অশুভ সংকেতের পর – ১৪

চোদ্দ

ডেভিডসন মিলিটারি অ্যাকাডেমির তলোয়ার বিতরণী চলছে। প্রতি বছর একবার করে এই অনুষ্ঠান হয়। ছাত্রদের অভিভাবক আর অন্যান্য ছাত্রেরা সবাই ব্যালকনিতে জড়ো হয়েছে। স্কুলের হল-ঘরে অনুষ্ঠান।

এ বছর মোট ছয়জনকে এই সম্মান দেয়া হয়েছে। ডেমিয়েন তাদের মধ্যে একজন। মার্কেরও একটা তলোয়ার পাওয়ার কথা ছিল। পাঁচজন ক্যাডেট এমন ভাবে দাঁড়িয়েছে যে স্পষ্টই বোঝা যায় ওখানে একজন অনুপস্থিত। গর্বের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজের পালা আসার অপেক্ষা করছে ডেমিয়েন। চওড়া কালো ফিতেটা এখনও ওর বাম বাহুতে শক্ত করে বাঁধা।

ব্যালকনিতে অ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বুহের। অ্যানের চোখে পানি এসে গেছে দেখে তাড়াতাড়ি নিজের রুমালটা বের করে দিল সে। একটু কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে রুমালটা নিল অ্যান।

নিচে, একজন ক্যাডেট আলাদা দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেক ক্যাডেট তার পুরস্কার আনতে যাবার সময়ে বিউ বাজাচ্ছে সে।

এবার ডেমিয়েনের নাম ডাকা হল। চমৎকার ভঙ্গিতে মার্চ করে এগিয়ে গেল সে। যে লোকটা পুরস্কার দিচ্ছে তার থেকে ঠিক এক ফুট দূরে খটাশ্ শব্দ করে জুতোর গোড়ালি ঠুকে থামল। ঋজু অ্যাটেনশনে দাঁড়িয়েছে ডেমিয়েন।

ব্যালকনিতে উত্তেজনার দুর্বলতায় এক হাতে বুহেরের কনুই জড়িয়ে ধরল অ্যান। হাতের ওপর মৃদু চাপড় দিয়ে ওকে সান্ত্বনা দিল বুহের।

ডেমিয়েনের পুরস্কার নেয়া হলে দ্বিতীয় আর একটা তলোয়ার হাতে তুলে নিল প্রাইজদাতা লোকটা। মার্কের তরফ থেকে গ্রহণ কর এটা,’ বলল সে! ‘তোমার ভাই আজ নেই, কিন্তু এই সম্মান যথার্থই তার প্রাপ্য।’

সবাই একসাথে জোর হাততালি দিয়ে উঠল। রুমাল দিয়ে চোখ মুছল অ্যান। বিনীত কুর্নিশ করে আবার মার্চ করে নিজের জায়গায় ফিরল ডেমিয়েন।

থর্নের শোফার মারে ব্যালকনিতে উপস্থিত হয়ে অ্যানের কানে কানে নিচু স্বরে কি যেন বলল। মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে বুহেরের দিকে ফিরল অ্যান। ‘আমার এখন যেতে হবে, পল। রিচার্ড তার জেট থেকে এইমাত্র ফোন করেছিল, কিছুক্ষণের মধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাবে সে। আমি নিজেই এয়ারপোর্টে ওকে আনতে যেতে চাই।’

‘ওখান থেকে ফিরে পার্টিতে যোগ দেবেন তো?’ প্রশ্ন করল বুহের।

‘চেষ্টা করব আমরা,’ বলে মারের পিছন পিছন বিদায় নিল অ্যান।

অ্যান বেরিয়ে গেলে নিচের দিকে চাইল বুহের। নেফের সাথে চোখাচোখি হল তার-দু’জনেই সামান্য মাথা ঝাঁকাল—তারপর অন্যদিকে মুখ ফেরাল ওরা।

.

লিমোসিনের পিছনের সিটে বসে থর্নের জন্যে অপেক্ষা করছে অ্যান। গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় রয়েছে মারে।

ছোট প্রাইভেট জেটটা ধীর গতিতে এগিয়ে এসে গাড়ির কাছে থামল। সিঁড়ি লাগানো হতেই দরজা খুলে গেল। প্লেন থেকে বেরিয়ে এক সাথে দুটো করে ধাপ পেরিয়ে দ্রুত নিচে নেমে এল থর্ন।

গাড়ির ভিতরে বসা অ্যানকে পাত্তাই দিল না থর্ন। সোজা মারের কাছে ছুটে গিয়ে উত্তেজিত স্বরে প্রশ্ন করল, ‘ডেমিয়েন কোথায়?’

‘অ্যাকাডেমিতে, স্যার,’ জবাব দিল মারে। মনিবের ব্যবহারে অত্যন্ত অবাক হয়েছে সে।

‘আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে মিউজিয়মে যাচ্ছি, তুমি এখনই ডেমিয়েনকে নিয়ে ওখানে এসো।’ গাড়ির দরজা খুলে অ্যানকে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে থর্ন বলল, ‘এসো, আমরা এক সাথেই যাচ্ছি।’

এয়ারপোর্ট টার্মিনালের দিকে এগোল ওরা দু’জন। রিচার্ডের সাথে তাল রাখতে পারছে না অ্যান, পিছিয়ে পড়ছে। কি যে ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। ওদের দিকে চাইল মারে-ওর চোখে ঘৃণার দৃষ্টি।

.

পার্টি বেশ জমে উঠেছে। ডান্স ফ্লোরে ছেলেমেয়েরা নাচছে। ক্যাডেটরা সবাই ইউনিফর্ম পরা, আর মেয়েরা পরেছে সাদা গাউন।

যারা নাচছে না তারা দাঁড়িয়ে আছে ককটেল টেবিলের ধারে। ওই বয়সের স্বভাবজাত আড়ষ্টতার কারণেই মেয়েরা যেখানে, তার উল্টোদিকে জড়ো হয়েছে ছেলেরা। চোরা দৃষ্টি বিনিময় আর হাসাহাসি চলছে ওদের মধ্যে।

কামরার অন্যপাশে সার্জেন্ট নেফের সাথে দাঁড়িয়ে আছে ডেমিয়েন। দু’জনেই নাচ দেখছে। ইলিনয়সের গভর্নরের মেয়ে দু’জন দেহরক্ষীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে ডেমিয়েনকে দেখছে খেয়াল করল নেফ। ‘ওই মেয়ের সাথে নাচতে হলে অসীম সাহসের দরকার,’ বলল সে।

‘গভর্নরের মেয়ের সাথে?’ প্রশ্ন করল ডেমিয়েন।

মাথা ঝাঁকাল নেফ।

হাসল ডেমিয়েন। বলল, ‘ভুলে যেও না আমি কে।’ সোজা মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল ও।

সন্তুষ্ট নজরে চেয়ে আছে নেফ।

.

জাদুঘরে ঢুকেই তাড়াতাড়ি চার্লসের অফিস ঘরের দিকে চলল রিচার্ড। ওর পিছু পিছু চলেছে অ্যান।

‘কথাটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না,’ চেষ্টা করেও রিচার্ডকে ধরতে পারছে না অ্যান।

‘তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে!’ উত্তেজিত কণ্ঠে বলল রিচার্ড। ‘মার্ককে ও-ই মেরেছে। অ্যাদারটন আর প্যাসারিনকেও—

‘থাম!’ এগিয়ে এসে রিচার্ডের হাত খামচে ধরল অ্যান।

ওর দিকে ফিরল রিচার্ড। ‘একের পর এক মানুষকে মেরেই চলবে সে। ওর পথের কাঁটা যে-ই হবে তাকেই মারবে সে।’ হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চওড়া মার্বেল পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল রিচার্ড।

রেগে আগুন হয়ে গেছে অ্যান। কিভাবে?’ জোর গলায় জিজ্ঞেস করল সে। ‘কিভাবে সে মারল ওদের? সে তো বরফে ফাটল—’

‘না, সে নিজে—’

‘আর গ্যাস পাইপ—ওটাও সে ছেঁড়েনি!’

চলতে চলতে থেমে দাঁড়াল রিচার্ড। ‘আরও লোক আছে,’ বলল সে। ‘ওরা ওকে ঘিরে রেখেছে—সাহায্য করছে!’

শক্ত একটা ঢোক গিলল অ্যান। বিশ্বাসই করতে পারছে না যে তার স্বামীর মুখ থেকেই এসব কথা শুনছে সে। ‘রিচার্ড,’ নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে অ্যান। ‘তুমি নিজেই ভেবে দেখ, বুঝবে কি ধরনের অবাস্তব কথা তুমি বলছ! ডেমিয়েন— শয়তান—তাকে সাহায্য করছে একদল লোক—ওরাও শয়তান। মাথা খারাপ হয়েছে তোমার?’

ওর হাত দুটো ধরে বোঝাতে চেষ্টা করল রিচার্ড। ‘অ্যান, চার্লসকে খুন হতে দেখেছি আমি—

চমকে উঠল অ্যান। চার্লসের মৃত্যুর কথা এই প্রথম উল্লেখ করা হল।

‘য়িগেইলের দেয়ালে ডিমিয়েনের চেহারাও দেখেছি আমি!’

অনেকক্ষণ চোখে চোখে চেয়ে রইল ওরা। রিচার্ড চাইছে অ্যান তাকে বিশ্বাস করুক। আর অ্যান চাইছে কথাগুলো রিচার্ড ফিরিয়ে নিক—সে বলুক এতক্ষণ যা বলেছে সবই মিথ্যে—ঠাট্টা করছিল সে।

কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও ঠাট্টা নয়। এর পরে কি ঘটবে সেই চিন্তায় ভীত—সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে সে। ‘এখন তাহলে কি করবে তুমি?’ প্রশ্ন করল অ্যান। ভয়ে গলাটা কেঁপে গেল তার।

.

গভর্নরের মেয়ের সাথে নাচছে ডেমিয়েন। সুন্দর নাচছে সে। অত্যন্ত উপভোগ করছে মেয়েটা। আজ পর্যন্ত তার সময় এত সুন্দর আর কোনদিন কাটেনি। ছেলে মেয়ে সবারই চোখ ওদের দু’জনের ওপর। মেয়েরা হিংসার চোখে দেখছে ওদের। সত্যিই সুন্দর মানিয়েছে দু’জনকে।

নাচের ফ্লোরে আর একপাক ঘোরার সময়ে হঠাৎ ডেমিয়েনের চোখে পড়ল তাদের শোফার আর নেফ এক কোনায় দাঁড়িয়ে গভীর আলাপে ব্যস্ত। মারের সাথে চোখাচোখি হল তার।

‘কিছু মনে কর না,’ ভদ্রতা করে বলল ডেমিয়েন। ‘এক মিনিট—একটু পরেই আবার আসছি আমি।’ মেয়েটাকে ওর দেহরক্ষী দু’জনের কাছে পৌঁছে দিয়ে নেফ আর মারের দিকে এগিয়ে গেল সে।

নেফ একটু এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বলল, ‘খুব সাবধান।’

শান্ত ঠাণ্ডা গলায় ডেমিয়েন বলল, ‘তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি কে।’

ক্ষমা চেয়ে সম্মান দেখানোর ভঙ্গিতে মাথা হেঁট করল নেফ।

ঘুরে মারের পিছু পিছু বাইরে গিয়ে অপেক্ষমাণ লিমোসিনে উঠল ডেমিয়েন।

.

অনেক বেছে শেষ পর্যন্ত ওয়ারেনের অফিসঘরের চাবিটা পেয়ে তালা খুলে ফেলল রিচার্ড। ঘরে ঢুকে লাইটটা জ্বেলেই পাগলের মত কি যেন খুঁজতে শুরু করল। ড্রয়ার খুলছে বন্ধ করছে, ক্যাবিনেট, আলমারি, টেবিলের তলা, কোথাও দেখতে বাকি রাখছে না।

‘কি খুঁজছো তুমি?’ প্রশ্ন করল অ্যান। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ও।

মুখ তুলে সে স্পষ্ট জবাব দিল, ‘ওই ছুরিগুলো এখানেই কোথাও আছে। থাকতেই হবে।’

ছুটে এগিয়ে এল অ্যান। ‘না, রিচার্ড!’ চিৎকার করে উঠল সে। ‘আমি তোমাকে কিছুতেই—

ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিল রিচার্ড। ‘সর, বাধা দিও না। আমি জানি গুগুলো এখানেই কোথাও আছে।

প্রচণ্ড ভয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল অ্যান। ‘ওকে মারতে যাচ্ছ তুমি!’

খুঁজে চলেছে সে। ‘যেভাবেই হোক ওকে ঠেকাতেই— ‘

‘না!’

‘অ্যান, ও মানুষের সন্তান না!’ তালাবন্ধ ড্রয়ারটা জোর করে টেনে খোলার জন্যে টানটানি শুরু করল রিচার্ড।

‘সে তোমার ভাই-এর ছেলে!’ কেঁদে ফেলল অ্যান। ‘নয় বছর ওকে নিজের ছেলের মতো আদর ভালবাসা দিয়েছ!’

কিন্তু ওর কথা রিচার্ডের কানে ঢুকছে না! ড্রয়ারটা খুলবেই—বদ্ধপরিকর সে। কিছুতেই খুলছে না ড্রয়ার। হাতের কাছে কিছু পাওয়া যায় কিনা আশেপাশে খুঁজে দেখল রিচার্ড। যন্ত্রপাতির ট্রে থেকে ছেনি তুলে নিয়ে আবার ড্রয়ারের কাছে ফিরে গেল সে।

.

বাইরে, মিউজিয়মের সামনে এসে থামল থর্নের লিমোসিন! গাড়ি থেকে নামল ডেমিয়েন। ঝুঁকে মারেকে কি যেন একটা নির্দেশ দিয়ে এক এক লাফে দুটো করে সিঁড়ি পার হয়ে ভিতরের দিকে এগিয়ে চলল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *