অশুভ সংকেতের পর – ৭

সাত

ডেমিয়েনকে কেউ দেখতে পায়নি—এইমাত্র একটা ভীষণ অন্যায় কাজ সে করেছে। স্কুল চ্যাপলেনের কামরা থেকে তার বাইবেলটা চুরি করেছে সে।

ছেলেদের পড়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের বাইবেল রাখা উচিত ছিল কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় খেলাধুলা শেখার জন্যে অনেক বই রয়েছে, অথচ ধর্ম-শিক্ষার জন্যে একটা বইও খুঁজে পায়নি ডেমিয়েন। লাইব্রেরিতে খুঁজেও যখন বইটা পেল না, ভাবল ক্যাটালগের ভুল জায়গায় খুঁজেছে সে। কিন্তু কাউকে জিজ্ঞেস করা যাবে না—কেউ জানুক এটা সে চায়নি।

শেষ পর্যন্ত চ্যাপলেনের ঘর থেকেই বইটা সংগ্রহ করেছে ও। বিকেল বেলা চুপিচুপি তার অফিস কামরায় ঢুকেছিল ডেমিয়েন। অ্যাকাডেমির সুনাম রক্ষার জন্য এখানে কোন দরজায় তালা দেয়া হয় না।

ঘরে কয়েক কপি বাইবেল দেখতে পেল ডেমিয়েন। শেলফ থেকে পুরানো একটা খণ্ড বেছে নিল সে। আশা করেছে হয়ত আজ আর এটার খোঁজ পড়বে না। তাছাড়া সে তো আজ রাতেই আবার ওটা যথাস্থানে রেখে যাবে।

শীতের বিকেল। বাইরে অন্ধকার হয়ে আসছে। দুরুদুরু বুকে নিজের ঘরে ফিরে এল ডেমিয়েন। বিছানার ওপর বসে দু’হাতে নিজের মাথাটা চেপে ধরল সে। উত্তেজনায় মাথাটা চক্কর দিচ্ছে। চরম মুহূর্ত উপস্থিত।

আজ সে জানবে আসলে কে সে।

বিছানা থেকে কম্বল আর চাদর উঠিয়ে নিয়ে বন্ধ দরজার তলায় চাপা দিয়ে বাতি জ্বালাল ডেমিয়েন। এখন আর বাইরে থেকে কেউ দেখতে পাবে না ওর ঘরে আলো জ্বলছে। বিছানার খালি তোশকের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে বাইবেল খুলে রেভিলেশনের অধ্যায় পড়তে শুরু করল সে।

‘এবং সারা পৃথিবী বিভ্রান্ত হয়ে জানোয়ারের পিছু নিল। এবং জানোয়ার যার থেকে শক্তি আহরণ করে সেই ড্রাগনের উপাসনায় মত্ত হল তারা। বলল, ‘পশুর সমকক্ষ কে আছে? কে আছে তার শক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে তাকে হারায়?’

বই থেকে মুখ তুলে ডেমিয়েন ভাবতে চেষ্টা করল কথাটার মানে কি দাঁড়ায়। মার্কের কথা তার মনে হল, সে তার একান্ত ভক্ত। টেডিও এখন তাই। বুহের আর নেফের কথাও ভাবল সে। ওদের আচরণেও অনেকটা একই ভাব লক্ষ্য করেছে ডেমিয়েন। খেলার কথা ভাবল সে—সত্যিই তো, কোনকিছুতেই তো তাকে হারাতে পারে না কেউ?

আগ্রহভরে পড়ে চলল সে :

“এবং পশুকে দেখেছি আমি, পৃথিবীর সব রাজা আর তাদের সব সৈন্য—সামন্ত তার বিরূদ্ধে যুদ্ধ করবে বলে জড়ো হয়েছে। ঘোড়ার পিঠে বসে আছে সে, পিছনে তার দল…”

ডেমিয়েনের মনে পড়ল অ্যাটিলাকে কেমন সহজে বুঝতে পেরেছিল সে। কল্পনায় ছবিটা কেমন স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠেছিল—মনে হচ্ছিল যেন সে নিজেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে অজস্র সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে সেখানে উপস্থিত ছিল। তারই অশুভ আদেশের অপেক্ষায় ছিল সবাই।

ঢোক গিলল ডেমিয়েন। ভিতরে ভিতরে একটা তীব্র অস্থিরতা আর উত্তেজনা অনুভব করছে সে। আবার বই-এ মন দিল ডেমিয়েন t

‘পশুটা দেখতে চিতার মতো, ভালুকের মতো পা, সিংহের মতো মুখ আর ড্রাগনের কাছ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে সে।’

কথাগুলো উপমায় লেখা হয়েছে বুঝল ডেমিয়েন। অ্যাটিলাকেও তার সৈন্যেরা যুদ্ধ থেকে ফিরে বিভিন্ন রূপে বর্ণনা করত—বলত কেমন অসুরের মতো যুদ্ধ করেছে সে। মুখে মুখে সেই গল্প গাঁথায় পরিণত হয়েছে। গল্প তাকে এমন এক শক্তিশালী পশুতে পরিণত করেছিল যার সামনে কোন মানুষের পক্ষে টেকা অসম্ভব।

সে একবার ভাবল, তার সম্বন্ধেও কি লোকে অমন গল্প বলবে? আবার পড়ে চলল সে :

‘তার নীতি হবে চাতুরী প্রয়োগ করে নিজের উন্নতি। অনেক বড় হবে সে, বিশাল শক্তি নিয়ে সে যুবরাজ শ্রেষ্ঠের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।’

বুহের তাকে বলেছিল থর্ন মালিকানা তার বুঝে নিতে হবে—একদিন সব তারই হবে।

কিন্তু যুবরাজ শ্রেষ্ঠের বিরদ্ধে দাঁড়ানো—সে কি করে হয়, আমি তো এখনও ছেলেমানুষ! ভাবল সে।

কতটা দায়িত্ব তার কাঁধে চাপতে যাচ্ছে ভেবে ভয়ে কেঁপে উঠল ডেমিয়েন। ভারি পাথরের মতই ওর কাঁধে চেপে বসেছে ওটা। নামাবার কোন উপায় নেই।

ডেমিয়েনের বুকের ভিতরটা ঢিপঢিপ করছে। তার মনে হচ্ছে বইটা ছুঁড়ে ফেলে দিলে বা পুড়িয়ে ফেললে ভাল হয়। যা পড়েছে তা ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে। বইটা তুলে সজোরে ছুঁড়ে মারল সে উল্টোদিকের দেয়ালে। বাড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ল বাইবেলটা।

স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বইটার দিকে চেয়ে আছে ডেমিয়েন। আগুন যেমন পতঙ্গকে টানে, ঠিক তেমনি টানছে ওকে বাইবেল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে মূল রহস্য উদ্ঘাটন করতে আর সামান্যই বাকি আছে তার।

শুকনো মুখে এগিয়ে গিয়ে বইটা তুলল ডেমিয়েন। খোলা বইটা দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে কয়েকটা পাতায় ভাঁজ পড়েছে। কম্পিত হাতে পাতাটা আবার খুলে সে পড়লঃ

‘যার জ্ঞান আছে সেই জানে পশুর সংখ্যাটা কতঃ মানুষ রূপী পশুর সংখ্যাও একই। সংখ্যাটা ছয়শো তার সাথে তিন কুড়ি এবং আরও ছয়।’

শব্দ করে বইটা বন্ধ করল ডেমিয়েন। তাহলে এর প্রমাণও আছে—একটা চিহ্ন। ওর যদি চিহ্নটা না থাকে তবেই সে মুক্ত! বইটার প্রতি অকৃত্রিম ঘৃণায় প্রতিটা পাতা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দরজার সামনে থেকে লাথি দিয়ে চাদর কম্বল সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল ডেমিয়েন। কেউ ওকে দেখে ফেলল কিনা কিছুই কেয়ার করছে না সে। করিডোর দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সোজা বাথরূমে ঢুকল ও।

ভিতরে কেউ নেই। টিউব লাইটে বাথরূমের সাদা টাইলগুলো দিনের আলোর মত ঝকঝক করছে। বাইরে আকাশে কিছুটা মেঘ করেছে—জোর বাতাস বইছে।

সাবধানে বাইবেলটা বেসিনের ওপর রাখল ডেমিয়েন। টুথ পেস্টের দাগ ভরা একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছে ডেমিয়েন। হাত ভিজিয়ে ঘষে আয়নার একটা অংশ পরিষ্কার করে নিল সে! তার দেহে কোথাও কোন চিহ্ন নেই এটা ভাল করেই জানে ও। তবু আর একবার খুঁটিয়ে দেখল সে। না, কোন দাগ নেই।

এবার চুল ফাঁক করে আয়নায় দেখল সে।

কিছুই নেই।

আবার আর এক জায়গায় চুল সরিয়ে চাইল—এবারেও কোন চিহ্ন ওর চোখে পড়ল না। কিন্তু এর শেষ আজ ওকে দেখতেই হবে। হতে পারে বড়রা মিথ্যেমিথ্যি তার মনে অহেতুক ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে।

আরও উপরে চুল ফাঁক করল সে।

এবারে চিহ্নটা স্পষ্ট দেখতে পেল ডেমিয়েন।

এতদিন ওটা কারও চোখে পড়েনি কারণ চিহ্নটা আকারে বেশ ছোট। ওর ঘন চুলের আড়ালে একত্রে লুকিয়ে রয়েছে তিনটে ছয়।

ডেমিয়েনের বুকটা ধড়াস করে উঠল। সত্যের রূঢ় আঘাতে পিছনের দেয়ালের ওপর প্রায় আছড়ে পড়ল সে। তাহলে এটাই সত্যি—নেফ যা বলেছে, বুহের যে সব ইঙ্গিত দিয়েছে—সবই সত্যি!

কিন্তু এখনও যে সে একটা বাচ্চা ছেলেই।

বাইবেলটা বুকে চেপে ধরেই পায়খানায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ডেমিয়েন। সে কি করবে, কোথায় যাবে, কিছুই জানে না সে। শুধু জানে তার এখন কিছুটা একা থাকতে হবে

করিডোর ধরে ছুটে সিঁড়ির দিকে এগোল ডেমিয়েন। ওখানে একটা ঘরে স্কুল ব্যাণ্ড রিহার্সেল দিচ্ছে। মার্ক ওকে দেখতে পেয়ে ডাকল, ‘ডেমিয়েন!

থামল না সে। ছুটে এগিয়েই চলল। চ্যাপলেনের অফিসের সামনে বইটা ফেরত দেয়ার জন্যে থামল সে। কিন্তু দরজাটা খোলা রয়েছে-অর্থাৎ চ্যাপলেন ভিতরেই রয়েছে। বইটা দরজার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েই উল্টোদিকে ছুটল ডেমিয়েন। দালান থেকে বেরিয়েও থামল না সে-ফাঁকা খেলার মাঠ পেরিয়ে, স্কুলের গেট পেরিয়ে, রাস্তা পেরিয়ে ছুটে চলল। নেফ, বুহের, স্কুল, বাইবেল সবকিছুর কাছ থেকে সে দূরে পালিয়ে যেতে চায়।

নিজের কাছ থেকেই পালাতে চাচ্ছে সে।

ছুটতে ছুটতে এখন আর পারছে না, মনে হচ্ছে বুঝি এবার তার ফুসফুসটা ফেটেই যাবে—পা দুটো সীসার মত ভারি হয়ে উঠেছে—বুঝল আর এক পা চলতে গেলেও মারা পড়বে সে-একটা গাছের তলায় হাঁটু গেড়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ল ছেলেটা।

খানিকক্ষণ পরে মুখ তুলে অন্ধকার আকাশের দিকে চাইল সে। কালো মেঘ জমেছে আকাশে, ঘন ঘন মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। দু’হাত আকাশের দিকে তুলে প্রতিবাদ জানাল সে। নাকি আত্মসমর্পণ করল?

ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ডেমিয়েন।

অনেক উঁচু ডালে বসে একটা প্রকাণ্ড দাঁড়কাক কর্কশ শব্দে ডেকে উঠল। সবই বুঝছে, এমন একটা ভাব নিয়ে ঘাড় কাত করে নিচে ছেলেটার দিকে চেয়ে রয়েছে কাকটা। ওর চোখে বিজয়ের আভাস।

.

সেই রাতেই আরও দুটো আশ্চর্য দৈব ঘটনা ঘটল।

প্রথমটা ঘটল পল বুহেরের বাসায়। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তার ডান হাতের অনামিকায় পরা আংটিটা খুলতেই সে অবাক হয়ে চিহ্নটা লক্ষ্য করল। উপাসনা যেদিন থেকে শুরু করে সেদিনই ওই আংটিটা হাতে চড়িয়েছে সে। আজ এতদিন পরে তার সাধনা সফল হয়েছে—আংটির নিচে তিনটে ছোট্ট অক্ষর দেখা যাচ্ছে—৬৬৬! গ্রহণ করা হয়েছে তাকে।

দ্বিতীয়টা ঘটল অ্যাকাডেমিতে নেফের নিজস্ব কোয়ার্টারে তার বাথরূমে। মুখ হাত ধুয়ে দাঁত মাজল সে। তারপর কপাল থেকে চুল সরিয়ে আয়নায় নিজের চেহারা দেখল। তার ‘ডাক’ আসার পর থেকে রোজ রাতেই সে আয়না দেখে। আজ দেখতে পেল চুলের নিচে তিনটে ছোট্ট ছয়।

পথে ওদের আর কোন বাধা রইল না। রাত দশটা। মার্ক ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠল। আসলে ঘুমায়নি সে—তন্দ্রার ঘোরে রয়েছে।

ব্যাণ্ডের সাথে রিহার্সেল শেষ করে কামরায় ফিরে সে দেখছে বিছানার চাদর আর কম্বল মাটিতে লুটাচ্ছে। একই ঘরে থাকে মার্ক আর ডেমিয়েন। যত্ন করে ভাই-এর বিছানা ঠিকঠাক করে দিয়ে নিজের খাটে এসে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকল। দুশ্চিন্তা নিয়ে ডেমিয়েনের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে চোখ লেগে এসেছিল তার। কি হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। ক্লাসেও আজ ডেমিয়েন অদ্ভুত আচরণ করেছে—তারপর সন্ধ্যায় ওভাবে ছুটে বেরিয়ে গেল। এর মধ্যে আর ওর সাথে কথা বলার সুযোগ পায়নি মার্ক। এত রাত হয়ে গেল এখনও ফেরেনি ডেমিয়েন ভয়ে তার ঘুম আসছে না।

ডেমিয়েনের হাল্কা পায়ের শব্দে ঘুরে তাকাল সে। ঘরে ঢুকে দরজার কাছে ওরই দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডেমিয়েন

‘কোথায় ছিলে তুমি?’ প্রশ্ন করল মার্ক। ওর স্বরে নির্ভেজাল শঙ্কা প্রকাশ পেল। ‘এদিকে দুশ্চিন্তায় মরছি আমি।’

জবাব দিল না ডেমিয়েন। নীরবে নিজের বিছানায় গিয়ে ছাদের দিকে চেয়ে শুয়ে রইল সে!

‘ডেমিয়েন!’ ফিসফিস করে ডাকল মার্ক। এবারেও কোন জবাব এল না এখনও উপর দিকে চেয়ে শুয়ে আছে ও। আর সহ্য করতে পারল না মার্ক আগের চেয়ে আর একটু জোরে সে প্রশ্ন করল, ‘কি হয়েছে তোমার?’

অনেকক্ষণ নীরব থেকে শেষে ডেমিয়েন বলল, ‘কিছুই হয়নি আমার। তুমি বাতিটা নিভিয়ে দাও, নইলে আমরা দু’জনেই বকা খাব।

বাতি নিভিয়ে দিল মার্ক। পুরোপুরি অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেল ঘরটা। চোখে অন্ধকার কিছুটা সয়ে এলে সে দেখল ডেমিয়েন তখনও একই ভাবে উপরের দিকে চেয়ে শুয়ে আছে। সত্যিই তোমার কিছু হয়নি?’ প্রশ্ন করল মার্ক

‘তুমি ঘুমাও তো!’ বিরক্ত কড়া সুরে ধমকে উঠে নিজেও পাশ ফিরে শুলো ডেমিয়েন।

অনেক রাত পর্যন্ত মার্কের কিছুতেই ঘুম এল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *