ছয়
অ্যাকাডেমিতে সামরিক ইতিহাসের ক্লাস হচ্ছে। শুকনো চেহারার বুডম্যান ক্লাস নিচ্ছে। সব শিক্ষকেরই এক একটা বিষয়ের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা থাকে। বুডম্যানের দুর্বলতা-অ্যাটিলা। তার ধারণা ইতিহাসের পাতা ভেদ করে যেন অ্যাটিলার অন্তরটা সে দেখতে পায়। তার মনে হয় অ্যাটিলার সাথে তার অনেক মিল—তাকেও লোকে ওর মতই ভুল বোঝে।
‘বেচারী অ্যাটিলাকে ইতিহাসে অত্যন্ত ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে,’ বুডম্যান বলে চলেছে। ‘কিন্তু আমাদের ভুললে চলবে না যে নিজের লোকজনের কাছে অ্যাটিলার সুশাসক বলে সুনাম ছিল…’
একমাত্র ডেমিয়েনই মনোযোগ দিয়ে লেকচার শুনেছে। আশ্চর্য ব্যাপার—ইতিহাসে কোনকালে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। কিন্তু গত কয়েক মাস যাবত অতীতে যারা পৃথিবীতে দিন কাটিয়ে মারা গেছে তাদের সম্পর্কে বিশদ ভাবে জানার একটা অদম্য কৌতূহল জন্মেছে তার।
তার আগে এবং পরে অনেক বিজেতাই জয়ের নেশায় ধ্বংসলীলায় মেতেছে, কিন্তু অযথা ধ্বংস অ্যাটিলার নীতি ছিল না….
টেডির সাথে দুষ্টুমিতে ব্যস্ত মার্ক। টেডি আজকাল থর্নদের পাশে বসা আরম্ভ করেছে। একটা কাগজের ওপর কি সব যেন আঁকছে মার্ক, আর তাই দেখে হাসি চাপার প্রাণপণ চেষ্টা করছে টেডি
‘আসলে,’ বলল বুডম্যান। ‘শিক্ষার প্রতি অ্যাটিলার উৎসাহের কারণেই অনেক রোমান পণ্ডিত তার রাজসভায় জায়গা পেয়েছিল…’
এই সময়ে কাগজটা ডেমিয়েনকে দেখাল মার্ক। আচমকা এমন মজার জিনিস দেখে শব্দ করে হেসে উঠল সে।
লেকচার বন্ধ করে বুডম্যান প্রশ্ন করল, ‘কে হাসে?’
তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ডেমিয়েন বলল, ‘আমি, স্যার।’
‘এদিকে এস,’ ডাকল টীচার। ‘আর ওই কাগজটাও আনো।’
বাধ্য ছেলের মত কাগজটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল ডেমিয়েন।
কুণ্ঠিতভাবে নিজের জায়গায় বসে রইল মার্ক। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ওর।
অন্য ছেলেরা সবাই আশঙ্কা নিয়ে কি হয় দেখার অপেক্ষায় রয়েছে।
কাগজটা ডেমিয়েনের হাত থেকে নিল বুডম্যান। তারই ছবি আঁকা হয়েছে। ঘোড়ার পিঠে মঙ্গোল শত্রুর ছিন্ন মাথা হাতে বসে আছে সে।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল ওর। শুধু তাকেই না, অ্যাটিলাকে অপমান করা হয়েছে।
কাগজটা মুড়িয়ে টেবিলের তলায় ফেলে দিয়ে সে বলল, ‘হুঁ!’ একটু চুপ করে থেকে ছেলেদের ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়ে আবার বলল, ‘দেখা যাচ্ছে ক্লাসে একজন শিল্পী আছে! কি ব্যাপার, থর্ন, ক্লাসে আমি কি বলি শুনতে মন চায় না তোমার?’ ওকে জবাব দেয়ার কোন সুযোগ না দিয়েই ব্যঙ্গ করে বলে চলল, ‘হ্যাঁ, তুমি তো অ্যাটিলার সম্বন্ধে সবই অবগত আছ, কি বল?’
গভীর একটা শ্বাস টেনে ডেমিয়েন জবাব দিল, ‘মোটামুটি জানি, স্যার। ডেমিয়েন নিজেও তার জবাবে ঘরের অন্য সবার মতই অবাক হয়েছে।
‘মোটামুটি জানো, না?’ ঠাট্টার সুরে কথাটার পুনরাবৃত্তি করল বুডম্যান। খুব বাহাদুর হয়ে গেছ—অ্যাটিলার নাম ছাড়া আর কিছু কি জানা আছে তোমার? তার আর রোমানদের কথা কিছু বলতে পারবে?’
আর একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ডেমিয়েন জবাব দিল, ‘মনে হয় পারব, স্যার। কিছুই জানে না সে! ভূতে পেয়েছে নাকি ওকে?
ক্লাসের ছেলেরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে আলাপ শুরু করল। আজ ডেমিয়েনের কপালে দুঃখ আছে। এভাবে টীচারের মুখে মুখে তর্ক করা ওর স্বভাব নয়।
‘পারবে?’ বুডম্যানের স্বরে অবিশ্বাসের সুর। ‘ঠিক আছে, দেখাই যাক। বলতে পার গাউল আক্রমণ করার সময়ে অ্যাটিলার সাথে কত সৈন্য ছিল?’
‘পাঁচ লক্ষ, স্যার,’ উত্তরটা কিভাবে সে জানল বুঝে ওঠার আগেই জবাব দিল ডেমিয়েন। ‘কিন্তু ইটিয়াসের কাছে ৪৫১ সালে শ্যালনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফেরার পথে ইটালী আক্রমণ করে, কিন্তু রোম পর্যন্ত সে যায়নি।’
একেবারে হাঁ হয়ে গেল বুডম্যান। এটা সে মোটেও আশা করেনি। কিন্তু এখন আর ফেরার উপায় নেই—এর শেষ তাকে দেখতেই হবে! পুরো ক্লাসের সামনে অপদস্থ হওয়া চলবে না।
যাহোক, অনেক ছেলেরই ইনসাইক্লোপীডিয়া ঘেঁটে সেখান থেকে কিছু কিছু অংশ মুখস্থ করে রাখার অভ্যাস আছে। থর্নও মুখস্থ বিদ্যার জোরেই হয়ত উত্তরটা দিতে পেরেছে, ভাবল বুডম্যান।
এবারে বিষয়ের আরও গভীরে ঢুকল বুডম্যান। ‘রোমে কেন যায়নি?’ প্রশ্ন করল সে।
একটু দেরি না করে ডেমিয়েন বলল, ‘পোপ প্রথম লিওর কূটনৈতিক দক্ষতাকেই সাধারণত এর কারণ বলে ধরা হয়। কিন্তু এর প্রধান সত্যিকার কারণ ছিল রসদের অভাব।’ এই পর্যন্ত বলে ডেমিয়েনকে ইতস্তত করতে দেখে বুডম্যান বুঝল ছেলেটা এবার ঠেকে গেছে। মানস চোখে ডেমিয়েন যৌন রোগের কদাকার চেহারা দেখতে পাচ্ছে। শালীনতা বজায় রেখে কথাটা কিভাবে বলা যায় মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছে সে। তাছাড়া সৈন্যদলের মধ্যে এই সময়ে একটা…একটা বিচ্ছিরি সংক্রামক রোগ দেখা দিয়েছিল।
ক্লাসের ছেলেদের কেউ কেউ কথাটার গূঢ় অর্থ বুঝতে পেরে হেসে উঠল
‘চুপ কর।’ ধমক দিল বুডম্যান। রেগে আগুন হয়ে গেছে সে। ডেমিয়েনের দিকে ফিরে এবার কঠিন তথ্য জিজ্ঞেস করে ওকে কুপোকাত করার সিদ্ধান্ত নিল মাস্টার।
‘অ্যাটিলার জন্ম কবে হয়েছিল?’
‘সঠিক জানা যায়নি, স্যার,’ বলল ডেমিয়েন।
‘কতদিন রাজত্ব করেছে?’
৪৪৫ সাল থেকে ৪৫৩ সাল পর্যন্ত। একটা আনন্দ উৎসবে নাক দিয়ে রক্ত উঠে মারা যায় অ্যাটিলা। ওটাই ছিল তার শেষ বিয়ে।’
এবার ক্লাস সুদ্ধ সবাই হেসে উঠল
‘চুপ! গর্জে উঠল বুডম্যান। তার আত্মবিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছে পুঁচকে ছেলেটা। ডেমিয়েনের আরও কাছে এগিয়ে এসে ওর চোখের দিকে চেয়ে সে প্রশ্ন করল, ‘অ্যাটিলার ডাই-এর নাম কি ছিল?’
‘ব্লেডা,’ জবাব দিল ও। কিন্তু এইটুকু বলেই থামল মা ডেমিয়েন। হঠাৎ জ্ঞানের আলোয় দীপ্ত হয়ে উঠেছে সে। তার অন্তর্নিহিত শক্তির প্রভাব কামরার ভিতর টের পাওয়া যাচ্ছে। চোখ দুটো থেকে আলো বেরুচ্ছে। সব উত্তরই ওর জানা আছে, কিন্তু কিভাবে সে জানল তা সে নিজেও বলতে পারবে না। শুধুমাত্র যে ঘটনাগুলো তার জানা, তা নয়। অ্যাটিলার মনের ভিতরটাও সে দেখতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন সে পূর্বজন্মের অ্যাটিলাকে চিনত
কিংবা-হয়ত সে নিজেই অ্যাটিলা ছিল।
‘৪৩৪ সালে অ্যাটিলা আর তার ভাই ব্লেডা, উত্তরাধিকার সূত্রে সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়,’ বলে চলল ডেমিয়েন। ‘আল্পস্ আর বলটিক সাগর থেকে ক্যাসপিয়ান সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সেই সামাজ্য। দুই ভাই-এর মধ্যে সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য।’ মার্কের দিকে চেয়ে কথাগুলো বলল ডেমিয়েন। ওর চাহনি শক্তিতে নিজের অজান্তেই শিউরে উঠল মার্ক। ‘৪৩৫ থেকে ৪৩৯ পর্যন্ত অ্যাটিলা তার সাম্রাজ্যের উত্তর আর পূর্ব দিকের বর্বরদের দমন করতে ব্যস্ত ছিল বলে মনে করা হয়—তবে এর সঠিক কোন বৃত্তান্ত পাওয়া যায়নি।’ এই পর্যন্ত বলে স্যারের দিকে চেয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আরও বলব?’
ডেমিয়েনকে আর ঠেকানো যাবে না। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে বুডম্যান। ঘোরের মধ্যে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল সে।
বলে চলল ডেমিয়েন। ‘৪৪১ সালে রোমানরা অ্যাটিলাকে তার প্রাপ্য দক্ষিণা দিতে গড়িমসি করায় সে ডানুবিয়ান সীমান্তে হামলা চালায়। অসাধারণ যোদ্ধা ছিল অ্যাটিলা। কোনক্রমেই ওর সাথে পেরে না উঠে শেষে এক বছর পরে রোমানরা সন্ধি করে।
মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে ক্লাসের সবাই।
এবার ডেমিয়েন যে তথ্য পরিবেশন করল তা বুডম্যানেরও জানা ছিল না। শৈশবে অ্যাটিলাকে প্রতিদিন একঘন্টা করে সূর্যের দিকে তুলে ধরা হত। তার মায়ের বিশ্বাস ছিল এতে তার দেহে সূর্যের তেজ প্রবেশ করে তাকেও সূর্যের মত তেজস্বী করে তুলবে। এই সময়ে তার বয়স ছিল তিন বছর।’
বোকার মত হাঁ করে চেয়ে ওর কথা শুনছে বুডম্যান।
থামল না ডেমিয়েন। বলেই চলল, ‘ভাই-এর সাথে চেহারায় অ্যাটিলার খুব কমই মিল ছিল। তাদের চামড়ার রঙও ছিল ভিন্ন। তবে জানা গেছে তার মা প্রকাশ্যেই বিভিন্ন পুরুষের সাথে মেলামেশা করত।
‘আমারই বয়সে, জীবনে যখন সে প্রথম যুদ্ধে নামে, তার একটা ছবিতে দেখা যায় সে তিনজন প্রতিপক্ষকে একই সাথে বিদ্ধ করেছে। ওটা সম্ভবত একটু অতিরঞ্জন। কিন্তু সে ওই বয়সেই অত্যন্ত সুদর্শন পুরুষ ছিল। সব রমণীই তার সঙ্গ কামনা করত। অল্প কিছুদিন পর থেকেই সে তান্ত্রিক উপাসনায় যোগ দেয়া শুরু করে।’
আর সহ্য করতে পারল না বুডম্যান। চিৎকার করে উঠল সে, ‘চূড়ান্ত অবমাননা! কোথায় পেয়েছ তুমি এসব কথা? বই-এর নাম বল!
এই প্রথম আমতা আমতা করল ডেমিয়েন। ‘আমি… আমি ঠিক জানি না, স্যার।’ মনে হল অথৈ পানিতে পড়েছে ও। নিজের ওপর আর ততটা আস্থা নেই ওর।
সুযোগটা হারাল না বুডম্যান। চট করে সে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আর তার ভাই? সেও কি তার সাথে প্রেতের উপাসনায় যেত?’
‘না, স্যার,’ মাথা নেড়ে বলল ডেমিয়েন। ‘তা কি করে হবে? তার আগেই তো ওকে অ্যাটিলা মেরে ফেলেছিল।’
চমকে উঠল মার্ক।
উপায় ছিল না তার। নিজের মনমত রাজ্য শাসন করে শান্তি আনার জন্যেই এটা করতে হয়েছিল তাকে।’ তারপর গলার স্বর নামিয়ে গোপন কিছু জানাচ্ছে এমনভাবে সে বলল, ‘এরপর থেকেই সে নিজেকে শক্তিমান ইবলিস বলে ভাবতে শুরু করেছিল।’
পুরো ক্লাস নিশ্চুপ।
হঠাৎ দড়াম করে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল নেফ। সোজা বুডম্যানের কাছে এগিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে তাকে কি যেন বলল সে। ঘামে নেয়ে উঠেছে বুডম্যান—প্রায় বিধ্বস্ত অবস্থা তার মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সে।
‘আমার সাথে এসো, থর্ন,’ বলল নেফ।
বিনা বাক্যব্যয়ে আদেশ পালন করে নেফের সাথে বেরিয়ে গেল ডেমিয়েন।
.
করিডোর ধরে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসে থামল নেফ। বুডম্যান ওদের পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি বাথরূমে গিয়ে ঢুকল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ওর-কল থেকে পানি না খেলে আর চলছে না। বাথরূমের স্প্রিং লাগানো দরজা বন্ধ হতেই রাগের সুরে প্রশ্ন করল নেফ, ‘ওখানে কি প্রমাণ করার চেষ্টা করছিলে তুমি?’
ঘোরের ভাবটা ডেমিয়েনের এখনও কাটেনি। সে বলল, ‘আমি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম, সার্জেন্ট।‘
মাথা নাড়াল নেফ। ‘তুমি বাহাদুরি দেখাচ্ছিলে, ডেমিয়েন,’ বলল সে। এই প্রথম ওকে নাম ধরে ডাকল নেফ।
ক্লাসের ভিতর কি ঘটেছে এটা নেফ কি করে জানল তা ভেবে দেখার সময় পেল না ডেমিয়েন। আশ্চর্য ঘটনাটা নিয়েই অভিভূত হয়ে আছে সে। ‘সব উত্তরই যে আমার জানা ছিল! ‘
ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করল ও। ‘কেমন করে জানি না—কিন্তু সবই জানতাম আমি।’
কঠিন স্বরে নেফ বলল, ‘সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা তুমি মোটেও কর না।’
‘কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা আমি মোটেও করিনি। আমি…’
বাধা দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল নেফ। ‘একদিন সবাই জানবে তুমি কে। কিন্তু সবাইকে সে কথা জানানোর সময় এখনও আসেনি।’
ঠিক এই কথাই বুহের বলেছিল।
বিভ্রান্ত ভাবে প্রশ্ন করল ডেমিয়েন, ‘আমি কে?’ মনে মনে ভয় পেয়েছে ও। কি ঘটছে কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছে না।
‘বাইবেল পড়,’ বলল সে। ‘নিউ টেস্টামেন্টের রেভিলেশন অধ্যায়। ওখানে সবই লেখা আছে। তোমার জন্যে ওটা ব্যাখ্যা বই…তোমার সম্বন্ধেও ওতে লেখা আছে। পড়ে বুঝতে হবে তোমাকে।’
চোখে চোখে চাইল ডেমিয়েন। ‘কি? কি বুঝতে হবে আমার?’
অনেকক্ষণ ওর দিকে চুপ করে চেয়ে থাকল নেফ। তারপর সম্ভ্রমের সাথে নিচু স্বরে বলল, ‘তুমি কে।’ কথা শেষ করে চলে যাবার আগে মাথাটা একটু সামনে ঝুঁকিয়ে ওকে কুর্নিশ করল কি, নেফ?