অশুভ সংকেতের পর – ৩

তিন

শিকাগোর বিরাট বাড়িতে পল বুহেরকে নিয়ে সকালের নাস্তা খেতে বসেছে রিচার্ড। দামি আসবাবপত্রে সুসজ্জিত ডাইনিং রুম। সকালের নাস্তা সাধারণত তার অপেক্ষাকৃত ছোট অথচ খোলামেলা আর একটা খাবার ঘরেই খায় রিচার্ড। তবে আজকের ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। ব্যবসা সংক্রান্ত আলাপ করার জন্যে পল নিজেই যেচে দাওয়াত আদায় করেছে। বড় ঘরটাই বেশি নিরিবিলি হবে মনে করে বাটলারকে এখানেই নাস্তা দিতে বলেছে রিচার্ড।

খাওয়া প্রায় শেষ। তবু এখনও কাজের কথায় না গিয়ে মামুলি বিষয় নিয়েই আলাপ করছে ওরা।

‘জাদুঘর কবে নাগাদ উদ্বোধন করবেন বলে স্থির করেছেন?’ প্রশ্ন করল পল। রিচার্ডের শখের প্রত্নতাত্ত্বিক চর্চায় তারও আগ্রহ আছে বোঝাবার চেষ্টা করছে সে।

বাটলার কফি নিয়ে এল।

‘ঠিক নেই, বিদেশ থেকে শেষ চালানটা কবে পৌঁছায় তার ওপর সব নির্ভর করছে,’ জবাব দিল রিচার্ড। ‘তবে ঈস্টার, অর্থাৎ মার্চের মধ্যেই খোলার চেষ্টা করব।’

বাটলার বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে কাজের কথা পাড়ল রিচার্ড। ‘পল,’ শুরু করল সে। ‘তোমার রিপোর্টটা চমৎকার। মাত্র একমাসের মধ্যে তুমি যে কি করে ওটা তৈরি করেছ তা তুমিই জানো।’

মিষ্টি কথায় প্রত্যাখ্যান করার ভূমিকা চিনতে পলের ভুল হল না। ‘কিন্তু…‘ তিক্ত স্বরে জোগান দিল সে।

হাসল রিচার্ড। …কিন্তু এতবড় একটা নতুন কাজে হাত দেয়ার আগে আমার বিশ্বাস সবার পূর্ণ সমর্থন প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা আছে তাদের O. K. দরকার। ‘

‘কিন্তু বিল অ্যাদারটন-এর বিরুদ্ধে—এই তো?’

‘হ্যাঁ, ওর ওপর আমাদের আস্থা আছে। তোমারও থাকা উচিত। হয়ত তার কাজে আজকালকার উঠতি যুবকদের মতো চমক নেই, তবে কাজ বোঝে লোকটা।’ কফিতে চুমুক দিল থর্ন। ‘একটু চেষ্টা করে তুমি ওর সাথে মিলেমিশে চলতে পারলে সব দিক থেকেই কাজ অনেক সহজে এগোতে পারবে।’

পল জানে যে এখন সে যা বলতে যাচ্ছে তা তার জন্যে বিপজ্জনক হতে পারে। তবু কথাটা বলে ফেলারই সিদ্ধান্ত নিল সে।

‘মিস্টার থর্ন,’ মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে পল বলল, ‘আমি জানি আমাকে বিল অ্যাদারটন পছন্দ করে না। আমার প্রতিটা কাজে সে বাধার বৃষ্টি করছে। ওর সাথে মানিয়ে চলাই যদি আমার উন্নতির একমাত্র পথ হয় তবে আমার কাজে ইস্তফা দেয়াই ভাল।

‘বাজে কথা,’ আপত্তি জানাল রিচার্ড। তারপর একটু হেসে আবার বলল, ‘তোমারও সময় আসবে।’

মাথা ঝাঁকাল পল। ওর বাঁকা হাসিটা বাইরে প্রকাশ পেল না। ‘ঠিক আছে,’ বলল সে। ‘আপাতত কিছুদিন না হয় আমার প্রেজেক্টটা ধামা-চাপাই থাক।’

সময়ে সবই হবে, ভাবল সে।

নাস্তার শেষে থর্নের সাথে গাড়ি পর্যন্ত এল বুহের। ওয়াশিংটনে থর্নের একটা মীটিং আছে। তাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবার জন্যে গাড়ি তৈরি। আন্ট মেরিয়নের মৃত্যুতেও জরুরি বৈঠকটা বাতিল করা সম্ভব হয়নি।

হাত মিলিয়ে বিদায় নেয়ার সময়ে প্রত্যাখ্যানটাকে একটু সহনীয় করার উদ্দেশ্যে থর্ন বলল, ‘সামনের সপ্তাহে ছেলেদের জন্মদিনে আসছ তো?’

‘অবশ্যই আসব। লেকের ওপরটা কি বরফ জমে শক্ত হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, বেশ মজাই হবে। তোমার স্কেট নিয়ে এসো।’

হেসে হাত নেড়ে বিদায় জানাল পল। সুট-টাই পরে, গলায় মাফলার জড়িয়ে স্কেটিংরত বিলের চেহারাটা কল্পনা করার চেষ্টা করল সে। হ্যাঁ, মজা হবে বৈকি!

গাড়ি রওনা হবার ঠিক আগের মুহূর্তে মিষ্টি মেয়েলী কণ্ঠ থর্নকে বাধা দিল।

‘মিস্টার থর্ন! ওহ্, মিস্টার থর্ন!’ সুস্পষ্ট ইংরেজি উচ্চারণ।

মুখ ফিরিয়ে থর্ন দেখল এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা হাত তুলে রাস্তা পার হয়ে গাড়ির দিকেই আসছে। মেয়েটার পরনে উজ্জ্বল লাল রঙের কোট—একই রঙের উজ্জ্বল পশমী কলার। হাতে লাল গ্লাভস, পায়ে কালো চামড়ার হাইহিল বুট। মুখে চোখ ধাঁধানো হাসি। ওর কাঁধে ঝুলছে একটা বড় ব্যাগ।

মুহূর্তের জন্যে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হল রিচার্ড। চেহারাটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে অথচ সামনাসামনি পরিচয় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল ওকে আগে কোথায় দেখেছে-ওয়ারেনের স্লাইডে, বেবিলনের বেশ্যার পাশে।

জোন হার্ট। সাংবাদিক।

মনে পড়তেই সুন্দরী মহিলার সঙ্গ পাওয়ার আনন্দটা উবে গেল। এই সাংবাদিক মহিলাই তার সাক্ষাৎকার নিতে চায়। কিন্তু তাকে এড়িয়ে যাবার কোন সুযোগ না দিয়ে গাড়ির ধারে পৌঁছে গেল জোন।

‘চেঁচিয়ে ডেকেছি বলে কিছু মনে করবেন না–উপায় ছিল না আমার…।’

‘না-না, সেজন্যে কিছু মনে করিনি আমি,’ শিষ্টাচার বজায় রাখল থর্ন। ‘আমার নাম জোন হার্ট। চার্লস ওয়ারেন আমার কথা নিশ্চয়ই আপনাকে বলেছেন?’

‘হ্যাঁ, বলেছে,’ জবাব দিল থর্ন। কিন্তু আমি তো তাকে…’

‘শুনেছি,’ বাধা দিয়ে বলে উঠল জোন। ‘উঃ, বাইরে বড্ড ঠাণ্ডা। আমি বরং গাড়িতে বসেই শুনি সাক্ষাৎকার দিতে আপনি কেন এত নারাজ।

হেসে সরে বসে জায়গা করে দিয়ে থর্ন বলল, ‘সাংবাদিক না হয়ে সেলস উওম্যান হলে অনেক উন্নতি করতে পারতে তুমি। বসো।’

গাড়ির পিছনের সিটে সুস্থির হয়ে বসে ব্যাগের ভিতরকার কাগজপত্র ঘাঁটতে শুরু করল জোন। ছোট ছোট অক্ষরে নোট করা কাগজের বহর দেখে রিচার্ডের মনে হল বুগেনহাগেনের ওপর অন্তত তিনটে মোটা বই লিখে ফেলার মালমশলা জোগাড় করে ফেলেছে মেয়েটা। ব্যাগের ভিতর থেকে একটা সুদৃশ্য দামি সিল্কের রুমাল বের করে নাক মুছল সে।

ঠাণ্ডা একেবারে কাবু করে ফেলেছে আমাকে,’ মন্তব্য করল জোন। ‘মিস হার্ট…’ শুরু করল থর্ন!

‘জানি। আপনি রিপোর্টারদের সাথে কথা বলেন না।’

‘তাছাড়া এয়ারপোর্টে প্লেন ধরতে হবে আমার–তাড়া আছে।’

‘মাত্র দু’মিনিট-এর বেশি সময় নেব না আমি।’

‘প্লেন মিস করা চলবে না আমার। তুমি না হয় পরে এক সময়ে…

‘নিশ্চিন্ত থাকুন। রিচার্ড থর্নকে না নিয়ে কোন প্লেন মাটি ছেড়ে আকাশে উঠবে না।’

‘এটা আমার জন্যেও অপেক্ষা করবে না। এয়ার ফোর্সের স্পেশাল প্লেন।’

‘তাহলে আমি আপনাদের সাথে এয়ারপোর্টেই যাব।’ একটা মন ভুলানো হাসি দিল জোন। ‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’

ইন্টারকমের সুইচ অন করে মারেকে গাড়ি ছাড়তে নির্দেশ দিল রিচার্ড। তারপর সুইচ অফ করে দিয়ে জোনের দিকে ফিরে বলল, ‘ওয়াশিংটন।’

‘এয়ার ফোর্স ওয়ান কারও জন্যেই অপেক্ষা করে না। ওখানে প্রেসিডেন্টকে দেশ চালানোর ব্যাপারে পরামর্শ দিতে যাচ্ছেন না তো?’

‘না,’ মনে মনে মেয়েটার রসবোধের প্রশংসা করে সে বলল। ‘সেক্রেটারি অভ স্টেটের সাথে বৈঠক আছে। যাক, এবারে বল তোমার কি বক্তব্য?’

আবার ব্যাগ ঘেঁটে একটা চামড়া দিয়ে বাঁধানো ছোট্ট নোট বই আর সোনার পেন্সিল বের করল জোন। ওগুলো হাতে নিয়ে জাদুমন্ত্রেই যেন ওর হাবভাব সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। পেশাদার দক্ষ সাংবাদিকে রূপান্তরিত হল জোন।

অর্ধেক পথ যেতে না যেতেই জোনের প্রশ্নের ধারায় বিরক্ত হয়ে উঠল রিচার্ড তুমি আমাকে এ পর্যন্ত সাতটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছ, মিস হার্ট—তার প্রত্যেকটাই অর্থ সংক্রান্ত।’

‘এর জোরেই দুনিয়া ঘুরছে—তাই না?’ হাসির ঝলক দেখিয়ে রিচার্ডের মন জয় করার চেষ্টা করল জোন। রিচার্ড অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে স্পষ্ট টের পাচ্ছে ও। আসল কথাটা পাড়ার জন্যে আরও কিছুটা সময় তার দরকার।

‘হ্যাঁ… আপনার বাবা জাদুঘরটা তৈরি করেছিলেন…’ নোট দেখে নিয়ে সে বলে চলল, ‘১৯৪০ সালে। কত টাকা খরচ হয়েছিল ওটা বানাতে?’

‘তা প্রায় একশো লক্ষ ডলারের মত হবে।

উনি তো নিজের চেষ্টায় বড়লোক হয়েছিলেন। অনেক খাটতে হয়েছিল তাঁকে। আচ্ছা এটা কি ঠিক যে আপনাদের দুই ভাইকে তিনি দারিদ্র কি জিনিস তা বোঝাবার জন্যে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল আর শক্ত কাঠের ওপর শুতে বাধ্য করতেন?’

হো হো করে প্রাণ খোলা হাসিতে ফেটে পড়ল রিচার্ড। আমাদের সম্পর্কে কি লোকজনের ওই ধারণা?’

ঠিক এই সময়ে লিমোসিনটা হঠাৎ থেমে দাঁড়াল। মিশিগান অ্যাভিনিউ-এর ড্র ব্রিজটার কাছে এসে পড়েছে ওরা। ঘন ঘন ঘন্টা আর লাল বাতি জ্বেলে সবাইকে জানানো হচ্ছে ব্রিজটা তুলে নেয়া হচ্ছে। শিকাগো নদী দিয়ে একটা জাহাজ পার হবে এখন। বিরক্ত ভাবে গাড়ির জানালা দিয়ে চেয়ে থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির ট্যাঙ্কারটা চিনতে পারল রিচার্ড। তার নিজের জাহাজই তাতে দেরি করাচ্ছে!

এটাকে দৈব সুযোগ বলে ধরে নিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাল জোন।

‘বুগেনহাগেনের সাথে আপনার আলাপ ছিল?’

‘না,’ কথার মোড় কোনদিকে নিচ্ছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না থর্ন।

‘তিনি প্রত্নতত্ত্বের সাথে আধ্যাত্মিক সাধনাও করতেন।’

‘কিন্তু সেটার সাথে এর কি সম্পর্ক?’

‘বেলভোয়ার ক্যাসেল খুঁড়ে তাঁর হাড়গোড় পাওয়া গেছে—আপনি শোনেননি?’

‘একটা মানুষের হাড় পাওয়া গেছে শুনেছি, কিন্তু গুগুলো যে বুগেনহাগেনের হাড় তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’

নিশ্চিত স্থির বিশ্বাস নিয়ে বলে চলল জোন। ‘একজন নয়, দু’জন মানুষের হাড় ওখানে পাওয়া গেছে। একটা বুগেনহাগেনের, অন্যটা তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদ মিশেল মরগ্যানের। আমার মনের মানুষ ছিল মিশেল। বুগেনহাগেনের সাথে অদৃশ্য হবার আগে পর্যন্ত আমরা একসাথেই ছিলাম।’

আটক রাস্তাটা এই সময়ে খুলে দেয়া হল। ইন্টারকমের বোতাম টিপল রিচার্ড। বোতাম টেপার ভঙ্গিতে ওর মনোভাব কিছুটা টের পাওয়া গেল।

মারে, গাড়ি থামাও। মিস হার্ট এখানেই নামবে,’ বলল সে।

হড়বড় করে কথা বলে চলল জোন। আপনার ভাই মারা যাবার কয়েকদিন আগেই তিনি ইসরাইলে বুগেনহাগেনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর কয়েকদিন পরেই বুগেনহাগেন আর মিশেলের জীবন্ত সমাধি ঘটে। এতসব ঘটনার পরও কি আপনার মনে কোন প্রশ্নই জাগে না, মিস্টার থর্ন?’

মাথা খারাপ মেয়েটার ডাবল থর্ন। এখনই কেনেডিদের কে হত্যা করেছে তার বর্ণনা দেয়া আরম্ভ করবে! সংযত কণ্ঠে সে বলল, ‘রাস্তা আটকে রেখেছি আমরা তামাশার পাত্র না হয়ে জোর করে নামিয়ে দেয়ার আগেই নেমে যাও।’

আপনি জানেন আপনার ভাইকে পুলিশ কেন গুলি করেছিল?’ জোনের চেহারা উন্মত্ত দেখাচ্ছে—চোখে বন্য একটা ভাব। ছুরিগুলোর কথা নিশ্চয়ই জানেন আপনি জানেন না?’

মারে ড্রাইভিং সিট ছেড়ে ঘুরে অন্য পাশে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল।

‘আমি যা জানি, তা হচ্ছে তুমি আমাদের দু’জনেরই মূল্যবান সময় নষ্ট করছ।’

‘প্লীজ, মিস্টার থর্ন,’ অনুনয় ভরা স্বরে বলল জোন। ‘ফালতু কথা বলছি না আমি—অনেক বছর ধরে অনেক খেটে সব তথ্য আমি জড়ো করেছি

‘অ্যা…হ্,’ তাচ্ছিল্যের সাথে বিরক্তি প্রকাশ করল থর্ন। ঘুরেফিরে আবার তার ভাই-এর মৃত্যুর সাথে জড়িত ধর্ম সংক্রান্ত কথাবার্তা উঠেছে। এতদিনে লোকে সে—সব কথা ভুলে গেছে বলেই মনে করেছিল সে।

গাড়ির ভিতরে ঝুঁকে জোর করেই জোনকে টেনে বের করার চেষ্টা করল মারে। গাড়ির ভিতরে থাকার জন্যে ধস্তাধস্তি করতে করতেই থর্নের উদ্দেশ্যে চিৎকার করল জোন। আপনি বুঝতে পারছেন না—আপনার মাথার ওপর ভীষণ বিপদ ঝুলছে!’

দূর হও তুমি আমার সামনে থেকে,’ ধমকে উঠল থর্ন। ‘ভবিষ্যতে আর কখনও তোমাকে আমার ত্রিসীমানায় দেখতে চাই না।’

‘প্রভুর দিকে চান,’ মরিয়া হয়ে বলল জোন।

‘মারে! জলদি কর!’

‘যীশুর ওপর বিশ্বাস রাখুন,’ কান্নায় ভেঙে পড়ল মেয়েটা।

জোনকে একরকম শূন্য করে তুলে নিয়েই গাড়ির বাইরে রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে দিল মারে। তখনও জোন চেঁচাচ্ছে, ঈশ্বরের দোহাই! একমাত্র যীশুই বাঁচাতে পারবে আপনাকে। বিশ্বাস না হয় য়িগেইলের দেয়ালে আঁকা ছবিটা দেখলে নিজেই বুঝতে পারবেন ওটা কার ছবি!’

‘এই পাগল মেয়েটার হাত থেকে রক্ষা কর— জলদি গাড়ি ছাড়!’ মারেকে নির্দেশ দিল থর্ন।

তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে গাড়ি ছেড়ে দিল মারে। জোন তখনও চিৎকার করে চলেছে, ‘আমার কথা আপনাকে শুনতেই হবে। সবার ভালোর জন্যেই বলছি…’

দূরে চলে গেল থর্নের লিমোসিন। ব্যর্থতায়, রাগে, দুঃখে জোনের গাল বেয়ে চোখের পানি পড়ছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপন ধরেছে ওর দেহে।

.

রিচার্ড থর্নের বাবা রেজিনাল্ড থর্ন শিকাগোর বিখ্যাত আরকিটেক্ট লুইস সুলিভানকে দিয়ে মিউজিয়মের জন্যে দালানটাকে বিশেষ কায়দায় তৈরি করিয়েছিলেন, যেন অল্পদিনেই ডিজাইনটা পুরানো না হয়। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পরেও দালানটাকে এখনও নতুন বলেই মনে হয়।

জোন হার্টের ট্যাক্সিটা এসে মিউজিয়মের সামনে থামল। ভিতরে ঢুকে নিজেকে খুব নগণ্য বলে মনে হচ্ছে তার। বিশাল ‘কামরাগুলোর ছাদ অনেক উঁচুতে।

মিউজিয়মেরই আর একটা কামরায় একগাদা ছড়ানো ছিটানো নকশা আর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে উদ্বোধনের সময়ে কোথায় কোটা রাখা হবে তা অ্যানকে বোঝাচ্ছে ওয়ারেন। রিচার্ডের শতমুখী কাজের মধ্যে একমাত্র মিউজিয়মেই কিছুটা আগ্রহী অ্যান। তাই হঠাৎ করে এসে কাজ কেমন এগোচ্ছে তা সে প্রায়ই দেখে যায়। সম্প্রতি ইসরাইল থেকে নতুন যা কিছু আসছে তাতেই যেন ওর বেশি ঝোঁক।

‘সাজানোটা ভালই হবে বলে মনে হচ্ছে,’ বলল অ্যান।

হেসে ধন্যবাদ জানাল ওয়ারেন। ‘শুনলাম আমি ফিরে আসার পর ওরা য়িগেইলের দেয়াল খুঁড়ে বার করছে। শিগগিরই ওটা এসে পৌঁছবে এখানে। সামনে ছড়ানো নকশার ওপর একটা কামরা দেখিয়ে সে আবার বলল, ‘এই ঘরটা আমি বিশেষ করে খালি রেখেছি ওর জন্যে।

য়িগেইলের নাম উঠতেই অ্যানের আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। ‘কে এই যিগেইল?’ প্রশ্ন করল সে।

‘বেশ রহস্যজনক একটা চরিত্র। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মানুষ। আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ধর্মযাজক ছিল সে। কথিত আছে যে ইবলিস স্বশরীরে ওর সামনে দেখা দিয়েছিল। তাতেই ওর মাথা বিগড়ে যায়।

ওর কথা শুনে অ্যান হেসে উঠবে আশা করেছিল চার্লস—এই গল্প শুনে বেশির ভাগ মানুষই তাই করে। অ্যান হাসল না দেখে একটু অবাক হয়েই সে বলে চলল, ‘এর পর থেকেই একাকীত্ব বরণ করে নেয় সে। এই সময়ে নিজের চোখে দেখা শয়তানের বিভিন্ন চেহারাই কেবল এঁকেছে সে-একেবারে জন্ম থেকে শুরু করে তার ধ্বংস পর্যন্ত। হয়ত য়িগেইল তার দেখা দৃশ্যগুলোই ছবিতে ধরে রাখতে চেয়েছিল। তাকে আর দেখা যায়নি, কেবল তার আঁকা দেয়ালটাই পাওয়া গিয়েছে।

‘খুব মজার ঘটনা তো?’ উৎসাহিত কণ্ঠে বলে উঠল অ্যান। ‘এখন ওটা না দেখা পর্যন্ত আর শান্তি পাব না আমি।’

আবার আগের সেই মিউজিয়ম সাজানোর কথায় ফিরে গেল চার্লস। ‘তোমার সবচেয়ে প্রিয় মূর্তি বেবিলনের বেশ্যাকে রাখা হবে এই চার নাম্বার রূমে। এখানে ওটা সবার চোখে পড়তে বাধ্য। নকশায় কামরাটার ওপর আঙুল ছোঁয়াল সে।

ওদের আলোচনার মাঝখানেই হঠাৎ কামরায় ঢুকল জোন।

মুখ তুলে চাইল ওয়ারেন। আরে, জোন যে!’ বিস্ময় আর খুশি প্রকাশ পেল ওর স্বরে। ‘কখন এলে তুমি?’

‘গতরাতে,’ একটু অপ্রতিভ ভাবে হাসল জোন। ভিতরের উৎকণ্ঠা লুকাবার চেষ্টা করছে সে।

‘অ্যান,’ পরিচয় করিয়ে দিতে তৎপর হল চার্লস। ‘এ হচ্ছে জোন হার্ট, তোমাদের—’

‘হ্যাঁ, স্লাইডে ছবি দেখেছি,’ বলল অ্যান। আর একজন সুন্দরীর চেহারা ভোলার পাত্রী সে নয়। ‘আমি অ্যান থর্ন,’ নিজেই পরিচয়ের পালা শেষ করে বলল। তুমিই তো আমার স্বামীর সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ, আমাদের দেখা হয়েছে।

জবাব শুনে ওয়ারেনের চেহারা মুহূর্তে পাল্টে গেল। লৌকিকতা ভুলে সে শুরু করল, ‘তোমাকে আমি বারবার…’

ওকে বাধা দিয়ে থামিয়ে দিল জোন। ‘ওটা আমার কাছে কতখানি গুরত্বপূর্ণ তা ঠিক বুঝতে পারেননি আপনি। এতদূর এসেও দেখা হবে না মেনে নিতে পারিনি আমি।’

‘এত কম সময়ে ম্যানেজ করলে কিভাবে? ওকে পেলে কোথায়?’ বলল অ্যান।

ওর গলার স্বরটা জোনের কানে প্রীতিকর ঠেকল না। তাছাড়া কাছাকাছি বয়সের হয়েও তাকে প্রথম দেখাতেই ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করাটাও ওর ভাল লাগেনি। সে জবাব দিল, ‘রূপের মায়ায় তাকে ভুলিয়ে গাড়িতে উঠে উদ্দেশ্য সিদ্ধি করেছি।

‘তাই নাকি? রিচার্ড নিশ্চয়ই খুব উপভোগ করেছে?’

‘শুরুতে তেমন না হলেও পরের দিকে করেছে।’ ইন্টারভিউ সুষ্ঠুভাবেই শেষ হয়েছে এমন ইঙ্গিত দিয়ে অ্যানের মনে জ্বালা ধরাতে চাইল জোন। প্রথম দেখাতেই মেয়েটাকে কেন যেন ভাল লাগেনি তার। রিপোর্টারদের সম্পর্কে খুব একটা উঁচু ধারণা তাঁর নেই।’

‘হ্যাঁ, রিচার্ড বলে ওরা মানুষের দুর্দশা আর দুর্ভাগ্য ঘেঁটে পেটের ভাত জোগায়।’ তার নিজেরও যে একই মত, তা ওর কথার সুরেই প্রকাশ পেল।

মধুর হাসিতে ভরে উঠল জোনের মুখ। অ্যান কতটুকু জানে বাজিয়ে দেখার জন্যে সে প্রশ্ন করল, ‘শিয়ালের মত?’

‘সুন্দর উপমা,’ জোনের চোখে চোখ রেখে জবাব দিল অ্যান। ওর মুখের ভাব বিন্দুমাত্র বদলাল না। ইঙ্গিতটা সে বুঝেছে কিনা টের পাওয়া গেল না।

ওয়ারেন এতক্ষণ কুণ্ঠিত ভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের ঠোকাঠুকি দেখছিল। কিছু একটা বলে ওদের থামাবার উদ্দেশ্যেই সে বলল, ‘জোনের লেখা সব প্রত্নতত্ত্বের ওপর।’ বলেই সে বুঝতে পারল কথাটা এখানে নিতান্তই অবান্তর।

‘তাই নাকি?’ বলে একটু বাঁকা হাসি হাসল অ্যান।

ওয়ারেনের পকেটে রাখা ছোট্ট যন্ত্রটা কর্কশ শব্দে বেজে উঠল। থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির সাথে ওকে যেন একটা অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে রাখা হয়েছে যন্ত্রটার সাহায্যে। সাধারণত ওভাবে ডাক পড়লে সে বিরক্ত হয়—কিন্তু আজ খুশিই হল। ‘এক মিনিট, আমি আসছি,’ বলেই সে মেয়েদের বিবাদ ওদেরই মেটাবার সুযোগ দিয়ে ঘর ছেড়ে পালাল।

‘আপনার স্বামীর কিন্তু সাংবাদিকদের ওপর বিরূপ হওয়া শোভা পায় না,’ মন্তব্য করল জোন। ‘হাজার হোক তারা তার ভাই-এর ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছে।’

‘তার মানে?’ কথার মোড় কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতে না পেরে ছ্যাঁৎ করে উঠল অ্যান।

‘খুব অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মৃত্যু হয়েছিল তার—প্রেস অনেক রেখে ঢেকে মান বাঁচিয়ে রিপোর্ট করেছিল।’

‘তাই নাকি?’ চাপের মুখেও শাস্ত থাকার চেষ্টা করল অ্যান। তার সাথে আমার কখনও পরিচয় হয়নি।’

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকে উঠল জোন। ‘ঠিক! আমি ভুলেই গেছিলাম যে আপনি রিচার্ড থর্নের দ্বিতীয় স্ত্রী!’

‘মিস হার্ট–’ শুরু করল অ্যান।

‘ঠিকই তো!’ বলে চলল জোন। ‘ডেমিয়েন রিচার্ড থর্নের ভাই-এর ছেলে—আর মার্ক তার প্রথম স্ত্রীর ছেলে। মোট কথা আপনি ওদের কাউকেই পেটে ধরেননি!’

‘কোন মহিলা সাপ্তাহিকের সাংবাদিক হলেই তোমাকে মানাত!’ নিজেকে সংযত রাখা অ্যানের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছে

‘ডেমিয়েন— হ্যাঁ, ওর কথাই কিছু শোনা যাক। ছেলেটা কেমন? মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে কেমন উপভোগ করছে সে?’

অ্যান কোন জবাব দেয়ার আগেই ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল চার্লস। ‘অ্যান!’ চিৎকার করল সে। ‘ওই মেয়েমানুষটার সাথে তোমার আর একটা কথাও বলার দরকার নেই!’ দু’হাতে জোনের কাঁধ ধরে জোর করে ওকে দরজার দিকে নিয়ে গেল চার্লস। ‘আমার মান-সম্মান সব ধূলিসাৎ করে দিয়েছ তুমি! রিচার্ড ফোন করেছিল।’ রীতিমত কাঁপছে চার্লস। ওকে এতটা রাগতে কেউ কখনও দেখেনি।

জানাজানি যখন হয়েই গেছে জোনের খোয়াবার আর কিছু বাকি রইল না। হিসহিসিয়ে সে বলে উঠল, ‘চরম বিপদ আসছে সামনে। আপনারা কেউ রক্ষা পাবেন না।’

‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?’ ওকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে যাবার জন্যে জোর করছে চার্লস। অ্যানের সামনে আর অপদস্থ হতে চায় না সে।

‘য়িগেইলের দেয়াল আমি দেখেছি!’ বলল জোন। বলার ভঙ্গিতে মনে হল যেন ওটা দেখলেই সব জানা হয়ে যায়।

চার্লসের ওপর কোন প্রতিক্রিয়া হল না। জোনকে দরজার বাইরে নিয়ে যেতে যেতে সে বলল, ‘তুমি কি দেখেছ না দেখেছ তাতে কিচ্ছু আসে যায় না আমার!’

‘অবশ্যই যায়!’ চার্লসের হাত থেকে জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে অ্যানের দিকে ফিরে দাঁড়াল জোন। ‘ডেমিয়েন—’

‘ডেমিয়েন কি?’ চড়া গলায় প্রশ্ন করল অ্যান।

‘সে…সে.…’ শুরু করল জোন, তারপর হঠাৎ মত পাল্টে ‘জানি না আমি!’ বলে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।

নীরবে দাঁড়িয়ে লম্বা করিডোরের মাথায় বাঁক নিয়ে জোনকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল ওরা।

.

উদভ্রান্তের মত মিউজিয়ম থেকে বেরিয়ে এলেও নিজের উদ্দেশ্য থেকে একটুও টলেনি জোন। তার এই কঠিন প্রতিজ্ঞাই তাকে সাগড় পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় আসতে বাধ্য করেছে। লোকে এখন পাগল ঠাউরালেও কর্তব্য করে যেতে হবে ওকে।

নিকটস্থ ‘এভিস’ অফিস থেকে একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে উত্তর শিকাগো অভিমুখে ছুটল সে। বিকেলের দিকে ডেমিয়েন আর মার্কের মিলিটারি স্কুলে পৌছে দেখল মাঠে আমেরিকান ফুটবলের মহড়া চলেছে।

ডেভিডসন মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে সব সময়েই খেলাধুলা আর শারীরিক যোগ্যতার প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়। সুস্থ সবল দেহ ওদের জন্য খুবই জরুরি এদেরই হয়ত একদিন নিজের দেশের জন্যে লড়তে হতে পারে। সুতরাং শত্রুকে হত্যা করার ক্ষমতা এখানে সবাইকেই অর্জন করতে হয়।

য়িগেইলের আঁকা দেয়ালটা দেখেছে জোন। ছবির সাথে ডেমিয়েনের কতখানি মিল তা নিজের চোখে দেখার জন্যে আজ এখানে এসেছে সে। মাঠে দর্শকের সংখ্যা খুব কম। দু’একজনের অভিভাবক কেবল তাদের ছেলেদের উৎসাহ দিতে খেলা দেখতে এসেছে। জোনের দিকে কেউ খেয়াল করছে না। নিবিষ্ট মনে খেলা দেখছে আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মাটিতে পা ঠুকছে।

মাঠে নেফ নিজে ছেলেদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আমেরিকান ফুটবলের প্যাড লাগানো পোশাক আর হেলমেটের ভিতর দূর থেকে কাউকে চেনা অসম্ভব। জোন লক্ষ্য করল স্কুলের ইউনিফর্ম পরা একটা ছেলে খেলায় অংশ না নিয়ে বসে বসে খেলা দেখছে। ওর চোখে বোতলের তলির মত মোটা কাঁচের চশমা। কেন ওকে খেলায় নেয়া হয়নি আন্দাজ করা যায়। কাছে এগিয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করল জোন, ‘ডেমিয়েন থর্ন কি মাঠে খেলছে?’

ছেলেটা জবাব দেয়ার আগেই বাঁশি বাজিয়ে সাময়িক বিরতি ঘোষণা করল নেফ। ওদের মধ্যে একটা ছেলে জোনের দিকে ঘুরে তাকাল। ওর দৃষ্টি জোনের দেহ ভেদ করে ভিতরে ঢুকল। চমকে ফিরে চাইল জোন। চোখ দুটো চিনতে পেরেছে সে—ঠিক ওই রকম অশুভ হলুদ চোখই আঁকা দেখেছে সে য়িগেইলের দেয়ালে। বিড়ালের চোখের মত, প্রায় মণিহীন, অত্যন্ত ক্ষমতাশালী বিজলী ভরা চোখ!

হঠাৎ হেলমেট খুলে ফেলল ছেলেটা। হুবহু এই চেহারাই আঁকা দেখে এসেছে সে।

‘ওই তো, ও-ই ডেমিয়েন থর্ন,’ ডেমিয়েনকে দেখিয়ে জবাব দিল ভারি চমশা পরা ছেলেটা। কিন্তু তার আর দরকার ছিল না—চিনেছে জোন। পায়ে পায়ে পিছু হটছে সে। এক অভাবনীয় ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছে ওর মুখে। আতঙ্কে জোনের সুন্দর মুখ বিকৃত দেখাচ্ছে।

ধীর পায়ে হেঁটে ফিরে চলল জোন। কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব দেখাবার নিষ্ফল চেষ্টা করছে সে। কিন্তু অল্প দূর গিয়েই আর পারল না–আতঙ্ক সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করেছে তাকে। নারী শোভন আচরণ বাদ দিয়ে ঝেড়ে দৌড় দিল সে। গাড়ি পর্যন্ত পথটা এখন অনেক লম্বা মনে হচ্ছে তার।

পিঠটা আবার গরম হয়ে উঠছে। পিঠের হাড় দুটোর নিচেই কেমন এটা অস্বস্তিকর অনুভূতি। ওই ভয়ানক হলুদ চোখ দুটো তার দিকে চেয়ে আছে বলেই যে এসব ঘটছে, এ বিষয়ে জোন নিঃসন্দেহ।

গাড়ির কাছে পৌঁছে মাঠ থেকে একটা তীক্ষ্ণ কঠিন আদেশ শুনতে পেল জোন। নেফের গলা। ‘থর্ন! এদিকে এসো!’

মুহূর্তে জোনের পিঠের অশান্ত ভাবটা কেটে গেল। আর গরম লাগছে না তার। তাড়াতাড়ি চাবি বের করে গাড়ি স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা করল জোন। থরথর করে কাঁপছে ওর হাত। তৃতীয়বার চাবিটা ঠিক জায়গায় ঢুকল। পাগলের মত গাড়ি ছোটাল জোন। টায়ারের আর্তনাদ তুলে সবেগে অ্যাকাডেমি ছেড়ে বেরিয়ে এল সে। হলুদ চোখ দুটোর পাল্লা থেকে যতদূরে সম্ভব পালিয়ে যেতে হবে তাকে।

.

শিকাগো ছেড়ে সোজা উত্তরদিকে চলেছে জোন। কেন যে ওদিকে যাচ্ছে তা সে নিজেও জানে না! শিকাগোতেই আবার তার ফিরে যাওয়া উচিত। কিন্তু সে জানে ওখানে কোন সাহায্যই সে পাবে না। থর্নদের সাথে আর দেখা করা যাবে না। ওরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই নিশ্চিত ধরে নিয়েছে সে পাগল। চার্লস ওয়ারেনের কাছে হয়ত বা সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল—ধর্ম আর যীশুতে বিশ্বাসী সে-কিন্তু তার অবাধ্য হয়ে থর্নের সাথে দেখা করার পর এখন সেও আর তাকে খাতির করবে না। কান্না পাচ্ছে ওর—যীশু এখন কোথায়? এই দরকারের মুহূর্তে প্রভু কেন সাহায্য করছেন না তাকে? কেন আর সবাইকে বোঝাতে পারছে না সে?

বৈঠকখানায় বা প্রার্থনা সভায় কাউকে শয়তানের অস্তিত্ব সত্যিই আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে জবাব পাওয়া যাবে, ‘নিশ্চয়ই! বাইবেলেই লেখা আছে সেকথা!’ কিন্তু বাস্তবে কি কাউকে বলা যায়, না বোঝানো যায় যে তোমার পালিত ছেলেই মূর্তিমান শয়তান?

গাড়ি চালাচ্ছে আর আনমনে এই সমস্যাটা নিয়ে ভাবছে জোন। অ্যাকাডেমি থেকে বেরোবার সময়ে যতদূরে সম্ভব পালিয়ে যেতে চেয়েছিল—কিন্তু চলতে চলতে এখন যে কতদূরে কোথায় চলে এসেছে বুঝে উঠতে পারছে না।

মুখ তুলে চারপাশে ভাল করে একবার চেয়ে দেখল সে। চাষের জমি আর খোলা মাঠ ছাড়া আর কিছু নজরে পড়ছে না। যে রাস্তাটা ধরে ও চলেছে সেটা ছাড়া আর কোন রাস্তাও নেই। একটাই পথ, মাঠের বুক চিরে দিগন্তের সাথে গিয়ে মিশেছে।

জোরালো বাতাস উঠল এবার। বাতাসের ঝাপটায় গাছগুলো নুয়ে পড়ছে। গাছের পাতা থেকে মড়া-কান্নার মত অশুভ আওয়াজ আসছে। হঠাৎ ভীষণ রকম ভয় পেল জোন। এবার ফেরা দরকার— নইলে রাত কাটানোর কোন আশ্রয় খুঁজে নিতে হবে তাকে। ঠিক এই সময়ে গাড়ির এঞ্জিন কয়েকবার কেশে উঠে একেবারে চুপ মেরে গেল।

একই সাথে বাতাসটাও চট করে থেমে গেল।

ভরবেগে গাড়িটা আরও কিছুদূর এগিয়ে রাস্তার মাঝখানেই স্থির হয়ে দাঁড়াল। চারপাশে প্রচণ্ড স্তব্ধতা। টু শব্দটি নেই। কোথাও কোন প্রাণের সাড়া জোনের চোখে পড়ছে না। কোন মানুষ, পশুপাখি, ঘর-বাড়ি—এমন কি দূরে একটা গাড়িও দেখা যাচ্ছে না-কিছুই নেই।

অ্যাকসেলারেটর দাবিয়ে ধরে চাবি ঘোরাল জোন। কোন শব্দই হল না। পরপর কয়েকবার চাবি ঘুরিয়েও কোন ফল হল না। তেল চেক করে দেখল এখনও অর্ধেক ট্যাঙ্ক রয়েছে।

গোলমালটা ওখানে নয়।

কার্ল বুগেনহাগেন আর মিশেলের কথা মনে পড়ল তার। ওরা কেন এবং কি কারণে মৃত্যুবরণ করেছে ভেবে জোনের গা কাঁটা দিয়ে উঠল

তার কপালে এতসব অঘটন আজ কেন ঘটছে এর কারণটা হঠাৎ জোনের কাছে দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার চেষ্টা সে বাদ দিল। এখন হাজার চেষ্টা করেও কোন ফল হবে না। অস্থির লাগছে—কি করবে ভাবতে ভাবতে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে ওর বুকের ভিতরটায় কেমন করছে। বুঝতে পারছে তার চারদিক থেকে প্রচণ্ড বিপদ ঘনিয়ে আসছে। মনটা শক্ত করে নিল জোন—যে করেই হোক উদ্ধার পেতেই হবে তাকে!

চারপাশটা ভাল করে আর একবার খুঁটিয়ে দেখল জোন। একটু প্রাণের সাড়া দেখার জন্যে মনটা আকুল হয়ে উঠেছে। চিমনির মুখে একটু ধোঁয়া, মাঠের মধ্যে একটা গরু, দূরে একটা গাড়ি—যে-কোন কিছু।

কিন্তু কোথাও কিচ্ছু নড়ছে না।

ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ির রেডিওটা ছাড়ল জোন। উন্মত্তের মতো একে একে সব কটা বোতাম টিপে চলল সে। স্টেশন ধরল কিনা দেখার জন্যেও অপেক্ষা করছে না। একবার চিন্তাও করল না যে ব্যাটারি শেষ হয়ে থাকলে রেডিও চলবে না।

এক স্টেশন থেকে বোতাম টিপে অন্য স্টেশন ধরার সময়ে ‘ওভার দ্যা রেইনবো’ গানের সুরটা ওর কানে গেল। মনে পড়ল বহুদিন ওই গানটা তার হতাশ মনে নতুন আশা আর সাহস জুগিয়েছে।

আর একটা স্টেশনে শোনা গেল জোর গলায় একজন তার রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। চিৎকার করে সবার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েই লোকটা যেন লোকজনকে তার দলে টানতে চাইছে। বিদেশী কোন অবোধ্য ভাষায় বক্তৃতা হচ্ছে বলে জোনের মনে হল।

তার মাথার ভিতরে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুই ভাবতে পারছে না সে।

রেডিও বন্ধ করে দিয়ে স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসে থাকল জোন। কখন যে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করতে শুরু করেছে জানে না।

প্রার্থনা শেষ করে আবার সামনে রাস্তার দিকে চাইল সে। জীবনের কোন চিহ্ন এখনও দেখা যাচ্ছে না।

এই সময়ে একটা সাইনবোর্ড ওর নজরে পড়ল। সে হলপ করে বলতে পারে ওটা একমুহূর্ত আগেও ওখানে ছিল না। রোদে বৃষ্টিতে জীর্ণ হাল হলেও অক্ষরগুলো পড়া যায়। ‘ন্যান্সির বাড়ি’ পড়ল জোন। ‘ন্যায্য মূল্যে থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে। তিন মাইল।’

এই এলাকার সাথে পরিচিত সবাই জানে ন্যান্সির বাড়ির অস্তিত্ব বহুদিন আগেই লোপ পেয়েছে। আশায় বুক বেঁধে গাড়ি থেকে নামল জোন। হেঁটেই পৌঁছতে হবে তাকে। তার বিশ্বাস ওখানে পৌঁছতে পারলেই সাহায্য মিলবে—সব মুশকিলের অবসান হবে। পিছনের সিটে রাখা ওভারকোট নেয়ার জন্যে ঝুঁকল সে।

প্রথমে ডানার ঝটপট তারপরেই গাড়ির ছাদে নখের আঁচড়ের শব্দ শুনতে পেল জোন। লাফিয়ে পিছিয়ে গেল সে। তার মুখের থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরেই গাড়ির ছাদে বসে আছে একটা প্রকাণ্ড দাঁড়কাক। হিংস্র চোখে ওর দিকেই চেয়ে আছে ওটা।

চিৎকার করে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করতে করতে আরও পিছাল জোন। হোঁচট খেয়েছে সে। কোটের ঝাপটা দিয়ে ভয় দেখিয়ে কাকটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করল জোন। কিন্তু কাকটা একটুও নড়ল না। স্থির দৃষ্টিতে ওটা জোনকে লক্ষ্য করছে। অ্যাকাডেমিতে ডেমিয়েন যেমন করে চেয়েছিল ঠিক তেমনি চোখে চাইছে ও জোনের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল—ওই ভয়ঙ্কর প্রাণীটাকে চিনছে সে।

ওটা নিঃসন্দেহে শয়তানের দূত।

দাঁড়কাকটা স্থির হয়ে বসে আছে। অশুভ বার্তা বয়ে এনেছে যেন। যে-কোন মুহূর্তে ডানা মেলে জোনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

পিছু হেঁটে সরে যাচ্ছে জোন। কাকটার ওপর থেকে একবারও চোখ সরায়নি। বেশ অনেকটা পিছনে এসে মাথা হেঁট করে অস্ফুট শব্দে বাইবেলের একটা বাণী উচ্চারণ করল সে। সবশেষে প্রভুর প্রশংসা করে মাথা তুলে দেখল কাকটা চলে গেছে।

খুশিতে ফুঁপিয়ে উঠল জোন। তাহলে তার বিশ্বাস ভিত্তিহীন নয়। প্রভু যীশুর বাণীর ক্ষমতা অসীম। তাঁর ___ না করায় তিনি তাকে শয়তান দূর করার ক্ষমতা দিয়েছেন।

পিছন থেকে কর্কশ আওয়াজ করে জোনের মাথার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল দাঁড়কাকটা। ওর পায়ের নখ মাথার নরম চামড়া ভেদ করে গভীরে ঢুকে গেল।

কাকের চেয়েও ভয়ঙ্কর স্বরে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠে দু’হাতে পাগলের মত বাড়ি দিয়ে ওকে মাথা থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করল জোন। কাকটা শক্ত ঠোঁট দিয়ে জোনের হাতে ঠোকর দিচ্ছে-ওর নখগুলো আরও গভীরে ঢুকে গেল—ওর পা জোনের মাথার সাথে একেবারে আটকে গেছে—কিছুতেই ছাড়ানো যাচ্ছে না।

মুখ বাড়িয়ে কাকটা এবার জোনের অশ্রুসিক্ত সুন্দর মুখের ওপর ঠোকর মারতে শুরু করল। প্রত্যেকবারই একটু করে মাংস ছিঁড়ে উঠে আসছে। রক্ত মেখে লাল হয়ে উঠেছে কাকের ঠোঁট-ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বেয়ে পড়ছে।

অসহ্য যন্ত্রণায় আকাশের দিকে মুখ তুলল জোন। কাউকে যেন নালিশ জানাচ্ছে সে। কিন্তু আকাশ আর দেখতে পাচ্ছে না ও। তার চোখ দুটোর জায়গায় এখন দেখা যাচ্ছে রক্তাক্ত দুটো গর্ত।

এবারে ডানা মেলে আকাশে উড়ল নরক থেকে পাঠানো মৃত্যু দূতটা। সাবলীল ভঙ্গিতে অনেক উপরে উঠে গেল সে। জোনের মাথা থেকে উপড়ে ছিঁড়ে আনা চামড়া, চুল আর রক্ত লেগে রয়েছে ওর নখে।

রাস্তার ধারে মাটিতে শুয়ে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে জোন। অনেকক্ষণ পর গড়াগড়ি থামিয়ে স্থির হয়ে পড়ে রইল। সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে।

আরও কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল।

দূরে ডিজেল এঞ্জিনের শব্দ শুনে কান খাড়া করল জোন। আঠারো চাকার একটা বড় ট্রাক আসছে। দ্রুত এগিয়ে আসছে ওটা।

মাথা তুলল জোন। এও কি সম্ভব? কোনমতে চেষ্টা করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল সে। রক্তাক্ত বিধ্বস্ত দেহে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল ও। দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে ট্রাক। চোখ হারিয়ে এখন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না জোন। হাত নেড়ে ড্রাইভারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চিৎকার করল সে।

ট্রাকের চালক এই নির্জন রাস্তার মাঝে কাউকে দেখবে আশা করেনি। যখন দেখল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কিছুই আর করার ছিল না।

গাড়ির প্রচণ্ড ধাক্কায় বিশ ফুট দূরে ছিটকে পড়ল জোনের প্রাণহীন দেহ। মাটি ছোঁবার আগেই মৃত্যু হয়েছে তার।

রাস্তায় চাকার চড়া সুরের আওয়াজ তুলে একশো গজ দূরে গিয়ে ট্রাকটা থেমে দাঁড়াল।

সব নীরব। ট্রাকের এঞ্জিন চলার মৃদু গুঞ্জন ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। দাঁড়কাকটা কর্কশ স্বরে একবার জোরে ডেকে উঠল—তারপর আরও উপরে উঠে আকাশে মিলিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *