অশুভ সংকেতের পর – ৮

আট

থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় নিজস্ব জেট থেকে ব্রিফকেস হাতে নামল ডেভিড প্যাসারিন। পথে কোথাও না থেমে ইণ্ডিয়া থেকে সোজা এসেছে প্লেনটা। সময়ের হেরফেরে অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছে।

প্লেন থেকে নেমেই সোজা একটা ফোন বুথে গিয়ে ঢুকল প্যাসারিন। সময়টা রবিবার বিকেল হলেও ফোন করাটা আপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কি ঘটেছে তা রিচার্ড থর্নকে এখনই জানানো দরকার।

ভাগ্য ভাল প্যাসারিনের সাথে কোম্পানির ক্রেডিট কার্ড রয়েছে—কারণ ওর পকেটে মাত্র কয়েকটা ভারতীয় পয়সা ছাড়া আর কিছুই নেই। থর্নের লেকের ধারে বাড়িতে ফোন বুক করে অস্থির ভাবে ফোনে বুথের কাঁচের ওপর আঙুল দিয়ে ড্রাম বাজাচ্ছে সে।

ফোন ধরল বাটলার। সে জানাল থর্নের বাসায় ফিরতে রাত হবে তবে কোন খবর থাকলে সে তা অবশ্যই আগামী কাল ভোরে তার কাছে পৌঁছে দেবে।

ব্যর্থ হয়ে মনে মনে কিছুক্ষণ ভাবল সে। কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে—অথচ থর্নকেই সবার আগে কথাটা জানানো দরকার। শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বুহেরকে ফোনে বুক করল।

.

বুহেরের অ্যাপার্টমেন্টটা খুব ছিমছাম। বাড়তি ঝামেলার কোনরকম বালাই নেই ওখানে। ওটার একমাত্র বিশেষত্ব হচ্ছে ওখান থেকে শিকাগো শহরের একটা অপূর্ব মনোরম দৃশ্য দেখা যায়। বাসাটা তৈরিই করা হয়েছে যেন কেবলমাত্র কাজের জন্য বাড়ির মত মনে হয় এমন সবকিছুই বিসর্জন দেয়া হয়েছে।

যখন ফোন বেজে উঠল তখন পড়ছিল বুহের। এখানে সব ঘরেই এমন ভাবে ফোন বসানো হয়েছে সে যেখানেই থাক ফোন ধরার জন্যে তাকে উঠতে হয় না। হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে নিল সে।

‘বুহের বলছি।‘

জবাব আসতে দেরি হল। একটু দ্বিধাগ্রস্ত নীরবতার পরে ওদিক থেকে প্যাসারিনের গলা শোনা গেল, ‘পল? আমি ডেভিড। তোমার সাথে আমার কথা বলা দরকার।’

‘কোথায় আছ তুমি?’ উৎকণ্ঠায় পলের গলাটা একটু পাতলা শোনাল।

‘শিকাগো এয়ারপোর্ট থেকে বলছি আমি। গোলমাল বেধেছে, তাই আমাকে জলদি ফিরতে হয়েছে।

ওকে থামিয়ে দিয়ে পল বলে উঠল, ‘সোজা তুমি এখানে চলে এসো।’

রিচার্ড আর অ্যান দু’জনে সন্ধ্যাটা উপভোগ করতে বেরিয়েছে। রবিবার ছেলেরা স্কুলে। অতিথিও কেউ নেই! মীটিং-এ ছুটতে হবে না, কোন জরুরি টেলিফোন আলাপ নেই–অখণ্ড অবসর। ভাবপ্রবণ মন নিয়ে রাতে বরফের ওপর দিয়ে ঘোড়া—টানা স্লেজ গাড়িতে চড়ে অবসরটাকে উপভোগ করতে বেরিয়েছে থর্ন দম্পতি।

পুরানো আমলের বিশাল স্লেজ গাড়ি। এমন ভারি গাড়ি সহজে বেগে টেনে নেয়ার ক্ষমতা একমাত্র ক্লাইডস্‌ডেল ঘোড়ারই আছে। গত বড়দিনের সময়ে এক বন্ধুর কাছ থেকে দুটো ক্লাইডস্‌ডেল ঘোড়া কিনেছে রিচার্ড। স্লেজ গাড়িটা নতুন করে রঙ করা, ঘন্টা লাগানো এসবের দেখাশোনা করেছে অ্যান নিজে। স্লেজের ঘন্টা আর ঘোড়ার খুরের শব্দ ওরা বাড়ি পৌছবার অনেক আগে শোনা যাচ্ছে। গাড়ির ভিতরে একই কম্বলের তলায় দু’জনে ঘন হয়ে পাশাপাশি বসে আছে। নিজেদের অত্যন্ত সুখী মনে হচ্ছে…

রাতে বাড়ি ফিরেই রিচার্ড শুনল প্যাসারিন ফোন করেছিল। বাসায় ফোন করে ওকে পাওয়া গেল না। রিসিভার নামিয়ে রাখতেই অ্যান বলল, ‘আজ আর ও নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। ঘরে চল,’ বলে ওর হাত ধরে ওকে শোবার ঘরে নিয়ে গেল অ্যান।

.

বুহেরের বসার ঘরে দামি ক্রোম আর চামড়ার সোফায় বসে ক্লান্ত অবসন্ন প্যাসারিন ধীরে ধীরে কফির পেয়ালায় চুমুক দিচ্ছে। ওকে মদ সেধেছিল পল, কিন্তু মদ খেলে নির্ঘাত ঘুমিয়ে পড়বে মনে করে সে নিজেই তা প্রত্যাখ্যান করেছে।

মদের গ্লাস হাতে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছে পল! প্যাসারিনের কাছে এইমাত্র যা শুনেছে সেটা হজম করার চেষ্টা করছে সে।

তাহলে তোমার ধারণা, যে লোকটা আমাদের কাছে জমি বিক্রি করতে রাজি সে আমাদেরই একজন লোকের হাতে খুন হয়েছে?’ গ্লাসের বাকি মদটুকু একবারে গলায় ঢেলে দিল বুহের।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল প্যাসারিন। ‘এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত,’ বলল সে।

অসম্ভব!’ বার থেকে আর এক গ্লাস মদ ঢেলে নিল বুহের।

‘জমির ব্যাপারে আটটা বিভিন্ন প্রদেশে যেতে হয়েছে আমার,’ বলল প্যাসারিন। ‘তার তিনটেতেই…’

‘তিনটে?’

‘তিনটে খুন।’ কফিতে আরেকটা চুমুক দিল সে। তারপর কাপটা নামিয়ে রেখে বলল, ‘একটাই আমার জন্যে যথেষ্ট।

‘কে করেছে কাজটা?’ আবার জানালার ধারে সরে গেল বুহের।

‘কি যেন, ‘বুঝতে পারছি না আমি।’

‘হুঁ,’ একটা বড় শ্বাস ছাড়ল বুহের। ‘আমাকেই ব্যাপারটা তলিয়ে দেখতে হবে।

যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল প্যাসারিন। আমরা কি কথাটা রিচার্ডকে জানাব?’ আলনা থেকে ওভারকোটটা নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল সে।

‘অবশ্যই!’ জোরের সাথে বলল বুহের। ‘কাল সকালে তাকেই প্ৰথম ফোন করব আমি। হ্যাঁ, ভাল কথা, রিচার্ড তোমার খোঁজ করছিল।’

‘আমাকে? কেন?’

ওর সাথে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গেল বুহের। ‘তোমার পি-৮৪তে যেন কি গোলমাল দেখা দিয়েছে। রিপোর্টটা তোমার টেবিলেই আছে। ওটা নিয়ে একটু চিন্তায় আছে রিচার্ড। কাল সকালে ওটা তুমি একটু চেক করে দেখ।’ বিদায় নিতে ওর সাথে হাত মেলাল প্যাসারিন। ‘ওটা বন্ধ হয়ে যাক, এটা কিন্তু আমি চাই না, ডেভিড।’

মাথা ঝাঁকাল প্যাসারিন। ‘আমি দেখব,’ বলে দরজা খুলল সে।

বিদায় দেয়ার আগে ঘুরে জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টিতে চেয়ে বুহেৱ বলল, ‘আমাদের ভিতর অতি উৎসাহী কেউ না থাকলেই বাঁচি। তাড়াতাড়ি প্যাসারিনের দিকে ফিরে চেয়ে সে আবার বলল, ‘আজ সোজা আমার কাছে চলে আসার জন্যে ধন্যবাদ। আমার প্রতি তোমার সত্যিকার আস্থা আছে জেনে সুখী হলাম।’

হাত তুলে বাই বাই’ জানিয়ে বিদায় নিল প্যাসারিন। কিন্তু তার মনে একটা খুঁতখুঁতি থেকেই গেল। কাজটা ঠিক হল তো? ভাবছে সে।

.

প্যাসারিনের হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে ফিরে আসা, ঝামেলার খবর বয়ে আনা, এখনও কিছুই থর্নকে জানানো হয়নি—তার ওপর পি-৮৪-র গোলমাল; এতসবের ভিতর বুহের ভুলেই গিয়েছিল যে, অ্যাকাডেমির ছেলেদের আজই নতুন কেনা কৃষি কলখারখানাগুলো দেখতে আসার কথা আছে।

তাই জানালা দিয়ে অ্যাকাডেমির বাস ঢুকতে দেখে বেশ অবাকই হল বুহের। বাসটা দালানের সামনে এসে থামার পর তার মনে পড়ল ওটা কেন আজ এখানে এসেছে। ইন্টারকমে সেক্রেটারিকে ডেকে তার হয়ে ছেলেদের স্বাগত জানাতে আদেশ করল বুহের!

ওরা আসার আর দিন খুঁজে পেল না; ভাবল বুহের। কিন্তু চলার পথে এই ধরনের ঝামেলা সামলাতে পারে বলেই আজ এত উপরে উঠতে পেরেছে সে।

বাইরে ছেলেরা চারপাশের চেহারা দেখে বেশ অভিভূত হয়েছে। আগে তারা কেবল এর ওর কাছে শুনেই এসেছে থর্নরা বড়লোক। কিন্তু তারা যে কি ধরনের বড়লোক সে বিষয়ে আজ ওদের স্পষ্ট ধারণা হল। এখানকার এক একটা বিশাল পাকা দালানই ওদের অনেকে যে সব শহরে বড় হয়েছে তার সমান। একটা ছেলে নিচু সুরে শিস দিয়ে উঠল।

সবার এই থমকে যাওয়া ভাবটা হালকা করার চেষ্টা করল টেডি। ‘এই ট্যুরে পরিচালকদের ডাইনিং রূমে আমাদের বিশেষ লাঞ্চ খাওয়ানো হবে না?’ কার্টুনের পেটুক চরিত্রের মত পেটে হাত বুলিয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে প্রশ্ন করল সে।

‘নিশ্চয়ই,’ ভদ্র নরম সুরে জবাব দিল ডেমিয়েন।

কিন্তু মার্ক ছাড়ল না। বলল, ‘আজ তোমাদের একটা নতুন পোকা মারার ওষুধ খাইয়ে ওষুধের গুণাগুণ পরীক্ষা করা হবে।’ সবাই একসাথে হেসে উঠল।

ওদের সবাইকে সবচেয়ে বড় দালানটায় নিয়ে যাওয়া হল। বুহের ওখানে ছেলেদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। নিজের সম্পর্কে কিছুটা জানার পর আজ বুহেরের সামনে একটু আড়ষ্ট বোধ করছে ডেমিয়েন। তবে এখন নিজেকে আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী আর সাহসী মনে হচ্ছে তার। আড়চোখে বুহেরের দিকে একবার চেয়ে কাঁচের দেয়ালে আঁটা লেখাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ডেমিয়েন। বড় বড় অক্ষরে লেখাঃ

ওষুধ ঘর। অনুমোদিত ব্যক্তি ব্যতীত প্রবেশ নিষেধ।

কাঁচের ভিতর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল বাস্কেটবল কোটের সমান হবে ঘরটা। ভিতরের লোকটাকে চিনতে পারল ডেমিয়েন। প্যাসারিনকে তার চাচার সাথে অনেকবার দেখেছে সে। প্যাসারিন ছাড়া ওই ঘরে রয়েছে মাইলের পর মাইল বিভিন্ন রঙের ঘুরানো পেঁচানো নানান আকারের পাইপ। একটা প্রকাণ্ড রোবটের পেটের নাড়িভুঁড়ির মত দেখাচ্ছে।

প্রত্যেকটা রঙেরই একটা করে অর্থ আছে। সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য হলেও দক্ষ কারিগরের কাছে ওগুলো খবরের কাগজ পড়ার মতই সহজবোধ্য। প্যাসারিনের নিজস্ব ল্যাবরেটরি এটা। সব কিছুই ওর নির্দেশে তৈরি। সে তার পি—৮৪কে নিখুঁত করার চেষ্টায় এখন ব্যস্ত।

একটা বড় কমপিউটার প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্যাসারিন। ডায়াল থেকে বিভিন্ন আলোর সংকেত ওকে জরুরি খবরগুলো জানিয়ে চলেছে। পাশে রাখা টিপ বোতাম বসানো টেলিফোন রিসিভার তুলে কয়েকটা বোতাম টিপে মুখ তুলে অদৃশ্য কোন সহকর্মীর উদ্দেশে চিৎকার করে বলল, ‘চাপ বাড়াও, টম! আরও একশো পাউণ্ড।’ তারপর রিসিভার কানে লাগিয়ে বলল, ‘প্যাসারিন বলছি, মিস্টার থর্ন কি অফিসে এসে পৌঁছেছেন?’

ওদিক থেকে মেয়েলি কণ্ঠে জবাব এল, ‘না, স্যার।’

প্যাসারিন একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল। উনি কি ফোনেও যোগাযোগ করেননি?’

‘না, স্যার।’

‘ঠিক আছে, উনি অফিসে এলেই যেন আমাকে খবর দেয়া হয়। ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরি,’ বলে রিসিভার নামিয়ে রাখার সময়ে বিড়বিড় করে কাকে যেন গাল দিল সে। তারপর ডায়ালগুলোর ওপর আর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে চিৎকার করল, ‘আরও পঞ্চাশ, টম!’

.

ছেলেদের সাথে ওদের গাইডের পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের অফিসে ফিরে এল বুহের। আজ তার থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির উঠতি এক্সিকিউটিভদের সাথে একটা মীটিং আছে। বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই এর দিন ঠিক করা ছিল। তরুণদের সাথে আলাপ আলোচনায় খুবই আনন্দ পায় বুহের। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ওদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়ার এই সুযোগটা সে সবসময়েই পুরোপুরি নেয়। উদ্বুদ্ধ হয়ে কেউ যদি তার সাহায্যে এগিয়ে আসে তাতে তারই সুবিধা। আর তাছাড়া ওদের হাতে রাখা ভাল, কারণ ওদের মধ্যেই কেউ একদিন তার চেয়ারটা দখল করবে।

ওদের তারুণ্য প্রতিবারই বুহেরকে বিস্মিত করে। একই রকম চুলের ছাঁট, থ্রি পিস সুট-তার মনে হয় যেন হারভার্ড-এর বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রী ক্লাস নিচ্ছে সে।

‘কিন্তু ইণ্ডিয়ায় জায়গা কেনার যে পরিকল্পনাটা আমরা বর্তমানে হাতে নিয়েছি,’ বলে চলেছে বুহের। ‘তাতে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন সেখানকার স্থানীয় লোক এটা না ভাবে যে আমরা শোষণের ব্যবসা খুলতে ওখানে যাচ্ছি। অবশ্যই না! তোমরা যেখানেই যাও জোর দিয়ে এই কথাই সবাইকে বোঝাবে। আমরা ওখানে যাচ্ছি ওদের সাহায্য করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। এখানে আমেরিকায় আমরা সাংস্কৃতিক আর শিক্ষাগত যে সব সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকি, ওখানকার হতভাগ্য লোকেরা তার কানাকড়ি অংশও পায় না। আমরা যদি আমাদের প্রাচুর্য কম ভাগ্যবান লোকজনের সাথে মিলেমিশে ভোগ না করি তবে থর্ন ইণ্ডাস্ট্রির সদস্য এবং আমেরিকাবাসী হিসেবে আমাদের কর্তব্যে অবহেলা করা হবে। আর মনে রেখঃ ইণ্ডিয়া আর মধ্যপ্রাচ্যে খাদ্য সরবরাহ করার মাধ্যমে আমরা রাশিয়াকে এগিয়ে এসে ওদের খাবার দেয়া ঠেকাচ্ছি। এতে আমরা শুধু কৃতজ্ঞতাই পাব না, তাদের ধনসম্পদও আমাদের হস্তগত হবে।

কথার মাঝেই বুহেরের কমবয়স্কা সুন্দরী সেক্রেটারি এসে ঘরে ঢুকেছিল। বক্তৃতা বন্ধ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল বুহের।

‘মিস্টার প্যাসারিন পি-৮৪-র কাজ আরম্ভ করেছেন,’ এতগুলো পুরুষ এক্সিকিউটিভের সামনে কথা বলতে গিয়ে একটু লাল হয়ে উঠল ওর মুখটা।। ‘আপনি কাজ শুরু হলেই জানাতে বলেছিলেন।

‘ধন্যবাদ,’ বলে তাকে বিদায় দিল বুহের। তারপর সবার দিকে চেয়ে সে আন্তরিক একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আধঘন্টার জন্যে তোমরা একটু বিশ্রাম নাও।’

বেরিয়ে গেল বুহের। ওরা অপেক্ষা করুক, ক্ষতি নেই। কিন্তু প্যাসারিনের সাথে তার কাজটা ফেলে রাখা যাবে না।

.

যে লোকটা গাইড হিসেবে ছেলেদের কারখানা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে, সে থর্ন ইণ্ডাস্ট্রিরই জন-সংযোগ বিভাগে একটা ছোটখাট পদে চাকরি করে। রিচার্ড থর্নের দুই ছেলের মনে ছাপ রাখতে পারলে তারা বাবার কাছে তার সম্পর্কে ভাল রিপোর্ট দেবেঃ এই আশায় সে যথাসম্ভব চেষ্টা করছে আজ।

‘শস্য যাতে দ্রুত আর অধিক ফলনশীল হয়, এই কারণে আমাদের উন্নতমানের শক্তিশালী সার ব্যবহার করতে হয়,’ বলে চলেছে লোকটা। কিন্তু সেই সাথে পোকা দমন করার জন্যে দরকার হয় নতুন নতুন কার্যকরী পোকা মারার ওষুধ।’ এইমাত্র ছেলেদের পোকা দমন ইউনিটের সামনে নিয়ে এসেছে গাইড।

প্যাসারিন যেখানে পি-৮৪ নিয়ে গবেষণা করছে তারই বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। গার্ডকে নিজের পরিচয়পত্র দেখিয়ে ওর হাতে একটা বিশ ডলারের নোট ধরিয়ে দিল গাইড। নিয়ম মাফিক এই ঘরটা প্রদর্শনী ট্যুরের আওতায় পড়ে না-কিন্তু মালিকের ছেলে আর তাদের বন্ধুদের জন্যে বিশেষ কিছু করতে চাচ্ছে গাইড। প্রকাণ্ড দরজা ওদের জন্যে খুলে গেল। সবাই ভিতরে ঢুকতেই দরজাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবার তালাবন্ধ হয়ে গেল।

ভিতরে ঢোকার পর বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আর কমপিউটারের গুঞ্জন ছাপিয়ে ছেলেদের সাথে কথা বলতে গাইডকে তার গলার স্বর বেশ খানিকটা চড়াতে হল।

‘এখানকার এই জটিল কাজকর্ম সবই ওই কমপিউটারের সাহায্যে মাত্র তিনজন লোক চালায়,’ রীতিমত চেঁচিয়ে কথা বলছে ওদের গাইড। ‘এই কারণেই ওখানে,’ কাঁচের দেয়াল ঘেরা জায়গাটা দেখিয়ে সে বলল, ‘কাউকে দেখা যাচ্ছে না।’

সবাই অভিভূত। কিন্তু একমাত্র টেডির চিন্তাধারাই কেবল একটা বিশেষ ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। ‘আচ্ছা, পোকার যৌনক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে কি একটা ওষুধ আছে না?’

ক্যাডেটদের একজন বলে উঠল, ‘টেডি! তোমার কি আর কোন চিন্তা নেই?’ কিন্তু গাইড ওর পক্ষ নিয়ে বলল, ‘না, ঠিকই বলেছে ও। আসলেই ফিরোমোন, অর্থাৎ এক ধরনের যৌন উত্তেজক রস শুধু পুরুষ বা স্ত্রী পতঙ্গ থেকে বের করে নিয়ে ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই উপায়ে যে-কোন লিঙ্গের যথেষ্ট পোকা মারতে পারলে বেশ সফল ভাবেই ওই পোকা দমন করা যায়। তখন আর নতুন পোকা জন্ম দেয়ার কেউ থাকে না।’

চোখের সামনে যে প্রকাণ্ড ব্যাপার-স্যাপার ওরা দেখতে পাচ্ছে তার তুলনায় ওই আশ্চর্য তথ্যও ওদের কাছে খেলো শোনালো। রঙিন পাইপের গোলক ধাঁধার ভিতর দিয়ে একটা সরু স্টীলের সিঁড়ি পাইপ ছাড়িয়ে ছেলেদের অনেক উপরে নিয়ে গেল।

‘এখানকার সব কাজই কমপিউটারে চলছে,’ চলতে চলতে চিৎকার করে বলল গাইড। ‘কমপিউটারের সাহায্যেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে নির্ধারিত পরিমাণে জলীয় আর বায়বীয় পদার্থ একসাথে মিশিয়ে প্রধান কারখানায় সরবরাহ করা হয়।’

নিচে প্যাসারিন হলুদ পাইপ লাগানো একটা জটিল চেহারার চাপ মাপার যন্ত্র নিয়ে কাজ করছে দেখতে পাচ্ছে ওরা। উপর দিকে চেয়ে দুটো পরিচিত চেহারা দেখতে পেয়ে সে চিৎকার করে ডাকল, ‘মার্ক! ডেমিয়েন! তোমরা এখানে কি করছ?’ ওর স্বরে উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেল। কিছুই ঠিকমত চলছে না আজ। এমন একটা দিনে ওদের ওই ঘরে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে প্যাসারিন

নিচে তাকিয়ে হাসল ওরা দু’জন। ‘আমরা কারখানাটা একটু ঘুরে দেখছি, ‘ চেঁচিয়ে জানাল ডেমিয়েন। তারপর প্যাসারিনকে দুশ্চিন্তায় ফেলে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে সবার সাথে এগিয়ে গেল ওরা।

ঠিক এই সময়ে ঘরের অন্য ধারে উঁচুতে একটা পাইপ সশব্দে ছুটে গেল। হিসহিস করে ঘন সবুজ বাষ্প বেরিয়ে আসছে।

‘পাইপ ফুটো হয়ে গেছে!’ কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল।

প্যাসারিন মুখ তুলে উপরে চেয়েই দেখতে পেল বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে ফোস্কা পড়ে গেছে তার সহকারীর মুখে। জ্ঞান হারিয়ে লোকটা রেলিং-এর ওপর দিয়ে ডিগবাজি খেয়ে নিচে পড়ল। ওর মাথাটা সজোরে মেঝের সাথে ঠুকে গেল।

নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না প্যাসারিন। কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে ছুটে যেতে যেতে সে চিৎকার করল, ‘বেরোও সবাই! জলদি ছেলেদের এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও!’

প্যাসারিনের চিৎকারে ছেলেদের গাইড চমকে ফিরে তাকাল। গ্যাসটা ধীরে ওদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

নিচে কন্ট্রোল প্যানেলের ডায়াল লক্ষ্য করছে প্যাসারিন। গ্যাস বেরুনোর গতির সাথে তাল রেখে সমানে ডায়ালের কাঁটা নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।

কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর লাল বোতাম রয়েছে একটা ( জরুরি অবস্থা ঘোষণার বোতাম ওটা। বিপদ দেখে দেহের সব শক্তি দিয়ে বোতামটা টিপে ধরল প্যাসারিন।

কাঁচের জানালা দিয়ে পাশের কমপিউটার রুমটা দেখা যাচ্ছে। ওখানে সাদাকোট পরা দু’জন কারিগর নিশ্চিন্ত মনে গল্প করছে। যে কারণেই হোক বিপদ সংকেত ওরা শুনতে পাচ্ছে না। বেচারা জানে না যে আজই সকালে বুহের নিজে বোতামটাকে অকেজো করে রেখে গেছে।

আবার বোতাম টিপল প্যাসারিন। কিন্তু লোক দুটো এখনও কথা বলেই চলেছে। বোঝা যাচ্ছে কোন সংকেতই ওরা শুনতে পাচ্ছে না।

ক্যাডেট ছেলেদের দম আটকে আসছে বিষাক্ত গ্যাসে। ওদের কাশি, চিৎকার আর কান্না প্যাসারিনের কানে আসছে। আতঙ্কে হুড়োহুড়ি লেগে গেছে ওদের ভিতর। ওই ঘর থেকে কোনক্রমে বেরিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে সবাই। শ্বাস কষ্টে মরিয়া হয়ে উঠেছে ওরা। গ্যাস লেগে চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে। কয়েক জনের মুখ আর হাতে ছোট ছোট ফোস্কা দেখা দিয়েছে।

গাইড ছুটে গিয়ে পাগলের মতো মাল ওঠানোর লিফটের বোতাম টিপতে লাগল।

কিছুই হল না-ওটাও কাজ করছে না।

বারবার বোতাম টিপে চলেছে গাইড। আর কি করা যায় কিছুই ওর মাথায় আসছে না। নিজের জীবন হারাতে বসেছে বলে সে ততটা ভীত নয়-কিন্তু থর্ন ছেলেদের কেউ যদি মারা যায় আর সে বেঁচে থাকে, তখন কি ঘটবে ভেবেই ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে লোকটা।

কেবল একজন মানুষ আতঙ্কিত হয়নি—সে হচ্ছে ডেমিয়েন। গ্যাসে ওর কোন ক্ষতিই হয়নি। চারপাশে চেয়ে সে দেখল তার বন্ধুবান্ধব একে একে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়তে আরম্ভ করেছে। এই প্রথমবারের মত ডেমিয়েন তার নিজের ক্ষমতা পুরোপুরি উপলব্ধি করল।

স্পষ্ট বুঝতে পারছে যে তার ইচ্ছার ওপরই এখন সব নির্ভর করছে। ইচ্ছা করলে সে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারে-সেক্ষেত্রে একমাত্র সে-ই বাঁচবে। অথবা সবাইকে বের হতে সাহায্য করে সে ‘হিরো’ হতে পারে।

সব কিছুই এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে ডেমিয়েন।

হিরো হবার ইচ্ছাটা ওর ভিতর হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিল সে। ছাদের দিকে এক নজর চেয়েই দেয়ালের সাথে বল্টু দিয়ে আঁটা একটা স্টীলের সিঁড়ি ওর চোখে পড়ল। সিঁড়িটা ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। সিঁড়ির মাথায় ছাদে একটা ঢাকনা চাপা দেয়া রয়েছে। ওদিক দিয়ে ছাদে ওঠা সম্ভব।

‘এদিকে,’ চিৎকার করে সিঁড়ির দিকে ছুটল ডেমিয়েন। ওর ব্যায়ামপুষ্ট দেহটা তরতর করে অবলীলাক্রমে উঠে যাচ্ছে ছাদের দিকে। সিঁড়ির মাথায় পৌঁছে ধাক্কা দিয়ে ঢাকনাটা খুলে ফেলল ডেমিয়েন। খোলা দরজা দিয়ে এক ঝলক রোদ আর তাজা বাতাস ঘরে ঢুকল।

অন্যান্য ক্যাডেট আর গাইড টলমলে পায়ে সিঁড়ির দিকে এগোল। একে অন্যের ওপর ভর দিয়ে পরস্পরকে সাহায্য করছে। কোনমতে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে পৌঁছে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে সবাই।

এতক্ষণে ডেমিয়েনের হঠাৎ প্যাসারিনের কথা মনে পড়ল। চেয়ে দেখল প্যাসারিন ছাড়া আর সবাই বেরিয়ে আসতে পেরেছে।

আবার ভিতরে ঢুকল ডেমিয়েন। সতর্কতার সাথে চটপট সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে পৌঁছে গেল।

নেই। কেউ নেই ওখানে। সবুজ ধোঁয়ায় ঘরটা ভরে উঠছে।একটা অ্যালার্ম বাজছে। চারদিকে বিভিন্ন জায়গায় থেকে থেকে লাল আলো জ্বলে উঠে বিপদ সংকেত জানাচ্ছে।

ঘুরে অন্য পাশ দিয়ে ছুটে এগিয়ে গেল ডেমিয়েন। এবার প্যাসারিনকে দেখতে পেল। কিন্তু প্যাসারিন দেখতে পেল না তাকে।

একটা ভাঙা ভ্যালভের সামনে কুঁকড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে প্যাসারিন। ওর একটা হাত এখনও সামনে বাড়ানো রয়েছে। মরার আগের মুহূর্তেও সে ভ্যালভটা বন্ধ করার একটা শেষ চেষ্টা চালিয়েছিল। মুখটা ফোস্কা পড়ে একেবারে বিকৃত হয়ে গেছে—চেনাই যায় না।

মরে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে দেহটা।

বিতৃষ্ণায় মুখ ঘুরিয়ে ছুটে তাড়াতাড়ি সিঁড়ির দিকে ফিরে চলল ডেমিয়েন।

ছাদে পৌঁছে সে দেখল ওখানে তখনও আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। কয়েকজন মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। চোখ থেকে সবারই পানি ঝরছে।

এবার মার্ক কেমন আছে দেখার জন্যে এগোল সে। যেতে যেতে টের পেল সে কে তা জানার পরেও খারাপ লাগছে না তার-ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে ও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *