অশুভ সংকেতের পর – ১

এক

ছেলেটার মুখ লকলকে আগুনের আলোয় দীপ্ত হয়ে উঠেছে। খুবই সুদর্শন চেহারা, কিন্তু তেরো বছরের ছেলের জন্যে একটু যেন বেশি গম্ভীর। আগুনের দিকে চেয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। তার অন্তস্তল থেকে জ্ঞানী একটা সত্তা যেন শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে—কিন্তু…

‘ডেমিয়েন?’

নড়ল না সে। ডাকটা তার কানেই পৌঁছেনি। অন্য জগতে বিরাজ করছে সে। মালীরা আর ওকে বিরক্ত না করে ওর চারপাশ থেকে মরা পাতা উঠিয়ে নিচ্ছে।

শিকাগোর নর্থ শোরের একটা বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝখানে বিরাট একটা বনফায়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ডেমিয়েন। মাঠটা একদিকে যতদূর চোখ যায় চলে গেছে, আর অন্যদিকে প্রায় শেষ মাথায় রয়েছে একটা পুরানো প্রাসাদ। এটাই তার চাচার বাসা।

কিন্তু কল্পনায় সে এখন রয়েছে একটা অনন্ত অগ্নিকুণ্ডের মাঝখানে। তার চারপাশে অনবরত বিলাপ আর আর্তচিৎকারের শব্দ হচ্ছে। যারা আর্তনাদ করছে তারা জানে এই দুঃখকষ্ট আর জ্বালার কোনও শেষ নেই।

‘ডেমিয়েন!’

কল্পনার ছবি উবে গেল। দূরে প্রাসাঙ্গের ব্যালকনি থেকে তার ভাই মাৰ্ক প্ৰচণ্ড ভাবে হাত নেড়ে ডাকছে তাকে।

মার্ককে খুব পছন্দ করে ডেমিয়েন। ছেলেটা নরম আর উদার। নয় বছর আগে সে যখন প্রথম এখানে আসে তখন মার্কই তাকে আপন করে নিয়েছিল। এখন ওরা দুই জমজ ভাই-এর মত—একই মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে পড়ে। ছুটিতে বাড়ি এসেছিল দু’দিনের জন্যে—আজ একটু পরেই আবার স্কুলে ফিরে যাবে। ওর চাচা—চাচীও এই গ্রীষ্ম প্রাসাদ ছেড়ে শীত কাটাবার জন্যে শহরের বাসায় গিয়ে উঠবে সামনের বছর জুন মাসের আগে আর ওরা কেউ ফিরবে না এখানে।

মুখ তুলে মার্ককে দেখতে পেয়ে হাত নেড়ে আসছি’ বলে চিৎকার করেই তার জন্মগত সাবলীল খেলোয়াড়-সুলভ ভঙ্গিতে ছুটল বাড়ির দিকে। সে সদর দরজায় পৌঁছতেই মার্ক স্কুলে ফিরে যাবার জন্যে বেঁধে রাখা ঝোলা থেকে তার প্রিয় বিউগলটা বের করে বিদায় নেয়ার আগে করুণ সুরে ‘ট্যাপস’ এর সুর তুলে ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার বাতাস ভারি করে তুলল।

বাড়ির ভিতরে ঢুকল ডেমিয়েন। শিগগিরই তেরোতে পড়বে ও। কৈশোর ছেড়ে পরিণত যুবক হয়ে উঠছে সে।

রবিবার সন্ধ্যায় আন্ট মেরিয়নের সামনেই ছেলে দুটো বিদায় নিয়ে লিমোসিনে উঠল। শোফার ওদের মালপত্র নিয়ে গাড়িতে তুলল। প্রতিবারই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়—আসার সময়ে দু’জনেই একটা করে ব্যাগ নিয়ে এলেও দেখা যায় ফেরার সময়ে ওদের জনপ্রতি অন্তত ছয়টা করে ব্যাগ নিয়ে ফেরত যেতে হয়। রিচার্ড থর্নের দ্বিতীয় স্ত্রী অ্যান ছেলেদের বিদায় দিতে গাড়ির কাছে এগিয়ে গেল। মার্কের মা ডেমিয়েন এখানে ওদের সাথে থাকতে আসার মাত্র বছরখানেক আগেই একটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। রিচার্ডের সাথে অ্যানের আকস্মিকভাবেই আলাপ হয়। তারপর বিয়ে। পরিবারের সবাই এ বিয়েতে অনেকটা হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে, কারণ একা থাকলে দু’দুটো ছেলে নিয়ে রিচার্ডকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হত।

নয় বছর পরে গাড়ির কাছে অ্যানকে ছেলে দুটোকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে বিদায় দিতে দেখে মনেমনে নুতন করে আবার কৃতজ্ঞ বোধ করল রিচার্ড। সত্যি, গুণ আছে মেয়েটির ওদের একজনও তার নিজের ছেলে নয়; অথচ নিজের ছেলের মতই ওদের ভালবাসে সে।

রিচার্ড এগিয়ে গেল গাড়ির দিকে। মার্ক আবার বেরিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়ে বলল, ‘আমাদের জন্মদিনে আবার দেখা হবে তাই না, আব্বু?’

‘নিশ্চয়ই,’ মার্কের কপালে চুমো খেয়ে জবাব দিল রিচার্ড। তারপর গাড়ির ভিতরে উঁকি দিয়ে ডেমিয়েনের উদ্দেশ্যে বলল, ‘কই ডেমিয়েন? তুমি যাবার আগে বুড়োকে একটু আদর করে দেবে না?’ নিজের ছেলে নয় বলে ডেমিয়েনকে সে কম প্রাধান্য দিচ্ছে এটা ওকে ভাবতে দিতে চায় না রিচার্ড।

খুশি হয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে রিচার্ডকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল ডেমিয়েন। বিদায় পর্ব শেষ করে ডেমিয়েন আবার গাড়িতে গিয়ে বসল। বরযাত্রীর গাড়ির মতো ধীরগতিতে এগোতে শুরু করল ওদের গাড়ি। বাঁক নিয়ে গাড়িটা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত রিচার্ড আর অ্যান হাত নেড়ে ওদের বিদায় জানাল।

ঘরে ঢোকার জন্যে ঘুরেই অ্যান খেয়াল করল তিনতলায় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আন্ট মেরিয়নও এতক্ষণ পর্দা সরিয়ে ছেলেদের বিদায় নেয়া দেখছিল অ্যান মুখ তুলে তাকাতেই পর্দা ছেড়ে দিয়ে সরে গেল আন্ট।

.

লিমোসিনের নরম গদি বসানো পিছনের সিটে গা এলিয়ে দিয়ে বসে মুখ দিয়ে শব্দ করে শ্বাস ছেড়ে ডেমিয়েন বলল, ‘ওহ্, বাঁচা গেল!’

‘যা বলেছ,’ সম্মতি জানাল মার্ক। ‘দম বন্ধ হয়ে এসেছিল, চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করছিল আমার!’

‘আমারও—ইচ্ছাটা পূরণ করি এসো।’ দু’জনে একসাথে কানফাটা একটা চিৎকার দিল। কানে তালা লেগে যাবার দশা হল মারের। একটু নড়েচড়ে বসে আবার রাস্তার ওপর নজর দিল সে।

‘মারে,’ চিৎকার থামিয়ে বলে উঠল ডেমিয়েন। ‘একটা সিগারেট দাও তো?’

রিয়ার ভিউ মিররে চেয়ে মাথা নাড়ল মারে। ‘ওটার জবাব তোমার ভাল করেই জানা আছে, ডেমিয়েন।

কাঁধ ঝাঁকাল সে। ‘তবু চেয়ে দেখলাম।’ হঠাৎ ঘুরে বসে বুড়ো আঙুল নাকে ঠেকিয়ে বাকিগুলো নেড়ে সে মার্ককে বলল, ‘দেখ, এটা আন্ট মেরিয়নের জন্যে! স্পেশাল! পশাল!’

বিউগল তুলে ডেমিয়েনের সালাম সমর্থন করে বেসুরো একটা কর্ড বাজাল মার্ক। ‘ঈশ্বর,’ ঘুরে বসে আবার মন্তব্য করল, ‘কেন যে ওরা ওই বদমেজাজী বুড়িটাকে এখানে ঢুকতে দেয় বুঝি না। অসহ্য!’

‘এটাও বুঝলে না? আন্ট না এলে মুখের সামনে আঙুল নেড়ে শাসন করে আমাদের ছুটির আনন্দ আর কে মাটি করবে?’ ব্যাখ্যা করল ডেমিয়েন।

‘বয়স হয়েছে বলেই কাউকে নিয়ে এমন রসিকতা করা ঠিক না,’ মন্তব্য করল মারে।

হঠাৎ ডেমিয়েনের ভাবভঙ্গি সম্পূর্ণ বদলে গেল। ‘মারে ঠিকই বলেছে,’ বলে নিজের মন্তব্যে নিজেই বেশ অবাক হল সে।

চট করে একবার ডেমিয়েনের দিকে চেয়ে ও ঠাট্টা করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করল মার্ক। ‘বুড়ির সময় শেষ হয়ে এসেছে,’ গম্ভীরভাবে বলল ডেমিয়েন। ওকে নিয়ে আর ঠাট্টা করা শোভন হবে না।’

পরিবেশটা ভারি হয়ে উঠেছে বুঝে চুপ করে রইল মার্ক। শেষ পর্যন্ত মারেই প্রসঙ্গ পালটে প্রশ্ন করল, ‘নতুন প্ল্যাটুন লীডারের সাথে পরিচয় হয়নি তোমাদের?’

মাথা নাড়ল ওরা। মার্ক মন্তব্য করল, ‘এরই মধ্যে আর একজন এসে গেছে? আমি মনে মনে দোয়া করছিলাম যেন ওরা বদলী কোনোদিনই না পায়!’

হাসি চাপতে গিয়ে ‘খুঁক’ করে শব্দ করে উঠল ডেমিয়েন। পরিবেশটা আবার সহজ হয়ে এসেছে দেখে মার্কও হাসল।

আগের সার্জেন্টের কি হয়েছিল শুনেছ?

‘না তো?’ কনুই দিয়ে মার্কের পেটে গুঁতো দিল ডেমিয়েন। আবার খেলায় মেতে উঠেছে ওরা।

‘ওরা বলে লোকটা নাকি আত্মহত্যা করেছে।’ সামনের আয়নায় পিছনের সিটে বসা ছেলে দুটোর প্রতিক্রিয়া খেয়াল করার চেষ্টা করল মারে। কোন বিকার দেখা গেল না। আত্মহত্যার কথায় বিচলিত হয়নি ওরা।

‘প্ল্যাটুন লীডার সবই এক,’ বলল ডেমিয়েন। ‘ওদের একজনকে দেখলেই সবাইকে চেনা হয়ে যায়।’ কথা শেষ করেই সে ব্যঙ্গ করে সার্জেন্টের গলা নকল করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘টেন্-শন্! সামনে তাকাও! বুক উঁচু! পেট ভিতরে! পাছা বাইরে!!’

হেসে লুটিয়ে পড়ল ওরা দু’জন।

‘আন্ট মেরিয়নের সম্মানে শেষ একটা সুর বাজাও!’

বিউগলটা তুলে বিকট একটা বেসুরো শব্দ করল মার্ক। তীক্ষ্ণ শব্দটা নিস্তব্ধ ঠাণ্ডা রাতকে চমকে দিয়ে বাতাসে ভেসে রইল। নিজের অজ্ঞাতেই শিউরে উঠল সে।

.

টেবিলে বারোজনের বসার জায়গা থাকলেও আজ রাতে খাবার ঘরে ওরা মাত্র চারজন। টেবিলের মাথায় রিচার্ড, বামদিকে স্ত্রী অ্যান আর ডানদিকে আন্ট মেরিয়ন। তার পাশে মাঝবয়সী ডক্টর চার্লস ওয়ারেন। ভদ্রলোক খ্রিস্টান ধর্মের বিশ্বজোড়া পুরানো শিল্পকলা বিশারদ। বর্তমানে থর্ন জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত।

কারও বাড়তি কফি লাগবে কিনা জানতে ঘরে ঢুকেছিল বাটলার। কিন্তু রিচার্ডের মুখের ভাবটা একবার লক্ষ্য করে সরে পড়ল। আন্ট মেরিয়ন তৈরি হচ্ছে—আশেপাশের সবাই ঝড়ের অপেক্ষায় রয়েছে। রিচার্ড চায় না ওদের ব্যক্তিগত সব কথা বাটলারের কানে যাক।

‘রাত হয়েছে, তাছাড়া আমিও ক্লান্ত,’ বাকি তিনজনের দিকে একবার চেয়ে শুরু করল আন্ট মেরিয়ন। ‘সোজাসুজি কাজের কথায় আসা যাক। বয়স হয়েছে আমার, খুব বেশিদিন আর বাঁচব না আমি। থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির সাতাশ শতাংশের মালিকানা রয়েছে আমার। আমার নিজের খুশিমত এই অংশ আমি ব্যবহার করতে পারি।’

‘এ তো সবাই জানে,’ বলল রিচার্ড। আন্ট মেরিয়ন কথা তুললে সে সব সময়ে এই কথাই বলে।

‘তোমরা সবাই জানো আমার অংশ আমি রিচার্ডকেই দিয়ে যাব। কিন্তু আজ সবার সামনেই আমি জানিয়ে দিচ্ছি যে আমার কথামত না চললে…’

ন্যাপকিনটা ছুঁড়ে টেবিলের ওপর রাখল রিচার্ড। ব্ল্যাকমেইল ঘেঁষা সামান্য ইঙ্গিতও ওর কাছে অসহ্য। ‘ওসব বলে আমাকে ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না, মেরিয়ন,’ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে সে। ‘ওই টাকার তোয়াক্কা করি না আমি।’

‘টাকার অঙ্কটা তিন বিলিয়ন ডলার! কেয়ার কর না বললেই হল?’

উঠে দাঁড়াল ডক্টর ওয়ারেন। অস্বস্তি বোধ করছে সে। ‘এসব ব্যক্তিগত কথায় আমার থাকা ঠিক না—আমি চলি,’ বলে যাবার জন্যে তৈরি হল ওয়ারেন।

আন্ট মেরিয়ন বাধা দিল। ‘আপনি থর্ন জাদুঘরের আইন সম্মত প্রতিনিধি, তাই কথাটা আপনারও জানা দরকার। ওটারও শতকরা সাতাশ ভাগের মালিক আমি।’ বিব্রতভাবে একবার রিচার্ডের দিকে চেয়ে আবার নিজের চেয়ারে বসে পড়ল ওয়ারেন।

‘ছেলে দুটোকে মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দু’জনকেই দুই স্কুলে পড়াতে চাই আমি।’

নীরবতার মাঝে কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল। অনেক কষ্টে রাগ চেপে শেষে ঝাঁঝের সাথে অ্যান বলল, ‘ছেলেদের বেলায় আপনার মতামতের কোন দাম নেই, ওরা আমাদের ছেলে, আমাদের ইচ্ছা মতই মানুষ হবে ওরা।’

এই জবাবই আশা করেছিল আন্ট মেরিয়ন। ওরা পরস্পরকে মোটেই সহ্য করতে পারে না। সামান্য হেসে সে জবাব দিল, ‘তুমি ভুলে যাচ্ছ, অ্যান—ওদের

একজনও তোমার নিজের ছেলে নয়। মার্ক হচ্ছে রিচার্ডের প্রথম স্ত্রীর সন্তান, আর ডেমিয়েন তার ভাই-এর ছেলে।’

রাগে থরথর করে কাঁপছে অ্যান। চোখ ফেটে কান্না আসছে তার। চেয়ার পিছনে ঠেলে উঠে দাঁড়াল সে। রিচার্ড তাড়াতাড়ি অ্যানের পাশে গিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিল ওকে।

‘এসব তুমি কি আরম্ভ করলে?’ অনুযোগ করল রিচার্ড

‘ঠিকই বলছি আমি,’ বলে চলল মেরিয়ন। মার্কের ভালোর জন্যেই বলছি ওদের আলাদা থাকা দরকার। বুঝতে পার না? ডেমিয়েনের দুষ্ট প্রভাবে মার্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

‘যথেষ্ট হয়েছে,’ ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠল রিচার্ড। ‘এবার তোমার কামরায় ফিরে যাও। চল, আমি নিজেই তোমাকে পৌছে দিচ্ছি।

রিচার্ডের চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মেরিয়ন। ‘তুমি একেবারেই অবুঝ, রিচার্ড—অন্ধ।’ দু’হাতে ওর জ্যাকেটের হাতা খামচে ধরল মেরিয়ন। তুমি জানো তোমার ভাই রবার্ট নিজেই তার ছেলে ডেমিয়েনকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছিল…’

ডক্টর ওয়ারেনের একথা জানা ছিল না। সচকিত হয়ে মুখ তুলে চাইল সে। লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল অ্যান। ‘এক্ষুনি সরিয়ে নিয়ে যাও রিচার্ড, আমার চোখের সামনে থেকে দূর কর ওকে।

আর সময় পাওয়া যাবে না, যা বলার এখনই বলতে হবে বুঝতে পারছে মেরিয়ন। বলে চলল সে, ‘ডেমিয়েনকে কেন মারতে গেছিল সে? জবাব দাও! সবার সামনে সত্যি কথাটা বল!’

নিজেকে সংযত রাখা রিচার্ডের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে বলল, ‘রবার্ট অসুস্থ ছিল। মানসিক…’

‘চুপ কর!’ চিৎকার করে উঠল অ্যান। ‘ওর কথার কোন জবাব দিও না!’

কি করবে বুঝতে পারছে না ওয়ারেন। ঘটনায় অত্যন্ত বিস্মিত আর অপ্রস্তুত হয়ে হাতের জ্যাপকিনটা মোচড়াচ্ছে, আর কল্পনায় অদৃশ্য হয়ে যেতে চাইছে সে।

একটা লম্বা দম নিয়ে আন্ট মেরিয়ন এবার শেষ চেষ্টা করল। ‘তোমরা ডেমিয়েনকে আলাদা না করলে আমার অংশ আমি কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করে যাব। যে কোন…

‘যা খুশি কর!’ গর্জে উঠল রিচার্ড। ‘পোড়াও— পানিতে ফেল, কিন্তু আমাকে ভয় দেখিয়ে…’

‘কথা শোন, রিচার্ড,’ অনুনয় করল মেরিয়ন। কান্নার ভাব প্রকাশ পেল তার গলায়। ‘তুমি তো জানো আমি সত্যি কথাই বলছি। বয়স হয়েছে আমার কিন্তু পাগল হইনি। তোমার ভাই ডেমিয়েনকে হত্যা করতে চেয়েছিল। কেন?’

দূর হও এখান থেকে!’ অ্যান মারমুখী হয়ে তেড়ে এগিয়ে গেল। রিচার্ড ধরে ফেলল ওকে। কিন্তু ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে মেরিয়নের মুখের সামনে আঙুল তুলে চিৎকার করল, ‘ওকে…চলে…যেতে…বল!’ থর থর করে কাঁপছে ওর আঙুলটা।

‘যাচ্ছি!’ বলে নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে নিল মেরিয়ন। তারপর ডক্টর ওয়ারেনের দিকে চেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বিদায় জানিয়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। রিচার্ড ওকে অনুসরণ করল।

প্রাসাদের ভিতরে ওদের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল। ডক্টর ওয়ারেনের দিকে ফিরে অ্যান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘আমি দুঃখিত, ভাবতেও পরিনি এমন একটা…’

‘না না, ওতে আমি কিছু মনে করিনি,’ বাধা দিয়ে বলে উঠল চার্লস ওয়ারেন। উঠে দাঁড়িয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে সে বলল, ‘চল, বসার ঘরে গিয়ে প্রজেক্টরে কিছু স্লাইড দেখা যাক। রিচার্ড আর তোমাকে দেখাবার জন্যে কিছু সুন্দর ছবি সাথে এনেছি আমি।’

কোনমতে এ ঘর থেকে পালাতে পারলেই বাঁচে সে।

.

তিনতলার ওপরে উঠে রিচার্ডের কাছ থেকে নিজের হাতটা জোর করে ছাড়িয়ে নিল মেরিয়ন। বৃদ্ধাকে হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে সাহায্য করছিল রিচার্ড।

কারও সাহায্য দরকার নেই আমার–একাই চলতে পারি আমি।’

নীরবে এগিয়ে চলল ওরা। নিজের কামরার কাছে পৌঁছে রিচার্ডের দিকে ফিরে দাঁড়াল মেরিয়ন। ‘তোমার ভাই ডেমিয়েনকে হত্যা করতে…’

‘ওসব কথা আগেও অনেকবার আলোচনা হয়েছে, আন্ট মেরিয়ন।’

‘কিন্তু এর একটা কারণ থাকবে তো?’

তুমি তো জানো এসব নিয়ে আলোচনা আমি অপছন্দ করি, তাও বাইরের একজন অতিথির সামনে—সত্যি…’

‘কিন্তু নিজের ছেলেকে সে মারতে চাইবে কেন?’ মানসিক চাপের মধ্যে ছিল—সুস্থ ছিল না সে।’

‘আর ডেমিয়েন? তোমার কি মনে হয় সে ঠিক আছে?’

‘ওর আবার কি দোষ?’ বলেই সে টের পেল আবার তার স্বর চড়ে গেছে। সামলে নিয়ে স্বাভাবিক গলায় সে বলল, ‘তুমিই তিলকে তাল বানিয়ে ডেমিয়েনকে অন্য চোখে দেখছ।

‘দেখার চোখ নিয়ে দেখলে তুমিও দেখতে পেতে।’

শেষ পর্যন্ত তাহলে তাই ঘটেছে, পাগল হয়ে গেছে আন্ট মেরিয়ন—ভাবল রিচার্ড। ‘ক্লান্ত তুমি, ঘুমাতে যাও। তোমার মাথাটা এখন আর ঠিক মত কাজ করছে না।’

একটা ভুরু ওঁচাল আন্ট মেরিয়ন। কোথায় আঘাত করলে সবচেয়ে বেশি লাগবে তা জানা আছে তার। মাথায় যে তার দোষ হয়নি সেটা ভাল করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যেই সে বলল, ‘আমার থেকে ডেমিয়েন যেন কিছু না পায় আগামীকাল সেই ব্যবস্থাই আমি করব!’ দরজার হাতল ছুঁলো সে।

ওর হাত ধরে ফেলল রিচার্ড। ‘তোমার অংশ নিয়ে তুমি যা খুশি করতে পার, ‘ মরিয়া হয়ে উঠেছে ওর গলা। ছেলে দুটোর স্বার্থরক্ষা করার জন্যে ওই শেয়ারগুলো তার অবশ্যই দরকার। ‘কিন্তু…’

‘জানি, এটা তোমার বাড়ি, আর আমি তোমার অতিথি,’ কথাটা শেষ করল মেরিয়ন। তবে এটা আমার কামরা-আজকের মত তোমাকে আমি বিদায় দিচ্ছি যাও।’

কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে হাত দিয়ে চোয়াল ঘষল রিচার্ড। সহজে বিচলি হয় না সে। কিন্তু এই মহিলা তাকে সহজেই অস্থির করে তোলার ক্ষমতা রাখে চট করে আন্ট মেরিয়নের গালে একটা দায়সারা চুমো খেয়ে সে বলল, ‘মারে কা ভোরে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে তোমার জন্যে।’ আর না দাঁড়িয়ে সোজা ফিরে চলল সে।

রিচার্ড অন্ধকার বারান্দা দিয়ে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত এখানেই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল আন্ট মেরিয়ন। সে অদৃশ্য হতেই একটা সাফল্যের হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। বিজয় দর্পে ঘরে ঢুকে সশব্দে দরজা বন্ধ করল সে।

বৈঠকখানায় পৌঁছে রিচার্ড দেখল ডক্টর ওয়ারেন স্লাইড প্রোজেক্টরে অ্যানকে ছবি দেখাচ্ছে। থর্ন জাদুঘরের জন্যে কিছু নতুন জিনিস আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে, ওগুলো তারই ছবি।

প্রত্নতত্ত্বের দিকে একটা স্বাভাবিক ঝোঁক আছে রিচার্ডের। ছোট্ট শহর আকরের কাছে একটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ মাটি খোঁড়ার কাজে টাকা পয়সা দিয়ে লোক লাগিয়েছিল তার বাবা রেজিনাল্ড থর্ন। ইদানীং সেই কাজ থেকে সুফল পেতে আ করেছে রিচার্ড।

প্রোজেক্টর চালু করে দিয়ে চার্লস ওয়ারেন বলল, ‘এসব জিনিসের মধ্যে বেশ কিছু এর মধ্যেই জাহাজে করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে-শিগগিরই প্রথম চালানটা এখানে পৌঁছে যাবে।’

প্রথম কয়টা বিভিন্ন আকারের মূর্তি আর পাত্রের ছবি। ছবিগুলো দেখতে দেখতে আন্ট মেরিয়নের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেল রিচার্ড। অ্যান তার স্বামীর দিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসল। কিছু, মানুষ আর কিছু জিনিসের প্রতি রিচার্ডের এই একাগ্র মনোযোগ আর আকর্ষণ আছে বলেই তার পক্ষে রিচার্ডকে স্বামী হিসেবে পাওয়া সহজ হয়েছে।

অ্যানের চিন্তার জাল ছিন্ন করে ওয়ারেন বলে উঠল, ‘এই ছবিটায় দেখা যাবে এই শিপমেন্টের একটা বিশেষ আর প্রধান আকর্ষণ।’

পর্দার দিকে চেয়ে নিজের অজ্ঞাতেই বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল অ্যানের মুখ। বেশ বড় একটা মূর্তি— ছবিতে প্রতিটি অঙ্গ তীব্র উজ্জ্বল রঙে উগ্রভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সাতটা মাথা বিশিষ্ট একটা জন্তুর ওপর বিজয়িনীর ভঙ্গিতে বসে আছে এক কামুক আমন্ত্রণে ভরা লম্পট নারী। গাঢ় লাল, বেগুনী আর সোনালী বেশের সাথে প্রচুর গয়না রয়েছে মেয়েটির পরনে। জন্তুর মাথাগুলো লম্বা চিকন গলার সাথে এসে মিশেছে। প্রত্যেক মাথায় শিঙ রয়েছে, মুখে বিষ দাঁত আর লম্বা বিভক্ত সরু জিভ। মেয়েটির মাথা পিছন দিকে হেলানো। লম্বা ঘন চুলের আলুথালু অবস্থা। হাতে ধরা একটা সোনালি গণপাত্র। সুরায় মত্ত সে।

‘ওঃ, মা,’ অস্ফুট স্বর বেরিয়ে এল অ্যানের গলা থেকে।

‘হ্যাঁ, ছবিটা আসলেই একটু ভয়ঙ্কর,’ স্বীকার করল চার্লস।

‘বেবিলনের বেশ্যা না?’ প্রশ্ন করল রিচার্ড।

মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল চার্লস। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চেয়ে জেরা করল অ্যান, ‘তুমি চেন ওকে?’ বলার ভঙ্গিতে সবাই হেসে উঠল। একটা পেন্সিল তুলে নিয়ে পর্দার কাছে এগিয়ে গেল চার্লস। ‘রোমের প্রতীক এই মেয়েটি। আর জন্তুটার মাথায় ক্ষুরধার শিঙগুলো রাজ্যহীন দশজন রাজাকে বোঝাচ্ছে। কথিত আছে যে পৃথিবীতে শয়তানের আবির্ভাবের পর ওরা পূর্ণ ক্ষমতা লাভ করবে।

‘জন্তুর পিঠে চড়েছে কেন মেয়েটা?’ জানতে চাইল অ্যান।

‘জানি না,’ জবাব দিল চার্লস। ‘তবে পবিত্র বাইবেলের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে ওই দশজন ওকে উলঙ্গ করে ওর মাংস খাবে, তারপর ওকে আগুনে পোড়াবে।’

‘চমৎকার!’ শিউরে উঠল অ্যান। ‘এসব বিশ্বাস কর তুমি?’

‘বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। আমার মনে হয় বাইবেলে অনেক কথাই একটু হেঁয়ালি করে উপমা দিয়ে লেখা হয়েছে। প্রকৃত অর্থ আমাদেরই উপলব্ধি করে বুঝে নিতে হবে।’

‘যেমন?’ চীনা জোঁকের মত ধরল অ্যান। কৌতূহলী হয়ে উঠেছে সে।

ফাঁপরে পড়ল চার্লস। কিছুদিন আগে পর্যন্তও সে এসব ব্যাপারে নাক সিঁটকাত। ধর্মীয় ব্যাপারে তার আকর্ষণ ছিল সম্পূর্ণ জ্ঞান-ভিত্তিক। ধীরে ধীরে সে উপলব্ধি করেছে, সবকিছুর পিছনেই একটা ঐশ্বরিক শক্তি রয়েছে। একটা কারণ রয়েছে।

তার বর্তমান বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করেই অ্যানের প্রশ্নের জবাব দিল সে। ‘ঘটনাচক্রে মনে হয় কেয়ামত ঘনিয়ে এসেছে।

‘কী?’ অ্যান ভাবছে চার্লস ঠাট্টা করছে।

‘গত দশ বছরে এমন কতগুলো ঘটনা ঘটেছে যেসব মহাপ্রলয়ের আগে ঘটবে বলে বাইবেলের ব্যাখ্যা বইয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। ভূমিকম্প, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ, জলবায়ুর পরিবর্তন….

‘কিন্তু এসব তো অহরহই ঘটছে?’ প্রতিবাদ করল অ্যান।

‘তা ঠিক, তবে সেই সাথে বিশেষ কিছু ঘটনাও ঘটেছে। যেমন, ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা হয়েছে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা লিখিত ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ হওয়ার অল্পকাল পরেই এটা ঘটবে। ষাট দশকে সেটা সম্পূর্ণ হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে শেষ তুলকালাম কাণ্ডটা ঘটবে মধ্যপ্রাচ্যে।

‘কিন্তু…’ আরম্ভ করল অ্যান।

বাধা দিল রিচার্ড। ‘ওসব কথা এখন থাক। শেষ যদি এসেই থাকে, নিশ্চিহ্ন হবার আগে মিউজিয়মের জন্যে এত টাকা খরচ করে কি কিনলাম সেটা দেখা যাক।’

পরিবেশটা হাল্কা হয়ে গেল। এমনকি চার্লসও হাসি চাপতে পারল না। বোতাম টিপে পরের ছবিতে চলে গেল সে।

পরের ছবিটার বিষয় একই। বেশ দূর থেকে তোলা হয়েছে ছবিটা। মূর্তির আকার অনুমান করার জন্যে একজন যুবতী মেয়েকে ওটার পাশে দাঁড় করানো হয়েছে।

‘মেয়েটা কে?’ প্রশ্ন করল রিচার্ড।

‘আমি তো ভেবেছিলাম এই মেয়েটাকেও তুমি চেন!’ কথার চিমটি কাটল অ্যান।

আমার পরিচিত একজন মহিলা সাংবাদিক। নাম জোন হার্ট। ওর নাম শোননি? প্রত্নতত্ত্ববিদ বুগেনহাগেনের আত্মজীবনী লিখছে ও।’

পরেরটা জোনেরই ছবি—কাছে থেকে তোলা! চমৎকার দেখতে মেয়েটা। লালচে চুল আর উজ্জ্বল প্রাণবন্ত চোখ।

‘একটু পক্ষপাতিত্বের গন্ধ পাচ্ছি?’ মন্তব্য করল অ্যান

মাথা নেড়ে কথাটা হেসে উড়িয়ে দিল চার্লস। ‘আরে না, তেমন কিছু না। তবে এটা ঠিক মেয়েটা খুব সুন্দরী হলেও বেশ কাজের। শিগগিরই শিকাগো আসছে মেয়েটা। ও তোমার একটা সাক্ষাৎকার নিতে চায়, রিচার্ড।’

‘আমার? কেন?’

‘খোঁড়াখুঁড়িতে তোমার কতটা উৎসাহ— জাদুঘর খোলার কতদূর এগোল, এইসব জানতে চায়।’

তুমি তো জানো আমি কাউকে সাক্ষাৎকারের অনুমতি দিই না, চার্লস।’

‘জানি।’

‘তাহলে?’

‘না, আমি ভাবলাম…’

‘ওকে জানিয়ে দিও।’

‘ঠিক আছে, রিচার্ড, তোমার জবাব ওকে জানিয়ে দেব আমি।’ চার্লস ভাল করেই জানে এখানে শত অনুরোধ করেও কোন ফল হবে না।

.

ঘন্টাখানেক পর প্রাসাদের সদর দরজায় থর্ন দম্পতি চার্লসকে বিদায় জানাতে গেল।

কালকেই শহরে চলে যাচ্ছি আমি,’ জানাল রিচার্ড। ‘অ্যান এখানকার পাট চুকিয়ে পরে আসবে।

মাথা ঝাঁকাল চার্লস। ‘এবারের গ্রীষ্মটা ভালই কাটল,’ অ্যানের সাথে হাত মিলিয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়াল সে।

‘আগামী পরশু তোমার সাথে দেখা হবে,’ বলল অ্যান।

গাড়ির কাছে এগিয়ে এসে একটু বিব্রত ভঙ্গিতে রিচার্ড শুরু করল, ‘আন্ট মেরিয়নের ব্যাপারটা…’

‘ওটা তখনই ভুলে গেছি,’ বলে দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল চার্লস। রিচার্ড হাত নেড়ে বিদায় জানাতেই কিছুটা সাদা ধোঁয়া ছেড়ে রাতের অন্ধকারে এগিয়ে গেল চার্লস ওয়ারেনের গাড়ি।

সবার অলক্ষ্যে জানালা খুলতে এসে তিনতলা থেকে ওদের সব কথাই শুনতে পেল আন্ট মেরিয়ন। তার হয়ে এমন করে চার্লসের কাছে রিচার্ডের ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টায় মেরিয়নের মনটা আরও বিষিয়ে গেছে। জানালার ধার থেকে সরে এসে বাইবেল নিয়ে বসল সে। রাতে জানালা খোলার মত ঘুমোবার আগে খানিকটা বাইবেল পড়া তার চিরকালের অভ্যাস।

কিন্তু আজ রাতে আর বাইবেলে মন বসছে না তার। আগামীকালই সে নতুন উইল করবে। হ্যাঁ, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে-ওদের উচিত শিক্ষা না দিয়ে শান্তি নেই তার। কোন একটা ধর্মীয় সংস্থাকেই সে তার শেয়ারের সব টাকা দান করে যাবে।

প্রতিশোধের চিন্তায় বিভোর থাকায় কখন যে একটা বিশাল কালো দাঁড়কাক মেরিয়নের জানালার কার্নিসে এসে বসেছে টেরই পেল না সে। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কাকটা চেয়ে রয়েছে মেরিয়নের দিকে।

.

পুরানো ফ্যাশনের একটা চশমা চোখে দিয়ে বিছানায় শুয়ে একগাদা কোম্পানি রিপোর্ট পড়ছে রিচার্ড। থর্ন ইণ্ডাস্ট্রিজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে প্রায়ই তাকে অনেক রাত পর্যন্ত এমনি অফিসের কাগজপত্র দেখতে হয়।

কিছুতেই সে আজ কাজে মন বসাতে পারছে না। আন্ট মেরিয়ন বাইরের লোকের সামনে তার ভাইয়ের মৃত্যুর কথা তুলে তার মনমেজাজ বিগড়ে দিয়েছে। যেসব কথা সে ভুলে থাকতে চায় সেসব কথাই কেবল মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তার মনে। কে জানে তার ভাই বেঁচে থাকলে সে আজ কি হত? প্রেসিডেন্ট হওয়াও বিচিত্র ছিল না। নিজের পেশায় প্রায় শীর্ষস্থানে পৌঁছে শেষ পর্যন্ত পাগলা কুকুরের মত গুলি খেয়ে প্রাণ হারানো ….

‘রিচার্ড!’ ড্রেসিং টেবিলের সামনে ব্রাশ দিয়ে চুল আঁচড়ানোর মাঝেই থমকে থেমে গেছে অ্যানের হাত। বেচারী নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ থেকেই তার মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল। চশমাটা ঠেলে কপালে তুলে দিয়ে ওর দিকে চাইল রিচার্ড!

‘আমাকে কথা দিতেই হবে,’ বলল অ্যান।

‘কিসের কথা, হানি?’

ফোঁস করে হতাশ ভাবে জোরে শ্বাস ফেলল অ্যান। বোঝাই যাচ্ছে এতক্ষণ ওর একটা কথাও রিচার্ডের কানে যায়নি। ‘আন্ট মেরিয়নকে জন্মের মত এখানে আর আসতে না দেয়ার কথা বলছি।’

‘ওহ্, অ্যান…’

‘কথা দাও!’

‘চুরাশি বছর বয়স হয়েছে তার, আর ক’টা দিনই বা বাঁচবে সে?’

‘সে আমি বুঝি না। আন্ট মেরিয়ন আর কোনদিন আমার বাসায় আসুক তা চাই না আমি। মেয়েটা কুটিল, ভয়ানক আর…

বয়সের প্রভাব পড়েছে, বাহাত্তুরে ধরেচে ওকে, অ্যান।

‘শুধু আমি নই, ছেলেরাও কেউ সহ্য করতে পারে না তাকে—বিশেষ করে ডেমিয়েন।’

চশমা খুলে সাইড-টেবিলের ওপর রাখল রিচার্ড। আজ রাতে আর মিছে পড়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। রিপোর্টগুলো গুছিয়ে মেঝের ওপর রাখল সে। পরিবেশটাকে একটু হালকা করার জন্যে বলল, ‘যাক, তবু কিছুটা রক্ষা আন্ট মেরিয়ন কয়েক বছরে একবার করে মুখ খোলে!’

‘তামাশা রাখ,’ ব্রাশ নামিয়ে রেখে আড়মোড়া ভেঙে উঠে এসে বিছানার ওপর বসল অ্যান। নায়লনের পাতলা নাইটির ভিতর দিয়ে ওর সুঠাম, সুন্দর দেহের প্রতিটি বাঁক দেখা যাচ্ছে। সত্যি, এতদিনেও অ্যানের প্রতি যৌন আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি তার। এখনও অ্যান তাকে বিছানায় চরম আনন্দ দেয়। মার্কের মা ছিল বেশ লাজুক, কিন্তু অ্যান ঠিক তার বিপরীত। উত্তেজক সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে সে রিচার্ডকে একেবারে উন্মত্ত করে তোলে। তার ভিতরে যে এত কাম লুকিয়ে ছিল তা অ্যানকে পাবার আগে জানত না রিচার্ড।

কাপড় ছেড়ে এসে বিছানায় ঢুকল রিচার্ড। অ্যান কাছে সরে এসে আরও ঘন হয়ে শুলো।

‘কই, কথা দিলে না?’

‘তুমি এখনও ওই কথাই ভাবছ? বাব্বাহ্, যাও, কথা দিলাম।’ রিচার্ড জানে কথা না দিয়ে নিস্তার নেই তার।

হাত বাড়িয়ে বেড সুইচ টিপে বাতি নিভিয়ে দিল অ্যান।

.

দুটো আলো একই সাথে নিভল। রিচার্ডের কামরায় বাতি নেভার সাথে সাথে তিনতলায় আন্ট মেরিয়নের চোখের আলোও নিভে গেল।

অসাড় ভাবে পড়ে রইল বৃদ্ধার নিষ্প্রাণ দেহ। বাইবেলটা তার হাত থেকে খসে পড়েছে।

কেউ জানল না। জানালা গলে ডানা ঝাপটে রাতের অন্ধকারে আকাশে উড়ল দাঁড়কাকটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *