অশুভ সংকেতের পর – ১০

দশ

রিচার্ড আর অ্যান বিছানায় শুয়েই খবরের কাগজ পড়ছে। সকালের নাস্তার সাথে কাগজও দিয়ে গেছে বাটলার। রিচার্ড সব সময়েই ‘দ্য ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল’ পড়ে—অ্যানের পছন্দ ‘দ্য শিকাগো ট্রিবিউন’।

আজ সকালে কাগজ খুলেই আঁতকে উঠল অ্যান। ‘রিচার্ড! দেখ!’ কাগজটা সে স্বামীর দিকে বাড়িয়ে দিল।

বিগত ডা. কেইনের ভয়ানক পরিণতির ছবিসহ লিফট দুর্ঘটনার কথা লেখা হয়েছে ওতে। থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির গ্যাস লীকেরও একটা ছোট্ট বিবরণ ছাপা হয়েছে।

আপাতত ডাক্তারের চেয়ে তার কারখানায় দুর্ঘটনার ব্যাপারে কাগজে কি লেখা হল সেটা জানতেই বেশি আগ্রহী থর্ন।

‘গতকালই ওর সাথে কথাবার্তা বললাম আমরা,’ একগোছা চুল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে বলল অ্যান। ‘সত্যি, অদ্ভুত মনে হয় না?’

‘হুঁম্‌ম্‌ম্‌ম্..…’

কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে রিচার্ডের দিকে চাইল অ্যান। ‘আচ্ছা, ড. কেইন কি ধরনের টেস্টের কথা বলছিল?’

‘জানি না, মনে হয় না সে… হঠাৎ থেমে জিজ্ঞেস করল, ‘ছেলেরা কেথায়?’

‘এখনও ঘুমাচ্ছে হয়ত—কেন?’

কাগজ নামিয়ে রেখে অ্যানের দিকে ফিরে বসল রিচার্ড। ‘ওরা এসব কথা শুনুক এটা আমি চাই না।

‘কেন?’ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল অ্যান। ‘ডাক্তার তোমাকে কি বলেছে?’

‘ডেমিয়েনের ওপর গ্যাসের কোন ক্রিয়া হয়নি।

‘সেটা খারাপ হল কিসে? আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত…’

‘এ ব্যাপারে ডাক্তার খুব বিব্রত ছিল। বলছিল সে নাকি বার ছয়েক টেস্ট করে দেখেছে।

‘কি দেখল?’

‘জানি না,’ জবাব দিল রিচার্ড। ‘ওর ক্রোমোজোমগুলো নাকি ভিন্ন ধরনের।’

‘আলাদা?’ অবাক হয়েছে অ্যান। অসম্ভব!’

‘আমিও তাই বলেছিলাম—কিন্তু ডাক্তার এ ব্যাপারে খুব চিন্তিত ছিল।’

খানিক চুপ করে থেকে অ্যান বলল, ‘তাহলে এখন কি করতে চাও তুমি?’ সত্যি কথা বলতে কি, কিছুই করব না আমি।’ কাগজের দিকে হাত বাড়াল থর্ন। ‘ওসব জেনেটিক্‌স্-এর বুলি বিশ্বাস করি না। ডেমিয়েন চমৎকার আছে।’

কেন যে সেদিন সকালে এমন প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙল তার কারণ নিজেও বুঝতে পারল না ডেমিয়েন।।

.

চার্লস ওয়ারেন আকর থেকে মাত্র ফিরেছে। ওখানে বেলভয়ের প্রাসাদ থেকে শেষ দফায় থর্ন জাদুঘরের জন্য যে মাল পাঠানো হবে তার দেখাশোনা করতে গিয়েছিল সে।

ভাগ্যের চক্রে য়িগেইলের দেয়ালটা এযাত্রায় দেখা হয়নি তার। ওটা আগেই জাহাজে তোলার জন্যে বাক্সবন্দী করা হয়েছিল। তার পরিচিত সাংবাদিক জোন হার্ট ওই দেয়ালটা নিয়ে যে রকম কাণ্ড বাধিয়ে তুলেছিল তাতে ওটা নিজের চোখে একবার দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শিকাগোতে পৌঁছানোর আগে আর ওটা চার্লসের দেখা হবে না।

ওখানে কয়েকদিন ওর খুব কাজের চাপ গেছে। আমেরিকায় তার নিজের অফিসে ফিরতে পেরে চার্লসের মনটা বেশ প্রসন্ন। সারা জাদুঘরে তার ঘরটাই কাজ করার জন্যে সবচেয়ে ভাল বলে মনে করে সে। একতলার নিচে বয়লার ঘরের সাথেই ওর অফিস। কাজের জন্য শান্ত নীরব পরিবেশ রয়েছে ওখানে। বিশেষ করে আজকে ছুটির দিন—যারা কাজে এসেছিল তারাও সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি চলে গেছে।

তার ঘরে প্রাচীন শিল্পকর্ম ঠিক করে রাখা আর মেরামত করার সবরকম আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে। বিশেষ রকম এয়ার-কণ্ডিশনার, বিশেষ ইনফ্রারেড আর আলট্রাভায়োলেট বাতি, নানান ধরনের ছোট বড় নিজস্ব তাপ নিয়ন্ত্রক থারমোস্ট্যাট যুক্ত চুল্লী। বোতলে ভরা বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, বিশেষ ব্রাশ আর রঙ মেশানোর কাঠের ছুরি। আধুনিক কারিগরি জ্ঞান আর পুরানো আমলের যন্ত্রপাতি আর রসদ ব্যবহার করে চার্লস যে-কোন পুরাকীর্তিকেই কিছুমাত্র অঙ্গহানি না করে নতুন তৈরি হয়েছে এমন রূপ দিতে পারে। এর জন্যে মূল শিল্পীর কাছে তখনকার দিনে যেসব জিনিস হাতের কাছে পাওয়া সম্ভব ছিল, কেবল সেইসব জিনিসই ব্যবহার করে সে।

আজ রাতে আকর থেকে আনা কিছু জিনিসপত্র নিয়ে কাজ করছে চার্লস। মাটির পাত্র আর ব্রোঞ্জের ছুরিগুলো সরিয়ে এবার সে পুরানো চামড়ার ব্যাগটা খুলল। প্লেনে করে আকর থেকে এগুলো নিজের সাথেই এনেছে ও। গুরুত্বপূর্ণ কিছু হতে পারে সন্দেহ করেই আজকের নিরিবিলি রাতটা কাজের জন্যে বেছে নিয়েছে।

চামড়ার সবকটা ফিতে সাবধানে খুলে ভিতরে চেয়ে একটু শুঁকে দেখল। বুঝতে পারছে জিনিসগুলো খুব পুরানো নয়। কিন্তু ওগুলো খুব নতুন বলেও মনে হল না।

ভিতরে হাত ঢুকিয়ে শক্ত করে পেঁচানো ছাগলের চামড়ার তৈরি লিখবার কাগজ বের করে আনল। ওগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে আবার হাত ঢুকাল সে। এবার বেরিয়ে এল ছোট্ট একটা ক্রুশে বিদ্ধ যীশুর প্রতিমূর্তি। ওটার দিকে একবার চেয়ে ওটাও সরিয়ে রাখল ওয়ারেন। আবার হাত ঢুকাতেই এবার বেরিয়ে এল একটা আধুনিক ম্যানিলা খাম! অবাক হলেও আপাতত ওটা সরিয়ে রাখল সে।

ব্যাগের ভিতর আর কিছুই পাওয়া গেল না।

অন্য একটা পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেশ ভারি একটা পুরানো কাপড়ে জড়ানো পুঁটলি বেরুল। বের করার সময়ে ভিতরে কিসের যেন পরস্পর বাড়ি খাওয়ার ধাতব একটা আওয়াজ ওয়ারেনের কানে এল। সাবধানে কাপড়ের মোড়ক খুলে দেখল ভিতরে রয়েছে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ সাতটা স্টিলেটো ছুরি। দেখেই বোঝা যায় গুগুলো বেশ পুরানো। হাতির দাঁতের হাতল। হাতলে খোদাই করা যীশুর মূর্তি।

ওয়ারেন আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছে না। এবার সে ম্যানিলা খামটা খুলল। এক গাদা কাগজ বেরুল ওর ভিতর থেকে। অবাক চোখে কাগজগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে তার মনে হলঃ হাতের লেখাটা অনেকটা বুগেনহাগেনের মতো।

মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করল সে।

.

ছেলেদের মার্চের ছুটিতে ওরা বাসায় বসে ওয়েস্টার্ন ছবি দেখে সন্ধ্যা কাটাচ্ছে!

ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা লম্বা লোক ছোট্ট একটা শহরের ধুলো ভরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হাত দুটো তার মুক্তো-সাদা পিস্তলের বাঁটগুলোর কাছাকাছি ঝুলছে।

হোটেলের তিনতলার জানালা থেকে একটা উইনচেস্টার রাইফেলের মাথা দেখা যাচ্ছে। ওপাশে একটা সাপ্লাই স্টোরের দোতলায় জানালার পর্দাটা একটু কেঁপে উঠল-কিন্তু ওদিকে নজর নেই লোকটার।

রাইফেলটা হঠাৎ গর্জন করে উঠল—লোকটা ডাইভ দিয়ে মাটিতে পড়েই অনেকগুলো মানুষ হয়ে গেল। সব কিছুই কাঁপছে—প্রত্যেকটা জিনিসই কয়েকটা করে দেখা যাচ্ছে কাঁপতে কাঁপতে ছবি পর্দা ছেড়ে দেয়ালের ওপর গিয়ে হাজির হল।

‘গুলি কর প্রজেকশনিস্ট ব্যাটাকে!’ চিৎকার করে উঠল ডেমিয়েন

ডেমিয়েনের পিছনে দেয়ালের ফোকর দিয়ে মাথা বের করল মার্ক। ‘ফাজলামি হচ্ছে, না?’ প্রতিবাদ করে তাড়াতাড়ি প্রজেক্টর ঠিক করায় মন দিল সে।

সাধারণত ওরা যখন বাসায় ছবি দেখে তখন ওদের বাটলারই প্রজেক্টর চালায়। বাটলারের কাছ থেকে হাতেখড়ি নিয়ে আজই প্রথমবারের মত প্রজেক্টর চালাচ্ছিল মার্ক। চরম উত্তেজনাময় মুহূর্তেই গোলমাল করে ফেলেছে সে!

মার্কের কপাল ভাল, অল্পক্ষণেই ঠিক হয়ে গেল প্রজেক্টর। ডেমিয়েন ঠাট্টা করে কিছু বলতে যাচ্ছিল, এই সময়েই আবার ছবি শুরু হল। চমৎকার কায়দায় মাটিতে একপাক গড়িয়ে উঠে দাঁড়াল হিরো। এরই ফাঁকে ওর দু’হাতে দুটো পিস্তল এসে গেছে। ডান হাতের গুলিতে মারা পড়ল রাইফেলধারী লোকটা, আর ওর বাম হাতের পিস্তল থেকে গুলি খেয়ে অন্য লোকটা পর্দা ছিঁড়ে নিয়ে সশব্দে জানালার তলায় ঘোড়ার পানি খাওয়ার টবে পড়ল। তারপর শহরবাসীদের বাহবা আর হাতত।দির মাঝে হিরো ঘোড়ায় চড়ে বিদায় নিল।

‘সব ভাল যার শেষ ভাল,’ মন্তব্য করল অ্যান। ডেমিয়েন সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে দিল।

‘মোটামুটি,’ বলল ডেমিয়েন। ‘দশে ছয় দেয়া যায়।

হেসে মাথা নাড়ল অ্যান। ‘এই বয়সেই তোমার এতটা কঠোর হওয়া মানায় না।’ উঠে দাঁড়িয়ে সে আবার বলল, ‘তোমরা কে কে বীফ স্যাণ্ডউইচ খাবে, বল।’

‘একটা!’ হাত তুলল রিচার্ড।

‘আমি দুটো!’ যোগ দিল ডেমিয়েন।

‘বুঝেছি, মার্কেরও দুটো চাই,’ বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল অ্যান।

প্রজেকশন ঘরে বসে মার্ক খুব সাবধানে ছবির রীল পেঁচাচ্ছে যেন আবার ফেঁসে না যায়। ডেমিয়েন পর্দাটা গুটিয়ে ফেলল। রিচার্ড ব্যাকগ্যামন খেলার বোর্ড সাজাতে বসল।

এই সময়ে সদর দরজার কলিং বেল বেজে উঠল Į

‘আমি দেখছি কে এল,’ বলে দরজার দিকে এগোল ডেমিয়েন।

দরজার বাইরে তুষারে আবৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে চার্লস ওয়ারেন। ওর হাতে বুগেনহাগেনের ম্যানিলা এনভেলপটা রয়েছে। ঠাণ্ডায় নয়, ভয়ে আর উত্তেজনায় মৃদুমৃদু কাঁপছে সে। একটু আগে সে যা পড়েছে তা যেমন আশ্চর্য তেমনি ভয়ঙ্কর।

ডেমিয়েনকে দরজা খুলতে দেখে ওর চেহারা একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হাসার চেষ্টা করল চার্লস। কিন্তু ডেমিয়েন সাথে সাথেই সতর্ক হয়ে গেল কিছু একটা আঁচ করে নিয়েছে সে।

‘ড. ওয়ারেন? কি ব্যাপার?’ একটু শক্ত ভাবে প্রশ্ন করল ডেমিয়েন।

‘হ্যালো, ডেমিয়েন-ডাল আছ?’ গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল চার্লস। ‘তোমার বাবার সাথে একটু দেখা করতে এলাম।’

‘আসার কথা ছিল আপনার?’ ঠাণ্ডা, ভদ্রভাবে প্রশ্ন করল ছেলেটা। টলবার পাত্র নয় সে!

তাঁকে খবর দাও আমি এসেছি,’ ওয়ারেনের স্বরে দৃঢ়তা প্রকাশ পেল। এক সেকেণ্ড একটু ইতস্তত করে তাকে ভিতরে ঢুকতে দিল ডেমিয়েন। চার্লস ভিতরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে দিল ডেমিয়েন।

‘বাবাকে খবর দিচ্ছি আমি,’ বলে হলঘর পেরিয়ে বসার ঘরে ঢুকল সে। জ্যাকেটের ওপর থেকে বরফ ঝেড়ে ফেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে চেষ্টা করল রিচার্ডকে কি বলবে সে।

.

‘ড. ওয়ারেন আপনার সাথে দেখা করতে চান,’ বাবাকে জানাল ডেমিয়েন।

‘চার্লস?’ বলল থর্ন। একসাথে খুশি আর অবাক দুই-ই হয়েছে সে। চমৎকার! ওকে ভিতরে নিয়ে এসো।’

কিন্তু তাকে ডাকতে হল না, ডেমিয়েনের পিছন পিছনই এসে ঘরে ঢুকল চার্লস। আর অপেক্ষা করতে পারেনি সে।

‘তোমার মাকে ড. ওয়ারেনের জন্যেও স্যাণ্ডউইচ বানাতে বল, ‘ ডেমিয়েনকে নির্দেশ দিল রিচার্ড। বিনা বাক্যব্যয়ে শক্ত হাতে দরজা বন্ধ করে চলে গেল সে। ঘর থেকে বেরিয়ে ডেমিয়েনের চেহারা কঠিন আর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। ওয়ারেন আজ কেন এসেছে, আর কেনই বা ওর দিকে সে অমন চোখে তাকাচ্ছিল, এসব ডেমিয়েনকে কারও বুঝিয়ে দিতে হবে না। কিন্তু আপাতত তার করণীয় কিছু নেই। স্যাণ্ডউইচের কথা বলতে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল সে।

.

গ্লাসে ব্র্যাণ্ডি ঢালছে রিচার্ড। এই সুযোগে কোথা থেকে কেমন ভাবে কথাটা শুরু করবে ভাবছে চার্লস

মার্কের কথা ভুলেই গেছে রিচার্ড। সে এখনও প্রজেকশন ঘরে বসে ছবির রীল পেঁচাচ্ছে। ওখান থেকে ড. ওয়ারেনের ও তার বাবার কি কথা হয় সবই ওর কানে যাবে।

রিচার্ডের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে এক চুমুকেই গ্লাস প্রায় শেষ করে ফেলল। ওর আচরণে খুব অবাক হল রিচার্ড। মদ পেটে পড়তেই সাহস সঞ্চয় করে সরাসরি কথা পাড়ল সে। ‘রিচার্ড, তোমাকে আজ একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব।’

‘আমাকে তুমি বন্ধু বলেই মনে করতে পার-বল কি তোমার প্রশ্ন,’ অভয় দিল রিচার্ড।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে এক নিঃশ্বাসে কথাটা বলে ফেলল সে। ‘লগুনে তোমার ভাই এর ব্যাপারটাতে আসলে কি ঘটেছিল বলতে পার?’

মুহূর্তে রিচার্ডের মুখের ভাব বদলে কঠিন হয়ে গেল। জবাব না দিয়ে সে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?’

‘আজ আকর থেকে আনা একটা ব্যাগের ভিতর আমি বুগেনহাগেনের কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র পেয়েছি। ব্যাগটা তার দেহের পাশেই পাওয়া গেছে।

‘তাই কি হয়েছে?’ রিচার্ডের স্বরে বোঝা গেল সে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। আর এক চুমুকে গ্লাসের বাকি ব্র্যাণ্ডি শেষ করে ফেলল চার্লস। ‘তুমি জানো, বুগেনহাগেনই তোমার ভাইকে ছুরি সরবরাহ করেছিল ডেমিয়েনকে মারার জন্যে?’

শাঁই করে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়াল রিচার্ড। ‘আবোল তাবোল এসব কি বলছ তুমি?’

প্রজেকশন ঘরের ফোকরের কাছে দাঁড়িয়ে কান পেতে ওদের এই অদ্ভুত ৰুথাবার্তা শুনছে মার্ক।

‘সাত বছর আগে বুগেনহাগেন তোমাকে একটা চিঠি লিখেছিল—’ আরম্ভ করল ওয়ারেন।

‘চিঠি? আমাকে?’ বাধা দিয়ে বলে উঠল থর্ন। ‘কোন চিঠিই পাইনি আমি।’

চিঠিটা পোস্ট করেনি সে,’ ওয়ারেন বলল, ‘চিঠিটা ওই ব্যাগের ভিতরেই…’

‘তুমি পড়েছ ওটা?’ অনুযোগ করল রিচার্ড।

‘রিচার্ড, তুমি আমাকে ভাল করেই চেন-তুমি তো জানো আমি একজন যুক্তিসম্পন্ন লোক-কিন্তু এখন আমি যা বলব সেটা তোমার কাছে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক শোনাবে।

‘ভনিতা ছেড়ে কি বলতে চাও বল!’ অস্থির হয়ে উঠেছে রিচার্ড।

‘বুগেনহাগেনের মতে…’ ঢোক গিলল চার্লস। ‘ডেমিয়েন…ডেমিয়েন হচ্ছে…ইবলিসের দূত…শয়তান!’

থর্ন এমন দৃষ্টিতে চার্লসের দিকে চাইল যেন তার চোখের সামনে একটা পাগল দাঁড়িয়ে আছে।

প্রজেকশন ঘরে দম বন্ধ করে রয়েছে মার্ক। ওয়ারেন বলে চলল, ‘ও মানুষ নয়, রিচার্ড। জানি এগুলো পাগলের প্রলাপের মতই শোনা যাচ্ছে—কিন্তু বুগেনহাগেন জানিয়েছে ওর জন্ম হয়েছে একটা শিয়ালের গর্ভে!’

হো হো করে হেসে উঠল থর্ন। ‘এই কথাটা আমাকে জানানোর জন্যে তুমি এসেছ?’ মাথা নেড়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়াল সে।

খালি গ্লাসটা নামিয়ে রেখে থর্নের দিকে এগিয়ে গেল চার্লস। ‘তোমার ভাই একথা জানতে পেরেছিল। বুগেনহাগেনের কাছে সাহায্যের জন্যে গিয়ে সে জেনে এসেছিল ওই অশুভ শয়তানকে কি করে হত্যা করা যাবে।’

সশব্দে নিজের গ্লাসটা টেবিলের ওপর ঠুকে রাখল থর্ন। ‘আমার ভাই অসুস্থ ছিল,’ কঠিন স্বরে বলল সে। মানসিক অসুস্থতা। তার স্ত্রীর মৃত্যু—

‘—ডেমিয়েনই ঘটিয়েছিল!’ বাধা দিয়ে বাক্য শেষ করল চার্লস। পাঁচ পাঁচটা মৃত্যু তার কারণেই ঘটেছে। বাইবেলের রেভিলেশন অধ্যায়ের সাথে মিলে যাচ্ছে। ওয়ারেন বুঝতে পারছে উত্তেজিত হয়ে উঠছে থর্ন। কিন্তু সে যতই রাগ হোক না কেন কথা তাকে শেষ করতেই হবে। ‘বুগেনহাগেন—’

‘লোকটা বদ্ধ উন্মাদ,’ কথার মাঝেই বলে উঠল থর্ন।

বোঝাতে না পারার মানসিক জ্বালায় মাথা নাড়ল চার্লস। ‘জানি, শুনতে রূপকথার মতই শোনায়…’ স্বীকার করল সে।

‘কিন্তু ওটাই আসলে সত্যি বলে বিশ্বাস কর তুমি,’ থর্ন বলল।

বুগেনহাগেনের চিঠিটা পকেট থেকে বের করে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে ফেলল চার্লস। ‘এই যে চিঠিটা—নিজেই পড়ে দেখ,’ বলল সে।

‘না।’

‘কিন্তু বুগেনহাগেনের কথাই যদি সত্যি হয় তবে তুমি, অ্যান, মার্ক—আমরা সবাই বিপদের মুখে আছি। জোন হার্টের কি পরিণতি হয়েছিল মনে নেই?—সে জানতো।

রিচার্ড নিজের ভিত্তিতে অনড়। ‘একটা পাগল বুড়োর বাজে বকবকানি পড়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই।

‘রিচার্ড,’ ওকে বোঝাতে চেষ্টা করল চার্লস। ‘বুগেনহাগেনকে আমি চিনতাম। লোকটা মোটেও পাগল ছিল না। তোমার কি কোন ঘটনায় খটকা লাগেনি? অদ্ভুত কোন—’

‘না!’ চেঁচিয়ে উঠল থর্ন।

ওয়ারেন ভয় পাচ্ছে আর কিছু বলতে গেলে থর্ন হয়ত তাকে মেরেই বসবে, তবু সে বলল, ‘ছেলেটা যা বলেছে বা করেছে তাতে আশ্চর্য হবার মত কিছুই কি তোমার চোখে পড়েনি?’

‘আমার বাসা থেকে চলে যাও, চার্লস…’

আমাদের মাঝে সম্প্রতি কয়েকটা মৃত্যুও ঘটেছে।

‘বেরিয়ে যাও!’ রাগে কাঁপতে কাঁপতে গর্জে উঠল থর্ন।

কিন্তু ওয়ারেন থামল না, বলেই চলল, ‘ইঙ্গিতগুলো খুবই পরিষ্কার, রিচার্ড! এতগুলো ঘটনা দৈবাৎ ঘটেছে বলে অস্বীকার করা যায় না। বাইবেল পড়—রেভিলেশন চ্যাপ্টারে সবই লেখা আছে! এর শেষ তোমাকে দেখতেই হবে!’

‘কোথায়?’ প্রশ্ন করল থর্ন। এই আলোচনা কি করে সহ্য করছে ভেবে নিজেই অবাক হল সে।

‘য়িগেইলের দেয়ালে,’ জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে ওয়ারেন। ‘বুগেনহাগেন তার চিঠিতে লিখেছে ওটা দেখেই সে নিশ্চিত জেনেছে। জাহাজে করে নিউ ইয়র্ক আসছে ওটা—যে-কোনদিন পৌঁছে যাবে।’

‘অতীত ঘেঁটে ঘেঁটে তুমিও সেকেলে হয়ে গেছ। জোন হার্টের মতে তুমিও ধর্মান্ধ হয়ে প্রলাপ বকা আরম্ভ করেছ। এর মধ্যে জড়াতে চাই না আমি—দরকার মনে হলে তুমি ওটা দেখোগে, যাও!’

কয়েক সেকেণ্ড থর্নের চোখে চোখে চেয়ে রইল চার্লস। কাজটা সহজ হবে না জানত–কিন্তু এভাবে শেষ হবে এটাও ভাবেনি। থর্নের সাথে তার বন্ধুত্ব সম্ভবত আর থাকবে না। তবু, এখন আর পিছিয়েও যাওয়া চলে না। তাই যাব,’ শান্ত গলায় বলল সে। তারপর ধীর পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

ধপ্ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল থর্ন। চার্লস যা বলেছে তার সবটুকু হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না—বেশ কিছু সত্যও আছে ওতে। কিন্তু বাকিটা…

মাথা নাড়ল সে। একে একে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সবাইকে হারাচ্ছে রিচার্ড। এর কারণ সে নিজেও জানে না।

প্রজেকশন রূমে থরথর করে কাঁপছে মার্ক। ভয়, দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনায় ওর মুখটা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দিল সে।

*

রান্নাঘরে মাকে স্যাণ্ডউইচ বানাতে সাহায্য করছিল ডেমিয়েন। জোরে সদর দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ ওরা দু’জনেই শুনল। একটু পরেই ওয়ারেনের গাড়ি স্টার্ট নিল, তারপর বাড়ির সামনের রাস্তায় চাকা ঘষার কিচকিচ শব্দ তুলে দ্রুত চলে গেল গাড়িটা।

দু’জনে চোখাচোখি হল। বাড়তি স্যাণ্ডউইচগুলোর দিকে চাইল দু’জনেই।

‘যাক,’ মুখে হাসিখুশি ভাব এনে বলল ডেমিয়েন। ‘বেশিটা না হয় আমিই খেয়ে নেব!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *