অশুভ সংকেতের পর – ২

দুই

পরদিন সকাল। ডেভিডসন মিলিটারি অ্যাকাডেমির সব ছাত্র মাঠে সমবেত হচ্ছে। ব্যাণ্ডের সাথে কুচকাওয়াজ হবে। বেশিরভাগ ছাত্রের চোখেই এখনও ঘুমের রেশ লেগে আছে।

ছুটির শেষে ছাত্রদের আমন্ত্রণ জানাতে প্রধান স্কুল ভবনের চওড়া সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়েছে কর্নেল। তার পাশেই শক্ত সুশ্রী চেহারার একজন যুবক। পরিপাটি করে ইস্তিরি করা মোটা ইউনিফর্মের নিচেও যুবকের সুগঠিত পেশী ঢেউ খেলে উঠতে দেখা যাচ্ছে। মোটা থলথলে দেহের কর্নেলকে ওর পাশে বেমানান ঠেকছে।

ছাত্রদের উদ্দেশ্যে চিরাচরিত ছক বাঁধা বক্তৃতা আরম্ভ করল কর্নেল। মাঠে দাঁড়িয়ে মার্ক ঠোঁটের পাশ দিয়ে চুপিচুপি বলল, ‘কর্নেলের পাশের লোকটাই মনে হয় আমাদের নতুন প্ল্যাটুন লীডার।

‘দেখে তো ভালই মনে হচ্ছে,’ নিচু স্বরে জবাব দিল ডেমিয়েন।  

‘হ্যাঁ, ঠিক গরিলার মত!

বক্তৃতা শেষে কর্নেল ব্র্যাডালি প্ল্যাটুন ছাড়া বাকি সবাইকে মার্চ করে ক্যানটিনে যাবার নির্দেশ দিল। মার্ক আর ডেমিয়েনের সাথে চব্বিশজন ক্যাডেট বাদে আর সবাই মাঠ ছেড়ে চলে গেল।

‘আরামে দাঁড়াও,’ আদেশ দিল কর্নেল। ছেলেরা সবাই একসাথে পা ফাঁক করে একটু বাঁয়ে হেলে দাঁড়াল। ‘তোমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই,’ আবার আরম্ভ করল সে। ‘সার্জেন্ট গুডরিচের জায়গায় সার্জেন্ট ড্যানিয়েল নেফ তোমাদের প্ল্যাটুন লীডার হিসাবে দায়িত্ব নিচ্ছে।’

সার্জেন্ট গুডরিচের নাম এতক্ষণ কেউ উচ্চারণ করেনি। তার মৃত্যু সম্পর্কে স্কুলের ছেলেদের সামনে আলোচনা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে আত্মহত্যা অত্যন্ত অগৌরবের আর কাপুরুষোচিত বলে গণ্য হয়। তার কথা ভবিষ্যতে আর ভুলেও উল্লেখ করা হবে না।

‘সার্জেন্ট নেফ একজন অভিজ্ঞ অফিসার,’ বলে চলল কর্নেল। আমার বিশ্বাস তার যোগ্য শিক্ষকতায় তোমরাই এই অ্যাকাডেমির শ্রেষ্ঠ প্ল্যাটুন বলে চিহ্নিত হবে। ছাত্রদের দিকে চেয়ে একটা বন্ধুসুলভ আন্তরিক হাসি দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে নেফের দিকে ফিরল কর্নেল। ‘তোমার হাতেই ওদের ভার ছেড়ে দিলাম, সার্জেন্ট।’

কেতাদুরস্ত একটা স্যালিউট ঠুকল নেফ। কর্নেলের ঢিলে-ঢালা দেহ নিয়ে মিলিটারি কায়দায় চলার করুণ প্রয়াস দেখে হাসি চাপল সে।

পিছনের সারিতে দাঁড়িয়েছে টেডি। একটু বেয়াড়া রকমের বাড় ওর। অন্যান্য ছেলেদের চেয়ে প্রায় আধ হাত উঁচুতে ওর মাথা। টাইট শার্টের ভিতর থেকে ওর লম্বা গলা আর কব্জি দুটো বিচ্ছিরি রকম বেরিয়ে রয়েছে। নিজের কুশ্রী চেহারার ঘাটতি সে পূরণ করে সহপাঠীদের ওপর দৈহিক জোর খাটিয়ে। কাঁধের ওপর ওর ঠাট্টার ছলে মারা ঘুসি অনেকেই খেয়েছে-প্রায় বিশ মিনিট পর্যন্ত হাত একেবারে অবশ হয়ে থাকে।

‘নতুন প্ল্যাটুন লীডারকে শুরুতেই একটু বাজিয়ে দেখলে মন্দ হয় না,’ ভাবল টেডি। নেফের বুকের ওপর ঝোলানো পদকগুলোর দিকে চেয়ে সে হাসি মুখে বলে উঠল, ‘সার্জেন্ট, তোমার মেডেলগুলো কিসের

‘চুপ কর!’ ধমকে উঠল নেফ। ‘এখানে কথা যা বলার আমি বলব। তোমাদের কিছু জিজ্ঞেস করা হলে তার জবাব দেবে।’ একে একে সবার দিকে চাইল সার্জেন্ট। ‘কি, পরিষ্কার হয়েছে আমার কথা?’ ছেলেদের নীরব থাকতে দেখে মনে মনে সন্তুষ্ট হয়ে সে আবার বলল, ‘পেশাগত জীবনে এটাই আমার প্রথম কাজ। দায়িত্ব যখন নিয়েছি তোমাদের ঘষেমেজে এমন ভাবে গড়ে তুলব যেন প্যারেড মাঠে তোমাদের কৃতিত্ব দেখে সবার তাক লেগে যায়।

প্রথম দিনেই প্ল্যাটুন লীডারের ধমক আর দাপটে মিইয়ে গেছে ছেলেরা। শুকনো একটা ঢোক গিলল টেডি। যেভাবেই হোক তাকে সবার সামনে এভাবে অপদস্থ করার শোধ সে তুলবে।

‘আপাতত তোমাদের নামগুলো জেনে নিই, নাস্তার পরে প্রত্যেকের সাথে আলাদা ভাবে আলাপ হবে আমার অফিসে। তোমার নাম?’

‘মার্ক থর্ন,’ দুর্বল স্বরে জবাব দিল মার্ক।

‘মার্ক থর্ন কি?’ ধমকে উঠল নেফ।

‘মার্ক থর্ন, সার্জেন্ট,’ তাড়াতাড়ি জবাব দিল সে।

‘থর্ন না? ভাল,’ হাসিমুখে বলল নেফ। ‘তোমাদের পরিবারের যথেষ্ট প্রভাব আছে এই অ্যাকাডেমিতে তাই না?’

ক্ষমতা আর প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হলেও ছেলেবেলা থেকেই সে শিক্ষা পেয়েছে নিজেকে জাহির করাটা রূঢ়। তাই চুপ করে রইল সে। কিন্তু নেফ তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার খোঁচাল, ‘কি, তাই না?’

‘আমার বাবা আর চাচা দু’জনেই এখানকার ক্যাডেট ছিলেন,’ দুইকূল রক্ষা করে জবাব দিল মার্ক।

‘ভাল কথা,’ বলল নেফ। ছেলেটির উপস্থিত বুদ্ধি দেখে অবাক হয়েছে সে। ‘কিন্তু মনে রেখ, বাড়তি কোন সুবিধা সেজন্যে তোমাকে দেয়া হবে না। সব ক্যাডেটই এখানে সমান।

জলদি ছাড়া পাবার আশায় তাড়াতাড়ি মাথা ঝাঁকাল মার্ক।

সুযোগের অপেক্ষায় ছিল টেডি। টিটকারী দিয়ে সে নিচু স্বরে বলে উঠল, ‘এসব লেকচার আমরা আগেও অনেক শুনেছি।’ ওর আশেপাশের ছেলেরা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল।

ঝট করে গোড়ালির ওপর ঘুরে সরাসরি টেডির দিকে চাইল নেফ। কিন্তু আমার কাছ থেকে আগে শোননি!’ আঙুল উঁচিয়ে শাসানোর ভঙ্গিতে বলল সে।

নতুন প্ল্যাটুন লীডারের কাছ থেকে সহজে পার পাওয়া যাবে না। আবার অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে নিল টেডি।

নাম জিজ্ঞেস করার পালা শুরু হল নতুন করে। মার্কের পাশেরজনকে প্রশ্ন করল নেফ, ‘নাম?’

‘ডেমিয়েন থর্ন…সার্জেন্ট।’

চট করে আবার মার্কের দিকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়ে সে বলল, ‘কই, তোমাদের চেহারা তো একরকম নয়?’

সাহস করে মুক্তা ঝরানো একটা সুন্দর হাসি দিয়ে ডেমিয়েন জবাব দিল, আমরা পরস্পরের চাচাত ভাই, সার্জেন্ট।’

নেফের চোখে কিসের যেন একটা আভাস দেখা দিয়েই আবার মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। ‘ঠিক আছে,’ বলল সে। ‘কিন্তু তোমাকেও বলে রাখছি, বিশেষ কোন খাতির তুমিও পাবে না!’

মাথা ঝাঁকাল ডেমিয়েন। অন্য ছেলেদের নাম জেনে নিতে এগিয়ে গেল নেফ। লোকটার ভিতর অদ্ভুত কি যেন একটা শক্তি রয়েছে বলে ডেমিয়েনের মনে হচ্ছে। ভিতরে ভিতরে কেমন একটা অকারণ পুলক বোধ করছে সে।

.

মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে মাত্র ষাট মাইল দূরে শিকাগো শহরের মাঝখানে থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির হেড অফিসের করিডোর ধরে পাশাপাশি হাঁটছে রিচার্ড থর্ন আর বিল অ্যাদারটন। আশেপাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। স্বাভাবিক—নেহাৎ কাজ পাগলা লোক না হলে এত সকালে কারও অফিসে আসার কথা নয়।

বিল অ্যাদারটন থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট। চৌষট্টি বছর বয়স-সাদাসিধে চেহারা। কলেজ থেকে ডিগ্রি পাওয়ার সাথে সাথেই থর্ন ইণ্ডাস্ট্রিতে ঢুকেছে সে। ধীর গতিতে উন্নতি করতে করতে একেবারে মাথায় পৌঁছেছে। কিছুদিন থেকেই একটা ব্যাপারে সে উদ্বিগ্ন। এই কোম্পানিরই স্পেশাল প্রোজেক্টস্ ডাইরেক্টর পল বুহেরকে নিয়েই ওর চিন্তা।

পলের বয়স তিরিশের কাছাকাছি। অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী। বিলের চেয়ার দখল করার অক্লান্ত চেষ্টা সে শুরু থেকে প্রকাশ্যেই করে আসছে। কিন্তু এতে বিল মোটেও শঙ্কিত নয়, রিচার্ডের সাথে অনেক দিনের সম্পর্ক তার—অনেকটা বন্ধুর মতই। তাই ওর ব্যক্তিগত ক্ষতির সম্ভাবনা কম। তবে পলের নীতিজ্ঞানশূন্য নিষ্ঠুর কাজের পদ্ধতি সে মোটেই অনুমোদন করে না। আরও ক্ষমতা হাতে পেলে পল তার নিজস্ব পদ্ধতিতে কাজ করে থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির সুনাম নষ্ট করে ফেলবে বলেই বিশ্বাস করে বিল। তাই আজকের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসার আগেই সে রিচার্ডের সাথে একটু আলাপ করে নেয়ার জন্যে সকাল-সকাল অফিসে এসেছে। পল কৃষি—সংক্রান্ত প্রচুর জায়গা আর যন্ত্রপাতি কেনার পরামর্শ দিয়েছে—প্ল্যান পাস হলে ওর ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে—বিল সেটা ঠেকাতে চায়।

রিভলভিং দরজা দিয়ে বেরুবার মুখে রিচার্ড বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের চালে জবাব দিল, ‘স্বীকার করছি, পলের সাথে একমত হয়ে চলা খুব কঠিন, কিন্তু ওই যোগ্যতার মানুষ খুঁজে পেতে আমাদের তিন বছর সময় লেগেছে।’

‘আমি ওর শিক্ষাগত যোগ্যতার…’

‘জানি, ওর চাল-চলন তোমার পছন্দ নয়, এই তো?’

দরজা দিয়ে বেরিয়ে মাথা নাড়ল বিল। ‘না, ওর চাল-চলন তবু সহ্য করা যায়—কিন্তু ওর নীতি সব সময়ে সামাজিক নিয়ম মেনে চলে না।’

‘তুমি ভয় পাচ্ছ আইনের চোখে আমরা অপরাধী হয়ে দাঁড়াতে পারি?’ প্রশ্ন করল রিচার্ড।

‘অসম্ভব কি? ইদানীং সে বেশ কিছু সমাজ বিরোধী কাজ হাতে নিয়েছে। লিমোসিনের ধারে পৌঁছে গেল ওরা। মারে সসম্মানে দরজা খুলে দাঁড়াল।

‘দেখা যাক, মীটিঙে জানা যাবে এ ব্যাপারে পল বুহেরের কি বক্তব্য। তবে তুমি ওখানে পলকে সরাসরি আক্রমণ না করে তোমার আপত্তি একটু কৌশলে মার্জিত ভাবে প্রকাশ কোরো।’

রিচার্ডের পাশেই পিছনের সিটে উঠে বসল বিল অ্যাদারটন। গাড়ি ছেড়ে দিল মারে।

.

অ্যাকাডেমির বারান্দায় তাদের নতুন প্ল্যাটুন লীডারের সাথে দেখা করার জন্যে জড়ো হয়েছে সবাই। একে একে ওদের ডাক পড়ছে।

দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে টেড়ি দাঁড়িয়ে। চোখে মুখে একটা ড্যাম কেয়ার ভাব। যে লোকটার কাছে অপদস্থ হয়েছে, তাকে সে মোটেও ভয় করে না, এটাই সবাইকে বোঝাতে চাইছে ছেলেটা।

ভিতরে ভিতরে খুব ঘাবড়েছে ও। তার বেয়াড়া ব্যবহারে যে নেফ প্রীত হয়নি এটা ভাল করেই বুঝেছে সে। এভাবে চলবে না-নতুন কোন পথ ধরতে হবে তাকে।

ভক্তরা টেডির চারপাশে ওকে ঘিরে রয়েছে। ওরাও টেডির অনুকরণে নিজেদের চেহারা নির্ভীক রাখার চেষ্টা করছে। কিছু একটা করা দরকার মনে করে দেয়ালে সার বেঁধে ঝুলানো ছবিগুলোর দিকে এগিয়ে গেল টেডি। প্রায় চল্লিশটা ছবি পাশাপাশি ঝুলছে-অ্যাকাডেমির প্রত্যেক বছরের ফুটবল টীমের’ ছবি

শেষ পর্যন্ত যা খুঁজছিল পেয়ে গেল টেডি। একটা ছবি দেখিয়ে সে বলে উঠল, ‘এই টীমেই খেলত আমার বাপ। এই যে তার ছবি।’ জনাছয়েক ছেলে দেখার জন্যে ঝুঁকে পড়ল। ‘বাবা ছিল রাইট আউট,’ বলে আড়চোখে ডেমিয়েনকে একবার দেখে নিয়ে সে আবার বলল, ‘রবার্ট থর্ন ছিল কোয়ার্টার ব্যাক।’ স্পষ্ট অবজ্ঞা প্রকাশ পেল ওর স্বরে। ‘টাকায় কী না হয়!’

দেয়াল ছেড়ে সিধে হয়ে দাঁড়াল ডেমিয়েন। ‘টেডি!’ ডাকল সে। ওর গলায় হুমকি।

টেডি ওর চারপাশের ভক্তদের দিকে একবার দেখে নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। ‘তোমার বাপের অনেক টাকা খসেছিল, তাই না?’

খিক খিক করে চাপা হাসির শব্দ উঠল। একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে ঘটনা মোড় নিচ্ছে বুঝতে পেরেই প্রাণ খুলে হাসতে পারছে না কেউ। ঠিক এই সময়ে দরজা খুলে নেফের ঘর থেকে বেরিয়ে এল মার্ক। মুহূর্তে ঘটনা আঁচ করে নিয়ে সে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘ডেমিয়েন, এবার তোমার পালা।’

প্রথমে মার্ক, পরে টেডির দিকে চেয়ে অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ স্বরে ডেমিয়েন বলল, ‘ভাল চাইলে জীবনে আর কখনও তুমি আমার বাপ তুলে কথা বলবে না—কোনদিন না।’ কথাটা শেষ করেই ঘুরে নেফের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল ডেমিয়েন।

মার্কের দিকে চেয়ে নাক দিয়ে একটা অবজ্ঞাসূচক শব্দ করল টেডি। ‘তোমার ভাই নিজেকে কি মনে করে?’ নিজের সমর্থকদের দিকে চেয়ে সে আবার বলল, ‘আমার বাবা তো বলে থর্নরা নাকি অর্ডার দিয়ে হ্যাট বানায়। মাথা মোটা তো? তাই দোকানের কোন টুপিই ওদের মাথায় লাগে না!’ নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে বিকট শব্দে হেসে উঠল টেডি। ওর সাথীরাও হাসিতে যোগ দিল।

সোজা টেডির দিকে এগিয়ে গেল মার্ক। ওর মুখোমুখি এসে থেমে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কুহা দেখেছ?

শব্দটার অর্থ টেডির জানা নেই। ওর সন্দেহ হল শব্দটা সম্ভবত অপমানজনক। মার্ক ওকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে বিশ্বাসই হচ্ছে না। ওদের মধ্যে ডেমিয়েনই শক্তিশালী আর ডানপিটে তার পক্ষে লাগতে আসা সম্ভব—কিন্তু মার্ক?

সিধে হয়ে দাঁড়াল টেডি। ‘কি বললে?’ ওর সামনে মার্ককে অত্যন্ত ছোট আর ক্ষীণ দেখাচ্ছে।

‘বোঝনি? ঠিক আছে, তোমার জন্যে না হয় সোজা করে বুঝিয়েই বলছি, ‘ আশ্চর্য রকম শাস্ত শোনাচ্ছে ওর গলা। ‘কুজটিকা-কুয়াশার মত ঝাপসা জিনিস। জাপানের উপকূলে দেখা যায়।’

কথার প্যাচে টেডি মার্কের তুলনায় নস্যি। কিন্তু আজকের আক্রমণটা যে কোন্‌দিক থেকে আসছে তা মোটেও বুঝে উঠতে পারছে না। ‘না,’ সন্দিগ্ধ ভাবে জবাব দিল সে।

‘দেখনি তো? দেখ!’ বলেই তার জুতোর চামড়ার শক্ত গোড়ালি সজোরে ঠুকে দিল টেডির বাম পায়ের আঙুলগুলোর ওপর।

একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে টেডি। অসহ্য ব্যথায় এক পায়ে লাফাচ্ছে সে। ওই পুঁচকে ছোঁড়াটা তাকে এত জোরে মারায় আশ্চর্য হয়নি সে, অবাক হয়েছে ওর ঔদ্ধত্যে। অ্যাকাডেমির কোন ছেলে তাকে এভাবে তাচ্ছিল্য করতে সাহস পায়নি সে যে কি করবে, কিছুই মাথায় আসছে না ওর

টেডির মাথা স্বাভাবিক অবস্থাতেই একটু ধীরে কাজ করে। ভেবাচেকা অবস্থা কাটিয়ে ওঠার আগেই মার্ক মুখ দিয়ে ‘চুকচুক’ শব্দে দুঃখ জানিয়ে এবার ওর অন্য পায়ের ওপর গোড়ালি দিয়ে মারল। টেডির বিস্ময়ের মাত্রা শেষ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বেচারা ঠিকমত দাঁড়াতেই পারছে না।

এমন অসহায় ভাবে পা বদল করে করে টেডিকে একপায়ে নাচতে দেখে হাসি পাচ্ছে ছেলেদের। কিন্তু এখন হাসলে পরে তার পরিণতি কি হবে বুঝেই ওরা হাসি চাপল। কি ঘটতে যাচ্ছে বুঝেই ওরা সরে দাঁড়িয়ে টেডি আর মার্ককে জায়গা করে দিল।

.

প্ল্যাটুন লীডার নেফের বিশাল ডেস্কটার সামনে ‘স্ট্যাণ্ড অ্যাট ইজ’ অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ডেমিয়েন। ডেস্কের পিছনে বসে ডেমিয়েনের ফাইল ওল্টাচ্ছে নেফ। খুঁজে পেয়ে পরীক্ষার ফলাফলগুলোর ওপর চোখ বুলাল সে।

‘অঙ্ক ভাল,’ আরম্ভ করল সার্জেন্ট। ‘বিজ্ঞান…খুব ভাল, সামরিক ইতিহাস…মোটামুটি, আরও উন্নতি করার অবকাশ রয়েছে।

‘জ্বী, সার্জেন্ট,’ ডেমিয়েনের মনোযোগ ওখানে নেই। নেফের পিছনে খোলা জানালা দিয়ে সে মাঠে নতুন ক্যাডেটদের খেলা দেখছে।

‘শরীর চর্চা,’ বলে চলল নেফ, ‘চমৎকার।’ ফাইলটা ঠেলে সরিয়ে রাখল সে। ‘শুনলাম তুমি ফুটবল খুব ভাল খেলতে পার?

কাঁধ ঝাঁকাল ডেমিয়েন। মুখে বড়াই না করে কাজে প্রমাণ করায় বিশ্বাসী সে। ‘গর্বিত হতে শেখ!’ ধমকে উঠল নেফ। ‘নিজের কৃতিত্বকে নিজেও মর্যাদার চোখে দেখতে হবে।’

‘জ্বী, সার্জেন্ট।’ আর কোন জবাব ওর মাথায় এল না।

‘আজ বিকালে খেলার মাঠে আমি উপস্থিত থাকব,’ বলল নেফ।

কথাটা ডেমিয়েনের কাছে চ্যালেঞ্জের মতই শোনাল। মাথা ঝাঁকাল, কিন্তু কেমন যেন বিব্রত বোধ করছে।

কয়েক মুহূর্ত অস্বস্তিকর নীরবতার মাঝে মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে গভীর আবেগ দিয়ে নেফ বলল, ‘আমি তোমাকে শিক্ষা দিতে এসেছি বটে, কিন্তু সেইসাথে তোমাকে সাহায্য করতেও এসেছি।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘তোমার কোন সমস্যা হলেই আমার কাছে চলে এসো, ভয় কোরো না…’

‘ভয়?’ ভাবল ডেমিয়েন। পুরো মনোযোগের সাথে এখন কথা শুনছে সে।

‘–দিনে-রাতে যে-কোন পরামর্শ বা সাহায্যের দরকার হলেই সোজা আমার কাছে চলে এসো। বুঝেছ?’

এসব কথার মানে ঠিক বুঝতে পারছে না ডেমিয়েন। তবু মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সে, ‘জ্বী, সার্জেন্ট।‘

ভবিষ্যতে আমাদের পরস্পরকে ভাল করে জানার অনেক সুযোগ আসবে।’ দূরে সরিয়ে রাখা ফাইলটার ওপর টোকা দিল নেফ, ‘দেখলাম বাপ-মা মরা ছেলে তুমি।

অস্বস্তিভরে মাথা ঝাঁকাল ডেমিয়েন।

হাসল নেফ। ‘আমিও তাই,’ আন্তরিক সহানুভূতির সাথে বলল সে। ‘অন্তত এ-ব্যাপারে আমাদের মিল রয়েছে।’

অবাক চোখে নেফের দিকে চাইল ডেমিয়েন। ওদের মধ্যে অদ্ভুত একটা কিছু ঘটছে, কিন্তু সেটা যে কি তা বুঝে উঠতে পারছে না ও।

নেফের চেহারা থেকে বন্ধুসুলভ হাসিটা মিলিয়ে গেল। ডেমিয়েনের সাথে সাক্ষাৎকারের ইতি টেনে গভীর স্বরে বলল, ‘ফস্টারকে আসতে বল।’

এক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এল ডেমিয়েন।

.

বারান্দায় বেরিয়েই ডেমিয়েন দেখতে পেল মার্ককে নির্দয় ভাবে পেটাচ্ছে টেডি। দু’হাত তুলে এঁকেবেঁকে অসহায় মার্ক মার ঠেকানোর চেষ্টা করছে।

আর দেরি করল না ডেমিয়েন। ‘টেডি!’ হুঙ্কার ছাড়ল সে। ডেমিয়েনের গলার এমন ভয়ানক স্বর ওর সহপাঠীরা আগে কখনও শোনেনি। ওদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল।

ঘুরে দাঁড়াল টেডি। ওর চোখে-মুখে বিজয় উল্লাস। কিন্তু ডেমিয়েনের চোখের দিকে চেয়ে ওর হাসি ম্লান হয়ে গেল।

দম বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।

কটকটকটকট একটানা একটা শব্দ উঠল। দুটো ক্ল্যাপস্টিক একসাথে বাড়ি খাওয়ার মত আওয়াজ। মুখ তুলে শব্দের উৎস খুঁজল টেডি। কিন্তু আর কেউ কেন শুনতে পাচ্ছে না? সবাই ওর দিকেই চেয়ে রয়েছে। শব্দটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট আর জোরাল হয়ে উঠল। শক্তিশালী একজোড়া ডানা পরস্পর বাড়ি খাচ্ছে-ঠিক টেডির মাথার ওপর। আতঙ্কিত চিকন গলায় চিৎকার করে উঠল টেডি, ‘বাঁচাও!’ দু’হাত মাথার ওপর তুলে অদৃশ্য আক্রমণকারীদের ঠেকাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে!

ক্যাডেটরা সবাই অবাক হয়ে হাঁ করে চেয়ে রয়েছে। কোনমতে উঠে কি ঘটছে বোঝার চেষ্টা করছে মার্ক। ডেমিয়েন সম্মোহিতের মত দাঁড়িয়ে।

হঠাৎ যেন ঘূর্ণি বাতাসেই টেড়ির দেহটা মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে গেল। পরক্ষণেই উড়ে গিয়ে আছড়ে পড়ল দেয়ালের গায়ে।

এই সময়ে অফিস ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এল নেফ। বাধা পেয়ে ডেমিয়েনের ঘোর কেটে গেল। মাথা ঝাঁকি দিয়ে পর পর কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে মুখ তুলে চাইল সে। কোনায় মাটিতে লুটাচ্ছে টেডি। শব্দটা থেমে গেছে। ক্যাডেটরা সবাই বিস্ময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

মাটিতে শুয়ে কি করছ?’ টেডিকে প্রশ্ন করল নেফ।

কথার উত্তর না দিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে উঠে বসে নিজের চোয়ালে হাত বোলাল টেডি।

‘কে মেরেছে তোমাকে?’ আবার জিজ্ঞেস করল নেফ।

টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়াল টেডি। ‘কেউ না, স্যার,’ বলল সে। কথাটা মিথ্যা নয়।

কথাটা মেনে নিয়ে নেফ বলল, ‘ঠিক আছে, এবার ফস্টার এসো আমার ঘরে।’ আবার নিজের কামরায় ঢুকল সে। ফস্টার তার পিছু নিল।

সবাইকে বিহ্বল অবস্থায় ফেলে ক্যাডেটদের পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে এল ডেমিয়েন। অন্যেরা টেডিকে ঘিরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ডেমিয়েনের পিছু নিল মার্ক। অল্প কিছুটা ছুটেই ভাইকে ধরে ফেলল সে।

‘ওকে কি করেছিলে তুমি?’ প্রশ্ন করল মার্ক। ব্যাপারটা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি সে।

‘জানি না,’ প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেল ডেমিয়েন। তবে সত্যি জবাবই দিয়েছে ও। ঘটনার জন্যে আসলে কে দায়ী তা সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। তার বাবার মত সে-ও পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো?

ওর কাঁধে হাত রেখে মার্ক বলল, ‘জানো, ওরা আমাকে অ্যাকাডেমির ব্যাণ্ডে নিতে চায়।’

‘তাই নাকি?’ হাসল ডেমিয়েন। ‘চমৎকার কথা!’ আবার সেই আগের হাসিখুশি ডেমিয়েনে রূপান্তারিত হল সে। কনুই দিয়ে মার্ককে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘দেখি ক্যান্টিনে কে আগে পৌঁছতে পারে, তোমাকে বিশগজ হ্যাণ্ডিক্যাপ দিচ্ছি।’

কিছুদূর এগিয়ে গেল মার্ক। তারপর দু’জনেই হাসতে হাসতে ছুটল ক্যান্টিনের দিকে।

আর পাঁচটা ছেলের মতই উচ্ছল ভাবে ছুটছে ওরা।

.

আটলান্টিক মহাসাগরের তিরিশ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে পশ্চিম দিকে উড়ে চলেছে এল অ্যাল কোম্পানির জেট। জানালার ধারে বসে বাইরের দৃশ্য দেখছে এক সুন্দরী ইংরেজ মহিলা—জোন হার্ট। ওয়ারেনের কথাই ঠিক, রিচার্ড থর্নের সাক্ষাৎকার নিতেই আমেরিকায় যাচ্ছে সে। তবে তার উদ্দেশ্যটা ঠিক আঁচ করতে পারেনি ওয়ারেন।

তার প্রেমিক মিশেল মরগ্যান নয় বছর আগে হঠাৎ নিখোঁজ হবার পর অতীত আর বাইবেল নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছে জোন। কিন্তু ছোট্ট ছেলে ডেমিয়েনকে ঘিরে এতগুলো রহস্যময় মৃত্যুর কোন কিনারা করতে পারেনি। ধীরে ধীরে সে এর ভিতরকার গূঢ় সত্যটাকে উপলব্ধি করেছে।

আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী বুগেনহাগেন তার শিষ্য মিশেলের ওপরই এর প্রতিকার করার দায়িত্ব দিয়েছিল। কথাবার্তা সব ওর সামনে হয়েছিল বলে মিশেলের অবর্তমানে তার ওপরই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে বলে মনে করে জোন। এটাকেই জীবনের ব্রত বলে গ্রহণ করেছে সে। যে করেই হোক তেরোতম জন্ম—বার্ষিকীর আগেই শয়তানের সন্তানকে শেষ করতেই হবে। নইলে এর পরে ওর ক্ষমতা আরও অনেক বৃদ্ধি পেয়ে যাবে—সাবালকত্ব প্রাপ্ত হবে সে—তখন তাকে ধ্বংস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

কাজটা হাতে নিয়ে দিশেহারা বোধ করছে জোন। কে তাকে বিশ্বাস করবে? যারা তাকে চেনে তারা মনে করবে এটা তার মনের নতুন একটা খেয়াল। আর যারা চেনে না তারা ভাববে ওর মাথা খারাপ।

এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত জ়োন নিজেও কিছুটা সন্দিহান ছিল। গত সপ্তাহে বেলভোয়ের দুর্গের ওপর একটা বিশেষ রিপোর্ট লিখতে ওখানে গিয়ে চূড়ান্ত প্রমাণ সে পেয়েছে। খুঁড়তে গিয়ে বিংশ শতাব্দীর দুটো কঙ্কাল পাওয়া গেছে ওখানে। জোনের ধারণা লোক দু’জনকে চিনতে পেরেছে সে। তাছাড়া য়িগেইলের দেয়ালটাও খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছে জোন।

নিজে নিঃসন্দেহ হওয়ার পরে আর চুপ করে বসে থাকতে পারেনি সে। প্ৰমাণ পাওয়ার সাথে সাথেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমেরিকায় গিয়ে সামনাসামনি রিচার্ড থর্নকে সত্য কথাটা জানাতে হবে। বলতে হবে তাদের মাঝেই বড় হচ্ছে ইবলিস—সন্তান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *