১৫
একেবারে যাবার ইচ্ছা ছিল না বলতে পারি নে। কিন্তু পরদিন সন্ধ্যাবেলায় যেতে পারলাম না। অনেক ঘোরা বাকি ছিল। এখন ঘুরে না নিলে আর হবে না। তবু ভেবেছিলান, সন্ধ্যাবেলা ঘুরে-ফিরে তারপর যাব। সন্ধ্যাবেলায় নৌকায় করে ফিরে আসছিলাম যমুনার ওপার থেকে। হঠাৎ এই মাঘের সন্ধ্যায় কালবৈশাখীর মতো চকিতে মেঘে ছেয়ে ফেললো আকাশ। ঘন ঘন বিদ্যুৎ ঝলকে ঝলকিত যমুনা। ঢেউ উঠলো তার বুকে। নৌকা দুলে উঠলো। বাতাস এলো, ঘোর হয়ে এলো অন্ধকার। ঝুসির পাড়ে নৌকা ঠেকাবার আগেই বৃষ্টি নেমে এলো, ঝোড়ো ঝাপটায়। ইচ্ছে করলো গুনগুনিয়ে উঠি—
‘উন্মাদ পবনে যমুনা তর্জিত/ঘন ঘন গর্জিত মেহ,
দমকত বিদ্যুৎ পথতরু লুণ্ঠিত/থরথর কম্পিত দেহ।’
পাড়ে যখন উঠলাম, তখন সর্বাঙ্গ সিক্ত। একে উত্তর প্রদেশের মাঘের শীত। তার উপরে জল। অসহ্য শীতে দাঁতে দাঁত, হাঁটুতে হাঁটু ঠেকে গেল। চারিদিকে সবাই ছুটছে। মানুষ ও জানোয়ার সমান তালে ছুটছে আশ্রয়ের সন্ধানে। দোকানপাট ঝাঁপ ফেলছে তাড়াতাড়ি। কোন রকমে আশ্রমে এসে উঠলাম।
সারারাত্রি প্রায় জল ঝরল। সকালবেলা শোনা গেল, কে একজন বৃদ্ধ সাধু শীতে বৃষ্টিতে বাইরে থেকে মারা গিয়েছে। হিমপ্রবাহের প্রথম শিকার। তারপরেই দারুণ অভিশাপের মতো বালুচরে নেমে এলো ভয়ংকর হিমপ্রবাহ। সারা উত্তর প্রদেশ জুড়েই এক অদৃশ্য ভল্লুক তার থাবা বসাল। ভেঙে যেতে লাগলো মেলা।
খোলা আকাশের বুকে যেসব সাধুরা আস্তানা নিয়েছিল, তারা লোটা কম্বল নিয়ে ছুটল শহরের দিকে। ঝুসির উঁচু জমির কোলে গুহা কেটে আশ্রয় নিয়েছিল যারা, তারা পালাতে লাগল। যাদের ঘর, তাঁবু ধসে ভেঙে পড়েছে, তারা বোঁচকাবুচকি নিয়ে ঘরে অভিযান করলো।
চারিদিকে শুধু পালাই পালাই রব। কোটরে কোটরে কেবল গোঙানি ও যন্ত্রণার ফোঁপানি। ভগবানের কাছে নিবেদন, আবেদন। শীতের তাণ্ডব চারিদিক ছত্রাকার করে দিল। এখন শুধু–
‘আগুন আমার ভাই,
আমি তাহারি গান গাই।’
আগুন, আগুন চাই। মানুষ বেরোয় না। শুধু উটগুলি কাঁপতে কাঁপতে আসে কাঠের বোঝা নিয়ে। এলাহাবাদের বাউন্ডুলে মেয়েপুরুষেরা কেউ বেকার রইলো না। সকলেই বনে বাদাড়ে ঘুরে কাঠ এনে বিক্রি শুরু করলো। আর নিয়ে আসতে-না-আসতে বিক্রি হয়ে যায়। একবেলা খাওয়া না জুটুক, আগুন না হলে চলবে না।
আগুন নিয়ে কাড়াকাড়ি, মারামারি। অর্থবান আশ্রমগুলি ভালো আছে। তাদের কাঠ, আগুন ও ভালো তাঁবুর অভাব নেই। সেখানে নাগারা উলঙ্গ হয়েই বেড়াচ্ছে নির্বিকারভাবে। কিন্তু অধিকাংশ গ্রাম থেকে নিয়ে আসছে কাঠ। এক টুকরো কাঠের জন্য তীর্থক্ষেত্রে কোলাহল ঝগড়ার অন্ত নেই
আমাদের আশ্রমের কাছেই গোলমাল। বেরুতে পারি নে তিন দিন ধরে। ইচ্ছে করলে বেরুনো যেত। কিন্তু এই শীতে কোথায় যাব! তার মধ্যে ভেজা ওভারকোটটি কয়েক মাসের মধ্যে শুকোবে কিনা সন্দেহ। তার ওজন হয়েছে কয়েক মাণ। গোলমাল শুনে বেরিয়ে এসে দেখি, একজন সাধুকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে দু’জন লোক। সাধুটির হাতে কয়েক টুকরো কাঠ। কী ব্যাপার? না, সাধুটি নাকি কাঠ চুরি করেছে ওই লোক দু’টির দোকান থেকে। কিন্তু সাধু কিছুতেই যাবে না। ভয়ংকর ভয়ংকর সব অভিশাপবাক্য বর্ষিত হচ্ছে তার গলা থেকে। কিছুতেই যখন যাবে না, তখন লোক দু’টি আক্রমণ করলো তাকে। সে পিঠ পেতে নিল সেই পীড়ন। তারপর বললো, ‘বেশ করেছ, মগর লকড়ি দেব না।’
দিল না। লকড়ি না, প্রাণের টুকরো কটি নিয়ে সে ফিরে গেল হাসতে হাসতে। একদিন শহরে গেলাম। ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম দেখলাম। কৌতূহল মিটল আনন্দভবন দেখে। একটু পোস্ট-অফিসে যাওয়ার দরকার ছিল। সেখানে গিয়ে দেখা এক বন্ধুর সঙ্গে। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক বন্ধু। তাঁকে আর এ কাহিনীতে টানব না। কিন্তু কদিন ধরে শুধু শহরেই যাওয়া আসা করলাম। একদিন নিমন্ত্রণ পেলাম, কেল্লার অভ্যন্তরভাগে সবকিছু দেখে নেওয়ার। সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।
গোলাপী বর্ণের আকবরের দুর্গাভ্যন্তরের সৌধটি, পাঁচিলের বেড়ার মধ্যে নির্জনে দাঁড়িয়ে আছে একলা। পাঁচিলের দরজা সারাদিন বন্ধই থাকে। কারণ ওখানে বারুদের স্তূপ নাকি ঠাসা আছে। সেখানে সাধারণ কর্মচারীদেরও প্রবেশ নিষিদ্ধ। মানুষের সঙ্গে যেন এক অতীত সৌধের অদৃশ্য মানুষেরা অবাক চোখ মেলে রইলো অলিন্দে অলিন্দে, গবাক্ষে গবাক্ষে। গবাক্ষে প্রবেশমুখে কোনো দরজা নেই। ছিল না কোনোদিন। মখমলের ভারী পর্দা ঝুলত। সেই পর্দার ফাঁক দিয়ে ঢুকত খোলা সঙ্গমের হাওয়া। বেনোয়ারি কাচের ঝাড় বাজত ঠিনিনিনি করে। এখন খোলা গবাক্ষ দরজা দিয়ে হাওয়া ঢুকে পাক খেয়ে ভিতরেই হারিয়ে যায়। আকবরের দুর্গ, দরবার বসতো একদিন এখানে। এখন পুরনো ইমারতের গন্ধে বাতাস ভারী।
বেরিয়ে এলাম। এই সৌধের পূর্বে দ্বিতীয় অট্টালিকার পেছনে জঙ্গল ও পুরনো প্রাচীর। প্রাচীরের নিচেই গঙ্গা। দেখলাম, এক জায়গায় একটি বিশাল বট। আসলের চেয়ে সুদ বেশি। বটের ঝুরি নেমে তৈরি হয়েছে আরও কতকগুলি গুঁড়ি। বটের গভীর ঝাড়ে চারদিকে হাল্কা অন্ধকার। তলায় গোবর দিয়ে সযত্নে লেপা-মোছা রয়েছে। লেখা আছে, অক্ষয়বট।
এই-ই প্রাচীন ও প্রকৃত অক্ষয়বট। কেল্লার অন্য অংশে পাতালপুরীতে অনেক দেবদেবীর সঙ্গেও রয়েছে একটি শাখাপত্রহীন বটের মোটা ডাল। পাণ্ডা বললো, ওটিই আসলে অক্ষয়বট। ইতিহাস তা বলে না। এই কৃত্রিম শাখাটি নিয়ে এক সময়ে কাগজে লেখালেখিও হয়েছিল। ওটি আসল অক্ষয়বট নয়, পাণ্ডাদের পয়সা রোজগারের সিদ্ধিবট হবে হয়তো। শ্রীশিবনাথ কাটজু, এম. এলো. এ, গবেষণা করে জানিয়েছেন, নিরালার এই ঝুরি-নামা বটটি আসল অক্ষয়বট। এর উপরে দাঁড়ালে দেখা যায় গঙ্গা-যমুনার সঙ্গম। আদিগন্ত মেলা ও তাঁবুর সমুদ্র।
একদিন, এই গাছ থেকেই সহস্ৰ সহস্ৰ হিন্দু ঝাঁপিয়ে পড়ে সঙ্গমে প্রাণ দিয়েছেন। তুলসীদাসের শ্রীরামচরিত মানসে আছে—
‘সঙ্গম সিংহাসনু সুধি সোহা।
ছত্র অক্ষয়বট মুনিমন মোহা।।
পূজহিঁ মাধব পদ জলজাতা।
পরসি অক্ষয়বট হরক্ষহি গাতা।।’
হিউ-এন-সাঙ, অলবেরুনী, আকবরের আমলের ইতিহাস-লেখক আবদুল কাদের বাদায়ুনী সকলেই লিখে ও বলে গিয়েছেন।
আর ওই দুরের চর, সঙ্গমের তীরভূমি। কোথায় কোন স্থানটিতে মাথায় রাজমুকুট নিয়ে এসে বসতেন সম্রাট হর্ষবর্ধন? কোথায় বসতো তাঁর পঞ্চবার্ষিকী মহাসভা, যেখানে, যুদ্ধের উপকরণ ছাড়া সবই বিলিয়ে দেওয়া হত দানছত্র খুলে। কিন্তু আশ্চর্য। কুম্ভমেলার ইতিহাস কোথাও নেই। কেবল লক্ষ লক্ষ নরনারী যুগযুগান্ত থেকে পাগলের মতো ছুটে এসেছে, এখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সঙ্গমে। কেউ বলেন, শঙ্করাচার্য এ মেলার প্রতিষ্ঠাতা। কতখানি সত্য তা জানি নে। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, শঙ্করাচার্য তাঁর প্রচারমঠ করেছিলেন চার জায়গায়। শৃঙ্গগিরিতে শৃঙ্গগিরি মঠ, দ্বারকায় সারদা মঠ, শ্রীক্ষেত্রে গোবর্ধন ও বদরিকাশ্রম অঞ্চলে যোশীমঠ। প্রয়াগের উল্লেখ তো দেখি নে!
ইতিহাসই যখন এলো, তখন শঙ্করাচার্যের কথা আর-একটু বলি। সে ইতিহাস একটু রাজনীতি-ঘেঁষা। এগারো শো বছর আগে আরব সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে তখন ইসলাম ধর্মপ্রচারকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে ভারতের দক্ষিণ সৈকতে। ধর্মপ্রচারের নামে, ওটা রাজ্য দখলের ফিকির বলা যায়। আর হিন্দু নিম্নবর্ণের মানুষেরা তখন বর্ণহিন্দুদের দ্বারা এমন ভয়াবহভাবে নির্যাতিত যে, তারা দলে দলে মুসলমান হতে আরম্ভ করলো। মন্দিরে প্রবেশাধিকার তো দূরের কথা, ভগবানকে ডাকবারই অধিকার নেই। ইসলাম ধর্ম উদার মূর্তি ধরে দিল দেখা। রাজায় প্রজায় একসঙ্গে বসে প্রার্থনা করলেও ভগবান অসন্তুষ্ট নন। তখন শঙ্করাচার্য ব্যাপার দেখে ধর্মকে ভেঙে গড়লেন। ইসলাম এক? হিন্দুর ভগবানও এক। উৎপত্তি হলো শঙ্করাচার্যের কেবলাদ্বৈতবাদ। নির্গুণ উপাসনা। এ ধর্মান্দোলনে তখন প্রগতিশীলতার গন্ধ ছিল। আজকে অনেকখানি মূল্যহীন। তবু আজকের ভারতকে অস্পৃশ্যতাবিরোধী অভিযান করতে হয়।
এই আমলেও হয়তো সহস্র সহস্র মানুষ এসেছে কুম্ভমেলায়। ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ দিয়েছে।
আজও আসে, এখনো আসে। আমার মতো কত মানুষ এসেছে, কত মানুষ দেখেছে। তবু ভাবি, সেদিনও কি এমনি বিচিত্রের মেলা বসতো! এমনি সব বিচিত্র নরনারী আসত তাদের হাসি ও চোখের জল নিয়ে! হয়তো আসতো, এর চেয়েও বিচিত্রতর ছিল তাদের হৃদয়লীলা।