অশুভ সংকেতের পর – ১৩

তেরো

ভোর হয়েছে। থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির ছোট্ট জেটটা লা গারডিয়া এয়ারপোর্টে নামল। প্লেনের ভিতরে একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে ঘরি দেখল রিচার্ড। সাতটা পঁয়তাল্লিশ।

হঠাৎ নিজেকে ওর খুব বোকা বলে মনে হচ্ছে। ওর এখন বিশ্বাসই হচ্ছে না যে নিছক একটা ফোনের ওপর ভিত্তি করে সে রাত দুপুরে উঠে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ওয়ারেনের সাথে দেখা করতে নিউ ইয়র্কে চলে এসেছে।

সেই রাতে ওয়ারেনের কথা হেসে উড়িয়ে দিলেও মার্কের মৃত্যুর পরে আজ আর তার কাছে কথাটা খুব অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে না। এর শেষ তাকে দেখতেই হবে।

থর্নের মন বলছে যে ওই য়িগেইলের দেয়ালটা নিজের চোখে দেখেই ওয়ারেন অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে ওটা দেখাবার জন্যেই এমন জরুরি তলব পাঠিয়েছে কিন্তু ওয়ারেন নিজে ফোন না করে একজন প্রীস্টকে দিয়ে কেন ফোন করাল এটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না থর্ন।

এয়ারপোর্ট টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিল থর্ন। গতরাতে প্ৰীষ্ট তাকে যে ঠিকানা দিয়েছে সেখানে পৌঁছে ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে দিল থর্ন। তারপর কি ভেবে ওকে আরও কিছু টাকা দিয়ে অপেক্ষা করতে বলে চার্চের ভিতর ঢুকল।

চার্চের বাইরেটা যেমন পুরানো ভিতরটাও তেমনি। বাতাসে ধুপের গন্ধে থর্ন বুঝল গির্জাটা এখনও ব্যবহারে আছে।

সোজা বেদীর ওপর দিয়ে উঠল থর্ন। রেলিং-এর কাছে পৌঁছতেই বাম দিকের একটা দরজা হঠাৎ খুলে গেল। ছোটখাট কুঁজো একজন প্রীস্ট বেরিয়ে এলেন। ‘মিস্টার থর্ন?’

মাথা ঝাঁকাল রিচার্ড।

খুঁড়িয়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। ‘আমি ফাদার ওয়েস্টন। ড. ওয়ারেন আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’ ইঙ্গিতে তাঁকে অনুসরণ করতে বলে পথ দেখিয়ে এগিয়ে চললেন তিনি।

পিছন পিছন যেতে যেতে রিচার্ড বলল, ‘ফোনে আমাকে খবর দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ড. ওয়ারেনের কি হয়েছে?’

মাথা নাড়লেন প্রীস্ট। ‘আমাকে কিছুই বলেনি, চার্লস। তবে এটা ঠিক যে—কোন কারণে সে রীতিমত আতঙ্কিত।’

একটা ছোট দরজার সামনে থেমে দরজায় টোকা দিলেন ফাদার ওয়েস্টন। ফ্যাসফ্যাসে গলায় ভিতর থেকে প্রশ্ন এল, ‘কে?’ গলাটা মোটেও ওয়ারেনের মত শোনাল না।

‘মিস্টার থর্ন এসেছেন,’ বলল প্ৰীষ্ট।

দরজা খুলে গেল। ওয়ারেন দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ অসুস্থ দেখাচ্ছে ওকে। চোখ দুটোতে রক্ত জমে লাল হয়ে রয়েছে, মুখ বসে গেছে। কয়েকদিন না কামানোয় মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি উঠেছে। দাড়ির নিচে থেকে ফ্যাকাসে হলুদ চামড়া উঁকি দিচ্ছে। হাত কাঁপছে ওর হাতের মুঠোয় রয়েছে একটা ক্রুশ। ‘রিচার্ড?’ ভীত স্বরে প্রশ্ন করল সে।

‘হ্যাঁ, আমি এসেছি, চার্লস।

ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্ষাতির কলার ধরে থর্নকে টেনে ঘরের ভিতরে নিয়ে দরজ বন্ধ করে দিল ওয়ারেন।

কোনমতে টাল সামলে নিল থর্ন। সতর্কভাবে ওয়ারেনের দিকে চাইল—নিশ্চিত পাগলের পাল্লায় পড়েছে সে। ওকে একটু শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলল, ‘চার্লস, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি—’

ওর কথা শুনছে না ওয়ারেন। বড় বড় চোখ করে থর্নের পাশে অদৃশ্য কিছুর দিকে চেয়ে সে ফিসফিস করে বলল, ‘মর্তে এসেছে পশু! হ্যাঁ, সত্যি, সব সত্যি! দেখেছি আমি—’

‘চার্লস, শোন, প্লীজ—’

‘দেয়ালটা দেখেছি-উঃ, ভয়ানক!’ শিউরে উঠে চোখ বুজল সে। ‘জোন হার্ট পাগল হয়ে গিয়েছিল, আর বুগেনহাগেন—’

থর্ন এগিয়ে গিয়ে ওয়ারেনের দুই কাঁধ শক্ত করে ধরে ওকে ঝাঁকাল। ‘এমন করছ কেন!’ ধমক দিল সে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এই লোকটাই সেই প্রত্নতত্ত্ববিদ পণ্ডিত, তার এতদিনের পরিচিত বন্ধু ড. চার্লস ওয়ারেন।

চার্লসের কাঁপুনি থেমে গেল। স্থির দৃষ্টিতে থর্নের দিকে চেয়ে আশা, আর তার প্রশ্নের জবাব খুঁজছে সে। ‘এখন কি তুমি আমাকে বিশ্বাস কর?’ প্রশ্ন করল সে। ‘নাকি এখনও তোমার ধারণা যে আমি পাগল?’

ওকে শক্ত করে ধরে থাকল থর্ন। ওকে বিশ্বাস করে, কথাটা এখনই স্বীকার করতে চায় না। অন্তত একজনকে শান্ত আর স্থির থাকতে হবে। নিজের চোখে দেয়ালটা ওকে দেখতেই হবে।

‘ওটা কোথায়?’ প্রশ্ন করল থর্ন। ‘সেই য়িগেইলের দেয়াল?’

.

সারিসারি রেল-লাইনের ধার দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। ওয়ারেনই পথ দেখিয়ে আগে আগে চলেছে সারবন্দী মালগাড়ির বগিগুলোর পাশ দিয়ে। ওর হাতে এখনও ক্রুশটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরা রয়েছে। অত্যন্ত উত্তেজিত মনে হচ্ছে ওকে। মাঝেমাঝেই থেমে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে কি যেন দেখছে সে।

‘কি দেখছ তুমি?’ প্রশ্ন করল থর্ন।

উত্তেজনার চরমে পৌঁছেছে ওয়ারেন। কথা বলতে পারছে না ঠিক মতো। বিড়বিড় করে যা বলছে তার একটা দুটো শব্দ বুঝতে পারছে রিচার্ড … ‘প্রায়…কিছু না…একটু…’

থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির ছাপ মারা অনেকগুলো ওয়্যাগন দেখা যাচ্ছে। দূরে এক জায়গায় মাত্র একটাই ছাপ মারা বগি লাইনের শেষ মাথায় বাফারের কাছে আলাদা করে শান্ট করে রাখা রয়েছে। ওটার সামনেই এসে থামল ওয়ারেন। কাঁপা হাতে তালা খুলে থর্নকে ইশারায় ভিতরে ঢুকতে বলল সে।

ঘুরে তাকিয়ে থর্ন প্রশ্ন করল, ‘তুমি আসবে না সাথে?’

মাথা নেড়ে আকাশের দিকে চাইল চার্লস। হঠাৎ ভয়ে জমে পাথর হয়ে গেল সে।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে মাথার বিশফুট উপরে একটা দাঁড়কাককে ধীর গতিতে চক্কর কাটতে দেখল রিচার্ড। ওয়ারেনের দিকে চেয়ে দেখল ভয়ে কুঁকড়ে বগির ধার ঘেঁষে ক্রুশটা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছে সে। ওর এত ভয়ের কারণ বুঝতে না পেরে রিচার্ড ডাকল, ‘এসো, চার্লস—ওটা একটা পাখি।’

মাথা নাড়ল ওয়ারেন। ওটার ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না সে–নড়ছেও না।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে একাই বগির ভিতরে ঢুকল রিচার্ড।

বিভিন্ন আকারের ছোট বড় বাক্সে বগিটা ভরা। একটা বাক্স ছাড়া আর সব ক’টাই পরিপাটি করে প্যাক করা রয়েছে। আধখোলা বাক্সটার দিকেই তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল থর্ন।

ওদের থেকে খানিকটা দূরে লম্বা একসারি বগি ঠিক ওই সময়ে পিছন দিকে লতে শুরু করল। শান্টিং করা হচ্ছে। সশব্দে পরস্পর বাড়ি খেতে খেতে থর্ন যে বগিতে রয়েছে সেদিকেই এগোচ্ছে ওগুলো

বগির বাইরে চোখ বুজে প্রার্থনা করছে ওয়ারেন। হুইসেল বাজিয়ে পাশের মেইন লাইন ধরে একটা ট্রেন ঝড়ের বেগে মাটি কাঁপিয়ে বেরিয়ে গেল। বাতাসের প্রচণ্ড ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গেল ওয়ারেন। উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে বগির সামনের বাফারের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পরবর্তী বিপর্যয়ের জন্যে নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছে সে।

ভিতরে থর্ন বাক্সের অনেকটা অংশ খুলে ফেলেছে। প্যাকিং-এর খড় সরিয়ে শেষ পর্যন্ত দেয়ালের একটা অংশ ওর নজরে এল। শক্ত পাথরের মত জিনিসের ওপর আঁকা হয়েছে। খুবই পুরানো দেখাচ্ছে, জায়গায় জায়গায় রং ক্ষয়ে উঠে গেছে। একখানে একটা ছোট ছেলের ছবি দেখতে পেল থর্ন। কিন্তু চেহারাটা প্রায় মুছে গেছে, স্পষ্ট বোঝা যায় না। আরও খড় সরাল সে।

বাইরে চলন্ত বগির সারির বেগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। মরিচা ধরা বাম্পার থেকে কর্কশ আওয়াজ উঠছে। একটা জংশনের কাছে এসে হঠাৎ যেন কয়েকটা বগি আপনা আপনি এই লাইনে ঢুকে পড়ল।

আবার চোখ বুজে প্রার্থনা করতে শুরু করেছে ওয়ারেন। দাঁড়কাকটা এখনও মাথার ওপর চক্কর কাটছে। ওর চক্করের গতি অনেক বেড়েছে এখন।

বগির ভিতরে আর একটা জায়গা অনাবৃত করে শয়তানের যৌবন কালের ছবি দেখতে পেল থর্ন। একটা খাঁজের পাশ থেকে ঝুলছে সে। কিন্তু এতেও চেহারাটা কিছুই চেনা যাচ্ছে না।

আমি কি পাগল হয়ে গেলাম? ভাবল থর্ন। এখানে প্রমাণ কিছুই পাওয়া গেল না এখনও। কিন্তু শেষ দেখতেই হবে আমাকে। বাকি অংশটুকু থেকেও খড় সরিয়ে ফেলল সে।

আর একটা মুখ দেখতে পেল থর্ন। পরিষ্কার একটা মুখ—মনে হচ্ছে যেন মাত্র কয়েক বছর আগেই আঁকা হয়েছে ওটা। থর্ন-এর কাছে চেহারাটা খুবই পরিচিত।

ডেমিয়েন থর্ন-এর মুখ ওটা।

একটু আধটু অমিল অবশ্য আছে—যেমন চুলের বদলে ওখানে রয়েছে লিকলিকে জিভ বের করা অনেক সাপ—মানুষের চোখের বদলে রয়েছে হলুদ বিড়ালের মত চোখ। কিন্তু ওটা যে ডেমিয়েনেরই চেহারা এতে কোনই সন্দেহ নেই।

বগিগুলো থর্নের বগিটার দিকে সবেগে এগিয়ে আসছে। চোখ বুজে প্রার্থনায় ডুবে আছে ওয়ারেন। হঠাৎ চোখ খুলেই আতঙ্কে ছোখ ছানাবড়া হয়ে গেল ওর। প্রথম বগির মরচে ধরা অংশটা ওর দিকে ছুটে আসছে, সরে যাবার সময় আর নেই। সভয়ে চিৎকার করে উঠল চার্লস। আংটাটা ওকে থর্নের বগির সাথে গেঁথে ফেলল। পিন দিয়ে দেয়ালে আটকানো প্রজাপতির মত হাত পা ঝাপটাচ্ছে ওয়ারেন।

ধাক্কার চোটে মেঝেতে পড়ে গেল থর্ন। ওর পিছনে দেয়ালটা কাত হয়ে ওর ওপর পড়তে যাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে গড়িয়ে সরে গেল সে। একটু আগে ও যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে দেয়ালটা সহস্ৰচূর্ণ হয়ে ভেঙে গেল।

যে প্রমাণ উদ্ঘাটন করতে এতদূর এল সেটা সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে এখন।

কিন্তু থর্নের এখন লাভ-লোকসান হিসেব করার সময় নেই। লাফিয়ে নিচে নেমে সহকর্মী বন্ধু ওয়ারেনকে হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করল সে।

আশ্চর্যের বিষয় তখনও বেঁচে আছে চার্লস। তার মুখের একপাশ বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে আরম্ভ করেছে। আংটা দুটো ওর বুকের ভিতর ঢুকে গেছে।

‘হায়, ঈশ্বর! চার্লস!’ উদভ্রান্তের মত মরণাপন্ন বন্ধুকে সাহায্য করতে ছুটে গেল থর্ন।

দুর্বলভাবে একটা হাত থর্নের দিকে সামান্য একটু বাড়াল চার্লস। ওর হাতে তখনও ক্রুশটা ধরা রয়েছে। ‘এটা নাও,’ ক্ষীণস্বরে বলল সে। ‘আর… ছুরিগুলো।’ হাঁ করে একটু শ্বাস নিল ওয়ারেন। ‘ছেলেটা…ওকে…শেষ…’

‘ছুরি?’ জিজ্ঞেস করল থর্ন। ‘কোথায়?’

‘যাও,’ গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না ওর। ‘সময় থাকতে যাও,’ অনেক কষ্টে কথাটা শেষ করল চার্লস

উপর দিকে চাইল থর্ন। দাঁড়কাকটা বগির মাথায় এসে বসেছে। ‘কিন্তু ছুরিগুলো কোথায়?’ চেঁচিয়ে প্রশ্ন করল থর্ন।

কিন্তু এখন আর ওয়ারেন ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না। ওর চোখ দুটো উল্টে গেছে—ক্রুশটা ওর হাত থেকে খসে পড়েছে।

ধীরে ওর থেকে পিছনে সরে এল থর্ন। একটা কর্কশ আওয়াজ তুলে ওয়্যাগনের মাথা ছেড়ে দাঁড়কাকটা আকাশে উড়ল। মুহূর্তে একপাক ঘুরে সোজা থর্নের দিকে ছুটে এল ওটা।

এক লাফে ক্রুশটা তুলে নিল থর্ন। দাঁড়কাকটা ওকে আক্রমণ করার ঠিক আগের মুহূর্তে ক্রুশটাকে মাথার ওপর তুলে ধরল। বিকট চিৎকার তুলে পাখিটা উড়ে দূরে সরে গেল।

ক্রুশটা মাথার ওপর তুলে রেখেই ছুটতে শুরু করল থর্ন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *