথা পড়লাম–জানি এখন আর দুঃখ জানিয়ে লাভ নেই, কিন্তু আমি সত্যিই দুঃখিত।‘
মাথা ঝাঁকাল ওয়ারেন। ‘কি করে যে এমন ঘটল…’ বলতে শুরু করল সে। কিন্তু খেলা অ্যানের পুরো মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে লক্ষ্য করে থেমে গেল। বল নিয়ে ডেমিয়েন প্রতিপক্ষ দলের সীমানার কাছে চলে গেছে। ওয়ারেনও খেলা দেখায় মন দিল। ওরা কেউ খেয়াল করল না একটা দাঁড়কাক ঠিক ওদের মাথার উপর গাছের ডালে এসে বসল।
বরফের ওপর দ্রুত গতিতে গোল পোস্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ডেমিয়েন। রক্ষণভাগে রয়েছে অ্যাদারটন। ডেমিয়েন সরাসরি এগিয়ে যাচ্ছে ওর দিকে দু’জনের মধ্যে প্রচণ্ড ধাক্কা লাগবে এখনি। তাড়াতাড়ি সরতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে জায়গাতেই আছাড় খেয়ে পড়ল বিল। ভয়ঙ্কর পরিণতির আশঙ্কায় ভয়ে চোখ বুজল সে।
অদ্ভুত দক্ষতার সাথে শেষ মুহূর্তে গতি পরিবর্তন করে বিলকে পাশ কাটিয়ে শাঁ করে বেরিয়ে গেল ডেমিয়েন। যাবার সময়ে ওর দেহের চাপে বরফে একটা সূক্ষ্ম চিড় ধরল।
চোখ খুলে অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করল বিল। ডেমিয়েনকে আশেপাশে দেখল না সে। ঘুরে চেয়ে দেখল ততক্ষণে সবেগে উল্টো দিকে রওনা হয়েছে ছেলেটা। চপপট উঠে অপটু ভাবে ওর পিছু নেবার চেষ্টা করল বিল। চিড়টা আরও গভীর আর লম্বা হয়ে অ্যাদারটনের আগে আগে চলল।
বুহেরই ব্যাপারটা প্রথম খেয়াল করে তাড়াতাড়ি ওদের দিকে এগোল।
বরফে ফাটল ধরার জোরালো দুটো আওয়াজ উঠল। অ্যাদারটনের চারপাশে বরফ ফেটে ফাঁক হয়ে গেল। খেলোয়াড়রা সবাই জায়গাতেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পাড়ের থেকে দর্শকদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত ডেমিয়েনের কাছে পৌঁছে কোমর জড়িয়ে ধরে শূন্যে তুলে ওকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এল পল। মাত্র ইঞ্চি দু’য়েকের জন্যে ফাটলের হাত থেকে রক্ষা পেল ওরা।
ভয়ে কাঠ হয়ে গেছে বিল। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে কি ঘটছে—কিন্তু কিছুই করার নেই ওর। ফাটল পেরিয়ে এপারে আসার আর সুযোগ পায়নি বেচারা।
‘বিল! আমি আসছি!’ চিৎকার করে বন্ধুর দিকে এগোল রিচার্ড।
আবারও হাড় ভাঙার মত শব্দ তুলে বরফে কয়েকটা ফাটল ধরল। অ্যাদারটনের তলায় বরফের চাকটা এখন পানিতে ভাসছে।
স্কেটাররা সবাই গর্তটার চারপাশে জড়ো হয়েছে। গর্তটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। বরফের ভেলার ওপর ভাসছে বিল। সবাই তাদের বাড়ানো হকি-স্টিক ওর ‘কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে।
কিন্তু বৃথা চেষ্টা। বিলের ভারে বরফের ভেলাটা একদিকে কাত হয়ে গেছে—বরফের ওপর ওর দেহটা আপনা-আপনি একটু একটু করে বরফের কিনারে পানির দিকে পিছলে নেমে যাচ্ছে।
পাড়ে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে নিজেকে চিৎকার করা থেকে বিরত রেখেছে অ্যান। কি ঘটতে যাচ্ছে সবই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সে, কিন্তু এটা রোধ করার কোন উপায় নেই তার।
বুহেরের হাত থেকে ছোটার প্রাণপণ চেষ্টা করছে ডেমিয়েন। অ্যাদারটনকে সাহায্য করতে চাইছে সে—কিন্তু পলের শক্ত মুঠো থেকে নিজেকে কিছুতেই ছাড়িয়ে নিতে পারছে না।
‘লাফ দাও!’ চিৎকার করল রিচার্ড।
কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। বিলের ভারে বরফের চাকটা আরও কাত হল— পিছলে ঝপ করে বরফের মত ঠাণ্ডা পানিতে পড়ল সে।
তলিয়ে গেল বিল। কয়েক সেকেণ্ড তাকে আর দেখা গেল না। তারপর হঠাৎ ভেসে উঠে খাবি খেয়ে একটু শ্বাস নিয়ে গ্লাভস পরা একটা হাত তুলে ভেঙে যাওয়া বরফের ধার ধরার চেষ্টা করল।
বরফের ওপর শুয়ে ঝুঁকে পড়ে রিচার্ড হাত বাড়াল। বিলকে সাহায্য করতে গিয়ে যেন রিচার্ডও পানিতে না পড়ে এ জন্যে একজন চট করে তার পিছনে শুয়ে তার পা চেপে ধরল। দেখাদেখি একই উপায়ে আরও কয়েকজন ওদের পিছনে শুয়ে পড়ে একটা শিকল তৈরি করে ফেলল। চিৎকার করে নিজের হাত বাড়িয়ে বিলের হাত ধরার চেষ্টা করল রিচার্ড।
কোনমতে বিলের মাথাটা কেবল পানির সামান্য উপরে ভেসে রয়েছে। ভয়ে ওর চোখ দুটো বিস্ফারিত। দু’হাতে বরফ খামচে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে বিল। কিন্তু ধারালো বরফে ওর গ্লাভস, হাত আর কব্জি চিরে ফালিফালি হয়ে রক্ত বেরিয়ে এল।
বরফের ওপর নিজের রক্ত দেখে একটা বুক কাঁপানো আর্তচিৎকার করে উঠল বিল। পরক্ষণেই স্রোতের টানে আবার তলিয়ে গেল সে। মনে হল কেউ যেন তার পা ধরে টেনে পানির তলায় নিয়ে গেল ওকে।
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আর তার দেখা পাওয়া গেল না। সবাই লাইন করে আর এক দফা খোঁজা শুরু করল ওরা। কালো দাঁড়কাকটা একটা বিকট চিৎকার দিয়ে আকাশে উড়ে চক্কর দিতে দিতে মিলিয়ে গেল।