অমৃত কুম্ভের সন্ধানে – ৯

হঠাৎ একরাশ ভিখারির ঝড় এলো বালুচরে। যেন চৈত্র-ঘূর্ণির ঝরাপাতা, ফুটোফাটা। কোথা দিয়ে এলো, কেউ জানে না, কেউ জানে না, এ-ঘূর্ণি যাবে ঘুরতে ঘুরতে কোন্ পথের উপর দিয়ে, কাদের দলে-মাড়িয়ে

হঠাৎ আমরা একরাশ নরনারী পাগলা ঘূর্ণির আবর্তে যেন পথরুদ্ধ, বিব্রত অসহায় হয়ে পড়লাম। হে পুণ্যবান, দাও দাও। হে তীর্থযাত্রী, দাও দাও। হে দয়ালু, হে রাজা রানী, দাও দাও, দাও দাও, দাও দাও।

কিন্তু প্রতিবাদ নেই, ক্রুদ্ধ গর্জন নেই, হা-হা করে বিতাড়ন নেই। সকলেই বিব্রত তবু হাসিমুখর। দিই দিই, দেব দেব, যা আছে তাই দেব। গতিক খারাপ। পকেটে হাত দিলাম। কোনোরকমে একজনের হাতে তুলে দিলাম পয়সা।

দেবার পরমুহূর্তেই সেই হাসি। নিঃশব্দ, নিরালা, দুস্তর তেপান্তরের সেই একাকী পথিকের বুকে আতঙ্ক-ধরানো পাখির বিচিত্র তীব্র হো হো ডাক। সেই লাল জামা, আর পালতোলা ময়ুরপঙ্খী পাড়। তেপান্তরের সেই বন্য বিহঙ্গিনী।

সচকিত চোখে তাকিয়ে দেখি, একলা নয়। অনেক, একরাশ। ভিখারি নয়। ভিখারিনী বাহিনী। বেশভূষায় প্রায় সকলেই একরকম। তার মধ্যেই, ময়লা ছিন্ন শাড়ি ও জামার ভাগ-ই বেশি। রুক্ষ চুল, ধূলি-ধূসরিত মুখ আর লজ্জাহীন ছিন্ন পোশাক! সবচেয়ে আশ্চর্য, তার মধ্যেও সিঁদুরের প্রসাধন, জটায় শুকনো ফুলের সজ্জা! কারুর বুকজোড়া সন্তান।

তারই মাঝে ওই লাল জামা। দলের মধ্যে রয়েছে মিশে। তবু যেন কেমন করে আলাদা হয়ে উঠলো চোখের সামনে। বোধ হয় চোখেরই দোষ। বুঝি দোষ মনের-ই। কে জানতো! না-জেনে আবার পকেট থেকে পয়সা তুলে দিয়েছি তাকে। ছি ছি, কী কলঙ্ক! কী ভাগ্যি, নেই খনপিসি, পিসির বাহিনী।

চোখ পড়তে দেখি, তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আবার ঠকেছি, বুঝি তাই। আবার ঠকিয়েছে, বুঝি তাই। দেখি, ঠোঁটের কোণে তার জয়ের হাসি। জয়ের মধ্যেই তো থাকে স্পর্ধা ও বিদ্রূপের ছোঁয়া। ঠোঁটের তীব্র বঙ্কিম রেখায় তার সেই দুর্জয় ছলনার হাসি। চাউনি দেখে চমকে উঠলাম। হেলানো ঘাড়, বাঁকা চোখে সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে আমাকে।

স্খলিত আঁচল পড়েছে লুটিয়ে বালুচরে। বাতাস থরথর কাঁপছে তার লাল জামায়, তার রুক্ষ চুলে, তার মেটে সিঁদুরের অস্পষ্ট এলোমেলো সিঁথিরেখায়, তার সর্বাঙ্গে। সব মিলিয়ে এই বালুচরের আর এক বেশ যেন দেখা দিয়েছে এই সর্বনাশী উন্মাদিনী যাযাবরীর মধ্যে।

একে রূপ বলবো কিনা জানি নে। কী রূপ বলব, বুঝি নে। একে রূপ বলতে বাধে। অরূপ বলতে সায় পাই নে মনে। এ রূপের খাদ নয়। অথচ মন ভরে উঠছে না অপরূপ বলে। এ কি ইস্পাতের তলোয়ার, নাকি রূপালী রঙের বাঁকা কাষ্ঠখণ্ড মাত্র?

মনের তলে আমার বিস্ময়ের ঘোর। যাযাবরী ভিখারিনীর চোখে-মুখে এত আয়োজনই বা কেন? এত শাণিত দীপ্তি কীসের! করুণা-প্রার্থিনীর এ নির্লজ্জ বহ্নি ছড়ানো কেন? এ কি যাযাবরী রক্ত প্রবাহেরই স্বভাব? নাকি, ঘরছাড়া মেয়ের সেই চিরাচরিত অভিশপ্ত জীবন পয়োনালীর ক্লেদ! অথবা, জীবন-প্রস্তরে ঘা খেয়ে খেয়ে প্রতি মুহূর্তে সে শাণিত ও দীপ্ত।

চোখ সরিয়ে নিলাম। লজ্জা হলো, সঙ্কোচ হলো মনে মনে। নিজেকে আমরা ভুলতে পারি না বোধ হয় ক্ষণেকের তরে। সবাই বলেছে, সে সর্বনাশী। শুধু সর্বনাশী। সর্বনাশেরই আয়োজন তার চোখে-মুখে বেশে।

যে সব হারিয়ে, পথে এসে দাঁড়িয়েছে হাত পেতে, সর্বনাশের আগুন তো জ্বালাবেই, সে। যার কিছু নেই, সর্বনাশের খেলা তো সাজে তারই। তাকে ভিক্ষে দিচ্ছে কেউ কেউ যেচে। কত লুব্ধ চোখের পেছনে, ভিখারিনী হয়েও রানীর মতো মাথা তুলে রয়েছে দাঁড়িয়ে। মাথা নুইয়ে অগ্রসর হলাম পথে। পথিকের স্বভাবসুলভ চাউনি দিয়ে অভিনন্দিত করতে পারলাম না তার দীপ্ত হাসিকে। সে মন নেই, সে সাহসও নেই। ঘূর্ণি ঝড় এল, আবার চলে গেল। যেন সেই রূপকথার কাহিনীর আঁউ মাউ কাঁউ শব্দের মতো ভিখারিনী-বাহিনী ছুটে চললো আবার। ওই শব্দের মধ্যে ব্যাকুলতা, ব্যস্ততা। এ ওকে ধাক্কা দিচ্ছে, ও একে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। পরস্পরের মধ্যে হিসেব হচ্ছে, কে কত পেয়েছে। ঝগড়া হচ্ছে, হাসছে।

সমস্তটা মিলিয়ে শোনাচ্ছে একটা ব্যস্ত ত্রাস আর্তনাদের মতো।

কারা নিজেদের মধ্যে কথায় কথায় বলছে, হিন্দিতে বলছে, ভিখারিনীগুলো মারাঠার আওরত। জানি নে, কোন্ দেশের আওরত। কিন্তু এদের দেখেছি চিরকাল। দেশের মেলায়, বাজারে, শহরে। কলকাতার শহরতলিতে, শনি রবিবারে দেখেছি দল বেঁধে ঘুরতে।

বিদেশে বেড়ানো নাকি কপালে লেখা থাকা চাই। লিখে দেন নাকি কোনো এক বিধাতা। জানি নে, কে সেই বিধাতা, যিনি ঘর-ছাড়ার বৈরাগ্যের তিলক এঁকে দেন কপালে। কিন্তু আমার পোড়াকপালে তো সে-তিলক কোনোদিন পড়েনি জানি। তবু কয়েকবার গিয়েছি নিকট ভারতের এদিকে ওদিকে। কিন্তু ওই জাতের মেয়েদের দেখেছি সর্বত্র।

সেই চিরাচরিত চেহারা। চুল বাঁধার এদের কোনো ছিরিছাঁদ নেই। তবু কেমন একটা রকম আছে। যা শুধু মানায় ওদের রুক্ষ জটায়। কাপড় পরার বিচিত্র ধরন। আমাদের ঘরের মেয়েদের আয়াসসাধ্য দেব-সজ্জার চেয়ে ওদের ময়লা কাপড়ের অনায়াস বেষ্টনী তৈরি করে একটি বিচিত্র ছন্দ। আর কেন জানি নে, ওদের ধূলিমলিন কীটসমাচ্ছন্ন দেহে দেখেছি অটুট যৌবন।

ভাবি, আমরা কত সঞ্চয় করে বেরুই তীর্থযাত্রা পথে। মন্দিরে মন্দিরে ফিরি মাথা কুটে কুটে। ওরা ফেরে শুধু আমাদের পেছনে পেছনে, দু’টো পয়সার জন্য। এত যে তীর্থক্ষেত্রের আনাচে কানাচে ঘুরে ফেরে ওরা, ভগবানের এক ছিটে পুণ্যও কি বর্ষিত হয় না ওদের মাথায়?

কোলাহলমুখর জনবন্যার সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতে চলছিলাম, আর ভাবছিলাম এমনি এক দার্শনিক তত্ত্ব! আচমকা কানের কাছে হাসি শুনে থমকে গেলাম। আবার সর্বনাশী! পাশ দিয়ে, আঁচল উড়িয়ে তীরবেগে ছুটে গেল সামনের দিকে। কিছু ঠাহর করার আগেই, চকিতে তার পালতোলা নৌকা-আঁচলের পাশ দিয়ে উঁকি দিয়ে উঠলো দুই খর চোখের দীপ্ত তারা। তারপর নিরালা বনের পাখির ডাকের মতো আকাশে উধাও হয়ে গেল হাসি। পেছনে তাকিয়ে দেখি, তিন-চারটে প্যান্ট-কোট-পরা আধাবয়সী মানুষ লুব্ধ উৎসুক চোখে লক্ষ করছে তার গতিবিধি। পাশ থেকে কে বলে উঠলো, ‘হাসতি হ্যায়।’

ফিরে দেখি অন্ধ সুরদাস। আপন মনে বলছে। তার লাঠি এসে ঠেকছে আমার পায়ের কাছে। চোখের দু’টি পর্দা ঠেলে এসেছে সামনের দিকে। পর্দা দু’টি কাঁপছে থরথর করে। আর হাসছে, হাসতে হাসতে আপন মনেই আবার বলে উঠলো, ‘হাসতি হ্যায় কৌন?’

বলে আবার হেসে উঠলো নিজের মনে। যেন কথোপকথন করছে কারুর সঙ্গে। হাসতে হাসতেই আবার জিজ্ঞাসা করে উঠলো, ‘রাস্তা তো ঠিক হ্যায়?’

জানি নে, এ শুধু তার কথার কথা কিনা। জানি নে, এ শুধু তার স্বগতোক্তি কিনা। তবু বলে ফেললাম, ‘হ্যাঁ, রাস্তা ঠিক আছে।’

‘ঠিক হ্যায়?’ বলে সে আবার হেসে উঠলো। সরল ও বোকাটে মনের অভিব্যক্তির মতো সে-হাসি। তবু যেন, সামান্য একটু বিস্ময়ের ঘোর তার গম্ভীর কণ্ঠে। একটু বা রহস্য ছোঁয়ানো। তেমনি হেসে আবার জিজ্ঞেস করলো, বাবুজী, ‘আপকা-রাস্তা ঠিক হ্যায়?’ বলে সে হাঁ-করা হাসিমুখে তাকিয়ে রহলো আকাশের দিকে। রোদ লেগে চোখের সাদা পর্দা দু’টি রুপোর মতো উঠলো চকচকিয়ে। যেন আকাশের বুকে পেতেছে কান। জবাব আসবে ওখান থেকে। জবাব দিতে গিয়ে থমকে গেলাম। এ আবার কেমন প্রশ্ন? আমি রীতিমতো চক্ষুষ্মান মানুষ। অন্ধকে বাতলে দিচ্ছি ঠিক পথের ঠিকানা। সে উলটে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার ঠিক-ঠিকানা? তবু কথা বলতে গিয়ে আটকালো। পথের ঠিক আছে কিনা কে জানে! কিন্তু এক কথায় তার জবাব দিতে পারলাম না। বিশেষ করে ওই মুখের দিকে তাকিয়ে। আমার জবাব দেওয়ার আগেই সে হেসে উঠলো। এই ভিড় ও কোলাহলের মধ্যে অপূর্ব শান্ত উদাস তার কণ্ঠস্বর। বললো, ‘কোই নহি বতা সক্তা কিধর গয়ী সড়ক, কহাঁ গয়া রাস্তা। হ্যায় না বাবুজী?’

মনে মনে ভাবলাম, তবে কি সে নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করছিল শুধু? রাস্তা তার ঠিক আছে কিনা, এ শুধু জিজ্ঞাসা নিজেকে। এত লোক চমকে ফিরে তাকে বারবার জবাব দিয়েছে, আর সে শুধু এমনি হেসেছে মনে মনে। তারপর আবার নিজেকেই বললো হিন্দিতে, ‘বাবুজী, আমি তো অন্ধ। জন্মান্ধ! মায়ের পেট থেকে পড়ে এক-ই বুলি শিখেছি আমি, রাস্তা ঠিক আছে তো? সারা সংসার যখন চেঁচিয়ে বলে, সব ঠিক হ্যায়, তখন আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। সব ঠিক হ্যায়? দুনিয়ার সব ঠিক আছে? তবে আমি কেন সব কিছুর ঠিক পাইনে? বাবুজী, ওহিসে পুছা কি, আপকা-রাস্তা ঠিক হ্যায়?’

বলে, আবার সে লাঠিটি চারপাশে একবার ঘুরিয়ে বলে উঠলো, ‘রাস্তা ঠিক হ্যায়?’

তারপর তার কম্পিত সাদা পর্দা দু’টি ঠেকে রইলো আকাশে। ওই ভাবেই সে এগিয়ে চললো আমার পাশে পাশে। আর ঘুমন্ত শিশুর দেয়ালা করার মতো তার হাঁ-করা মুখে কখনো হাসি, কখনো গাম্ভীর্য!

কে বলে উঠলো, ‘কা হো সুরদাস, গানা কাহে বন্দ কর দিয়া?’

সুরদাস বোধ হয় গানই ভাঁজছিল। আবার গান ধরল।

সামনে তাকিয়ে দেখি, পথ রোধ করেছে ঝুসির উচ্চ ভূমি। সেই উঁচু জমির উপরে, নিচে থেকে উঠে গিয়েছে সিঁড়ি, হঠাৎ বাঁক নিয়েছে বাঁদিকে। হারিয়ে গিয়েছে একটি বিশাল বটের আড়ালে। তার উপরে, মনে হলো প্রাচীরবেষ্টিত কেল্লা মাথা তুলেছে আকাশে। উত্তরাংশের কার্নিসবিহীন সরল প্রচীর নিচের দিকে নেমে এসেছে। সেই প্রাচীরের গায়ে মস্ত একটি অন্ধ গুহামুখের গহ্বর। গহ্বরমুখ থেকে আর একটি সিঁড়ি নেমে এসেছে বালুচরে। সেই গুহামুখ থেকে পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে নেমে আসছে নরনারী। সিঁড়ির ধাপ এমন এঁকেবেকে নেমে এসেছে, চলন্ত নরনারীর বাহিনীকে দেখাচ্ছে যেন দূর-থেকে-দেখা ধীর গতি ঝরনার মতো।

শুনেছিলাম, এটি সমুদ্রগুপ্তের কূপ। কিন্তু কূপ কোথায়? এ যে দেখছি, চারিদিক থেকে একটি সুরক্ষিত সু-উচ্চ গড়ের মতো। হঠাৎ মনে হয়, যেন এক সামরিক গাম্ভীর্যে ও কৌশলে এর চারপাশে গোপন রয়েছে সমরায়োজন।

দু’দিকের দুই সিঁড়ি দেখে বুঝলাম, দক্ষিণেরটি আরোহণী। উত্তরে অবতরণিকা। আরোহণীর মধ্যপথে ঝুরি-নামা প্রাচীন বটগাছ। ছায়া ভরে রেখেছে সিঁড়িতে। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই শত শত বছরের এই অশ্বথের ঝুপসী ঝাড়। মাটি থেকে আকাশ পর্যন্ত, উচ্চভূমির কোলে কোলে, ফাটলে, গর্তে সর্বত্র ছাপ প্রাচীনতার। কেবল সরল ও খাড়া প্রাচীরের রোদচমকিত সাদা রঙ যেন নতুনের ছোঁয়ায় ঝকমক করছে।

আমার পেছন থেকে অন্ধ সুরদাস জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবুজী, সামনে টিলাকে সিঁড়ি হ্যায় না?’

টিলা? সমুদ্রগুপ্তের কূপ নয়? লোকের মুখে মুখেও একই কথা। সমুন্দরগুপ্তের টিলা। কিন্তু এ অন্ধ কেন জিজ্ঞেস করছে? সে কি উঠতে পারবে?

বললাম, ‘হ্যাঁ, সিঁড়ি। কিন্তু, তুমি তো উঠতে পারবে না সুরদাস।’

সে একটু হেসে বললো, ‘নহি সকেঙ্গে?’ বলে ঘাড় তুলে তাকালো উপর দিকে। মুখগহ্বর থেকে বেরিয়ে-পড়া জিভ নাড়তে লাগল। যেন সে দেখতে পাচ্ছে, দেখে নিচ্ছে, কত উঁচু। তারপর বললো, ‘বাবুজী, এ তো আমার পহলী দফা নয়। আরো তো কিনি দফা উঠেছি।’

বলে হাসলো। হেসে ঘাড় ফেরাল ডাইনে বাঁয়ে। দেখলো পেছনে। আবার বললো, ‘বাবুজী, আপ চলা গয়ে?

বললাম, ‘না।’

যেতে পারছিলাম না। সে অন্ধ। কত অন্ধ দেখি পথে পথে। পথ চলতে তাদের সঙ্গে কথা বলিনে। তাকাই নে ফিরে। জিজ্ঞেস করলে জবাব দিই। দয়া হলে অন্ধ ভিখারিকে পয়সা দিই দু’টো। ওই পর্যন্তই।

কিন্তু ফিরে তাকাতে হলো আজ। তাকাতে হলো এই কুম্ভমেলায় এসে। সুরদাস অন্ধ। কিন্তু তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি যেন চক্ষুষ্মানদের মতো। তার ওই আত্মভোলা হাসির মধ্যে কোথায় যেন আত্মগোপন করে রয়েছে এক গম্ভীর সচেতন, অভিজ্ঞ, সহৃদয় মানুষ। এক উদাস কৌতুক ও রহস্যের ছোঁয়া লেগে রয়েছে যেন তার ভাবে-ভোলা মুখে। আমি তাকে দেখছি। কথা শুনে মনে হয়, আমাকে সে তার চেয়ে বেশি দেখছে।

সে তেমনি হেসে বললো, বাবুজী, ‘বোলি হ্যায় সব-কি, চঢ়না মুশকিল, উতারনা সরল! মগর, হম্ তো অন্ধা বাবুজী। জনম সে অন্ধা। হমকো চঢ়না সরল, উতারনা মুশকিল।’

বলে, সে হাসলো আবার ঘাড় কাত করে। এমন হাঁ-করা হাসি যে, তার মুখগহ্বরের মধ্যে আলজিভটি পর্যন্ত নড়তে দেখা যায়।

কিন্তু অবাক হলাম, তার উলটো কথা শুনে। চিরকাল তো শুনে আসছি, উঠতে পারলে নামা যায়! উঠতে পারে ক’জনা! বললাম, ‘ওঠাই তো কঠিন সুরদাস। নামতে পারে সবাই।’

সে বললো, ‘হবে হয়তো। বাবুজী, আপনার আঁখ বন্ধ করে দিই। ধরিয়ে দিই রাস্তা। আপনি চড়ে যেতে পারবেন। কিন্তু নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়বেন। তাই নয়? একবার শোচিয়ে বাবু আঁখ বন্ধ করকে।’

বলে সে দু’টি ঘষা পাথরের মতো চোখ নিয়ে তাকালো আমার দিকে। হাসি চিকচিক করছে তার ওই ঘষা পাথরে।

কিন্তু চোখ বুজে তো নামিনি কখনো। ভাববো কেমন করে! আমি এক শহুরে বুদ্ধি-অভিমানী মানুষ নীরবে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। এ অন্ধ আমাকে বলছে ওঠা-নামার কথা।

সে আড়-মাতালার মতো হাসলো মাথা নেড়ে। ডাকল যেন কোন্ সুদূর থেকে, ‘বাবুজী।’

বললাম, ‘বল।’

‘ওইসা শোচ্‌না বঢ়ি মুশকিল, হ্যায় না?’ বলে ঘাড় নেড়ে গুনগুন করে উঠলো, আঙুল দিয়ে তাল ঠুকল নিজের লাঠিতে। কী বললো, গানের কথায় বুঝতে পারলাম না। তবে তার ঘাড় দোলানি দেখে বুঝলাম, নিজের বক্তব্যের অর্থ বোঝাচ্ছে সে কোনো এক সজনিকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে। তারপর বললো, ‘বাবুজী, চঢ়কে উচা যো মিলি হাতমে, উতরানে কি বখত রাখো সামালকে। নাহি তো, ও গির যায়েগী, ঢুড়না বেকার হোগী। কেঁও কি, তুম তো অন্ধা হ্যায় না? অন্ধা, তুমকো রো’নে পঢ়েগা!

মনে করলাম, এ বুঝি শুধু অন্ধেরই বেদনা। দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ কেমন করে তা অনুভব করবে!

বললাম, ‘তাই হবে হয়তো সুরদাস।’

সে বললো, ‘সায়েদ নহে বাবুজী, সচ্চা। মহাপুরুষ লোক উজান চলে আপনা সাধনপথে। কাঁহে? পাপের দরিয়া বয়ে চলেন তিনি পুণ্যের উজানে। মগর বাবুজী, দরিয়া বয়ে কি নামে আপ্‌না সাধনপথে? নিচের পথকে হর্ আদমি ডরতা। পাপ ঔর মরণের মায়া তো হ্যায় ওহি রাস্তার কিনারে কিনারে। তবে? হুঁশিয়ার সে চড়ো, মগর উতারো জায়দা হুঁশিয়ারসে। সহজ ভেবে যদি সহজে নামো সজনী, তোমার পা পিছলে কোথায় চলে যাবে, হারিয়ে যাবে কোথায়! গর্দা পড়বে তোমার সারা গায়ে, আর অন্ধ সংসার তখন হাসবে, ধিক্কার দেবে তোমাকে।’

সহজ সমজকে মৎ চলিহো সজনী,
রাস্তা বহুৎ টেঢ়া হ্যায়।।

‘বাবুজী, ক্যায়া হম গলত্‌ বতায়া।’

অন্ধকারের ঘূর্ণি জলরাশি যেন, আচমকা আলোর মাঝে নির্মলরূপে টলমল করে উঠল। সত্যি, পদস্খলিত মানুষ যখন নামে, মৃত্যু ওত পেতে থাকে তার জন্যে। প্রাণের জিনিস মুঠোয় নিয়ে যখন শিশু নাচে, তখন-ই তো কোন ফাঁকে সব হারিয়ে তার কান্না আসে। মানুষ উঠতে গিয়ে পড়ে না। নামতে গিয়ে পড়ে। পড়বেই তো। নামবার পথে টান যে বেশি! আনন্দে অধীর পদযুগল যে তখন শিথিল ছন্দে চলে নেচে নেচে।

চোখ থাকতে বুঝলাম না। বুঝতে হলো অন্ধের কাছ থেকে। তাকিয়ে দেখি, তার সারা মুখ আলোকময়। আলো তার অন্ধ চোখে, মুখে। তার পাথরের মস্ত শক্ত চওড়া বুকটিতে উজ্জ্বল বর্মের মতো ঝলকিত রোদ! রূপ-অন্ধ চোখে আমি তাকিয়ে রইলাম অন্ধ জীবনসন্ধানীর দিকে।।

সে বললো, ‘বাবুজী, গোঁসা তো করলেন না আপনি?

গোঁসা? রাগ করবো তার উপরে? কেন? বললাম, ‘রাগের কথা তো তুমি কিছু বলোনি সুরদাস?’

সে হেসে বললো, ‘সচ্ বাবুজী? আমি মূর্খ। আমার কথায় সবাই হাসে, গোঁসা করে। বাবুজী, দুনিয়া অন্ধ, সবসে বড়া অন্ধা হাম। সেই জন্যেই তো বারবার বলি, রাস্তা তো ঠিক হ্যায়। সোচ্ বুঝকর চলো সজনী। রাস্তা তো ঠিক হ্যায়?’

বুঝলাম, অন্ধ যা-ই বলুক, যে রাস্তার জন্য, তার অত জিজ্ঞাসাবাদ, তা নিশ্চয়ই ভগবানের দোরগোরায় গিয়ে পৌঁছেছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাস্তাটা কীসের সুরদাস? ভগবানের?’

সুরদাস বিনয়ে হাতজোড় করে যেন ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়ালো নুয়ে। বললো, ‘বাবুজী, ভগবান কে, তা তো আমি জানি নে। দুনিয়া অন্ধকার। আমি আলো খুঁজে ফিরছি। বাবুজী, আপনি কী খুঁজছেন, সে তো আপনি জানেন। আর রাস্তা? হাজারো রাস্তা পড়ে আছে। কোন্ রাস্তা ধরবেন, সে তো জানে আপনার মন। যর্ মন ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায় রাস্তা।’

বলে হেসে উঠলো। তারপর হঠাৎ বললো, ‘বাবুজী, লকরী কা দুকান হ্যায় না এঁহা?’

দেখলাম, সত্যি, একটি জ্বালানী কাঠের স্তূপ রয়েছে অদূরে উত্তরে। স্তূপের উপর দু’টি কিশোর-কিশোরী দিব্যি গা এলিয়ে দিয়ে রয়েছে পড়ে। বোধ হয় রোদ পোহানো হচ্ছে। বললাম, ‘আছে। কী করে বুঝলে?’

‘হাওয়াসে লকরীকে বাস আতি হ্যায়। হম্‌কো থোড়া নিশানা দিজীয়ে বাবুজী, হম হুঁয়া হি বৈঠেঙ্গে।’

বললাম, ‘কেন? তুমি ওপরে উঠবে না?’

সে বললো, ‘নহি।’

হাত ধরে তাকে কাঠের স্তূপের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিলাম। দিয়ে বললাম, ‘তুমি কেন এসেছ সুরদাস এই ভিড়ের মেলায়? তোমার তো কষ্ট হবে?’

চলতে গিয়ে দাঁড়ালো সে। বললো, ‘বাবুজী, ঘর ভি অন্ধকার, বহার ভি, তখলিফ হর্ জায়গা পর। তব্‌ আনন্দ কাঁহা হ্যায়! ‘

বলে সে লাঠি ঠুকে এগিয়ে গেল। এতক্ষণ ভাবি নি। এখন তার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করলাম সতর্ক দৃষ্টিতে। যদি হোঁচট খায়! কিন্তু সে টুক টুক করে গিয়ে বসলো ঠিক কাঠের গাদার নিচে উয় বালুতে। বসে ফিরল আবার এদিকে। মুখে সেই হাসি। যেন আমার দিকে ফিরে তাকালো বিদায়ের হাসি নিয়ে।

ঘরে ও বাইরে যার অন্ধকার, সর্বত্র যার নিরানন্দ, তার আনন্দ কোথায়? সে কি শুধু এই পথের পরে পথে, পথচলার মধ্যে? টিলাতে ওঠবার সিঁড়িতে পা দিয়ে থামলাম। তাই তো, একটি পয়সাও দিলাম না সুরদাসকে। কিন্তু সেও তো চায়নি। ফিরে দেখি, সে ওই কিশোর-কিশোরীর সঙ্গে হাসি ও গল্পে মেতে উঠেছে। আর আশ্চর্য! কিশোর-কিশোরী দু’টি দিব্যি তার পাশে এসে বসেছে। হাত তুলে দিয়েছে সুরদাসের ঘাড়ের উপর। আর সুরদাস যেন সদা হাস্যময় একটি আনন্দের প্রতিমূর্তি। শিশুদের সঙ্গে খেলায় মাতা, ওই কি তার আলো খোঁজা?

সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম উপরে। উপরে উঠে সামনে পেলাম একটি পরিষ্কার চত্বর। বাঁয়ে কয়েকটি ছোটখাটো খুপরি। মন্দিরের গম্বুজের মতো সাজানো রয়েছে সেই খুপরির মাথা। ভেতরে সিঁদুরলেপা ছোট ছোট পাথরের নুড়ি। শুধু নুড়ি নয়। ছোটখাটো পাথরের মূর্তিও আছে। কারুর হাত ভাঙা, পা ভাঙা। মুখ ভেঙে গেছে অনেকের। বুঝলাম, বছরের পর বছর এসব খুপরির পাথরের দেবতারা থাকেন নিরালায় ঘুমন্ত, উপবাসী। মরশুম এসেছে, তাই ধোয়া -পৌঁছা হয়েছে। প্রতি খুপরির পাশে বসেছে পাণ্ডারূপী শিখাধারী ব্রাহ্মণ। পরিচয় পাড়ছে দেবতার। দান-ধর্মের উপরোধ চলেছে রীতিমতো গলা ছেড়ে। আর তীর্থযাত্রীর পয়সা ঝুনঝুন বেজে উঠছে খুপরি ঘরে।

বালুচর থেকে উঠে এলাম এক ছায়াচ্ছন্ন গ্রামে। গ্রাম-ই তো। ঝুসি গ্রাম। প্রতিষ্ঠানপুর। প্রাচীন বৎস দেশ। কিন্তু এখানে কোথায় সমুদ্রগুপ্তের কূপ?

বাঁদিকে পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, গৃহস্থের বাসভূমি। ডাইনে গভীর খাদ, খাদের ভিতরে ঘন জঙ্গলে বাসা বেঁধেছে অন্ধকার। নিচে থেকে সোজা উঠে এসেছে একটি নাম-না-জানা গাছের সবুজ শির। হাত দিয়ে তার পাতা ধরা যায়। এ শীত রুক্ষ ঋতুতে এত দক্ষিণ্যে কে ভরে দিল সারাটি গাছ! এই কি কূপ?

উঁকি দিলাম। খাদের মধ্যে মানুষের ছায়া। গুঞ্জন কলকাকলী। কী ব্যাপার? লক্ষ করে দেখলাম, খাদের গায়ে একটি সরু রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে পিল পিল করে চলেছে মানুষের স্রোত। স্রোত গিয়ে ঢুকছে একটি অন্ধ সুড়ঙ্গে। তাহলে ওই কি কূপ? কিন্তু যাওয়ার পথ কোথায়?

মুখ তুলে তাকালাম খাদের ওপরে, দক্ষিণ দিকে। ওপরেও একটি বাড়ি। পুরনো বাড়ি। গায়ে তার মেরামতের তালি। সেদিকেও চলেছে জনস্রোত। সামনে তাকিয়ে দেখি, উঁচু টিলার মাটি গিয়ে ঠেকেছে পুবের আকাশে। ওই দিক দিয়েই ঘুরে চলেছে সবাই দক্ষিণ দিকে। পাঁচিলের পাশ ঘেঁষে ভেসে গেলাম পথের স্রোতে। এমনি করেই পথ। একজন চলে গিয়েছে কবে। তারই পায়ের দাগে দাগে আর-একজন, তারপর শত শত লক্ষ লক্ষ। পথের পরে পথে, নতুন থেকে নতুনের সন্ধানে। জানি, যাচ্ছি নে কোনো নতুনের সন্ধানে। পথও নতুন নয়। কিন্তু পুরনো পথে আমি তো নতুন। আমার যে সবই নতুন।

পথের ধারে ধারে, দলে দলে সাধু। অপলক চক্ষু আর গম্ভীর মুখ। নজরটি তীর্থযাত্রীদের মুখের দিকে। কোথাও কাঠের আগুন আর গঞ্জিকা সেবন চলেছে। তীর্থযাত্রী ও যাত্রিণীরা কেউ কাছে বসছে আবার বসছেও না।

হঠাৎ দাঁড়াতে হলো। ভয়ংকর ভিড়। সামনে সেই পুরনো ভাঙা বাড়ি। একটা নয়। কয়েকটি ঘর। ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে ছড়িয়ে। সবই ভাঙা, পুরনো, নোনা ধরা। চোখে ভেসে উঠলো, ঘোষপাড়ার দোলমেলার ছবি। কাঁচরাপাড়ার ঘোষপাড়া। তবে তফাত আছে অনেকখানি। সেখানে চলে খোলকরতালের সঙ্গে কীর্তন ও নামগান মেয়ের দল গায়। পুরুষের দল গায়। আবার এরই মধ্যে, কোথাও ভাঙা হারমোনিয়ামের ভাঙা সুর। তার চেয়েও ভাঙা হাঁফ-ধরা রুগ্ন মেয়ের সরু গলায়, ‘পীরিতের রীতি না বুঝিলেন গো সখী’ গান। চোখের কাজলের চেয়ে কালো তার চোখের কোল। হারমোনিয়ামের সাদা রীডের চেয়েও সাদা তার শীর্ণ আঙুলের নখ। বাঙলার দূর জেলার গ্রাম্য বাবুরা দাঁড়িয়ে বাহবা দেন। পকেট থেকে গুনে গুনে পয়সা তুলে দেন তাঁরা। হাল আমলের কথাই বলছি।

সেখানেও এমনি পুরনো বাড়ি রয়েছে কয়েকটি। ভাঙা বাড়ি। কোনটিতে সতীমায়ের স্মৃতি। কোনটিতে বাবার

কিন্তু এখানে গান নেই। হারমোনিয়ামের শব্দ নেই। নেই ভাঙা বন্দরের বারবনিতার আসর। পূর্ণিমার রাত্রে ঘটা করে ফাগ মাখানো, খাওয়ানো আর ভয়াবহ উৎসবের মাতামাতি। এখানে ব্যস্ততা, ব্যগ্রতা, ব্যাকুলতা। যানে দো বাবুয়া। যেতে দাও, দর্শন করতে দাও। আর সমতল থেকে অনেক উঁচুতে, ঝরাপাতা আর পুরনো ইট ছড়ানো, ছায়া-ভরা এই তীর্থাঙ্গন বিষণ্ণ ও উদাসীন। একই সঙ্গে উদার ব্যোম ব্যোম্ শব্দ ও বহু কণ্ঠের আরাধনা, আহবান ও হাসি। এ যেন অনেক বিশাল। আলোর ছড়াছড়ি চারিদিকে। আকাশ যেন হাতের কাছাকাছি। আর বিচিত্র থেকে বিচিত্রতর বেশ নরনারী, তার ভাষা, তার রূপ।

বুঝলাম, কোনো দেবতা অধিষ্ঠিত আছেন এখানে। তাই ঠেলাঠেলি ও ভিড়। ভাবছিলাম ভিড় ঠেলে ঢুকব কিনা। কে যেন জাপটে ধরল পেছন থেকে। মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, শুধু একখানি বহুরঙে রঙিন ছাপা উড়নি। অবাক হয়ে মানুষকে দেখবার জন্য কষ্ট করে ফিরতে হলো। ক্লান্ত কম্পিত একজন মাড়োয়ারী বৃদ্ধা। পোশাক দেখে আমার মনে হলো তাই। বেচারির ঘাড়ের উপর মাথাটি পর্যন্ত ঠকঠক করে কাঁপছে। স্তিমিত দৃষ্টি উদ্ভ্রান্ত। শণনুড়ি সাদা চুলে সোনার টিকুলি। গলায় ভরি দশেকের একটি সোনার হার নয়, শিকল বিশেষ। চোপসানো গাল, দাঁতহীন মাড়ির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে জিভ। সর্বাঙ্গে আবিরের মতো ধুলো ছড়ানো।

আমি যে মানুষ, সেটা বোধ হয় খেয়াল-ই নেই। যেন পাথরের মাঝে একখানি খুঁটি ধরে বুড়ি টাল সামলাচ্ছে, বিশ্রাম করছে। সরতে গেলে পড়ে যাবে। কিন্তু আর-কিছু না হোক, বৃদ্ধা যা ভারী, তাতে আমাকেই টাল সামলাতে ব্যস্ত হতে হচ্ছে। কিন্তু বলবো কাকে? যাকে বলব, সে তো ফিরেও দেখছে না। দু-হাতে জাপটে রয়েছে ধরে। আর আশ্চর্য! এমন একটা ব্যাপারের প্রতি এ ভিড়ের ভ্রূক্ষেপও নেই।

কয়েক মিনিট পর বৃদ্ধা হঠাৎ মুখ তুলল। তার মাথাটি দ্বিগুণ জোরে নড়ল ঠকঠক করে। চোখ দু’টি গেল বুজে, মুখটি হাঁ হয়ে বেরিয়ে পড়লো দাঁতহীন মাড়ি। এর নাম হাসি। সত্যি, যেন এক অনির্বচনীয় সুধা ঝরে পড়লো সারাটি মুখে। তারপর দু’হাত দিয়ে আমার মুখে মাথায় বুলিয়ে দিল হাত। দিয়ে আবার হাঁপাতে হাঁপাতে হারিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে।

বুঝলাম আমার কাজ ফুরিয়েছে। ভিড়ের মধ্যে না গিয়ে, পুবদিকে এগিয়ে গেলাম। দক্ষিণদিকে ভাঙা পাঁচিলের বেষ্টনী, পুব ও উত্তরে পাতাঝরা গাছের ফাঁকে ফাঁকে আকাশ দিচ্ছে উঁকি। কিন্তু ওসব দিকে মানুষের বড় আনাগোনা দেখছিনে। সকলের ঠেলাঠেলি, মাথা কোটাকুটি মন্দিরের দরজায়।

দক্ষিণের ভাঙা পাঁচিলের উপরে উঁকি মেরে নিচে দেখলাম মানুষের স্রোত। কিন্তু এমনভাবে নেমে গিয়েছে টিলার ঢালু জমি, তার চার পাশে এত ছোটখাটো সুড়ঙ্গ, যেন ভেরী বেজে উঠলে এখুনি তীরধনুক হাতে বেরিয়ে পড়বে শত শত সৈনিক। পুবদিকে গেলাম। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দূর সমতলে অড়হরের ক্ষেত দেখা যাচ্ছে। উত্তর দিকে সমতলে এদেশীয় গ্রাম। আমাদের বাঙলা চোখে কেমন যেন শ্রীহীন ঠেকে এই গ্রামগুলি। গ্রাম নয়, যেন বস্তি। খোলা-ছাওয়া চালাঘর। কোথাও বেড়া ও পাতার ছাউনি নেই। একটি হিন্দি প্রবাদ আছে-

ছাজা বাজা কেশ।
তিনো মিলকে বাঙলা দেশ।।
চিনি…দহি।
বাঙলামে নহি।।

কতখানি সত্য জানি নে। তবে, ঘরছাওয়া ও বাঙলাদেশের ঢাকের বাজনা, এর সঙ্গে পাল্লা চলে না। আর এদেশের তুলনায় বাঙালিনীর কেশ রচনা, সে-কথা বলতে হয় না রূপদর্শীকে। সেই কবরী-বন্ধনে-বাঁধা বাঙালির মন ও হৃদয়-গাছের ফাঁকে ফাঁকে, ওই সমতলের গ্রামেও দেখছি ভিড়।

গ্রাম দেখতে দেখতে চমকে উঠলাম। সামনেই একটি থোকা থোকা ফুলে-ভরা সজনে গাছ। নিজের দেশের গাঁয়ের পথে এর ছড়াছড়ি। কিন্তু এখানে সজনে-সুন্দরীর এ বিচিত্র অঙ্গসজ্জা দেখে ভরে উঠলো চোখ। ভেতরে আমার খুশি-বিষাদের ছায়া। মনে হলো, কত যুগযুগান্ত না জানি আছি দেশ ছেড়ে। সেই বিরহ আমার ঘোচাল এবং বাড়াল এই ফুল সজনে।

সাদা সাদা ফুল। বোঁটায় তার কাঞ্জনবর্ণের ছোঁয়া। সোনা রুপোর অজস্র ঐশ্বর্যে যুবতী সজনে হাসিতে খুশিতে তুলেছে মাথা। তারই মধ্যে নবীনার লাজে ভয়ে সর্বাঙ্গ তার কিছুটা বা নম্র। হাল্কা গন্ধে ভরে উঠেছে তার চারপাশ।

চমক ছিল আরও। সজনের নরম ডাল কেঁপে উঠেছে থরো থরো করে। ফুল পড়ছে তলায়। উপুড় হয়ে ফুল কুড়োচ্ছে এক রক্তাম্বরী। কুড়োচ্ছে আর ভরছে কোঁচড়ে। ব্যাকুল হাতে কুড়োচ্ছে যেন পড়ে পাওয়া অমূল্য ধন।

দেখতে দেখতে দেখলাম। চোখ ফেরাই-ফেরাই করেও দেখতে হলো। রক্তাম্বরীর যে বাঁয়ে আঁচল। আঁচল বেঁধেছে কোমরে। যাকে বলে গাছ-কোমর। বাঙালিনী? এ যে বাঙলা-গাঁয়ের পাড়ায় এসে পড়েছি!

মুখ তুলল রক্তাম্বরী। সর্বনাশ! এ যে সত্যি করালরূপিণী রক্তাম্বরী! কালো মেয়ে। মেয়ে নয়, কালো বউ। না বউ নয়, আর-কিছু। মাথায় তার ঘোমটা নেই। এলানো রুক্ষ চুলের রাশি ছড়িয়ে পড়েছে কোমরের নিচে। কাঁধ-হাতা দৃষ্টিকটু লাল জামা। নিরলঙ্কার দেহ। গলায় মালা রুদ্রাক্ষের। অস্পষ্ট সিঁথি লেপা সিঁদুরে। বাঙলা সিঁদুরে। খাটো আঁটো শক্ত দেহ। বয়স অনুমান করা কঠিন। কিন্তু চোখ দু’টি প্রকৃত রক্তাম্বরীই বটে। জন্মের সময় কেউ বুঝি ফালা ফালা করে কেটে দিয়েছিল ওই চোখের ফাঁদ। নইলে অত বড় চোখ হয় কখনো? এ যে পটে আঁকা কালীর আকর্ণবিস্তৃত চোখ।

ঘাড় ফিরিয়ে ওই বিশাল নিষ্পলক চোখে তাকালে সে আমার দিকে। অসঙ্কোচ দৃষ্টিতে তার কৌতূহল ও বিস্ময়। নাকি ক্রোধ ও সন্দেহ, বুঝতে পারলাম না।

ওদিকে কোলাহলের গুঞ্জন। আর এখানে, এই ঝরাপাতা-ছাওয়া, টিলার বনভূমি হঠাৎ যেন আড়ষ্ট স্তম্ভিত হয়ে রইলো চোখের চাউনিতে! চকিত মুহূর্তে চারদিকে নিঃশব্দ, স্তব্ধ হয়ে গেল।

এ কোন্ বনবিহারিণী কপালকুণ্ডলা পড়লো আমার চোখের সামনে! ঠোঁটে নেই তার বিচিত্র হাসি, ভূ-লতায় নেই এস্ত আহ্বান। কিন্তু এখুনি কি টিলাভূমির এ নিঃশব্দ বনাঞ্চলটুকু আচমকা বিস্ময়ে শিউরে উঠবে এ যুগের কপালকুণ্ডলার কথায়, ‘পথিক, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?’

কিন্তু ঘুমন্ত বনানীর স্বপ্নভঙ্গের মতো শোনা গেল না সেই বিচিত্র কণ্ঠস্বর। উত্তর প্রদেশের টিলাভূমি উঠলো না শিউরে কুম্ভমেলার এই কপালকুণ্ডলার নতুন উপাখ্যানে, তার আগেই কাপালিকের প্রবেশ।

‘নমস্তে বাবুজী, নমকস্ত হই। কাঁহাসে আসতা হ্যায়?’

আসতা হ্যায়? ঘোর বাঙালি। পেছন ফিরে দেখি, রক্তাম্বরী। কালো মুখে আপ্যায়নের বিকট হাসি! লাল ধুতি, লাল চাদর। খোঁচা খোঁচা গোঁফ-দাড়ি ও লাল চক্ষু। তাও আধবোজা কিন্তু উজ্জ্বল। মাথায় পাগলের মতো জট-পাকানো চুল। ওজন বোধ হয় মণখানেক। গলায় রুদ্রাক্ষের বোঝা।

বলতে গেলাম, ‘তুমি’? মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়লো, ‘আপনি’?

আধবোজা লাল চোখ বিস্ফারিত করে বললো সে, ‘আজ্ঞে আপনি বাঙালি? মানে, দেশের মানুষ?’

তা বটে। আমি যে এ যুগের প্যান্ট-অলেস্টার-শোভিত আধুনিক নবকুমার! কাপালিকদের নিশ্চয়ই এতে বিলক্ষণ ভয় আছে। আমার জবাব শোনবার আগেই সে জবাব দিল। জোড় হাতে, নত হয়ে বিনয়ে গলে পড়লো, ‘আজ্ঞে আমার নাম অদ্ভুতানন্দ ভৈরব। লোকে বলে ভূতানন্দ, নয়তো আজ্ঞে, ভূত-বাবা। আমি কালীসাধক ভৈরব। নিবাস ছিল যশোরে। পাকিস্তান হয়ে গেল, ধর্ম রক্ষে হয় কিনা হয়, সেই ভয়ে আজ্ঞে এখন চব্বিশ পরগনায় বারাসতে আশ্রম করেছি। উনি, আজ্ঞে ওই মেয়েমানুষটি আমার ভৈরবী। বড় আশা ছিল মনে প্রয়াগে তীর্থদর্শন সাধন-ভজন করব। দিলাম আজ্ঞে পাড়ি জয় মা কালী বলে। সে যাক! আজ্ঞে আপনের নিবাস?’

যাক, কথা তাহলে থামল ভূতানন্দ ভৈরবের। কথা তো নয়, যেন ‘আজ্ঞে’ সম্বোধনের মালা গাঁথা। কালীসাধক, কিন্তু কথায় দেখছি হার মানে বৈষ্ণব। বোধ হয় যশোহরের হরিবংশের রক্ত আছে দেহে।

ওদিকে ভৈরবী নির্বিকার। সে ব্যস্ত ফুল কুড়োতে। বোধ হয় নবকুমার থেকে আশ্বস্ত হয়েছে ভৈরবের দর্শনে! জবাব দিতে গেলাম। তার আগেই ভূতানন্দ বলে উঠলো ‘নিশ্চয়ই, আজ্ঞে, কলকাতায় আপনার বাড়ি?’

বললাম, ‘কাছাকাছি।’

হাত জোড় করেই বললো, ‘তবে আসেন আজ্ঞে, আমার আশ্রমে একটু ধূলা দে যান।

তবে মানে কলকাতার কাছাকাছি বলে? তাছাড়া এখানে আবার আশ্রম কোথায়? তার উপরে ভূতানন্দর আশ্রম! ভয় অবশ্য নেই। শত হলেও আধুনিক কাপালিক তো বটে বলি দিতে পারবে না।

গেলাম তাদের সঙ্গে। অদূরে গাছের মাঝখানে হোগলা দিয়ে ঘেরা ঘর। সামনেটি ঝাঁটপাট দেওয়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। চারপাশে শুকনো পাতার ডাঁই। ভূতানন্দ ভৈরবের আশ্রম। হোগলার মাথায় আবার একটি লাল কাপড়ের ফালি নিশান। চালার ভিতরে একটি টিনের রঙ ওঠা সুটকেশ। অ্যালুমিনিয়ামের থালা দু-একটি। কম্বল-বিছানো বিচালী শয্যা।

ভূতানন্দ তাড়াতাড়ি কম্বলের ছেঁড়া টুকরো দিল পেতে। বললো, ‘বসেন আজ্ঞে, মন খুলে একটু ধর্মের কথা কই। রাতে আজ্ঞে ভল্লুকের ভয় করে, দিনের বেলা কেউ মাড়ায় না এদিকে। আর বাঙালি আসে কিনা তাও জানি নে। যত পাঞ্জাবী, আর মাড়োয়ারী, বলবো আজ্ঞে আপনাকে, যথার্থ জোয়ান জোয়ান মেয়েমানুষ মহা মহা সব সুন্দরীও বটে, আমার আশ্রমের চারপাশে সব, কী বলব, একেবারে দিনমানে, কী বলে, একেবারে ইয়ে করতে বসে। আমি সেরকম মানুষ নই আজ্ঞে, তাই। নইলে পরে আজ্ঞে, খ্যাঁকাড়ি দিলেও শোনে না। অথচ, আমার এখানে না হলে সাধনা চলে না। যাক, আপনি যখন এসেছেন

কথা তার থামল। বুঝলাম, তখন আজ্ঞে, আসুন একটু ধর্মালোচনা করা যাক। কিন্তু আমার মুখে যে ধর্মের বুলি ফুটবে না।

এদিকে ভৈরবী একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাটি নিয়ে পা ছড়িয়ে বসলো অদূরে। কোঁচড় থেকে ঢালল সজনে ফুলের গোছা। তারপর বিশাল চোখ দিয়ে আগে দেখলো আমাকে তারপর তার ভৈরবকে। মনে হলো, একটু যেন ফুলে উঠলো নাকের পাটা, ওই চোখেও বা একটু অগ্নিঝলক।

ভেরবীর চোখে-মুখে, গায়ে পায়ে, বসায় নড়ায় একটা আসন্ন দুর্যোগের ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে যেন। ভৈরবী যখন, তখন চোখে কিঞ্চিৎ অগ্নিঝলক থাকাই হয়তো স্বাভাবিক। পাকানো পাকানো ভাবটিও অস্বাভাবিক নয় হয়তো। কিন্ত ভাব-ভঙ্গিটা মোটেই সুবিধের মনে হচ্ছে না।

কিন্তু ভূতানন্দের সেদিকে খেয়াল নেই। সে দিব্যি জমিয়ে বসে বললো, ‘আচ্ছা, দাদাবাবু—’

দাদাবাবু? ভূতবাবা দেখছি আত্মীয়তাতেও দুরন্ত। বুঝলাম, ধর্মালোচনার ভূমিকা বিস্তার করা হচ্ছে। কিন্তু ভূতানন্দর গোল রক্ত চোখের ভাবটি যেন, আটঘাট বেঁধে পাতা হচ্ছে কোনো বিশেষ ফাঁদ। একবার ধরতে পারলে আর রেহাই নেই। হঠাৎ চোখ বুজে ভূ-দু’টি কপালে তুলে বললো, ‘বলেন তো, জগৎটি কার?’

সর্বনাশ! এমন বিরাট প্রশ্ন! ঝুসি-টিলার এ নির্জন স্থানে এত বড় দার্শনিক প্রশ্নও অপেক্ষা করেছিল আমার জন্য, তা জানতাম না। আর প্রশ্নের পরেই ভূতানন্দর চাপা চাপা হাসি, মৃদু মৃদু ঘাড় দোলানি। অর্থাৎ, সহজ কথা নয়। জবাব দিয়ে তবে উঠুন।

জবাব শুনে ভূতবাবা খুশি হবে কিনা জানি নে। তবু বললাম, ‘দেখে-শুনে তো মনে হয়, জগৎটা মানুষেরই। ‘

ভূতানন্দ খুশি হয়েছে বোঝা গেল। চকিতের জন্য চোখ দু’টি খুলে, আবার বুজিয়ে বললো, ‘বেশ বেশ, অর্ধেকখানি বলেছেন। কিন্তু কোন্ মানুষের?’

কোন্ মানুষের? কোন্ মানুষের আবার! আমাদের মতো মানুষেরই। বললাম, ‘বুঝলাম না তো!’

সে চোখ বুজেই বললো, ‘বুঝলেন না?’ চোখ খুলে বললো, ‘পুরুষ মানুষের না মেয়ে মানুষের আজ্ঞে?’

মানুষের এ ভাগাভাগি রীতিতে তো কখনো বিচার করে দিখি নি। কিন্তু ভূতানন্দ যে রকম চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে, বোঝা গেল ওইটাই তার আসল প্রশ্ন। যদি বলি, উভয়েরই, তা হলে সঠিক জবাব হয়। কিন্তু তার মনঃপূত হবে কি? তার চেয়ে ভূতানন্দর জবাবটাই শোনা যাক। বললাম, ‘তা তো ঠিক জানিনে।’

ভূতানন্দর হাসি ও দ্রুত ঘাড় দোলানিতে বোঝা গেল, আমার এ অজ্ঞতাই সে আশা করেছিল। তারপর এক খাবলা মাটি তুলে বললো, ‘এর নাম কী আজ্ঞে?’

শঙ্কিত হলাম। ভূতানন্দ কোনো ভৌতিক ভেলকি দেখাবে না তো? বললাম, ‘মাটি।’

‘আজ্ঞে ঠিক। মা-টি। অর্থাৎ?’

বলেই চকিতে ভৈরবীর দিকে ফিরে বললো, ‘কানটা এদিকে খাড়া রাখিস গো চণ্ডিকে।

চণ্ডিকে অর্থাৎ ভৈরবী, বোঝা গেল। কান খাড়া করতে হবে কেন, বুঝলাম না। কিন্তু ফিরে দেখি, অন্য রকম। ভৈরবীর বিশাল চোখজোড়া দপদপিয়ে উঠলো বারকয়েক। ঠোঁটের কোণে বাঁকা ঝিলিকে তার কপট হাসি না দুরন্ত রাগ, বোঝা মুশকিল। তারপর কান খাড়া করলো কিনা বুঝলাম না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত, সারা দেহে তার একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ খেলে গেল। দেখা গেল, সেই তরঙ্গের ধাক্কায় সে অন্য দিকে ফিরে বসেছে। কে জানে, ওইটিই কান খাড়া করার ভঙ্গি হয়তো!

ভূতানন্দ ফিরে দেখলো না সেদিকে। সে ভূ নাচিয়ে বলে চললো, ‘এই মাটি আজ্ঞে, আমার মা তা হইলে? আমার মা-টি! অর্থাৎ কিনা, মা ধরিত্রী। তা হইলে, জগত্মনি হইলেই মেয়ামানুষ। কেমন কিনা দাদাবাবু?’

ধরিত্রীকে যখন মা বলেছি, তখন ভূতানন্দর ভাষায় মেয়েমানুষ বলতে আপত্তি কম বললাম, ‘তাই হবে।’

একমণি মাথাটিকে বোঁ করে আর-এক পাক ঘুরিয়ে একেবারে নিশ্চল হলো ভূতানন্দ। বললো, ‘তা হইলে মায়েরও মা আছেন, কেমন কিনা আজ্ঞে?’

ঘাড় নেড়ে সায় দিতে হলো। মা থাকলে, তাঁর মা থাকবেন, এতে আর সন্দেহ কী।

ভূতানন্দ বিস্ফারিত চোখে, ভয়ংকর হেসে বললো, ‘তবে সেই মা কে?’

তা তো জানি নে। আমার এ অজ্ঞতা দেখে ভূতানন্দ খুশি বৈ দুঃখিত নয়! গলা নামিয়ে গভীর স্বরে বললো সে, ‘হুঁ, হুঁ, তোমার নাম জগৎমাতা জগত্তারিণী, শক্তিরূপিণী মা কালী। উনিই আজ্ঞে জম্মো দিলেন, দিয়ে আবার খেলতে লাগলেন। এর নাম মায়ের লীলে।’

বলতে বলতে আরও খানিকটা অগ্রসর হয়ে, গলা আরও নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো, ‘কিন্তুন্ একটা কথা হলপ করে কইতে পারি, প্রোয়াগে আজ্ঞে মা কালী নাই।’

চমৎকৃত হলাম। এত বড় গুহ্য সংবাদ তো আমার জানা ছিল না। বললাম, ‘তাই নাকি?’

‘তবে আর আপনারে কী বলতেছি আজ্ঞে? সারা মেলাটা টহল দিয়া আসেন, একটা মুখে যদি, হুস্‌ হুস্..’

কথার মাঝেই ভূতানন্দ হাততালি দিয়ে উঠলো। দেখলাম, সামনের গাছটিতে দু’টি কাক এসে ডাকছে কা কা করে। তাড়া খেয়ে কাক দুটো পালাল। ভূতানন্দ বিরক্ত হয়ে বললো, ‘মা নাই, মায়ের চ্যালারা সব ঠিক আছে। ওই যে দেখলেন, গায়ের রঙ কালো। ওই কালো কাউয়া আর কুকিল, সব মায়ের চ্যালা। কিন্তু ডাকের ভেদ দেখলেন তো? আচ্ছা, এট্টু বয়েন, চ্যালা যখন আসছে, শান্তিতে বসতে দিবে না। এট্টু জমিয়ে বসা যাক।’

বলে, সে তড়াক করে উঠে, দিব্যি তরতর করে সামনের গাছটায় উঠতে লাগল! অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, গাছটি প্রাচীন ও মস্ত বড় নিমগাছ। আশ্চর্য! কাক তাড়াতে ভূতানন্দ একেবারে গাছে উঠে বসলো! এ যে পাঁচুগোপাল থেকে আর-এক কাঠি উপরে!

ভৈরবীও দেখলাম, ওইদিকেই তাকিয়ে আছে। থাকতে থাকতেই তার সরু ও তীব্র চাপা গলায় ঝঙ্কার শোনা গেল, ‘মরণ! মুখে আগুন!’

এই তার প্রথম কথা। জানি নে, উত্তর প্রদেশের এ টিলাভূমি তার হাজার হাজার বছরের জীবনে এমন কড়া পাকের বিচিত্র বাঙলা কথাকটি আর কোনোদিন শুনেছে কিনা। কিন্তু ওই শব্দেই যেন চমকে উঠলো নির্জন টিলাভূমি। মড়মড়িয়ে উঠলো শুকনো পাতা। আর আমার কানের মধ্যে দিয়ে এক নতুন সুর গিয়ে পশল মরমে। এ কথার স্বাদ মিষ্টি নয়, ঝাল। কিন্তু বড় মিষ্টি ঝাল।

একটু ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার?’

প্রশ্ন শুনে ভৈরবীর রাগান্বিত কালো মুখে যেন হাসির ঝিকিমিকি দেখা দিল। যাকে বলে রাগের হাসি। বললো, ‘বিষ!’

বিষ? আমার অবাক মুখ দেখে ভৈরবীর হাসি একটু দুর্জয় হলো। বললো, ‘আপনেগো ভৈরব কয় মা কালীর চন্নামিরতো। মুণ্ডু! ওইতে ওনার নিশার মরণ হয়

নিশা অর্থ নেশা। কিন্তু নিমগাছের রসে! জানা ছিল না। আর জানতামও না, সেজন্য কেউ আবার এমন আয়োজনও করতে পারে। ফিরে দেখি, এক হাতে ডাল ধরে, আর-এক হাতে একটি সের-পরিমাণ টিনের কৌটো নামিয়ে আনছে ভূতানন্দ। যেখান থেকে টিনটি খুলেছে, সেখানে তেলের গাদের মতো রসের ধারা নেমে এসেছে কালো নিমডালের গা বেয়ে।

ভৈরবী আবার আমার দিকে ফিরে বললো, ‘বোঝলেন গো দাদাবাবু? ওই যে কইল না, এখানে ছাড়া ওনার সাধনা হয় না, তা এই মরণ-রসের জন্যে। এ ছেড়ে যাবে কমনে?’ কথা কটি নিচু গলায় বললো ভৈরবী। বলে, হাসতে গিয়ে একটা বিষাদের ব্যঞ্জনা ছড়িয়ে পড়লো তার সারা মুখে। হাসলো। কিন্তু হাসিটি করুণ হয়ে উঠলো হঠাৎ।

ভূতানন্দ খুশি মোরগের মতো তড়িঘড়ি এসে বসলো টিন নিয়ে। বললো, ‘কই গো চণ্ডিকে এট্টু ন্যাকড়াকানি দেও। ছেঁকে নিই।’

আমার দিকে ফিরে বললো, ‘সবই আমার মায়ের লীলে আজ্ঞে। মা নেই কিন্তু মায়ের প্রেত্যক্ষ কিরপা আছেন সবখানে। নইলে বলেন আঁজ্ঞে দাদাবাবু, মায়ের এমন পাদোদকের ভাণ্ডটি কে আমার জন্যে এখানে রেখে দিল! কী বলবো আজ্ঞে, যথার্থ ভালো বস্তু অমর্ততুল্য। আপনারা আঁজে লেখাপড়া জানা ভদ্দরলোকের ছেলে, নইলে, ঘাঁটাঘাঁটি ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে এমন পবিত্তর বস্তু, কী বলবো!

তার ‘কী’ বলবার মানে বোধ হয়, আজ্ঞে দাদাবাবু, আপনিও একবার চেখে দেখতে পারেন। বুঝলাম, কিন্তু নিমের রস নিশ্চয়ই ভয়ংকর কটু স্বাদ হবে। খাবে কী করে? জিজ্ঞেস করলাম, ‘খাবেন কী করে? তেতো হবে না?’

ভূতানন্দর মুখে বোধ হয় রসের ধারা বইতে আরম্ভ করেছে। তাড়াতাড়ি ঝোল টেনে বললো, ‘তিতা? আজ্ঞে, কথাই তো আছে, আগে তিতা পাছে মিঠা। ভোজনে বসে আগে নিমপাতা ভাজা খান না? আগে তো তিতাই লাগবে। সুখের আগে আজ্ঞে দুঃখু! নইলে সুখ হজম হইবে না। বসেন, আজকে সাক্ষাৎ কথা বলব আপনাকে।’

বলে আবার তাড়া দিল, ‘কই লো চণ্ডিকে, ন্যাকড়াখানি দিবি না এমনি ঢেলে দেব?’

কিন্তু চণ্ডিকের গরজ বড় বালাই। হঠাৎ সজনে ফুল মাটিতে রেখে, এলো চুলে ঝাঁকানি দিয়ে রক্তাম্বরী ফণা তুলল। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলো, ‘বড় যে কালী কালী হচ্ছে, বলি নজ্জা করে না?’

দুর্বিপাক। বুঝলাম, আমার ওঠার সময় হয়েছে। ভূতানন্দ নিতান্ত বিস্মিত হতভম্ব হয়ে বললো, ‘এই দ্যাখো, কী হইল তোর?’

চণ্ডিকে উত্তেজনাবশত দু’-হাত তুলে আঁট করে বাঁধল চুল। ঠোঁট বেঁকিয়ে তেমনি তীব্র গলায় বললো, ‘কী হইল, তার মরণ-ই তো দেখছি। ভদ্দরনোকের সামনে কইব সে-কথা, অ্যাঁ? বড় যে কালী কালী হচ্ছে, বলি নজ্জা করে না?’

কে বলবে, এটা এলাহাবাদ! কে বলবে, প্রয়াগের কুম্ভমেলা! কে বলবে, এ সেই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানপুর! এখানে বসে যে বাঙলাদেশের গেঁয়ো কোঁদল শুনছি। কোথা থেকে কোথায় এলাম, অমৃতের সন্ধানে! এ যে চিরকালের অমৃত বর্ষণ আরম্ভ করলো চণ্ডিকে আর ভৈরব! ফেলে পালানো ছাড়া উপায় নেই।

কিন্তু ততক্ষণে ভৈরব ভৈরবমূর্তিতে উঠেছে দাঁড়িয়ে। গায়ের রক্তবর্ণ উত্তরীয় টান মেরে কোমরে বেঁধে চিৎকার করে উঠলো, ‘কী! কালীনামের নিন্দে করছিস তুই? এত বড় সাহস?’

ভৈরবী চিৎকার করে না। চিবিয়ে চিবিয়ে বিধিয়ে বলে, ‘কালী নিন্দে করবো ক্যান? তোমার গুণ গাইছি যে গো! বলি, আর কতদিন চালাইবে এমনি করে? এত যে হাঁকাহাঁকি? ও চণ্ডিকে, সজনে ফুল তুলে নিয়ে আয়, চচ্চড়ি হইবে। তা কোন কালী দিয়ে চচ্চড়ি হইবে।’

ভূতানন্দ আমাকে সাক্ষী মেনে বললো, ‘দেখেন, দেখেন আঁজ্ঞে দাদাবাবু, সাবধান করে দেন, নইলে বলি হয়ে যাবে, এই বলে দিলাম।’

কী বিপদ! নিজের সাবধান হওয়ার সময় এসেছে। তার উপর আবার ভৈরবীকে! সে ক্ষমতা আমার নেই।

ভূতানন্দই আবার বলে উঠলো, ‘খুন হইবি চণ্ডিকে। আজ তোর বাপের কেষ্টোরই একদিন কি, আমারই একদিন। খবোরদার।’

বুঝলাম না, কে বাপের কেষ্ট। ভৈরবের মূর্তি দেখলে আতঙ্ক হয়। কিন্তু চণ্ডিকে অবলীলাক্রমে এই মূর্তির আরও সামনে গিয়ে বললো, ‘আমার বাপের কেষ্টোর গুণ আছে। তোমারই কালীনামের মুরোদ নাই। ওই যে বলে না, মুরোদ বড় মান, তানার ছেঁড়া দুইখান কান! জানলেন গো দাদাবাবু…’

কী জানবো, জানি নে। কিন্তু প্রমাদ বড় ভারী। তবু ফিরে তাকাতে হলো ভৈরবীর দিকে। সে তার লাল আঁচলখানি আরও কষে বেঁধে বললো, ‘তখন বোলে কত কথা। রেলের টিকিট ফাঁকি দিয়া আসলো, কইলাম, ওইখানে গিয়া গিলবো কী? বললে, চল না, নাখ নাখ নোক আসবে, আর দেদার চাল ডাল পয়সা দিবে। খাওয়ার আবার ভাবনা? নোকে যেচে দিবে। তা নোক এইখানে কী করতে আসে, সেতো শুনলেন ওনার নিজের মুখে। দিনরাত ওই মরণ-রস পাড়তিছে আর গিলতিছে। দু দিন ধইরা দাঁতে কুটা কাটি নাই গো দাদাবাবু, কুটা কাটি নাই। শীতে মইলাম, এক কণা আগুন নাই। এত এত সাধু হাত পেইতে বেড়াইতেছে, উনি নিচে লামতে পারেন না। অমন গোটা গোটা ফুলগুলান কি কাঁচা চিবুবো?’ বলতে বলতে গলাটা ধরে এলো যেন ভৈরবীর।

কিন্তু ভূতানন্দ এতবড় অপমান আর সইতে পারল না কিছুতেই। বিশেষ আমার মতো একজন অপর ভদ্রলোকের সামনে। কোথায় মৌজ করে একটু ধর্মালোচনা চলবে, তা নয়, শেষে মুরোদ নিয়ে টানাটানি। বড় দুর্বল স্থানে ঘা দিয়েছে ভৈরবী। তাই আমার দিকে আর ফিরে তাকাতে পারছে না ভূতানন্দ। মানুষের সম্মানে আঘাত লাগলে সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু সে সম্মান যদি মিথ্যে হয়, তবে তা সহ্য করা আরও মুশকিল। তখন সে আত্মরক্ষার জন্য শেষ উপায় অবলম্বন করে। ভূতানন্দর অবস্থা যেন খানিকটা তাই। সে রক্তচক্ষু বিস্ফারিত করে বললো, ‘তোর মতো মেয়েমানুষের মুখে এতবড় কথা! বজ্জাত, নষ্ট মেয়েমানুষ কমনেকার! তুই কি আমার ঘরের মাগ যে, তোরে দুবেলা খাওয়াবো বলে কিরা কাটছি মা কালীর দোরে—অ্যাঁ?’

চণ্ডিকা মুহূর্তে মাথা তুলে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়াল। কী চোখ! বিশাল চোখ দু’টিতে তার সত্যি আগুন ঠিকরে পড়ছে। লাল কাপড়ে ঢাকা তার বলিষ্ঠ দেহে কী অপূৰ্ব তেজ! দু’দিনের উপোসী কালো মুখে তার কেউটের ফণার মতো চমকানি। ভৈরবীর রূপ আছে কিনা, সন্ধান করে দেখিনি। কিন্তু কালো মেয়ের এমন বিচিত্র, ভয়ংকর সুন্দর রূপ আর কখনো দেখিনি। জানি নে, এমন রূপের সামনে কোনো পুরুষ কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে কিনা। কিন্তু ভূতানন্দ পারল না।

বোঝা গেল, ভূতানন্দ দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই সম্মুখ সমর ছেড়ে সে আচমকা পেছন থেকে অক্রমণ করেছে চণ্ডিকাকে। কিন্তু, মানুষ একবার যখন দুর্বলতাবশত পেছনে আশ্রয় নেয়, তখন তার পরাজয় অনিবার্য। সেই পরাজয়েরই শেষধাপে নামল ভূতানন্দ। লাথি মেরে ফেলে দিল সে তার অতি সাধের মাতৃ-পাদোদক। তারপর চেঁচিয়ে বললো, ‘রইলো তোর লজ্জা আর মুরোদ! চললাম আমি। মর তুই এখানে। আর খোল-করতাল এনে তোর বাপের কেষ্টোর ভজনা কর, লোক জুটবে খনি।’

বলে, দুপদাপ করে সোজা উত্তর দিকে গাছের আড়ালে আড়ালে আদৃশ্য হয়ে গেল।

হাসতে হাসতে মাথা ব্যথা! কোথা থেকে কী হয়ে গেল! মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম যেন আপদবিশেষ! কোন্ এক অদৃশ্য অপরাধের খোঁচা এসে যেন লাগলো আমার মনে। মনে হলো, অপরাধের মূল আমি। আমি না থাকলে, এমনি করে হয়তো বলত না ভৈরবী। সম্মানহানিতে অতখানি ক্ষিপ্ত হত না ভূতানন্দ।

কোথায় সমুদ্রগুপ্তের কূপ। আর কোথায় কী!

ফিরে যেতে উদ্যত হলাম। তবু যাওয়ার আগে ভৈরবীর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না। কিন্তু তাকিয়ে আর পা উঠলো না। থমকে দাঁড়ালাম।

ভৈরবীর গাল বেয়ে নেমেছে জলের ধারা। কী সান্ত্বনা দেব! যাদের কোনোদিন দেখি নি, জানি নে পরিচয়, তাদের হঠাৎ কলহের মাঝে কী কথা বলবো! যেটুকু জানি, সেটুকু তাদের উপোসের বেদনার কথা। আর যেটুকু ইঙ্গিত দিয়ে গেছে ভূতবাবা, তাকে ভিত্তি করে সান্তনা দেওয়া আমার সাজে না।

তবু এই টিলাভূমির নিরালা গাছের ছায়ায় ওই চোখের জল দেখে বিদায় নিতে বাধল। নিতে হবে জানি। তবু এই মুহূর্তে পারলাম না।

হঠাৎ ভৈরবী আদুরে বউটির মতো বলে উঠলো, ‘দেখলেন তো দাদাবাবু, কেমন করে কইয়া গেল। আজ দশ বছর তোমার সঙ্গে রইছি, আমি কি তোমার কেউ নয়? ওই কথা কইয়া আমারে অষ্টপোহর যাতনা দেয়। তোমার বউ না হইতে পারি, বউ-এর চাইতে বড়, আমি তোমার ভৈরবী। তোমার ধর্মে আমি, কম্‌মে আমি। তোমার সুখে আমি, দুঃখে আমি। কী বলেন গো দাদাবাবু, অ্যাঁ? কী আর কইছি! দুইদিন খাই নাই, শরীলে তো এট্টু কষ্টও হয়। কিন্তুন, দেখলেন তো’–বলতে বলতে তার ঠোঁট দু’টি কেঁপে উঠে, বিশাল চোখে অশ্রুর বান ডাকল। আর দূরদেশের এ টিলাতে দাঁড়িয়ে আমার বুকের মধ্যে ভরে উঠলো চাপা বেদনা। ভৈরবীর ক্ষুধাও যেমন আত্মপ্রকাশ করেছিল, তেমনি এবার আত্মপ্রকাশ করলো এক প্রেমবতী নারী।

চোখের জল নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভৈরবী আবার বললো, ‘বলো, আমি কি তোমার কেউ নয়? সাত পাক ঘুরি নাই ঠিক। ষোল বছরের মেয়া আইজ তিরিশ হইল। দাদাবাবু, এই চইদ্দ বছরে কত লক্ষ পাক দিছি তা জানেন ভগবান। উনি তো সাক্ষী আছেন! তবে? তবে ক্যান দেও ওই খোঁটা? আমি দুঃখু পাইলে তোমার পাপ হইবে না? আমার পুণ্যিও তোমার লাগবে না? মা কালীর নামে ইস্তিরি হইছি, ছান্নাতলায় বিয়ার চাইতে কি তা কম? ক্ষুদায়ও তুমি, ভরা পেটেও তুমি। আর কারে কইব গো, অ্যাঁ? আর কারে কইব?’

জলভরা মুখখানি কাছে এনে সে আমাকেই বললো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো। বলে সে নতমুখে, এলোচুলে দাঁড়িয়ে রইলো আমার সামনে। কোথায় রোষবহ্নি, কোথায় বা চণ্ডিকার চণ্ডালিনী মূর্তি! ক্ষুধা ও প্রেমের অপমানে দুর্ভাগ্যবতী অশ্রু-অন্ধ সেই চিরদিনের পাড়াঘরের মেয়েটি। এই বিরাট তীর্থক্ষেত্রে যখন সবাই দানে ধ্যানে ধর্মে ব্যস্ত-এস্ত উন্মত্ত, যখন আপন মনে মানুষ অরণ্যের বুকে খুশি বিহঙ্গটির মতো ফিরছে মনে আশ মিটিয়ে, তখন সে আমার সামনে খুলে ধরল মানুষের হৃদয় ও দেহের, বাস্তব ও বিচিত্রের এক রূপমহলের দরজা। ভাবি, এই তো বিশ্বের সবটুকু রূপ! হৃদয় ও জঠরের কামনা-বাসনা সৌন্দর্য-ই তো অপরূপ। এর শেষ নেই। এর বাড়া বৈচিত্র্য কই? এরপর বদলে দিল আবার আমার সুর। তাই তো নিয়ম। সুর তরঙ্গে তরঙ্গে শুধু রূপান্তর—ভৈঁরো থেকে গজল, গজল থেকে পূরবী, পূরবী থেকে ইমন, ইমন থেকে বেহাগের অশ্রুভরা অন্ধকার রাতে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকবো মৌন নক্ষত্রের চোখে।

তাই তো! থামবার কী আছে। কী আছে নিরানন্দের। সে তো আমার চলার পথে দিয়েছে নতুন চলার রস। সংযোজন করলো নতুন সুর।

ফিরে তাকালাম। ভূতানন্দর আশ্রম নয়, কুঁড়েঘর। সূর্য খানিক বেঁকেছে মাঝ-আকাশের কোল থেকে। নিম, তেঁতুল, সজনে, পিপুলের ছায়া ঝিলিমিলি। নতমুখী রক্তাম্বরী কালো মেয়ে। পায়ের কাছে তার অভুক্ত হাতের ছোঁয়া সজনে ফুল। মধুলোভী মৌমাছি এসেছে ছুটে, গন্ধে গন্ধে।

ভাবি, নিজের চোখজোড়ার মন ফিরিয়ে দেখি, সারা দেশে এমনি কত কুঁড়ের কত ঝি-বউয়ের পায়ের কাছে পড়ে আছে সজনে ফুলের গোছা। এক ছিটে নুন, দু’ফোঁটা তেল আর এক কাঁসি ভাতের অভাবে এমনি কত সজনে ফুলের গোছা গিয়েছে শুকিয়ে। জানি, যে শুধু করুণার জল দিয়ে ভেজাতে চায় এ বিশ্বের চিঁড়ে, সেও করুণার পাত্র। করুণা করতেও চাই নে। জানি, আমারও ‘মুরোদ বড় মান’। আমার মতো মানুষকে দান-ধ্যান করে শুধু ছেঁড়া কান-ই দেখতে হবে। জানি, তবু সমুদ্রগুপ্তের টিলার উপর এ অভাবিত সজনে ফুলের গোছাও যদি যায় শুকিয়ে, তবে নিয়ত মরুবাসের যে রসটুকু সান্ত্বনা, তাও যে হারিয়ে যাবে বিষবাষ্পে।

অনেক দ্বিধা করে হাত দিলাম পকেটে। ডাকলাম, ‘ভৈরবী!’

ভৈরবী আচমকা ঘোমটা তুলে বললো, ‘আমার নাম তো ভৈরবী নয় দাদাবাবু।’

বললাম, ‘তবে বুঝি চণ্ডিকা?’

তার উপোসী শুকনো মুখে এখনো জলের দাগ। সেই মুখে তার অপূর্ব লজ্জিত হাসি। বললো, ‘না।’

‘তবে?’

‘আমার নাম ময়লা।’ বলতে বলতে তার কালো মুখে চিরুনির মতো সাদা দাঁতের সারি ঝকমক করে উঠলো। বলেও তার এত আনন্দ, উপোসী মুখখানি ভরে উঠলো আলোয়। চমকে ভাবলাম, রহস্য নয় তো!

বললাম, ‘ময়লা? সে আবার কী?’

সে বললো, ‘আমার নাম গো! বড় যে কালো, তাই ছোটকালে নাম রেখেছিল ময়লা।’

বলার সুযোগ পেলাম। যদি কাটিয়ে ওঠা যায় গ্লানিটুকু। বললাম, ‘ময়লা কোথায়? দিব্যি ঝকঝকে দেখছি।’

কাজ করলো ওষুধটি। ময়লা হেসে উঠলো সশব্দে। তবু কী বিচিত্র! চোখের জলের দাগটুকু আছে গালে।

বললাম, ‘আমি কিন্তু আলোই বলবো।’ বলে পকেট থেকে পয়সা নিয়ে বললাম, ‘তা ভৈরবী, কিছু মনে কোর না। দেখা হয়ে গেল পথে, এইটুকুনি লাভ। আবার কে কোথায় যাব! পয়সা কটি রাখো, সজনে ফুলের চচ্চড়ি রেঁধো আজ, কেমন? ‘

কিন্তু গোলযোগ ঘটল। ভেবেছিলাম মেঘ কেটেছে। তবে যে হঠাৎ আবার তার চোখে জল! তাড়াতাড়ি আমার আসনখানি তার লাল আঁচল দিয়ে বৃথাই ঝেড়ে দিল। বৃথা, কেননা ধুলো যাবার নয়। দিয়ে ধরা গলায় বললো, ‘এট্টু বসেন।’

অপ্রস্তুত ও বিব্রত বোধ করলাম। ময়লা যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চায় তবে ভুল করেছে। পথের নিয়ম ঘরে চলে না, ঘরের নিয়ম নয় পথে। আমরা পরস্পর কৃতজ্ঞ এই পথের দেখাদেখিতে। পরমুহূর্তেই দুশ্চিন্তা হলো। বললাম, ‘ভূতানন্দ ফিরে আসবে তো?’

সে বললো, ‘আসবে না? যাইবে কমনে? দ্যান, পয়সা দ্যান।’

বলে, নিঃসঙ্কোচে হাত পাতল। দিলাম। পয়সা কটি আঁচলে বেঁধে, জল-চোখ টিপে হেসে বললো, ‘ওইরকম কয়। শোনা আমার কপাল দাদাবাবু। কিন্তু সামনে যদি থালায় কইরা কিছু দিতে পারি, তখন কালী নামে কী হাসনের ফোয়ারা, একবার দেইখ্যা যাইয়েন। সুখ বড় বেইমান। ত্যাখন সে-দুঃখর কথা মনে থাকে না। মানুষটারে চিনি তো!’ বলতে বলতে তার কালো মুখে সলজ্জ হাসি ফুটল। লজ্জিত ত্রস্ত চোখে একবার আমার দিকে চেয়ে নত করলো মুখ। বড় বিচিত্র তার এ লজ্জা-হাসিখানা। আমাকে মাঝে রেখে মনের কোন্ গোপন লীলাখেলায় লীলাবতী হয়ে উঠলো সে! বললাম, ‘কিছু বলবে?’

ভৈরবীর এত লজ্জাও ছিল! ঘাড় নেড়ে জানালে, ‘হ্যাঁ।’ তারপর তার ডাগর চোখ মেলে দিল পুবে, গাছের ফাঁকে দূর আকাশের দিকে। বললো, ‘দাদাবাবু, মানুষটার উপর রাগ করবেন না। ও-ই রকম। ছোটকাল থেইকে জানি, ও সাপুড়ে, ডাকাবুকো। আমি ঘোর বোষ্টমের মেয়া। দেখলে চোখ বুজতাম। ওই যে কইল না, তোর বাবার কেষ্টোর-ই একদিন, কি আমার-ই একদিন। আমার বাপ যে কেষ্টোভক্ত বোষ্টম তাই খোঁটা দিল। তা দাদাবাবু বোষ্টমের মেয়া, ওনার কাছ থেকে তফাতেই থাকতাম। ত্যাখন আমার ডাগর বয়স। তা ওই মানুষটি য্যাখন ত্যাখন আমার আগুপিছু ফিরত, চোরের মতো আড়ে আড়ে দেখত, চখে চখে পড়লে হেইসে বলত, ময়লা, কী বাহার তোর কালো রঙখানি। শুইনে ভয় হতো, আর কী হইত আইজও জানি না। মোকে কইত, কালী ময়লার যে রূপ আর ধরে না। ক্যান কি জানি। তারপরে, একদিন তিনো সইন্ধ্যেবেলা আড়ালে আমার হাত দুইখানি ধরে কইল, ময়লা, তোর মধ্যে যে মা কালীর অংশ রইচে লো। তোরে আমার চাই। চাই কইলেই চাওয়া? কী সাহস! ডরে মরি। কয় কী? তবু, মেয়েমানুষের মন তো! কইলাম, কী যেন মনে লইল, হেইসে হেইসে কইলাম, ওমা! ছি, আমি কালা পেঁচি, কালামুখী, মা কালীর সঙ্গে আমার কথা, খাওয়া, বসা। তিনি কইলেন, ময়লা আমার পরান। আমিও যে চখ বুজলে তাই দেখি ময়লা। তোর হাসি কথা, চখের তরাসে তুই সাক্ষাত কালী। তোরে নইলে, নিজের চিতা নিজেরে জ্বালাইতে হইবে। শোনেন কথা।..’

বলে, হেসে উঠলো ময়লা। চোখের জলে, কৈশোরের স্মৃতিতে হাসি কান্নায় কী বিচিত্ৰ রঙের ছোঁয়া লাগিয়ে দিলে সে আমার পথ-চলা-ব্যস্ত মনে! আমি জানি, উত্তর প্রদেশের এ টিলার বুকেও সে লাগিয়ে দিল ওই রঙের ছোপ।

হেসে বললো, ‘মনে মনে বুঝলাম, ময়লা, এইবার মলি। কইলাম, হুঁ, তুমি সবই দেখতে পাও। ভূত-পেরেতও নাকি দেখতে পাও! আমারে এট্টু দেখাইতে পার? কইল, ‘খুব পারি। আমি থাকবো লাটাই চণ্ডীতলায় কাল সন্দেয়, আসিস, ডরাইস্ না, দেখাইব।

গেছিলাম দাদাবাবু, সত্য কইরা আমায় ভূত দেখাইল।’

অবাক হয়ে বললাম, ‘ভূত দেখতে পেলে?

বললো, ‘হ্যাঁ দাদাবাবু।

হাসি পেল। চেপে গেলাম। অমন সহজ স্বীকৃতি ময়লা ভৈরবীর দ্বারাই বোধ হয় সম্ভব। তবু বললাম, ‘কেমন দেখলে? কী দেখলে?’

নিরাভরণ হাতখানি শূন্যে মেলে দিয়ে সে বললো, ‘কী জানি কী দেখলাম! চখ অন্ধকার, কী দেখাইল, উনি-ই জানেন! খালি বুজলাম, সোসার ওনার বশ। দেব-দেবী যক্ষ রক্ষ, সব-ই ওনার গুণবশ। আমিও বশ হইলাম। এমন বশ হইলাম, বোষ্টমের মেয়া হইয়া কালীভক্তের সঙ্গে সেই রাত্রেই লাটাই চণ্ডীতলা থেইকেই সকলের মায়া কাটাইয়া ওনার সঙ্গে বার হইয়া গেলাম। সেই থেকে ওনার-ই সঙ্গে সঙ্গে। দাদাবাবু, উনি যাইবে কমনে? এমনি কতবার গেল, কতবার আসল। যাওয়া আসা নিয়া সোসার। আর যদি ময়লা হই তোমার জীবনে, তবে ধুইয়া সাফ কইরে যাও, নইলে ময়লা কি সঙ্গ ছাড়ে!’

হাসতে গিয়ে কাঁদল। বললো, ‘তবু দাদাবাবু, আইজ আমার কী পুণ্যি গো! এখানে চাইলের বড় দাম। আলো চাইল, পঁচিশ তিরিশ টাকা মণ। তবু, ওনার সামনে সইজনে ফোলের চচ্চড়ি দিয়ে হাতপোড়া গরম ভাত দুইটে দিতে পারব, নিজেও পাইব। যা শীত! সাপের ছোবল। গতরে এট্টু যুত পাইব, কালীনামের ফোয়ারা ছোটাব। দাদাবাবু, আপনারে পেন্নাম করি।’

ছি ছি ছি, একে রক্তাম্বরী, তায় ভৈরবী! উঠে দাঁড়ালাম তাড়াতাড়ি। সেই করুণা ও কৃতজ্ঞতা। কেন? বললাম, ‘এবারে যাই।’ তবে, তারপরে আবার আবেগবশত না বলে পারলাম না, ‘আলো ভৈরবী, ময়লা ধুয়ে সাফ করার কথা বললে। ময়লা মাথায় নিয়ে তুমি কিন্তু হীরে হয়ে গেছ, ও আর ধুয়ে সাফ হবে না।’

মনে মনে বললাম, তুমি গেলেই ভূতানন্দর জগৎ অন্ধকার। ময়লা হেসে উঠলো। বললো, ‘আসবেন তো আবার দাদাবাবু?’

ফিরে দেখে বুঝলাম, ভৈরবীর চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছে। বললাম, ‘যদি পারি, আসব।’ মনে মনে বললাম, যদি না পারি, তবে এ টিলার ছবি তোমারই মূর্তি ধরে অক্ষয় হয়ে থাকবে আমার চোখে। এ অস্বচ্ছন্দ জীবনের ক্ষেত্রে, বিশেষ উন্নাসিক স্বদেশ-পরিচয়-অজ্ঞ কূপমণ্ডুক শহুরে সভ্যতার কছে সত্য অনেক সময় অসত্য ও অস্বাভাবিক। এখানে যে এমনি এক ময়লা ও ভূতানন্দর দেখা পেলাম, কিছুই নয়, তবু দেখলাম এমনি এক বিচিত্র নাটক, তো হয়ত নিজেই ভুলে যাব এই টিলা থেকে নেমে। তবু জানি, মানুষের ধর্ম, প্রেম ও ক্ষুধার এ ঘটনা অক্ষয় হয়ে থাকবে।

জানি নে, কী শুনলাম। দু’দিনে কত মানুষের সঙ্গে দেখা হলো, কত কী শুনলাম। মনের অজস্র তারে বাজল কত সুর। আধ্যাত্মের উপলব্ধি নেই। সবই মানুষের মধ্যের হেরফের বলে দেখলাম। এ-ও কি ভৈরবীর কোনো গূঢ় সত্ত্বসূত্রের বন্ধন, নাকি যা শুনলাম তা শুধু মানবমানবীর বিচিত্র প্রেমোপাখ্যান, জানি নে। তবু আমি সাধারণ। সেই সাধারণের হৃদয় তো টাবুটুবু ভরে উঠলো এই হাসি কান্নার কাহিনীতেই।

হঠাৎ কেশো গলার হাসি শুনে চমকে দাঁড়ালাম। একটি দেবদারুর আড়ালে, কপালে হাত ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে স্বয়ং ভূতবাবা! বললো, ‘চললেন, আঁজ্ঞে?’

হাসি চেপে বললাম, ‘সে কি, একেবারে এত কাছাকাছি, এখানে যে?’

কিমাশ্চর্যম! লজ্জায় ও বিনয়ে ভূতানন্দ মাটিতে মিশল যে! চোখ পিটপিট করে, গলার রুদ্রাক্ষ খুঁটে, সে এক কাণ্ড। বললো, ‘আঁজ্ঞে দেখলেন তো, সাক্ষাৎ চণ্ডীঠাকরুণ, হেঁ হেঁ।’

মানে বোধ হয়, কী করে আর তবে যাব! বললো, ‘ভৈরবী একেবারে চণ্ডাল। মায়ের চরণামিতোটুকু গেল। আবার আসবেন, মা কালীর কথা বলবো।’

কী ভাগ্যি, ভূত দেখাতে চায় নি! জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে কুপ কোথায়?’

সে বললো, ‘ওই যে পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি, ওর উঠানেই দরজা পাবেন।’

‘চলি তা হলে?’

ভূতানন্দ জোড়হাতে বললো, ‘আজ্ঞে।’তারপর ফিসফিস করে বললো, ‘রাগ দেখলেন তো? আসল ভৈরবীর ও-ই লক্ষণ অ্যাজ্ঞে, আর আমি—’

মুখখানি অন্ধকার ও করুণ হয়ে উঠলো তার। ওকে আর সান্তনা দিলাম না। এগিয়ে গেলাম। বুঝলাম, ওই রকম করুণ মুখে জোড় হাতে এবার আর-একজনের কাছে যাবার সময় হয়েছে।

বলতে কি ডিগবাজী-খাওয়া বিটলে পাখিটার মতো, খুশিতে আমার ডানা ঝটপট করে উঠল। একটা মস্ত নিশ্বাস ফেললাম। গুনগুনিয়ে উঠলো মনটি আপনি আপনি, চল চল চল হে আকাশতলে আজ সব-ই খেলা। চল চল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *