অশুভ সংকেতের পর – ১২

বারো

থর্ন পরিবারের নিজস্ব কবরখানাটা ওদের বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়। রিচার্ডের বাবা রেজিনাল্ড থর্নকে এখানেই তার স্ত্রীর কবরের পাশে কবর দেয়া হয়েছে। রিচার্ডের প্রথম স্ত্রীর কবরও এখানেই। আন্ট মেরিয়ন ওদের থেকে একটু দূরে আলাদা জায়গায় রয়েছে।

ওরা মার্কের মায়ের পাশেই ওকে কবর দিচ্ছে।

শূন্য দৃষ্টিতে শীতের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ভিতর দিয়ে জড়ো হওয়া লোকজনের দিকে চেয়ে আছে রিচার্ড। একদিন তাকেও এখানে আসতে হবে, ভাবছে সে।

অ্যান আর রিচার্ড দু’জনেই কালো পোশাক পরেছে। ডেমিয়েন দাঁড়িয়ে আছে অ্যানের পাশে। ওর পরনে স্কুলের নেভিব্লু ইউনিফর্ম-বাম হাতে একটা চওড়া কালো ফিতে বাঁধা রয়েছে।

থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির তরফ থেকে এসেছে পল বুহের। অ্যাকাডেমি থেকে একদল ক্যাডেট নিয়ে মার্ককে ‘গার্ড অভ অনার’ দিতে এসেছে সার্জেন্ট নেফ। পাথরের মূর্তির মত অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাডেটের দল। কফিনটা কবরে নামানো শুরু হতেই একজন ক্যাডেট এক পা এগিয়ে এসে বিউগল্‌-এ করুণ সুরে ‘ট্যাপস’ বাজাতে শুরু করল।

বিউল্‌-এর প্রথম স্বরটা কানে যেতেই অ্যানের চোখ দিয়ে পানির ধারা নামল। মার্কের প্রিয় সুর ছিল ওটা। অকারণেই রিচার্ডের একটা পুরানো কাউবয় গানের কথা মনে পড়ছে আজ। তারা যখন অ্যাকাডেমিতে পড়ত তখন ক্যাম্পের আগুনের ধারে ওর ভাই রবার্ট ওই গানটা প্রায়ই গাইত! গানের কথাগুলো হচ্ছেঃ আজ শোবার ঘরে একটা বিছানা খালি পড়ে আছে…। ওর চোখেও এবার জল এল। ছেলে মারা যাবার পর এই প্রথম কাঁদল রিচার্ড।

চার্চের পাদরী প্রার্থনা শুরু করলেন। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল রিচার্ড। ধর্মকথা শোনার মত মনের অবস্থা এখন আর তার নেই। ওরা যে যা-ই বলুক, তার একমাত্র ছেলেকে ওরা কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না।

ডেমিয়েনের দিকে চোখ পড়ল ওর। খেয়াল করল ডেমিয়েন চেয়ে আছে নেফের দিকে—নেফ দেখছে বুহেরকে আর বুহের ডেমিয়েনকে। পরিপাটি একটা ত্রিভুজ তৈরি হয়েছে।

কিন্তু ও নিয়ে আর ভাবার সুযোগ পেল না রিচার্ড। হাতে টান অনুভব করে ঘুরে দেখল ভেজা চোখে অ্যান চেয়ে আছে তার দিকে। ওর চোখে অনুষ্ঠানের প্রতি একটু মনোযোগ দেয়ার মিনতি।

অ্যানের হাত চাপড়ে সান্ত্বনা দিয়ে কবরের দিকে ফিরল রিচার্ড। প্রীষ্ট কি বলছেন শোনার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ—কিন্তু অল্প পরেই সে আবার হারিয়ে গেল গত কয়েকদিনের ঘটনামালার চিন্তায়।

বারবার ঘুরে ফিরে ড. ফিডলারের অফিসে ময়না তদন্তের পরে যে সব কথা হয়েছিল সেগুলোই ওর মনে পড়ছে।

*

‘কিভাবে ঘটল এটা?’ ডাক্তারকে প্রশ্ন করেছিল সে। ‘আপনি তো ওকে ওর জন্মের পর থেকেই নিয়মিত দেখে আসছেন। আগে এর কোন ইঙ্গিত পাননি?’

বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়েছিল ডাক্তার। ‘এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটতে দেখেছি আমি। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষ—বাইরে থেকে তাই মনে হয় সুস্থ রয়েছে ওটা, কোন কারণে মানসিক চাপ বেশি হলেই, ব্যস—পাতলা ধমনী ছিঁড়ে যায়।’

এই সময়ে অ্যান প্রশ্ন করেছিল, ‘তাহলে ওটা জন্মের সময় থেকেই ওর মাথার ভিতরে ছিল?

মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার। ‘সেটারই সম্ভাবনা বেশি। আমি সত্যিই দুঃখিত।’

কিন্তু আমার কতটা দুঃখ তা তুমি বুঝবে না, ভেবেছিল থর্ন।

.

কবর দেয়া শেষ হতেই কবরের পাশ থেকে দূরে সরে এল শোকার্ত লোকজন। বেশ জোরে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সবাই তাড়াহুড়ো করে তাদের সমবেদনা জানিয়ে নিজেদের অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠছে।

বিদায় না নেয়া পর্যন্ত সবাইকে শুকনো হাসিতে কৃতজ্ঞতা জানাতে দাঁড়িয়ে থাকল রিচার্ড। লৌকিকতা শেষ হলে সে-ও নিচু হয়ে লিমোসিনে ঢুকে অ্যান আর ডেমিয়েনের পাশে বসল। রিচার্ডের নির্দেশ পেয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলল মারে।

.

পরের সপ্তাহে অনেক রাতে রিচার্ডের একটা ফোন এল নিউ ইয়র্ক থেকে। একজন প্রীস্ট ফোনে জানালেনঃ চার্লস ওয়ারেনের অবস্থা খুব খারাপ—ঘোরের মধ্যে সে বারবার রিচার্ডকে চাইছে-দেখা করতে হলে সে যেন অবিলম্বে নিউ ইয়র্ক চলে আসে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই সুটকেসে কয়েকটা দরকারি জিনিস ভরে যাবার জন্যে তৈরি হল রিচার্ড। অ্যান তাকে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে অনেক অনুরোধ করল, কিন্তু কোন বাধা মানল না রিচার্ড। এক্ষুনি তাকে যেতে হবে।

‘যেতে চাই না আমি,’ চড়া গলায় জবাব দিল রিচার্ড। ‘কিন্তু আমাকে যেতেই হবে!’

বিছানায় উঠে বসে সাইড টেবিল থেকে সিগারেট নিতে হাত বাড়াল অ্যান। হাত কাঁপছে ওর। ‘ফোনে ওয়ারেনের সাথে কথা বললেই তো পার? ওর জন্যে তাড়াহুড়া করে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত ছুটবার কি মানে আছে? তাছাড়া সে তো এই পরিবারের কেউ—’

‘ওরা বলল মহা বিপদে আছে চার্লস—আমাকে চাচ্ছে,’ বাধা দিয়ে বলে উঠল থর্ন। ঘরে চোখ বুলিয়ে কিছু নিতে বাকি থাকল কিনা দেখল সে।

‘আমরাও তোমাকে চাই, রিচার্ড,’ নিচু স্বরে বলল, ‘অ্যান।

ঘুরে ওর দিকে চেয়ে রিচার্ড বলল, ‘যত শীঘ্রি সম্ভব ফিরে আসব আমি।’ ঝুঁকে অ্যানের গালে চুমু খেয়ে দরজার দিকে এগোল সে।

‘সকালে ডেমিয়েনকে আমি কি বলব,’ প্রশ্ন করল অ্যান।

দরজায় দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করল রিচার্ড। ওর কথা ভুলেই গিয়েছিল সে। ‘ওকে বল,’ দ্রুত চিন্তা করছে রিচার্ড, ‘বল চার্লসকে কাস্টমসের একটা জরুরি সমস্যায় সাহায্য করতে নিউ ইয়র্ক গেছি—কিংবা যা খুশি বল-কেবল সত্যি কথাটা জানিও না!’ তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে।

পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নেমে অপেক্ষমান লিমোসিনে গিয়ে উঠল রিচার্ড। আসার পথে সে টের পেল না ডেমিয়েনের ঘরের দরজাটা সামান্য ফাঁক হল। ফাঁক দিয়ে বিড়ালের মত হলুদ দুটো চোখ লক্ষ্য করল সব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *